সময়ের সরহদ ছুঁয়ে কবিতার চরৈবেতি
একমাত্র সৎ ও শুদ্ধতম কবি নিজের প্রলম্বিত যাত্রাপথে কবিতাকে আলিঙ্গন করে জীবনের সমান্তরালে পথ চলতে পারেন। নিমগ্ন-কবি যাপনের পরিসরে কবিতার ঘোরাক্রান্ত বলয়ে নির্মাণ করতে পারেন স্বোপার্জিত আত্মপরিচিতি। তৃষ্ণার লেলিহান অগ্নিতে একাকী নিঃসঙ্গতার বিপন্ন প্রহরে আকণ্ঠ পান করতে থাকেন কাব্যের সুষমা। তারপর ঘোষণা করেন: ‘সবুজের বুকে আমরা সূয হয়ে থাকি’ (লাল গাড়ি)। এভাবেই অরুণালোকের সারথি হয়ে প্রকৃত কবি উত্থান-পতন আর সঙ্কুলতার পাকদণ্ডি পেরিয়ে ঠিকই পৌঁছে যান কবিতার অলৌকিক বন্দরে। আধুনিক বাংলাদেশের কাব্যচর্চায় নব্বই দশকের অন্যতম কাব্যপ্রতিভা সেলিনা শিরীন শিকদার জীবন ও কবিতার মেলবন্ধনে ‘দূর নভদেশে তারকাপুঞ্জের মতো’ (জোনাকীর সরোবর) দেদীপ্যমান হয়ে অবস্থান করেন পাঠকবোধের অতল অলিন্দে।
সেলিনা শিরীন শিকদানের উত্থানপর্বে পটভূমি হিসাবে বলা যেতে পারে যে, কবি ও কবিতার দেশ বাংলাদেশে প্রথা ও অপ্রথাগত প্রণোদনায় কাব্যচর্চার ধারা অবিরল, যার মধ্যে প্রকৃত-কবি-সত্তায় স্থায়ী হন সামান্যই। খোদ বাংলা একাডেমি ‘তরুণ লেখক প্রকল্প’র মাধ্যমে কবি ও লেখকদের প্রশিক্ষিত করেছিলেন, যাদের অধিকাংশই হারিয়ে গিয়েছেন। যে কয়জন ম্যারাথন রেসে টিকে আছেন কিংবা সর্বাবস্থায় সাহিত্যের কাছেই সমর্পিত হয়েছেন, সেলিনা শিরীন শিকদার তাদের অন্যতম। জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, মহাত্মা আহমদ ছফার সান্নিধ্যে শিল্পবোধে জারিত হয়ে তিনি ‘তরুণ লেখক প্রকল্প’-এর একজন হলেও ছিলেন অগ্রগামী ও অনন্য। নবম গ্রন্থ কবিতা সংকলন ‘জোনাকীর সরোবর’-এ তিনি জাগৃত করেছেন স্বকীয় আত্মশক্তির প্রতীতি ও প্রত্যয়। ‘শস্যের সজীব দোলায় প্রশান্তির ভোর’ হয়ে তিনি ‘স্বপ্নলোকে ফলনের সফলতায় শিস দিয়ে যান’ (শিস দিয়ে যায়)।
সেলিনা শিরীন শিকদারের আত্মপ্রকাশ ১৯৯৬ সালে বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত তার আধুনিক রূপকথা গ্রন্থ ‘অরুণালোক’-এর মাধ্যমে। একই বছর প্রকাশিত হয় তার মরমী পংক্তিগুচ্ছ ‘বয়েত-১’। তারপর তিনি রচনা ও প্রকাশ করেন ‘রাজর্ষীই মাগো ও অন্যান্য রূপকথা’, ‘আধুনিক রূপকথা’, ‘আধুনিক রূপকথা (ত্রয়ী)’, ‘অনুগল্প’, ‘বয়েত-২’ এবং কাব্যগ্রন্থ ‘ডানায় ডানায় অধিবাস’। ২০২৩ সালে প্রকাশিত ‘জোনাকীর সরোবর’।
