“মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতা নিয়ে নিয়েছেন”
হেনরি কিসিঞ্জারকে জোসেফ জে সিসকোর চিঠি ও অন্যান্য
[জোসেফ জে সিসকো (জন্ম ৩১ অক্টোবর ১৯১৯-মৃত্যু ২৩ ডিসেম্বর ২০০৪), ইতালিয়ান-আমেরিকান, ১৯৭১-এ আন্ডার সেক্রেটারি অব স্টেট; চেয়ারম্যান, ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল রিভিউ গ্রুপ। মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে হেনরি কিসিঞ্জারের শাটল ডিপ্লোম্যাসি চলাকালে তিনিই প্রধান দাপ্তরিক দায়িত্ব পালন করেন। সিসকো ১৯৫১ সালে কূটনৈতিক চাকরিতে যোগদানের আগে কিছুসময় সিআইএ-ও কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেছেন। হেনরি কিসিঞ্জার তখন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রিচার্ড এম নিক্সনের সহকারী।]
১৫ মার্চ ১৯৭১ : আজ ঢাকায় দিনের প্রথম ভাগে শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছেন, তার দল আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে (৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টি অধিকার করে) পূর্ব পাকিস্তানের শাসনভার নিয়ে নিয়েছে।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সামরিক আইন প্রশাসন, যা এখনো পাকিস্তান সরকার, তার তোয়াক্কা না করেই মুজিব এককভাবে এ কাজটি করেছেন। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, মুজিবের ঘোষণার ৩৫টি নির্দেশনা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ হাতে তুলে নেওয়ার ইচ্ছাকৃত ও পরিকল্পিত পদক্ষেপ।
এই পদক্ষেপ নিয়ে মুজিব সরাসরি ইয়াহিয়া সরকারের মুখোমুখি দাঁড়ালেন, তবে তিনি সচেতনভাবে পূর্ব পাকিস্তানের নিঃশর্ত স্বাধীনতা ঘোষণা এড়িয়ে গেছেন এবং তার এ কাজের ভিত্তি যে গত ডিসেম্বরের নির্বাচনে জনগণের গণতান্ত্রিক রায় তা উল্লেখ করেছেন।
ইয়াহিয়া প্রশাসন এই সংকটাকীর্ণ পদক্ষেপের কারণে অবশ্যই দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখাবে। মুজিবের সঙ্গে কথা বলার জন্য ইয়াহিয়া ঢাকায় ছুটে এসেছেন।
ইয়াহিয়ার সামনে দুটি পথ—এর যে কোনোটি ইতিমধ্যেই ভঙ্গুর হয়ে পড়া পাকিস্তানের ঐক্য আরো বিপদাপন্ন করে তুলবে। ইয়াহিয়া যদি মুজিবের এ পদক্ষেপ মেনে নেন, তাহলে ধরে নিতে হবে তার সামরিক আইনের ক্ষমতা অন্তত পূর্ব পাকিস্তানে প্রত্যাহৃত হয়েছে, পশ্চিম পাকিস্তানে তা বহাল রাখা দুরূহ হয়ে পড়বে (ভুট্টোর রোববারের ভাষণ তা আরো স্পষ্ট করে তুলেছে)।
যদি ইয়াহিয়া কিংবা সামরিক বাহিনীর অন্যরা বলপ্রয়োগ করে মুজিবকে প্রতিহত করেন, পূর্ব পাকিস্তান হয়ে উঠবে সামরিক বাহিনী ও বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের লড়াইয়ের রণক্ষেত্র। যার ফলে শেষ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলার আত্মপ্রকাশ ঘটবে।
পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন হবে—যদি-না দীর্ঘমেয়াদে সেনাবাহিনী বিদ্রোহ দমন করতে পুরোপরি সক্ষম হয়। ‘সম্ভাব্য সব পন্থায়’ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত সব শক্তিকে প্রতিহত করতে মুজিব এক বিবৃতিতে বাঙালিদের আহ্বান জানান।
সোমবার করাচিতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো দাবি জানিয়েছেন ক্ষমতা দুই অংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে হস্তান্তর করা হোক—ভুট্টোর দলকে পশ্চিমাংশের, মুজিবকে পূর্বাংশের।
ভুট্টোর ভাষণ মুজিবের পদক্ষেপকে উজ্জীবিত করে থাকতে পারে। বিগত কিছুদিন ধরে যা সন্দেহ করা হচ্ছিল—ভুট্টো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সম্পূর্ণ বা আংশিক খণ্ডিত দেশে পশ্চিমাংশের ক্ষমতা গ্রহণই তার জন্য উত্তম, তবে মুজিবের মতো পদক্ষেপ গ্রহণ ভুট্টোর বেলায় সহজ হবে না কারণ সেনাবাহিনী পশ্চিমাংশে এত শক্তিশালী যে বিদ্রোহীদের দমন করা কঠিন হবে না। এ সময় ইয়াহিয়া কী সাড়া দেন তা-ই হয়ে উঠবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক।
