কারার ঐ লৌহ কপাট: সৃষ্টি-বিকৃতির ইতিবৃত্ত



নাজমুল হাসান
কারার ঐ লৌহ কপাট: সৃষ্টি-বিকৃতির ইতিবৃত্ত

কারার ঐ লৌহ কপাট: সৃষ্টি-বিকৃতির ইতিবৃত্ত

  • Font increase
  • Font Decrease

১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাস অনুযায়ী বাংলা ১৩২৮ সালের অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম মাত্র ২২ বৎসর ৬ মাস বয়সে আড্ডার ফাঁকে একটুখানি সময়ের মধ্যে ‘ভাঙার গান’ শিরোনামে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ কবিতাটি গানের সুরে রচনা করেন। 'ভাঙার গান' শিরোনামেই কবিতাটি 'বাঙ্গলার কথা' পত্রিকার ২০ জানুয়ারি ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দ অনুযায়ী বাংলা পৌষ-মাঘ ১৩২৮ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়। কবিতা হলেও এটি ছিল মূলত একটি বিদ্রোহাত্মক গান; কবিতাটির শিরোনামের মধ্যেই সেটি প্রকাশ পেয়েছে।

১৯২৪ সালের আগস্ট মাস অনুযায়ী বাংলা ১৩৩১ সালে ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকার আষাঢ়-শ্রাবণ সংখ্যায় কবিতাটির সাথে আরও ১০টি কবিতা যোগ করে মোট ১১টি কবিতা নিয়ে ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের দুই মাস পর ১১ নভেম্বর ১৯২৪ তারিখে তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারত শাসনাধীন বঙ্গীয় সরকার গ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত ও নিষিদ্ধ করে। ব্রিটিশ সরকার আর কখনো এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেনি। ফলে পরাধীন ব্রিটিশ-ভারতে গ্রন্থটি আর প্রকাশিত হতে পারেনি। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর ১৯৪৯ সালে স্বাধীন ভারতে ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়।

পটভূমি:

১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে গান্ধীজীর নেতৃত্বে ভারতবর্ষে সত্যাগ্রহ আন্দোলন চলাকালীন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সম্পাদনায় 'বাঙ্গলার কথা' নামক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটির সহকারী সম্পাদক ছিলেন হেমন্ত কুমার সরকার। ব্রিটিশ বিরোধী এই সত্যাগ্রহ আন্দোলন দমনের জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারত সরকার ব্যাপকভাবে তরুণদেরকে গ্রেপ্তার করতে থাকে। 'বাঙ্গলার কথা' পত্রিকায় স্বদেশী ভাবপুষ্ট লেখা প্রকাশের জন্য ব্রিটিশ-ভারতের পুলিশ ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ১০ ডিসেম্বর চিত্তরঞ্জন দাশকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠায়। ওই সময় 'বাঙ্গলার কথা' পত্রিকার হাল ধরেন চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী শ্রীযুক্তা বাসন্তী দেবী।

একদিন বাসন্তী দেবী 'বাঙ্গলার কথা' পত্রিকায় প্রকাশের জন্য একটি কবিতা লিখে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে দাশ পরিবারের সুকুমাররঞ্জন দাশকে নজরুল ইসলামের কাছে পাঠান। এ সময়ে নজরুল ইসলাম ও কমরেড মুজাফফর আহমদ কলকাতার ৩/৪ সি, তালতলা লেনের একটি বাড়ির নিচ তলায় একই রুমে ভাড়া থাকতেন। 'ভাঙার গান' শীর্ষক এই গানটি সম্পর্কে কমরেড মুজাফফর আহমদ তাঁর 'কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা'-তে লিখেছেন- "আমার সামনেই দাশ-পরিবারের শ্রী সুকুমাররঞ্জন দাশ 'বাঙ্গলার কথা'র জন্য একটি কবিতা চাইতে এসেছিলেন। শ্রীযুক্তা বাসন্তী দেবী তাঁকে কবিতার জন্যে পাঠিয়েছিলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ তখন জেলে। সুকুমাররঞ্জন আর আমি আস্তে আস্তে কথা বলতে লাগলাম।‌ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নজরুল তখনই কবিতা লেখা শুরু ক'রে দিল। বেশ কিছুক্ষণ পরে নজরুল আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে তাঁর সেই মুহূর্তে রচিত কবিতাটি আমাদের পড়ে শোনাতে লাগল।”

পড়া শেষ করে কাজী নজরুল ইসলাম কবিতাটি সুকুমাররঞ্জন দাশের হাতে দেন, যা 'বাঙ্গলার কথা' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বাসন্তীদেবীর অনুরোধে পরবর্তীতে নজরুল ইসলাম কবিতাটি সুরারোপ করে সে গানের স্বরলিপিও তাঁর কাছে পাঠিয়ে দেন বলে জানা যায়। ফলে এ গানের সুরকার নজরুল ইসলাম নিজেই। এই কবিতাটি লেখার দুই/তিন সপ্তাহ আগে ওই বাড়িতে থাকার সময়েই কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কালজয়ী ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি রচনা করেন। চিত্তরঞ্জন দাশ হুগলী জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় তিনিসহ সেখানে বন্দি থাকা অন্যান্য স্বদেশী আন্দোলনের বন্দিরা একত্রে কোরাস আকারে কাজী নজরুল ইসলামের দেওয়া সুরে সর্বপ্রথম ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটি জেলখানার ভিতরেই গেয়েছিলেন।

ব্রিটিশ রাজরোষের কারণে কাজী নজরুলের লেখা যুগবাণী, বিষের বাঁশি, ভাঙ্গার গান, প্রলয় শিখা ও চন্দ্রবিন্দুসহ মোট ৫টি গ্রন্থ ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে। বাংলা সাহিত্যে সমকালীন অন্য কোনো কবি বা সাহিত্যিকের এত গ্রন্থ একত্রে কখনো বাজেয়াপ্ত হয়নি। ১৯২২ সালে নজরুল 'ধূমকেতু' নামের একটি পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন। ১২ সেপ্টেম্বর ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ধূমকেতু'র দ্বাদশ সংখ্যায় 'আনন্দময়ীর আগমন' নামে নজরুলের একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। কবিতাটি ব্রিটিশ শাসকদের ভিত কাঁপিয়ে দেয়। ফলে এই কবিতায় নজরুলের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম রাজদ্রোহের মামলা হয়। একই বছরের ৮ নভেম্বর রাজদ্রোহের অপরাধে নজরুলের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়।

দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত নজরুলের বিচার হয়েছিল কলকাতার আলীপুর চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে। পরবর্তীতে এ মামলার রায়ে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১০ জানুয়ারি নজরুল এক বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। রায় ঘোষণার পরেরদিন তাকে আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

নজরুল ইসলামকে ২৩ নভেম্বর ১৯২২ থেকে ১৫ ডিসেম্বর ১৯২৩ এই এক বছর জেলে রাখা হয়। জেল-জীবনে কয়েদিদের সঙ্গে কোরাস কণ্ঠে তিনি বহুবার এ গানটি গেয়েছেন। যদিও সে গানের কোনো রেকর্ড নাই। পরবর্তীতে গিরীন চক্রবর্তীর গাওয়া এ গানটি সর্বসাধারণের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে। গিরীন চক্রবর্তীর গাওয়া সুরই ছিল নজরুল ইসলামের নিজের করা সুর।

মূলভাব:


‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটি ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ-বিরোধী বিপ্লবীদের জন্য একটি উদ্দীপনামূলক গান। গানটির মাধ্যমে কবি যে দ্রোহের প্রকাশ করেছেন তা হলো—প্রতিবাদ-ধ্বংসের মধ্য দিয়েই জাগ্রত হবে পরাধীন ভারতে স্বাধীনতার নতুন পতাকা, স্বাধীনতার নতুন সূর্য স্বাধীন জাতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে আলো ছড়াবে। গানটির মাধ্যমে নজরুল তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের আহ্বান জানিয়েছিলেন। বিপ্লবীদের মনে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন পরাধীনতার বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন হওয়ার আমিয় বাণী।

কবিতাটির প্রকাশ সংক্রান্ত ইতিহাস:
১. পত্রিকা: বাঙলার কথা, শিরোনাম: ভাঙার গান, ২০ জানুয়ারি, ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দ, শুক্রবার, ৭ মাঘ ১৩২৮।
২. কাব্যগ্রন্থ: ভাঙার গান, প্রথম সংস্করণ- শ্রাবণ ১৩৩১ বঙ্গাব্দ, আগস্ট ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দ, কবিতার শিরোনাম ‘ভাঙার গান’। দ্বিতীয় সংস্করণ- ন্যাশনাল বুক এজেন্সি লিমিটেড, ১২ বঙ্কিম স্ট্রিট, কলিকাতা- ১২। খ্রিষ্টাব্দ ১৯৪৯ । কবিতার শিরোনাম ‘ভাঙার গান’ (গান) ১। পৃষ্ঠা: ১-২।
৩. নজরুল-রচনাবলী। জন্মশতবর্ষ সংস্করণ। প্রথম খণ্ড। বাংলা একাডেমি, ঢাকা। ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৩/মে ২০০৬। ভাঙার গান। গান-১। পৃষ্ঠা: ১৫৯-১৬০।

গানটির রেকর্ড সংক্রান্ত ইতিহাস:
১. Columbia Records- কলাম্বিয়া রেকর্ডস, প্রখ্যাত রেকর্ড কোম্পানি কলাম্বিয়া’র তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত রেকর্ড। জুন ১৯৪৯, জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় ১৩৫৬, জি.ই. ৭৫০৬। শিল্পী: গিরীন চক্রবর্তী।
২. এইচএমভি (HMV), হিজ মাস্টার’স ভয়েস- His Master's Voice, জানুয়ারি ১৯৫০, পৌষ-মাঘ ১৩৫৬, এন. ৩১১৫২। শিল্পী: গিরীন চক্রবর্তী।
৩. ২০০৬ সালের মার্চ মাস জুড়ে বিবিসি বাংলার শ্রোতারা ভোট দিয়ে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কুড়িটি বাংলা গানের যে তালিকা করেছে তার মধ্যে ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানটি ১৬তম।

গানটির চলচ্চিত্রে রূপদান সংক্রান্ত ইতিহাস:

১. চলচ্চিত্র: চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন। কাহিনীকার- চারুদত্ত। চিত্রনাট্যকার এবং পরিচালক- নির্মল চৌধুরী। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে বেঙ্গল ন্যাশনাল স্টুডিওর ব্যানারে চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ নভেম্বর, রবিবার ১১ অগ্রহায়ণ ১৩৫৬। গানটির চলচ্চিত্রের স্বরলিপিকার ও স্বরলিপিতে করেছিলেন- রশিদুন্‌ নবী। নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপি (বিংশ খণ্ড)। কবি নজরুল ইন্সটিটিউট, পঞ্চম গান। শিল্পী: গিরীন চক্রবর্তী ও সহ-শিল্পীবৃন্দ। সুরকার: কাজী নজরুল ইসলাম।
পর্যায়: বিষয়াঙ্গ- স্বদেশ, সুরাঙ্গ- সামরিক মার্চ, তাল- দ্রুত দাদরা, গ্রহস্বর: সা।
লিঙ্ক: চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন https://www.youtube.com/watch?v=F1StxYnf-yU

