কিউরেটর



এনামুল রেজা
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিকেলটা নিস্তেজ হয়ে আসছে। রোদের উত্তাপ ও আলো দুটোই ম্রিয়মাণ। বর্ষার দ্বিতীয় মাস অথচ আকাশ পরিষ্কার। ভাসমান সফেদ তুলোর মতো শরৎঘেঁষা মেঘ। চার রাস্তার একটা মোড়ে দাঁড়িয়ে মন খারাপ হলো। ফুলহাতা শার্টের ডান আস্তিনে কপালের ঘাম মুছলাম। একটা খালি রিকশা আসছে সোজাসুজি। সরে দাঁড়ালাম একপাশে।

রাস্তার ওই ধারে একটা দশতলা বিল্ডিংয়ের নিচে ছোট্ট চায়ের দোকান। ঢালু কংক্রিটের সঙ্গে ভারসাম্য রেখে তৈরি সিমেন্টের দু সারি বেঞ্চ। তীব্র চায়ের তৃষ্ণা পেল। গরমে প্রাণ বেরিয়ে যেতে চাইছে কিন্তু চায়ের ঘ্রাণ নাকে এলে কবে আর ঠিক থেকেছে মাথা! বহুক্ষণ ধরেই ঘুরছি পায়ে হেঁটে। রিপনদের বাসাটা কেউ চিনল না। এতজনকে জিজ্ঞেস করলাম। গেটের দু পাশে বড় দুটো নারিকেল গাছওয়ালা একতলা পুরানো বাড়ি, ছাদ ভরে আছে টবে বেড়ে ওঠা অজস্র গাছপালায়। একদম যেন ঝুলন্ত বাগান।

পীরের মহল্লা শহরটির নাম। হবে, আজ থেকে কয়েকশো বছর আগে এখানে আস্তানা গেড়েছিলেন একজন বা বহুজন পীর। লোকজন আসত, মানত করত বটবৃক্ষে সুতো বেঁধে, দরগায় চড়ত শিন্নি। কল্পনা করে নিতে বেশ লাগে। রিপনরা এলাকার পুরনো পরিবারগুলোর একটি। কখনো তাকে বা তার বাবা নঈমুল হক সাহেবকে জিজ্ঞেস করে অমন পীর বিষয়ক জটিলতার কথা শুনিনি অবশ্য। এর আগে এসেছিলাম একবারই। রিপনের বোন তমালিকার বিয়েতে। সাজানো গোছানো এক ছোট্ট শহর মনে হয়েছিল পীরের মহল্লাকে, বাসার ছাদ থেকেই শহরের পাশ ঘেঁষে বয়ে চলা নদীটা দেখা যেত। বেশ প্রশস্ত হলেও শান্ত সমাহিত নদী, ওইপারে গ্রাম।

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মাঝবয়সী লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘নঈম ডাক্তারের বাসাটা কোনদিকে জানেন?’ চাঅলা গরম পানির বলক ওঠা একটা কেতলিতে শুকনো কালো চা পাতা ঢালতে ঢালতে বলল, ‘কোন নঈম ডক্তর?’
ওই যে পীরের বাজারে বড় চেম্বার আছে, বাড়িটা পুরনো ধাঁচের, ছাদ ভরা গাছপালা।
দুইটা বড় নারিকেল গাছ আছে বাড়ির সামনে?
হ্যাঁ হ্যাঁ। একদম। আপনি চেনেন?
জ্বি চিনি। কিন্তু এসবে লাভ নাই।
চাঅলার উত্তরটা বুঝলাম না। কিসে লাভ নেই? দেখলাম অন্যপাশের বেঞ্চে বসা দুজন লোক আগ্রহী দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আমার দিকে। একজনকে বেশ চিনলাম। ওই লোকটিকেই না রিকশা থেকে নেমে জিজ্ঞেস করেছিলাম রিপনদের বাসা কোনদিকে? কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে আবার বললাম, ‘রিপন আর আমি একই অফিসে কাজ করি। এসেছি মায়ানগর থেকে। ঠিক কোন দিক দিয়ে গেলে পৌঁছতে সুবিধা হবে বলবেন?’

