কবি শহীদ কাদরী : প্রয়াণবার্ষিকীতে ভালোবাসা



মারুফ রায়হান
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

সৃষ্টিশীলের শারীরিক মৃত্যুর পর সব শেষ হয়ে যায় না, বরং বলতে পারি নবসূচনা ঘটে। তা না হলে বিতোভেনের সুর আজ শুনতাম না, পড়তাম না দস্তয়েভস্কির উপন্যাস। লিওনার্দো ভিঞ্চির ছবিও মুছে যেত। কবির ক্ষেত্রেও একই কথা জোর গলায় বলতে পারলে সুখী হতাম। কবি যা লেখেন তা খনির রত্নরাজি হতে পারে, কিন্তু চাপা পড়ে থাকে। খনন বা উত্তোলন করে সেই মহার্র্ঘের স্বাদ নিতে হয়। সেজন্যে চাই সমঝদার, পাকা জহুরি। বাংলাদেশে তার অভাববোধ আমরা প্রত্যক্ষ করছি কয়েক দশক হলো। এখন আরো বেশি মন্দ সময়। তবু খাঁটি কবিতা খাঁটি সোনার মতোই ঔজ্জ্বল্য ছড়াতে পারে।

কবিতার বিচার করবে মহাকাল—এমন একটা আপ্তবাক্য চালু রয়েছে বটে, যদিও আমরা মনে রাখি না স্বকাল যদি স্বীকৃতির যোগাড়যন্ত্র শুরু না করে, তবে মহাকালের সাধ্য কি মহাকবিকে শনাক্ত করবে! বাংলা সাহিত্যে এমন একজন কবিকেও দেখানো যাবে না যিনি তাঁর সমকালে না-গৃহীত থেকেছেন। এমনকি জীবনানন্দও।

তবে একথা ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখা চাই যে, কবির কবিতার মূল্য বুঝতে হলে তাঁর সময়কে বিবেচনায় নিতে হবে, যেমন পাঠ করতে হবে তাঁর সমকালের বা সমসময়ের সব প্রধান কবিদের। কবি যে ভাষা ও বাকভঙ্গিমায় লিখেছেন, যে ভূমিতে বসে লিখছেন সেইসবও এড়িয়ে যাওয়ার যুক্তি নেই।

শহীদ কাদরীকে নিয়ে কিছু বলবার আগে এই ভূমিকাটুকু দেওয়াটা সমীচীন বোধ করলাম। পশ্চিম বাংলা থেকে উপড়ে নিয়ে তাঁকে রোপণ করা হয়েছিল এই আশ্চর্য নগরী ঢাকায়। পরে তিনিই আবার গুডবাই জানান এই শহরকে; যান বিশ্বের আরো বড় বড় শহরে। কিন্তু সত্য আমরা অস্বীকার করে যেতে পারি না যে, ঢাকায় বসে মাত্র তিনখানা কাব্য যিনি লিখে মহাকালের দরোজায় কড়া নেড়ে গেছেন, সেই তিনিই আবার কবিতারহিত রয়েছেন দশকের পর দশক, বিদেশভূমে। শেষদিকে কুড়িয়ে কাড়িয়ে যে কটি কবিতা পেয়েছেন সেগুলো জড়ো করে বের করলেন সর্বশেষ কাব্য—“আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও”। যেখানে আমরা মিস করে যাই তাঁর যৌবনের, বলা ভালো স্বেচ্ছানির্বাসনে যাওয়ার আগে লেখা ওই তিন কাব্যের সুধা ও সমবৈশিষ্ট্যকে। প্রায় চারটি দশক তিনি ছিলেন মাতৃভূমি থেকে দূরে। এই প্রবাসযাপনকে অনেকেই ‘স্বেচ্ছা নির্বাসন’ বলে থাকেন। এক অর্থে তো এটি সত্যি। অন্য দেশে ডেরা খুঁজে ফেরা নয়, নিজের জায়গা থেকে দূরে সরে যাওয়া, প্রস্থান করা। এই ঢাকা শহর এবং কবিতামগ্ন সময় থেকে নিজেকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া। ১৯৭৮ সালে দেশত্যাগের সময় তিনি ছিলেন যৌবনের চূড়োয়, মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সী। ওই বছরই তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই’ প্রকাশিত হয়। প্রথমে যান বার্লিনে। সেখান থেকে চলে যান লন্ডনে। তারপর ফেরেন বস্টনে। কোথাও সেভাবে থিতু হননি। শেষমেশ আমেরিকারই আরেকটি রাজ্য নিউইয়র্কে বসবাস শুরু করেন।

