পরাবাস্তবতা-জাদুবাস্তবতা
আপাতদৃষ্টিতে অবাস্তব অথচ বাস্তবের অধিক
অসম্ভব তবু প্রতিনিয়ত সম্ভাবনার শঙ্কা জাগায়
তারই নাম পরাবাস্তবতা
অন্যভাবে বলতে জাদুবাস্তবতা:
যেমন, এই যে আশ্চর্য সকাল
এর কতtটুকু তুমি দেখো
কতটুকু আমি
আর কতটুকু দিগন্তের ওপাশে অদেখার!
জলের উপর একলা মুখ ঝুঁকিয়ে থাকা
শেষবিকেলের মর্মবেদনা জানে
শিরীষ কিংবা কৃষ্ণচূড়ার ভাসমান পাতা
তুমি আর আমি কতটুকু জানি!
অর্থবোধ্য সীমানা পেরিয়ে
আমাদের যাতায়াত নেই
এমন কোনো ঠিকানায়
যার দিক নেই, চিহ্ন নেই, প্রতীক নেই!
সম্পর্ক
প্রিজমের টুকরোয় ছিটকে পড়া আলোয়
অধ্যয়ন করছি সম্পর্ক
সম্পর্কের উত্থান-পতন
বাঁক ও শিহরণ
লগ-ইন বা লগ-আউটে
নিত্য জন্মাচ্ছে নতুন সম্পর্ক
সম্পর্কের বিভিন্ন রং
লিখে লিখে মুছে দিচ্ছে ফেসবুক
সন্তরণশীল সম্পর্ক খেলা করছে
মানুষের জীবনের বহুদূরের ভার্চুয়ালে
সম্পর্ক হয়ে গেছে স্বপ্নময় জগতে
মনকে জাগ্রত রাখার কৌশল
জোনাকি
দূরমনস্ক দার্শনিকতায়
রাতের পথে যারা আসে
তারা যাবে দিগন্তের দিকে
আত্মমগ্ন পথিক-পায়ে।
এইসব পদাতিকের অনেকেই আর ফিরবে না
ফিরে আসবে অন্য কেউ
তার চিন্তা ও গমনের ট্র্যাপিজ ছুঁয়ে
অন্য চেহারায়, অন্য নামে ও অবয়বে।
তারপর
গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে সরল রেখায়
আলোর মশালে জ্বলে উঠবে
অনুভবের অসংখ্য জোনাকি।
নিঃসঙ্গতা
নিঃসঙ্গতা শীতের কুয়াশার মতো প্রগাঢ়
তমসাচারী মৃত পাখির নিঃশব্দ কুহুতান-স্মৃতি
নিহত নদীর শ্যাওলাজড়ানো জলকণা
দাবানল-দগ্ধ বনমর্মর:
মায়ায় মুখ আড়াল করে অনন্য বিমূর্ত বিবরে
নিঃসঙ্গতা কল্পলোকে রঙ মাখে
নীলাভ স্বপ্নের দ্যুতিতে
অস্তিত্বে, অনুভবে, মগ্নচৈতন্যে:
জীবনের স্টেজ অ্যান্ড স্ক্রিনে!
আর্কিওপটেরিক্স
পনেরো কোটি বছরের পাথরশয্যা ছেড়ে তিনি
প্রত্নজীববিদের টেবিলে চলে এলেন:
পক্ষী জীবাশ্ম দেখে প্রশ্ন শুরু হলো পৃথিবীময়
‘ডানার হলেই তাকে পাখি বলতে হবে?‘
তাহলে ‘ফ্লাইং ডাইনোসরস‘ কি?
তাদের শরীরে রয়েছে ডানা, কারো কারো দুই জোড়া!
পাখি, একলা পাখি, ভাবের পাখি খুঁজতে খুঁজতে হয়রান
বিজ্ঞানী থেকে বিপ্লবী কবিগণ
আর্কিওপটেরিক্স কি পাখির আদি-জননী?
বীর সাঈদ
মোঃ আলাউদ্দীন ভুইয়া
সাঈদ ছিল গুণী, এই পুলিশ যেন খুনি,
টের পাইনি সাঈদ বাবা।
সরলতার সুজোগে, দানবের মত হুজুগে,
তাঁজা বুকে মারলি থাবা।
হে ঘাতক চিনলে না-সাইদ কে,
অন্যরা কারা।
আকাশ ছুঁয়ে গুলি মেরে দিতে
করে কারা!
প্রশ্ন; বল, বল, বল ওরে ঘাতকের দল,
শত শত সংসার করে দিলে-অচল।
বুঝে, না বুঝে চালিয়েছ-বন্ধুকের নল।
আমাদের দেশ, করে দিলে শেষ,
অন্ধকারে তল।
এখন বুঝি, হত্যা ছিল তোমাদের পুঁজি,
তোমরা তো হার মানিয়েছ ব্রিটিশের যোগ।
তোমরা তো হার মানিয়েছ ক্যান্সার রোগ।
তোমরা তো হার মানিয়েছ পাকের ডান্ডা।
সব শেষে পেলে শুধু ঘোড়ার আন্ডা।
হে; প্রভু তোমার কাছে ফরিয়াদ,
না, ছিল ছাত্র জনতার অপরাধ,
শুধু হকের উপর ছিল প্রতিবাদ,
ওরে তার পাপের ছিল এত ভার।
হেলমেট খুলে গেল ইশারায় বিধাতার,
মুহুর্তে ভেসে গেল দানবের ছায়া,
ছেলের মত দেখেও, ঘাতকের হল না যে মায়া,
ঘাতক তোমার নামের মাঝে করি শুধু-বমি,
দোয়া, সাঈদ না ফেরার দেশে সুখে থাক তুমি।
কিছু না বোঝার আগে বুকে নিলে-তীর।
আজ তুমি হয়ে উঠেছ বাংলার বীর।
আজিম রাস্তায় হাঁটছে। কিন্তু চমকে যাচ্ছে বারবার। এ কোথায় এলো সে! আজিম ছাড়া সবার মাথায় হেলমেট। অথচ রাস্তার কোথাও কোনো মোটর সাইকেল নেই। হেলমেট পড়ে যে মারামারি করছে তাও না। প্রতিটা মানুষ স্বাভাবিক চলাফেরা করছে। অথচ মাথায় হেলমেট! কেবল আজিমের মাথায় কিছু নেই। হেলমেটের কারণে মুখের কিছুই দেখা যায় না। হেলমেটের সামনে অংশ কালো গ্লাস দিয়ে ঢাকা। হেলমেটের মানুষ হাঁটছে। ওই অবস্থাতেই কথা বলছে একে অপরের সাথে। কী অদ্ভুত। একটা বাস গেলো। বাসের যাত্রীদের সবার মাথায় হেলমেট। একেবারে মুখ ঢাকা।
আজিমের ঘোর কাটছে না। এ কোথায় এলো সে!
‘আজিম সাহেব?’
কে যেন ডাক দিলো।
‘কে, কে?’
চমকে উঠলো আজিম।
‘এই যে আপনার পেছনে।’
আজিম হকচকিয়ে পেছনে তাকালো। একটা লাল হেলমেট পরা মানুষ।
‘কে আপনি? আপনাকে চিনছি না তো। হেলমেট পরে আছেন কেন?’