আচমকা কাঁধে কেউ হাত রাখলে ঘুরে চাইলাম বাঁ দিকে। কম্পিত মিহি কণ্ঠে রুগ্ন এক বৃদ্ধ কাঁধ থেকে হাতটা না সরিয়েই কথা বলে উঠলেন। ‘নঈম ডাক্তারের বাড়ি খুঁজতাছেন শুনলাম। তা নাম কী আপনের? কুনখান থাইকা আসা হয়?’

বুঝতে বাকি রইল না। ঘণ্টাখানেক ধরে এই সর্পিল অলিগলির ছোট্ট শহরটায় ঘুরে বেড়াচ্ছি রিপনদের বাসার সন্ধানে এবং বেশ রটে গিয়েছে একজন অচেনা লোকের ওধারা অনুসন্ধান। আজকের যুগে বাসাবাড়ির নম্বর ছাড়া কেউ কোথাও যায়? মোবাইল ফোনই বা আছে কেন? তবে সঙ্গে থাকা নম্বরটি যে বন্ধ, বহুবার ডায়াল করেও সংযোগ মেলেনি, কাকে বোঝাব?

দশ বছর একসঙ্গে কাজ করেছি রিপন আর আমি। ঠিক দু সপ্তাহ আগে হুট করেই সে অফিসে আসা বন্ধ করে দিল। একদিন, দুদিন এমনকি তিনদিনকেও অস্বাভাবিক মনে হয়নি। ভেবেছিলাম হয়তো বাড়িতে গিয়েছে জরুরি কাজে। কিন্তু এমন বিনা নোটিশে এতদিনের কামাই অফিস মানবে কেন? শেষে আমিই বাধ্য হয়ে ম্যানেজমেন্টকে অনুরোধ করেছিলাম। রিপনের সঙ্গে পারিবারিক যোগাযোগ আমার, আসছে উইকেন্ডে অন্তত একবার দেখে আসি ওদের বাসায় কোনো ঝামেলা হলো কিনা। এরপর অফিস যা সিদ্ধান্ত নেবে, সেটা নিশ্চিই অবিচার হবে না। এতদিনের অভিজ্ঞ কর্মী, ওর মতো কন্টেন্ট ডেভলপার চাইলেও যে বাজারে হুট করে মিলবে না, ম্যানেজমেন্টের বেশ ধারণা ছিল। উইকেন্ডের দুদিন আর একদিন বাড়তি যোগ করে মায়ানগর থেকে একশো নব্বই মাইল দূরের মফস্বল শহর পীরের মহল্লায় এসেছি আমি। কিন্তু সাত বছর আগের সেই পুরনো ধাঁচের বাড়িটি খুঁজতে এমন হোঁচট খেতে হবে কে জানত? শহরটির ভুতুড়ে পরিবর্তন হয়েছে এই আধা যুগে, না মেনে উপায় নেই।

