বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত মুক্তির সংগ্রাম



মিনার মনসুর
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

যারা বলেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের কী দিয়েছে—আমি তাদের কিছুই বলি না। তাদের করুণা করা যেত কিংবা বাংলার বরেণ্য কবি আবদুল হাকিমের ভাষায় বলা যেত, ‘সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি’। কিন্তু আমি তার কোনোটাই করি না। কারণ আমি তাদেরকে কখনোই করুণা বা ক্রোধ কোনোটারই যোগ্য বলে বিবেচনা করিনি। তবে যারা বলেন যে বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতা ছাড়া আর কিছুই দেননি, আমি তাদেরকে আয়নায় নিজের অবয়বটি দেখতে বলি। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের আগে তিনি কী ছিলেন, আর এখন কী হয়েছেন সেটা দেখলেই তো এ জাতীয় সব কু-তর্কের মীমাংসা হয়ে যায়! কথাটি সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। স্বাধীনতার আগের সেই বাংলাদেশ আর এই বাংলাদেশ যে এক নয় সেটা বোঝার জন্য গবেষক-পণ্ডিত হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না, শুধু চারপাশে তাকানোর মতো দুটি নির্দোষ চোখ থাকলেই চলে। স্বাধীনতা-পরবর্তী গত সাড়ে চার দশকে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে যে-অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে, আমাদের নিকট অতীতের বাস্তবতার নিরিখে তা অভাবনীয়ই বলা যায়। আর তার বীজ বপিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর জাদুকরী হাতেই। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। এখানে যে-কথাটি না বললেই নয় তা হলো, যারা স্বাধীনতা ও পরাধীনতার প্রভেদ বোঝেন না তাদের সঙ্গে তর্ক করা বৃথা।

দাঁত থাকতে মানুষ দাঁতের মর্যাদা বোঝেন না। এটা কোনো নতুন কথা নয়। প্রকৃতিদত্ত সহজলভ্য অক্সিজেনের অবারিত সমুদ্রে যার বসবাস, অক্সিজেন-শূন্যতায় প্রাণ ওষ্ঠাগত না হলে সে অক্সিজেনের মূল্য বুঝবেই-বা কিভাবে? অথচ আমাদের আদিকবিরাও তা বুঝতেন। স্বাধীনতার ধারণা যখন এতটা স্পষ্টভাবে দানা বাঁধেনি, তখনই আমাদের আরেক বাঙালি কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় লিখে গেছেন, ‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়!’ স্বাধীনতাহীনতায় কেউ বাঁচতে চায় না। কারণ স্বাধীনতার চেয়ে দামি যে আর কিছুই হতে পারে না তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। স্বাধীনতার জন্যে বিশ্বের দেশে দেশে এখনো যারা হাসিমুখে জীবন উৎসর্গ করে চলেছেন তারাই জানেন স্বাধীনতার আসল মূল্য। যুগ যুগ ধরে রক্ত ঝরিয়েও অনেকে আজও স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি। সেদিক থেকে আমরা নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে যা কখনো ঘটেনি, ঘটবে এমনটা কল্পনাও করা যায়নি, সেই অভাবনীয় ঐতিহাসিক কাণ্ডটিই ঘটে গেছে আমাদের জীবনে। আর এই অসম্ভবকে যিনি সম্ভব করে দিয়ে গেছেন তাঁর নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মাত্র ৫৫ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে তিনি যদি আর কিছু নাও করতেন, শুধু এই একটি কাজের জন্যেই তিনি অমর হয়ে থাকতেন। তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে খোদিত হয়ে থাকত বিশ্ববরেণ্য নেতাদের তালিকায়।

