‘বাঙালি দেখিয়েছে, তারা মানুষ’
মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় গণমাধ্যমের অবিস্মরণীয় ভূমিকা অনালোচিত থাকলে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসচর্চা পূর্ণতা পাবে না। ভারতীয় গণমাধ্যমের অনন্য সেই ভূমিকা কেবল সেদেশের জনমতকেই প্রভাবিত করেনি, বিশ্ব জনমত গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমের স্মরণীয় সেই ভূমিকা অন্বেষণ করেছেন ইতিহাস গবেষক ও সাংবাদিক আশরাফুল ইসলাম। ইতিহাসের অংশ হয়ে যাওয়া বিরল এসব তথ্য নিয়ে ‘ভারতীয় গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে বার্তা২৪.কম-এ।
আমরা যদি দৃষ্টিপাত করি, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পূর্বের দিনগুলির দিকে; সেখানে দেখব ভারতীয় গণমাধ্যম নির্মোহভাবে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের জনগণের হৃদয়ের আকুতিকে চমৎকার ভাবে তুলে ধরেছে। আমরা দেখতে পাবো, বাঙালির অবিসংবাদিত পুরুষ মুজিবের আত্মপ্রকাশের প্রতিটি স্তরকে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো কি গুরুত্বের সঙ্গে নানা আঙ্গিকে তুলে ধরছে!
কেবল সংবাদ আয়োজনে নয়, সম্পাদকীয় পর্যবেক্ষণে, উপসম্পাদকীয় নিবন্ধে, এমনকি বিজ্ঞানপণচিত্রেও উৎকীর্ণ হয়েছে মুজিব বন্দনা। বাঙালি অধ্যুষিত পশ্চিমবঙ্গ কিংবা পার্শ্ববর্তী ভারতের প্রদেশসমূহের সংবাদপত্রই নয়, রাজধানী দিল্লিসহ সব প্রদেশের সংবাদপত্রেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টাকে অকুণ্ঠ সমর্থন যোগায়। সর্বভারতীয় স্তরে জনমানসে বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের প্রশ্নে যে ব্যাকুলতা সৃষ্টি হয়েছিল তার পেছনে বোধহয় সেই সময়কার গণমাধ্যমের অবিস্মরণীয় অবদানকেই সর্বাগ্রে এগিয়ে রাখতে হবে।
ভারতীয় গণমাধ্যমের চিত্রিত দৃশ্যে আমরা দেখতে পাবো, বঙ্গবন্ধু শুধু পূর্ববঙ্গে বা পূর্বপাকিস্তানেই অবিসংবাদিত ছিলেন না; গোটা উপমহাদেশবাসীর কাছেই তাঁর সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা ছিল। আমরা যদি ফিরে তাকাই ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালের ভারতীয় গণমাধ্যমের দিকে, দেখব বঙ্গবন্ধু কতটা প্রিয় ছিলেন ভারতের জনগণের কাছে।
দেখতে পাবো সেইসময়কার দৈনিকগুলোর শীর্ষ খবরে যেভাবে ঠাঁই পেয়েছিলেন বাংলাদেশের জনক-তাতে প্রতীয়মান হয়নি তিনি অন্য কোনো দেশের একজন নেতা। কেবল স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সময়েই নয়, স্বাধীনতাপূর্ব ও পরবর্তী সময়গুলোতেও শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে উঠেন ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রধান শিরোনামের বিষয়। দৃষ্টিপাত করব তেমনি কিছু প্রতিবেদনের দিকে। অবিস্মরণীয় ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠা সেসব প্রতিবেদন বাঙালি জাতির জনককে প্রজন্মের কাছে নতুনরূপে মূল্যায়নের সুযোগ করে দেবে।
