লেখকদের সমুদ্র অভিযাত্রা: নদীপথে বিশ্বের প্রথম বইমেলা

  • মাহমুদ হাফিজ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

লেখকদের সমুদ্র অভিযাত্রা: নদীপথে বিশ্বের প্রথম বইমেলা

লেখকদের সমুদ্র অভিযাত্রা: নদীপথে বিশ্বের প্রথম বইমেলা

বঙ্গোপসাগর থেকে ফিরে: দেশের প্রায় তিনশ’ লেখকের সমুদ্র অভিযাত্রী দল মেঘনা-মোহনা ও বঙ্গোপসাগর পরিভ্রমণ শেষে ডাঙায় ফিরেছেন। বৃহস্পিতবার যাত্রার মেঘনা মোহনা ও বঙ্গোপসাগর পরিভ্রমণশেষে তাঁরা শনিবার রাতে বুড়িগঙ্গায় ফিরে আসেন। বিলাসবহুল জাহাজে তিন দিন দুই রাত অবস্থানের সময় প্রীতি সম্মিলনী, আলোচনাসভা, সমকালীন সাহিত্য বিতর্ক, কবিতাপাঠ, সঙ্গীতানুষ্ঠান, র‍্যাফেল ড্র ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠিত হয়। এতে আয়োজন করা হয় ভাসমান জাহাজে পরিভ্রমণরত লেখকদের বই নিয় নদীপথে বিশ্বের প্রথম বইমেলা। অভিযাত্রী দল হরিণের অভয়ারণ্যখ্যাত চর কুকরিমুকরি দ্বীপ, লাল কাঁকড়ার বাসস্থানখ্যাত তারুয়া সমুদ্র সৈকত, ভোলার কচ্ছপিয়া ঘাট ও বেতুয়া টার্মিনাল ভ্রমণ করেন। বিলাসবহুল জাহাজ শুভরাজে এই সমুদ্রযাত্রার আয়োজন করে কবি অনিকেত শামীম সম্পাদিত ‘লোক’ লিটল ম্যাগাজিন। বার্তা ২৪ কম এর প্রতিনিধি  তিনদিনের অভিযাত্রায় শামিল হয়ে বিস্তারিত পর্যবেক্ষণ করেছেন।

লঞ্চে বই পড়া

লেখকদের ফি বছর আনন্দ ভ্রমণ আয়োজনের ধারাবাহিকতায় এ বছর ‘লোক’ সমুদ্র অভিযাত্রার পরিকল্পনা করে। কয়েকমাস ধরে আয়োজনের প্রস্তুতি চলে। কথাসাহিত্যিক পারভেজ হোসেনকে আহবায়ক, কবি হাসান মাহমুদ ও সাকিরা পারভীনকে যুগ্ম আহবায়ক এবং কবি আহমেদ শিপলুকে সদস্য সচিব করে ভ্রমণ বাস্তবায়নে কমিটি করা হয়। বিভিন্ন বিভাগে লেখক-কবিদের সমন্বয়ক নির্বাচিনকরা হয়। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও ঘুর্ণিঝড়ের পূর্বাভাসের লেখকদের  জলযাত্রায় দ্বৈরথ তৈরি হয়। স্বভাবসুলভ বোহেমিয়ানা আর ভবের পাগল অদম্য লেখকদের কিছুই দমাতে পারেনি। বৃহস্পতিবার ঘূর্ণিঝড়প্রভাবিত গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিকে সৃষ্টিতে পরিণত করে সারাদেশ থেকে তিনশ লেখক যখন ওয়াইজঘাটের শুভরাজ জাহাজে পৌঁছান, তখন আর কারও বুঝতে বাঁকি ছিল না- এ যাত্রা অদম্য ও অবধারিত।

বিজ্ঞাপন
উন্মুক্ত আলোচনা_ বাক স্বাধীনতা ও লেখকের দায়

জাহাজের প্রবেশমুখে পারভেজ হোসেন ও অনিকেত শামীম এর নেতৃত্বে আহমেদ শিপলু, রিপন আহসান রিতু, মুশতাক মুকুল লেখকদের কেবিন বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন- তখন সকলের  মুখে মুখে ভেসে ওঠে সমুদ্রযাত্রার আভাস। এই যাত্রায় শামিল হতে অনেক লেখক দেশের নানাপ্রান্ত থেকে এসে বাংলাবাজারের বিউটি বোর্ডিং ও সদরঘাটের বিভিন্ন হোটেলে পূর্বদিন রাত্রিযাপন করেন। ঢাকা থেকে যোগ দেন সমান সংখ্যক লেখক। জাহাজে নিবন্ধন ও চাবি বুঝিয়ে দেয়ার কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর বিলাসবহুল বহুতল জাহাজটি দেখে সবাই আন্দে মেতে ওঠেন। যাত্রা শুরুর পর আসে সান্ধ্য জলপানের আহবান।

