প্রবীণ লেখকদের থেকে আমরা তরুণরা সেভাবে অনুপ্রেরণা পাই না!
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) আয়োজনে সিআরবি শিরিষতলায় মাসব্যাপী অমর একুশে বইমেলায় এক তরুণ লেখক মন্তব্য করে বলেন, প্রবীণ লেখকদের থেকে আমরা তরুণরা সেভাবে অনুপ্রেরণা পাই না!
বইমেলাকে কেন্দ্র করে লেখক-পাঠকদের আড্ডায় মুখর হয়ে উঠেছে মেলা প্রাঙ্গণ। তবে চট্টগ্রামের তরুণ লেখকদের মনের হতাশা যেন কিছুতেই কাটছে না! এই হতাশার অন্যতম বড় কারণ প্রবীণ লেখকদের সংস্পর্শ না পাওয়া।
তরুণ লেখকদের অভিযোগ, নবীনদের জন্য প্রবীণ লেখকরা তেমন কোনো ভূমিকা রাখছেন না। অনুপ্রাণিত করা তো পরের কথা, অনেকে মনে করেন, নবীনদের লেখা দুর্বল, তাদের লেখার হাত কাঁচা, সে কারণে নবীনদের ‘দূর দূর’ করে তাড়িয়ে দেন।
আজকের নবীনরাই একদিন প্রবীণ হবেন, সে বিষয় নিয়েই মঙ্গলবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) কথা হয়, চট্টগ্রামের কয়েকজন তরুণ লেখকের সঙ্গে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, তরুণ কবি ও কথা সাহিত্যিক রাহমাতুল্লাহ রাফির প্রথম উপন্যাস ‘আত্মহত্যার ইতিবৃত্ত’ এবারের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে। ‘উপকথা’ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হওয়া এই বইটির প্রচ্ছদ করেছেন গুণী প্রচ্ছদশিল্পী পরাগ ওয়াহিদ। এর আগে তার দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
তরুণ এই কবি ও কথা সাহিত্যিক বার্তা২৪.কমকে বলেন, সত্যি বলতে কী প্রবীণ লেখকদের থেকে আমরা তরুণরা সেভাবে অনুপ্রেরণা পাই না! কয়েকজন ছাড়া অধিকাংশ প্রবীণদের ধারণা, তরুণেরা লিখতে জানে না। অথচ, তাদের কর্তব্য ছিল প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ লেখকদের রচনা নেড়ে-চেড়ে তারপর একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া।
রাফি বলেন, ‘নবীনদের সঙ্গে প্রবীণদের পার্থক্য হচ্ছে, জেনারেশনের। তারা যেই পটভূমিতে গল্প বলেন, আমাদের সেই পটভূমি থেকে বের হয়ে আসতে হয়েছে। তাদের গল্পে যদি চিঠি কিংবা টেলিফোনে নায়ক-নায়িকার যোগাযোগ হয়, আমাদের গল্পে সেই স্থান দখল করবে মেসেঞ্জার-হোয়াটসঅ্যাপ। কিন্তু তারা সেটা মানতে চান না।’
আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামের শিক্ষার্থী, তরুণ কবি ও কথা সাহিত্যিক কামরান চৌধুরী ২০২৩ সালের বইমেলায় ‘আখ্যায়িকা’ নামে একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। ‘দুয়ার’ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত সে বইটির প্রচ্ছদ করেছিলেন পরাগ ওয়াহিদ।
তরুণ এই কবি ও কথা সাহিত্যিক বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘আখ্যায়িকা’ আমার মৌলিক কাব্যগ্রন্থ। কবিতা যেমন ভালোবাসতে শেখায়, বিরহের কথা বলে, তেমনি জীবনের কথা বলে! জীবনের কিছু কবিতা রয়েছে এই 'আখ্যায়িকা'য়। বইটির জন্য পাঠকমহল থেকে বেশ সাড়া পেয়েছি। বইটি নিয়ে পাঠকদের আগ্রহ দেখে আমি আশাবাদী। তাদের আলোচনা-সমালোচনা আমাকে অনুপ্রাণিত করে, শেখায়!’
তবে কামরান চৌধুরীর মনের দুঃখ অন্য জায়গায়! খোলাসা করলেন সেটিও। বললেন ‘একটা বিষয় খুব খারাপ লাগে! আমি বহু প্রবীণ লেখককে দেখেছি, আত্ম অহংকারে নিমজ্জিত। উদীয়মান লেখকদের জন্য তাদের যেন করণীয় কিছুই নেই! তাদের অনেকেই নবীন লেখকদের দূর দূর করে তাড়িয়ে দেন। অনেকেই মনে করেন, নবীনদের লেখা দুর্বল! তাদের লেখার হাত কাঁচা। অথচ আজকের নবীনরাই একদিন প্রবীণ হবেন।’
চট্টগ্রামের আরেক তরুণ গুণী কবি রহস্য শর্মা। ‘হারিয়ে তোমায় পথে’ ও ‘একান্নিশা’ কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে গত কয়েক বইমেলায় তিনি ব্যাপক সাড়া ফেলেছিলেন। এবারের বইমেলাতেও তার নতুন কবিতার বই ‘দ্রোহন্যতে’ আলো ছড়াচ্ছে। এই বইটির প্রচ্ছদও করেছেন পরাগ ওয়াহিদ।
তরুণ এই কবি বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘বর্তমানে প্রবীণ লেখকরা নবীনদের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেন না। এটা হতে পারে, জেনারেশনের গ্যাপের কারণে। হতে পারে. তাদের আত্মম্ভরিতার কারণে। আবার হতে পারে, ব্যস্ততার কারণে। তাছাড়া, প্রবীণ লেখকরা পড়ালেখায় নব্বই শতাংশ সময় ব্যয় করলেও নবীনরা পুরো সময় নষ্ট করছেন মার্কেটিং আর মিডিয়াতে।
এখানে আমি করো নিন্দা করতে আসিনি। তবে, বড় সত্য যে, তরুণদের অনেকেই পড়ালেখা থেকে অনেক দূরে থাকেন। প্রবীণদের সংস্পর্শ থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখেন আবার প্রবীণ লেখকদেরও একটা অংশ তরুণদের থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেন।’
তবে, তরুণদের এসব অভিযোগ মানতে নারাজ ‘একুশে পদক’প্রাপ্ত বরেণ্য লেখক হরিসংকর জলদাস।
বার্তা২৪.কমকে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে এমন কেউ আসেনি। যারা এসেছে, তাদের লেখায় কোনো ভুল থাকলে আমি ধরে ধরে সেগুলো সংশোধন করেছি। তাছাড়া, তরুণেরা কোনো স্কুল খুলে বসেনি যে, তাদের সময় দেওয়া প্রবীণদের জন্য বাধ্যতামূলক। সংস্পর্শ-সান্নিধ্যের জন্য প্রবীণদের কাছে যেতে হয়। তার জন্য দরকার আনুগত্য, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। তবে, সবাই সহযোগিতা করবে না, সেটা সত্য। আমার বইও এক সময় এক লেখক সামনেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। লেখকরা ব্যস্ত থাকেন। তবে, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা নিয়ে আসলে প্রবীণরা অবশ্যই তাদের মূল্যায়ন করবেন!’