২. চলচ্চিত্র: জীবন থেকে নেয়া। জহির রায়হান নির্মিত শেষ কাহিনী চিত্র। চলচ্চিত্রটি ১৯৭০ সালের এপ্রিলে মুক্তি পায়। সঙ্গীত পরিচালক ও সঙ্গীত শিল্পী: খান আতাউর রহমান। শিল্পী: অজিত রায়, খন্দকার ফারুক আহমেদ ও অন্যান্য। চলচ্চিত্রটি সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন। বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা আলমগীর কবির এই চলচ্চিত্রকে ‘বাংলাদেশের প্রথম জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী চলচ্চিত্র’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
লিঙ্ক: জীবন থেকে নেয়া https://www.youtube.com/watch?v=4gOJVlb_9-A

‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ এবং ‘জীবন থেকে নেয়া’ উভয় চলচ্চিত্রেই শিল্পী গিরীন চক্রবর্তী এবং অজিত রায় ও খন্দকার ফারুক আহমেদ গানটিকে কাজী নজরুল ইসলামের সুরে গেয়েছেন। দুটি চলচ্চিত্রের গানের সুরের মধ্যে সামান্য একটু ভিন্নতা থাকলেও উভয় ক্ষেত্রেই গানটির বিপ্লবী মূলভাব ফুটে উঠেছে। চেতনার সাথে মিল রেখে ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে গানটিকে বেশি প্রাণবন্ত মনে হয়েছে। মূল গানটি জেলখানায় বসে কয়েদিরা কোরাস কণ্ঠে গেয়েছিলেন বলে দুটি চলচ্চিত্রেই গানটিকে জেলখানার কয়েদিদের দ্বারা কোরাস কণ্ঠে গাওয়ানো হয়েছে।

কবিতাটির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

কারার ঐ লৌহকপাট,
ভেঙ্গে ফেল, কর রে লোপাট,
রক্ত-জমাট
শিকল পূজার পাষাণ-বেদী।


ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

এখানে ‘কারা’ মানে কারাগার, তৎকালীন পরাধীন ব্রিটিশ-ভারতের যে কারাগারে স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনরত তরুণ বিপ্লবী বীরদের গ্রেপ্তার করে আটক করে রাখছিল। সেই কারাগারের শক্ত লোহার দরজা তথা লৌহকপাট ভেঙে ফেলে তাকে লোপাট অর্থাৎ ভেঙেচুরে গুড়িয়ে ধূলিসাৎ করে ফেলার আহ্বান জানানো হয়েছে।

‘পূজার বেদী’ হলো যেখানে পূজা করা হয়, সে শ্রদ্ধা-সম্মানের স্থান। পূজার বেদীতে মানুষের মনের গভীর থেকে উঠে আসা পরম ভক্তির আবেগ মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকে। কবি এখানে স্বদেশকে পূজার বেদীর সাথে তুলনা করেছেন। যে পূজার বেদীতে ফুলের শ্রদ্ধার্ঘ্য থাকার কথা সে বেদীতে আজ ব্রিটিশ সরকার দ্বারা অত্যাচারিত ভারতের বীর সন্তান, স্বাধীনতাসংগ্রামী, বিপ্লবীদের রক্ত জমাট বেঁধে আছে, সে বেদীতে আজ পরাধীনতার শিকল পরানো। এ বেদী আজ বেদী নেই, একে নির্মমতার পাষাণে পরিণত করা হয়েছে। এ শিকল ভেঙে, জমাটবাঁধা রক্ত সরিয়ে পাষাণময় পূজার বেদীকে মুক্ত করে মায়াময় ও পবিত্র করতে হবে, অর্থাৎ পরাধীন দেশের শোষণ-নির্যাতন থেকে দেশকে মুক্ত-স্বাধীন করে তাকে উপভোগ্য ও আত্মনির্ভর করতে হবে।

ওরে ও তরুণ ঈশান!
বাজা তোর প্রলয় বিষাণ!
ধ্বংস নিশান
উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি।

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

ঈশান শব্দের অর্থ শিব, মহাদেব, মহেশ্বর। এর আরেকটা অর্থ উত্তরপূর্ব কোণ। হিন্দুমতে শিব প্রলয়ের দেবতা এবং ধ্বংসের রাজা বা নটরাজ। এখানে কবি ‘তরুণ ঈশান’ বলতে শিবশক্তির প্রলয়ের সাথে তুলনীয় ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামী তরুণ বীর সন্তান ও বিপ্লবীদের বুঝিয়েছেন। ‘প্রলয়’ অর্থ ধ্বংস, ‘বিষাণ’ শব্দের অর্থ শিঙা। ইসলামি মতে ইসরাফিল শিঙায় ফু দিলে যেভাবে পৃথিবীর প্রলয় বা ধ্বংস শুরু হবে সেভাবে পরাধীন ভারতবর্ষের স্বাধীনতাকামী তরুণ বীর সন্তানদেরকে তাদের ‘প্রলয় বিষাণ’ বাজানোর আহ্বান জানিয়েছেন। স্বাধীনতাকামী তরুণ বীর সন্তানদের সক্ষমতাকে কবি প্রলয়ের দেবতা মহাদেবের মহাশক্তির সাথে তুলনা করে তাদেরকে পরাধীনতার শিকল ভাঙতে প্রলয় বিষাণ বাজানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

‘নিশান’ মানে পতাকা,‘ধ্বংস নিশান’ মানে যে পতাকা ধ্বংসের প্রতীক, ধ্বংসের নির্দেশনা দেয়। ‘প্রাচীর’ অর্থ দেওয়াল, ‘ভেদি’ মানে ভেদ করা বা ভেঙে-ফুড়ে বেরিয়ে আসা। কবি স্বাধীনতাকামী তরুণ বীর সন্তানদেরকে এমনভাবে ‘ধ্বংস নিশান’ বা ধ্বংসের পতাকা ওড়াতে বলেছেন যেন তা স্বাধীনতাকামী সূর্যসন্তানদেরকে যে কারাগারে আটক রেখেছে সে কারাগার ভেদ করে ফুড়ে বেরিয়ে আসে, পরাধীনতার প্রাচীর বা দেওয়াল ভেদ করে মাথা উঁচু করে বেরিয়ে আসে। সে পতাকা দেখে যেন সমগ্র পরাধীন ভারতবাসী স্বাধীন-মুক্ত হবার লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ হয়।


গাজনের বাজনা বাজা!
কে মালিক? কে সে রাজা?
কে দেয় সাজা
মুক্ত স্বাধীন সত্যকে রে?

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

‘গাজন’ সনাতনধর্মীদের একটা সামাজিক উৎসবের নাম। চৈত্র মাসের শেষ দিকে ঢাক, ঢোল, কাঁসর, বাঁশি ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্রের মিলিত বাজনা বাজিয়ে গাজন উৎসব পালন করা হয়। মিলিত বাদ্যযন্ত্রের বাজনা বাজায় গাজন উৎসবের বাজনা খুব প্রকট হয়। কবি এখানে গাজনের বাজনার মতো প্রবল শব্দে বাজনা বাজিয়ে লড়াইয়ে নেমে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীন হওয়ার তীব্র আহ্বান জানিয়েছেন।

কবি এখানে ব্যঙ্গ করে ব্রিটিশ শাসকদের স্বরূপ প্রকাশ করার নিমিত্তে পরাধীন ভারতবাসীকে প্রশ্ন করেছেন—কে মালিক, কে রাজা, কে সাজা দেয়, কে মুক্ত, কে স্বাধীন, কে সত্য? অর্থাৎ ওরা বিদেশি, ভিনদেশি, ওরা আমাদেরকে শাসন করার অধিকার রাখে না। এ দেশ আমাদের, এ দেশের মালিক আমরা, এ দেশের রাজা আমরা, এখানে আমরা মুক্ত-স্বাধীন, এখানে আমাদেরকে কেউ সাজা দেওয়ার অধিকার রাখে না। এখানে আমরাই সত্য, ওই ব্রিটিশরাই এখানে মিথ্যা। ওরা মিথ্যার উপরে দাঁড়িয়ে আমাদের সত্যকে মিথ্যায় পরিণত করতে পারে না।

হা হা হা পায় যে হাসি,
ভগবান পরবে ফাঁসি!
সর্বনাশী
শিখায় এ হীন তথ্য কে রে!

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

ভগবান মানে সর্বশক্তিমান, সর্বমুক্তমান, সর্বমালিক মহাশক্তি। কবি এখানে ভগবান বলতে এ দেশের সাধারণ মানুষ বিশেষ করে স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী বীরদের বুঝিয়েছেন। তারাই এ দেশের মালিক। ভগবানকে যেমন বন্দি রাখা অসম্ভব, ভগবানকে যেমন বন্দি করা অসম্ভব, ভগবানকে যেমন বেঁধে রাখা তথা ফাঁসি দেওয়া অসম্ভব, ভগবানকে যেমন ধ্বংস করা অসম্ভব—তেমনি এ দেশের স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী বীর, যারা এ দেশের মালিক তাদেরকেও বেঁধে রেখে তথা বন্দি রেখে ফাঁসির দড়ি পরানো অসম্ভব। সুতরাং এই বীরদেরকে জেলে আটকে রেখে তাদের গলায় ফাঁসির দড়ি দেওয়ার যে পায়তারা ব্রিটিশরা করছে তা দেখে কবির হা হা হা কোরে অট্টহাসি পাচ্ছে। কারণ, স্বাধিকারের জন্য যেভাবে প্রতিরোধ-সংগ্রাম চলছে তাতে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে ভগবান অর্থাৎ এ দেশের বিপ্লবী-বীরদেরকে ফাঁসি দেওয়া অসম্ভব।

ব্রিটিশ শাসকেরা বিপ্লবী-বীর ও স্বাধীনতাকামী ভারতীয়দেরকে প্রচণ্ড শাস্তি দেওয়ার কথা প্রচার করে মানুষকে বিপ্লব-বিরোধী করার চক্রান্তে লিপ্ত ছিল। তাদের এ চক্রান্তে যাতে মানুষ ভয় পেয়ে বিভ্রান্ত না হয়ে যায় সে জন্য কবি প্রচণ্ড আস্থার সাথে প্রশ্ন রেখেছেন—বিপ্লবী-বীরদের ফাঁসি দেওয়া যায়, এমন হীন অর্থাৎ নীচ ও জঘন্য তথ্য কে শেখাচ্ছে? কে ছড়াচ্ছে এমন অসম্ভব কথা? অর্থাৎ কবি মানুষকে অভয় দিচ্ছেন যেন ব্রিটিশ শাসকদের এমন চক্রান্তে ভয় পেয়ে বা বিভ্রান্ত হয়ে মানুষ আন্দোলন থেকে সরে না যায়। কারণ, এই বিপ্লবী স্বাধীনতাকামী শক্তিকে আটকে রাখা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।


ওরে ও পাগলা ভোলা!
দে রে দে প্রলয় দোলা
গারদগুলা
জোরসে ধরে হেচ্‌কা টানে!

