ধারাবাহিক উপন্যাস 'রংধনু'-৯
[নবম কিস্তি]
মাঝে মাঝে ম্যারির সাধ জানে নতুন জীবনের। আহ! জীবনটা যদি আবার নতুন করে শুরু করা যেতো! ঘুম ভেঙে দেখা মিলতো একদম আনকোরা নতুন একটি সকাল, যে সকাল ভেসে যাচ্ছে অপার্থিব অলীক আলোয়।
ম্যারি জীবনের রূঢ় অভিজ্ঞতায় জানেন, এত আলো ভাল নয়। তবু তিনি নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করেন, “এত কেন দেখো তুমি চোখ?”
তিনি আলোকিত সকাল থেকে চোখ ফেরাতে চান, পারেন না। তার মর্মমূল থেকে উঠে আসছে অদ্ভুত আত্মগ্লানি। কেউ জেনো তার সত্তার কানে কানে বলছে,
“তোমার নতুন করে আজ তবে ফের মৃত্যু হোক! চারপাশে ছেঁড়া-ফাটা উপড়ানো মানুষের বাঁচা আর তার পাশে একা একা অন্ধকার ধৈর্য্যের মতো নিজেকে পোড়াও তুমি ম্যারি, তুমি এক অনাবৃষ্টির বানভাসি, তোমাকে মেরেছে কে? তুমি জানো না, গোপনে যে তুমিই নিহত।”
প্রতিদিন জন্ম আর প্রতিদিন মৃত্যুর চক্রব্যূহে নিজেকে বড্ড অসহায় লাগে ম্যারির। জীবনের উপরিভাগে এইসব মনস্তাত্ত্বিক সঙ্কট মোটেই টের পাওয়া যায় না বাইরে থেকে। কখনো কখনো কেবল চোখের কাঁচে ছায়াপাত ঘটায় অন্তর্গত বিষণ্নতার মেঘ।
অথচ আর দশটা স্বাভাবিক ও সচ্ছল ঘরের মতো একটি পরিবারেই জন্মেছিলেন তিনি। অভাব কী তা কোনওদিন বোঝেননি। লেখাপড়ায় আগাগোড়া ওপর দিকে ছিলেন। জীবনে, যাপনে, শিক্ষায় যে-স্তরে তিনি পৌঁছেছেন, তা বহুজনের কাঙ্ক্ষিত। ঠিক বয়সে বিয়ে হয়েছিল, যদিও নিজের ইচ্ছায়, তথাপি ক্যাভিনও ছিল শিক্ষায় আর সংস্কৃতিতে অসাধারণ।
বছর না-ঘুরতে ম্যারির কোলে এসেছিল টমাস। তাকে যত্নে মানুষ করেছেন ব্যক্তিগত উত্থা্ন-পতনের বিপন্নতাকে পরাজিত করেই। আর বিচ্ছিন্নতা? আমেরিকায় তা এন্তার ঘটছে। সব কিছুর পরেও ম্যারির একার লড়াইয়ে টমাসের শিক্ষা ও জীবনের গতি সূর্যমুখীর মতো যথেষ্ট আলো-ঝলমলে।
কিন্তু জীবনের শেষটা যেমন ভাবা গিয়েছিল তেমনটা হল না ম্যারির। ক্যাভিন জীবনের আলো ম্লান করে দিয়ে আকস্মিক ভাবে চলে গেল। বাড়িতে কেবল মা আর ছেলে। তারপর এক সময় এলেন আরেকজন, ম্যারি মা আর টমাসের নানী। পারিবারিক বলয়ে কিছুটা সঙ্গ পাওয়া গেলো তৃতীয় একজনের। তবু সমস্যার শেষ হয় না। ম্যারির চারপাশের সবাই তাকে ঘিরে নিঃসঙ্গতার মেঘ খুঁজে পায়।
শুধু মা নন, সকলেই বলতে থাকল, দেখেশুনে কোনো ছেলের সঙ্গে একটা বিয়ে করে নাও। বাড়িতে কোনো পুরুষ কর্তা না থাকলে কি শ্রী থাকে! ম্যারির মা মিসেস অ্যানি গিলবার্ট, খোঁজখবরও চালাচ্ছিলেন নিজের মতো করে, উচ্চশিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত বংশের সুচাকুরে দু’-তিনটি ছেলের সন্ধানও পেয়েছিলেন।
আচমকা একদিন তার ছিঁড়ল। ম্যারি আটকে গেলেন বাগানের পাইন গাছের সঙ্গে নিঃসঙ্গতার বন্ধনে। পারিবারিক-ব্যক্তিগত বিষয় চর্চা করলেই ম্যারি অতীতমুখী হয়ে পড়েন। স্মৃতির হ্যাঙওভার থেকে বের হতে পারেন না। অথচ স্বাভাবিক, জাগতিক জীবনে তিনি প্রচণ্ড ভবিষ্যতচারী। ক্যারিয়ার ও পেশার ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র থমকে থাকেন নি তিনি। পিছিয়ে পড়ার তো প্রশ্নই আসে না।
শান্ত, স্বিগ্ধ অথচ লড়াকু মানসিকতার জন্য ম্যারি ক্যাম্পাসের অন্যতম আলোচিত চরিত্র। অনেকের পছন্দের মানুষও তিনি। কোনো হতাশা নেই, হাহাকার নেই, বেদনার আত্মপ্রকাশ নেই তার মধ্যে। জীবনকে স্বাভাবিক গতি ও ছন্দে এগিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর একজন ‘ঘটনাবহুল অভিজ্ঞতায় জারিত’ মানুষকে কে না ভালোবাসবে! কিন্তু ম্যারি জানেন, গোপনে তার মধ্যে বইছে সুপ্ত রক্তপ্রবাহের নদী। পৃথিবীর আর কেউ যে একান্ত নদীর খোঁজ জানে না।