বৃদ্ধের প্রশ্নের জবাবে কিছু বলবার আগেই আরো কিছু লোক চায়ের দোকানটিতে জড়ো হয়ে গেল। আমি এক আগন্তুক বসে আছি, আমাকে ঘিরে জনা দশেক মানুষ।
‘শেষ কবে এসেছেন এদিকে আপনি?’ প্রশ্নকর্তা আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে, মুখটা দেখা গেল না। তবু উত্তর করলাম, ‘বছর সাতেক আগে। কিন্তু কী বিষয় বলেন তো ভাই?’
চারপাশে একটা মৃদু শোরগোল উঠল। বিষয় আর কী.. শহর কি আর ছোট আছে.. নাকি সেই শহর আছে…
কিন্তু, ওই যে চাঅলা ভাই তো ঠিকই চিনেছিলেন। কী ভাই, চেনেন নাই?
আমার প্রশ্নে চাঅলা হতাশ দৃষ্টিতে দূরে কোথায় চেয়ে রইল। বৃদ্ধ লোকটির কণ্ঠ বেজে উঠল তখন রোদ পড়ে আসা ঘিঞ্জি শহরটির এই কোনে, ‘ও তো সবই চেনে। আপনাকেও চেনে। কী রে চিনিস না?’
চাঅলা বলল, ‘জ্বি। ইনি গল্প লেখেন। এনার স্ত্রীর আটমাসের পেট। কিন্তু এসবে লাভ নাই।’
‘মানে কী?’ অবাক হয়ে প্রশ্নটা নিজেকেই করলাম বিড়বিড় করে। আমি লেখক কিন্তু বিখ্যাত কেউ তো নই। মাসখানেক পর পদ্ম-র ডেলিভারি ডেট, এই তথ্যও নির্ভুল। ওর কথা মনে পড়তেই কীরকম অদৃশ্য ওজন চেপে বসল আমার কাঁধে। ব্যাখ্যা করা যায় না এমন এক আতঙ্ক টের পেলাম। কী করছে পদ্ম এখন? এমন বিকেলগুলো গল্পের বই পড়ে কাটাতেই ও ভালোবাসে। নধর উপান্তের লেখা ওই বইটা কি এখন পড়ছে ও? সেই যে এক লোক অনেক বছর শেষে নিজের গ্রামে ফিরে দেখল পুরো গ্রামটাই ফাঁকা। ঘরবাড়িগুলো জনশূন্য। ঘেসো জমির মাঝখান দিয়ে পায়েহাঁটা পথ। দড়িতে মেলে দেওয়া কাপড় উড়ছে। টিউবওয়েলের নিচে জমে আছে জল। কিন্তু প্রাণের চিহ্ন নেই কোথাও। কিছু আগেই যেন সবাই ছিল। হঠাৎ উধাও হয়েছে। তারপর…

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Aug/27/1566896425693.jpg

আমরা দুইটা কাম করবার পারি বাবাসাহেব। এক, আপনারে মায়ানগরের ফিরতি গাড়িতে উঠায়া দেওয়া, দুই…’—বৃদ্ধটির মুখে বাবাসাহেব সম্বোধন শুনে কিছুটা ধাতস্ত হওয়া গেল। কমে এলো আতঙ্কের ভার। অজানা জায়গায় অপরিচিত জনগণের কৌতূহলের কারণ হতে কার স্বস্তি লাগবে? আমি আরেক কাপ চায়ের কথা বললাম। ব্যাকপ্যাক থেকে একটা সিগারেট বের করে টংয়ের খুঁটিতে ঝুলন্ত গ্যাসলাইটারে সেটা ধরিয়ে দীর্ঘ একটা টান দিলাম। নিকোটিনের তিতকুটে আর কষটা স্বাদ মুখ হয়ে আমার কণ্ঠের দেয়ালে ঘাঁ মারল। খুশখুশে কাশি উঠে এলো প্রতিক্রিয়ায়।
বৃদ্ধ বললেন, মায়ানগর ফিরত যান আপনি। আমগো এলাকায় নঈম ডক্তর বইলা কেউ থাকে না।
জ্বি। আমি বুঝেছি চাচামিয়া।
বুঝলে তো ভালাই। এখন ছয়টা বাজে। ঠিক রাইত পৌনে নয়টায় এখ্যান ট্রেন নরসিংহ থেকে মায়ানগরে ফেরে। আমগো ইস্টিশন থিকা সেইটায় উঠবার পারবেন। সোজা চইলা যান। উইটিং রুমে বইসা অপেক্ষা নিবার পারেন। চাইলে একটু ঘুমায়াও নিলেন।