বলা বাহুল্য, বঙ্গবন্ধুর অবদান শুধু স্বাধীনতার মধ্যে সীমিত নয়, যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্যস্বাধীন এ দেশটিকে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর কঠিনতম কাজটিও সম্পন্ন করতে হয়েছিল তাঁকেই। এককথায়, সেটা ছিল এক দানবীয় কর্ম। নয়মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে গোটা দেশ ক্ষতবিক্ষত। সড়ক যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। দেশের প্রধান দুটি সমুদ্র বন্দরই ব্যবহারের অনুপযোগী। অর্থনীতির প্রধান খাত হিসেবে বিবেচিত কৃষি মুখ থুবড়ে পড়েছে। নামমাত্র যে শিল্প ও ব্যাংকবীমা ছিল—তাও দেউলিয়া হয়ে গেছে। খাদ্য নেই। কোষাগারও শূন্য। পুলিশ-প্রশাসন কিছুই নেই। নেই স্বাধীন একটি দেশ চালানোর মতো অভিজ্ঞতাসম্পন্ন দক্ষ এবং অভিজ্ঞ জনবলও। এদিকে মানুষের প্রত্যাশা তখন আকাশচুম্বী। বেকার তরুণ-যুবকরা অস্ত্র হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে সারা দেশে। প্রায় এক কোটি মানুষ দেশ ছেড়ে গিয়েছিল। তারাও ফিরতে শুরু করেছে শূন্য হাতে। অন্যদিকে, আমেরিকা, চীন ও তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের ধনী দেশগুলোর অবস্থান স্বাধীনতার বিপক্ষে। দেশের ভেতরেও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিগুলো তখনও তৎপর। এরকম একটি অবস্থায় বঙ্গবন্ধুকে হাল ধরতে হয়েছিল সদ্যস্বাধীন এ দেশটির। আরো লক্ষণীয় যে তিনি সময় পেয়েছিলেন মাত্র সাড়ে তিনবছর—১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। এটুকু সময়ের মধ্যে তিনি যা করেছিলেন তা দেশ-বিদেশের ঝানু ঝানু বিশেষজ্ঞদেরও চমকে দিয়েছিল। পর্বতপ্রমাণ প্রতিকূলতার মধ্যেও গোটা দেশের চেহারাই বদলে দিয়েছিলেন তিনি। তার দৃষ্টান্ত ভূরি ভূরি।

এখানে শুধু এটুকু বলাই যথেষ্ট যে, স্বাধীনতাপরবর্তী গত সাড়ে চার দশকে দেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণ ছাড়িয়ে গেছে। তার পরও আমরা খাদ্যে স্বনির্ভরতার কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। বিস্ময়কর অগ্রগতি সাধিত হয়েছে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নসহ সামগ্রিক জীবনমানের ক্ষেত্রেও। মানুষের আয় ও আয়ু দুটোই বেড়েছে। সর্বোপরি, মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট নিয়ে যে-বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেই বাজেটের আকার ইতোমধ্যে পাঁচ লাখ কোটি অতিক্রম করে গেছে। বাংলাদেশের সামনে এই যে অপরিমেয় সম্ভাবনার স্বর্ণদ্বার খুলে গেছে, আলাদীনের সেই আশ্চর্য চেরাগটির নাম হলো স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু কেবল সেই স্বাধীনতাই এনে দেননি, একই সঙ্গে নির্মাণ করে গিয়েছিলেন অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার মহাসড়কও। সেই মহাসড়ক ধরেই আমরা এখন তরতর করে এগিয়ে চলেছি। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন যে, স্বাধীনতার পরপরই যে-সংবিধানটি তিনি জাতিকে উপহার দিয়ে গেছেন, তা এখনো বিশ্বের অন্যতম সেরা সংবিধান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। গণতন্ত্র শুধু নয়, সর্বপ্রকার মৌলিক অধিকারেরই নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে সেই সংবিধানে। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা হয়েছে যে, প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক হলো জনগণ।

২.
প্রাথমিক বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে দেশ যখন সামনের দিকে চলতে শুরু করেছিল—ঠিক তখনই হানা হয় চূড়ান্ত আঘাত। সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় তাঁকে। কারা কেন মানবেতিহাসের এ ঘৃণ্যতম হত্যাযজ্ঞটি সংঘটিত করেছিল তা ইতোমধ্যে সকলেরই জানা হয়ে গেছে। মজার ব্যাপার হলো, ষড়যন্ত্রকারীরা যে-বাকশালকে তাদের যাবতীয় আক্রমণের মূল ঢাল বা বর্ম হিসেবে ব্যবহার করেছিল, সেটি ছিল পরীক্ষামূলক একটি কর্মসূচি। কিছুটা যুগান্তকারীও বলা যায়। এর গুরুত্বপূর্ণ দুটি দিক ছিল। প্রথমত, দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা সংক্ষেপে ‘বাকশাল’ গঠন। দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচিটিই ছিল আসল। বঙ্গবন্ধুর কাছে প্রথম বিপ্লবটি ছিল দেশের স্বাধীনতা অর্জন। তার নেতৃত্বেই সেটি সফল হয়েছে। বাকশাল ঘোষণার মধ্য দিয়ে তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। তাঁর ভাষায়, এ বিপ্লবের লক্ষ্য হলো—‘দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো’।

