ছোট্ট পাখি চন্দনা
আমার নামটা একটু পুরনো ধাঁচের। ফাতেমা আকতার খানম। আমার বাবা-ভাই কারো নামের সাথেই খান নেই। তবুও আমি খানম। অবশ্য উনিশ শ পঞ্চাশ সালে, যে বছর আমার জন্ম তখন নিশ্চয়ই নামটা ভালোই শোনাত। তাছাড়া নবীজীর মেয়ের নামে নাম। আমার ডাকনামটা কিন্তু দারুণ। চন্দনা। ছোট্ট পাখি চন্দনা। গানটাও দারুণ—ও আমার ছোট্ট পাখি চন্দনা। আমার ছোটমামা নামটা রেখেছে।
ছোটমামা একাত্তরের সেপ্টেম্বরেই পেশোয়ার চলে যায়। আর ফেরেনি। এক প্রয়াত বন্ধুর বিধবা স্ত্রীকে বিয়ে করে রেডিমেড দুটো মেয়েও সাথে পায়। মেয়েদেরও হয়তো তার মতোই একজন রেডিমেড বাবার দরকার ছিল। এদের বন্ধন ছিঁড়ে আসতে হয়তো তার মন চায়নি। বাহাত্তরের শেষদিকে একটা গ্রুপ ছবি মাকে পাঠায়। স্টুডিওতে তোলা, ব্যাকগ্রাউন্ডে একটা পাহাড়ি ঝরনা, সামনে ছোটমামা, তার বউ এবং ছোট দুটো মেয়ে। মেয়েগুলো দেখতে কী যে সুন্দর, সিনেমার নায়িকাদের ছোটবেলার ছবির মতন।
তিয়াত্তরে একটা চিঠি, আমাকে লেখা। নভেম্বরের শেষ দিন হাতে আসে। ছোটমামার সেই চিঠিটা :
তোর বাবার চিঠিতে সব খবর পেয়েছি। সেদিন তোর বিয়েতে এত খাটাখাটনি করলাম, অথচ শেষ ব্যাচে খেতে বসেছি বলে একটা রোস্টও পেলাম না। এটা একটা কথা হলো! আমি কিছু কিছু মনে করিনি। গত শবে-বরাতে আল্লাহ নিশ্চয়ই আমার নামে বরাদ্দ করা রোস্টটা কেটে দিয়েছেন।
বিয়ের জন্যে তুই-ই না পাগল হয়ে উঠেছিলি! তোর বাবা এ নিয়ে আমাকেও তো কম ধমকায়নি। তোর বিয়ের ষড়যন্ত্রে নাকি আমিও আছি। বাবার রাজত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হবার চেষ্টা—এও এক ধরনের আগরতলা ষড়যন্ত্র। তবলিগ দলের এক দ্বীনিভাই নাকি তোর বাবাকে বলেছে—ছেলেটি নাস্তিক। তোর হবু বর মঞ্জুর নাস্তিক। আস্তাগফিরুল্লাহ। আমি বললাম, দুলাভাই, ছেলেটা ভালোই ছিল, আমি সব খবর নিয়েছি, তার বংশে একজন বুজর্গ আছেন, বাবা বোম্বে থেকে জাহাজে চড়ে হজ্ব করতে আরবদেশে গিয়েছেন। মার্ক্স-টার্ক্স পড়ে মাথাটা একটু বিগড়ে গেছে। সব ঠিক হয়ে যাবে বিয়ের পর। দেখবেন দুলাভাই, বিয়ের পর জায়নামাজ ছেড়ে সহজে উঠবেই না।
কী বললি, মাথা বিগড়ে গেছে? একটা পাগলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দেব? এটা হতে পারে না।
একশবার পারে। আপাও তো আপনাকে পাগল মনে করে।
দূর হ শয়তান। আমাকে নিয়ে কথা!
তুই আত্মহত্যার একটা মোক্ষম থ্রেট দিয়ে কাজটা সহজ করে ফেললি। বিয়ের দিন মঞ্জুর টাইস্যুট পরে এলো। সাদা শার্টের ওপর ছাই রঙের কোট। স্যুট কেন, শেরওয়ানি কোথায়, পাজামা নেই? এ ছেলে নাস্তিক না-হয়ে যায় না। আমার দিকে দাঁত কড়মড় করে তোর বাবা বললেন, বদ্ধ উন্মাদ।
বদ্ধ উন্মাদটা কে? আমি না মঞ্জুর?