অশোককুমার সেন সম্পাদিত কলকাতার প্রভাবশালী দৈনিক বসুমতীর ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি সংখ্যা। বাঙালির মহানায়কের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের খবরে পরিপূর্ণ সেদিনের সংখ্যাটি। সেদিনের প্রধান শিরোনাম ‘বঙ্গপিতার সম্বর্দ্ধনায় ঢাকা উত্তাল’। পাশেই সিঙ্গেল কলামে ‘এক মর্মস্পর্শী পুনর্মিলন’ শিরোনামে বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ অনিশ্চিত কারাবাসের পর স্বজনদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার আবেগমথিত বর্ণনা।
প্রথম পাতায় দুই কলামে রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে উদ্ধৃত করে দৈনিকটি প্রকাশ করেছে ‘বাঙালি দেখিয়েছে, তারা মানুষ’ শীর্ষক প্রতিবেদন। প্রধান শিরোনামে দৈনিকটি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশের মাটিতে পা দেবার সেই দিনটির প্রতিটি ক্ষণের অনুপুঙ্খ বিবরণ মুদ্রিত করেছে অসাধারণ ব্যঞ্জনায়।
অনন্য সেই প্রতিবেদন
‘অভাগিনী বাংলা মায়ের আজ বড় আনন্দের দিন। সোনার বাংলার কোলে তার দামাল ছেলে অজেয় মুজিব ফিরে এসেছে। ভারতীয় উপমহাদেশের ৬২ কোটি মানুষের অভিনন্দনের জয়টিকা আজ তার ললাটকে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করে তুলেছে। গোটা বাংলাদেশে আজ যেন আলোকবন্যা নেমে এসেছে। তার নবজীবনের প্রাণপুরুষের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে শুভ পদার্পণের লগ্নে যৌবনের জোয়ারে শুধু ঢাকা নয়, চট্টগ্রাম থেকে রংপুর সমস্ত বাংলা যেন আজ প্রমত্তা। জীবনসিন্ধু মন্থন করে অমৃতের সন্ধান যে মিলিয়ে দিয়েছে, সেই চিরপুরাতন বঙ্গবন্ধুর নবআবির্ভাবে বাঙালি আজ চিত্ত উজাড় করে বন্দনা করছে। ঢাকা আজকের যুগের অযোধ্যা।’
পত্রিকার পৃষ্ঠায় উৎকীর্ণ সেই প্রতিবেদনে তখনকার সাংবাদিকরা কী আবেগ দিয়ে মূর্ত করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর কলকাতার সফরকে! সেই প্রতিবেদনের পরবর্তী অংশে লেখা হচ্ছে, ‘কারাগার থেকে যুগপুরুষের মুক্তি ছিনিয়ে আনা হয়েছে বলে উচ্ছ্বাস অফুরন্ত, আবেগ কানায় কানায়। জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে, পথে-প্রান্তরে, গৃহে-কাননে আজ অভূতপূর্ব কল্লোল। সারা বাংলার হৃদয় আজ উপড়ে অর্ঘ্য হিসেবে নিবেদিত হয়েছে। পদ্মা-মেঘনা-বুড়িগঙ্গার তুফানেও সোনার বাংলার সোনার ছেলের আগমনীর কলতান।’
‘কাল থেকে ঢাকায় শুধু মানুষ আর মানুষ। ট্রেনে, নৌকায়, এমনকি পায়ে হেটে মানুষ ঢাকায় এসেছে। শিশু, নারী, যুব, বৃদ্ধ কেউ বাদ যায়নি। পথই আজ প্রধান্য পেয়েছে। এসেছে চাষী, এসেছে মজুর, এসেছে জেলে, এসেছে জোলা, এসেছে কামার, এসেছে কুমোর, এসেছে শাঁখারী, এসেছে কারিগর, দোকানী, রিকশাওয়ালা, ফেরিওয়ালা সবাই আজ এসেছে। সরকার ছুটি ঘোষণা করেছেন। এত মানুষ, কিন্তু তবু শৃঙ্খলা রাখার চেষ্টায় অন্ত নেই। যার রথচক্রের চিহ্ন অনুসরণ। ফুল, মালা আর পতাকা। বাজী-তোপ-আলো। গোটা বাংলা আজ বেপরোয়া। কি দিয়ে কি নিয়ে আনন্দের প্রকাশ করবে তার কোনও ঠিকানা নেই। পথ-প্রান্তর মাটিই যেন আজ সবাইকে পেয়ে বসেছে। মুজিব আসার পর থেকে এই অবস্থা। সারা রাত আজও বোধহয় সবাই এভাবেই কাটাবে। ঢাকার সাথে সাথে পদ্মার এপার ওপার দু’পারের মানুষ যেন আজ বলছে,
‘‘ওরে যাব না আজ ঘরে রে
ভাই যাব না আজ ঘরে
ওরে আকাশ ভেঙে বাহিরকে
আজ নেব রে লুঠ করে’’।
(চলবে...)