রাঁচিতে নজরুলের স্মৃতিতীর্থে ছায়ানট
অনন্য প্রতিভা কবি কাজী নজরুল ইসলামের বর্ণময় জীবনের একটি করুণ অধ্যায়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের রাঁচি শহরের নাম। রাঁচি একদা অবিভক্ত বিহারের অংশ ছিল এবং শহরটি পশ্চিমবঙ্গের সীমানা-সংলগ্ন। রাঁচিতে বাঙালিদের একটি বড় ও সমৃদ্ধ বসতি ছিল। ছিল কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। অসুস্থ নজরুল রাঁচিতে ছিলেন কিছুদিন। তাছাড়া তিনি সুস্থাবস্থায় রাঁচিতে হুড্রু জলপ্রপাতের আশেপাশের নৈসর্গিক পরিবেশ উপভোগ করেছিলেন সপরিবারে।
এবছর নজরুলের স্মৃতিধন্য রাঁচিতে পালিত হয়েছে একটি অনুষ্ঠান। দিনটি ছিল ২২ জুলাই (শুক্রবার) বিশ্ব মস্তিষ্ক দিবস। এদিন রাঁচির সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব সাইকায়াট্রি (সিআইপি) এবং কলকাতার নজরুল চর্চা কেন্দ্র ছায়ানট যৌথভাবে আয়োজন করে একটি ভিন্নধারার অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয় CIP-এর R.B.Davis অডিটোরিয়ামে। এতে রাঁচিতে কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতি আলোচনা এবং কবির অমর 'বিদ্রোহী' কবিতা প্রকাশের শতবর্ষে কবির প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য জ্ঞাপন করা হয়।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটির পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন ছায়ানটের (কলকাতা) সভাপতি সোমঋতা মল্লিক। বাংলা ছাড়া হিন্দি, ইংরেজি এবং উর্দুতেও কাজী নজরুল ইসলামের অনূদিত কবিতা শোনা যায় অনুষ্ঠানে। গাওয়া হয় নজরুলের বিভিন্ন আঙ্গিকের গান। পরিবেশনায় ছিলেন ছায়ানটের শিল্পীবৃন্দ।
সিআইপির পক্ষ থেকে ডিরেক্টর ডা. বাসুদেব দাস (সাইকায়াট্রি), অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ডা. দীপাঞ্জন ভট্টাচার্য্য (প্রধান,সাইকায়াট্রি সোশাল ওয়ার্ক) এবং ডা. অবিনাশ শর্মা (অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার-ইন-চার্জ) এই অনুষ্ঠানটির পরিকল্পনায় বিশেষ ভূমিকা রাখেন। শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নয়, এই বিশেষ দিনে মস্তিষ্কের সুস্থতায় মিউজিক এবং আর্ট থেরাপির ভূমিকা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেন রাঁচির বিশিষ্ট নিউরোলজিস্ট ডা. উজ্জ্বল রায়।
উল্লেখ্য, সুস্থাবস্থায় কবি নজরুল বেশ কয়েকবার রাঁচিতে সপরিবারে গিয়েছিলেন, তার প্রমাণ স্বরূপ পাওয়া যায় বেশ কিছু আলোকচিত্র।
>> রাঁচির হুড্রু জলপ্রপাতের পাদদেশে দুই পুত্র-কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধর সঙ্গে কাজী নজরুল ইসলামের ছবিটি বিশেষভাবে জনপ্রিয়।
>> রাঁচির হুড্রু জলপ্রপাতে পুত্র বুলবুলকে কোলে নিয়ে প্রমীলা দেবী।
>> রাঁচিতে বাড়ির সামনে নজরুলের ক্রাইসলার গাড়ি। গাড়ির খুদে আরেহীদের মধ্যে রয়েছে দুই পুত্র অনিরুদ্ধ-সব্যসাচী। দূরে চায়ের পেয়ালা হাতে নজরুল এই দৃশ্য উপভোগ করছেন।
এসব তথ্য রয়েছে কল্যাণী কাজী সম্পাদিত 'Nazrul, The Poet Remembered' গ্রন্থে।
প্রসঙ্গত বলা যায় যে, ১৯৫২ সালের ২৭ জুন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে কলকাতার বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের উদ্যোগে নজরুলের চিকিৎসাকল্পে 'নজরুল নিরাময় সমিতি' গঠিত হয়। কমিটির সভাপতি করা হয় অতুল গুপ্তকে এবং সাধারণ সম্পাদক করা হয় কাজী আবদুল ওদুদকে। যুগ্ম সম্পাদক হন সজনীকান্ত দাস ও সুফী জুলফিকার হায়দার। সদস্য ছিলেন: সৈয়দ বদরুদ্দোজা, এ এফ রহমান, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, হুমায়ুন কবীর প্রমুখ।