তিনি কথা বললেন না।
তারপর শরীর খারাপ লাগার অজুহাত দেখিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে সোজা বাসায়। বাসা তো দূরে নয়—রিকশায় পাঁচ মিনিটেরও কম। চাবি ছিল তোর মার কাছে। ঘরে ঢুকতে না পেরে রাগে গদ গদ করে ফিরে এলেন। রিকশা থেকে নেমে প্রথম পা-টাই রাখলেন একদলা কাঁচা গোবরের ওপর। ঘাসের ওপর নতুন কেনা বাটার জুতোটা খুব করে ঘষে বিয়ের প্যান্ডেলে ঢুকলেন। ততোক্ষণে বিয়ে পড়ানো, খোরমা বিতরণ, মোনাজাত—সব শেষ। অনেকটা জোর করেই তাকে খাবার টেবিলে বসালাম। ঢোক ঢোক করে দু গ্লাস বোরহানি খেয়ে উঠে পড়লেন। জামাইকে ধরে আনলাম তোর বাবার কাছে। মঞ্জুর কদমবুসি করতে যতই এগুচ্ছে, তোর বাবা ততই পা টেনে নিচ্ছে। গোবরের ব্যাপারটা তাকে আপসেট করে রেখেছে। নতুন জামাই যাতে গোবরের ঘ্রাণ না পায় সে জন্যই তার পা লুকোবার চেষ্টা।
তোকে আর মঞ্জুরকে যখন আস্ত খাশির স্পেশাল ডিশে বসানো হলো সেখান থেকে বেশ খানিকটা তুলে এনে তোর বাবাকে এনে দিলাম। কয়েকবার না না বলেও শেষ পর্যন্ত ভালোই খেলেন। দু গ্লাস বোরহানিতে তো আর পেট ভরে না।
তোকেও দেখলাম কেমন বেহায়ার মতো খাচ্ছিস। নিজের বিয়ের খাবার এত খেতে আছে! আমাকে তো একবারও বললি না, ছোটমামা খাবে না? অবশ্য নিজের বিয়ের দিন কি আর এত কথা বলা যায়!
শেষ ব্যাচে বসলাম। রোস্ট পেলাম না। খাওয়া শেষ না-হতেই সাবান-চিলুমচি হাতে একজন হাজির। পাঁচ টাকা দিয়ে তবে নিষ্কৃতি।
তোর বিয়ের দিন আবহাওয়াটা ভালো ছিল না। কত নম্বর সিগন্যালও ছিল—পাঁচ না দশ মনে নেই। বিয়ের জন্য তুইও ক্ষেপাটে হয়ে আছিস। আকাশটা মেঘাচ্ছন্ন ছিল। দুপুরের পর দমকা বাতাস। বিয়ের প্যান্ডেলটা করা হয়েছে একটা খোলা মাঠে। ঝড়ো বাতাসে সামিয়ানার খানিকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে উঠেছে। তোকে তাড়াতাড়ি বরের সাথে গাড়িতে তুলে দিতে হবে।
শেষ মুহূর্তে তুই একটুখানি কেঁদেছিলি। বিয়ের দিন মেয়েদের একটু কাঁদতে হয়।
গাড়িতে তুলে দেবার ঠিক আগের মুহূর্তে তোকে আদর করতে ইচ্ছে করছিল। সাহস পাচ্ছিলাম না। আমার মনে হচ্ছিল মঞ্জুর ছোকরাটা বোধহয় বলছে, ছোটমামা, দিস ফার এন্ড নো ফারদার। আর মামাগিরি ফলাতে হবে না।
শোন, তোর বাবার চিঠির ভেতরে তোর মার একটা ছোট্ট চিরকুটও ছিল—‘তোমরা সকলে মিলিয়া মেয়েটার এতবড় সর্বনাশ করিয়াছো। তাহার দিকে তাকাইতে পারি না। দোয়া করিও যেখানেই থাকুক জামাই যেন ফিরিয়া আসে।’ আমার বিশ্বাসের ভিত বড়ো নড়বড়ে। আমার দোয়াতে কাজ হবে না। তবুও আমার মনে হয় মঞ্জুর তোর কাছে ফিরে আসবে। ফিরতেই হবে তাকে। তোর বাবাকে আমাদের জন্য দোয়া করতে বলিস।
এবার যখন চিল্লায় যাবে একটু মনে করিয়ে দিস আমার কথা। তোর বাবার দোয়া আল্লাহ কবুল করতেও পারেন। একরোখা টাইপের মানুষের দোয়া কবুল হয় কিনা কে জানে।
জুনায়েদ আলী খানের কথা তোর মনে আছে? সিক্সটি সেভেনে তোদের বাসায় একবার নিয়ে গিয়েছিলাম। মানে নাইনটিন সিক্সটি সেভেনে। তোদের জন্য বড় টিনের কৌটোভর্তি মিল্কি চকোলেট এনেছিল। তোর বাবা চকোলেটে কামড় দিয়েই, ওয়াক থু, তওবা আস্তাগফিরুল্লাহ বলে চেঁচিয়ে উঠলেন, এতে শূকরের দুগ্ধ মেশানো আছে, ওটা হারাম। তোর মা-ও দু একটা খেয়ে বলল, তাই তো, আমারও কেমন যেন লাগছে। তোর বাবা কি আগে কখনো শূকরের দুগ্ধ খেয়েছেন যে চকোলেট মুখে দিয়েই বুঝে ফেললেন? এটা আর তাকে জিজ্ঞেস করা হলো না। হারাম চকোলেট আনার অপবাদ নিয়েই তাকে ফিরে যেতে হলো। খুব একটা খাতির-যত্ন পেল না।