মিয়াভাই, আপনার পরিচয় তো খোলাসা হলোনা। নাম কি আপনার? ভিড়ের মাঝখান থেকে সুদর্শন এক যুবক জানতে চাইল হঠাৎ। বয়সে আমার ছোট হবে। এক ধরনের উপহাসই হয়তো খেলা করে উঠল ভিতরে, বিরূপ পরিবেশকে সামাল দেবার মেকানিজম কি বলা যায় ব্যাপারটাকে?
আমার নাম শিপলু। তবে ওই চাঅলা ভাই তো জানেন আমার পরিচয়। তার থেকে সব জেনে নেবেন আমি চলে যাওয়ার পর।
খুব একটা কাজ হয়েছে বলে মনে হলো না। যুবকটি কৌতূহলের সুরে প্রশ্ন ছুড়ল আবার, আপনি লেখেন। সাংবাদিক আপনি, ঠিক ধরেছি?
না রে ভাই।
আপনার ব্যাগে তাহলে কী? ক্যামেরা? আমাদের খুলে দেখাবেন?
কথাবার্তার এই পর্যায়ে বৃদ্ধটি সেই একইরকম কাঁপা কিন্তু মিহি কণ্ঠে ধমক লাগাল। ‘হইছে, থাম তো মুরশিদ। ইনি লোক ভালো, দেইখা বুঝোস না? সত্য কইতাছে।’

কোনো উপায় না দেখে হাত উঁচিয়ে একটা রিকশা ডাকলাম। লোকগুলো আমাকে ঘিরে রাখা বৃত্ত ভেঙে বেরোবার পথ করে দিল। মায়ানগরে ব্লকের পর ব্লক বহুতল দালানের গ্রাস চোখ সওয়া আমার কিন্তু এই ভুতুড়ে শহরটি কীরকম ঘিঞ্জি হয়ে উঠেছে উঁচু উঁচু দালানে, দৃষ্টি বাধা পাচ্ছে প্রতি মুহূর্তেই। ঘিয়ে, ছাইরঙা কিংবা সাদা বাড়িগুলো মাঝখানে সড়ক রেখে দু পাশে সীমানা দেয়াল তুলেছে। অধিকাংশই নতুন। ছোট ছোট জানালা, বারান্দা নেই, কংক্রিটের খাঁচা যেন। কিছু আবার আছে সুপরিসর, ঝুলন্ত বারান্দায় নারী পুরুষ কিংবা শিশু।

এভাবে কে চায় সেধে বিপদে পড়তে? খুব খারাপ কিছু ঘটতে পারে কখনোই ভাবিনি। আগেরবার পীরের মহল্লায় এসে বেশ তো লেগেছিল। তিনদিনের ছুটি রিপনদের বাসায় শুয়ে বসে আড্ডা মেরে কাটিয়ে দেওয়া চলবে, এই ছিল পরিকল্পনা। অনুমান ছিল, মায়ানগর থেকে এভাবে কাউকে না বলে ওর অকস্মাৎ অন্তর্ধানের কারণ বিয়ে। জানি না, হয়তো দীর্ঘদিনের প্রেমিকার সঙ্গে পরিণয় এগিয়ে এসেছিল তার। খুব রিজার্ভ ধরনের মানুষ রিপন। এত বছর একসঙ্গে কাজ করলাম, কত জায়গায় গিয়েছি একসঙ্গে আমরা। অথচ কোনোদিন নিজের একান্ত বিষয়ে মুখ খুলেছে তা হয়নি।

সে তুলনায় রিপনের আব্বা-আম্মাকে মনে হয়েছিল প্রাণখোলা। গাছপালার দারুণ শখ ছিল। তমালিকার বিয়েতে এসে দিন চারেক ছিলাম আমি। বোঝা চলছিল, একদম একলা হয়ে পড়বেন তারা। রিপন শহরে ফিরবে আমার সঙ্গে, তখন এ দুজনের কাটবে হাতছাড়া হওয়া দু সন্তানের স্মৃতিচারণ করে। নিঃসঙ্গতার প্রশ্নেই একদিন নঈম চাচা আমাকে বলেছিলেন, ‘বুঝলে শিপলু, ঘরের চেয়ে শক্তিশালী বন্ধু কিছু আর নেই। দেখো, মানুষ কেমন কাছের মানুষকে ছেড়ে চলে যায়, ঘর কিন্তু কখনো মানুষকে ছাড়ে না। সে আশ্রয়দাতা, সঙ্গী হিসেবেও চমৎকার। এই যে বনে-বাদাড়ে ভর্তি বাড়িটা দেখছো, আমার পরদাদার হাতে তৈরি। এতগুলো প্রজন্ম সে পার করল। এ বাড়ি কথা বলে, তা জানো তো?’ চাচি হেসে উঠেছিলেন, ‘ছেলেটার মাথা খারাপ করা আর কী! বাড়ি কথা বলবে কেন?’