হেলমেটের মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে লোকটা হাসছে।
‘আপনিও পরবেন। সমস্যা নাই।’
‘দেখুন, হেলমেট না খুললে আমি কথা শুনব না। আপনাকে না দেখে তো আমি কথা বলছি না।’ আজিম রেগেই গেলো এবার।
লোকটা হেলমেট খুললো। আজিমের ঘোর কাটছে না। এ কি দেখছে সে!
লোকটার মাথাটা সংবাদপত্র দিয়ে মোড়ানো। চোখ নেই, নাক নেই। শুধু ঠোঁট, দাঁত আর জিহবা আছে। দাঁত দেখিয়ে হাসছে লোকটা।
লোকটার হাসি দেখে আশেপাশে আরো কয়েকজন হেলমেট মানব এলো। ওরাও দাঁড়ালো। আজিম খেয়াল করলো, সবাই গোল ওকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। হেলমেট খুলে ওরাও হাসছে জোরে জোরে।
ওদেরও সবার মাথা সংবাদপত্র দিয়ে মোড়ানো। এদেরও চোখ নেই, নাক নেই। দাঁত বের করে হাসছে আজিমের দিকে তাকিয়ে। যেন আজিম একটা কৌতুক।
একটা ঝাঁকুনি দিলো শরীরটা। মনে হলো হোঁচট খেলো। এতেই ঘুমটা ভাঙলো আজিমের। বিরক্ত মুখে বালিশের পাশে রাখা মোবাইল ফোনটায় সময় দেখলো। রাত ৪টা ২৯ মিনিট। কোনো মানে হয়? প্রায়ই ঘুম ভেঙে যাচ্ছে এই গভীর রাতে। স্বপ্নটা আবারো হানা দিয়েছে আজিমের চোখে। সেই একই স্বপ্ন। গরমে ঘেমে গেঞ্জি আর বিছানার চাদর এক হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। মগবাজারে আজিম যে বিল্ডিংটায় থাকে সেটা আটতলা। আজিম থাকে টপ ফ্লোরে। মাথার ওপরে ছাদ। আর ছাদ দিনভর সূর্যে তেতে থাকে। ফ্যানে আপাতত ঠাণ্ডা মেলে কিন্তু শরীরতো বিদ্রোহ করে।
তিন বেডরুমের ফ্ল্যাট বাসাটায় আজিম একটা রুমে থাকে। অন্য দুই রুমে থাকে সাদেক ও আফজাল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে হলে দুইজনই ছিল আজিমের রুমমেট। সাদেক এখন ব্যাংকার আর আফজাল কাজ করে ওষুধ কোম্পানিতে। পাস করে বের হওয়ার পর বাসাও একটা নেয়া একসাথে। সেই সাথে ডাইনিং রুমের জন্য একটা ডাইনিং টেবিল, ফ্রিজ আর কম দামের একটা সোফা সেট। ব্যাচেলর হলেও বাসাটাকে একটা পরিবারের স্পর্শে রাখা।
আজিম সাংবাদিক। সবচেয়ে দেরি করে বাসায় ফেরা লোক। রাত ১২টায় অফিস থেকেই বের হয়। বাসায় ফিরে বিছানায় যেতে যেতে রাত ১টার মত বেজে যায়। এরপরও যদি রাত ৪টার দিকে ঘুম ভেঙে যায় তাহলে মন ও মেজাজ কিছুই ভালো থাকার কথা না। এর ওপর বাড়তি যন্ত্রণা হয়ে এসেছে এক স্বপ্ন। সেটা দু:স্বপ্ন না ভালো কিছু সেটাই বুঝতে পারছে না আজিম। প্রচণ্ড তৃষ্ণায় বিছানার পাশে রাখা স্টিলের গ্লাসটা শেষ করেও কাজ হলো না। ডাইনিং এ যেতেই হবে। এক বিন্দুও ইচ্ছা করছে না আজিমের। বাড়ি গেলে বিছানার পাশে বিশাল পানির বোতলটা রেখে দিয়ে যেতেন আজিমের বাবা, সিদ্দিকুর রহমান। সাথে একটা গ্লাস। রাতে যেনো রুম থেকে বের হওয়া না লাগে। রুমের দরজা লক করে না আজিম। ভোরের দিকে টের পেতো আজিমের গায়ে চাদর। কখন সিদ্দিকুর রহমান এসে চাদর দিয়ে ওকে ঢেকে দিয়ে গেছে টেরেই পায়নি সে।
রুমের দরজা খুলেই দেখে ডাইনিং রুমের বাতি জ্বালানো। ডাইনিং টেবিলে বসে পত্রিকা পড়ছেন সিদ্দিকুর রহমান!
আজিম অবাক হলো।
‘বাবা, আপনি কখন এলেন?’
পাজামা-পাঞ্জাবি পড়া সিদ্দিকুর রহমানের চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। চশমাটা হাতে নিয়ে ফ্রেমের কাঁচটা পাঞ্জাবির কাপড়ে পরিস্কার করলেন। এটা সিদ্দিকুর রহমানের অনেক পুরানো অভ্যাস।
‘তোমার এখানে আসতে আসতে রাত ৯টা বেজে গেলো। তুমি অফিসের কাজে এই সময় ব্যস্ত থাকো, সেটা আমি জানি। তাই ফোন করে বিরক্ত করিনি।’
‘কী বলেন? আপনি এসেছেন, আমাকে বলবেন না? এতক্ষণ ধরে এখানে? খেয়েছেন? বাসায় আসার পরও ডাকেননি কেন?’
আজিম ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সিদ্দিকুর রহমান রুটিন মেনে চলা লোক। খেয়েছেন কিনা ঠিক মত, না ঘুমিয়ে এখানে বসে থাকা?
‘আরে তুমি এত ব্যস্ত হয়ো না। এখানে বসো। আমি ঠিক আছি?’ সিদ্দিকুর রহমান হেসে বললেন।
‘আচ্ছা তোমার লেখা মনে হচ্ছে কম আসছে। কারণ কী?’
আজিম হাসলো।
‘বাবা, ইদানিং ডেস্ক সামলাতে হচ্ছে। বাইরে যাওয়ার সময় কম পাচ্ছি। তাই রিপোর্ট লেখার সময় কম মিলছে।’
‘এটা কী করে হয়। তুমি এত ভালো রিপোর্ট করো আর তোমাকে ডেস্কে বসিয়ে দিলো! এডিটর জানে না তোমার রিপোর্ট ভালো হয়?’
‘জানেন বাবা। তারপরও উনার মনে হয়েছে ডেস্কেও যদি সময় দেই তাহলে ভালো হয়। আর ইচ্ছে করলেই বাইরে গিয়ে স্পেশাল রিপোর্ট করতে পারি। তাতে এডিটরের কোনো না নেই।’
‘হুম। আর তুমি বাইরে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছো!’