জুনায়েদ আলী খান লিভার ব্রাদার্সে আমার সিনিয়র সহকর্মী। তাজমহল রোডে নিজের টাকায় কেনা একটা ছোট্ট দোতলা বাড়িতে থাকত। সরকার এটাকে অ্যাবান্ডেড প্রপার্টি ঘোষণা করেছে। বাড়িটার শেষ পর্যন্ত কী হবে আমি জানি না। দুলাভাইকে জিজ্ঞেস করিস। এ বাড়িটার ওপর জুনায়েদের মেয়েদের দাবি থাকা অসঙ্গত হবে না। একাত্তরের প্রথমদিকেই জুনায়েদ ঢাকার পাট চুকিয়ে পেশোয়ার চলে যায়। সাথে নিঘাত, ওর বউ এবং দুটো মেয়ে নওশিন ও নওরিন। জুলাইতে পারিবারিক গোলযোগে গুলিবিদ্ধ হয়ে জুনায়েদ মারা যায়। খবরটা নিঘাতের কাছ থেকে পাবার আগেই লিভার ব্রাদার্সের এক কলিগ আমাকে জানায়। তাজমহল রোডে জুনায়েদের জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে যাওয়া-আসা করতে করতে নিঘাতের সাথে আমার একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জুনায়েদের সাথে শেষদিকে আমার সম্পর্ক শীতল হতে থাকে। যুদ্ধ চলছিল। মুক্তিযোদ্ধা হবার মতো সাহস বা দেশপ্রেম কোনোটাই আমার ছিল না। বরং ছেলেবেলাটা পশ্চিম পাকিস্তানে কাটানোর কারণে তাদের সাথেই যোগাযোগটা ছিল বেশি। নিঘাতের পাশে দাঁড়ানোটাই আমার কাছে বেশি জরুরি মনে হয়েছে। হাবিব ব্যাংকে একটা চাকরিও হয়ে যায়। বাহাত্তরে নিঘাতকে বিয়ে করি। বিয়েটা কেউ ভালো চোখে দেখেনি। জুনায়েদের আত্মীয়রা আমাকে মারতে এসেছিল। নিঘাত তাদের লিখিত দিয়েছে জুনায়েদের সম্পত্তিতে তার কোনো দাবি নেই। নওশিন ও নওরিন কী মনে করেছে জানি না। তবে প্রথমদিকে আমারই মনে হয়েছে আমি ওদের বাবার গোপন ঘাতক। এমন একটা কিছু ঘটুক হয়তো আমিই চেয়েছিলাম। নিঘাত ও আমার একটা মেয়ে হয়েছে, নাম সাভেরা। মানে জানিস তো? সাভেরা হচ্ছে প্রভাত, জাগো হুয়া সাভেরা নামে একটা সিনেমা আছে, খান আতার। এখন আমাদের তিনটি মেয়ে নওশিন দশ, নওরিন চার ও সাভেরা এক বছর। আমি তো আর আটকেপড়া বাঙালি নই। আমি নিজেই নিজেকে আটকেছি। আমি আর ফিরতে চাই না। নিঘাত জুনায়েদের বিক্ষিপ্ত সঞ্চয়গুলো একত্র করেছে, আমারও কিছু আছে। আমরা দূরে কোথাও মাইগ্রেট করব। নিঘাতের উদ্যোগের কোনো শেষ নেই। মেয়ে তিনটিকে তো মানুষ করতে হবে।
তোদের বিয়েতে কতো খাটলাম। তোর বাবা ভাবলেন আমার ষড়যন্ত্র। তোর মা কী ভাবল কে জানে। কেন যেন আমার মনের মধ্যে গেঁথে গেছে মঞ্জুর ছেলেটা আমাকে পছন্দ করছে না। না করুক। তবুও, আমি চাই, আমার চিঠি তোর কাছে পৌঁছার আগেই যেন ছেলেটা ফিরে আসে।
তোর কাছে আগেও লিখতে চেয়েছি। হয়ে ওঠেনি। আজ নিজেকে বাধ্য করলাম। আজ নভেম্বরের বারো তারিখ। তোর বিয়ের দিন।
- ছোটমামা / নভেম্বর ১২, ১৯৭৩।
দুই.
ছোটমামা,
বহু বছর পর তোমার চিঠির জবাব দিতে বসেছি। শেষ পর্যন্ত হয়তো লেখা হবে, পোস্ট করা হবে না। আমার অনেক চিঠিই পোস্ট করা হয় না। কোনো না-কোনো বইয়ের ভেতর রেখে দিই—আর এটাকেই আমরা বলি বুকপোস্ট। বুকপোস্ট করা চিঠি সহজে হারায় না, প্রেরক বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে পেয়ে যায়।
তোমার চিঠি আমার একটুও ভালো লাগেনি। এজন্য বারবার পড়িনি। তুমিও আমার ইমম্যাচুরও বান্ধবীদের মতো আশ্বাস দিয়েছো, দেখিস ফিরে আসবে।
কেমন করে ফিরবে? ও, তো নেই।
আমাকে নিয়ে যা যা লিখেছো দ্বিতীয়বার পড়ার ইচ্ছে হয়নি। তবে তোমার মেয়েদের কথা পড়েছি। নওশিন, নওরিন এবং সাভেরা। মনে মনে তোমার সংসারের ছবি এঁকেছি। সাভেরা কি বাংলা জানে?