সঙ্গীতানুষ্ঠানের আকৃষ্ট ভিডিওধারী লেখক সাংবাদিকগণ

সংক্ষিপ্ত উদ্বোধনীপর্ব ও সঙ্গীতায়োজনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় সমুদ্রমুখো জাহাজযাত্রা। কবি সম্পাদক সঙ্গীতশিল্পী হাসান মাহমুদ এর উপস্থাপনায় সঙ্গীতানুষ্ঠান সকলের উপস্থিতিতে আনন্দঘন হয়ে ওঠে। এতে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন অনেক কবি, বাচিক শিল্পীগণ আবৃত্তি করেন এবং  হাসান মাহমুদ স্বয়ং ভরাট গলায় গানে মাতিয়ে রাখেন সকলকে। পরে ‘বাক-স্বাধীনতা ও লেখকের দায়’ নিয়ে উন্মুক্ত আলোচনাপর্ব অনিকেত শামীম সভাপতিত্ব করেন। কবি নাসির আহমেদ, নাট্যকার মাসুম রেজা, ভ্রমণলেখক শাকুর মজিদ, কবি আরিফুল হক কুমার, কবি আহমেদ স্বপন মাহমুদ, কবি চঞ্চল আশরাফ, কবি জাহানারা পারভীন প্রমুখ আলোচনা করেন। সঞ্চালনা করেন কবি জুয়েল মাজহার। ভররাত ধরে চলে সঙ্গীত, নৃত্য, কবিতাপাঠ, আড্ডা। টানা চৌদ্দঘন্টা অসংখ্য নদী পরিভ্রমণ করে লেখকগণকে বহনকারী শুভরাজ জাহাজ সকাল আটটায় চরফ্যাশনের বেতুয়া টার্মিনালে নোঙর করে।

বিজ্ঞাপন
চর কুকরিমুকরির পাখি

পরদিন লেখকবৃন্দ সকালের নাস্তা সেরে বেতুয়া থেকে শশীভূষণ বাজার হয়ে রিজার্ভ বাসযোগে পৌঁছান কচ্ছপিয়া ঘাটে। কচ্ছপিয়া থেকে বিশেষ ট্রলার ও লঞ্চে চর কুকরিমুকরি, তারুয়া সমুদ্রসৈকতসহ আশপাশের বিভিন্ন দ্বীপ ও বঙ্গোপাসাগর ভ্রমণে যাওয়া যায়। ক্চ্ছপিয়া ঘাট থেকে বিশেষভাবে সজ্জিত তিনটি লঞ্চ ও কয়েকটি স্পিডবোটে লেখকগণ তারুয়া সমুদ্র সৈকতে পৌঁছান। লাল কাঁকড়ার আবাস আর সৃজিত বন দেখার পর তাঁদের বহনকারী লঞ্চ যাত্রা করে উত্তর বঙ্গোপসাগর। সমুদ্রের প্রান্ত ছুঁয়ে তা পৌঁছে যায় চর কুকরি মুকরি। এখানে ছিল  মধ্যাহ্নারের আয়োজন। মধ্যাহ্ন আহারে ছিল সমুদ্রের তাজা পোয়া মাছের তরকারি, ডাল, সব্জি আর দেশি মোটা চালের ভাত। মধ্যাহ্নারে উদরপূর্তি করে কেউ সমুদ্রে নামেন, কেউ পাশের বনে হরিণ দেখতে চলে যান কেউ ছোটেন প্রকৃতির নীবিড় সান্নিধ্যে। পরে সন্ধ্যার আগে তারা ফের রওয়ানা দেন কচ্ছপিয়া ঘাট হয়ে বেতুয়ায় নোঙর করা জাহাজে।

জাহাজে রাতে স্বরচিত কবিতপাঠ, সঙ্গীতায়োজন ও নদীপথে বিশ্বের প্রথম ব্‌ইমেলার আয়োজন করা হয়। এতে উপস্থিত লেখকরা স্ব স্ব  বইপত্র প্রদান করে মেলার টেবিলগুলো ভরে ফেলেন। বহু বই বিক্রিও হয়। অনুষ্ঠানের আয়োজকদের পুরোধা অনিকেত শামীম ঘোষণা করেন গুগলে অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, বাংলায়, এশিয়ায় এমনকি বিশ্বে নদীপথে এটাই প্রথম বইমেলা।