শহীদ কাদরী ঠিকই বুঝেছিলেন একজন কবির মাতৃভূমি থেকে দূরে অবস্থান করা একটি অভিশাপ, এ অনেকটা আত্মহত্যার মতোই। আত্মহত্যা বলতে, কবিসত্তার হনন। কিন্তু তিনি দৃঢ়চেতা ছিলেন বলেই প্রবাসে থিতু হয়েও শেষ পর্যন্ত আবার কবিতা লিখতে শুরু করেন। জীবনের গোধূলিবেলায় এসে তারুণ্যের কবিপ্রতিভার নবায়ন ঘটানো আর কোনো কবির পক্ষে সম্ভবত সম্ভবপর হয়নি। প্রবাসে বসবাসকারী লেখকেরা স্বদেশে আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকেন। এক ধরনের পরোক্ষ সংযোগও থাকে। কিন্তু যুগের পর যুগ আক্ষরিক অর্থে নিজ দেশের মাটির গন্ধ নিচ্ছেন না, আলোবাতাস মাখছেন না এমন কবির পক্ষে পুনরায় কবিতার জগতে প্রত্যাবর্তন খুব সহজ নয়। অথচ শহীদ কাদরী পেরেছিলেন।

বাউন্ডুলেপনা, আড্ডাবাজ আর মশকরায় সেই পঞ্চাশের-ষাটের দশকে আর কোনো কবি ছিল না তাঁর মতো। সুরাপানেও অদ্বিতীয়। তাঁর মতো প্রাণখোলা অট্টহাসিও আর কোনো কবিকে হাসতে দেখা যেত না। তাঁর সমকালীন ও কিছুটা অনুজ কবিদের স্মৃতিচারণায় শহীদ কাদরী সমীহ জাগানিয়া কবিতার এক রাজকুমার। মৃত্যু এসে অমরত্ব দিতে পারে ক’জন কবিকে? কবি শহীদ কাদরী তাঁর যৌবনের তিনখানা কাব্য দিয়েই আবহমান বাংলা কবিতার পাঠককে বিশুদ্ধ আধুনিক কবিতাসুধা পান করিয়ে যাবেন—একটি দশকে এমন কবির দেখা খুব বেশি মেলে না। শহীদ কাদরীর যেসব কথোপকথনের ভিডিও দেখেছি, অনলাইন ও কাগজে পড়েছি তাতে শেষ পঞ্চাশ ও গোটা ষাটের দশকে তাঁর মনন তৈরি প্রসঙ্গে ধারণা পাওয়া যায়। বাংলা ভাষা ও ইউরোপের আধুনিক কবিতা যেমন তিনি নিবিষ্টচিত্তে পড়তেন, তেমনি পাঠ করতেন আধুনিক দর্শন ও বিজ্ঞান সম্পর্কিত গ্রন্থাবলি। ফলে কিছুটা বয়োজ্যেষ্ঠ সতীর্থদের মধ্যে তাঁর ছিল বিশেষ কদর। আর প্রথম থেকেই সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি কাব্যভাষা ছিল তাঁর অধিকারে, যে স্বকীয় স্বর প্রতিষ্ঠার জন্য একজন কবির দীর্ঘকাল নিবিষ্ট থাকতে হয়। আধুনিক শাহরিক মানুষের দ্বান্দ্বিক জীবনবোধ এবং সেইসঙ্গে অনন্য শিল্পবোধ ছন্দের ছাঁচে স্বচ্ছন্দভাবে উৎসারিত হতো তাঁর কলমে। কোথায় যেন তাঁর ছিল বিষাদগ্রস্ততা এবং একইসঙ্গে অনিকেত ভাবনা। (তৃতীয় কাব্য ‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই’-এর একটি কবিতায় পাচ্ছি : একটি মাছের অবসান ঘটে চিকন বটিতে,/ রাত্রির উঠোনে তার আঁশ জ্যোৎস্নার মতো/ হেলায়-ফেলায় পড়ে থাকে/ কোথাও কোনো ক্রন্দন তৈরি হয় না) সব মিলিয়ে এগার বছরের সময়পরিধিতে (১৯৬৭ থেকে ১৯৭৮) যে তিনটি কবিতাগ্রন্থ তিনি পাঠককে উপহার দেন সেগুলো সর্বকালের বাঙালি পাঠকের জন্যই যেন মহার্ঘ্য হয়ে উঠেছিল।