বিবিসি লন্ডন
২৭ মার্চ ১৯৭১ (দ্বিতীয় সংবাদ)
তিন দিন আগে সেনা মোতায়েনের একজন চাক্ষুষ সাক্ষী বিবিসি প্রতিনিধি নিজেই : তাকে ঢাকা থেকে বহিষ্কারের আদেশ দেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেছেন, ঢাকা শহরের লোকদের সন্ত্রস্ত করার জন্য সেনাবাহিনী পূর্ব-পরিকল্পিত নিষ্ঠুর একটি অপারেশন চালিয়েছে।
আমাদের সংবাদদাতা আরো বলেছেন, ট্যাংক ও আর্মার্ড ট্রাকভর্তি সৈন্য খুব কমই প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে, যদিও ছাত্রদের হাতে কিছু অস্ত্র ছিল। চারদিকে গুলির শব্দ এবং ভবনগুলোতে লেলিহান অগ্নিশিখা।
আমাদের প্রতিনিধি ও তার সঙ্গী ফিল্ম ক্রুকে তিনবার ব্যাপকভাবে তল্লাশি করা হয়েছে। দেশের বাইরে প্রেরণের আগেই তাদের সংবাদ ও কাগজপত্র জব্দ করে রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, সামরিক সরকার মরিয়া হয়ে উঠেছে যাতে সেন্সরবিহীন সংবাদ দেশের বাইরে যেতে না পারে।
প্রতিনিধি আরো জানিয়েছেন, সামরিক বাহিনীর বিবৃতিতে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেফতার হওয়ার সংবাদটি সম্ভবত সত্য।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১
পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ শেষ হয়ে আসছে। রেডিও পাকিস্তান জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা হয়েছে। ভারতীয় বাহিনী ঢাকায় প্রবেশ করেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধী সংসদে বলেছেন, দু পক্ষের প্রতিনিধি ঢাকায় আত্মসমর্পণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন। পাকিস্তানের পক্ষে এই চুক্তি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের।
তিনি বলেন, ভারত আশা করে যে পাকিস্তানে আটক পূর্ব পাকিস্তানীদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান নিজ দেশের মানুষের মধ্যে তাঁর আসন গ্রহণ করবেন এবং বাংলাদেশকে শান্তির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।
তিনি বলেন, ভারতীয় বাহিনী প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় অবস্থান করবে না। তিনি আরো বলেন, লাখ লাখ শরণার্থী এর মধ্যেই দেশের পথে পা বাড়িয়েছে।
(বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস থেকে প্রচারিত ইংরেজি সংবাদের অনুবাদ)
একটি অসাধারণ সাক্ষাৎকার
[তেহরানের দৈনিক কিয়ান আওয়ামী লীগ প্রধানের যে সাক্ষৎকার গ্রহণ করে তার ওপর ভিত্তি করে ডন ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১-এ যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে তা অনূদিত হলো]
মুজিব প্রদেশসমূহের অধিকার নিশ্চিত করতে চান
তেহরান, ১৯ ফেব্রুয়ারি : আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, কেবল পূর্ব পাকিস্তানের নয়, ফেডারেল কাঠামোর আওতায় পশ্চিম পাকিস্তানের সব প্রদেশের অধিকার তিনি নিশ্চিত করতে চান। তেহরানের দৈনিক কিয়ানের প্রতিনিধিকে ঢাকায় দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেন, আমরা চাই সুবিচার ও ঐক্যের ভিত্তিতে সমগ্র জাতি উন্নতি লাভ করুক। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক পাকিস্তানই হবে শক্তিশালী পাকিস্তান। তার পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে শেখ মুজিব বলেন, পররাষ্ট্রনীতি হবে জোট নিরপেক্ষ কিন্তু পৃথিবীর সকল দেশের সাথে সক্রিয় বন্ধুত্ব থাকবে।
শেখ মুজিবুর রহমান জোর দিয়ে বলেন, যারা তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে, তারা কুৎসা রটনাকারী। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে যেসব ভুল করা হয়েছিল তা সংশোধন করতে পারলে পাকিস্তান শক্তিশালী হয়ে উঠবে, অন্যদিকে বর্তমান প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে পাকিস্তান এত দুর্বল হয়ে পড়বে যে, তা থেকে আর উত্তরণ সম্ভব হবে না।
শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে ইসলামাবাদ আর পূর্ব পাকিস্তানের ভবিষ্যতের নির্দেশনা দিতে পারবে না। পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত্বশাসন প্রসঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, আমাদের কর্মসূচি কেবল পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নয়। ফেডারেল কাঠামোর আওতায় আমরা চাই পাঞ্জাব, সিন্ধু, বালুচিস্তান এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের অধিকারও সুরক্ষিত হোক।
বাংলাদেশকে দারিদ্র্যের মধ্যে ফেলে রাখা পশ্চিম পাকিস্তানি ভাইদেরও প্রকৃত স্বার্থের পরিপন্থী। এখন যা স্থানীয় দারিদ্র্য, দীর্ঘমেয়াদে তা-ই সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়বে। আমরা চাই ধনবাদী পদ্ধতির যে একচেটিয়াবাদ ও ট্রাস্ট লাখো মানুষের দারিদ্র্যের বিনিময়ে কিছু মানুষকে মোটাসোটা করছে, তার অবসান ঘটুক।
ভারত কি বাংলাদেশকে খেয়ে ফেলবে?
যখন জিজ্ঞেস করা হলো, ফেডারেল পাকিস্তান হবার কারণে ভারত না আবার বাংলাদেশকে ‘খেয়ে ফেলে’, মুজিব হেসে উঠেন। তিনি আমাদের আশ্বস্ত করলেন, ‘আজকাল কেউ কাউকে খেয়ে ফেলতে পারে না। ভারত তো তাদের বাংলাকে নিয়ন্ত্রণ করতেই হিমশিম খেয়ে যায়, আমাদের দরিদ্র লোকেরা ভেঙে পড়ার পর্যায়ে এলেও তাদের স্বাধীনতা রক্ষা কতে পারবে।’
তিনি বলতে থাকলেন ‘ভিয়েতনামের দিকে তাকান, আমেরিকার মতো শক্তিশালী দেশ তার ইচ্ছে চাপাতে গিয়ে গরিব কৃষকের মাতৃভূমিতে কত অসহায় হয়ে পড়ছে। আমেরিকা যদি ভিয়েতনামকে খেয়ে ফেলতে না পারে, ভারত কেমন করে বাংলাদেশকে খাবে?’
অর্থনৈতিক নীতিমালা
সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে রচিত প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ মুজিবের অর্থনৈতিক নীতিমালায় প্রধান সেক্টরসমূহ ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স, ভারি শিল্প, বিদেশ বাণিজ্য, পাট, তুলা, যানবাহন বিশেষ করে জাহাজ পরিবহন পুরোপুরি জাতীয়করণের কথা বলা হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করেন, এতে ‘কোটারি শক্তি ভেঙে যাবে এবং দেশের ফেডারেল ইউনিটগুলো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যার যার অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে পারবে এবং জনগণ রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ড নিয়ে সরাসরি কথা বলার সুযোগ পাবে।
বিদেশী ঋণ
তার অর্থনৈতিক নীতিমালার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, উদারীকরণ, ‘বৈদেশিক ঋণের অভিশপ্ত বোঝা’ থেকে পাকিস্তানকে রক্ষা করা—‘আমরা অতীতে উন্মত্তের মতো বৈদেশিক ঋণ গ্রহন করেছি, আমাদের গ্রহণ করা ঋণে কিছু সংখ্যক পুঁজিবাদী এবং প্রশাসনে তাদের এজেন্টগণ পুষ্ট হয়েছে আর ঋণের বোঝা ও ঋণের সুদের বোঝা বহন করতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে।’
তিনি চান ফেডারেল সরকার পূর্ণ কর্মসংস্থান, খাদ্যসহ মৌলিক চাহিদা পূরণ এবং ইরানের ‘লিটারেসি কোর’-এর মতো সংগঠনের মাধমে দারিদ্র্য বিমোচনের গ্যারান্টি দিক। তার পররাষ্ট্রনীতি জোটনিরপেক্ষ থাকার এবং পৃথিবীর সব জাতির সঙ্গে বন্ধুত্ব রক্ষার এবং আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যা নিষ্পতি করার।
তিনি চান পাকিস্তান ‘সেন্টা’ এবং ‘সিয়োটো’ থেকে বেরিয়ে আসুক, তবে তিনি চান পাকিস্তান, ইরান ও তুরস্কের একত্রে থাকার আরসিডি গ্রুপ থাকুক এবং বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর অংশগ্রহণে তা আরো বড় হোক।
কাশ্মীর বিরোধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একনায়কত্বের দোহাই দিতে এবং সমরাস্ত্রের জন্য বিপুল ব্যয় করতে সামরিক বাহিনী ও পুঁজিবাদীরা কাশ্মীরকে ব্যবহার করছে। ‘তবুও জম্বু ও কাশ্মীরের জনগণের জন্য আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করিনি।’