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

প্রলয় বা ধ্বংসের দেবতা এবং ধ্বংসের মাধ্যমে সৃষ্টির দেবতা দুটোই শিব বা মহাদেব। অর্থাৎ মহাদেব ইচ্ছে করলে যেমন সৃষ্টি করতে পারেন, তেমনি ইচ্ছে করলে আবার প্রলয় বা ধ্বংসও করতে পারেন; এটা নিতান্তই তাঁর খেয়াল। এজন্য শিবকে বলা হয় ‘পাগলা ভোলা’। কবি এখানে জেলখানায় বন্দি স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীদেরকে ‘পাগলা ভোলা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। কবির মতে ব্রিটিশ সরকার এই পরাধীন ভারতের পুরোটাকেই কারাগার বানিয়ে রেখেছে। ফলে এই কারাগারে বন্দি প্রতিটি মানুষই আসলে ‘পাগলা ভোলা’। পরাধীনতার কারাগারে বন্দি স্বাধীনতাকামী মানুষকে কবি আহ্বান করছেন তাঁরা যেন মহাশক্তিধর ‘পাগলা ভোলা’ তথা মহাদেবের ধ্বংস বা প্রলয় ক্ষমতার মতো ক্ষমতা প্রয়োগ করে পুরো ভারতবর্ষকে দোলা দিয়ে কাঁপিয়ে তাঁদের ক্ষমতার জানান দেয়। তাঁরা যেন এই কারাগার বা গারদের লোহার শিক জোরসে ধরে হেচ্‌কা টান দিয়ে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে মুক্ত হয়ে আসে।

মার হাঁক হায়দারী হাঁক,
কাঁধে নে দুন্দুভি ঢাক
ডাক ওরে ডাক,
মৃত্যুকে ডাক জীবন পানে!

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

‘হায়দার’ অর্থ শক্তিশালী, তরবারি বা সত্যের তলোয়ার। আব্রাহামিক ধর্মের শেষ নবি হজরত মোহাম্মদ (স.)-এর আপন চাচাত ভাই ও জামাতা ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলীর প্রচণ্ড শক্তি ও শৌর্য-বীর্য থাকার কারণে তাকে ‘হায়দার’ বলা হয়। ‘হাঁক’ শব্দের অর্থ হুংকার। কবি ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী ভারতবাসীকে হজরত আলীর সেই হায়দারী হাঁকের মতো প্রচণ্ড হুংকার দিয়ে ব্রিটিশরাজের ভিত কাঁপিয়ে পদানত করার আহ্বান জানিয়েছেন।

‘দুন্দুভি ঢাক’ হলো একপ্রকার বৃহৎ ঢাক বা দামামা জাতীয় প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র, রণবাদ্যবিশেষ। বন্দি-জীবন আসলে মৃতপ্রায়-জীবন; কবি বন্দিদশাকে মৃত্যুর সাথে তুলনা করেছেন এবং সেই মৃত্যুদশা থেকে জীবনকে মুক্ত করে স্বাধীন দেশে সজীব হয়ে গৌরবের সাথে বেঁচে থাকার জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন এবং সে সাহস সঞ্চার করেছেন।


নাচে ওই কালবোশাখী,
কাটাবি কাল বসে কি?
দে রে দেখি
ভীম কারার ঐ ভিত্তি নাড়ি!

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

বাংলা বৈশাখ মাস এবং এর কাছাকাছি মাসগুলোতে যে প্রচণ্ড ঝড় হয় তাকে ‘কালবোশাখী’ বলে। পরাধীন ভারতবাসীর মনের ভিতরে ব্রিটিশবিরোধী যে ভয়ঙ্কর আক্রোশ ক্রমাগত তোলপাড় করে চলেছিল তাকে কবি কালবোশাখীর সাথে তুলনা করেছেন। তিনি মুক্তিকামী দ্রোহী ভারতবাসীকে কালবোশাখীর ভয়ঙ্কর প্রলয় শক্তি নিয়ে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলছেন, এখন বৃথা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার সময় নয়। এভাবে কাল বা সময় হরণ করা খুবই অনুচিত। সময় নষ্ট না করে প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়ার এখনই সময়।

মহাভারতের কাহিনী অনুসারে ভীম হলো পঞ্চপাণ্ডবের দ্বিতীয় পাণ্ডব। ভীম অসম্ভব শক্তিশালী ছিলেন। ভারতবর্ষের বিপ্লবী বীরদের উপরে ব্রিটিশরাজ ভীমের শক্তি প্রয়োগ করে অত্যাচার-নির্যাতন করছে, তাদেরকে গ্রেপ্তার করে ভীমের মতো শক্তিশালী কারাগারে বন্দি করে রাখছে। কবি ভারতবাসীকে আহ্বান করছেন যেন তারা তাদের সংগ্রামী শক্তি প্রয়োগ করে ওই ‘ভীম কারা’ বা শক্ত কারাগারের ভিত্তি নাড়িয়ে দিয়ে তা উপড়ে ফেলে মুক্তি-সংগ্রামীদের মুক্ত করে আনে।

লাথি মার, ভাঙ্গরে তালা!
যত সব বন্দী শালায়-
আগুন-জ্বালা,
-জ্বালা, ফেল উপাড়ি।।

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

বল প্রয়োগ করে যারা ভারতবর্ষকে দখল করেছে তাদের কাছ থেকে নিজের অধিকার আদায়ের জন্য কবি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বিশ্বাসী নন, তিনি বল প্রয়োগের বিরুদ্ধে বল প্রয়োগ করেই অধিকার ছিনিয়ে আনতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বন্দিরা কবে মুক্তি পাবেন অথবা আদৌ পাবেন কি না সে অপেক্ষায় তিনি বসে থাকতে রাজি নন। তিনি জনগণের সম্মিলিত শক্তিকে একত্র করে এখনই শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সকল বন্দিশালা বা কারাগার ভেঙে সকল বন্দিকে মুক্ত করতে চান। এই শক্তি প্রয়োগকেই কবি ‘লাথি’র সাথে তুলনা করেছেন এবং মুক্ত হওয়াকে ‘তালা ভাঙা’র সাথে তুলনা করেছেন এবং বলেছেন “লাথি মার ভাঙ্গরে তালা”।

‘আগুন-জ্বালা,ফেল উপাড়ি’ শব্দগুলি দিয়ে কবি স্বদেশীদেরকে উদ্বুদ্ধ করছেন যেন তারা আন্দোলন-সংগ্রাম করে ব্রিটিশদের সকল অন্যায়, অবিচার, নির্যাতনকে ভারতবর্ষের মাটি থেকে চিরতরে উপড়ে ফেলেন, উচ্ছেদ করেন। এ দেশের মালিক হবে এ দেশেরই জনগণ, এ দেশকে শাসন করবে এ দেশেরই জনপ্রতিনিধি, ভারতবর্ষ হবে বিশ্বের বুকে স্বাধীন সার্বভৌম শোষণ-নির্যাতনমুক্ত দেশ।

গানটি বিকৃতির ইতিহাস:

রাজা কৃষ্ণ মেনন পরিচালিত, আরএসভিপি মুভিজ এবং রায় কাপুর ফিল্মস প্রযোজিত, ইশান খাট্টার, মৃণাল ঠাকুর, প্রিয়াংশু পাইনুলি ও সোনি রাজদান প্রমুখ অভিনীত ‘পিপ্পা’ ছবিটি ১০ নভেম্বর ২০২৩ সালে অ্যামাজন প্রাইম ভিডিওতে মুক্তি পায়। চলচ্চিত্রটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার যুদ্ধকে তুলে ধরেছে। ছবিটিতে নজরুলের গান 'কারার ঐ লৌহকপাট'-এর রিমেক করা হয়েছে। অস্কারজয়ী সুরকার এ আর রাহমানের রিমেক সংস্করণে গানটি গেয়েছেন ভারতীয় গায়ক রাহুল দত্ত, তীর্থ ভট্টাচার্য, পীযূষ দাস, শ্রায়ী পাল, শালিনী মুখার্জি ও দিলাসা চৌধুরী।

এ আর রাহমান বাংলা গান নিয়ে আগেও কাজ করেছেন। ‘নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস: আ ফরগটেন হিরো’ সিনেমার জন্য রবীন্দ্রসংগীত ‘একলা চলো রে’-এর সংগীতায়োজন তিনি করেছিলেন। এ ছাড়া ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’ গানটির সুরারোপও তিনি নিজের মতো করেছেন। তবে নজরুল সংগীত নিয়ে এটাই তাঁর প্রথম কাজ। দক্ষিণ ভারতীয় এ সুরকার তাঁর রেমিক সংস্করণে ‘কারার ঐ লৌহ–কবাট’ গানটির মূল সুরের ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট রাখেননি। বিপ্লবী-বিদ্রোহী চেতনার ভাব ও সুরের গানটিকে তিনি লোকগীতির রোমান্টিক ঢংয়ে পরিণত করে নষ্ট করে ফেলেছেন। এমন একটি রুদ্র চেতনার গানকে হত্যা করে তিনি জঘন্য অপরাধ করেছেন যা ক্ষমাহীন।

মূল গানটি কারাগারে মধ্যে গাওয়া হলেও ‘পিপ্পা’ ছবিতে গানটিকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ছবিতে দেখানো হয়েছে- ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা রাতের অন্ধকারে আগুন জ্বালিয়ে নাচগান করে রীতিমতো উৎসব করে গানটি গাইছেন। গানটি গাওয়ার মুহূর্তে পাকিস্তানি সৈন্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করে। গানটি রচনার প্রেক্ষাপট এবং এর বিপ্লবী চেতনা এমন উত্সবপূর্ণ দৃশ্যের সাথে যায় না।

চলচ্চিত্রে দৃশ্যের পরিবেশ-পরিস্থিতি ও উদ্দেশ্য বুঝে সেই দৃশ্যের উপযোগী গানের সুর সৃষ্টি করা সুরকারের কাজ। ‘পিপ্পা’ ছবিতে গানের যে পরিবেশ দেখানো হয়েছে ওই পরিবেশে এই বিপ্লবী গানটি খাটে না। সিনেমার দৃশ্যে নরম সুরে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটি গাইয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের যেভাবে আনন্দরত অবস্থায় দেখানো হয়েছে সেটি মানানসই ও যুতসই হয়নি, এটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এ অসংগতির দায় স্ক্রিপ্টরাইটার ও পরিচালককে বহন করতে হবে। ফলে এ বিকৃতির জন্য এ আর রহমানের সাথে তারাও দোষী।