আচমকাই একজন খানিকটা টের পেয়েছিল ম্যারির হৃদয়ের গোপনতম জগৎ সম্পর্কে। তার নাম ম্যাথু। রোমান যুবকটি ইতালি থেকে নানা স্থানের অভিজ্ঞতা নিয়ে ভাসতে ভাসতে এসেছিল আমেরিকায় ম্যারিদের ক্যাম্পাসে। প্রাচীন রোমান ভাস্কর্যের আদলে মায়াবী মুখ আর পেশীবহুল পৌরুষের মাখামাখিতে ম্যাথু একটানে ম্যারির বুকে তীরের মতো বিদ্ধ হয়েছিল। অদ্ভুত ছিল তার জীবন আর অতি বিচিত্র জীবনযাপন প্রণালী। পাত্র বা প্রেমিক হিসেবে পশ্চিমের অগ্রসর সমাজের তথাকথিত বিবেচনায় ম্যাথু ছিল পরীক্ষায় ফেল করা ছাত্রের মতো অপাঙতেয়। তার তিন কুলে প্রায় কেউ নেই। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়াও বেশিদূর নয়। ছবি এঁকে তার রোজগার, একটা ছোটখাটো বিজ্ঞাপনী সংস্থায় তার আঁকার চাকরি। কিছু কিছু পয়সা জমিয়ে সে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ভ্রমণ করে। ম্যারিদের ক্যাম্পাসে সে পড়াশোনা করতে নয়, এসেছিল মানুষ ও প্রকৃতি দেখতে।
ম্যাথুর মধ্যে ক্যাভিনের প্রচ্ছায়া দেখেছিলেন ম্যারি। তার মনে হয়েছিল, ক্যাভিন আর ম্যাথু একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। এক সময় তার মনে হয়েছিল, ক্যাভিনের অবর্তমানে একমাত্র ম্যাথুই তার একান্ত জীবনে জায়গা পেতে পারে।
ম্যাথুর সঙ্গে ম্যারির নিবিড়তা বাড়ছে টের পেয়ে মাঝখানে দেয়াল হয়ে দাঁড়ান মিসেস অ্যানি। মা হয়ে মেয়ের জীবনের সঙ্গে অনুল্লেখযোগ্য ও নিষ্প্রভ কোনও কিছু জুড়বে, এটা কোনওদিন ভাবনাতেও আনেন নি তিনি। যারা অসফল, তিনি চিরকাল তাদের করুণার নজরে দেখেছেন। এবার মেয়ের জীবনে এমন কাউকে কেমন করে আসন দেবেন, সেটা বুঝতে পারলেন না। পরিস্থিতি হাতছাড়া হচ্ছে দেখে নিজের আচরণগুলোর ওপরেও তিনি নিয়ন্ত্রণ হারান। একটা প্রবল ক্রোধ তাঁকে আচ্ছন্ন করল। প্রায় উচ্ছন্নে যাওয়া একটি ছেলেকে এ বাড়ির জামাতা হিসেবে মেনে নেওয়া দুষ্কর, সেটা জানার পরেও মিসেস অ্যানি মেয়ের মতের বিরুদ্ধে একটি কথাও বললেন না। তবে তিনি ম্যাথুকে চোখের সামনে দেখতেও চাইলেন না।
"বিয়েটা হতেই পারে", বললেন তিনি, "কিন্তু তাঁর পক্ষে তা নিয়ে আনন্দ করা অসম্ভব, স্বীকৃতি জানানো অসম্ভব।" বিশেষত ক্যাভিনের সঙ্গে মেয়ের বিচ্ছিন্নতার স্মৃতি তাকে ক্ষিপ্ত ও আতঙ্কিত করে। ক্যাভিন-সদৃশ্য ম্যাথুকে সামনে রেখে ম্যারির জীবনে আরেকটি ঝুঁকি নেওয়ার কথা তিনি কল্পনাও করতে পারেন না। তিনি মেয়ের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার উদ্যোগ নিলেন।
সেই থেকে চারপাশটা ধূসর হয়ে যায় ম্যারির। ম্যাথু টের পায় টানাপোড়েনের বিষয়গুলো। ম্যারির নিজেরই তৈরি করা একাকিত্বের বৃত্তের মধ্যে ঢুকতে ঢুকতেও ঢুকলো না ম্যাথু। দুজনের মধ্যে পারিবারিক-সামাজিকভাবে তৈরি হওয়া অদৃশ্য বেড়াটা ভাঙা হলো না আর। ম্যাথু আবার হারিয়ে গেল নিজের জগতে। দুজনের মধ্যে একটা ছোট্ট ফাঁক রইল শুধু। বয়স কম হলে লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি ভাঙার মতো ফাঁকটা ভরে দেওয়া যেতো। কিংবা পেরিয়ে যাওয়াও সম্ভব হতো। সম্পর্কের নিবিড় নৈকট্যে এসেও ‘সম্ভব’কে এক ফুৎকারে ‘অসম্ভব’ করে দিয়ে ম্যারি আর ম্যাথু সরে গেলেন নিজেদের আলাদা বিবরে।
[পরবর্তী কিস্তি আগামী শুক্রবার]