নানা প্রসঙ্গে নানাভাবে সে-কথা বারবার বলেছেনও তিনি। এও বলেছেন যে, ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে তিনি তাৎপর্যপূর্ণ দুটি কথা বলেছিলেন একই নিঃশ্বাসে। সেটি হলো, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। স্বাধীনতার স্বপ্ন সফল হয়েছে কিন্তু প্রকৃত ‘মুক্তি’ অর্জিত হয়নি। শত শত বছরের শোষণ-বঞ্চনার নিগড় থেকে দেশের কোটি কোটি মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে মুক্ত করার কাজটি যে কতটা কঠিন তা তিনি অন্য যে-কারো চেয়ে ভালো জানতেন। তিনি বলেছেন, তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লবের লক্ষ্য হলো—অর্থনৈতিক মুক্তি। তাঁর ঘোষিত বাকশাল তথা দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ দেশের ভুখানাঙ্গা মানুষকে শোষণ-বঞ্চনা ও দারিদ্র্যের বংশানুক্রমিক শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করা সম্ভব বলে তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাসও করতেন।

গত শতাব্দীতে প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীদের খুবই প্রিয় একটি স্লোগান ছিল—‘এ সমাজ ঘুণে ধরা/ এ সমাজ ভাঙতে হবে’। দশকের পর দশক ধরে স্লোগানটি এ-দেশের মুক্তিকামী মানুষকে অনুপ্রাণিতও করেছে। গতানুগতিক অর্থে বঙ্গবন্ধু বিপ্লবী ছিলেন না। সব ধরনের হঠকারিতা বা চরমপন্থা থেকে তিনি নিজেকে সযত্নে দূরে রেখেছেন আমৃত্যু। তবে দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বঙ্গবন্ধু নিজেও সম্ভবত উপলব্ধি করেছিলেন দুঃখী মানুষের ভাগ্য বদলাতে হলে ঘুণে ধরা সমাজ ভাঙা ছাড়া গত্যন্তর নেই। তাঁর ভাষায়, ‘আমি কেন ডাক দিয়েছি? এই ঘুণে ধরা ইংরেজ আমলের, পাকিস্তানি আমলের যে শাসনব্যবস্থা তা চলতে পারে না। একে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। তা হলে দেশের মঙ্গল আসতে পারে। না হলে আসতে পারে না। আমি তিন বছর দেখেছি। দেখেশুনে আমি আমার স্থির বিশ্বাসে পৌঁছেছি।...’ (সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রদত্ত ভাষণ: ২৬ মার্চ, ১৯৭৫)।

আমার বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচির মধ্যে বিদ্যমান ঘুণে ধরা সমাজ ভাঙার বলিষ্ঠ কিছু উপাদানও ছিল। তিনি তাঁর মতো করে সমাজ-ভাঙার কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। বিশেষ করে কৃষি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তনের চিন্তা ছিল বঙ্গবন্ধুর মনে। পঁচাত্তরের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল জনসভায় প্রদত্ত দীর্ঘ ভাষণে সেটা তিনি বলেছেনও খোলাখুলিভাবে। তাঁর ভাষায়—“এই যে নতুন সিস্টেমে যেতে চাচ্ছি আমি, গ্রামে গ্রামে বহুমুখী কো-অপারেটিভ হবে। ভুল করবেন না। আমি আপনাদের জমি নেব না। ভয় পাবেন না। ...পাঁচ বছরের প্ল্যানে বাংলাদেশের ৬৫ হাজার গ্রামে কো-অপারেটিভ হবে। প্রত্যেকটি গ্রামে এই কো-অপারেটিভে জমির মালিকের জমি থাকবে। ...কর্মক্ষম প্রতিটি মানুষকে কো-অপারেটিভের সদস্য হতে হবে। এগুলো বহুমুখী কো-অপারেটিভ হবে। পয়সা যাবে তাদের কাছে, ফার্টিলাইজার যাবে তাদের কাছে, টেস্ট রিলিফ যাবে তাদের কাছে, ওয়ার্কস প্রোগ্রাম যাবে তাদের কাছে। আস্তে আস্তে ইউনিয়ন কাউন্সিল টাউটদেরকে বিদায় দেয়া হবে। তা না হলে দেশকে বাঁচানো যাবে না। এই জন্যই ভিলেজ কো-অপারেটিভ হবে। আমি ঘোষণা করছি যে পাঁচ বছরের প্ল্যানে প্রত্যেকটি গ্রামে পাঁচশো থেকে হাজার ফ্যামিলি নিয়ে কম্পালসারি কো-অপারেটিভ হবে।”