ভারতীয় গায়ক রাহুল দত্ত, তীর্থ ভট্টাচার্য, পীযূষ দাস, শ্রায়ী পাল, শালিনী মুখার্জি ও দিলাসা চৌধুরী এরা প্রতিষ্ঠিত গায়ক এবং সম্ভবত সবাই বা অধিকাংশই বাঙালি। এই গানের সুর তাদের অজানা থাকার কথা নয়। ফলে এরা সবাইও বিকৃত সুরে গানটি গাওয়ার জন্য অপরাধী।

২০২১ সালে নজরুলের ছোট ছেলে কাজী অনিরুদ্ধের ছেলে কাজী অনির্বাণ ও তাঁর মা কল্যাণী কাজী ‘পিপ্পা’ সিনেমা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে গানটি ব্যবহারের লিখিত চুক্তি করেন। চুক্তিনামায় প্রথম সাক্ষী ছিলেন অনির্বাণ কাজী। কাজী অনির্বাণ স্বীকার করেন—মা গানটা ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিলেন সুর এবং কথা না বদলে রিক্রিয়েট করার জন্য। মা ওদের বলেছিল, গানটা তৈরি হয়ে গেলে একবার শোনাতে। কিন্তু ওরা তা শোনায়নি। ছবির নির্মাতারা এ দায় এড়াতে পারে না।

উপসংহার:
সব সৃষ্টি কালজয়ী হয় না, সবাই কালজয়ী সৃষ্টি করতে পারে না। যারা কালজয়ী সৃষ্টি করেন তারা তাদের সৃষ্টির সাথে সাথে নিজেরাও কালজয়ী হয়ে অমরত্ব লাভ করেন। কাজী নজরুল ইসলাম হলেন সেই কালজয়ী স্রষ্টা; তিনি নিজেও অমর, তাঁর সৃষ্টিও অমর। 'ভাঙার গান' শিরোনামে লেখা ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানটি নজরুলের সৃষ্টিসমূহের মধ্যেও এক অনন্য সৃষ্টি। এ সৃষ্টিকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা এ আর রহমান রাখে না। অনেকে বলেন—সময়ের প্রয়োজনে সৃষ্টির ভিন্নভাবে প্রকাশ হওয়াটা স্বাভাবিক। কথাটা হয়তো সত্য কিন্তু সৃষ্টিকে ভিন্নভাবে প্রকাশ করা এবং তাকে বিকৃতরূপে প্রকাশ করা এককথা নয়। মানুষ যদি পুরনো সৃষ্টির ভিন্নভাবে প্রকাশ সানন্দে গ্রহণ করে তবেই তাকে পরিবর্তন করে প্রকাশ করা হয়, একেই বলে সময়ের প্রয়োজনে সৃষ্টির ভিন্নভাবে প্রকাশ।

‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানটির সুর পরিবর্তন বাঙালি গ্রহণ করেনি, এটাকে বিকৃতি হিসেবে নিয়েছে। ফলে এ পরিবর্তন গ্রহণযোগ্য নয়।

নাজমুল হাসান: লেখক ও চিকিৎসক।

   

৩ গুণী পাচ্ছেন বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

  • Font increase
  • Font Decrease

রবীন্দ্র ও নজরুল সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার পাচ্ছেন ৩ গুণী গবেষক।

মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) বাংলা একাডেমির জনসংযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ বিভাগের পরিচালক সমীর কুমার সরকার স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র-সাহিত্যের গবেষণায় অবদানের জন্য এবার রবীন্দ্র পুরস্কার ২০২৪ পাচ্ছেন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী এবং অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা। অন্যদিকে, বাংলা একাডেমি নজরুল-সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের জন্য অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা পাচ্ছেন নজরুল পুরস্কার ২০২৪।

আগামী ২৫শে বৈশাখ ১৪৩১/৮ মে ২০২৪ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি আয়োজিত অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র পুরস্কার-২০২৪ ও আগামী ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১/২৩ মে ২০২৪ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে নজরুল পুরস্কার-২০২৪ প্রদান করা হবে।

অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানা 

খ্যাতিমান নজরুল গবেষক অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানার জন্ম ২৫শে জুলাই ১৯৩৭। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় ১৯৫৮ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৫৯ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৮৫ সালে মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিমের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি এইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন।

বাংলাদেশের মহিলাদের মধ্যে তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগের পাণ্ডুলিপি ও সাহিত্য বিষয়ে প্রথম গবেষক। ১৯৮৩ সালে তিনি ফারসি ভাষায় ডিপ্লোমা লাভ করেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রণীত মধ্যযুগের সাহিত্য-সম্পাদনা-গ্রন্থ 'নওয়াজিশ খান বিরচিত গুলে-বকাওলী কাব্য। পরে প্রকাশিত হয় তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ‘আবদুল হাকিম : কবি ও কাব্য (১৯৮৭)। অপর সাহিত্য সম্পাদনা-গ্রন্থ 'আবদুল হাকিম রচনাবলী' (১৯৮৯)।

কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে ড. রাজিয়া সুলতানার গবেষণাগ্রন্থ 'কথাশিল্পী নজরুল (১৯৭৫), 'নজরুল (১৯৮৮), অন্বেষা' (২০০১) এবং 'সাহিত্য-বীক্ষণ' (১৯৮৮)। ড. রাজিয়া সুলতানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। ইতোপূর্বে তিনি বিভিন্ন সরকারি কলেজে ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।

অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রজন্মের বিশিষ্ট সাহিত্য-সমালোচক ভীষ্মদেব চৌধুরীর জন্ম ১৯৫৭ সনের ৩০শে নভেম্বর সিলেট শহরে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি সম্পন্ন করেন। ১৯৮৪ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা। ২০০০ সনে তিনি অধ্যাপক হিসেবে উন্নীত হন। বাংলা উপন্যাস, রবীন্দ্র ছোটগল্প এবং বাংলাদেশের সাহিত্য তাঁর অনুধ্যান ও মূল্যায়নের কেন্দ্রীয় বিষয়। ভীষ্মদেব চৌধুরীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : জগদীশ গুপ্তের গল্প : পঙ্ক ও পঙ্কজ (১৯৮৮); মিরজা আবদুল হাই (১৯৮৯); বাংলাদেশের সাহিত্যগবেষণা ও অন্যান্য (দ্বি সংস্করণ ২০০৪); সৈয়দ মুজতবা আলীর পত্রগুচ্ছ (সম্পা. ১৯৯৩); তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস : সমাজ ও রাজনীতি (১৯৯৮); তারাশঙ্কর স্মারকগ্রন্থ (সম্পা. ২০০১); দু-চারটি অশ্রুজল : রবীন্দ্রগল্পের ভিন্নপাঠ (২০০৫); কথাশিল্পের কথামালা : শরৎচন্দ্র ও তারাশঙ্কর (২০০৭); সাহিত্য-সাধনায় ঢাকার নারী (২০১১); প্রভাতসূর্য :রবীন্দ্রনাথ সার্ধশত জন্মবর্ষ স্মরণ (সম্পা. ২০১১)।

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের শিক্ষক ও সাধারণ সম্পাদক। গুণী এই শিল্পীর জন্ম রাজশাহীতে। বাবা অধ্যাপক মফিজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষক ও মা খানম মমতাজ আহমদ। রবীন্দ্রনাথের গানসহ সুস্থধারার সংগীত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত থেকেও তিনি দেশজুড়ে শুদ্ধ সঙ্গীতের চর্চাকে ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখছেন। 

;

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত



কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

  • Font increase
  • Font Decrease

আবুল মাল আবদুল মুহিত সাবেক অর্থমন্ত্রী। সবচেয়ে বেশিবার বাজেট উপস্থাপন করে রেকর্ড গড়া অর্থমন্ত্রী তিনি। দীর্ঘ চাকরিজীবন শেষে রাজনৈতিক জীবন এবং স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে অবসর—সব ছিল তার বর্ণাঢ্য জীবনে। তার পর দেশের অর্থমন্ত্রী হয়েছেন আবু হেনা মোহাম্মদ মুস্তাফা কামাল ও বর্তমানে আবুল হাসান মাহমুদ আলী; কিন্তু কেউই আবুল মাল আবদুল মুহিতের মতো সাফল্যের সাক্ষর রাখতে পারেননি। মুস্তাফা কামালের মন্ত্রিত্ব কালের পুরোটা সময় কেটেছে ‘অনুপস্থিতি’ আর বিবিধ ব্যর্থতা দিয়ে। নতুন অর্থমন্ত্রী মাত্রই নিয়েছেন দায়িত্ব, তাই তাকে এনিয়ে এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা কঠিন।

আবুল মাল আবদুল মুহিত কেবল অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অর্থমন্ত্রীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন লেখক, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাঙালির মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি সরকারি চাকরি ত্যাগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে কাজ শুরু করেছিলেন। ১৯৫৬ সালে যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি)। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ওয়াশিংটন দূতাবাসে পাকিস্তানের কূটনীতিকের দায়িত্বে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের জুনে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৮১ সালে স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরি ছেড়েও দেন। সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদেরও অর্থমন্ত্রী ছিলেন তিনি। গণতন্ত্রে দেশকে ফেরানো হবে এই শর্তে তিনি এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। এরপর বছরখানেক দিন শেষে যখন দেখেন এরশাদ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছেন না, তখন তিনি স্বেচ্ছায় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ের পর যে মন্ত্রিসভা গঠন করে সেখানে শেখ হাসিনা তাকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। প্রবল প্রতিকূল দেশীয় ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেওয়া আবুল মাল আবদুল মুহিত বৈশ্বিক মন্দা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতিকে যে জায়গায় নিয়ে গেছেন তার সুফল দীর্ঘদিন ভোগ করেছে দেশ। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্পসহ আরও অনেক প্রকল্প তার আমলে শুরু হয়। তিনি আর্থিক ব্যবস্থাপনার দিকটি সুনিপুণভাবে করে গেছেন। তার দায়িত্বকালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যে ঊর্ধ্বগতির সঞ্চার হয়েছিল সেখান থেকে দেশ একটা সময়ে ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায়।

মাথাপিছু আয়, জিডিপি, রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির নানা খাতের ব্যবস্থাপনায় তিনি যে সাফল্যের সাক্ষর রেখেছেন তার পথ ধরে পরের অর্থমন্ত্রীরা সেটা অব্যাহত রাখতে পারেননি। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে পারেননি এবং পদে থেকেও তার কাজে অনুপস্থিতি দেশকে গভীর সংকটে নিপতিত করেছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মুস্তাফা কামাল বিজয়ী হলেও তাকে মন্ত্রিসভায় রাখেননি শেখ হাসিনা, এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে।

