ধারাবাহিক উপন্যাস 'রংধনু'-৮
[অষ্টম কিস্তি]
“এই ছবিতে তুমি যে ঘাসের ওপর থেকে রংধনু শুরু করলে, কী করে তা বাস্তবের কাছাকাছি হবে?”
ম্যারির প্রশ্ন শুনে পল্লবী মাথা ঝুঁকিয়ে তার হাতের পেনসিলটা কাগজে এলোমেলো ঘষতে থাকে। কোনো উত্তর দেয় না। ক্যাম্পাসে পড়তে আসা দক্ষিণ এশীয় তরুণীটির দিকে অপলক চেয়ে থাকেন ম্যারি। পল্লবী মাথা ঝুঁকিয়ে রেখেই একসময় বিড়বিড় করে, “আমি তো কখনো সত্যিকারের রংধনু দেখিনি!”
ম্যারি চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রায় অর্ধস্ফুটে বলেন, “বুঝেছি। তবে আর কী।”
কথাটা বলে ম্যারি নিজের মনে ভাবলেন, মেয়েটিকে এভাবে বলা ঠিক হয় নি। পল্লবী আহত হতে পারে কিংবা তার মধ্যে না-পারার হতাশা আসতে পারে। এটা ঠিক কাজ নয়। শিক্ষার্থীর গুণ জাগ্রত করা তার দায়িত্ব। কোনো কিছু করার এবং পারার পথ দেখানো কর্তব্য। না-পারার বিষয়গুলো মনে করিয়ে তাকে আটকে দেওয়া মোটেও ঠিক হয় নি।
নিজের ভুল বুঝতে পেরে পল্লবীর পাশে বসে হাসতে হাসতে ম্যারি বলেন, “সব সময় বাস্তবকে হুবহু আঁকার দরকার নেই। দেখা জিনিস হুবহু আঁকতে নেই। স্বপ্ন, কল্পনা আর ইচ্ছে মিশিয়ে আঁকতে হয়। তবেই সেটা তোমার একান্ত নিজের সৃষ্টি হবে।”
পল্লবীর ঠোঁটের কোণ বেঁকে উঠতে উঠতেও ফের স্বাভাবিক হয়ে যায়। তার খুশির সঙ্গে শোনা যায় হাতের চুড়ির রিনিঠিনি শব্দ। ম্যারি সন্তর্পণে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেন।
অন্য ছেলেমেয়েগুলোর ড্রয়িং খাতা চেক করে ম্যারি খানিকটা আশাহত হন। কিন্তু তিনি সেটা নিজের মনেই লুকিয়ে রাখেন। এদের দোষ দেওয়ার কিছু নেই। সত্যি সত্যি রংধনু তারা দেখে নি। বইয়ে দেখা কিংবা ইউটিউবের রংধনু দেখে দেখে যতটুকু আঁকতে পেরেছে, সেটাই বেশি।
একটি বিষয় দেখে ম্যারি খুবই বিস্মিত হন। রংধনু পৃথিবীর সর্বত্র একই রকম হবে, এটাই বিজ্ঞানের সূত্র। কিন্তু ছেলেমেয়েদের রংধনুতে তেমন ছাপ নেই। আফ্রিকা থেকে আসা সারাহ রংধনু এঁকেছে কালচে আকাশের প্রেক্ষাপটে। চীনের ছেলে লি লালচে আকাশের পটভূমিতে যে রংধনু চিত্রিত করেছে, তাতে সাতটি রঙ স্পষ্টভাবে খোলে নি। ম্যারি টের পান, সবার মনে আলাদা আলাদা আকাশ, যা তারা কল্পনা করেছে নিজের দেশ ও পরিবেশের প্রভাবে। তাই পল্লবীকে আলাদাভাবে দোষ দেওয়া ঠিক নয়। তার রংধনু তারই নিজস্ব পরিবেশ ও অনুভূতির ফসল, যা তিনি এই প্রথম একেকজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে একেক রকমের দেখলেন। রংধনু অভিন্ন হলেও মানুষের মন আর কল্পনা যে সেটাকে আলাদা অবয়ব দিয়েছে, সেটা দিব্যি প্রকাশ পায় ম্যারির কাছে।
ড্রয়িং খাতাগুলো নিয়ে কোনো নেতিবাচক মন্তব্য করা থেকে বিরত রইলেন ম্যারি। সবাইকে একটিই কমেন্ট করলেন তিনি, “গুড ওয়ার্ক, ট্রাই এগেইন।”