কক্সবাজারে হানিমুনের একটা স্বপ্ন তুমি দেখিয়েছিলে। ওখানকার সেকেন্ড অফিসার নাকি তোমার ক্লাসমেট। এসডিও সাহেবও পরিচিত। বলেছিলে হিলটপ সার্কিট হাউসে থাকতে দেবে। স্পিডবোটে মহেশখালী ঘুরিয়ে আনবে, মাথিনের কূপ দেখাতে টেকনাফ নিয়ে যাবে। পাহাড়ের উপর সার্কিট হাউস। দরজা খুললেই সমুদ্র। মধ্যরাতে সমুদ্রের গর্জনে ঘুম ভেঙে যাবে।
হানিমুনটা হলো না। আমার বিয়ের রাতেই সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। এত বড় জলোচ্ছ্বাস আর হয়নি। মঞ্জুর বলল, মানুষের লাশের পাশে হানিমুন হতে পারে না। ঠিকই।
একাত্তরে দেশজুড়ে এত যে ঘটনা ঘটে চলছিল, মঞ্জুর কোনোটাই গায়ে মাখেনি। খুব নির্বিকার। কোনো কোনো দিন পাকিস্তানি অত্যাচারের ভয়াবহ কাহিনী আমিই শুনিয়েছি। কতটা তার কানে ঢুকেছে কে জানে। বরং আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছে, আরে ধ্যাৎ ওসব রাখো। সব ঠিক হয়ে যাবে।
ইউনিভার্সিটিতে ওর চাকরিটা হয় হয় করেছে। আমাকে যখন বিয়ে করল তার বেশ আগেই কলেজেরটা ধরেছে। দিনরাত খেটেখুটে এমফিলের ডিসার্টেশন তৈরি করছে। ইউনিভার্সিটিতে নিতে দেরি হচ্ছে দেখে জি সি দেবই কলেজেরটা ধরতে বলেছিলেন, সাথে এমফিলটাও।
জুলাই পর্যন্ত আমরা ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ভাড়া বাসাতেই ছিলাম। তিরিশ তারিখে মঞ্জুর বইপুস্তক বাক্স-পেটরা গুছিয়ে আমাকে আমাদের বাসায় রেখে গেল। বলল, ইন্ডিয়া যাচ্ছি। ট্রেনিং নিয়ে শিগগির ফিরব।
ওর সব বইপুস্তক আর আমার বিয়েতে তোমার দেওয়া ফ্রিজটা আমার রুমে রাখলাম, ফার্নিচারগুলো বাইরের ঘরটাতে। তুমি ভাগ্নির বিয়েতে ফ্রিজ দিয়েছো শুনে আমার বান্ধবীরা বলেছে, তুমি নিশ্চয়ই মিলিয়নিয়ার।
তিরিশ তারিখ রাতে মঞ্জুর আমার সাথে থাকেনি। কোথায় ছিল বলেনি। একত্রিশের রাতটা একসাথেই। আমাদের বাসাতে। রাতভর খুব ছটফট করল। আমি একটু বেশি করে আদর করতে চেষ্টা করলাম। মঞ্জুর কেঁদে ফেলল। বলল, ওর মার কথা মনে পড়ছে। ওদিকে বাবার মেজাজ বিগড়ে আছে। মাকে বলেছে, নাস্তিকটা বুঝি চাকরি খুইয়েছে? আগেই বলেছিলাম।
ঢাকা শহরের অবস্থা থমথমে। আমার চারটি ভাইবোন লেখাপড়া বন্ধ করে বসে আছে। বাবার এলপিআর শুরু চুয়াত্তরের মে-র এক তারিখ থেকে। তারপর সংসার কেমন করে চলবে এ নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই বাসায় একটা সেমিনারের মতো ব্যাপার ঘটে যাচ্ছে। বাবা রাত দশটার পর আলো নিভিয়ে ফেলার নির্দেশ দেন। পয়সা তো আর গাছে ধরে না। আসলেই সংসার কে চালাবে?