নানা কারণে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে এই দেশ স্মরণ রাখবে। তন্মধ্যে একটি যদি পেনশন ব্যবস্থা হয়, অন্যটি নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়ন। নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি এখনো আনুষ্ঠানিক হয়নি যদিও, তবে এনিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। নয় মাস আগে দেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হয়েছে, এবং এই নয় মাসে ব্যাপক সাড়া যদিও পড়েনি, তবে এখন পর্যন্ত ১ লাখ লোক এই সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। অথচ তিনি যখন প্রথমবার সবার জন্যে পেনশন চালুর কথা বলেন, তখন এই উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিলেন অনেকেই। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে তিনি এক বৈঠকে সকলের জন্যে পেনশন চালুর ব্যবস্থার কথা বলে অনেকের বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন। তবু তিনি এর একটা খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব দেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে। আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘সবার জন্য পেনশন চালু করতে পারলে এ দেশ থেকে অনেক কিছু দূর হবে। মানুষ যখন দেখবে তার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত তখন অনেকেই অনিয়ম থেকে সরে আসবে। মানুষ এত অনিয়ম-হানাহানি করে শুধু ভবিষ্যতের জন্য।’ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে খসড়া তৈরি হয়ে আসার পর তিনি জানালেন, কিছুই হয়নি। এরপর তার নিজের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় খসড়া তৈরির কাজ। তিনি এনিয়ে কথা বলতেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবুল মাল আবদুল মুহিতের ওই উদ্যোগের পক্ষে ছিলেন, এবং কাজ করার নির্দেশ দেন। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর পর তথ্যগুলো একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক কর্মকর্তা।

আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের বাজেটে দেশের সকল নাগরিকের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালুর স্বপ্নের কথা বলেছিলেন। তিনি তার বাজেট বক্তৃতার ৫৯ নং পৃষ্ঠার পেনশন অধ্যায়ে বলেছিলেন ‘সরকারি পেনশনারগণ দেশের সমগ্র জনগণের একটি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। তাই সরকারি কর্মচারীদের পাশাপাশি সকলের জন্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অংশগ্রহণমূলক সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুকরণে আমরা কাজ করছি। আমাদের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ-রাষ্ট্রে রূপান্তর করা।’ এর আগের বছরের বাজেটে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ শতাংশ, যাদের প্রায় সবাই সরকারি চাকুরে, এখন পেনশন সুবিধা পান। বাকি ৯৫ শতাংশের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ গ্র্যাচুইটি সুবিধা পেলেও অন্যদের জন্য সে সুবিধাও নেই।’ তার বক্তব্য তখন সে পর্যন্তই ছিল, এবং এক বছর পর পরের বাজেটে এসেছে স্বপ্নের পূর্ণ অবয়ব। আর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারে। এরবাইরে আছে ২০১৮ সালে পেনশন নিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিতের উদ্বোধন করা এক পাইলট প্রকল্পে, যেখানে ৫৭ জন ব্যক্তিকে এই প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা হয়। দেশের মানুষদের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালু নিয়ে যে স্বপ্নের রূপরেখা দিয়েছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত, সেটা তার জীবদ্দশায় পূরণ হয়নি। তার মৃত্যুর কয়েক মাস পর সরকারি তরফে হয়েছে প্রকাশ্য এবং প্রধানমন্ত্রী করেছেন এর বাস্তবায়ন।

সম্প্রতি নারীদের গৃহকর্মের অর্থনৈতিক মূল্য নির্ধারণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। গত ২৩ এপ্রিল সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ সুপারিশ করা হয় বলে সংসদ সচিবালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। নারীদের গৃহকর্মের এই মূল্যায়নে ঘরে হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল পালন, বিভিন্ন জাতের সবজি উৎপাদনসহ নানা হিসাব এর মধ্যে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশের অন্তত ৪৩ শতাংশ নারী পুরোপুরিভাবে গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে যুক্ত। দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান ২০ শতাংশ। তবে নারীর এই গৃহস্থালি কাজকে জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতিতে যোগ করা হলে জিডিপিতে নারীর অবদান দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ বা তার কাছাকাছি। এখন নারীদের গৃহস্থালি কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে, এ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এটাও ছিল সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের স্বপ্ন। দায়িত্ব পালনকালে একাধিকবার তিনি এনিয়ে কথা বলেছেন, নারীদের কাজের রাষ্ট্রীয় মূল্যায়নের গুরুত্বারোপ করেছেন। ২০১৭ সালের অক্টোবরে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে প্রয়াত এই অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে ঘরের সেবামূলক কাজের কোনো মূল্যায়ন নেই। সে কারণে জিডিপিতে এর কোনো অন্তর্ভুক্তি নেই। এটার মূল্যায়ন করা জরুরি।’ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে এই মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘বিষয়টি আমরা পরিসংখ্যান বিভাগে যুক্ত করব এবং সরকারিভাবে আমরা এটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাব।’

আবুল মাল আবদুল মুহিত নেই আজ দুই বছর। ২০২২ সালের ৩০ এপ্রিল না ফেরার দেশে চলে যান বরেণ্য এই ব্যক্তিত্ব। মৃত্যুর মাস দেড়েক আগে তাকে দেওয়া সিলেটে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি নিজের জীবনের মূল্যায়নে বলেছিলেন, ‘আমি আমার জীবনকে নিয়ে গর্বিত।… অনেকে হয়ত একে আত্মগরিমা বলবেন। কিন্তু এটা অন্যায় নয়। বরং এরজন্য নিজেকে গড়ে তুলতে হয়।’ ৮৮ বছরের দীর্ঘ সময়কে তিনি বলতেন ‘মহাতৃপ্তির-মহাপ্রাপ্তির জীবন’।

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত।

;

চতুর ঘুঘু



শরীফুল আলম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

নেশাখোরের মত কখনো কখনো খিলখিল করে হাসি
প্রথমত দহন উষ্ণতায় ,
তারপর সুবিশাল শূন্যতায় ,
কখনো কখনো ছুঁয়ে ফেলি সাজানো প্রতিমা
জীবনের দাবী ,
তবে আপাতত গন্তব্য বলে কিছু নেই আমার
কবিতার অবয়ব এখনো যেটুকু আছে
তাকে আমি রঙ্গের উৎসবই বলি
কিম্বা যেটুকু আছে তা জীবনের দাবী ।

ক্রমাগত অন্তর্গত দ্বন্দে
অবাধ্য ভাষা এখন প্রাচীর তোলে
প্রসারিত মৃত্যুর কথা বলে ,
আমি তার গল্পের শেষটা জানার চেষ্টা করি
রাতের গহ্বর থেকে তোলে আনি মৃত্যুর পরোয়ানা ,
কিন্তু অস্পষ্টতা কিছু থেকেই যায়
আবার নিজে নিজেই বলি
আমার জলভূমিতে আবার কিসের নিঃসঙ্গতা ?

স্বপ্নবাসর ? সে এক চতুর ঘুঘু
আমি তার ক্ষণিকের হটকারীতা বুঝতে পারি
এমনকি চোখ বুজে
আমি ভুলে যাই তার সন্ধ্যার ঘায়েল
যেন দেখেও দেখিনা
বিনা মোহে সারারাত অহেতুক তার অহংকার
নিরর্থক বাজি ধরে সে
অর্কিড নিরালায় আমিও একা থাকি
ভাঙ্গা চোরা রাত জেগে থাকে আমার পাশে
মনে হয় চোখ দিয়ে ছুঁয়ে দেখি তার ঢাকাঢাকি
ফিরতি নজরে সেও আমায় দেখে
আমার মিষ্টি কবিতার মতই
আমিও থমকে যাই পাখীর ডাকে
দূর দরিয়ায় তখন উলুধ্বনি শংখ বাজে ,
ইচ্ছে হয় নাগরদোলায় আবার গিয়ে দুলি
আর জানই তো কবিরাই প্রেমে পড়ে
কবিরাও চুমু খায়
সুন্দরী পেলে তাঁরাও শুয়ে পরে।

*************************
শরীফুল আলম ।
২১এপ্রিল । ২০২৪ইং
নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।

;

শিশু সুভাষচন্দ্রের চেতনায় স্বদেশপ্রেমের উন্মেষ যেভাবে



উৎপল আইচ
-নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। ছবি: সংগৃহীত

-নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুকে আমরা প্রায় সকলেই বৃহত্তর ভারতবর্ষের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক বলে মানি এবং শ্রদ্ধা করি। তাঁর তুলনাহীন দেশপ্রেমের সামগ্রিক পর্যালোচনা শুধু একটা নাতিদীর্ঘ রচনার পরিসরে লিপিবদ্ধ করা সম্ভব নয়। তাই বালক-কিশোর সুভাষচন্দ্রের জীবনে দেশাত্মবোধের অঙ্কুরোদয় আর তার উন্মেষই এই রচনার উপজীব্য থাকলো।

১৯০২ সালের জানুয়ারি মাসে ৫ বছর বয়স থেকে ১৯০৮ সালের ডিসেম্বর মাস অবধি, অর্থাৎ প্রায় ১২ বছর বয়স অবধি, দীর্ঘ ৭ বছর, সুভাষচন্দ্র ব্যাপ্টিস্ট মিশনারিদের দ্বারা পরিচালিত কটকের প্রটেস্ট্যান্ট ইউরোপিয়ান স্কুলে পড়াশুনা করেন। বিলিতি আদর্শে নিয়ন্ত্রিত এই স্কুলের বেশির ভাগ ছাত্রই ছিল ইউরোপীয় কিংবা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। যদিও এই স্কুলে খুব ভালো ইংরেজি শেখানো হতো, আসল প্রচেষ্টা ছিল ছাত্রদের মনেপ্রাণে ইংরেজ করে গড়ে তোলার। তাই বাইবেলের উপর খুব জোর দেওয়া হত। তাছাড়া গ্রেটবৃটেনের ইতিহাস ও ভূগোল, ল্যাটিন ইত্যাদি শেখানো হতো। সেই স্কুলে সংস্কৃত বা অন্য কোন ভারতীয় ভাষা শেখাবার প্রশ্নই উঠে না। তবে পড়াশুনার সাথে সাথে স্কুলের প্রধান শিক্ষক নিয়মানুবর্তিতা এবং ভদ্র-ব্যবহারকে শিক্ষার বড় অঙ্গ বলে মনে করতেন।

এই স্কুলে প্রবেশের কয়েক বছর পরই বালক সুভাষচন্দ্র বঙ্গভঙ্গ-জনিত দেশের রাজনৈতিক নবজাগরণের ব্যাপারটা বুঝতে শিখেছিলেন। প্রথম দিকে না বুঝতে পারলেও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এটাও অনুভব করতে পারলেন যে তাঁদের বাড়ির বা তাঁদের সমাজের জীবন আর স্কুলের জীবন একদম ভিন্ন ধরণের। সুভাষচন্দ্র এও জানলেন যে ভারতীয়রা পরীক্ষায় সর্বোচ্চ স্থানাধিকারী হলেও শুধুমাত্র ভারতীয় বলে স্কলারশিপ-পরীক্ষা দেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। তাছাড়া, ইউরোপীয় এবং অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ছেলেরাই ভলান্টিয়ার কোর-এ যোগ দিতে পারে, বন্দুক ব্যবহার করা শিখতে পারে যা ভারতীয় ছাত্রদের জন্য নিষিদ্ধ।

