ইটগুলো পরিমিত সিমেন্টে গাঁথা হবে তো?

  • প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

বেশ ক’বছর আগে থেকে ‘ব্রিকস’ নামে একটি আন্তর্জাতিক জোটের নাম নতুন করে শোনা যাচ্ছে। শুরুতে অর্থনৈতিক জোট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও পরবতীর্তে কেউ এটাকে বলছেন রাজনৈতিক জোট, কেউ ভূ-রাজনৈতিক, কেউবা উত্তরের চাপের বিরুদ্ধে দক্ষিণের ঠেকানোর প্রচেষ্টা হিসেবে অভিহিত করেছেন। তবে যে যেভাবেই বিশ্লেষণ করুক না কেন, বর্তমানে শক্তির ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় ব্রিকস একটি ব্লক বা জোট হিসেবে নব্য আলোচনার জন্ম দিচ্ছে। ব্রিকস আমাদের দেশে আলোচনায় স্থান পাচ্ছে কারণ, ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্রিকস-এর সদস্যপদ লাভ করার জন্য আবেদন করেছে।

বর্তমানে ব্রিকসকে নতুন করে ভাবা হলেও এটার উৎপত্তি ও বিকাশ কিন্তু একবারেই নতুন নয়। তবে এর সম্প্রসারণ চিন্তা নতুন করে ভাবাচ্ছে। সেই ২০০০ সালের গোড়ার দিকে ব্রিকস ভাবনা শুরু হলেও গোল্ডম্যান স্যাক্সের জিম ওনিল ২০০১ সালে প্রথম ব্রিকস’র প্রতিষ্ঠার ধারণা নিয়ে আসেন। চারটি দেশ ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন শুধু ‘ব্রিক’নামে ২০০৯ সালে এই জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটায়। তখন এসব দেশে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণের নিরীখে এই জোট গঠন করা হয়। এরপর ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকাকে সদস্যপদ দিয়ে ‘ব্রিক’থেকে ‘ব্রিকস’নামের শব্দবন্ধন তৈরি করে জোটটি। এরপর ২০১২ সালে সদস্য দেশগুলোর একজন কূটনীতিবিদ এটাকে ‘আলোচনার মঞ্চ নয়-বরং সমন্বিত হবার মঞ্চ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

বিজ্ঞাপন

ব্রিকস-এর ধারণার পর গোল্ডম্যান স্যাক্স উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে থেকে ‘দ্য নেক্সট ইলাভেন’ তালিকা প্রকাশ করে। সেই তালিকায় মিসর, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, মেক্সিকো, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভিয়েতনামের পাশাপাশি বাংলাদেশও স্থান পায়। এরপর ফরাসী আর্থিক ও বীমা প্রতিষ্ঠান কোফেস ২০১৪ সালে ১০টি উন্নয়নশীল দেশে নিয়ে একটি তালিকা প্রকাশ করে। সেখানে সম্ভাবনাময় উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে রয়েছে পেরু, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, কলম্বিয়া, শ্রীলঙ্কা, কেনিয়া, তানজানিয়া, জাম্বিয়া, বাংলাদেশ ও ইথিওপিয়া।

পরবতীর্তে ২০১৪ সালের ২১ জুলাই বিশ্বব্যাংকের মডেলকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য ব্রিকস-এর অধীনে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘দ্য নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনবিডি)। এটি করোনাকালীন সময়ে নতুন সদস্যপদ আহব্বান করলে মিশর, বাংলাদেশ, সংযুক্ত আরব আমিরাত, উরুগুয়ে এনবিডি-র সদস্যপদ লাভ করে।