ম্যারি কিন্তু ঠিকই টের পান, ছেলেমেয়েগুলোর কাজে অবচেতনভাবে একটি বার্তাই ভেসে ওঠে, তা আসলে তাদেরই সঙ্কুল পরিস্থিতির প্রতিফলন। যে কারণে তাদের ছবির আকাশগুলো বদলে গিয়েছে। কোনও একটি হয়েছে কালচে, কিছু লালচে কিংবা পিঙ্গল। চোখের সামনের আর্থসামাজিক বাস্তবতাই তাদের অনুভতি ছুঁয়ে ভিসুয়াল রিপ্রেজ়েন্টেশনের গভীরে বিশেষ ভাবে নিহিত রয়েছে। উত্তাল পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে যার জন্ম, তার ছবির আত্মদর্শী চৈতন্যের মধ্যে সেই বীজমন্ত্র লুক্কায়িত থাকবেই।
চিত্রকর্ম বোঝার ও বিশ্লেষণের আলাদা চোখ আছে ম্যারির। কারণ, একসময় ম্যারি নিজেই ছিলেন ক্যাম্পাসের চলমান শিল্প আন্দোলনের অন্যতম হোতা। শিল্পকে মানুষের দরবারে পৌঁছে দেওয়ার সেই অবিরত প্রচেষ্টার ফসল তুলেছিলেন তিনি আর তার সঙ্গে এক জেদি যুবক, ক্যাভিন। তাদের চাঞ্চল্যে ক্যাম্পাসের গথিক স্থাপত্যের গম্বুজওয়ালা ভবনগুলো ছুটির দিনের বৈকালিক আড্ডায় গমগম করত। এক শিল্পশোভিত ক্যাম্পাসের উদ্ভাস হতো কবি-সাহিত্যিক-চিত্রকর-ভাস্কর-গায়ক-সমালোচক-সম্পাদকদের ভিড়ে। সঙ্গে থাকতো আর্ট, পত্রপত্রিকা ও বই বিষয়ক আড্ডা। চলতো আবৃত্তি, কবিতাপাঠ, গান ও গল্পপাঠের মশগুল আসর।
প্রায়ই মহান শিল্পীদের ছবির প্রদর্শনী, নতুন উদীয়মান শিল্পীদের কাজ সংগ্রহ, মার্কিন দেশের লিথো প্রেসগুলোর সন্ধান, পুরনো ছাপচিত্রের খোঁজে অহর্নিশ অন্বেষণ ইত্যাদি ছিল তার যাপনের অবিচ্ছেদ অংশ। শিল্প ইতিহাসের সন্ধিক্ষণ তখন থেকেই তাঁর অবচেতনে তৈরি করে ফেলেছিল চিত্রকর্মের এক মহার্ঘ মিউজ়িয়াম।
একবার অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের সহায়তায় তিনটি কক্ষ নিয়ে ম্যারির কাজগুলোর একটি প্রদর্শনীর পরিকল্পনা ও আয়োজন করেছিল তাঁরই সাথী ও বন্ধুসম ক্যাভিন। প্রায় দেড়শোটি নানা মাধ্যমের কাজ ও বিবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষার সে এক মহাযজ্ঞ! এই উপলক্ষে তাঁর শিল্প নিয়েই একটি ডকু-ফিল্ম রিলিজ় করে বন্ধুরা। সমালোচকরা বলেছিলেন, অভিনবত্বে একটি আলাদা মাত্রার সংযোজন ঘটেছে ম্যারির কাজে। যেন রূপবন্ধ নতুন ভাবে পুনর্বিন্যাসের ফলে সিম্ফনি ও স্টাইল, বক্তব্য ও বর্ণনা, কম্পোজ়িশন ও ক্যাজ়ুয়ালিটি, মেসেজ ও মেটাফর একে অপরের পরিপূরক হয়ে প্রকাশিত হয়েছে ম্যারির আঁকা ছবিগুলোর পরতে পরতে।
হবে না কেন? ড্রয়িং, ছাপচিত্রের রঙিন পুনর্নির্মাণ, জলরং, ইঙ্ক, তেলরং, গ্রাফিক্স, মিশ্র মাধ্যম, রঙিন পেন্সিল, উডকাট, লিনোকাট, সেরিগ্রাফ, নিউজ পেপার ম্যাটে মিশ্র মাধ্যম, অ্যাক্রিলিক, এচিং, ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য— কী করেননি ম্যারি? শিল্পের যাবতীয় নিরীক্ষায় সৌন্দর্যের সবগুলো পথ পেরিয়ে এসেছেন তিনি। তারপর এক সময় নিঃসঙ্গ ও একেলা হয়ে পড়েছেন নিজেরই অজান্তে।
রংধনু নিয়ে অ্যাসাইনমেন্টে ব্যস্ত ছেলেমেয়েদের ছবিগুলোর সঙ্গে মেতে ম্যারির চাপা-শিল্পীসত্তা গুপ্ত লাভাস্রোতের মতো বের হয়ে এলো। সবাই চলে যাওয়ার পর তিনি আলাদাভাবে পল্লবীকে নিয়ে বসলেন। মেয়েটির সঙ্গে তিনি একটি অদ্ভুত নিবিড়তা অনুভব করেন। সবার চেয়ে বেশি সখ্যতাও তিনি বোধ করেন পূর্বদেশের এই মেয়েটির সঙ্গে। ঘরবাড়ি ছেড়ে মার্কিন দেশের ক্যাম্পাসে পড়তে আসা বেশকিছু ছেলেমেয়ের মধ্যে পল্লবী