মুজিব ভারতের সঙ্গে সর্বোত্তম সম্পর্ক রক্ষা করতে চান। তিনি বলেন, ‘আমরা একই উপমহাদেশের ভাগীদার। পছন্দ হোক বা না হোক আমাদের একসঙ্গে থাকতে হবে, একসঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হবে।
চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব
চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব মুজিবের পররাষ্ট্রনীতির অংশ। ভৌগোলিক অবস্থান এবং নীতিই বন্ধু নির্ধারণ করে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘কিন্তু তার মানে এই নয় আমাদের পদ্ধতি ও দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। আমরা মুসলমান এবং আমরা কখনো কমিউনিজম গ্রহণ করব না।’ ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে মুজিব বলেন, ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক এবং আবেগময় বন্ধনে দু দেশ এমন দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ যে এ নিয়ে বেশি কথা বলার প্রয়োজন নেই এবং এই দুই ভ্রাতৃপ্রতীম দেশকে কেউই বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না।
জাতিসংঘ মহাসচিব বললেন
জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট পূর্ব পাকিস্তানের নিরঙ্কুশ সমর্থিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আনীত রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার গোপন বিচার নিয়ে পাকিস্তান সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, নভেম্বরে পূর্ব বাংলায় হারিকেনের ধ্বংসযজ্ঞ এবং পরবর্তী কলেরা মহামারির চেয়ে ভয়াবহ হবে এই বিচারের পরিণতি।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা উ থান্টের সঙ্গে একমত পোষণ করেন। আওয়ামী লীগের জন্য ৯৮ ভাগ জনসমর্থনের ওপর ভিত্তি করে তারা এই মন্তব্য করেন।... ইয়াহিয়া খানের প্রশাসন কোথায় মুজিবুর রহমানের বিচার হচ্ছে তা প্রকাশ করতেও অস্বীকার করছে। তাদের সরবরাহকৃত তথ্যে বলা হয়েছে ‘পাকিস্তানের কোথাও’ তার বিচার হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাঙালিরা কোনো রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেবে তা যেখানে উদ্বেগের বিষয়, যেখানে তারা পশ্চিমাপন্থী, কিন্তু তারা রেড চীনের প্রতিবেশী, মুজিবুর রহমান যেখানে মধ্যস্থতার চেয়ে বাস্তব পদক্ষেপ নিতে বেশি ঝুঁকে আছেন—তিনি ভোটারের মতামত ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনীর চাওয়ার তফাতটা ভালো করে জানেন তার গোপন বিচারের পরিণতি ভালো হওয়ার নয়।
(১৩ আগস্ট, ১৯৭১)
মুজিবকে অবশ্যই মুক্তি দিতে হবে - ইন্দিরা গান্ধী
[ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দুটি অফিসের একটি দিল্লির প্রশাসনিক ভবন, যেটি সাউথ ব্লক নামে পরিচিত। সানডে টাইমস-এর নিকোলাস ক্যারোল এখানে ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয় ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে।]
গান্ধী বললেন, তাঁর কোনো সন্দেহ নেই যে ভারত ও পাকিস্তানের জন্য বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠবে, যদি বাইরের কোনো হস্তক্ষেপ না থাকে তাহলে উপমহাদেশে স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে।
ক্যারল : বাংলাদেশ প্রশ্নে আপনার ঘোষিত লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। আপনি স্পষ্টভাবেই বলেছেন, ভারতের রাষ্ট্রসীমা বৃদ্ধির কোনো অভিলাষ নেই। তাহলে কবে নাগাদ শেষ ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারের কাজটি সম্পন্ন হবে?
মিসেস গান্ধী : এ পর্যায়ে বলা কষ্টকর। বিষয়টি প্রধানত বাংলাদেশ সরকারের ওপর নির্ভর করে। আমরা আশা করি তা শিগগিরই ঘটবে।
ক্যারল : কত সপ্তাহ বা মাস এমন কিছু কি ভাবছেন?