নেতাজী সুভাষচন্দ্র তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ‘অ্যান ইন্ডিয়ান পিলগ্রিম’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘এইসব ছোটোখাটো ব্যাপার থেকেই আমাদের চোখ খুলতে শুরু হল, বুঝলাম যে এক বিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও ভারতীয় হিসাবে আমরা কতটা আলাদা’ (“Small incidents like these began to open our eyes to the fact that as Indians we were a class apart, though we belonged to the same institution.”) । সুভাষচন্দ্র তাঁর আত্মজীবনীর শুরুতেই লিখেছেন যে তাঁর মন স্পর্শকাতর এবং তিনি একজন অন্তর্মুখী ব্যক্তি। (“I was and still remain an introvert.”) সুভাষচন্দ্র সেই আত্মজীবনী অসুস্থ অবস্থায় ১৯৩৭ সালের ডিসেম্বর মাসে দশদিনে অস্ট্রিয়ার ব্যাডগাসটেন-এ অবস্থানকালে লিখেছিলেন। তিনি সেখানে স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য গিয়েছিলেন।

আত্মজীবনীতে তিনি আরও লিখেছেন, “সব কিছু বিচার করে আমি এখন একজন ভারতীয় বালক বা বালিকাকে এরকম স্কুলে পাঠাবো না। সে নিশ্চিত সুসমন্বয়ের অভাবে এবং তজ্জনিত অশান্তিতে ভুগবে, বিশেষতঃ সে যদি স্পর্শকাতর স্বভাবের হয়। (“Considering everything, I should not send an Indian boy or girl to such a school now. The child will certainly suffer from a sense of mal-adaptation and from consequent unhappiness, especially if he or she is of a sensitive nature.”)

১৯০৯ সালের জানুয়ারি মাসে সুভাষচন্দ্র কটকের র‍্যাভেন্-শ কলেজিয়েট স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে (এখনকার হিসাবে সপ্তম শ্রেণিতে) ভর্তি হন। এই স্কুলে তিনি চার বছর পড়াশুনা করে ১৯১৩ সালের মার্চ মাসে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন। সুভাষচন্দ্র বসু যখন র‍্যাভেন্শ কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন তখন সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন শ্রী বেণীমাধব দাস। সুভাষচন্দ্রের বয়স তখন ১২ বছর। কিশোর সুভাষ তার আগে এক বর্ণও বাঙলা পড়েননি। এদিকে তাঁর সহপাঠীরা সবাই বাঙলায় পারদর্শী ছিল। কিন্তু চরম অধ্যবসায়ী সুভাষ এক বছরের মধ্যেই বাঙলাটা রপ্ত করে ফেলেন। সংস্কৃতের ব্যাপারও একই কথা বলা যায়। এই নতুন স্কুলে তাঁর বন্ধুও জুটে যায় যেটা প্রোটেস্ট্যান্ট ইউরোপিয়ান স্কুলে হয়নি।

সুভাষচন্দ্র ছিলেন নিরহংকারী এবং প্রচারবিমুখ মহাপুরুষ, তাই অনেক কথা বিস্তারিতভাবে আত্মজীবনীতে লেখেননি বা হয়তো আত্মপ্রশংসা হবে মনে করে এড়িয়ে গেছেন। র‍্যাভেন্শ কলেজিয়েট স্কুলে তাঁর বাল্যবন্ধু ও সহপাঠী ছিলেন শ্রী চারুচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি সুভাষচন্দ্রদের প্রতিবেশীও ছিলেন। আমাদের সৌভাগ্য যে চারুচন্দ্র তাঁর স্মৃতি রোমন্থন করে শ্রী সুবোধচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়কে দিয়ে “সুভাষচন্দ্রের ছাত্রজীবন” নামে একটা বই লিখে গেছেন। তাঁর কাছ থেকে আরো অনেক তথ্য জানা যায়। এছাড়া অন্যান্য সূত্র থেকেও কিছু নতুন তথ্য জানা যায় এবং কিছু তথ্যের সমর্থন মেলে।

প্রথম ভর্তি হবার দিন সুভাষচন্দ্র কোট-প্যান্ট পরে র‍্যাভেন্শ কলেজিয়েট স্কুলে গিয়ে দেখতে পান যে সমস্ত শিক্ষক এবং অন্যান্য সব ছাত্ররা দেশীয় পোশাক পরে আছেন। তার পরদিন থেকে তিনিও ধুতি-পাজ্ঞাবি পরে স্কুলে যেতে শুরু করেন। সুভাষচন্দ্র তাঁর আত্মজীবনীতে ক্ষুদিরাম বসুর নাম উল্লেখ না করে লিখেছেন যে ১৯০৮ সালে যখন প্রথম বোমা নিক্ষেপ করা হয় তখন চারদিকে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল এবং তাঁদের মধ্যেও সাময়িক উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল। সুভাষচন্দ্র তাঁর আত্মজীবনীতে এও লিখেছেন যে সেসময় বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে, স্বদেশি জিনিস ব্যবহারের পক্ষে মিছিল ও আন্দোলন চলছিল এবং তাঁরা কিছুটা সেদিকে ঝুঁকেছিলেন, কিন্তু বাড়ির নিষেধ থাকায় রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগদান করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয় নি। তবে তাঁরা বিপ্লবীদের ছবি কেটে কেটে পড়ার ঘরে টাঙিয়ে রাখতেন। এক আত্মীয় পুলিশ অফিসার দেখে ফেলায় সেগুলোও পরে অপসৃত হয়েছিল এবং এতে তাঁদের মন খারাপ হয়েছিল।

আমরা “সুভাষচন্দ্রের ছাত্রজীবন” গ্রন্থ থেকে জানতে পারি যে, ১৯১১ সালের ১১ আগস্ট তারিখে র‍্যাভেন্শ কলেজিয়েট স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র (বর্তমান নবম শ্রেণি) সুভাষচন্দ্র নিজ উদ্যোগে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসির তৃতীয় বাৎসরিক স্মরণ দিবস উপযুক্ত ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে পালন করেছিলেন স্কুলে এবং র‍্যাভেন্শ কলেজ ও স্কুল হোস্টেলে। সুভাষচন্দ্রের প্রস্তাব মত সব ছাত্ররা উপবাস করে এই পূণ্য দিনটি অতিবাহিত করেছিল সেদিন। অবশ্য এর পরিণতি ভালো হলোনা; ডিভিশনাল কমিশনারের কাছে খবর পৌঁছে যায় আর ফলস্বরূপ ম্যাজিষ্ট্রেট এই বিষয়ে তদন্ত করে প্রধান শিক্ষক শ্রীবেণীমাধব দাসকে কটক থেকে কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে বদলি করে দেয়।

র‍্যাভেন্শ কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই সুভাষচন্দ্র শিক্ষক শ্রীবেণীমাধব দাসের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন তাঁর প্রখর ব্যক্তিত্বের জন্য। তিনি প্রধান শিক্ষককে মনেপ্রাণে শ্রদ্ধা করতে শুরু করেন। যেহেতু বেণীমাধববাবু দ্বিতীয় শ্রেণির নীচে কোন ক্লাস নিতেন না তাই অধীর আগ্রহে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উঠার জন্য অপেক্ষায় থেকে যখন সেই সুযোগ সুভাষচন্দ্র পেলেন তখন তাঁর সে ভাগ্যও দীর্ঘস্থায়ী হলো না। তবে এই কয়েক মাসের মধ্যেই শ্রী বেণীমাধব দাস ছাত্র সুভাষের মধ্যে একটা নৈতিক মূল্যবোধ জাগিয়ে দিয়ে গেলেন।

এই বিচ্ছেদ সুভাষের জন্য খুব বেদনার হয়েছিল কিন্তু তাঁর সাথে বেণী মাধবাবুর চিঠিপত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ রইল। সুভাষচন্দ্র আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে, প্রকৃতিকে কিভাবে ভালবাসতে হয়, প্রকৃতির প্রভাবকে জীবনে কিভাবে গ্রহণ করতে হয় তা মাস্টারমশাই শ্রী বেণীমাধব দাসই তাঁকে শিখিয়েছিলেন। প্রকৃতি তো দেশমাতৃকারই অবিচ্ছিন্ন অঙ্গ। কিন্তু মাস্টারমশাই যে তাঁকে স্বদেশপ্রেম শিখিয়েছেন তা অবশ্য স্পষ্ট করে সুভাষচন্দ্র তাঁর আত্মজীবনীতে লেখেননি। হয়ত ১৯৩৮ সালে ছাপা বইতে তেমন কিছু কথা লিখে বেণীমাধব বাবুকে ইংরেজ-পুলিশের কুনজরে পড়তে দিতে চাননি।

বেণী মাধববাবুর বদলির কিছুদিন পর থেকেই সুভাষচন্দ্র বয়ঃসন্ধিজনিত কিছু মানসিক অশান্তিতে ভুগছিলেন। সৌভাগ্যবশতঃ ঠিক এই সময়ই তিনি কটক শহরে নবাগত এক আত্মীয়ের বাসায় অপ্রত্যাশিতভাবে স্বামী বিবেকানন্দের রচনাবলী পেয়ে যান এবং তা অতি উৎসাহে পড়ে ফেলেন। সুভাষচন্দ্র বুঝতে পারেন যে এই জিনিষই তিনি এতদিন ধরে খুঁজছিলেন এবং এগুলোর মধ্যেই তিনি তাঁর মানসিক অশান্তির সমাধান খুঁজে পেলেন। স্বামী বিবেকানন্দের জীবনের আদর্শই সুভাষচন্দ্র হৃদয়ঙ্গম করে নিলেন, যার মূল কথাটা হল, “আত্মনঃ মোক্ষার্থম জগৎহিতায় চ” অর্থাৎ ‘মানবজাতির সেবা এবং আত্মার মুক্তি’।

মানবজাতির সেবা বলতে স্বামী বিবেকানন্দ স্বদেশের সেবাও বুঝিয়েছেন। স্বামীজীর প্রধান শিষ্যা এবং জীবনীকার ভগিনী নিবেদিতা আমাদের জানিয়েছেন যে, মাতৃভূমিই ছিল স্বামী বিবেকানন্দের আরাধ্যা দেবী। আত্মজীবনীতে সুভাষচন্দ্র আরও লিখেছেনঃ ‘একটি বক্তৃতায় স্বামীজী বলেছেন, “সদর্পে বল মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী, আমার ভাই।”