আজিম যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য সাংবাদিকতা বেছে নেয় তখন সিদ্দিকুর রহমান বেশ খুশি হয়েছিলেন। আজিমের মনে আছে ছোট বেলায় ওদের বাসায় দুটো পত্রিকা দিয়ে যেতো হকার। ইত্তেফাক আর অবজারভার। বইয়ের চেয়ে বেশি প্রিয় ছিল আজিমের ওই দুই পত্রিকা। খেলার খবর, কত ছবি, কত শব্দ, কত কত বাক্য। পাস করে বের হওয়ার পরই একটা পত্রিকায় চাকরি হয়ে যায় আজিমের। সিদ্দিকুর রহমানের খুশি ধরে রাখে কে! ছেলের নামে যেদিন রিপোর্ট ছাপা হয় নিজে সেদিন বন্ধুবান্ধব ও স্বজনদের বাসায় পত্রিকা নিয়ে দিয়ে আসেন। ছোট্ট শহরে ছেলেকে বিখ্যাত বানিয়ে তুলতে সিদ্দিকুর রহমানের উৎসাহের কমতি নেই।
‘আপনি খাওয়া দাওয়া করেছেন?’ আজিম পানি দিল তাঁর বাবাকে।
‘হ্যাঁ, তোমার বন্ধুরা বেশ খাইয়েছে। খেয়েই তো ড্রইংরুমে হেলান দিয়েছিলাম। তাতেই ঘুম।’
‘ঘুম ভাঙার পর আমার রুমে যেতেন। এখানে বসে ছিলেন কষ্ট করে।’
‘তুমি খুব ক্লান্ত থাকো। বিরক্ত করতে ইচ্ছা করল না। তোমাকে দেখতে ইচ্ছা করছিল। তাই চলে এলাম।’
‘ভালো করেছেন। কখন রওনা দিলেন?’
‘রওনা দেয়ার কথা সকালেই। কিন্তু দেরি হয়ে গেলো। প্রচণ্ড রোদ আর গরম মাথায় নিয়ে বের হলাম। বাসে উঠার পর বৃষ্টি। বাস থেকে নামার পর আবার গরম।’
বাইরে তাকালো আজিম। বিজলির চমক দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টি নামবে দ্রুত।
‘এক কাজ করো। চা বানাও। তোমার জন্যও বানিও। চা খেতে খেতে গল্প করি।’
রান্নাঘরে যাওয়ার আগে নিজের রুমের আর ড্রইংরুমের জানালার গ্লাস টেনে দিলো আজিম। বৃষ্টিতে ঘর ভিজে যায়। ওদিকে ডাইনিংয়ে জানালার পাশেই বসেছেন সিদ্দিকুর। বাতাসে তাঁর পাতলা চুল উড়ছে। ৭০ এর বেশি বয়স হলেও চুলে কালো রং দেন তিনি। আজিম ভাবে, বাবাকে সাদা চুলে কখনোই ভালো লাগবে না।
‘জানালাটা লাগিয়ে দিব?’
‘না, থাক। তুমি চায়ের ব্যবস্থা করো।’
আজিম রান্নাঘরে যায়। বাবার জন্য চা বানানোটা সহজ। পানি গরম করলেই হয়। কাপে একটা টি প্যাক। আর কিছু না। আজিমও এভাবেই চা খায়। তবে চায়ে তার নেশা নেই।
চায়ে চুমুক দিলেন সিদ্দিকুর রহমান।
‘চায়ের সাথে কিছু খাবেন? মুড়ি আছে।’
‘না, তুমি বসো। দেশের কী অবস্থা?’
পত্রিকা সরিয়ে এক পাশে ভাঁজ করে রাখলেন সিদ্দিকুর।
‘আমি সাংবাদিক বলে আমার কাছে দেশের খবর সব থাকবে?’
আজিম ইচ্ছে করেই ওভাবে বললো।
‘অবশ্যই। তুমি দেশের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেছো। কাজ করছ খবর নিয়ে। মানুষ তোমার কাছেই তো খবর জানতে চাইবে। এটাই স্বাভাবিক।’
আজিম ভাবতে থাকে। এর কী উত্তর হতে পারে? আসলেই কি আজিম খবরের সাগরে ভেসে বেড়ায়? মানুষ চাইলেই কলসিতে করে বা বোতলে করে চাহিদা অনুযায়ী সাপ্লাই দেয়? কাগজের দাম বাড়ছে। মানুষ বাসায় পত্রিকা রাখা কমিয়ে দিচ্ছে। এখন অনলাইনের সময়। চাইলেই পকেটে থাকা ফোনেই খবর পড়ে নেওয়া যায়। আগে সারাদিন কাজ করে একটা সংবাদপত্র প্রকাশ হতো। এখন ওই পত্রিকার অনলাইন ভার্সন চলে এসেছে। যা মিনিটে মিনিটে খবর সাপ্লাই দেয়। তাতে তো কাজের ব্যস্ততা বেড়েছে। খুশি হওয়ার কথা। মুহিত সেদিন লিখেছে, ওজন কমানোর পাঁচ উপায়। সেটা সেদিন সবচেয়ে বেশি পঠিত সংবাদের তালিকার শীর্ষে ছিল। এডিটর পর্যন্ত বাহবা দিয়েছে ওকে। আমেরিকার নির্বাচন, ইউরোপের বাজারের খবর পর্যন্ত এখন মিনিটে মিনিটে আপডেট করা যায় দেশে বসে। কিন্তু, যমুনায় ভেসে যাওয়া গ্রামের স্কুলটার আপডেট কী? কবে আবার স্কুলটা চালু হবে সেই খবরটা মেলে না এত এত অনলাইনে। কাগজে আরো মেলে না। এখন কাগজের অনেক দাম।
‘থাক, দেশের অবস্থা বলতে হবে না। তোমার অবস্থা বলো। লেখাটা চালু রেখো। ছেড়ে দিও না। রিপোর্ট না লিখতে পারো এখন, কলাম লিখবে। তুমি কলামও ভালো লিখতে পারো।’
‘কলেজে পড়ার সময় ডিরোজিও কে নিয়ে একটা কলাম লিখেছিলাম। আপনার মনে আছে?’
