জীবনের অনুভব ও অনুরণনে শীতের কবিতা
বছরের পৌষ মাসের শেষে আর মাঘ মাসের প্রথমে সারা দেশের ওপর দিয়ে কোনো কোনো বছর মৃদু থেকে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যায়! পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা নেমে আসে। কিছু কিছু এলাকার মানুষ ঘরবন্দী হয়ে পড়ে। শীতার্ত মানুষের বিভিন্ন দুর্ভোগও সেইসাথে লেপ্টে থাকে। এরমাঝে আমরা যারা ঢাকায় বসবাস করি, তারাও কনকনে শীত অনুভব করে থাকি। হিমেল বাতাসও কাউকে কাউকে কাবু করে। এমন পরিবেশে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য জায়গায় কবি সম্মেলনে কবিরা ছুটে গিয়ে কবিতা পড়ে। এই সময়টায় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বেড়ে যায়, বিভিন্ন পেশার মানুষ তার সুযোগ ও সাধ্য অনুযায়ী বিভিন্ন উৎসবে অংশ নেয়। এমন অবস্থায় আমরা যারা কবিতা লিখি বা পড়ি, তারা তো কবিতা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকি না, কবিতার কণ্ঠলগ্ন থেকে যাই, এই শীতেও।
এই শীতে বেছে বেছে খুঁজে খুঁছে বেশকিছু শীতের কবিতা পড়লাম, আর তা থেকে পাঠস্পৃহার উষ্ণতা পেলাম। এই শীতকে নিয়ে পুরো কবিতা লিখেছেন কোনো কোনো কবি, আবার কোনো কোনো কবি শীতের অনুষঙ্গ টেনে নিয়ে কবিতার কোনো পঙ্ক্তি সাজিয়েছেন। শীতের বর্ণনা ও অনুষঙ্গ পেয়ে যাই বাংলা কবিতার ধারাবাহিকতায়, সেই চর্যাপদের কবি থেকে আজকের তরুণতম কবির কবিতায়।
আমরা তো জানি—বাংলা কবিতা বহু বিষয় নিয়ে লেখা হয়েছে। এই কবিতায় তো মিশে আছে এদেশের মানুষের চৈতন্য-বুদ্ধি-আবেগ-কল্পনা ও বহুবিধ বোধ। আমরা পাঠক হিসেবে খুঁজে পাই জীবনের খণ্ড খণ্ড রূপ, খুঁজে পাই নিজের মুখ এবং দেশ ও প্রকৃতির মুখ।
ঋতুর বৈচিত্র্য একেক দেশে একেকভাবে উন্মুখ হতে দেখা যায়। বাংলাদেশের ঋতু বৈচিত্র্য প্রকৃতির এক স্বকীয়তা নিয়ে আছে। ছয় ঋতুর দেশ এই বাংলাদেশ। একেক ঋতু একেক আবহ ও রূপবৈশিষ্ট্য নিয়ে আমাদের জীবনের সাথে একাকার হয়ে আছে। শীত আমাদের ছয় ঋতুর মধ্যে অন্যতম। হেমন্তের পর বসন্তের আগে শীতের অবস্থান। পৌষ-মাঘ মাস নিয়ে শীত ঋতু আমাদের দিনপঞ্জির হিসেবে থাকলেও—শীত শুরু হয় কিছু আগে ও সমাপ্তিও কিছু পরে হতে দেখা যায়। বসন্ত জাগিয়ে দিয়ে শীত যেন চলে যায়।
শীতে বিভিন্ন রকমের শাকসবজির দেখা মেলে। বন্যার ছোবল থাকে না। নতুন ধানের আনন্দে কৃষক যেন খুঁজে পায় জীবনের সৌন্দর্য। শীত হয়ে ওঠে অন্যান্য ঋতুর চেয়ে আরো বেশি উৎসবলগ্ন। কত রকম পিঠা খাওয়ার ধুম। শীতে পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠান জেগে ওঠে। কোথাও পালাগান, কোথাও যাত্রাগান, কোথাও সাংস্কৃতিক উৎসব ও মেলা। এসব বাংলাদেশের মানুষের সামাজিক ঐকভূমি নিয়ে জীবনকে প্রবহমান রাখছে যুগ যুগ ধরে।
