মোশতাক আহমেদ: এক থেকে হাজার কপির লেখক
বইমেলায় ২০০৪ সালে প্রথম উপন্যাস জকি বের করার পর মাত্র এক কপি বিক্রি হয়েছিল। এমন ঘটনায় যেকোন লেখকের জন্যই মন খারাপ হওয়া স্বাভাবিক। তবে এতে দমে যাননি তখনকার নবাগত লেখক মোশতাক আহমেদ। তিনি চেষ্টা করে গেছেন গত ২০ বছর ধরে। লিখেছেন শতাধিক উপন্যাস। এছাড়া নিজেকে শুধু এক জায়গায় সীমাবদ্ধ রাখেননি। ১২০টি উপন্যাসের মধ্যে বেশিরভাগই সায়েন্স ফিকশন। এক্ষেত্রে তিনি এবার হাফ সেঞ্চুরি করেছেন। এবারের বইমেলায় এসেছে তার ৫০তম সায়েন্স ফিকশন ‘দ্য নিউ ওয়ার্ল্ড’। এছাড়াও বহুমাত্রিক লেখক মোশতাক আহমেদ ধারাবাহিকভাবে লিখেছেন প্যারাসাইকোলজি থ্রিলার, ভৌতিক উপন্যাস, রোমান্টিক উপন্যাস, কিশোরদের জন্য শিশিলিন গোয়েন্দা সিরিজ রূপার সিন্দুক। একই সঙ্গে ভ্রমণ ও মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস রচনায়ও তিনি সমাদৃত হচ্ছেন সর্বত্র।
বইমেলায় সরেজমিনে মোশতাক আহমেদের বই কিনতে পাঠকদের ব্যাপক ভীড় পরিলক্ষিত হয়েছে। সিরিয়াল ধরে অটোগ্রাফ ও ফটোগ্রাফও নিচ্ছেন পাঠকরা। মোশতাক আহমেদের পাঠকদের মধ্যে কিশোর এবং নারীদেরই বেশি দেখা গেল। অনিন্দ্য প্রকাশের সত্বাধিকারী আফজাল হোসেনের কথায়ও তার প্রমাণ মিলল। আফজাল হোসেন বলেন, কথাসাহিত্যিক মোশতাক আহমেদ খুব জনপ্রিয় লেখক। এজন্য আমরা তার ৯০টিরও বেশি বই প্রকাশ করেছি। এবারও তার চারটি নতুন উপন্যাস এসেছে। সেগুলো হলো: প্যারাসাইকোলজি উপন্যাস- হারানো জোছনার সুর। সায়েন্স ফিকশন- দ্য ওল্ড ওয়ার্ল্ড। ভৌতিক- মৃত্যুবাড়ি। শিশিলিন গোয়েন্দা সিরিজের রূপার সিন্দুক। প্রতিবছরই বইমেলার শুরু থেকেই পাঠকরা তার বই কিনে থাকেন। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। পাঠক চাহিদা অনুযায়ী আমরা তার পুরনো অনেক বইও পুনমুদ্রণ করেছি। নতুনগুলো তো আছেই। একেকজন পাঠক ৫-৭টা করেও বই কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। এতে আমরা খুবই খুশি।
মোশতাক আহমেদ ২০১৮ সালে বাংলা একেডেমি সাহিত্য পুরস্কার এবং শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন। এছাড়াও তিনি কালি ও কলম সাহিত্য পুরস্কার, ছোটদের মেলা সাহিত্য পুরস্কার, কৃষ্ণকলি সাহিত্য পুরস্কার এবং চ্যানেল আই সিটি আনন্দ সাহিত্য পুরস্কারসহ নানা সম্মাননায় ভূষিত হন। লেখালেখির বিগত দু’দশকে বহুবার বইমেলা এবং অনলাইনে বই বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানসমূহে তার বই বেস্ট সেলার হয়েছে। এখন সবমিলিয়ে হাজার হাজার কপি বই বিক্রি এবং লেখক হিসেবে তুমুল জনপ্রিয় হলেও তিনি অতীতকে ভুলে যাননি। অকপটেই স্বীকার করলেন প্রথমবার তার মাত্র এক কপি বই বিক্রির কথা।
মোশতাক আহমেদ বলেন, ২০০৪ সালে প্রথমবার আমার ‘জকি’ উপন্যাসটি বইমেলায় আসে। সেবার মাত্র এক কপি বই বিক্রি হয়েছিল। এতে আমার মন খুব খারাপ হয়েছিল। একপর্যায়ে দেখি মেলায় একজন লেখকের বই তুমুল জনপ্রিয়। তাকে ঘিরে পাঠকরা বলতে গেলে উন্মাদনায় ছিল। পরে দেখলাম তিনি জনপ্রিয় সায়েন্স ফিকশন লেখক ড. জাফর ইকবাল। তখন ভাবলাম সায়েন্স ফিকশন যেহেতু জনপ্রিয়, তাই এ ধরনের বই লেখা যায়। সেই যে সায়েন্স ফিকশন লেখা শুরু, এরপর থেকে আমাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