`হ্যাঁ। ডিরোজিওর জন্মদিন উপলক্ষে লিখেছিলে। আমাদের শহরের সাপ্তাহিক পত্রিকাটায় ছাপা হয়েছিল সেটা। বেশ মনে আছে।’
‘এসএসসি পরীক্ষার পর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই সময় বইটি কিনে দিয়েছিলেন আপনি। এক উপন্যাসে কত চরিত্র, কত ইতিহাস। কত কত নায়ক।’
‘তোমার ওই লেখা ছাপানোর কয়েক দিন পর ওই পত্রিকার সম্পাদকের সাথে আমার দেখা। আমাকে বলে, স্যার লেখাটা আপনার ছেলেই লিখেছে নাকি আপনি সাহায্য করেছেন? দিয়েছিলাম ধমক। ও নিজেই লিখেছে।’
‘তাই নাকি। এ কথা তো বলেননি কোনো দিন?’ আজিম অবাক হয়।
‘ওতটুকু বয়সে তোমাকে ওই কথা বললে তোমার কনফিডেন্স কমে যেতো। আমার মনে আছে, উপন্যাসটা পড়ে তুমি ডিরোজিওর ওপর আরো দুইটা বই পড়ে ফেলেছিলে।’
আজিম চায়ে চুমুক দেয়।
আজিম ভাবছে, সে বাসায় এলো। তার বাবাকে চোখে পড়লো না কেন? এসেই অবশ্য নিজের রুমে ঢুকে দরজা আটকে দেয়। গোসল করেই ঘুম দেয়। অফিসেই রাতের খাওয়াটা সেরে ফেলে আজিম। ছোটবেলায় রাত সাড়ে আটটায় রাতের খাবার শুরু করতে হতো। সিদ্দিকুর রহমানের কড়া নির্দেশ। রাত আটটায় বিটিভির বাংলা সংবাদ শুরু। সেটা দেখে তারপর খাওয়া। আর ১০টার দিকে ঘুম। আজিম হলেও রাত আটটার দিকে খেয়ে ফেলতো। অভ্যাসটা এখনো আছে।
বাবা তো ওর ঘরেও শুয়ে থাকতে পারতো। আজিম আসলে কিছু মেলাতে পারছে না।
‘আমি বাসায় আসার পর আমাকে ডাকলেন না কেন? এতক্ষণ কোথায় ছিলেন?’ আজিম এবার প্রশ্নই করে।
‘আরে ওদের সাথে খেয়ে ড্রইংরুমেই সোফায় হেলান দিয়ে বসে ছিলাম। কখন যে ঘুম এসে গেলো টের পাইনি। বাতিটাও নেভানো ছিল। তুমি হয়তো খেয়াল করো নি।’
এটা ঠিক। আজিম নি:শব্দে বাসায় ঢুকে। না পারতে ড্রইং বা ডাইনিংয়ের বাতি জ্বালায় না। এমনিতেই দেরি করে বাসায় আসে। এর ওপরে রাতে শব্দ করাটা আসলেও অন্য দুইজনের ওপর অন্যায়।
‘তুমি কেমন আছো সেটা বললে না কিন্তু।’ সিদ্দিকুর চশমার কাঁচ মুছলেন।
‘এইতো বাবা। চলছে।’
‘না। সামথিং রং। আমাকে বলো।’ সিদ্দিকুর ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন।
‘তেমন কোনো সমস্যা না।’
‘তাহলে যে স্বপ্নটা দেখছো, ঘুম ভাঙছে রাতবিরাতে সেটাকে সমস্যা মনে হচ্ছে না?’
‘বলেন কী? আমার এ কথা আপনি জানলেন কী করে?’ আজিম অবাক হয়। সাদেক বা আফজালের কেউ বলবে। এরা যে কী?
‘আমাকে বলো।’
আজিম পানি খেলো। সিদ্দিকুর এমনিতেই তাকে নিয়ে টেনশন করেন। এসব স্বপ্ন টপ্নের কথা বলে তাঁকে চিন্তায় ফেলার ইচ্ছা ছিল না আজিমের। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বাবাকে বললেই একটা সুরাহা মিলবে।
‘বিষয়টা তোমাকে নিয়ে হেলমেট মানবেরা হাসাহাসি করে ওই পর্যন্তই? নাকি আরো কিছু দেখো?’ সিদ্দিকুর জানতে চাইলেন।
‘মাঝে মাঝে একটু বেশিও দেখি। হঠাৎ এক হেলমেট মানব দৌড়ে আসতে থাকে। হাতে বড় একটা লাঠি। এটা দিয়ে সে আমার মাথায় জোরে আঘাত করে। তীব্র যন্ত্রণায় আমি মাটিতে বসে পড়ি। লাঠির আঘাতে আমার মাথাটা দুই ভাগ হয়ে যায়। বেরিয়ে যায় মগজ, রক্তে মুখটা ভরে যায়। আর….’
‘আর কী?’ সিদ্দিকুর মন দিয়ে শুনছেন।
‘মাথাটা ফেটে যাওয়ার সাথে সাথেই মাথাটা থেকেই কতগুলো বর্ণ, শব্দ দৌড়ে বের হয়ে গেলো! ঠিক যেমন কোনো বস্তা বা ব্যাগে আটকা ইঁদুর ছাড়া পেলে যেভাবে দৌড় দেয়, ঠিক সেই রকম।’
‘বর্ণগুলো বা শব্দগুলো কীসের?’
‘জানি না। আমি খেয়াল করার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু এরপরই ঘটে আরেকটা ঘটনা। একজন হেলমেট মানব একটা সংবাদপত্র নিয়ে দৌড়ে আমার কাছে আসতে থাকে। আরেকজন হেলমেট মানব একটা হেলমেট নিয়ে আসতে থাকে। আমার মগজবিহীন রক্তাক্ত মাথাটা সংবাদপত্র দিয়ে মুড়ে দিতে থাকে। এমনকি চোখটাও ঢাকা পড়ে যায়। অন্ধকার হয়ে আসে সবকিছু।’
আজিম ঘামতে থাকে। শ্বাস নিতে থাকে জোরে জোরে। টেবিলে মাথা ফেলে দুই হাত দিয়ে মাথাটা ঢেকে রাখার চেষ্টা করে।
‘মাথাটা অসম্ভব যন্ত্রনা করে বাবা।’
‘হ্যাঁ। বুঝতে পারছো কী রক্ষা করা দরকার? ওই শব্দগুলো বেঁচে থাকুক, বর্ণগুলোও।’
‘এই আজিম। আজিম। উঠ। কীরে কী হলো তোর?’ সাদেক ডাকছে।
আজিম মাথা তুলে তাকালো, চোখে বিস্তর ঘুম।
‘কীরে, ডাইনিং টেবিলে ঘুমাচ্ছিস কেন?’ সাদেক অবাক হলো।
আজিম মাথাটা তুলে এদিক ওদিক তাকালো। সকালের রোদ এসে পড়েছে টেবিলে। গরমে ঘেমে গেছে আজিমের শরীর।
‘উঠে রুমে যা। রুমে গিয়ে ঘুমা। কখন এসেছিস এখানে?’
আজিম এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু খোঁজার চেষ্টা করলো।
‘কীরে কিছু খুঁজছিস?’ সাদেকের প্রশ্ন। আফজালও বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো।
বাসায় আর কেউ নেই। আজিম বুঝতে পেরে আর কিছু বললো না।
‘আমি ঠিক আছি। সমস্যা নেই। মুখ ধুয়ে আসছি। নাস্তা করব তোদের সাথে।’
‘আজিম, তুই বাড়ি যাবি কবে? ভাবছি ছুটি পেলে তোর সাথে যাব। কাকার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তোর সাথে না হয় থাকলাম দিনটা।’ আফজাল বলে।
‘তাই তো। কবে যেন আজিম?’ সাদেক বলে।
‘আগামী সপ্তাহে। ১৭ তারিখ। বাবার মৃত্যুর এক বছর হবে।’ আজিম খেয়াল করলো টেবিলে দুই কাপ চা। একটা শেষ হয়েছে। আরেকটাতে কেউ চুমুক দেয়নি।
পরিশিষ্ট
দুপুরে অফিসে যাচ্ছে আজিম। মেট্রোরেলের গেটের নিচে এক ভবঘুরে লোক বসা। এই গরমে তার গায়ে চাদর। দুই পাশে পুরানো ছেঁড়া কম্বল। এ ধরণের ভবঘুরে ঢাকা শহরে অনেক। তারপরও আজিম দাঁড়িয়ে গেলো। লোকটার মাথায় হেলমেট। এমন হতদরিদ্র, ভবঘুরে লোকটার মাথায় লাল একটা হেলমেট। যার সামনের দিকটা কালো গ্লাসে ঢাকা!