কিন্তু এখন? খোঁজ তো দূর, যেনবা এই এলাকায় রিপন আর ওদের কথাবলা বাড়িটার অস্তিত্বই ছিল না কোনোদিন।

সন্ধ্যা নামল ধীরে ধীরে। দোকানপাটে জ্বলে উঠল লালচে বা শাদাটে বাল্ব। পীরের বাজার ছাড়িয়ে আরো অনেকটা দূরে রেল স্টেশন। রিকশার নিচে বাঁধা হারিকেন ঝাপসা আলো ফেলছে আধো-অন্ধকার পথের শরীরে। দু পাশে দালানগুলো কমে গিয়ে বেড়ে চলেছে গাছপালা আর খানাখন্দের সারি। হঠাৎ করেই যেন বা গিরিপথ ছেড়ে সমভূমির দিকে এগিয়ে চলেছি। আকাশের চেহারা এখন আর পরিষ্কার নয়, বেশ মেঘ জমেছে, বৃষ্টি আসলে বিপদে পড়ব। ছাতা কিংবা রেইনকোট, কোনো কিছু আনবার দরকার মনে করিনি রওনার আগে। অন্য সময় হলে এমন দৃশ্য আর পরিবেশ আমাকে আনন্দ দিত। মায়ানগরে এমন নিরালায় রিকশা ভ্রমণের উপায় তো আর নেই। শব্দে দূষণ, বাতাসে দূষণ, মানুষেও।

সোজা রাস্তাটা ডানে মোড় নিয়ে সম্ভবত স্টেশনের দিকে চলে গেছে। সেদিকটায় দাঁড়িয়ে একটা ছায়ামূর্তি হাত উঁচিয়ে কিছু ইশারা করছে। কাছাকাছি হতে দেখলাম, সেই সুদর্শন যুবকটি, কী নাম যেন? বিষণ্নতায় ভার হয়ে থাকা হৃদয়কেও একটা নিরুত্তাপ কৌতূহল দখল করে নিল মুহূর্তে। রিকশাঅলাকে বললাম, ‘ভাই, একটু সাইড করেন তো একপাশে।’

‘মিয়াভাই, আমাকে চিনেছেন? আমার নাম মুরশিদ। ভয় পেয়ে চম্পট দিচ্ছেন নাকি?’ অন্ধকারেও লোকটার সাদা দাঁত দেখে বোঝা গেল নিঃশব্দে হাসছে। এবার কিছু মুহূর্ত আগের কৌতূহল ছাপিয়ে হৃদয় দখল করল একটা ভয়ানক ক্রোধ।
ফাজলামো করার জায়গা পান না? রাজধানীতে ফিরে আপনাদের ছেড়ে দেব ভেবেছেন?
এই যে মিয়াভাই, রাগ করছেন দেখি। রাগের কিছু নেই। আবার ধরেন, আপনি বন্ধুর সন্ধান ভালোমতো না করেই পালিয়ে যাচ্ছেন…
আমি মোটেই পালিয়ে যাচ্ছি না।
বললেই কি মেনে নেব? কলিগের সন্ধানে এসে তাকে না পেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন না?
অনুমতির প্রয়োজন বোধ না করেই রিকশায় উঠে এলো মুরশিদ। আমুদে কণ্ঠে রিকশাঅলাকে বলল, ‘নেন দেখি ভাই। সামনে নেন আবার।’

হেলেদুলে রিকশা চলতে শুরু করল। মোরশেদ ছোটখাট স্বাস্থ্যবান মানুষ। কালো সুতি প্যান্টের ওপর নীল সাদার চেকচেক ফতুয়া পরেছে, অচেনা পারফিউমের সুবাস আসছে তার গা থেকে। ফাঁকে ফাঁকে জরদার ঘ্রাণও। সে যে পান খায় আগে খেয়াল করিনি। কিছুদূর চুপচাপ রিকশা এগিয়ে গেল, কাছাকাছি কোথাও থেমে থেমে ঝিঁঝিঁ ডাকছে। ফতুয়ার বুক পকেট থেকে এক খিলি পান বের করে মুখে পুরল সে।