কবিরা তার দেশ, প্রকৃতি ও ঋতু অনুভব করেন—তাদের অনুভূতি দিয়ে, অভিজ্ঞতা দিয়ে ও প্রজ্ঞা দিয়ে। এ-কারণে কবিতা হয়ে ওঠে শব্দের দ্যোতনায় পাঠকের কাছে সুখপ্রদ ও চৈতন্যআশ্রয়ী এক শিল্প। আমরা যদি আমাদের ঋতুর বৈভব ও বিভিন্ন অনুষঙ্গ অনুভব করতে যাই—তাহলে বাংলা কবিতার কাছে যেতে হবে। আমি এই শীতে বেশকিছু শীতের কবিতার কাছে গিয়ে এক ভিন্ন ভূগোল পেয়েছিলাম, তারই ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন ভূ-ভাগ তুলে ধরছি।
সেই চর্যাপদের এক কবি লিখেছেন :
‘করুণা মেহ নিরন্তর ফরিয়া
ভাবাভাব দুংদুল দুলিআ।’ (কবি ভুসুকুপাদালাম)
আধুনিক বাংলায় রূপান্তর করা হয়েছে এভাবে :
‘ভাব-অভাবের কুয়াশা দলিত করে করুণা মেঘ
নিরন্তর স্ফুরিত হচ্ছে।’
মধ্যযুগের বাংলা কবিতায় শীতের ব্যঞ্জনা পাই এভাবে :
‘শিশিরক অন্তরে আওয়ে বসন্ত।’
এখনকার বাংলায় তা হয়ে এমন :
‘শীতকালের পর বসন্ত আসে।’
‘চণ্ডিমঙ্গল’ কাব্যে কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী লিখেছেন শীতসময়ের কথা, যেমন :
‘শুনো দুঃখের কাহিনী শুনো দুঃখের কাহিনী
পুরান দোপাটা গায়ে দিতে করি পানি
পউষে প্রবল শীত সুখী যগজন।
তুলি পাড়ি পাছড়ি শীতের নিবারণ
হরিণী বদলে পাই পুরান খোসলা।’
মাইকেল মধুসূদন দত্ত-র ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যে খুঁজে পাই এক ভিন্নমাত্রার শীতের কাব্য-সুষমা :
‘আলু থালু হায়, তবে কবরীবন্ধন!
আভরণহীণ দেহ, হিমানীতে যথা
কুসুমরতন-হীন বন-সুশোভিনী
লতা!’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় বাংলাদেশের বিভিন্ন ঋতুর অনুষঙ্গ এসেছে বৈচিত্র্যের সাথে। বাংলাদেশের প্রকৃতির বন্দনা তাঁর কবিতায় বিভিন্নভাবে প্রাণ পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘চিত্রা’ কাব্যগ্রন্থের ‘সিন্ধুপারে’ কবিতায় লিখেছেন :
‘পউষ প্রখরে শীতে জর্জর, ঝিল্লিমুখর রাতি
নিদ্রিত পুরী, নির্জন ঘর, নির্বাণদীপ বাতি।’
কিংবা ‘শীতে ও বসন্তে’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ শীতের স্পর্শমান কাঁপুনির কথা বলেছেন, এভাবে :
‘প্রথম শীতের মাসে
শিশির লাগিল ঘাসে,
হু হু করে হাওয়া আসে,
হি হি করে কাঁপে গাত্র।
কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় :
‘পউষ এলো গো!
