কবি আল মাহমুদের জন্মদিন উপলক্ষে ব্যাপক কর্মসূচি
কালজয়ী কবিতার স্রষ্টা আল মাহমুদের ৮৭তম জন্মদিনে আল মাহমুদ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে দেশ-বিদেশে ব্যাপক কর্মসূচি শুরু হয়েছে।
সোমবার (১১ জুলাই) পবিত্র কোরআন খতম ও মোনাজাতের মাধ্যমে এই কর্মসূচির সূচনা হয়। ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সময় সম্পাদক কবি ও কথাসাহিত্যিক সাঈদ চৌধুরী লন্ডনের সেভেন কিংয়ে অনুষ্ঠিত কোরআন তেলাওয়াত এবং মোনাজাতে অংশ গ্রহণ করেন। মোনাজত পরিচালনা করেন মাওলানা মাসুম আহমদ। মহান আল্লাহর কাছে প্রিয় কবির জান্নাতুল ফেরদৌস কামনা করেন উপস্থিত কবি প্রেমিক ও মুসল্লিগণ। একজন মুক্তিযোদ্ধা কবি হিসেবে তাকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদানের জন্য রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছেন প্রবাসী জনতা।
কর্মসূচির অংশ হিসেবে আগামী ছয় মাসে বৃটিশ লাইব্রেরিসহ কয়েকটি খ্যাতিমান লাইব্রেরি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য ও গবেষণা বিভাগে আল মাহমুদের রচনা সমগ্র প্রদান করা হবে। এছাড়া আল মাহমুদকে নিয়ে আলোচনা ও বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত লেখা সমূহ ফাউন্ডেশনের ফেসবুক পেইজ এবং হোয়াটসঅ্যাপ ও ইমেইলে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশিদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। এজন্য দেশ-বিদেশের লক্ষাধিক ডাটা আপডেট করা হয়েছে।
কবি আল মাহমুদকে নিয়ে যারা গবেষণা করছেন, বিশেষ করে পিএইচডি করেছেন তাদের জন্য আগামী জন্মদিন থেকে বিশেষ এওয়ার্ড প্রদানের প্রস্তুতি নিচ্ছে আল মাহমুদ ফাউন্ডেশন। এ উপলক্ষে বাছাইকৃত লেখাসমূহ নিয়ে গ্রন্থ প্রকাশ করা হবে।
আজকের অনুষ্ঠানে মানবিকতা ও সাম্যবাদের কবি আল মাহমুদকে ব্যাপকভাবে অধ্যয়ন ও তার মাগফিরাতের জন্য দেশ-বিদেশের সকল পাঠকের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়। এসময় স্মৃতিচারণ করে সাঈদ চৌধুরী বলেন, বাংলা সাহিত্যে অসংখ্য কালজয়ী কবিতার স্রষ্টা আল মাহমুদ। বাংলা কবিতাকে গৌরবোজ্জ্বল অবস্থানে নিয়ে এসেছেন তিনি। আমাদের কবিতায় যে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার উন্মেষ ঘটেছে তিনিই তার নায়ক। আল মাহমুদ ছিলেন একাধারে কবি, সাংবাদিক. ঔপন্যাসিক, ছোটগল্প লেখক, প্রাবন্ধিক ও শিশুসাহিত্যিক। দুই বাংলার অপরাজেয় এই কবির জন্ম ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই। কবির বাবা মীর আবদুর রব। মা রওশন আরা মীর। স্ত্রী সৈয়দা নাদিরা বেগম। ব্যক্তিজীবনে পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ের জনক তিনি। তার প্রকৃত নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ।
স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য আল মাহমুদের কবিতা। দেশ-বিদেশে তাকে নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানের কবিতা, গল্প, উপন্যাস এবং শিশু সাহিত্য নিয়ে আল মাহমুদের বইয়ের সংখ্যা দেড় শতাধিক। নির্বাচিত কবিতা ও গল্প সমগ্রও পাঠকের হৃদয় ছুঁয়েছে। মোট ১৩ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে ‘আল মাহমুদ রচনাবলি’। প্রথম কবিতার বই ‘লোক লোকান্তর’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে এবং ‘কালের কলস’ ও ‘সোনালি কাবিন’ ১৯৬৬ সালে। কবি তার সোনালি কাবিনে নদীর মতো কবিতার ঢেউয়ে প্রবাহিত রোমাঞ্চকর অনুভূতি প্রকাশ করেছেন সনেট ছন্দের মেলবন্ধনে। চিত্রকল্পে আত্মিকতার দারুণ খোরাক জুগিয়েছেন পাঠক মহলে। এই গ্রন্থই তাকে নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়। আল মাহমুদের ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’, ‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না’, ‘একচক্ষু হরিণ’, ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’ ও ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ কালজয়ী কাব্যগ্রন্থ। ‘কাবিলের বোন’, ‘উপমহাদেশ’, ‘ডাহুকি’, ‘আগুনের মেয়ে’, ‘চতুরঙ্গ’ ও ‘পোড়ামাটির জোড়া হাঁস’ ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। ‘পানকৌড়ির রক্ত’সহ বেশ কিছু গল্পগ্রন্থও রচনা করেছেন তিনি।