ভৌতিক উপন্যাস লেখার কারণ কী? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একবার বইমেলায় এক নারী পাঠক আমাকে বললেন- ভুতের বই আমার খুব প্রিয়। আপনি ভুতের বই লিখবেন। এরপর থেকে আমিও ভাবলাম, এমন পাঠকদের বিশেষ করে নারী পাঠকদের বঞ্চিত করে কী লাভ? তখন থেকে প্রায় প্রতিবছরই আমি একটা করে ভৌতিক উপন্যাস লিখে থাকি। এছাড়া রোমান্টিক উপন্যাসও নারী-পুরুষদের ভালো লাগার একটি বিষয়। সেজন্য রোমান্টিক উপন্যাস লিখে থাকি।
শিশিলিন গোয়েন্দা সিরিজ মোশতাক আহমেদের জনপ্রিয় একটি কিশোর গোয়েন্দা উপন্যাস। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য গোয়েন্দা সিরিজ না লিখে কিশোরদের জন্য শিশিলিন সিরিজ কেন লিখছেন? জবাবে মোশতাক আহমেদ জানান, গোয়েন্দা সিরিজ লিখতে আমারও ইচ্ছে হয়। তবে আমি বাংলাদেশ পুলিশে কাজ করি। একজন পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে আমার লেখা গোয়েন্দা সিরিজে পেশাগত কোনো গোপনীয়তা প্রকাশ হয়ে যায় কিনা সেই ভয়ে থাকি। যেটা হয়তো আমার প্রকাশ করা উচিৎ হবে না। এজন্য আমি এখন গোয়েন্দা সিরিজ লিখছি না। তবে ভবিষ্যতে অবসরের পর হয়তোবা গোয়েন্দা সিরিজ লিখতে পারি।
বাংলা সাহিত্যে সম্পূর্ণ নতুন একটি ধারা প্যারাসাইকোলজি উপন্যাস। মোশতাক আহমেদকে প্যারাসাইকোলজি উপন্যাস তুমুল জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, গতানুগতিক উপন্যাস তেমন জনপ্রিয় না হওয়ায় আমি আসলে বিভিন্ন ধারায় লেখা শুরু করি। নতুন ধারা তৈরির চেষ্টা থেকেই মূলত: প্যারাসাইকোলজি উপন্যাস লেখা। শুরুতে ভয়ে ছিলাম প্যারাসাইকোলজি নাম নিয়ে। এমন নামে উপন্যাস চলবে কিনা সেটা নিয়ে দ্বিধায় ছিলাম। তবে পাঠক আমাকে হতাশ করেনি। বরং প্যারাসাইকোলজি উপন্যাস পাঠকদের কাছে তুমুল জনপ্রিয়।
একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা হয়েও কীভাবে লেখালেখির সাথে যুক্ত আছেন এবং শতাধিক বই লিখলেন? মোশতাক আহমেদের ভাষ্য, আমি আসলে নিয়ম করে নিয়মিত লিখি। বছরে ৩৬৫ দিনের মধ্যে প্রায় ৩৫০ দিনই সকাল ৬টা থেকে ৮টা পর্যন্ত লেখালিখি করি। আর আমার কম্পিউটার টাইপিং স্পিডও অনেক ভালো। এছাড়া কোনো গল্পের প্লট মাথায় আসলে সেটি নোট করে রাখি। এতে পরবর্তীতে আমাকে গল্পের সংকটে পড়তে হয় না। এখনও আমার শতাধিক গল্পের প্লট নোট করা আছে। এসব কারণে এবং সর্বোপরি পাঠকের ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমি এতদূর আসতে পেরেছি। এই ধারা ভবিষ্যতেও বজায় রাখব।
লেখালেখি জীবনের কোনো একটি স্মৃতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রথম থেকেই আমি সাধারণত কোনো বইয়ের পুশ সেল করি না। আমার বাসনা ছিল, যেদিন থেকে সাধারণ কোনো পাঠকের বুকশেলফে আমার বই দেখতে পাবো, সেদিন হয়তো বুঝতে পারব আমার লেখালেখি স্বার্থক। কিন্তু পুলিশ কর্মকর্তা হওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের যে কারও বাসায় যাওয়ার সুযোগ থাকে না। পেশাগত কারণেই আমরা সব জায়গায় যেতে পারি না। কিন্তু একবার হঠাৎ ফোন এলো এক নারী তার দুই সন্তানসহ ‘আত্মহত্যা’ করেছেন। পেশাগত কারণে সেখানে যেতে হলো। ক্রাইম সিন দেখতে গিয়ে একপর্যায়ে সেই বাসার আলমারিতে আমারই লেখা একটি বই প্রথমবারের মতো দেখতে পেলাম। সেদিন বুঝতে পারলাম আমার লেখালেখি স্বার্থক। তবে সেটি আমার জন্য আনন্দদায়ক হওয়ার চেয়ে বেশি কষ্টকরই ছিল।