সকালে মঞ্জুর একটা চেকবইয়ের ন’টা পাতায় ফাতেমা আকতার খানম লিখে টাকার জায়গাটা খালি রেখে সই করে বইটা আমার হাতে তুলে দিল। বলল, মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কটা তো চেনো, ফার্মগেইট। হাজার পনের টাকা জমা আছে। যখন যা লাগে তুলে নিও। তোমার বাবার কাছে চাইতে যেও না।
তারপর খুব তড়িঘড়ি করে একটা অসমাপ্ত চুমো দিয়ে মঞ্জুর রাস্তায় বের হয়ে পড়ল। কিছু বলতেও পারলাম না। সাবধানে থেকো এ কথাটাও না।
তা কদিন পরই বাবাকে একা বাসায় রেখে আমরা মেঘনা পাড়ি দিয়ে বাড়িতে চলে গেলাম। মঞ্জুরকে জানাতে পারলাম না। ঠিকানা জানি না যে। কোথায় লিখব। ডিসেম্বর ষোল তারিখে দেশ স্বাধীন হলো। আমরা একুশ তারিখে ঢাকা ফিরে এলাম। এ মাসেরই গোড়ার দিকে আমাদের বাসাটা লুট হয়ে গেল। বাবাকে হাত-পা বেঁধে ফেলে রেখেছিল। সাদাকালো টেলিভিশন থেকে শুরু করে কোরআন শরীফের রেহেল পর্যন্ত সব নিয়েছে। নেয়নি বইপত্রগুলো আর তোমার দেওয়া বিশালাকার ফ্রিজ। দু জনকে বাবা চিনতে পেরেছে। ওরা বাবাকে খুব মেরেছে, একজন খুব জোরে বাবার অণ্ডকোষ চেপে ধরেছিল। কথাটা মনে হলে বাবা আতকে উঠলেও মার খাওয়ার ব্যাপারগুলো বাবা পরে আর স্বীকার করত না। বাবার চেনা সেই দুজনের একজন নাকি পরে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত হয়েছে।
ছোটমামা, ঢাকায় ফিরে তো এলাম। কিন্তু আমার মুক্তিযোদ্ধা কোথায়? আমার স্বামী ফিরল না কেন? স্বাধীনতা দিয়ে আমার কী হবে?
চার বছর ধরে খুঁজেছি, পাইনি। প্রতিদিন প্রতিরাত অপেক্ষা করেছি, আসেনি। ও নাকি নভেম্বরেই বাংলাদেশে ঢুকেছে। সাথে অনেক এম্যুনেশনও ছিল। তাহলে কোথায় গেল? বছর তিনেকের মাথায় বাবা বলল, ওসব ছেলে ছোকরার বিশ্বাস কী? বিয়েশাদি করে কোলকাতার কোথাও ঘাপটি মেরে পড়ে আছে। আগেই বলেছিলাম, ছেলেটা ভালো না।
কী জানি হতেও পারে।
ছোটমামা, শেষ পর্যন্ত তোমার খোঁজ পেলাম। তুমি লন্ডনের বাইরে এপিং ফরেস্টের কাছে থাকো। তোমার মেয়েরা স্টেটসে। সাভেরা মাইক্রোসফট কোম্পানিতে কাজ করে। মামী মারা যাবার পর তুমি একটি গুজরাটি মেয়েকে বিয়ে করেছো। তোমার দুটো বাইপাস সার্জারি হয়ে গেছে। নিষেধ অমান্য করে তুমি এলকোহলের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছো। তোমার বউভাগ্য খুব ভালো। গুজরাটি মামী নাকি একটি বড় বিউটি পার্লার চালাচ্ছে। তোমার মেয়েদের সাথেও তার সম্পর্ক খুব ভালো। এসব খবর এনে দিয়েছে আমার স্বামী সৈয়দ শরাফত উল্লাহ। তুমি কেমন আছো আমার খুব জানতে ইচ্ছে করত। আমাকে খুশি করার জন্য আমার স্বামী এতটা কষ্ট করেছে। বুশ হাউজে ওর এক বন্ধু বিবিসিতে পার্টটাইম কাজ করে। তোমাদের চেনে। তার কাছ থেকেই এসব খবর উদ্ধার করেছে।
আমার বিয়ের খবর হয়তো-বা তুমি পেয়ে থাকবে। একসময় মনে হয়েছে আমার সম্পর্কে তোমার কোনো আগ্রহ নেই। এক ধরনের অভিমান থেকে আমিও তোমাকে মুছে ফেলতে চেয়েছি আমার মন থেকে।
মঞ্জুরের জন্য যত কষ্টই লাগুক, সত্যকে মেনে নেওয়ার ক্ষমতা আমার বরাবরই ছিল। রাতের পর রাত কেঁদেছি। এখনো যে কান্না আসে না এমন নয়। কিন্তু এখন ওকে খুব দূরের মানুষ মনে হয়। অন্য গ্রহের। মঞ্জুর বেঁচে থাক বা না-ই থাক, আমি ওকে হারিয়েছি একাত্তরের আগস্টের প্রথম দিনে। ঠিক তার পাঁচ বছর সাতাশ দিন পর ছিয়াত্তরের আঠাশে আগস্ট আমার বস সৈয়দ শরাফত সাহেবকে বিয়ে করেছি। শরাফত সাহেবের বয়স তখন চল্লিশ হবে। তোমার চেয়েও পাঁচ বছরের বড়। আমার কত?