‘ভাই, ওরে কী দেখেন। পাগল। ওভারব্রিজ নাইলে মেট্রোরেলের গেটের কাছে বইসা থাকে হেলমেট পইরা, চাদর গা দিয়া। এখন দেখি এখানে বইসা পড়সে। কবে উঠব কে জানে।’
সিটি করপোরেশনের ঝাড়ুদার বলছিল আজিমকে এসব কথা।
হঠাৎ করে ভবঘুরেটা হেলমেটের গ্লাসটা উপরের দিকে তুললো। আজিমের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসলো।
আজিমের দিকেই তাকিয়ে বললো, ‘কীরে, হেলমেট পড়বি?’
রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্ক বাংলা সাহিত্যে অনালোচিত ও উপেক্ষিত একটি বিষয়, যা নিয়ে নিবিড় গবেষণা ও বহুমাত্রিক চর্চার আবশ্যকতা রয়েছে। অনেকেই হয়ত জানেন না যে, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে নজরুল রচনা করেছিলেন এক মর্মস্পর্শী স্মরণ সঙ্গীত। রবীন্দ্র প্রয়াণের পটভূমিতে অসীম শ্রদ্ধার প্রলেপে অবিস্মরণী হয়ে আছে সেই গান: ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে/জাগাও না জাগাও না। ‘রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্ক এবং তার পরে‘ শীর্ষক এক প্রবন্ধে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন (কালি ও কলম, চৈত্র ১৪২৬, মার্চ ২০২০)।
শুধু তাই নয়, ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু সংবাদে নজরুল শোকে বিহ্বল-বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। শোকাচ্ছন্ন অবস্থাতেই তিনি পরপর তিনটি শ্রদ্ধাজ্ঞাপক কবিতা রচনা করেন। একটিতে বলেন ‘দুপুরের রবি ঢলে পড়েছে অস্তপারের কোলে’। কবিতাটি তিনি কলকাতা রেডিওতে যখন আবৃত্তি করছিলেন, তখন, আবৃত্তি করার সময়েই, তাঁর দেহে রোগাক্রমণের লক্ষণ দেখা দেয়। আবৃত্তি তিনি সম্পূর্ণ করতে পারেন নি। তাঁর জিহ্বা আড়ষ্ঠ হয়ে গিয়েছিল। পরের বছর ১৯৪২ সালে মাত্র ২২ বছরের সৃষ্টিশীল জীবনের অবসান ঘটিয়ে নজরুল চিরতরে স্তব্ধ হয়ে যান।
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল বাংলা সাহিত্যের দুই দিকপাল, জীবনে ও কর্মে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী ব্যক্তিত্বের মানুষ হলেও তাঁদের যোগাযোগ, সম্পর্ক ও পারস্পরিক মনোভাব কেমন ছিল, তা সাহিত্যবোদ্ধা মাত্রই জানতে আগ্রহী হবেন। তাঁদের মধ্যে ব্যক্তিগত মিল ও অমিল এবং সম্পর্কের ইতিবৃত্তটিও তাঁদের আলাদা সাহিত্য রুচি ও বৈশিষ্ট্যের মতো পার্থক্যপূর্ণ হবে, এটাই স্বাভাবিক। তথাপি একই সময়কালের আগে ও পরে দু’জনের অবস্থান হওয়ায় তাদের পারস্পরিক সংশ্লেষ ও সম্পর্কের তুলনামূলক পর্যালোচনা সকলের বিশেষ মনোযোগের কারণ।
তবে, সমাজের দশজন সাধারণ মানুষের বিচারে যা প্রামাণ্য মাপকাঠি, তা দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে এবং তাদের সম্পর্ককে বিচার করা সংগত হবে না। কারণ সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে যা সম্ভব-অসম্ভব এবং স্বাভাবিক-অস্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া হয়, তাঁদের ক্ষেত্রে তা সর্বত্র প্রযোজ্য নয়। যেমন, স্কুলে কোনো একজন কতোটুকু পাটীগণিত-বীজগণিত-ইংরেজি-বাংলা-ইতিহাস-ভূগোল ইত্যাদি শিখে কতোটা ভালো ফলাফল করেছে, সেটা একজন সাধারণ লোকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ডের বিষয় হলেও প্রতিভাবানদের ক্ষেত্রে তা কদাচ নয়। তাঁদের জীবনের দিকে তাকালেই এ সত্য প্রতিভাত হয়।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন স্কুল পালানো ছেলে। প্রথাগত শিক্ষা ও স্কুল ব্যবস্থার শক্ত কাঠামোর বিরুদ্ধে তাঁর এন্তার অভিযোগ ও অনেক সমালোচনা রয়েছে। তা সত্ত্বেও তিনি রবীন্দ্রনাথ হয়েছিলেন। এর ব্যাখ্যায় বলা যায়, তাঁর জন্ম হয়েছিল কলকাতার অত্যন্ত অভিজাত একটি পরিবারে। এ পরিবারের শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ছিল ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপটে অগ্রগণ্য এবং প্রায়-তুলনাহীন। প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত না-হয়েও তাই সেই পরিবেশে লালিত-পালিত হয়ে একটি ছেলের পক্ষে রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠার বিশ্বাসযোগ্য একটা ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায়।
কিন্তু বৃহত্তর বাংলার এক সুদূর প্রান্তবর্তী পাড়াগাঁয়ের ছেলে ‘দুক্ষু/দুখু মিয়া’ নজরুল ইসলাম হয়ে উঠলেন, সে এক অজানা ‘রহস্য‘। তাঁর অধিকাংশ জীবনী-লেখকরা সেই রহস্যের বিশ্বাসযোগ্য কোনো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ না-দিলেও সর্ব-সাম্প্রতিক একটি নজরুল-জীবনী গবেষণার বিস্তারিত পরিসরে বিষয়টি তুলনামূলকভাবে আলোচিত হয়েছে: দুঃসহ দারিদ্র্য ও অশিক্ষার বন্ধন কাটিয়ে নজরুল কী করে নজরুল হলেন, সেটা কেবল একটা বিস্ময়ের ব্যাপার নয়, সেটা প্রায়-অবিশ্বাস্য ব্যাপার (গোলাম মুরশিদ, বিদ্রোহী রণক্লান্ত: নজরুল-জীবনী, ঢাকা: প্রথমা প্রকাশন, ২০১৮)।
নজরুলের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রথম পরিচয় লেখার মাধ্যমে, চাক্ষুষ ও সরাসরি নয়। এবং সেটা বাংলায় বা কলকাতায় নয়। বরং যোগাযোগের সময়কাল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঢামাঢোলের মধ্যে সিন্ধু প্রদেশের করাচির সেনানিবাসে, যেখানে সৈনিক নজরুল তখন অবস্থান করছিলেন আর রবীন্দ্রনাথ যথারীতি বাংলায়।