শহীদ কাদরীর প্রথম কাব্যের প্রথম কবিতা ‘বৃষ্টি, বৃষ্টি’, এটি তাঁর সিগনেচার পোয়েম। কোনো কবির আত্মপ্রকাশ এবং আত্মস্বর প্রচার-প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রথম কবিতাটি সবসময় বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে। এই কবিতায় পাই সম্পূর্ণত নগরের বৃষ্টি; এবং বৃষ্টি নিয়ে বাঙালির কবিতাপনার সম্পূর্ণ বিপরীত ছবি। প্রথম পঙ্ক্তির প্রথম বাক্যটি আগেকার বর্ষাবাদনের সব সুর মুছে দেয় যেন—‘সহসা সন্ত্রাস ছুঁলো।’ বর্ষার এসে পড়া প্রকাশ করতে গিয়ে ‘সন্ত্রাস’ শব্দের প্রয়োগ। একেবারে অভাবিত। এখানে বৃষ্টির জল জীবন্ত এক অস্তিত্ব যেন (কেবল করুণ ক’টা / বিমর্ষ স্মৃতির ভার নিয়ে সহর্ষে সদলবলে/ বয়ে চলে জল পৌরসমিতির মিছিলের মতো/ নর্দমার ফোয়ারার দিকে,—)। এই কবিতা নিয়ে যত বিশ্লেষণ পড়েছি সেগুলোর ভেতর আমেরিকায় বসবাসকারী কবি ওমর কায়সারের অভিমত বিশেষ লক্ষণীয়। তিনি লিখেছেন, ‘এই বৃষ্টির বিবরণ কোনো নারী, প্রকৃতি, প্রেমিকের বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল-এর অভিষেক নয়; নয় আবেগ, যে ‘কেঁদেও পাবে না তাকে’ বর্ষায়। এটি কেয়া-কেতকী তমাল-তরী-ধান দোলানো মিষ্টি বৃষ্টি নয়—এটি শহরের অলি-গলি-দালান, রাস্তা, সাইনবোর্ড অফিস-আদালত, যান, ব্যবসা, মহাজন-সাহেব, পৌর সমিতিকে তাড়িত করা বিহ্বল বর্ষা : ‘অবিরল করাত কলের চাকা, লক্ষ লেদ মেশিনের আর্ত অফুরন্ত আর্বতন—বিপন্ন বিদ্যুৎ মেঘ, জল, হাওয়া—ময়ূরের মত যার বর্ণালি চিৎকার, জল, জল, জল, তীব্র হিংস্র খল’। এই পৃথক সুর এবং ক্ষিপ্র বেগ কাদরী তাঁর নিজস্ব অক্ষর-বৃত্ত চালে ঝরিয়েছেন, যা বাংলা-পদ্যে-ধারাবাহিত ঝংকৃত ৮/৬ চাল নয় আবার জীবনানন্দের বিলম্বিত সুরও নয়। প্রথমেই ৮ মাত্রার শোঁ শোঁ : ‘সহসা সন্ত্রাস ছুঁলো’, তারপর যতি নিয়ে ১২ অথবা ২০ মাত্রা-র দৌড়। এই আনোখা বাঁটের চলনে কবিতার শ্রুতিকল্প বক্তব্যটিকেও স্বতন্ত্র ওজন দিয়েছে। ‘বৃষ্টিতে নাগরিক উপাদান সব ভেসে যাচ্ছে।’

এই কবিতাটিকে শহীদ কাদরী স্বয়ং কতটা গুরুত্ব দিতেন তা ওমর শামসেরই রেফারেন্স থেকে জানতে পারি। ২০০৫-এর দিকে, তাঁর এ কবিতা প্রসঙ্গে তিনি একদিন ফোনে বলেছিলেন, “এই হচ্ছে আমার ওয়েস্ট ল্যান্ড।” টি এস এলিয়টের ওয়েস্ট ল্যান্ড যাঁরা পড়েছেন তাঁরা শহীদ কাদরীর বক্তব্যের তাৎপর্য বুঝবেন।

নবযাত্রার শেষ বইটিতে কোমলগন্ধি লিরিকের সন্ধান পাব। অক্ষরবৃত্তের শক্তি আমরা দেখেছি কাদরীতে। এমনকি অন্ত্যমিল ও অন্তরমিলের জাদুও। চিত্রকল্পের চমৎকারিত্ব-ভরা তাঁর কবিত্বে মোহিত হয়েছি আমরা বহুবার। শেষের কবিতায় প্রবলভাবে তার দেখা না মিললেও বুঝতে অসুবিধে হয় না যে সেই অভিন্ন পরাক্রম কবির কলম থেকেই নিঃসৃত হয়েছে এইসব বুদ্ধিদীপ্ত সুসম্পাদিত পঙ্ক্তিমালা।