নেতাজী সুভাষচন্দ্র লিখেছেন যে তাঁর বয়স যখন ১৫ ছুঁই ছুঁই, ঠিক তখন বিবেকানন্দ তাঁর জীবনে প্রবেশ করলেন; বিবেকানন্দের প্রভাব তাঁর জীবনে আমূল পরিবর্তন এনে দিল এবং তিনি স্বামী বিবেকানন্দের পথই বেছে নিলেন। বিবেকানন্দের সাথে সাথে তাঁর গুরু রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের প্রতিও সুভাষচন্দ্র আকৃষ্ট হলেন এবং কটকে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভক্তবৃন্দের একটা সংগঠন গড়ে তুললেন। সেই সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল অধ্যাত্মচর্চা করা আর দুঃস্থের সেবা করা। স্কুল ছাড়ার সময় যত এগিয়ে আসছিল, সুভাষের মধ্যে ধর্মভাব আর মানবসেবা করার প্রবণতা ততই বেড়ে যাচ্ছিল। লেখাপড়ায় আর মন বসছিল না।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শিশু সুভাষ (দণ্ডায়মান, ডান থেকে প্রথম)

এরপর ১৯১২ সালের অক্টোবর মাসে মহাসপ্তমীর দিন কৃষ্ণনগর থেকে মাস্টারমশাই শ্রী বেণীমাধব দাসের পরিচয়পত্র নিয়ে হাজির হলেন সুভাষেরই সমবয়সী একই (ফার্স্ট) ক্লাসের ছাত্র শ্রী হেমন্তকুমার সরকার। হেমন্ত কলকাতার একটা রাজনৈতিক দলের সভ্য ছিলেন যাদেরও আদর্শ ছিল আধ্যাত্মিক উন্নতি এবং দেশসেবা। সেই প্রথম সুভাষ ও তাঁর কটকের বন্ধুরা প্রথমবারের মত কলকাতার রাজনৈতিক প্রেরণার আস্বাদন পেলেন। হেমন্তের কাছে তাদের দলের নানাবিধ কাজের বর্ণনা শুনে সুভাষচন্দ্র মুগ্ধ হলেন।

হেমন্ত একদিন সুভাষের দলের ছেলেদের দেশের প্রতি তাদের কর্তব্য সম্বন্ধে অনুপ্রাণিত করে একটা আবেগময় বক্তৃতাও দিলেন। এইসঙ্গে সুভাষচন্দ্রের সাথে তাঁর নিবিড় সখ্যতাও গড়ে উঠল। চারদিন কটকে থেকে বিজয়া দশমীর সন্ধ্যায় হেমন্তকুমার পুরী চলে গেলেন এবং কলকাতায় ফিরে গিয়ে তাঁর দলের প্রধানকে সব জানালেন। সেই দলনেতা চিঠির মাধ্যমে কটকের এই দলটার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন এবং কয়েক বছর এই যোগাযোগ ছিল।

হেমন্তকুমার পরে তাঁকে লেখা সুভাষের বেশ কিছু চিঠি প্রকাশ করেন যার থেকে সুভাষচন্দ্র বসুর কৈশোরের এবং যৌবনের অনেক কথা জানা যায়। তিনি তাঁর বিখ্যাত “সুভাষের সঙ্গে বারো বছর (১৯১২ – ১৯২৪)” বইতে জানান যে, সুভাষের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের সময়ই তাঁদের মধ্যে স্থির হয়েছিল যে পাশ করে তাঁরা চাকরি করবেন না এবং সুভাষ আই-সি-এস আর হেমন্ত আই-ই-এস-এ ঢুকে সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে চাকরি-মোহগ্রস্ত বাঙালীর সামনে আদর্শ দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন।

১৯১৩ সালের ১ মার্চ সুভাষচন্দ্র আর হেমন্তদের ম্যাট্রিক পরীক্ষা শুরু হয়। দুজনেই তাঁদের এই নূতন বন্ধুত্বের আর নতুন জীবনের আলোড়নে পড়াশুনায় তেমন মন দিতে পারেন নি। সুভাষচন্দ্র তো তারও আগে থেকেই পড়াশুনায় অমনোযোগী হয়ে গিয়েছিলেন। তৎসত্ত্বেও সুভাষ ৭০০-র মধ্যে ৬০৯ নম্বর পেয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। পরীক্ষার পর আগের পরিকল্পনা মত সুভাষচন্দ্র কিছুদিনের জন্য হেমন্তের কাছে কৃষ্ণনগরে যান।

কলকাতার দলের কয়েকজন সদস্যও সেখানে আসেন এবং তাঁরা সদলবলে পলাশী, মুর্শিদাবাদ ইত্যাদি ঐতিহাসিক স্থানগুলি দেখতে বের হন। পলাশীতে তাঁরা দেখতে পান যে সেই আম্রকানন আর নেই আর লর্ড কার্জনের আদেশে বিজয় স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। হেমন্ত নবীনচন্দ্র সেনের “পলাশীর যুদ্ধ” আবৃত্তি করতে করতে যখন নবাব সিরাজদৌল্লার সেনাপতি মোহনলালের মুখনিঃসৃত অংশে আসেন তখন সুভাষচন্দ্র আর চোখের জল চেপে রাখতে পারেন না। তাঁর দলের সেই ভ্রমণ সাতদিনে সমাপ্ত হয়েছিল।

এরপর সুভাষচন্দ্র কলকাতায় এসে তাঁর বড় দাদাদের মত প্রেসিডেন্সি কলেজে আই এ ক্লাসে ভর্তি হলেন ১৯১৩ সালের জুলাই মাসে। তখন তাঁর বয়স সাড়ে ষোল। ভর্তি হওয়ার সাথে সাথেই তিন মাসের গ্রীষ্মের বন্ধ হয়ে যায়। সেই তিন মাসে তিনি কলকাতার সেই দলটাকে খুঁজে বার করলেন আর পছন্দমত কিছু নতুন বন্ধুও জুটিয়ে ফেললেন। কটকের পরিবেশ আর কলকাতার পরিবেশে আকাশ-পাতাল পার্থক্য।

অবশ্য এর প্রায় বছর দেড়েক আগে স্বদেশী আন্দোলনের জোয়ার সমাপ্ত হয়েছে। বঙ্গভঙ্গ রদ হয়েছে তবে তার জন্য বঙ্গ প্রদেশকে (বাংলা প্রেসিডেন্সিকে) অনেক খেসারত দিতে হয়েছে। হিন্দী-উড়িয়া-অসমীয়া-ভাষী অঞ্চলগুলোকে বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে আর ব্রিটিশ-ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। তবে এই স্বদেশী আন্দোলন স্বাধীনতা সংগ্রামকে এক নতুন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল এবং এজন্য সশস্ত্র বিপ্লব আন্দোলনের তৎপরতাও বৃদ্ধি পেয়েছিল।

সুভাষের আত্মজীবনী থেকে জানা যায় যে এসময় সুভাষচন্দ্র শ্রীঅরবিন্দের লেখা ও চিঠিপত্র পড়ে তাঁর প্রতিও আকৃষ্ট হয়েছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের কিছু ছাত্রদের মধ্যেও এই বিপ্লবী চিন্তাধারা সক্রিয় ছিল। কিন্তু সুভাষচন্দ্র কলকাতায় এসেছিলেন মানবসেবা আর আধ্যাত্মিক উন্নতির সঙ্কল্প নিয়ে, যদিও তাঁর মধ্যে বিপ্লবীদের প্রতি সহানুভূতি ছিল এবং স্বদেশচিন্তা তাঁকে গভীরভাবে আলোড়িত করত। আত্মজীবনীতে সুভাষচন্দ্র লিখে গেছেন, ‘কলেজ-জীবনে প্রবেশ করবার সময় জীবন সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা জন্মে গিয়েছিল। বুঝেছিলাম যে জীবনের একটা উদ্দেশ্য আছে এবং এই উদ্দেশ্য সফল করার জন্য নিয়মিত শরীর ও মনের অনুশীলনের প্রয়োজন।’

এসময় তাঁর সাথে কয়েক মাস আগে প্রয়াত বিখ্যাত কবি, নাট্যকার, গীতিকার, স্বদেশী-সংগীতস্রষ্টা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র দিলীপ কুমার রায়ের বন্ধুত্ব হয়। দিলীপ কুমার রায় সুভাষচন্দ্রের সমবয়সী ছিলেন এবং সেবছরই প্রেসিডেন্সি কলেজে আই-এস-সি ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলেন। তাঁরা কাছাকাছিই থাকতেন। সুভাষ একদিন দিলীপকুমারের বাড়ীতে এসে দিলীপকুমারকে তাঁর উদ্যোগে কলেজে সদ্য প্রতিষ্ঠিত বিতর্কসভায় যোগ দেবার জন্য আমন্ত্রণ জানান। সেই প্রথম পরিচয়ের বর্ণনা খুবই সুন্দর।

সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন যে, আমাদের দেশে তর্ক-বিতর্কের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে কারণ স্বাধীনতার জন্য বড় বড় বক্তার, বাক-যোদ্ধার খুব প্রয়োজন। শ্রী দিলীপকুমার রায় তাঁর “আমার বন্ধু সুভাষ” বইতে লিখেছেন যে তিনি বলেছিলেন, রামকৃষ্ণ তো বলে গেছেন তর্ক দিয়ে সত্যের সন্ধান পাওয়া যায় না। সুভাষচন্দ্র উত্তরে বলেছিলেন, “তিনি কি বলেছিলেন তাতে আমাদের দরকার কি? ... আমাদের গড়ে তুলতে হবে ভবিষ্যৎকে। কেন, আপনার বাবা কি বলেননিঃ ‘চোখের সামনে ধরিয়া রাখিয়া অতীতের সেই মহা আদর্শ, জাগিব নূতন ভাবের রাজ্যে রচিব প্রেমের ভারতবর্ষ?” দিলীপকুমার আশ্চর্য হয়ে জানতে চেয়েছিলেন, ‘তাঁর কবিতা আপনার মনে আছে?’ উত্তরে সুভাষের দৃষ্টি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। তিনি বলেছিলেন, “অন্তরে গাঁথা আছে।”

সুভাষের দলের সকলেই ব্রহ্মচর্যের ব্রত নিয়েছিলেন। দলের প্রধান লক্ষ্য ছিল ধর্ম আর জাতীয়তাবাদের সমন্বয় ঘটানো – শুধু চিন্তায় নয় কাজের মাধ্যমে। তাঁর দলের ছেলেরা নতুন নতুন ভাবধারার সন্ধানে দর্শন, ইতিহাস, জাতীয়তাবাদের উপর বই খুঁজে খুঁজে পড়তেন এবং নিজেদের মধ্যে তা আলোচনা করতেন। তাছাড়া নতুন সদস্য সংগ্রহ করতেন এবং নামকরা লোকদের সাথে আলাপ পরিচয় করতেন। এছাড়া সাধু-সন্তদের সন্ধানে থাকা এবং ছুটির সময় তীর্থস্থানে তাঁদের সন্ধান করাও একটা কাজ ছিল। ১৯১৩ সালে বড়দিনের ছুটিতে তাঁরা দলবেঁধে গিয়ে কলকাতা থেকে ৫০ মাইল দূরে শান্তিপুরে কিছুদিন গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী হয়ে বাস করেছিলেন। ১৯১৪ সালে তাঁরা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সাথেও দেখা করতে গিয়েছিলেন। বেলুড় রামকৃষ্ণ মঠ ও অন্যান্য জায়গায় প্রায়ই যেতেন। দক্ষিণ কলকাতার অনাথ ভাণ্ডার দরিদ্র সেবা প্রতিষ্ঠানের জন্য রবিবার বাড়ি বাড়ি ঘুরে অর্থ ও চালডালও সংগ্রহ করেছেন।