উল্লেখ্য, ১৯১৪ সালের জুলাই মাসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হলে স্কুলের দেয়াল-পত্রিকায় সৈন্য বাহিনীতে যোগদানের একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয় এবং তা দেখে কিশোর নজরুল বাঙালি পল্টনে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেন। ঘটনাটি সবিস্তারে বিবৃত করেছেন অরুণকুমার বসু (নজরুল-জীবনী, কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ২০০০, পৃ. ২১)।
করাচির সেনানিবাসে নজরুল কী কী করতেন এবং কী কী পড়তেন, সে সম্পর্কে যে বিবরণ জানা যায়, তা হলো: ভাণ্ডারের দায়িত্ব পালন করতেন দিনের বেলা, রাতের বেলা করতেন লেখাপড়া। তিনি রবীন্দ্রনাথ পড়েছিলেন, বিশেষ করে কবিতা আর গান। তদুপরি, নজরুল করাচি থেকে কলকাতায় ফিরে আসার সময় সঙ্গে যেসব জিনিপত্র নিয়ে এসেছিলেন, তাতে ব্যবহার্য পোষাক ছাড়াও কবিতার খাতা, গল্পের খাতা, পুঁথি-পুস্তক, মাসিক পত্রিকা ও রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরলিপি ইত্যাদিও ছিল। পুস্তকগুলির মধ্যে ছিল ইরানের মহাকবি হাফিজের দিওয়ানের একখানা খুব বড় সংস্করণ। এ তথ্য দিয়েছেন নজরুল-সুহৃদ কমরেড মুজফফর আহমদ (কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা, কলকাতা: ন্যাশনাল বুক এজেন্সি, ১৯৯৫, পৃ. ১৭)। তদুপরি গবেষক গোলাম মুরশিদ দাবি করেছেন, করাচিতে লেখা তাঁর গল্প ও অন্যান্য রচনায় বহু রবীন্দ্রসংগীতের উদ্ধৃতি আছে।
১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হওয়ায় ১৯২০ সালে সৈন্য বাহিনী ভেঙে দিলে নজরুল কলকাতায় চলে আসেন। কলকাতায় তিনি বন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের মেসে উঠেছিলেন। পরে তিনি চলে আসেন মুজফফর আহমদের আস্তানায়। চলে আসার নেপথ্য কারণ ছিল সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি। এ প্রসঙ্গে তিনটি ভাষ্য পাওয়া যায়। তবে, এর ফলে তাঁর মনে হিন্দু-বিদ্বেষ তৈরি হতে পারতো, কিন্তু তেমনটা হয়েছিল বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং তিনি জাতিভেদ এবং ছোঁয়াছুঁয়ির তীব্র নিন্দা জানিয়ে কবিতা ও গান লিখেছিলেন, দাবি করেন গবেষক গোলাম মুরশিদ।
মুজফফর আহমদ বাংলাদেশের সদ্বীপে জন্মগ্রহণকারী ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, যে দলটি ১৯২৫ সালে স্থাপিত হয়। কিন্তু ১৯২০-এর দশকে তিনি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং নজরুলের মুক্তি কবিতা এবং হেনা ব্যথার দান প্রকাশ করেছিলেন। মুজফফর আহমদ থাকতেন ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে। নজরুলকে তিনি আহ্বান করেছিলেন যে সৈন্য বাহিনী থেকে কলকাতায় ফিরে তিনি যেন তাঁর মেসে ওঠেন। এসব ঘটনাবলীর বিবরণ রয়েছে মুজফফর আহমদের আত্মজৈবনিক গ্রন্থসমূহে (কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা, কলকাতা: ন্যাশনাল বুক এজেন্সি, ১৯৯৫ এবং আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, কলকাতা: ন্যাশনাল বুক এজেন্সি ১৯৯৬)।
কলকাতার নতুন আবাসে ১৯২০-২১ সালের সময়কালে নজরুলের সঙ্গে সাহিত্য পরিমণ্ডলের যোগসূত্র নিবিড়ভাবে স্থাপিত হয়। শিক্ষিত মুসলমান যুবক ছাড়াও প্রতিষ্ঠিত হিন্দু কবি-লেখকগণের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়। কলেজ স্ট্রিটের আস্তানায় আগে থেকেই অনেক হিন্দু-মুসলমান কবি-সাহিত্যিক আড্ডা দিতে আসতেন। নজরুলের আগমনের পরে তাঁর গান এবং ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে সে আড্ডার পরিধি দ্রুত সম্প্রসারিত হয়। এ সময়ে যাঁরা আসতেন, তাঁদের কয়েকজনের নাম উল্লেখ করেছেন মুজফফর আহমদ। এঁরা হলেন শশাঙ্কমোহন সেন, গোলাম মোস্তাফা, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রলাল রায়, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, কান্তি ঘোষ, ধীরেন গঙ্গোপাধ্যায়, যোগীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, ধীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, শান্তিপদ সিংহ। মোহিতলাল মজুমদারের নামও উল্লেখ করেছেন তিনি।
কলকাতার আবাসস্থল ৩২ নম্বরে আড্ডা দেওয়া ছাড়া নজরুল এ সময়ে আরো আড্ডা দিতে যেতেন গজেন্দ্রনাথ ঘোষের আসরে-বৈঠকে, যিনি ছিলেন মিত্র ও ঘোষ প্রকাশনীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও কথাসাহিত্যিক। মিত্র ও ঘোষ প্রকাশনীর সুদীর্ঘদিনের কর্মী ও পরবর্তীতে অন্যতম পরিচালক সবিতেন্দ্রনাথ রায় (ভাণু বাবু) নিজের তিন খণ্ডের স্মৃতিচারণে বিস্তারিত জানিয়েছেন যে (কলেজ স্ট্রিটে সত্তর বছর, কলকাতা: দীপশিখা প্রকাশন, ২০১০), সেখানে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে পরিচয় হয় নজরুলের। এ ছাড়া, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরচ্চন্দ্র (দাদা ঠাকুর). মতিলাল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখের সঙ্গেও তাঁর পরিচয় হয়েছিল।
নজরুলের সঙ্গে দুজন গায়কের ঘনিষ্ঠতা জন্মে। তাঁদের একজন তখনকার কলকাতার নাম-করা রবীন্দ্রসংগীত-শিল্পী হরিদাস চট্টোপাধ্যায় আর একজন নলিনীকান্ত সরকার। পত্রপত্রিকার সূত্রে আরো অনেকের সঙ্গে নজরুলের পরিচয় হয়। তাঁদের মধ্যে অরবিন্দ ঘোষের কনিষ্ঠ ভ্রাতা বারীন ঘোষ, যিনি সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ছিলেন। রাজনীতির পথে নয়, সে সময় পত্রিকার সূত্রে নজরুলের পরিচয় হয় চিত্তরঞ্জন, ফজলুল হক এবং আরো অনেক কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিকের সঙ্গে।
তবে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তখনো তাঁর সাক্ষাত-পরিচয় হয়নি। সে পরিচয় হয়েছিল পরের বছর (১৯২১)। কারণটি গোলাম মুরশিদ জানাচ্ছেন, রবীন্দ্রনাথ এ সময়ে একটানা ষোল মাস ইউরোপ-অ্যামেরিকায় ভ্রমণে ছিলেন।