দেখতেই তো পাচ্ছেন শহরটা বদলে গেছে কীরকম? সাত বছর আগে যেমন দেখেছেন, এতদিন পর আপনার জায়গায় অন্য কেউ হলেও অবাক মানত। একতলা বাড়ি পেয়েছেন একটাও? পাবেন না হাজার খুঁজলেও। সব ছয়তালা সাততালা দালান। নানান এলাকার মানুষে মাছির মতো ভনভন করছে। তবু ছোট শহরের এই সুবিধা। কিছুদিন গেলেই সবাই সবাইকে চিনে ফেলে।
আমার একটা কথার জবাব দেবেন দয়া করে?
কী কথা?
নঈম ডাক্তার বা রিপন নামটা কি সত্যিই এমন অপরিচিত? কী এমন হয়ে গেল এর মাঝে? একবারও আমার মনে হচ্ছে না যে ভুল এলাকায় এসে ওদের সন্ধান করছি।
না মিয়াভাই, অপরিচিত কেন হবে? সব ঘটনা সবার সামনে তো বলাও যায় না।
কী বলব তা ভেবে উঠবার আগেই আমাদের রিকশা থেমে গেল। কিন্তু রেল স্টেশন কোথায়? এদিকটা দেখছি শহরের পরিত্যক্ত অংশ। চারদিকে বাড়িঘর কিছুই নেই। একসময় ছিল তার প্রমাণ হিসেবে অসমতল ভিতগুলো রয়ে গেছে। বাজারটা কেউ গুঁড়িয়ে দেয়নি তবে ম্লান অন্ধকারে ছায়া ছায়া শাটারবিহীন দোকানের সারি, খাওয়ার হোটেলগুলোর সামনে উঁচু মাটির বিশাল চুলোতে ধ্বস নেমেছে। মুরশিদ বলল, ‘ওই পশ্চিমে সোজা হেঁটে যান, বাজারটা পার হলেই রাস্তার পাশে দেখবেন দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটা। ওইটাই খুঁজছেন আপনি। এগিয়ে যান।’

যুবকটির কথাবার্তা বোধের অগম্য হয়ে উঠেছে। তবু কিছু বলার চেয়ে মনে হলো নেমে যাই রিকশা থেকে। ব্যাকপ্যাকটা কোলের ওপর থেকে কাঁধে চড়িয়ে পশ্চিমে অস্থির পায়ে হাঁটা ধরলাম। ওই তো, নঈম ডাক্তারের বাড়ি ছাড়া ওটা আর কী?

হ্যাঁ, অবিকল সেই বাড়ি। গেটের দু পাশে নারিকেল গাছ দুটির মাথা বাতাসে নৃত্যরত। কিছু আগের গুমোটভাব কেটে গেছে। বাসার ছাদে এক ছোটখাটো মিনিয়েচার অরণ্যের মতো তৈরি হয়েছে টবে লাগানো গাছে, সেখানে জমাট বেঁধে আছে অন্ধকার। কিন্তু মানুষ কোথায়? আলো জ্বলছে না যে ভিতরে? কয়েকবার রিপনের নাম ধরে ডাকলাম। কোনো সাড়া এলো না। গেট পেরিয়ে ছোট্ট একটা উঠোনের মতো ছিল, এখন ঠিক উঠোনের কোন দিকটায় দাঁড়িয়ে আছি ঠাহর করা যাচ্ছে না। আঁধার বাড়ছে প্রতি মুহূর্তেই।