বিজ্ঞাপন

মূলত: মার্কিন ডলারের উচ্চমূল্য ও একক আধিপত্য ঠেকাতে ব্রিকস-এর মধ্যে জন্ম নেয় এনবিডি ব্যাংক। মার্কিন ডলারকে টেক্কা দেবার জন্য প্রেসিডেন্ট পুতিন এর প্রথম উদ্যোক্তা হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। বিশেষ করে ২০২২ সালে মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ-এর উপর সুদের হার আগ্রাসী করার ফলে উন্নয়নশীল দেশের মুদ্রনীতির উপর নিম্নমুখী চাপ পড়ে। তাই আন্তজার্তিক বাণিজ্যে মুদ্রাবহুমুখীকরণ ছিল এনবিডি-র উদ্দেশ্য। এনবিডি কর্তৃক উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতির বিকাশে এটাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখা হলেও সদস্য দেশগুলোর মধ্যে শুধু চীনের অর্থনীতি ৬ ট্রিলিয়ন থেকে ১৮ ট্রিলিয়ন ডলারে এবং ভারতের ১.৭ থেকে ৩.১ ট্রিলিয়নে উন্নীত হলেও অন্যান্য দেশগুলোর ক্ষেত্রে তেমন কোন অগ্রগতি অর্জিত হয়নি।

ইতোমধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলেও ২০২২ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার বিরুদ্ধে কোন সদস্য রাষ্ট্র প্রতিবাদ করতে সাহস করেনি। এমনকি ২০২৩ সালে জুলাই মাসেও ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ অব্যাহত থাকায় ব্রিকস—এর ক্রমাগত নীরবতা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের মনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ সৃষ্টি শুরু করেছে।

ব্রিকস-এর প্রভাবশালী সদস্য প্রেসিডেন্ট পুতিন প্রতিবেশী ভাইয়ের সাথে জেদ করে ক্রমাগত যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। আরেক সদস্য ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের নিধন করার জন্য পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েছিল। চীনের প্রেসিডেন্ট লী শিনপিংকে স্বৈরাচার আখ্যায়িত করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ইউক্রেনে আক্রমণ বা যুদ্ধ বন্ধের ব্যাপারে ব্রাজিল, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা একবারেই নিশ্চুপ। বরং তাদের হয়ে অস্ত্র, গোলাবারুদ সরবরাহ করে চলেছে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ। এছাড়া একটু গভীরে আলোকপাত করলেই স্পষ্ট যে, নতুন সদস্যলাভে আগ্রহী দেশগুলোর সিংহভাগ অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল এবং রাজনৈতিকভাবে নিজেদের দেশের মধ্যে অন্তর্কলহ ও অশান্তির মধ্যে কালাতিপাত করে চলেছে। এসব দেশের অনেকের রাজনৈতিক মতাদর্শের অবস্থানের দোদুল্যমানতা অবলোকন করে মার্কিন ভিসানীতি চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।

এছাড়া শত শত চেষ্টা তদ্বির করে গত তিন যুগেও বাংলাদেশ ভারতের নিকট থেকে আন্তজার্তিক তিস্তা নদীর পানির ন্যায্যতা পায়নি। ইইউ বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত বাণিজ্যসুবিধা দিলেও চীন—ভারত এখনও সেই বাণিজ্যসুবিধা দিতে আগ্রহী নয়।

অন্যদিকে চীনের আগ্রাসী নয়াচীন নীতি, চীন-ভারত সীমান্ত উত্তেজনা,বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত ও রোহিঙ্গা সমস্যা ও বিশ্বের আরো অনেক জটিল সমস্যার প্রেক্ষিতে ব্রিকস কোন মতামত প্রকাশ করেনি। এতে মনে করা হচ্ছে ব্রিকস কোন বৈশ্বিক রাজনৈতিক সংকট নিয়ে মাথা ঘামাতে চায় না। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সারা বিশ্বে যে পরিমাণ অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে তার মোকাবেলায় একটি অর্থনৈতিক জোট হিসেবেও ব্রিকস—এর কোন তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না।