কিন্তু কোনো কোনো জীবনীকার দাবি করেছেন যে, ১৯২১ সালের আগস্ট-অক্টোবর মাসের কোনো এক দিন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুল দেখা করেন। এ সম্পর্কে দু‘টি মত প্রচলিত আছে। প্রথম মতটি হলো, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় নজরুলকে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে নিয়ে যান। কিন্তু এ মতটিকে আপাতদৃষ্টিতে ভ্রান্ত বলেছেন গোলাম মুরশিদ। কারণ পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় কোথাও উল্লেখ করেননি যে তিনি নজরুলকে রবীন্দ্রনাথের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি প্রতিদিন রবীন্দ্রনাথের কাছে যেতেন না যে, নজরুলকে নিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করার যোগ্য মনে করবেন না। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা তাঁর আত্মজীবনীতে (চলমান জীবন, কলকাতা: প্রতিক্ষণ পাবলিকেশনস, ১৯৯৪) বেশ বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের কাছে গেলেও তা লিপিবদ্ধ করতেন।
আরেকটি বিবরণে জানা যায়, ১৯২১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রনাথের ষাট বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ তাঁকে একটি সংবর্ধনা দেয়। নাটোরের মহারাজা সে অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। কিংবদন্তী প্রচলিত আছে যে, এই সভায় রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে তাঁর পাশের আসনে বসার জন্যে আহ্বান জানান। অরুণকুমার বসু (নজরুল জীবনী, কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ২০০০) এমন দাবি করলেও অনেকের মতে তা সঠিক নয়। গোলাম মুরশিদ এই দাবি নাকচ করে বলেছেন, তখন পর্যন্ত নজরুলকে রবীন্দ্রনাথ চিনতেনও না। প্রশান্ত পালের রবি জীবনীতে কলকাতার প্রসিদ্ধ দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে এই অনুষ্ঠানের কার্যাবলীর দীর্ঘ বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। তাতে নজরুলের কোনো উল্লেখ নেই। এই অনুষ্ঠানের মাত্র তিন সপ্তাহ আগে রবীন্দ্রনাথ প্রায় ষোলো মাস বিদেশে থাকার পর প্রথমবারের মতো কলকাতায় আসেন। এ সময়ে অত্যন্ত ব্যস্ততার মধ্যে তাঁর দিন কাটে। বেশ কয়েকটি সংবর্ধনা সভায় তাঁকে যোগ দিতে হয়। বিভিন্ন জায়গায় তিনি কয়েকটি বক্তৃতাও দেন। এর মধ্যে একটা বক্তৃতা ছিল টিকেট করে যোগদানের। মহাত্মার গান্ধীও তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসার কথা এ অনুষ্ঠানের দুদিন পরে। এতো ব্যস্ততার মধ্যে তখনকার করুণ ও অপরিচিত নজরুলের পক্ষে রবীন্দ্রনাথের দেখা না-পাওয়াই সম্ভব।
তবে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথমবারের মতে নজরুলের দেখা হয় ১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে। এ সময়ে পূজার ছুটিতে একদিন ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সঙ্গে নজরুল শান্তিনিকেতনে যান রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে। সেখানে নজরুল তাঁর আগমনী কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনান। কিন্তু এই তথ্যের বিষয়েও ভিন্নমত আছে। মুজফফর আহমদের বিবরণ অনুযায়ী দুর্গাপূজার ছুটিতে নজরুল কুমিল্লা যান। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি, তাঁর সঙ্গে দেখা করার গুরুত্ব এবং আকর্ষণ দুই-ই নজরুলের ছিল। কিন্তু এক কিশোরীও তাঁকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করছিল পূর্ব বাংলার মফস্বল শহর কুমিল্লার কান্দিরপাড় থেকে। সেটা অবশ্য প্রেম ও প্রত্যাখ্যানের বেদনাময় অন্য আরেক কাহিনী। ধুমকেতুর মতো গতিময় নজরুল জীবনের প্রায়-সকল ঘটনাই ঘটেছে চরম অস্থিরতার মধ্যে, সিদ্ধান্তহীন আকস্মিকতায় ও অপরিকল্পিতভাবে। তবে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত গভীর ও সার্বক্ষণিক যোগাযোগের ভিত্তিতে পরিচালিত না হলেও তা নিবিড়তায় পরিপূর্ণ ছিল। রবীন্দ্র-নজরুল প্রসঙ্গ ছিল শ্রদ্ধা-স্নেহের প্রলেপে আচ্ছাদিত। নজরুলের প্রতি রবীন্দ্রনাথের শুভেচ্ছা, সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাব ছিল না। রবীন্দ্র-নজরুল প্রসঙ্গ ও সম্পর্কের সুবিস্তৃত আলোচনা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে ঋদ্ধ করবে এবং অখণ্ড বাংলা সাহিত্যের পরম্পরাকেও পরিপুষ্ট করবে।
সঙ্গীত পরিবার আমাদের। বাবা এ এইচ এম আব্দুল হাই ব্যক্তিগত জীবনে একজন প্রকৌশলী ছিলেন। পেশাগতভাবে তিনি সরকারের ক্যাডারভুক্ত একজন উচ্চতর কর্মকর্তা ছিলেন, পিডব্লিউডির চিফ ইঞ্জিনিয়ার। প্রকৌশলী হলেও সঙ্গীতের প্রতি ছিল তার অগাধ পাণ্ডিত্য। তিনি ছিলেন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বিশারদ। পারিবারিকভাবে বাবার এই গুণ তার সন্তানদের মাঝে বিস্তৃত হয়। আমরা চার বোন, এক ভাই। আমার বড় তিন বোন ছিলেন সঙ্গীত শিল্পী। একদিন আমিও আমার ভেতর শিল্পীসত্তার খোঁজ পাই।
যদিও নাচ ও খেলায় পারদর্শিতা ও আগ্রহ ছিল অপরিসীম। বাবার সূত্রে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রতি একটা টান থাকলেও, নিয়মিত চর্চার ভেতর অবস্থান করতে হলেও একটা সময়ে অনুভব করলাম, আমার হৃদয়জুড়ে অবস্থান করছে নজরুল সঙ্গীত এবং কবির বাণী। কবির শব্দ চয়ন, ব্যবহার, প্রকাশ ও গভীরতা আমাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। এ এক অধ্যাত্মিক গতিময় শক্তি এবং অবিশ্বাস্য জীবনবোধ, যা আমার ভেতর চিরস্থায়ীভাবে আসন গ্রহণ করেছে। এটাই যেন আমার সুনিশ্চিত শেষ ঠিকানা। সেই আমলে নারীর প্রতি, জীবনের প্রতি কবি কাজী নজরুল ইসলামের যে দৃষ্টিভঙ্গি তা ছিল এক অভাবনীয় বিষয়। বিশেষ করে নারীর অধিকার নিয়ে তিনি তার ভাবনা-চিন্তা তার লেখনীতে যেসময়ে যেভাবে প্রকাশ করে গেছেন, তার প্রয়োজনীয়তা সাম্প্রতিক বিশ্বে রয়ে গেছে । এখনও যেন এমন এক ব্যক্তিত্বেরই প্রয়োজন।