পউষ এলো অশু-পাথার হিম-পারাবার পারায়ে।
ঐ যে এলো গো—
কুজ্ঝটিকায় ঘোমটা-পরা দিগন্তরে দাঁড়ায়ে।’
শীতের কত কবিতা লিখেছেন কবিরা, ভিন্নভিন্ন আদলে, আঙ্গিকে ও বোধভাষ্যি নিয়ে। বিষ্ণু দে-র কবিতায় প্রতীকী ব্যঞ্জনায় শীতের শব্দমালা পায় ভিন্নমাত্রা :
‘হিমের হাওয়া বয়ে তো গেল
দোঁহার মাঝে।
নীলোৎপল হয়েছে আজ কাঠগোলাপ।’
জীবনানন্দ দাশের কবিতায় শীতের কুয়াশা, রোদ, শিশির, ভেজাঘাস আরো অনেক শীতের অনুষঙ্গ বিভিন্নভাবে এসেছে, যা অন্য কবিদের কবিতায় ততটা দেখা যায় না। জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কবিতায় আমরা পাই এমন পঙ্ক্তি :
‘সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;’
তাঁর ‘শঙ্খমালা’ কবিতায় উপমা নিয়ে শীত :
‘বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যথিত তোমার দুই চোখ
খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি—কুয়াশার পাখনায়—’
কবি সমর সেনের কবিতায় নগরজীবন রয়েছে এক মূল বিষয় হিসেবে, আর সেই জীবনের ক্লান্তি, বেদনাহত ক্লেদ ও বিভিন্ন অনুষঙ্গ এসেছে। একই পাটাতনে লেখা তার ‘মৃত্যু’ নামের কবিতাটি :
‘সূর্য অস্ত গেল, সূর্যদেব কোন দেশে—
এখানে সন্ধ্যা নামল,
শীতের আকাশে অন্ধকার ঝুলছে শূকরের চামড়ার মতো,
গলিতে গলিতে কেরোসিনের তীব্র গন্ধ
হাওয়ায় ওড়ে শুধু শেষহীন ধূলোর ঝড়;
এখানে সন্ধ্যা নামল শীতের শকুনের মতো।’
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য শোষণ ও শৃঙ্খল-মুক্তির দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে শ্রমজীবী মানুষের সংবেদনায় কবিতা লিখেছেন, তারই প্রতিভাস ‘প্রার্থী’ নামক কবিতায় :
‘হে সূর্য! শীতের সূর্য!
হিম শীতল সুদীর্ঘ রাত তোমার প্রতীক্ষায়
আমরা থাকি
যেমন প্রতীক্ষা করে থাকে কৃষকের চঞ্চল চোখ
ধান কাটার রোমাঞ্চকর দিনগুলির জন্য।’
আর কবি শামসুর রাহমানের কবিতায় এসে শীতের অস্তিত্ব পাই অন্য এক অনুভবে :
‘একদার কুয়াশায় লীন কোনো পৌষের হিমেল
রাত আজো অস্তিত্বের গীর্জের চূড়োয়
ঝরায় শিশির কণা।’
(শীতরাত্রির সংলাপ)
কবি আহসান হাবীব তাঁর ‘শীতের সকাল’ কবিতায় এক ভিন্ন চিত্রকল্পে শীতের ছবি টেনে এনেছেন :
‘রাত্রিশেষ!
কুয়াশায় ক্লান্ত শীতের সকাল—
পাতার ঝরোকা খুলে ডানা ঝাড়ে ক্লান্ত হরিয়াল।’
কবি শহীদ কাদরী শীতের শব্দ টেনে এনে মানবিকতার বন্ধনকে কবিতায় প্রাণ দিতে কুণ্ঠিত হন না, বরং সামাজিক জীবনকে সংহত করার জন্য কাব্যশক্তিকে অভিজ্ঞতায় ও কাব্য-সুষমায় উজ্জ্বল করেন :
‘অথচ এ-শীতে একা, উদ্ধত আমি,
আমি শুধু পোহাই না ম্লান রোদ
...
নিয়ত উত্তাপ দেই বন্ধু পরিজনে।’
(এইশীতে)
শীতের সময়ে উল্লিখিত কবিসহ অন্যান্য কবিদের শীতের কবিতা পড়তে পড়তে মনে হয়—কী এক জাদুকরী প্রতিভাসে শীতের অনুষঙ্গ টেনে এনেছেন কবিরা, কাব্যের শিল্পশর্তে কবিতাকে করেছেন সমৃদ্ধ, আর তা থেকে পাঠক হিসেবে আমরা বিভিন্ন বোধের সাজুয্যে পেয়ে যাই আমাদের শীত, স্বদেশ ও জীবন।