অধিকিন্তু, যুদ্ধবহুল বৈশি^ক সংকটকে পাশ কাটিয়ে শুধু মার্কিন ডলারের আধিপত্য রুখতে গিয়ে অর্থনৈতিকভাবে অনেক দুর্বল দেশকে ব্রিকস-এর সদস্যপদ দেবার যে প্রচেষ্টা চলছে তা সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটকে আরো কোন কঠিন গহ্বরে ঠেলে দিতে যাচ্ছে তা বেশ বড় চিন্তার বিষয় হিসেবে দাঁড়িয়েছে।

এরই মাঝে ব্রিকস-এর আরো ২০ টি নতুন সদস্য দেশের অন্তর্ভূক্তির আবেদন জমা হয়েছে। বাংলাদেশও আবেদন করেছে এবং আগামী আগষ্টে ব্রিকস-এর সম্মেলনে নতুন সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের অন্তর্ভূক্তিলাভ আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ বলেছে, ‘ইউএসকে বাইপাস করে আমরা ব্রিকস-এ যোগদান করছি না।’বাংলাদেশের লক্ষ্য ভবিষ্যতে ব্রিকস থেকে এনবিডি-র মাধ্যমে বড় ঋণ পাওয়া ।’

কারণ, ব্রিকস-কে ভবিষ্যতের ‘গেম চেঞ্জার’হিসেবে মনে করে সরকারকে কেউ কেউ পরামর্শ দিয়েছেন। কেউ আবার এটাকে বাংলাদেশের জন্য ‘ব্রেকথ্রু’ বা হঠাৎ সুযোগের সাফল্য হিসেবে মনে করছেন।

কিন্তু বর্তমান বৈশ্বিক পরিমন্ডলে ব্রিকস বাংলাদেশের জন্য ততটা ইতিবাচক মনে হচ্ছে না। বর্তমানে বাংলাদেশ পশ্চিমাদের নানাবিধ আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে কোনঠাসা হয়ে রয়েছে। একজন বিশ্লেষক বলেছেন, ‘এই মুহুর্তে বাংলাদেশ পাশ্চাত্যের বড় দেশগুলোর সংগে সাংঘর্ষিক অবস্থানে রয়েছে।’ ‘ব্রিকস-এর একটি দেশ রাশিয়া যার সংগে বিশ্বের অনেক দেশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুদ্ধে লিপ্ত।’আমেরিকায় বাংলাদেশের একজন সাবেক রাষ্ট্রদূত বলেছেন, ‘আমারা তাদেরকে যেভাবে ভাবি তারা এখনও আমাদেরকে সেভাবে ভাবে না।’

তাহলে বাংলাদেশ কোনদিকে যাবে? এসব বিশ্লেষণকে মোটেও হেলফেলা হিসেবে মনে করার উপায় নেই। আমাদের বৈদেশীক নীতি হলো ‘সবার সংগে বন্ধুত্ব, কারো সংগে বৈরিতা নয়।’কিন্তু রাজনৈতিকভাবে পরস্পর বৈরী দেশগুলোর জোটের সংগে সদস্যপদ লাভ করে কোন দেশ বা জোটের বিরাগভাজন হতে চাওয়াটা এখন ওপেন সিক্রেটে পরিণত হয়ে গেছে। ফলত: বৈরী কোন দেশে বাড়ি গাড়ি কিনে, ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবার পরিজন রেখে তাদের সাথে রাজনৈতিক শত্রুতা শুরু করা কি নিছক আরো নতুন হঠকারীতা নয়?

আমরা তো ব্রাজিলে বা আফ্রিকার কোন দেশে বাড়ি কিনতে চাই না। মনে মনে বিশ্বাস করি, ভালবাসি রাশিয়া কিন্তু বৈদেশিক নীতির দোহাই দিয়ে সুখের সন্ধানে যাই আমেরিকা, কানাডায়। এখনও সন্তানকে শিক্ষালভের জন্য রাশিয়ায় না পাঠিয়ে মার্কিন বা ইউরোপ মুল্লুকে পাঠাই। জাপানী গাড়ি বা ট্রেন কিনে চড়ে বেড়াতে পছন্দ করি। আমাদের পছন্দ ও দৃষ্টিভঙ্গির সাথে ও মধ্যে কৌশলগত বিচক্ষনহীনতা ও দূরত্ব তৈরির প্রবণতা সবসময় কাজ করে থাকে। এসব বৈপরিত্য আমাদের জাতীয় চরিত্র।