মিসেস গান্ধী : এখনো বিষয়গুলো এলোমেলো অবস্থায় রয়েছে বলে আমি এ অবস্থায় কিছু বলতে পারছি না। সেখানকার জনগণের নিরাপত্তার বিষয়টিও দেখতে হবে। অবাঙালিদের প্রতি এবং অন্যান্য বিষয়েও আমাদের দায়িত্ব রয়েছে। আমি মনে করি ভারতীয় সেনাবাহিনী এক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারবে।
ক্যারল : আপনি কি আবারও সুনির্দিষ্টভাবে বলবেন যে পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো এলাকা ভারতের অধিকারে রাখার ইচ্ছে আপনার নেই?
মিসেস গান্ধী : আমি মনে করি আমি সুনির্দিষ্টভাবেই জনসভায় এবং সংসদে বলেছি যে আমাদের সীমানা সম্প্রসারণের কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই।
ক্যারল : পাকিস্তানের অধিকারে যে এলাকা রয়েছে যা আপনার মতে ন্যায্যত ভারতের—সেক্ষেত্রেও কি এমনই কথা প্রযোজ্য?
মিসেস গান্ধী : আমি বলেছি যে আমরা বল প্রযোগ করে তা উদ্ধার করব না। কিন্তু আপনি জানেন, আমরা কেবল বিশ্বাসই করি না, এটা প্রমাণিতও হয়েছে যে যুদ্ধরহিতকরণ রেখা বরং খামখেয়ালির মাধ্যমে নির্ধারিত এবং তা শান্তি নিশ্চিত করতে সাহায্য করে না। তবে এটা নিয়ে সরকার নতুন করে বা নতুন কিছু ভাবছে না।
ক্যারল : বাংলাদেশের জন্য তার নেতা শেখ মুজিবুরের বিশেষ প্রয়োজন। তার মুক্তি নিশ্চিত করতে ভারত কী করছে? আপনি কোন ধরনের চাপ দিচ্ছেন?
মিসেস গান্ধী : আমি মনে করি না আমরা অনেকটা চাপ দিতে পারব। আমাদের দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে আমরা বিশ্ব সরকারগুলোর কাছে আপিল করেছি, আমি ব্যক্তিগতভাবে সবার কাছে চিঠি লিখেছি। আমরা একান্তভাবে প্রত্যাশা করি, তারা কিছুটা চাপ দেবে। আজ সকালেই দেখলাম আমেরিকান সরকার (পাকিস্তানের সাথে ভারতের) যুদ্ধবিরতির কিছুটা কৃতিত্ব দাবি করে বসেছে: আশা করি তারা তাহলে এ ব্যাপারটাও দেখবে।
ক্যারল : কিন্তু আপনি তো তার জন্য জিম্মি হিসেবে পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীদের আটকে রেখেছেন। এটা কি সমঝোতার দরকষাকষিতে একটা ভূমিকা রাখতে পারে?
মিসেস গান্ধী : এ নিয়ে আমি তেমন কিছু বলতে পারব না, কারণ আমি জানি না কিভাবে সে আলোচনা হবে বা কী ঘটবে।
ক্যারল : ভারত শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে বলে মনে করেন?
মিসেস গান্ধী : পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হবে এ নিয়ে আমার কখনোই কোনো সন্দেহ ছিল না। আমি মনে করি দুর্ভাগ্যজনক দিকটি হচ্ছে মাঝেমধ্যে এমন সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছে যারা এই সম্পর্ক স্থাপনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার কোনো সন্দেহ নেই যে পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে আমাদের প্রতি একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ অনুভূতি রয়েছে। যখনই আমাদের কেউ যে কোনো উদ্দেশে সেখানে গিয়েছে যেমন শিখদের, অতীতে আমাদের ক্রীড়াদলকে তারা উষ্ণ স্বাগতম জানিয়েছে।
ভারতেও দেখবেন পাকিস্তানের ব্যাপারে কোনো কথা নেই; এটা ঠিক তাদের খবরের কাগজে ঘৃণা প্রচারণা অব্যাহত আছে। এমনকি শিক্ষা কর্মসূচিতে।...ভারতে কী ঘটছে, উন্নয়ন কিভাবে হচ্ছে সে দৃষ্টিতে যদি তারা তাকায়, আমরা যদি সহযোগিতা করি তাহলে দুই দেশই আরো শক্তিশালী ও সামর্থ্যবান হয়ে আমাদের কঠিন সমস্যার মোকাবিলা করতে পারব।
ক্যারল : আপনাকে যুক্তিসংগত আশাবাদী শোনাচ্ছে।
মিসেস গান্ধী : আমি মনে করি আমি একজন আশাবাদী মানুষ।
ক্যারল : বাংলাদেশ ও শরণার্থী প্রশ্নে ভারতের অবস্থান বুঝতে না পারায় আপনি প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে তিরষ্কার করেছেন, ফলে আপনার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠেছে। যদি ধরে নিই আপনার প্রত্যাশা অনুযায়ী যত দ্রুত সম্ভব এ সম্পর্কের উন্নয়ন হয়, আপনি প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পদক্ষেপ গ্রহণ দেখতে চান?