‘পেলেন কাউকে?’ মুরশিদের প্রশ্নে চমকে উঠলাম। নিঃশব্দে কখন পাশে দাঁড়িয়েছে।
না, কেউ তো সাড়া দিল না।
কেউ থাকলে নিশ্চয়ই দিত।
দেখেন ভাই, আপনাদের শহরে ঢুকবার পর থেকে কোনো কিছুই আমার মাথায় ঢুকছে না। খুলে বলবেন প্লিজ?
প্লিজের কিছু নেই আসলে। মাথায় ঢুকবে সব, ধীরে ধীরে।
মানে?
একটু আগেই আপনাকে জিজ্ঞেস করলাম না? আবার করি, গোটা পীরের মহল্লায় একতলা বাড়ি দেখেছেন কোনো?
ভুল বলছে না মুরশিদ। বারবার যে মনে হচ্ছিল শহরটা আগের মতো নেই, এই কি সেই বদলের কারণ?
কী ভাবেন? দেখেন নি তো? এখন এই যে নঈম ডক্তরদের ভিটায় দাঁড়িয়ে আছেন, গোটা শহরে এই একটাই বাড়ি যেটা একতলা। শহরের সমস্ত লোকজন ধীরে ধীরে ছেড়ে দিচ্ছিল তাদের পুরনো নিবাস। বহুতল ভবনের সংখ্যা যেমন বাড়ছিল শহরের নতুন অংশে, এর পক্ষে জনমতও। এমনকি যাদের অর্থ নেই, তারাও চাইছিল উঁচুতে উঠতে। দেখছেন না, শহরের এই দিকটা কীরকম পরিত্যক্ত হয়ে আছে? এ মহল্লাটা ধীরে ধীরে সমান করে দিয়েছে নগরভবনের বুলডোজার এসে। শুধু ওনারাই ছিলেন সবকিছুর বিপক্ষে। আপনার কলিগ আর তার বাবা-মা। এ বাড়িটা তাই রয়ে গেল। অবিকল। কেউ একটা টোকা পর্যন্ত দেয় নাই কোনো দেয়ালে।
বাড়ি রয়ে গেল। কিন্তু ওরা কোথায়? কী করেছেন আপনারা তাদের সঙ্গে?

আমরা একটা বিপ্লব শুরু করেছিলাম। সেই বিপ্লবের প্রথম প্রতিপক্ষ ছিল নঈম ডক্তরের পরিবার। সবাই এই পুরনো দিকটা ছেড়ে গেলেও তারা মাটি কামড়ে পড়ে রইল। একঘরে হয়ে গেলেও, দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আর তাদের অবিবাহিত পুত্র, মেয়েটার বসবাস তো বিদেশেই ছিল বিয়ের পর থেকে। তাদের আর বিশেষ প্রয়োজন কী সমাজের কাছে? কিন্তু আপনি তো অস্বীকার করবেন না যে, সমাজের সিদ্ধান্তে যারা নেই, সমাজে থাকবার কোনো দরকারও তাদের নেই।
নেই মানে? ওরা কোথায় এখন? আপনারা এই সামান্য কারণে তিনজন মানুষকে ভিটেছাড়া করেছেন?

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Aug/27/1566896478188.jpg

নাহ। আমরা কি ছোট লোক? ঠিক এক সপ্তাহ আগে টাউন হলে সভা হয়েছিল। ভোটাভুটি। পীরের মহল্লা হবে দেশের প্রথম বহুতল শহর। আমরা সেইটা থেকে মাত্র একধাপ দূরে ছিলাম। নগরপিতা বললেন, ‘নঈম ডক্তর যদি এখনো তার সিদ্ধান্ত থেকে না সরে আসে, তবে ভিন্ন উপায় আমাদের সামনে নেই। একজন মানুষ আমাদের বৃহৎ লক্ষ্যের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াবে তা হতে দেব না আমরা।’ পুলিশ কমিশনারের দিকে চেয়ে নগরপিতা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তাই কি দেওয়া উচিত?’ উঠতি বয়সের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক তরুণী তখন বলেছিল, ‘এমন ডিসিশান পুরো শহরটাকে বিপদের মুখে ফেলতে পারে। কেস-কামারি হবে, পত্রিকায় সংবাদ হবে, নানান আশঙ্কা। তার জবাবে নগরপিতা উত্তর দিয়েছিলেন, আহা, সে কী চমৎকার উত্তর, ‘এত বড় একটা বিপ্লব হতে যাচ্ছে, আর লোকে জানবে না? দরকার পড়লে লোকে আন্দোলন করবে দিন রাত। পায়ে হেঁটে লং মার্চে যাবে মায়ানগর অভিমুখে। অনশন চলবে সংসদের সামনে। একটা ব্রাইট ফিউচারের জন্য এমন সংগ্রাম কি নগরবাসি করবে না?’

