শৈল্পিক ভাবনা ও সৃষ্টিশীলতায় উজ্জ্বল মিতা চৌধুরী
থিয়েটার গ্রুপগুলোর পদচারণায় তখনও মুখরিত হয়নি সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহর। মহিলা সমিতি মঞ্চ ঘিরে ঢাকার নাটকপাড়া নামে বেইলি রোডেরও অভিষেক ঘটেনি সেসময়। ঢাকার নাগরিক ল্যান্ডস্কেপ বহন করছিল বিগত পাকিস্তানি আমলের গতানুগতিক নাট্যচর্চা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের স্মৃতি। বিনোদনের পুরনো জায়গা সাবেক মাহবুব আলী মিলনায়তন কিংবা ঢাকা জেলা ক্রীড়া সমিতির মিলনায়ন ছাড়িয়ে নতুন দেশের রাজধানী শহর ঢাকা তখন সাংস্কৃতিক তৃষ্ণার নতুন অভিমুখ সন্ধানী। আর তখনই সাদাকালো টেলিভিশনে তৎকালের সংক্ষিপ্ত সময়সীমার সম্প্রাচারে ভেসে আসে একগুচ্ছ নতুন মুখ, যারা পূর্ববর্তী প্রজন্মের আজমেরি আরা রেশমা, আহসান আলী সিডনি, মাসুদ আলী খানদের চেয়ে অনেক আলাদা।
নাটকে মিতা হক, শম্পা রেজা, রিনি রেজা, প্রিসিলা পারভিন পাশের বাড়ির মেয়ের মতো সাবলীল ভঙ্গিতে নিজেদের উপস্থাপন করেন। যাদের অনেকেই নাটক ও শিল্পমাধ্যমেই বাইরেও মেধাবী শিক্ষার্থী হিসাবেও ছিলেন সুপরিচিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত।
গানে 'জিংগা শিল্পী গোষ্ঠী' তারুণ্যসুলভ নতুন ঝংকার তুলে। পিলু মমতাজ, আজম খান, ফিরোজ সাঁই, ফেরদৌস ওয়াহিদ আনেন পপ মিউজিকের জোয়ার। লিনু বিল্লাহ, শিমুল বিল্লাহ চিহ্নিত করেন প্রতিশ্রুতির দৃষ্টান্ত।
বড় পর্দার রাজ্জাক-কবরী ছাড়া ছোট পর্দায় জুটি বিষয়টি তখনও দানা বাঁধেনি। আর তখনই নজর কাড়েন মিতা চৌধুরী ও আল মনসুর। মিতা চৌধুরী পরিণত হন বাংলাদেশ টেলিভিশনের আধুনিক অভিনয় রীতির প্রধানতম ও অগ্রণী একজনে। বাংলাদেশে শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, শিল্পিত প্রজন্মের প্রথম নান্দনিক প্রতিনিধি হয়ে উঠেন তিনি।
সত্তর-আশির দশকের জনপ্রিয় এই নাট্যশিল্পী দীর্ঘদিন প্রবাসে ছিলেন। ২০০৬ সালে দেশে ফিরে আবার নাটকে অভিনয় শুরু করেন। অনেক শিল্পীর পক্ষেই সগৌরবে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ ও যোগ্যতা দেখানো সম্ভব হয়না। মিতা চৌধুরী তা সম্ভবপর করেছিলেন নিজের ক্ষেত্রে, নিজের মেধা, মনন ও কৃতিত্বে। তিনি ছিলেন এমনই এক শিল্পী, যিনি বয়সের ব্যবধান ঘুচিয়ে মিশে যেতে পারতেন প্রজন্ম ও পরম্পরায় এবং যাকে অনুজরা আদর্শ হিসেবে মেনে নিতে দ্বিধাবোধ করেননি কখনই। তাঁর শৈল্পিক ভাবনা ও সৃষ্টিশীলতা ছিল উজ্জ্বল, অভিনয় দক্ষতা ছিল বৈশিষ্ট্যময়, অন্যের চেয়ে আলাদা এবং সতত অনুপ্রেরণার উৎস।
মিতা চৌধুরী প্রখ্যাত নির্মাতা আতিকুল হক চৌধুরী, আবদুল্লাহ আল মামুনের মতো ব্যক্তিত্বের নির্দেশনায় স্মরণীয় কাজ করেছেন। সহশিল্পী হিসাবে সমকাল এবং পরবর্তী প্রজন্মের অনেকের সঙ্গে নিজের অভিনয় জীবনকে প্রবহমান রেখেছেন। নিজস্ব শৈলী ও নৈপুণ্যে সর্বাবস্থায় তিনি ছিলেন স্বকীয় বিশিষ্টতায় দীপ্তিময় ও অগ্রসর।
প্রবাস জীবনে সুদূর লন্ডনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার (২৯ জুন) রাতে মারা যান দেশের প্রথিতযশা নাট্যশিল্পী মিতা চৌধুরী (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। অভিনেত্রীর মেয়ে নাভিন ফেসবুকে মিতা চৌধুরীর মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করার পর শোকের ছায়া নেমে আসে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জগতে। তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন বলে জানিয়ে তার মেয়ে লিখেছেন, "Dear friends, this is Naveen posting to give you the sad news of our mother’s passing less than two hours ago with Miran and I by her side. Innalillahe wa inna ilahe rajeun. Please pray for us. We won’t be able to respond to all messages. Our beloved Ma is now with our beloved father singing and dancing again…."
মিতা রহমানের মৃত্যুতে গভীর শোক, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।