না ফেরার পথে 'দার্শনিক ঔপন্যাসিক' মিলান কুন্দেরা

  • মায়াবতী মৃন্ময়ী, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

মিলান কুন্দেরা

মিলান কুন্দেরা

সমকালের অন্যতম প্রধান ঔপন্যাসিক মিলান কুন্দেরা সক্রিয় জীবনকে শতবর্ষের কালপর্বে নিয়ে যাবেন বলে আশা করেছিলেন ভক্ত, অনুরাগী, পাঠকেরা। কিন্তু মধ্য-নব্বই বছরের কর্মবহুল জীবনের ইতি টেনে প্রয়াত হলেন তিনি। না ফেরার পথে যাত্রাকালে তিনি রেখে গেলেন কথাশিল্পের নিজস্ব আঙ্গিক।

ক্রিটিক্যাল বীক্ষণে বিশ্বদর্শনের উত্তরাধিকার, তীব্র তীর্যকতা, সূক্ষ্ম রসবোধ, শাণিত ভাষা ভঙ্গি আর এক প্রবল নির্লিপ্তির জীবনবোধ, যা তাকে ‘সকলের চাইতে আলাদা’ করে রেখেছিল। তার এই বিশেষ দর্শন ও ভঙ্গিমা একুশ শতকের বিশ্বসাহিত্যের একটা বড় অংশকে বিশেষ ভাবে প্রভাবিত করে, যা তিনি বহন করে এনেছিলেন বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন অসুখে ভুগছিলেন। চেকোস্লোভাকিয়ার বার্নো শহরের মিলান কুন্দেরা লাইব্রেরির পক্ষ থেকে তার মৃত্যু সংবাদ জানিয়েছেন সংস্থার মুখপাত্র আনা ম্রাজ়োভা এসব তথ্য জানান।

বিজ্ঞাপন

দীর্ঘ জীবনে বহু বার বিতর্কে জড়িয়েছেন কুন্দেরা। ২০০৮ সালে তার বিরুদ্ধে চেকোস্লোভাকিয়ার কমিউনিস্ট সরকারের চরবৃত্তির অভিযোগও ওঠে। তবে তার রচনার মতো এই সব অভিযোগকে তিনি শ্লেষের সঙ্গেই উড়িয়ে দেন। ২০১৯ সালে তাকে চেকোস্লোভাকিয়ার নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তার নিজের শহর বার্নোতে মিলান কুন্দেরা লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয়।

ফ্রান্স প্রবাসী চেক সাহিত্যিক মিলান কুন্দেরা ছিলেন বিংশ শতকের বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম প্রধান মুখ। ১৯২৯ সালে জন্মগ্রহণকারী কুন্দেরা কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ-সহ সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই তার অবদান রেখেছেন। তবে, তার প্রসিদ্ধি মূলত ঔপন্যাসিক বা আখ্যানকার হিসেবেই।

বিজ্ঞাপন

কুন্দেরার জন্ম চেকোস্লোভাকিয়ার বার্নো শহরে। তার বাবা লুডভিক কুন্দেরা ছিলেন খ্যাতনামী পিয়ানোবাদক ও সঙ্গীত তত্ত্ববিদ। বাবার হাত ধরেই শিল্পের জগতে প্রবেশ কুন্দেরার। প্রাথমিক ভাবে সঙ্গীতের শিক্ষা লাভ করলেও পরে তিনি মনপ্রাণ ঢেলে দেন লেখালেখিতেই। ১৯৪৮-এ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন কুন্দেরা। কিন্তু ১৯৫০-এই পার্টি থেকে তাঁকে বিতাড়ন করা হয় কমিউনিজ়ম-বিরোধী কার্যকলাপের জন্য।

সেই সময় প্রাগে পাঠরত ছিলেন মিলান। স্নাতক হওয়ার পর সেই শহরেই অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত হন। ১৯৫৬-এ তাকে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ ফিরিয়ে দেওয়া হলেও ১৯৭০ সালে আবার তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। ১৯৭৫ সালে দেশ থেকেও বিতাড়িত হন তিনি এবং ফ্রান্সে বসবাস করতে শুরু করেন। ১৯৮১ সালে তিনি ফ্রান্সের নাগরিকত্বও লাভ করেন। যদিও পরে তাঁর চেক নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়া হয়, তবু নিজেকে ফরাসি লেখক হিসাবে পরিচয় দিতেই পছন্দ করতেন কুন্দেরা এবং জন্মভূমিতে আর ফিরে যাননি একবারের জন্যেও।

মিলান কুন্দেরার সাহিত্য বহুমাত্রিক ও বিচিত্র পথগামী। প্রাথমিক পর্বে তাঁর লেখালিখিতে রাজনৈতিক উচ্চারণ প্রকট থাকলেও পরে তিনি সেই ধারা থেকে বেরিয়ে আসেন এবং ইউরোপীয় নবজাগরণ পর্বের সাহিত্যের উত্তরাধিকার তিনি বহন করেন। ১৮৮৪ সালে ‘দি আনবিয়ারেবল লাইটনেস অফ বিইং’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হলে সাহিত্যমহলে আলোড়ন পড়ে যায়। কুন্দেরা পরিচিত হতে শুরু করেন ‘দার্শনিক লেখক’ হিসাবে। তাঁর পূর্ববর্তী রচনা ‘দ্য বুক অফ লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং’ থেকেই রেনেসাঁস লেখক সর্ভেন্তিস, জভান্নি বোকাচ্চিও বা রাবেলাইয়ের প্রভাব তাঁর রচনায় স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। কার্যত কুন্দেরার লিখন হয়ে দাঁড়ায় জীবন বা জীবনোত্তীর্ণ জগতের সন্ধান। ‘ইম্মর্টালিটি’, ‘আইডেন্টিটি’ বা ‘ইগনোর‌্যান্স’ উপন্যাসে তিনি এই ভঙ্গিমা এবং দর্শনকেই আরও বিস্তারে নিয়ে যান।

কুন্দেরার রচনায় স্বৈরশাসন বা স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতার বিরুদ্ধে বার বার প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে। তবে সেই প্রতিবাদ কখনই উচ্চকিত ছিল না। তাঁর সাহিত্যের মাধ্যমে কোনও ‘বার্তা’ দিতে তিনি পছন্দও করতেন না। সূক্ষ্ম রসবোধ, তির্যক বাচনভঙ্গি আর এক আপাত-নির্লিপ্তিই তাঁকে ‘সকলের চাইতে আলাদা’ করে রেখেছিল। তাঁর এই বিশেষ দর্শন ও ভঙ্গিমা একুশ শতকের বিশ্বসাহিত্যের একটা বড় অংশকে বিশেষ ভাবে প্রভাবিত করে এবং একটি আলাদা ও অনন্য সাহিত্যিক ঘরানার জন্ম দেয়।

জীবনে বহু পুরস্কার পেয়েছে কুন্দেরা। ১৯৮৫ সালে তিনি জেরুজ়ালেম পুরস্কার পান। ১৯৮৭তে পান তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ ‘দি আর্ট অফ নভেল’-এর জন্য পান অস্ট্রিয়ার স্টেট প্রাইজ ফর ইউরোপিয়ান লিটারেচার। ২০২০ সালে তাঁকে ফ্রান্‌জ কাফকা পুরস্কার প্রদান করে তাঁর দেশ চেকোস্লোভাকিয়া। ১৯৮৮ সালে তাঁর উপন্যাস ‘দি আনবিয়ারেবল লাইটনেস অফ বিইং’ হলিউডে চলচ্চিত্রায়িত হয়।

মিলান কুন্দেরা