[পুরো ভাষণ শুনতে ইউটিউব লিংকে ক্লিক করুন]

মূলত দ্বিতীয় বিপ্লবের এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্যই তিনি গঠন করেছিলেন বাকশাল নামক নতুন রাজনৈতিক দল। এটাকে তিনি বলেছিলেন জাতীয় দল বা প্লাটফরম। দল-মত নির্বিশেষে সকলেরই যোগ দেওয়ার সুযোগ ছিল এ দলে। সামরিক-বেসামরিক বহু সরকারি কর্মকর্তা সেই সুযোগ গ্রহণও করেছিলেন। গুটিকয় ব্যতিক্রম ছাড়া বাকশালে যোগ দেওয়ার জন্য হিড়িক পড়ে গিয়েছিল তখন। নানাভাবে দেনদরবারও চলছিল। শোনা যায়, যাকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ বলে বঙ্গবন্ধুর সমকক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর হাস্যকর চেষ্টা চালানো হচ্ছে দীর্ঘদিন যাবৎ সেই সেনা কর্মকর্তাও ছিলেন এই দলে। ছিলেন আরো অনেকেই। বাকশালের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় এখনো থামেনি। বলা হয় যে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য বঙ্গবন্ধু একদলীয় শাসন কায়েম করেছিলেন! বিসর্জন দিয়েছিলেন গণতন্ত্রকে! সে জন্যই নাকি সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল! বহু ‘নিরপেক্ষ’ বুদ্ধিজীবী-পণ্ডিতের মুখেও আমি এমন কথা বহুবার শুনেছি। এ প্রচারণা যে সুপরিকল্পিত, বিদ্বেষপ্রসূত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। অনেকটা হরিণের পানি ঘোলা করার সেই গল্পের মতো। বস্তুত বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার পরপরই। দেশি-বিদেশি অনেকেই জড়িত ছিলেন এ-ষড়যন্ত্রের সঙ্গে। একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়াই ছিল তাদের প্রথম লক্ষ্য। ঘাতকরা তাদের লক্ষ্যে এতটাই অবিচল ছিল যে, বঙ্গবন্ধু বাকশাল কর্মসূচি ঘোষণা না করলেও পরিস্থিতির কোনো হেরফের হতো বলে আমার মনে হয় না।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Aug/03/1564835607561.jpg
◤ বাকশাল ছিল বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব ◢

 

ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, ক্ষমতা আঁকড়ে থাকাই যদি বঙ্গবন্ধুর মূল উদ্দেশ্য হতো তার জন্য বাকশাল গঠনের প্রয়োজন ছিল না। স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তিনি আরো বহুদিন ক্ষমতায় থাকতে পারতেন। আমার জানা মতে, বঙ্গবন্ধুর ঘোর বিরোধীরাও নির্বাচনের মাধ্যমে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার অসম্ভব দাবি কখনোই করেননি। সব দল মিলেও যে সেটা সম্ভব হতো না তা তারা ভালো করেই জানতেন। এমনকি চুয়াত্তর-পঁচাত্তরের সেই কঠিন দিনগুলোতেও সকল বিচারেই বঙ্গবন্ধু ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। সেটা তিনি নিজেও জানতেন। যেখানেই তিনি যেতেন, সেখানেই মানুষের ঢল নামত। আমার মনে হয়, বঙ্গবন্ধুর কষ্ট ছিল অন্য জায়গায়। তিনি নিজের সঙ্গেই এক কঠিন যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। নিজেকে, নিজের চারপাশের সব সীমাবদ্ধতাকে, ছাড়িয়ে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে বঙ্গবন্ধু তাঁর সারা জীবনের স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবের মিল খুঁজে পাচ্ছিলেন না। বিশেষ করে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ তাঁকে খুব বিচলিত করে তুলেছিল।