সেলিনা শিরীন শিকদার সচেষ্ট রয়েছেন পাঠ এবং অর্থের মধ্যে সম্পর্কের বুনন তৈরিতে। দেশজ ও উত্তর আমেরিকার অভিজ্ঞতায় তিনি তার শিল্প জগৎ নির্মাণে মেধায় তীক্ষ্ণ, সৃজনে পরিমিত এবং সমাজ-সভ্যতা-জীবন বিষয়ক অনুভবের মূর্ত ও বিমূর্ততার নান্দনিক কারিকর। ফলে তার কবিতার অন্তর্নিহিত বার্তা বোধে, সৃজনে ও মননে ঋদ্ধ এবং পরিপূর্ণ, যা বহুমাত্রিক ছন্দে, বর্ণে, বিভায়, বর্ণনায় সচল-সজীব জীবনেরই রূপতাত্ত্বিক ছাপচিত্র স্বরূপ।
বিশিষ্ট লেখক ও কবি সেলিনা শিরীন শিকদারের কবিতা সংকলন গ্রন্থ ‘জোনাকীর সরোবর’। প্রকাশ করেছে জাগৃতি প্রকাশনী। পাঁড় পর্বে বিভাজিত কবিতাগুলোর প্রতি অধ্যায়ে বর্ণিল চিত্রকর্মের সংযোজন গ্রন্থের এক মহার্ঘ্য প্রাপ্তি। কাব্য ও শিল্পের যুথবদ্ধতায় তাঁর কবিতা এক অনির্বটনীয় দার্শনিক মূল্যবোধ ও জীবন-জিজ্ঞাসায় জারিত করে বাংলা কবিতার পাঠকদের। পাঠক অনুভব করেন এক আপাদমস্তক কবি ও দার্শনিক, সুফি ও স্বাপ্নিকের মরমী ছোঁয়া, মানবিকতার স্পর্শ। এমনকি, প্রেম ও রোমাঞ্চের মতো চিরায়ত বিষয়ও তিনি প্রতিস্থাপন করেন মহাকালিক ও নৈর্ব্যক্তিক আবহে: ‘দুই চোখে অধোগতি দৃষ্টি রাখি/দেখো নীরবতাই এবাদত’ (ছায়ার জগৎ)।
সেলিনা শিরীন শিকদার সমকালীন বাংলা কবিতার হৈ হট্টগোলে এক ধ্যনস্থ কবিসত্তা, যিনি প্রচারবিমুখ হলেও কোনো পরিস্থিতিতেই কবিতাবিমুখ নন। তাপসীর আরাধনায় তিনি কবিতা ও সাহিত্যসাধনাকে করেছেন ধ্যান, জ্ঞান, প্রেম ও প্রার্থনা। প্রকৃতি, সমাজ-সংস্কৃতি, লোকজ, আদিবাস ও অভিবাসনের অনুধ্যানে তিনি সাধারণ দৃষ্টির বাইরে এক মহামানবিক বয়ান তৈরি করেছেন, যা তাকে একবিংশের বস্তু ও প্রযুক্তি তাড়িত সমাজে শাশ্বত চিন্তনের মনোজাগতিক কাব্যকীর্তির আধ্যাত্মিক প্রতিনিধিতে পরিণত করেছে।
সেলিনা শিরীন শিকদার মূলত রূপকথা গল্পকার, কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক। পেশাগত জীবনে তিনি একজন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন পেশাজীবী ও সক্রিয় মনোবিজ্ঞানী। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেন আজিমপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা মহাবিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্লার্ক ইউনিভার্সিটি থেকে। তিনি প্রধানত রূপকথার আঙিকে গল্প লেখেন। তার ছোট, সুফিবাদী, মরমী ও আধ্যাত্মময় কবিতাগুলো ‘বয়েত’ নামে সমাদৃত। সামগ্রিকভাবে সেলিনা শিরীন শিকদার তার সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে যে স্বতন্ত্র পরিচিতি অঙ্কন করেছেন, তা ‘জোনাকীর সরোবর’-এও সুস্পষ্ট।