এজন্য হন্যে হয়ে বিশ্ব পরিমন্ডলে বেশি তৎপরতা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করাটা আমাদের জন্য মোটেও সুখকর হয় না। আমাদের প্রতি সন্দেহ ও বৈদেশিক চাপ বেড়ে যায় নিজেদের শূন্যতায় ও বোকামীতে। যার ভুক্তভোগী হচ্ছে দেশের জনগণ। যেমনটা হয়েছে নতুন ভিসানীতি আরোপের ফলে।

স্বাধীনভাবে ভোট প্রদানে আশায় সাধারণ মানুষ উন্মুখ। এজন্য ‘সংবিধানের আওতায় কোনো গ্রহণযোগ্য সংস্কারের প্রস্তাব থাকলে তা নিয়ে আলোচনাও কি হতে পারে না?... জনগণের রায় নিতে ভয় কীসের?’ (জাগোনিউজ ২৭.৬.২০২৩)। নিজের ঘরে কেন অশান্তির আগুন জ¦লে সেদিকে নজর দেয়াটা এখন বড় কাজ। আন্তজার্তিক মহলের মধ্যে এসব কথা আরো বেশী ঘাটাঘাটি করার সুযোগ তৈরি করে দিয়ে নিজেদের দুর্বলতা আর প্রদর্শণ করা ভাল নয়।

কোন কোন বিশ্লেষক বলেছেন, ব্রিকসে যোগদান আমাদের জন্য ইতিবাচক। তবে সেটা কবে কখন কিভাবে ইতিবাচক হতে পারে তার বিশ্লেষণ দেননি। ব্রিকসের সদস্যদের অভিলাষ বড় কিন্তু নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন কারণে ভাল সমঝোতা নেই। করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দোহাই দিয়ে আমাদের দেশে দ্রব্যমূল্যস্ফীতিকে চেপে রাখার প্রবণতা বহুদিনের। এটা আরো বেশীদিন চেপে রাখার প্রচেষ্টাকে নিম্নআয়ের মানুষ ভালভাবে গ্রহণ করছেন না। কারণ সামান্য মরিচ-পিঁয়াজের মতো মশলার ঘাটতি বা বার বার ভয়ানক ডেঙ্গুর মতো নাজুক পরিস্থিতি ওই যুদ্ধের কারণে হচ্ছে না। ব্রিকস-এর কাঙ্খিত নতুন ২০ সদস্যে দেশের মধ্যে বাংলাদেশের মতো কারো ততটা বেশি উন্নয়ন লিপ্সা বা তৎপরতা নেই, অভ্যন্তরীণ জটিলাবস্থাও নেই। তাই ঘরের বেসামাল অবস্থাকে সামাল না দিয়ে বৈশ্বিক পরিমন্ডলে সমাজ-দার্শনিক প্রতিপক্ষ তৈরি করে, অর্থনৈতিক বন্ধু হারিয়ে বাংলাদেশকে কোণঠাসা করার প্রয়োজন কি?

উঠতি অর্থনীতির মিশ্র, মডারেট চিন্তাধারা প্রসূত আধুনিক বাংলাদেশ সবার সংগে থেকে উন্নতি করতে চায়। কিন্তু বৈরী জোটের বিরুপাক্ষের মধ্যে পড়ে ঘূর্ণি খেতে শুরু করলে কারো কারো ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব আশা করা অমূলক। যা আমাদের
আর্থ-সামাজিক অগ্রগতিকে দ্রুত থামিয়ে দিতে পারে। এজন্য আমাদেরকে সামনের যে কোন শুরু থেকে আরো সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]