সেসময় কলেজে অধ্যাপকদের পড়ানো সুভাষচন্দ্রের একঘেয়ে লাগতো। এই একঘেয়েমি কাটানোর জন্য জনহিতকর কাজে মেতে থাকতেন। বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা, বন্যা বা দুর্ভিক্ষপীড়িতদের জন্য টাকা তোলা, সহপাঠীদের নিয়ে বেড়াতে যাওয়া–এই ধরণের কাজ তাঁর ভালো লাগত। প্রথম বছরের কলেজের ছুটিতে কটক গিয়ে কাছের একটা গ্রামে কলেরা হওয়ায় সে গ্রামে রোগীর শুশ্রূষা করতেও যান। সেই এক সপ্তাহে তিনি দেশের দারিদ্র্য, মৃত্যুর তাণ্ডবলীলা আর নিরক্ষরতার অভিশাপ প্রত্যক্ষ করেন। কলকাতায় ফিরে এসে ষাট মাইল দূরে কৃষ্ণনগরে এক উদাসী পাঞ্জাবী শিখ তরুণ সাধুর সন্ধান পেয়ে হেমন্তকে নিয়ে পায়ই তাঁর কাছে যেতে শুরু করেন। সেই সন্ন্যাসীকে দেখে সুভাষের মনে দীক্ষা নেবার ইচ্ছা জাগে।

১৯১৪ সালের গরমের ছুটির সময় সুভাষচন্দ্র প্রায় দুমাস গুরু খুঁজতে উত্তর ভারতের প্রায় সবকটা তীর্থস্থান ঘুরে বেড়ান। বাড়িতে শুধু একটা পোস্টকার্ড পাঠিয়ে জানিয়েছিলেন মাত্র। এই তীর্থভ্রমণের সময় হিন্দু সমাজব্যবস্থার মূল গলদগুলি তাঁর কাছে ধরা পড়ে। অবশ্য অনেক প্রকৃত ধার্মিক সন্ন্যাসীরও দর্শন পান। সেখান থেকে ফিরে এসে কিছুদিনের মধ্যেই সুভাষচন্দ্র টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হন। সেবার তাঁর ৬৩ দিন জ্বর ছিল। জ্বর সেরে গেলে সুভাষচন্দ্র স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে কার্সিয়াং গিয়ে এক মাস থেকে আসেন। এরপর ১৯১৪ সালের নভেম্বর মাসে হেমন্ত ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়াতে আক্রান্ত হন এবং সুভাষ কৃষ্ণনগরে গিয়ে বন্ধুর সেবা করেন। এসব গোলযোগে পড়াশুনার ব্যাঘাত হওয়ায় ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার ফল ভাল হলনা। তবুও ১৯১৫ সালে তিনি ফার্স্ট ডিভিশনে আই এ পাশ করেছিলেন এবং দর্শনে অনার্স নিয়ে একই কলেজে বি এ ভর্তি হলেন।

কৈশোরে সুভাষচন্দ্র বসু

১৯১৬ সালের জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাস সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনে একটা তাৎপর্যপূর্ণ সময়। তখন তাঁর বয়স ১৯ বছর। ঘটনাটা সবার জানা। অনেকেই এই সম্বন্ধে বিস্তারিত লিখেছেন। তাই খুব সংক্ষেপে সেই ঘটনাটার বিবরণ দিয়ে এই লেখাটা শেষ করব। প্রেসিডেন্সি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন এডওয়ার্ড ফারলে ওটেন। এই ইংরাজ অধ্যাপক ছিলেন I.E.S. (ইন্ডিয়ান এডুকেশান সার্ভিসের সদস্য) এবং বর্ণবিদ্বেষী। তিনি ১৯১৫ সালে ইডেন হিন্দু হোস্টেলে আমন্ত্রিত হয়ে ভাষণ দেন এবং সেই বক্তৃতায় ভারতীয়দের সম্বন্ধে খারাপ মন্তব্য করেন। অসন্তুষ্ট হলেও তাঁকে সভাপতি করে ডেকে আনা হয়েছে বলে ছাত্রেরা সেদিন কোন গোলযোগ করেনি। কিন্তু ১০ জানুয়ারি ১৯১৬ তারিখে তিনি কয়েকজন ছাত্রকে কলেজের বারান্দায় ধাক্কা দেন।

ছেলেরা যেহেতু থার্ড ইয়ার অর্থাৎ বি এ ফার্স্ট ইয়ারের ছিল এবং সুভাষচন্দ্র সেই ক্লাসের প্রতিনিধি ছিলেন, তিনি অধ্যক্ষ মিঃ এইচ আর জেমসের কাছে গিয়ে প্রতিবাদ জানান। অধ্যক্ষ মিঃ জেমস জানান, যেহেতু অধ্যাপক ওটেন ইন্ডিয়ান এডুকেশান সার্ভিসের সদস্য তাই তিনি অধ্যাপক ওটেনকে শাসন করতে পারবেন না। পরদিন ছাত্ররা ধর্মঘট শুরু করে এবং ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিন কর্তৃপক্ষ ওটেনকে চাপ দিলে ওটেন ছাত্র প্রতিনিধিদের সাথে কথা বলে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলেন। কিন্তু প্রায় একমাস পর ওটেন একই কাজ করে ফেলেন।

যদিও সেবারের ছাত্রটি আই এ ফার্স্ট ইয়ারের ছিল, সুভাষচন্দ্র ছাত্র-প্রতিনিধিদের মিটিংয়ে জানান, এই অধ্যাপককে এভাবে শোধরানো যাবে না এবং তাকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে। ছাত্র-প্রতিনিধিদের সভায় তাঁর এই প্রস্তাব অনুমোদিত হয় এবং পরদিন, ১৫ই ফেব্রুয়ারি ১৯১৬, মিঃ ওটেন কলেজের করিডোরে প্রহৃত হন। এই ঘটনার জন্য সুভাষচন্দ্র এবং শ্রী অনঙ্গ মোহন দাম কলেজ ও ইউনিভারসিটি থেকে বহিষ্কৃত হন। যদিও সুভাষচন্দ্র নিজে মিঃ ওটেনকে প্রহার করেননি, তিনি নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে চুপ করে থাকেন। সত্যি বলে দায়িত্ব এড়িয়ে বহিষ্কার এড়াতে রাজি হন না।

নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ছোটবেলায় প্রথমে তিনি ইংরেজি শিক্ষা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসেছেন এবং ইংরেজদের সঙ্গে মিশেছেন। তারপর তিনি নিজের দেশের সংস্কৃতির সঙ্গেও পরিচিত হন। যখন তিনি স্কুলে পড়েন তখন বিভিন্ন প্রদেশের ছেলেদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। মুসলমানদের সম্বন্ধে উদারতার জন্য তাঁর ছেলেবেলার অভিজ্ঞতাই বহুল পরিমাণে দায়ী। তাঁদের কটকের বাড়ী ছিল মুসলমান এলাকায় এবং প্রতিবেশীরা বেশীরভাগই ছিল মুসলমান। তাঁর বাবাকে সবাই খুব শ্রদ্ধা করতেন।

তাঁরাও মুসলমানদের উৎসব অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন। তাঁদের বাড়ীর কাজের লোকেরা অনেকেই মুসলমান ছিলেন এবং তাঁরাও সুভাষচন্দ্রদের খুব অনুরক্ত ছিলেন। স্কুলে মুসলমান শিক্ষক আর ছাত্রদের সাথেও তাঁদের খুব সৌহার্দ্য ছিল। মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করা ছাড়া কোন ব্যাপারেই তিনি কোন প্রভেদ দেখতেন না। এই জন্যই আজাদ হিন্দ ফৌজে হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খ্রিষ্টান-সব ধর্মাবলম্বীরা এক হয়ে ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পেরেছিল।

বাল্যকাল আর কৈশোর ছিল সুভাষচন্দ্রের প্রস্তুতির সময়। যে দেশপ্রেম তাঁর পরবর্তী জীবনে প্রস্ফুটিত হয়েছে, তার ব্যাপকতা, গভীরতা, বিস্তীর্ণটা ইত্যাদি বুঝতে হলে তাঁর বাল্যকাল আর কৈশোরকে ভাল করে জানতেই হবে। যারাই নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনী অধ্যয়ন করেছেন তাঁরাই একমত হবেন যে তিনি এই উপমহাদেশের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক।

পূর্বেই বলেছি, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর মধ্যে কোন প্রাদেশিক, ধার্মিক বা জাতপাতের সঙ্কীর্ণতা ছিল না। তিনি মনে করতেন, ধর্ম যার যার নিজস্ব ব্যাপার। তিনি নিজেকে সম্পূর্ণভাবে দেশের জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন এবং তাঁর এই দেশপ্রেম কৈশোরেই অঙ্কুরিত হয়েছিল। এমনকি তিনি যে আই.সি.এস পাস করে তা থেকে পদত্যাগ করবেন তাও সেই কৈশোরেই স্থির করে ফেলেছিলেন। বালক-কিশোর সুভাষচন্দ্রই পরে নেতাজী হয়ে আমাদের দেশকে ইংরেজের হাত থেকে স্বাধীন করেছিলেন।

সেসময়কার ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এ্যাটলি নিজমুখে একথা স্বীকার করে গেছেন। শুধু দুঃখের কথা এই যে কিছু স্বার্থান্বেষী নেতার জন্য যে অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন নেতাজী দেখেছিলেন, তা পূরণ করা সম্ভব হয়নি। আজ এত বছর পর নেতাজীর আকাঙ্ক্ষিত বৃহত্তর ভারতের প্রয়োজনীয়তা কিছুটা হলেও আমরা উপলব্ধি করতে পারছি। নেতাজীর জীবনযাপন, চিন্তাভাবনা, কার্যকলাপ সব একটি মাত্র আবেগ দ্বারাই সঞ্চালিত হয়েছে এবং তা হচ্ছে দেশপ্রেম।

অহিংসার পূজারি গান্ধীজী পর্যন্ত তাঁকে “Patriot of Patriots” আখ্যা দিতে বাধ্য হয়েছেন। নেতাজীর দেশপ্রেম নেলসন ম্যান্ডেলা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং আরও অনেককে অনুপ্রাণিত করেছে। আজও ভারতবাসী এবং বাঙালী নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর তুলনাহীন দেশপ্রেম থেকে অনুপ্রাণিত হন। যতদিন মানবজাতি থাকবে এবং দেশপ্রেম আলোচিত হবে, ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জনক নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর নাম পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হবে। জয়তু নেতাজী।।

লেখক: সাবেক কুটনীতিক ও ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু, নয়াদিল্লি; ভারত। ইমেল: [email protected]

;