মিসেস গান্ধী : হ্যাঁ, এটি আপনিই উল্লেখ করেছেন। শেখ মুজিবের মুক্তির বিষয় তাদের বাংলাদেশ পরিস্থিতির বাস্তবতায় স্বীকার করতে হবে। তাদের পাকিস্তান পরিস্থিতির বাস্তবতাও মানতে হবে। একটা দূরের দেশ অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে উৎসাহ জোগাতে পারে না, হস্তক্ষেপও করতে পারে না। আপনার পছন্দের বিশেষ সরকারকে আপনি সমর্থন করতে পারেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সেই সরকার সে দেশের জনগণের জন্য সঠিক কিনা? যদি তা না হয়, তাহলে এটি কখনো শক্তিশালী সরকার হতে পারে না—এর পেছনে যত সেনাবাহিনীই থাকুক না কেন, তাতে কিছু এসে যায় না। এটা আমাদের বিষয় নয়, তাদের। এটা পাকিস্তানের ব্যাপার।
ক্যারল : বর্তমানে ভারতের সঙ্গে ব্রিটেনের চমৎকার সম্পর্ক। এশিয়ায় আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষায়, যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ বা কমনওয়েলথ বিষয়ক ব্রিটেন কী করতে পারে বলে আপনার ধারণা?
মিসেস গান্ধী : আমি আগেই বলেছি বাইরের শক্তি যদি হস্তক্ষেপ না করে তাহলে স্থিতিশীলতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। ব্রিটেন সম্প্রতি কোনো হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু আপনারা আগে করেছেন। বর্তমান পরিস্থিতি অংশত সে কারণেই সৃষ্টি হয়েছে—কেবল আপনাদের নয়, অন্যদের হস্তক্ষেপেও।
ক্যারল : আপনি কি মনে করেন আপনার এই উদ্বেগের বিষয়টি আমরা সবাই অবহিত?
মিসেস গান্ধী : হ্যাঁ, আমি মনে করি আপনারা জানেন।
ক্যারল : আমরা যদি বাংলাদেশকে আগে স্বীকৃতি দিই, আপনি তা স্বাগত জানাতেন?
মিসেস গান্ধী : বাংলাদেশের জনগণ স্বাগত জানাবে।
ক্যারল : আপনি কি মনে করেন আমাদের স্বীকৃতি আন্তর্জাতিকভাবে সংকট সমাধানে সহায়ক হবে?
মিসেস গান্ধী : আমি মনে করি তা হবে। এটা বাংলাদেশের জন্য ভালো, কারণ তারা বুঝবে তাদের বন্ধু আছে।
ক্যারল : গত সপ্তাহে মি. কুজনেতজভ যখন দিল্লিতে আসেন, তখন কি বাংলাদেশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বীকৃতি দান নিয়ে আলোচনা করেছেন?
মিসেস গান্ধী : না, আমরা এ ধরনের বিষয় নিয়ে আলাপ করিনি। তবে আমরা নিশ্চয়ই আশা করব, আরো বহুসংখ্যক দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে।
ক্যারল : অন্য সব দেশ পেছনে ফেলে কেবল সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে ছুটে আসবে—এটাকে আপনি অনাকাঙ্ক্ষিত মনে করেন না?
মিসেস গান্ধী : এটাকে বরং আমি এভাবে দেখতে চাই, যত বেশিসংখ্যক দেশ স্বীকৃতি দেবে, বাংলাদেশ তত আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে, এখন বাংলাদেশকে যেসব সমস্যার মোকাবিলা করতে হচ্ছে তখন তার সমাধান সহজ হয়ে যাবে। আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, স্বাধীনতা দরজাটা খুলে দেয়; কিন্তু আসল কাজ আসে তারপর।