সাতাশ কি আঠাশ। নিখোঁজ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হিসেবে তিয়াত্তরে নামকাওয়াস্তে একটা ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে বিটিএমসিতে একটা চাকরি পেয়ে যাই। চাকরিটারও দরকার ছিল।
চাকরিতে ঢোকার তিন মাসের মাথায় আমার বিরুদ্ধে একটা তদন্ত হয়। তদন্তকারী কর্মকর্তা শরাফত সাহেব। অভিযোগ হচ্ছে, আমি প্রতারণা করে চাকরি নিয়েছি। আমার স্বামী নিখোঁজ নয়। প্রায়ই রাতে আমার কাছে আসে, সকালে চলে যায়। কোনো কোনো রোববারে আমাদের দুজনকে মধুমিতা ও বলাকায় দেখা যায়। অভিযোগকারী হিসেবে পাঁচজনের নাম এবং স্বাক্ষর ছিল। আমি তাদের কাউকে চিনি না। বস্ত্র মন্ত্রণালয় থেকে তদন্তের নির্দেশ এসেছে।
শরাফত সাহেব বললেন, অভিযোগ প্রসঙ্গে আপনার কিছু বলার থাকতে পারে। বলতে পারেন। চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলাম না। আমার চারপাশের সব ঝাপসা হয়ে আসছিল। বললাম, স্যার অভিযোগটি যেন সত্য হয়। আমার স্বামীকে পেলে চাকরি লাগবে না। ওরা হয়তো জানে আমার স্বামী কোথায়। আমি তাকেই চাই। শরাফত সাহেব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রতিবেদনে কী লিখেছেন জানি না। আমার কোনো ক্ষতি হয়নি। তারপর আরো বছর তিনেক পার হলো। শরাফত সাহেব একদিন তার রুমে ডাকলেন।
স্যার, ডেকেছেন?
হ্যাঁ, বসুন।
তারপর এক ঢোক পানি খেয়ে বললেন, ফাতেমা আকতার, আমি বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
জ্বি স্যার, বিয়ে করা ভালো।
থ্যাঙ্ক ইউ।
কিছুক্ষণ একটা পেপারওয়েটের দিকে তাকিয়ে থাকলেন, ফাতেমা আপনার আপত্তি না-থাকলে আমি আপনাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিতে চাই।
থাঙ্ক ইউ, স্যার। আপনি আমার সম্পর্কে তেমন জানেন না। আমার হাজব্যান্ড আছে এ কে এম মঞ্জুর। খুব ব্রিলিয়েন্ট স্টুডেন্ট। ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করার কথা হচ্ছিল। একাত্তরের আগস্টে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছে।
আমি জানি। তিনি ফিরে আসেননি।
জ্বি স্যার, হয়তো তার মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়নি।
ফাতেমা, আপনার সাথে আমার বয়সের ব্যবধান অনেক। এটাকে যদি আমার অযোগ্যতা মনে না-করেন, আমার প্রস্তাবটা বিবেচনা করতে পারেন।
আচ্ছা স্যার।
থ্যাঙ্ক ইউ।
স্যার, খুলনার টেক্সটাইল মিলটা প্রাইভেট সেক্টরে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রাইভেটাইজেশন বোর্ড কিছু তথ্য চেয়েছে। চিঠিটা তৈরি করে আনছি।
আমরা প্রাইভেটাইজেশন বোর্ডকে সরাসরি লিখব না। আমরা মিনিস্ট্রিকে দেব। ওরা জানাবে।
স্যার আসি।
জ্বি, আপনার সাথে আমার অপ্রাসঙ্গিক আলাপটুকু নিয়ে যদি কারো সাথে আলাপ না- করেন খুশি হব। আপনার জবাব পেয়ে গেছি। একটুও ভাববেন না, এসিআর-এ এর কোনো রিফ্লেকশন হবে না। আপনাকে আসতে হবে না। ড্রাফটসহ ফাইলটা পাঠিয়ে দেবেন।
জ্বি স্যার।
তিনি আগাগোড়া পেপারওয়েট কিংবা ডেস্ক ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে কথা বলছিলেন। একবারও আমার সাথে তার চোখাচোখি হয়নি। সরকারি কাজের বাইরে এটুকুই আলাপ। বাহাত্তরের জুনেই মা আমাকে বিয়ে দিতে উঠে পড়ে লেগেছিলেন। কত কথা—মেয়েদের শরীর। আর পাঁচ বছর পর কেউ তো চোখ তুলেও তাকাবে না। শরীরটা থাকতে থাকতে একটা ভালো ছেলে ধরতে হবে। আমার শরীরটা কি কেবল ছেলে ধরার জন্যেই?
নিজের টেবিলে ফিরে এলাম। অনেকদিন পর খুব ভালো লাগল। চোখ ঠেলে কান্না আসতে চাইল। বাথরুমে কতক্ষণ কাঁদলাম। মনে মনে স্যারের সাথে কথা বললাম।
স্যার, আমার ডাকনাম কী জানেন?