অন্ধকার গাঢ় হবার আগেই আকাশ জুড়ে অজস্র নক্ষত্র ফুটে গেল। সেই নক্ষত্রের আলোর নিচে দাঁড়িয়ে মনে হলো, যে পৃথিবীতে আমি আছি এখন, একে ঠিক চিনি না। মুরশিদ আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘চলেন, আপনাকে ইস্টিশন পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।’
পায়ে হেঁটে পরিত্যক্ত বাজারটা পেরিয়ে এলাম। যেখানে রিকশাটা ছিল, অবিকল দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু রিকশাঅলা নেই। কী করব ভেবে পেলাম না কয়েক মুহূর্ত। মায়ানগর ফিরে কী বলব ম্যানেজমেন্টকে?

আমার চিন্তার সুতো কাটল অজস্র মানুষের পায়ের শব্দ। একদল লোক যেন মিছিল করে এদিকেই আসছে এগিয়ে। প্রায় সবার হাতে চার্জার লাইট। মিছিলের সামনের দিকে সেই বৃদ্ধটি। পাশে রুগ্ন আর অস্বাভাবিক লম্বা এক লোক। সাদা পাঞ্জাবী-পাজামা পরে থাকায় যাকে দীর্ঘ এক মৃতদেহ বলে ভ্রম হলো এক মুহূর্তের জন্য।

মিছিলটি আমার খুব কাছে এসেই থেমে গেল। যতজনের চোখের দিকে তাকাবার সুযোগ হলো, তাদের দৃষ্টিতে একধরনের চেপে রাখা বেদনা। বৃদ্ধটি অনুযোগ করে বললেন, ‘কাজটা তুই ঠিক করোস নাই রে মুরশিদ। বাবাসাহেবরে ইস্টিশনে পাঠায়া দিলেই ভালো করতি।’

বৃদ্ধের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অস্বাভাবিক দীর্ঘাঙ্গ লোকটিই কি নগরপিতা? শোনা যায় না প্রায় এমন খসখসে কণ্ঠে সে বলল, ‘আপনিই শিপলু? রিপনের বন্ধু?’
জ্বি।
শুনলাম রাজধানীতে ফেরত যাচ্ছেন?
হ্যাঁ যাচ্ছি।
কেমন দেখলেন আমাদের শহর?

কিছু বলবার মতো শব্দ খুঁজে পেলাম না আর। এলোমেলো হাওয়া দিচ্ছে। কোন এক অফুরন্ত ক্লান্তির ভাণ্ডার থেকে যেন পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে ঘুমের আরক। অবসন্ন হয়ে উঠল মন ও শরীর। লোকগুলোর হাতে চার্জার জ্বলছে। মেঘ ডাকছে আকাশে। হালকা বৃষ্টি ঝরতে শুরু করল। আম্মা এর নাম দিয়েছিলেন সুঁইসুঁই বৃষ্টি। কিছুক্ষণের এক অসহ্য নীরবতা শেষে লোকটা বলল, ‘মায়ানগর আর ফেরা হবে না আপনার। বহুতল বিপ্লবের একটা স্থায়ী স্মৃতিচিহ্ন রাখবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা। একটা স্মৃতির বাগান। তার দেখাশোনা করতে যোগ্য লোকও তো চাই আমাদের।’
‘মানে?’
নগরপিতার সেই অপরিবর্তনীয় খসখসে কণ্ঠ ঘোষণা করলো, ‘নঈম ডক্তরের বাড়িটাকে আমরা জাদুঘর হিসেবে সংরক্ষণ করব। আপনি হবেন এই জাদুঘরের কিউরেটর।

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;