নানা সূত্রে এখন জানা যাচ্ছে যে, দ্রুত কিছু একটা করার জন্য ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড অস্থির হয়ে উঠেছিলেন তিনি। নানা জন নানা পরামর্শ দিয়েছেন তাঁকে। বলেছেন, ভেবেচিন্তে ধীরেসুস্থে পা ফেলতে। পরিণতি সম্পর্কে সতর্কও করে দিয়েছেন। ফিডেল ক্যাস্ট্রোর মতো নেতারাও ছিলেন পরামর্শদাতাদের দলে। কিন্তু একাত্তরের রুদ্ধশ্বাস দিনগুলোর মতো এবারও বঙ্গবন্ধু স্বীয় সিদ্ধান্তে অবিচল ছিলেন। কারো কথাই শোনেননি তিনি। এমন নয় যে, পরিণতির ব্যাপারে তিনি খুব উদাসীন ছিলেন। ঘাতকের বুলেট যে-কোনো সময়ে তাঁর বুক ঝাঁঝরা করে দিতে পারে তাও তাঁর অজানা ছিল না। রবীন্দ্রনাথের খুব ভক্ত ছিলেন তিনি। সত্য যে কঠিন—নিজের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনেই তা তিনি উপলব্ধি করেছেন পদে পদে। স্বধর্মে অবিচল থাকা যে আরো কঠিন তাও তিনি জানতেন। তবু যুধিষ্ঠিরের মতো তিনিও স্বধর্ম পালনে কখনোই কুণ্ঠিত হননি। যুধিষ্ঠির চলতেন নিজের বিবেচনা ও বিশ্বাস অনুযায়ী। বিবেকের নির্দেশকে শিরোধার্য জ্ঞান করতেন। এটাই হলো স্বধর্ম। শত ঝড়ঝঞ্ঝা সত্ত্বেও এ-পথ থেকে একচুলও বিচ্যুত হননি যুধিষ্ঠির। এ জন্য বুদ্ধদেব বসু মহাভারতের নায়কের শিরোপাটি তুলে দিয়েছিলেন তাঁর মাথায়। বলেছিলেন—মহাবীর অর্জুন নন, যুক্তিবাদী যুধিষ্ঠিরই হলেন যথার্থ নায়ক। বঙ্গবন্ধুও তাই। বলা যায়, সম্পূর্ণ সজ্ঞানেই ঘাতকের উদ্যত সঙ্গীনকে অগ্রাহ্য করে একাত্তরের মতো আবারও বিবেকের ডাকেই সাড়া দিয়েছিলেন তিনি। এটাই তার স্বধর্ম। তবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমি রাজা ইডিপাসেরও মিল খুঁজে পাই—কোনো কিছুই যাকে নিজ জনগণের মঙ্গলসাধনের ব্রত থেকে নিবৃত্ত করতে পারেনি। খুঁজে পাই আমাদের কালের ট্রাজিডির অনন্য এক মহানায়ককে।

বলা বাহুল্য, সপরিবারে আত্মাহুতি দিয়ে বঙ্গবন্ধু এ-দেশের হতদরিদ্র মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে যে-সংগ্রামের সূচনা করে গেছেন, তাকে সফলভাবে সমাপ্ত করার গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয়েছে বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের ওপর। এখানে ব্যর্থতার কোনো অবকাশ নেই। আমাদের সৌভাগ্য যে, তাঁরই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ ও দূরদর্শী নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত মুক্তির সংগ্রাম সমাপ্ত করার পথে ইতোমধ্যে আমরা অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছি। দেশে-বিদেশে সর্বত্রই বাংলাদেশ আজ এক যথার্থই বিস্ময়ের নাম। জাতির পিতার সোনার বাংলা এখন আর কেবল স্বপ্নমাত্র নয়, পদ্মা সেতুর মতোই তার অবয়ব ক্রমেই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে দিনদিন।

মিনার মনসুর
পরিচালক, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;