জ্বি না।
স্যার, আমার ডাকনাম চন্দনা, ছোট্ট পাখি চন্দনা। আমার ছোটমামার রাখা নাম। মঞ্জুর চন্দনা বলে ডাকত। আমি তো দেখতে ছোটখাটো। আমার তুলনায় মঞ্জুর তো গালিভার। ওর পাশে আমাকে বোধহয় তেমন মানাত না। মঞ্জুরই গুনগুন করত, ও আমার ছোট্ট পাখি চন্দনা।
টেবিলে ফিরে এসে ড্রাফটটা রেডি করলাম। স্যারের বিষয়ে আমাদের কারোই তেমন জানা নেই। বছর দশেক আগে বিয়ে করেছিলেন, প্রথম বছরেই বউ স্যারের এক স্থপতি বন্ধুর হাত ধরে চলে গেছে। স্ত্রী যখন চলে যাচ্ছে, তখন তাকে উইশ করেছেন, তার নেক্সট বার্থ ডে-র জন্যে একটা আগাম উপহারও দিয়েছেন। বলেছেন, তোমার জন্মদিনে আমার যাওয়াটা অনেকেই ভালো চোখে দেখবে না। এটা রেখে দাও। অল দ্য বেস্ট।
এসব তো আর আমি স্যারকে বলতে শুনিনি। অফিসের লোকজন এ নিয়ে খোশগল্প করেছে। দু চার মাসে একবার তার রুমে ডাক পড়ে। ফাইলটা হাতে নিয়ে বিকেল চারটায় আবার গেলাম তার রুমে। একদিনে দুবার। চোখ খানিকটা তুলে ধমকে উঠলেন, আপনাকে ফাইল পাঠাতে বলেছি। ফাইলসহ আসতে বলিনি।
এক মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে নিষ্পলক তার দিকে চেয়ে থাকলাম, স্যার আমি রাজি।
কী রাজি? কণ্ঠে আরো ধমকের ঝাঁজ।
স্যার, আপনি চাইলে আমি আপনাকে বিয়ে করব।
আরো গম্ভীর এবং আরো নির্বিকার কণ্ঠে বললেন, তাৎক্ষণিকভাবে ম্যাচুরড কোনো সিদ্ধান্ত আসে না। পাঁচ-সাত দিন কি একমাস সময় নিন। ভালো-মন্দ বিবেচনা করুন। লোক লাগিয়ে আমার সম্পর্কে আরো জানুন। আই এম নট ইন এ হারি। তাছাড়া আমি চাইলে আপনি রাজি? আপনার নিজের কোনো চাওয়া নেই? আমি হায়ারার্কিক্যাল পয়েন্ট থেকে কোনো সিদ্ধান্ত চাপাতে চাই না। আপনি যখন চাইবেন কেবল তখনই হতে পারে। ড্রাফট কাল পাঠাবেন।
অপমানিত বোধ করলাম। ফাইলটা হাতে নিয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে টেবিলে ফিরে এলাম। পাশের টেবিলের সানজিদা আপা জিজ্ঞেস করলেন, শরাফত সাহেব বকেছেন?
জ্বি, আমার ড্রাফটটা টু দ্য পয়েন্ট হয়নি।
ডোন্ট বি ডিজহার্টেন্ড। ওর বারোটা বাজল বলে। ইউনিয়ন ওর ওপর ক্ষেপে আছে। ওরা মন্ত্রী ও সেক্রেটারিকে ওর নামে যাচ্ছেতাই বলে এসেছে। ব্যাটা এবার শিক্ষা পাবে। মুরোদ নেই নিজের বউ ধরে রাখার। ইম্পেটেন্ট কোথাকার।
তিনটি দিন কোনো রকমে পার করলাম। প্রতিদিন ভেবেছি ডাক পড়বে। চার দিনের দিন নিজের ভেতরেই ভেঙে পড়লাম। সেই সাথে জ্বর, মাথাব্যথা। অফিস কামাই গেল আরো পাঁচ দিন। অসুস্থতার কথা বলে ছুটির দরখাস্ত পাঠিয়েছি। খুব স্পষ্ট করে দরখাস্তের একপাশে বাসার ঠিকানা এবং টেলিফোন নম্বরও দিয়েছি। দরখাস্ত তাকেই সম্বোধন করে লেখা। অবচেতনে আমি বোধহয় চাইছিলাম তিনি একটা ফোন করবেন, কেমন আছি জানতে বাসায় আসবেন। কিছুই হলো না। উপেক্ষিত বোধ করার কষ্টটা ভীষণ। সেই কষ্টটাই আমাকে সহ্য করতে হলো। এরপর আরো দু মাস। তিনি অফিসে আসা বন্ধ করে দিলেন। শুনলাম চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। চাকরি ছাড়া নিয়ে ইউনিয়ন রটাল, শালাকে বাধ্য করেছি। সানজিদা আপা বললেন, শুনেছো টি গার্ডেনের মালিকের স্ত্রীর সাথে নাকি ধুমছে চালিয়ে যাচ্ছে।
আমি বললাম, আপনি যে বলছেন ইম্পেটেন্ট।
এর মধ্যেই আকস্মিকভাবে পিএবিএক্স লাইনে ফোনটা এলো, ফাতেমা আমি শরাফত।
জ্বি স্যার, ভালো আছেন।
ভালো। তুমি কেমন আছো?
তার কণ্ঠে ‘তুমি’ শুনে আমি ফোনে কিছু একটা ফিরে পেলাম।
ভালো স্যার, থ্যাঙ্ক ইউ।
শোনো ফাতেমা, তোমার বিশেষ কোনো অসুবিধা না-থাকলে কালই তোমাকে বিয়ে করব। তিনদিনের একটা ছুটির দরখাস্ত অফিসে ফেলে এসো। আমি সন্ধ্যায় তোমাকে বাসা থেকে তুলে নেব। ঠিকানা, ফোন নম্বর সব জানি। অসুবিধে হবে না। ছুটির তিনদিন আর লাগোয়া শুক্র-শনি মিলে পাঁচ দিন যথেষ্ট, কী বলো?