নামের এই তরুণীর জন্য কেন ম্যারি অনেক বেশি নৈকট্য অনুভব করেন, তা তিনি নিজেও ঠিকঠিক জানেন না। এই মেয়েটি পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে নানা বিষয়ে তার সঙ্গে এসে কথা বলে। তার প্রশ্নের ধরণ, জিজ্ঞাসার তীব্রতা ও কথা বলার আন্তরিক সুর ম্যারিকে মুগ্ধ করে। প্রাচ্য দেশের সংস্কৃতিতে বড় হওয়া মেয়েটির মধ্যে অপার কৌতূহল। গান শুনতে আর বই পড়তেও ভীষণ ভালোবাসে সে। ম্যারি প্রায়ই তাকে একমনে লাইব্রেরিতে পড়তে দেখে। বিচিত্র সব বই ইস্যু করে পড়ার জন্য বেছে নেয় পল্লবী। জানাশোনা কিছুটা গভীর হলে পল্লবী কিছু গান প্রেজেন্ট করে ম্যারিকে। গানের কথাগুলো বাংলায় কিন্তু সুর হৃদয়-ছোঁয়া। বিশেষ করে একটি গান ম্যারিকে আচ্ছন্ন করে প্রবলভাবে। গানটির প্রথম লাইন “তোমারও পরাণ যাহা চায়।”
ম্যারি একবার জিজ্ঞেস করেছিল পল্লবীকে, “এতোজন থাকতে তুমি আমাকে তোমার দেশের তোমার ভাষার গান উপহার দিলে কেন?”
“তোমাকে খুব দুখী ও বিষণ্ন মনে হয় আমার। গানগুলো শুনলে তোমার ভালো লাগবে।” কালবিলম্ব না করেই জানিয়েছিল পল্লবী।
ম্যারি ভীষণ অবাক হন। তারুণ্য ও যৌবনের সন্ধিক্ষণের সঙ্কুল পরিস্থিতিতে রয়েছে এই মেয়ে। অথচ কেমন করে তার মনের গভীরে ডুব দিয়েছে মেয়েটি। অলক্ষ্যে আপন হয়ে যাওয়া এমন একটি মেয়েকে মন থেকে ভালো না বেসে পারেন না ম্যারি।
এসব কথা ভাবতে ভাবতে ম্যারি বাস্তবে ফিরে আসেন। পল্লবীর আঁকার সরঞ্জাম গুছিয়ে দিতে দিতে বলেন, “তোমার যেমন ইচ্ছে হয়, তেমনভাবেই আঁকো তোমার রংধনু। আমি সেই ছবির নাম দেবো ‘পল্লবীর রংধনু’।"
উচ্ছ্বল ঝরণার মতো আনন্দে উজ্জ্বল হয় পল্লবীর সমস্ত মুখমণ্ডল। পল্লবী হাসতে হাসতে উঠে পড়ে। আঁকার খাতা আর রঙের বাক্স দু’হাতে নিয়ে সে রওনা দেয় নিজের হোস্টেলের দিকে। যেতে যেতে বলে,
“মিস, আমি তোমাকে একটা চমৎকার রংধনু উপহার দেবো, যা আমি শুধু তোমার কথা ভেবে আঁকবো। আমি নিশ্চিত, তুমি খুবই পছন্দ করবে আমার রংধনু।”
পল্লবীর চলে যাওয়া দেখতে দেখতে ম্যারি একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। পথের শেষে অদৃশ পল্লবীর ছায়াও আর নেই। সেখানে মনে হয় আবছায়ায় দেখা যাচ্ছে ক্যাভিনকে, যে লোকটি জীবনে প্রথম তাকে রংধনুর রঙের অরণ্যে পাগল করেছিল। ম্যারি তার একান্ত ভাবনায় ছেদ টেনে আকাশের দূর দিগন্তে তাকান। তারপর নিজেকে কিছুটা ঘুরিয়ে পশ্চিম আকাশে দৃষ্টি দেন তিনি। ক্যানভাসের মতো রংবহুল আকাশে তখন প্রদোষের আবিরমাখা উল্লাস। এখনই দিবাবসানে হাত ধরে শুরু হবে অন্ধকার রাতের।
ম্যারি অস্তগামী রশ্মির দিকে তাকিয়ে একাকী কি যেন চিন্তা করেন। তার ঘটনাবহুল জীবনের কোনো খণ্ডাংশের ছায়াপাত কি দেখতে পান তিনি আকাশের উদার শরীরে? তার স্থির ও অবিচল দৃষ্টি আটকে যায় অস্তাচলের দূর দিগন্তে। এক সময় তিনি অস্পষ্ট শব্দের মায়াজালে কোনক্রমে উচ্চারণ করেন, “তাঁর জীবনে অস্তবেলার রঙ-টা অন্যরকমও হতে পারত।”
পরবর্তী কিস্তি আগামী শুক্রবার।
আরও পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস 'রংধনু'-৭