এই সমিতির উদ্যোগে ২৫ জুলাই, ১৯৫২ সালে নজরুলকে চিকিৎসার জন্য রাঁচির মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। সঙ্গে ছিলেন প্রমীলা নজরুল। শেখ দরবার আলমের লেখা 'নজরুল জীবন ও পালিতা কন্যার স্মৃতিকথা' থেকে জানা যায় রাঁচি সম্পর্কিত বেশ কিছু তথ্য। বইটিতে কাজী নজরুল ইসলামের পালিতা কন্যা শ্রীমতী শান্তিলতা দেবী জানিয়েছেন, সুস্থাবস্থায় কবি রাঁচি বহুবার গেছেন। রাঁচিতে হিনো হাউসে দু-তিনবার থেকেছেন সুস্থাবস্থায়। শেষবার হিনো হাউস থেকে 'লালপুর' বলে একটা বাড়িতে উঠেছিলেন কবি। অসুস্থাবস্থায় রাঁচি মানসিক হাসপাতালে গিয়ে কবি ইউরোপিয়ান কটেজে ছিলেন একবছরের-ও বেশি। সঙ্গে আমার মেয়ে ছিলেন সেখানে। হাসপাতালে আমি বহুবার গেছি। ওখানে কবির চিকিৎসা হয়েছিল ভালো। সাহেব ডাক্তাররা কবিকে যত্ন নিয়ে দেখতেন। ওখানে কবির যত্ন-আত্যি হয়েছিলো ভালো।
যদিও শান্তিলতা দেবী বলেছেন, কবি ইউরোপিয়ান কটেজে ছিলেন একবছরের-ও বেশি, তথাপি বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায় যে, অধ্যক্ষ মেজর ডেভিস রোগ নির্ণয়ে অপারগ হন। চারমাস চিকিৎসার পর অবস্থা অপরিবর্তিত থাকায় তারা কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন।
১৯৫৩ সালের ১০ মে নিরাময় সমিতির উদ্যোগে উন্নত চিকিৎসার জন্য নজরুল, অনিরুদ্ধ ও স্বেচ্ছাসেবক মিস ললিতা ঘোষকে নিয়ে নিরাময় সমিতির সহ-সম্পাদক ডা. রফিকউদ্দীন আহমদ 'জল আজাদ' জাহাজযোগে লন্ডনের পথে যাত্রা করেন। প্রখ্যাত নিউরো সার্জেন ডা. অশোক বাগচীও কবির সফরসঙ্গী ছিলেন।
বর্তমানে রাঁচিতে বসবাসরত শ্রী পার্থসারথি গোস্বামীর কাছ থেকে নজরুল স্মৃতিবিজড়িত Hinoo House সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। Hinoo House-এর বর্তমান অবস্থার রূপকার তিনি। তার কাছ থেকে জানা যায়, Hinoo House নামটি নজরুলেরই দেওয়া। তাই তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এখনও এই বাড়ির ফলকে এই নামটি শোভা পায়।
কাজী নজরুল ইসলামের কনিষ্ঠ পুত্রবধূ শ্রীমতী কল্যাণী কাজী সম্পাদিত 'Nazrul, The Poet Remembered' বইটিতে অসুস্থাবস্থায় রাঁচিতে অবস্থানকালে নজরুলের একটি আলোকচিত্র পাওয়া যায়, সঙ্গে তথ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১৯৫২ সালে রাঁচির রাস্তায় বড় ভাই সাহেবজানের ছেলে আবদুস্ সালামের (হাঁদু) সঙ্গে সাইকেল রিকশায় নজরুল, তখন নজরুলকে রাঁচিতে ইউরোপীয়ান মেন্টাল হসপিটালের ৩নং কটেজে রাখা হয়েছিল চিকিৎসার জন্য। এই তথ্যের উপর নির্ভর করেই বর্তমানে সিআইপিতে ৩নং কটেজ খোঁজার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু বহু বছর অতিক্রান্ত হয়েছে, পাল্টে গেছে অনেক কিছুই। তাই সিআইপির কর্তৃপক্ষের মতে, হয়তো বর্তমান যে ৩নং কটেজ, সেই কটেজেই ছিলেন নজরুল।
রাঁচির বিশিষ্ট বাঙালি গোপাল চন্দ্র লালা 'আমার চোখে ইউনিয়ন ক্লাব ও লাইব্রেরি' শীর্ষক লেখায় লিখেছেন, সন, তারিখ সব বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে, কিন্তু কিছু ঘটনা উল্লেখযোগ্য। কাজী নজরুল যখন রাঁচির মানসিক আরোগ্যালয়ে, এই ক্লাবের বহু সদস্য শ্রী যদুগোপাল মুখার্জীর নেতৃত্বে কবির জন্মদিনে তাকে সম্বর্ধনা জানাতে যান। আমারও সুযোগ হয়েছিল তার চরণ বন্দনার। স্মৃতির বিলোপে তিনি তখন খুবই কাতর। যে গতি-প্রাণতা তাকে দুর্বার করে রেখেছিল সেটাই এখন নিস্তেজ। গতির সঙ্গে গতের এই মেলবন্ধনও বোধ হয় জীবনেরই আর এক নিগূঢ় নিয়ম।
রাঁচিতে নজরুলকে চিকিৎসারত অবস্থায় দেখেছেন এরকম মানুষেরাও আজ জীবনের শেষ লগ্নে উপস্থিত। এখনও তাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে নজরুলের সেই নির্বাক, ভাবলেশহীন মুখখানি। তাদের অনেকের সঙ্গে ছায়ানট সদস্যরা কথা বলেন। সংগ্রহ করেন নজরুল জীবনের অমূল্য স্মৃতি। নজরুল স্মৃতিতীর্থ রাঁচিতে মহান কবির স্মৃতিচিহ্ন অন্বেষণে কলকাতার নজরুল চর্চা কেন্দ্র ছায়ানট প্রচেষ্টা নজরুল গবেষণায় নতুন মাত্রা যুক্ত করবে নিঃসন্দেহে।