জাহাজের টাইটানিক ডেকে ক্যাম্পিংয়ের সামনে

বেতুয়ায় ভাসমান জাহাজে রাত্রিযাপনের পরদিন সকালে লেখকবৃন্দ ঢাকামুখো যাত্রা করেন। এ সময় অনুষ্ঠিত হয় ‘প্রযুক্তিযুগে লিটল ম্যাগাজিনের হাল হকিকত’ শীর্ষক উন্মুক্ত আলোচনা। কথা সাহিত্যিক সেলিম মোরশেদ এর সভাপতিত্ব ও রাজা সহিদুল আসলামের সঞ্চালনায় আলোচক ছিলেন কবি সম্পাদক সরকার আজিজ, পরিব্রাজক ও ভ্রমণগদ্য সম্পাদক মাহমুদ হাফিজ, চর্যা সম্পাদক কবি আযাদ নোমান, কবি সম্পাদক মারুফুল আলম, কবি সম্পাদক দ্রাবিড় সৈকত, কবি সম্পাদক আহমেদ শিপলু, কবি সম্পাদক আঁখি সিদ্দিকা প্রমুখ। মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন বর্ষীয়ান কবি আবদুর রাজ্জাক, কবি ফরিদ কবির ও কবি চঞ্চল আশরাফ। বিপুল কবি-লেখকের অংশগ্রহণে বিতর্কটি হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত ও শিক্ষণীয়।

র‍্যাফেল ড্র, পুরস্কার বিতরণী ও বইমেলায় বিক্রিত বইয়ের অর্থ লেখকদের হাতে প্রদানের  মাধ্যমে সমাপণী পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। সমাপণী পর্ব পরিচালনা করেন  আহবায়ক পারভেজ হোসেন ও সমন্বয়ক কবি রিপন আহসান রিতু। পুরস্কার বিতরণ করেন নাসির আহমেদ, অনিকেত শামীম, মাহমুদ হাফিজ, তারেক রেজা, হাসান মাহমুদ প্রমুখ। র‍্যাফেল ড্র’তে প্রথম পুরস্কার লাভ করেন কবি ফরিদ কবির। এতে জুয়েল মাজহার, চঞ্চল আশরাফ, ইমরান উজ জামান, রেহানা জামান প্রমুখকে তাঁদের বিক্রিত বইয়ের দাম আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয়।

কেবিন জোনে কবি আবদুর রব ও ভ্রামণিক মাহমুদ হাফিজ

সমুদ্র অভিযাত্রার আয়োজক-অংশগ্রহণকারী নির্বিশেষে উদ্দীপনা ছিল উল্লেখের মতো। এতে অংশগ্রহণ করে  কবি আবদুর রব বার্তা ২৪ কম বলেছেন, লেখকরা সৃষ্টি ও আনন্দের কারবারি। এ ধরনের আয়োজন তাঁদের সৃষ্টির প্রণোদনাকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। এরকম ভ্রমণে প্রথম অংশগ্রহণকারী কবি ও গল্পকার রেহানা জামান বলেন, ব্যতিক্রমী আয়োজনে অংশ গ্রহণ এই প্রথম। নদীপথের প্রথম বইমেলায় গল্প ও কবিতার বই নিয়ে উপস্থিত হতে আগ্রহী ছিলাম। তাছাড়া ভ্রমণ ও প্রকৃতি ‌আমার পছন্দ। মূল উদ্যোক্তা অনিকেত শামীম ও আহবায়ক পারভেজ হোসেন জানিয়েছেন, লেখকদের আনন্দ ভ্রমণে দেশের কবি-লেখকদের বিপুল সাড়ায় আমরা অভিভূত। ব্যতিক্রমী সব আয়োজন লেখকদের যেমন সমৃদ্ধ করে, তাদের মধ্যে ভাবের আদানপ্রদান ও সম্প্রীতিও বাড়ায়। তাই প্রতি বছর আনন্দ আয়োজন অব্যাহত থাকবে।

সমুদ্র অভিযাত্রা উপলক্ষে ‘লোক’ ম্যাগাজিন কবিদের নাম ঠিকানা সংবলিত বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। এ উপলক্ষে বিশেষ ব্যাগ, কলম ও প্যাড উপহার দেয়া হয়।