পুনশ্চ
আজ কবির তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে মনে পড়ছে তাঁর অন্তিম প্রত্যাগমনের ক্ষণটি। কী ভালোবাসায় দেশের কবি ও কবিতাপাঠকেরা অপেক্ষা করছিলেন তাঁর জন্যে। তাঁকে অন্তিম অভিবাদন জানাবার জন্যে। শহীদ মিনারে ঢল নেমেছিল। বাংলা মা তাঁর আঁচল বিছিয়ে রেখেছিল কবির জন্যে। একদিকে চলছিল প্রয়াণ-পরবর্তী আনুষ্ঠানিকতা; অন্যদিকে শোকগ্রস্ত শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ থেকে ফিরে নিভৃতে আমি তৈরি করছিলাম কবিকে নিয়ে টিভি অনুষ্ঠানের পাণ্ডুলিপি। ইতোমধ্যেই সংগৃহীত হয়েছে কিছু ব্যতিক্রমী ফুটেজ। ‘জন্মেই কুঁকড়ে গেছি মাতৃজরায়ণ থেকে নেমে’—কবিকণ্ঠে এই কবিতার আবৃত্তি, তাঁকে ঘিরে আড্ডার ফুটেজ ছাড়াও বেশ কিছু দুর্লভ আলোকচিত্র। ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’—এই কবিতায় সুরারোপ করে গেয়েছেন কবিরই প্রবাসকালীন বন্ধু এবং বাংলা গানের বাঁকবদলকারী গানওয়ালা সুমন। সেই গানটিও নেওয়া হয়ে গেছে পেনড্রাইভে। বিটিভিতে রেকর্ডিং শুরু হলো। কবিপত্নী নীরা শোনালেন কবির শেষতম কাব্যের জন্মইতিহাসসহ হৃদয়স্পর্শী স্মৃতিকথা। কবি বলেছিলেন, ১৯৯১ সালে প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশিত ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’ কবিতাটি না পেলে এই বই করা সম্ভব নয়। কবিতাটির খোঁজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হলো। ২০০৮ সালে সেটি উদ্ধার করা বাস্তবিকই কঠিন ছিল। ভাগ্যিস বাংলাদেশের একজন পাঠিকা সেসময় আমেরিকায় বেড়াতে গিয়েছিলেন এবং তাঁর নজরে পড়েছিল সেই বিজ্ঞাপন। তিনি দেশে ফিরে তাঁর সংগ্রহ থেকে কবিতাটি কপি করে নীরা কাদরীকে পাঠিয়েছিলেন। কবির প্রকাশক মফিদুল হক ও কবি রুবী রহমানের সঙ্গে শুরু হলো আমার আলাপচারিতা। সেখানে ওই দুজনের দুটি কথা খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল বলেই এখানে তার উল্লেখ করছি।

মফিদুল হক ১৯৬৭ সালকে আধুনিক বাংলা কবিতার তাৎপর্যর্পূণ কাল বলে চিহ্নিত করলেন। চট্টগ্রাম থেকে সেসময় চার আধুনিক কবির চারটি টাটকা কবিতাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল বিশেষ প্রকাশনা সৌকর্য নিয়ে। সেই চার কবির ভেতর শহীদ কাদরী তো ছিলেনই, ছিলেন শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ; এবং সৈয়দ আলী আহসান। মফিদুল হক বলছেন, পূর্ববাংলার আধুনিক বাংলা কবিতা সমস্বরে বেজে উঠেছিল ওই চার কাব্যে, যদিও তাঁদের মধ্যে কনিষ্ঠতম কবি শহীদ কাদরীর কবিতাই ছিল কারো দ্বারা প্রভাবিত নয়, একেবারে স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর। বিশ্বসভ্যতা ও বিশ্বনাগরিকতার মধ্যে বেজে উঠেছিল ঢাকা নগরীর নিজস্বতা। আর কবি রুবী রহমানের মতে সেই ষাটের দশকে বাংলা কবিতার নিয়ন্ত্রক শক্তির অন্যতম একজন ছিলেন শহীদ কাদরী।

কবি শহীদ কাদরী যখন প্রবাসে ছিলেন আমরা তাঁর জন্মদিন স্মরণে রাখিনি। তাঁর প্রয়াণের পর জন্ম ও প্রয়াণবার্ষিকীতে অন্তত স্মরণ করে তাঁকে ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা জানানোর প্রয়াসের ধারাবাহিকতা যেন রক্ষা করতে পারি—সেটিই পরম প্রত্যাশা।

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;