জ্বি স্যার, যথেষ্ট।
নতুন কিছু কিনতে যেও না। আমি সব ব্যবস্থা করেছি। খুব ঘটা করে বিয়ে করার বয়স তো নেই।
জ্বি স্যার।
ধমকে উঠলেন তিনি, এত স্যার স্যার করছো কেন? বিয়ের পরও স্যার বলবে নাকি?
এইবার আমি হেসে ফেললাম, জ্বি না স্যার।
পরদিন তিনি আমাকে তুলে নিয়ে গেলেন তার এপার্টমেন্টে, ইন্দিরা রোডে। বললেন, ফাতেমা এটা তোমার বাড়ি। লাল কাতান শাড়ি ও অলংকার এগিয়ে দিলেন। তাড়াতাড়ি তৈরি হও। নিজেই নিজেকে বউ সাজালাম। কাজী সাহেব এলেন। শরাফতের কয়েকজন বন্ধুও। বললাম, কবুল। তারপর কাবিননামায় সই করলাম। ওতে কী লেখা পড়েও দেখিনি। দরকারও নেই। আটটার মধ্যে সব সেরে শরাফতকে নিয়ে লাল কাতানে বাড়ি ফেরা। আমাকে বউ সাজে দেখে আমার ভাই-বোনরা থ। শরাফত বাবা ও মাকে সালাম করল। বলল, আমাকে মাফ করবেন। ফাতেমার কোনো দোষ নেই। আমিই বাধ্য করেছি। চলুন একটু ডাল ভাত খেয়ে আসি।
বাবা প্রেসারের দোহাই দিলেন, মা হাউমাউ করে কাঁদলেন।
আমরা পাঁচ ভাই-বোন এবং শরাফত তার গাড়িতে সোজা ব্লু বেল নামের একটা চাইনিজ রেস্তোরাঁয়। শরাফতের বন্ধুরাও ছিল। আমার সবচেয়ে ছোটবোন শাপলা কানের কাছে মুখ এনে জিজ্ঞেস করল, এই মটুটাকে কোথায় পেলি? এটাকে দুলাভাই ডাকলে মানাবে না। ছোট খালুজান ডাকা যেতে পারে।
একসাথে এত দামি খাবার আমরা ভাই-বোনেরা পাইনি। খেতে খেতে শরাফত সবার সাথে খুব হেসে হেসে কথা বলল। বিয়ে নিয়ে একটা এবং খাবার নিয়ে একটা জোকও বলল। রাত সাড়ে এগারোটার মধ্যে সবাইকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে মাকে সালাম করে এবং বাবাকে কিছু না-বলে ফিরে এলাম ইন্দিরা রোডে শরাফত ও আমার এপার্টমেন্টে। রাতভর তার সাথে কথা বললাম। একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জয়েন করেছে। অনেক টাকা বেতন। শরাফত বলল, কাল আমরা হানিমুনে কাঠমান্ডু যাচ্ছি।
কাঠমান্ডু ! আমি ভেবেছি কক্সবাজার।
স্বপ্নের মধ্যে কদিন কেটে গেল। উনিশশ ছিয়াত্তর। আমিও চাকরিটা ছেড়ে দিই বিয়ের অল্পদিনের মধ্যে। শরাফতের কথায় এক্সটার্নাল হিসেবে এমএটাও পাশ করি। শেষ পর্যন্ত আবার একটা এনজিওতে। আমরা রিপ্রোডাকটিভ হেলথ সেক্টরে কাজ করি।
টি গার্ডেনের ম্যানেজার স্ত্রীর সাথে সম্পর্কের কিংবা ইম্পেটেন্ট হবার কোনো লক্ষণ আমার স্বামীর নেই। আমার মেয়ে অথৈ এখন একুশ, সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে পড়ছে আর তরঙ্গ, আমার ছেলে, ড্রাগ এডিক্ট, সুইসাইডাল টেন্ডেন্সিও আছে। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা ড্রপ দিয়েছে। মেয়ে ও ছেলের এসব সামুদ্রিক নাম মঞ্জুরের কাছ থেকে পাওয়া। সত্তরের বারোই নভেম্বর বিয়ে, ডিসেম্বর না-যেতেই ছেলে-মেয়ের নাম পাকা করে বসে আছে। এসব নামের উৎস শরাফতকে কখনো বলিনি। বলাটা কি ঠিক হতো?
ছিয়াশিতে বাবা মারা গেল। মৃত্যুর দুদিন আগে বাবার মাথায় হাত রাখতেই বিড়বিড় করে বলল, আমার মন বলছে নাস্তিকটা মরেনি। ছোটমামা, সত্যি বলছি, মাঝে মাঝে আমারও মনে হয় বাবার কথাই ঠিক। ও মরেনি। ওর যুদ্ধটা এখনো শেষ হয়নি। শেষ হলে ঠিকই ফিরত।
- তোমার চন্দনা।