আজ অব্দি নারীর অধিকার নিয়ে যে সব কথা বা বক্তব্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উত্থাপিত হয়েছে বা হচ্ছে, তা যেন নজরুলের কথারই প্রতিফলন। ঠিক তেমনি তার যে গভীর দেশাত্মবোধ সেটাও তিনি তাঁর জীবনাচারণে ও লেখনীতে প্রকাশ করে গেছেন। বিদ্রোহী কবিতা সেই স্বাক্ষর রেখেছে। মানব-মানবীর সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তার মর্যাদাবোধ, সহানুভূতি ও মমতা ছিল বিরল। হৃদয় যেন তাঁর আপনগতিতে কবির দিকেই ধাবিত হয়। এভাবে ধীরে ধীরে আমি যেন কবির উপকূলে ঠাঁই পেলাম, ঠাঁই নিলাম। নজরুল সংগীতের প্রতিটি শব্দ, তাল, লয় , সুর যেন জীবন হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। দিন যতই যেতে লাগলো, ততই যেন আমি কবির একনিষ্ঠ অনুরাগী হয়ে উঠলাম।
অসাম্প্রদায়িক ও বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে কবি
বিশ্বশান্তি, মানবতা, মানবমর্যাদা, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে সকল ভাবনা ও প্রচারণা জরুরি ছিল, কবি তাঁর সৃষ্টিকর্মে তা প্রকাশ করে গেছেন অবলীলায় ও সহজ ভাষায় এবং সেটা বিভিন্ন আঙ্গিকে। তাঁর জীবনাচারণ ছিল অন্যায়ের প্রতিবাদে ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় একনিষ্ঠ। অবহেলিত, নিগৃহীতদের জন্য তিনি ছিলেন পরম দরদী। বৈষম্য, শোষণের বিরোধিতা করে গেছেন তিনি আমৃত্যু। প্রকৃতির প্রতিও তিনি অসীম ভালোবাসার প্রকাশ ঘটিয়েছেন তাঁর সৃষ্টিকর্মে।
তিনি ছিলেন তারুণ্যের কবি। তরুণদের পথ দেখিয়েছেন, সাহসী করে গেছেন। জীবন দর্শনের কৌশল শিখিয়ে গেছেন। তাঁর এই বোধ আমার ভেতর সঞ্চারিত হয় আপন গতিতে। আমি তরুণদের নিয়ে কাজ করছি। সুরসপ্তক সঙ্গীত একাডেমি আমার, যেখানে শিশু, কিশোর, তরুণ ও পরিণত বয়সের সকলেই কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবন দর্শন, আদর্শে সম্পৃক্ত হবার সুযোগ পাচ্ছে। সঙ্গীত সাধনা করবার সুযোগ পাচ্ছে। শুধু সুরসপ্তক সঙ্গীত একাডেমি নয়, দেশ ও জাতির প্রতি যে দায় ও দায়িত্ব কবির ছিল, আমি চেষ্টা করছি সেসব অনুসরণ করতে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমি কবির দর্শন ও আদর্শের ব্যাপ্তি ঘটাতে চেষ্টা করছি। দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে আমি তাঁকে পৌঁছে দেবার ব্রতে নিয়োজিত হয়েছি। এ আমার অসীম অকৃত্রিম সাধনা।
নজরুলকে দেখার প্রথম স্মৃতি
তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি। বাবা আব্দুল হাইয়ের ছিল নজরুল সঙ্গীতের প্রতি দারুণ ভক্তি, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। খুব ভালোবাসতেন তিনি কবি ও তাঁর সৃষ্টিকে। বাবা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বিশারদ হওয়ায় বেশ ভালো বুঝতেন নজরুল সঙ্গীতের সুর ও আবহ। বাণী আর সুরের কারণেই কবির প্রতি বাবার দুর্বলতা এক অনন্য বৈশিষ্ট্যে রূপ নেয়। কবিভক্ত সেই বাবার হাত ধরে আমরা দুই বোন, জান্নাত আরা ও আমি কবির ধানমন্ডির বাসভবন অতি আগ্রহে ছুঁটে যাই। গিয়ে দেখি ঘরের কপাট বন্ধ।
জানানো হলো, আমাদের চিন্তার কোনো কারণ নেই; তাঁর সাথে আমাদের দেখা হবেই। ছোট্ট মনে তখন নানান মিশ্র উৎকন্ঠা, অপেক্ষা, কবিকে দেখব বলে। আর তাঁকেইবা কী বলব অথবা শুনব। শুনেছি তিনি নির্বাক কবি। একসময়ে কপাট খুলে গেলো। আমাদের ভেতরে ডাকা হলো। দেখলাম, কবি লম্বা হয়ে শুয়ে আছেন। কবির অভিব্যক্তি তখন বুঝা কঠিন সাধারণদের জন্য। বড় বড় নির্বাক সেই দৃষ্টি! তিনি কী যেন বলতে চান, অথচ পারছেন না বলতে। আমি তখন কিশোরী। দেখলাম, দেশের বড় বড় সঙ্গীত শিল্পীরা তাকে গান শুনিয়ে যাচ্ছেন একে একে। তার বিছানার সামনে মেঝেতে হারমোনিয়াম, তবলা সাজানো।
কবির মুখে ভাষা ছিল না, কিংবা হয়তবা ছিল যা কেবল কবিই বুঝতেন। সেই অভিব্যক্তি যেন অনেক কিছুই বুঝাতে চাইছিল। কবি পরিবার আমাদেরকে গান পরিবেশনার জন্য বললেন। আমরা গান গাইতে বসে পড়লাম। কিন্তু মনে মনে ভাবলাম, কী গানইবা গাইব, আর নির্বাক কবি কীইবা বুঝবেন। অতপর ‘নীলাম্বরী শাড়ি পরি নীল যমুনায় কে যায়’ গানটি ধরলেন জান্নাত আরা। আমি তার সহযোগি হলাম। যখন গানটির সুক্ষ্ন কারুকাজ ও সুরের মূচর্ছনা কন্ঠে নিবদ্ধ হলো, ঠিক তখনি খেয়াল করলাম কবির মনবীণার তারে সুরের ঝংকার বেঁজে উঠলো এবং সাথে সাথে শোওয়া থেকে কবি উঠে বসলেন।
দীর্ঘ সময় যাবৎ কবির ভেতরের যে অভিব্যক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটছিল না, এই গানটি শোনার পর তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটল। তিনি বলে উঠলেন, বাহ্! কবির এই প্রকাশ ছিল আমাদের কাছে অপ্রত্যাশিত ও কল্পনাতীত। শঙ্কিত হয়ে আমরা রুম থেকে বের হয়ে যাই। আমাদেরকে ফেরানো হলো। বুঝানো হলো, এটা কবির সুখ ও আনন্দ প্রকাশ। আমাদেরকে আবার ডাকা গাল গান সম্পূর্ণ পরিবেশনার জন্য। আমরা পুরো গান গাইলাম। কবির এই প্রতিক্রিয়া প্রকাশ বলে দেয়, আপাততভাবে তাঁকে নির্বাক মনে হলেও, আদতে তিনি যেন তা নন। সঙ্গীতের প্রতি ছিল তাঁর অসীম তেজময়ী এক উপলদ্ধি।
লেখক: বিশিষ্ট নজরুল সঙ্গীত শিল্পী ও প্রতিষ্ঠাতা, সুরসপ্তক সঙ্গীত একাডেমি।