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের লিফলেটে কবিতা ছাপার কারণে ফেরারি হওয়া আল মাহমুদ একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামে মুজিবনগর সরকারের স্টাফ হিসেবে কাজ করেছেন, যুক্ত ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাথেও। প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতায় রচনা করেছেন কালজয়ী দু’টি উপন্যাস ‘কাবিলের বোন’ ও ‘উপমহাদেশ’। ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’ ও ‘বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ’ আল মাহমুদের সাড়া জাগানো আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ। তৎকালীন দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক কবি আল মাহমুদ এক সময় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতেও কাজ করেছেন। সেখানে পরিচালক হিসেবে অবসর নিয়েছেন।
সৃজনশীল সাহিত্য রচনার জন্য আল মাহমুদ অসংখ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৮), জয়বাংলা পুরস্কার (১৯৭২), হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৪), ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৬), একুশে পদক (১৯৮৭), নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক (১৯৯০), সমান্তরাল (ভারত) কর্তৃক ভানুসিংহ সম্মাননা পদক-২০০৪ উল্লেখযোগ্য।
অনুষ্ঠানে আল মাহমুদকে নিবেদিত সাঈদ চৌধুরীর কবিতা ‘রুপালি আলোয়' আবৃত্তি করা হয়। ‘তুমি এলে আগুনের ফুলকির মতো/ রৌদ্র কিরণে ঝলসিত চারিদিক/ উচ্ছ্বাস আনন্দ ছড়িয়ে মুখরিত/ ছেলেবুড়ো আনন্দে দিক-বিদিক।/ উনুনের ধার ঘেঁষে দাই মা/ আয়াতুল কুরছি পড়ে/ আগুনের আঁচে বসে তা দেয়/ সফেদ কাপড়ের ভাজে, জিন-ভূত/ যেন আসেনা ঘরে।/ ছায়ারৌদ্র মেঘের খেলা/ বনশ্রী প্রফুল্ল হয়ে ওঠে/ দীপ্ত রাঙ্গা উদয়ের বেলা।/ গ্রীষ্মের দাবদাহ মুছে যায়/ সোনার রবি ছড়ায় কিরণ/ মরু মুষিকের উপত্যকা’য়।/ যেভাবে বেড়ে ওঠি প্রাণের স্পন্দনে/ জ্যোতিস্রোতে মিশেছে প্রিয় স্বদেশ/ জীবন্ত মুক্তিসংগ্রামে কাবিলের বোন/ স্বাধীনতার স্বপ্ন জাল বোনে উপমহাদেশ।/ কবির আত্মবিশ্বাস কবির কররেখা/ আগুনের মেয়ে অর্ধেক মানবী/ নিশিন্দা নারী যতই হোক দেখা।/ কবির সৃজন বেদনা কবিতার আঁচল/ দশ দিগন্তে উড়াল ডাহুকী দিনযাপন/ কবিতার জন্য বহুদূর কবি ও কোলাহল।/ তুমি, আরব্যরজনীর রাজহাস/ আমি, দূরগামী/ প্রহরান্তের পাশ ফেরা এক চক্ষু হরিণ/ পাখির কাছে ফুলের কাছে/ কালের কলস- কিরণ ছড়ায়।/ তুমি, সোনালি কাবিন/ মায়াবী পর্দা দুল ওঠো/ বখতিয়ারের ঘোড়া’য়।/ তুমি, অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না/ প্রহরান্তের পাশফেরা, দোয়েল ও দায়িতা/ লোক লোকান্তর- বিদ্যুৎ চমকায়।/ তোমার ভরাট গলার সুকন্ঠ উচ্চারণ/ মেঘমালা হয়ে উড়ছে হাওয়ায়/ শ্যামল শ্যামল নীলিমায়।/ সৌরভসিক্ত আল মাহমুদ/ বাংলাভাষা হয় গতিময়/ তোমার দৃপ্ত রুপালি আলোয়।’
কিংবদন্তি এই কবি ২০১৯ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি ইন্তেকাল করেন। আধুনিক বাংলা কবিতার এই মহান স্রষ্টাকে তার জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে সর্বত্র। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এবং আল মাহমুদ এক ও অভিন্ন। আল মাহমুদের এই রচনা সম্ভার বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেবার প্রত্যয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে আল মাহমুদ ফাউন্ডেশন। এছাড়া বাংলা ভাষার বরেণ্য লেখকদের সাহিত্য সম্ভার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সেগুলোর বিশ্বমানের অনুবাদ, একাডেমিক আলোচনা, সাংগঠনিক সংযোগ ও পেশাদারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে আল মাহমুদ ফাউন্ডেশন। বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রধান কবি আল মাহমুদকে নতুন প্রজন্ম ও আন্তর্জাতিক লেখকদের সামনে যথার্থভাবে উপস্থাপন করতে এবং তার সাহিত্যকে উপভোগ, শিক্ষা এবং গবেষণার জন্য অ্যাক্সেসযোগ্য করে তুলতে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ।