ছেলের নখ কাটতে কাটতে



শাহ ইয়াছিন বাহাদুর
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

ছেলের নখ কাটছিলাম। তখনই চোখে পড়ল ওর বাঁ পায়ের দুটো আঙুলের চামড়ায় ছোট ছোট কেমন দুটো দাগ! নেইলকাটার হাতে আমি গভীর আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠায় ওর আঙুলের দাগগুলো পরীক্ষা করতে থাকি আর মনে করতে থাকি, কবে কোথায় যেন এমন কিছু দাগ আগেও দেখেছি। সাত মাসের শিশুপুত্রের কুসুম-কোমল ও তুলতুলে দুটি পা আর পায়ের আঙুল। অথচ ছেলের আঙুলে স্পর্শ করলে চামড়ার আবরণটুকু হাতে বাজছে।

একটু আগে ওর মা ওকে গোসল করিয়ে, গায়ে লোশন মাখিয়ে, খাইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে, আমার হাতে নেইলকাটার ধরিয়ে দিয়ে নিজে গোসলে গেছে। যখন বাসায় থাকি, ছেলের নখ বড় দেখলে আমিই কেটে দিই। মাসে একবার ছুটিতে আসি বলে বলতে গেলে ছেলের পেছনে সময় দিতেই পারি না। লালনপালনের সব ধকল যায় ওর মায়ের ওপর দিয়ে। তবু ওর প্রতি ওর মায়ের সর্বস্ব করার পাশাপাশি আমার নখ কাটার কাজটাকে নিতান্ত সামান্য মনে হলেও যখনই পাই, এই সুযোগটুকু আমি গভীর আগ্রহের সাথে কাজে লাগাই।

ওর নখের ওপর চামড়া ওঠার লক্ষণটা আজই চোখে পড়ল এবং কেন পড়ল ও কোথায় দেখেছি ভাবনাটা যখন গভীর হচ্ছিল তখনই মনে পড়ল, আরে, আমার পায়েও তো ক’মাস আগে এমন দাগ ছিল। ডান পায়ের দুটো আঙুলে! আমার পায়ের দাগগুলো বেশ ভুগিয়েছে। প্রথম প্রথম চুলকাত খুব। এরপর চামড়া শক্ত হতে হতে একসময় একটু একটু করে উঠতে থাকল। ডাক্তার দেখালে জানতে পারলাম, এগজিমা। ছেলের আঙুলেও এমন কিছুর লক্ষণ না তো?

ছোট্ট শিশুপুত্রের আঙুলে কষ্টদায়ক ও বিশ্রী রোগটির কথা মনে হতেই মুহূর্তে একটা ভয়ের প্রেত আমার দিকে যেন ধাবিত হয়। মাথার ওপর ঘুরতে থাকা ফ্যানের বাতাস হঠাৎ অনেক বেশি শীতল মনে হয়। দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আসায় চারপাশ ঝাপসা লাগে। ওয়ালক্লথের ওপর পদ্মাসনে বসেছি বলে নিজের পা দেখতে পারছি না। এতেই আপাতত স্বস্তি। কিন্তু আমার পায়ের প্রায় মুছতে থাকা দাগটার সাথে শিশুপুত্রের পায়ের আঙুলের দাগগুলো যে করেই হোক মিলিয়ে দেখব, দেখতেই হবে, ঝাপসা দৃষ্টিতে এমনটা যত দ্রুত ভাবছি তত দ্রুত আমার চারপাশ যেন শ্লথ হয়ে আসে। দ্রুত ভাবার চেষ্টা করি, এগজিমা এমন কোনো কঠিন রোগ নয় যে কখনো সারবে না। আমারটা যেমন সেরে যাচ্ছে, পুত্রের হয়ে গেলেও একদিন তা সেরে যাবে, এটা নিশ্চিত। তাহলে এত ভয় কেন পাচ্ছি আমি?

ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। কী সুন্দর আর পবিত্র ওর ঘুমের ধরন, বুকের ওঠানামা!

সাত মাস আগে ক্লিনিকে ছেলে হবার সংবাদে অনেকেই জানতে চেয়েছে, ছেলে কার মতো দেখতে হয়েছে? মা না বাবা, কার মতো, আমি এর উত্তর তখন কাউকেই দিতে পারিনি। আসলে বুঝতেই পারিনি। ওর মুখটা এত নরম আর নিষ্পাপ ছিল যে, যতবার দেখেছি, একবারও ওকে আমি বা আমার স্ত্রীর মতো না ভেবে প্রতিবার ওর মতোই ভেবেছি। ভাবতে ভালো লেগেছে। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে দেখছি, কোথাও কোথাও আমি বা আমার স্ত্রীর অনেক কিছুর সাথেই ওর অনেক কিছু যেন কিভাবে কিভাবে মিলে যাচ্ছে। এবারই খেয়াল করলাম, ওর মুচকি হাসিটা ঠিক যেন আমারই মুচকি হাসি। পার্থক্য এটাই, আমি হাসির সময় ঠোঁটগুলোকে ডান গালের দিকে টেনে নিই আর ও টেনে নেয় বাম গালে। কিছুদিন আগে ওকে কোলে নিয়ে একবার চোখে চোখ রেখে মুচকি হাসতেই সেও হেসে ওঠে আর তখন ওর হাসি আমার ভেতরে প্রচণ্ড একটা নাড়া দেয়। মুহূর্তের জাদুতে ভীষণ চমকে উঠি। মনে হয়, প্রকাণ্ড ও স্বচ্ছ একটা আয়নার সামনে স্নান শেষে আমি নিজেই হেসে উঠেছি। তখনই মূলত ওর মুচকি হাসির সাথে আমার হাসির সামঞ্জস্যের ব্যাপারটা খেয়াল করি।

আমার মুচকি হাসিটা পরিচিত সবারই পছন্দের। অনেকের ঈর্ষারও কারণ। আর সে কারণেই চেহারা বা স্বাস্থ্যের সবকিছু ছাপিয়ে মুচকি হাসির সাথে শিশুপুত্রের এমন দারুণ মিল টের পেয়ে ভীষণ শিহরিত হই আর কী আশ্চর্য, তখনই নিজের মনকে আমার কানে বারবার জপ করতে শুনি, শোনো, তুমি তার পিতা, তুমি তার পিতা! স্বর্গ ছুঁয়ে আসা গভীর মায়া ও মমতার এক চাদর জড়ানো পিতৃত্ববোধ তখন আমার ভেতর ধীরে ধীরে প্রবলভাবে জাগতে থাকে। তার হাসির শব্দে আমার গভীরে পবিত্র হাজারও সংগীত বেজে ওঠে। তার প্রতিটি নড়াচড়ায় আমাকে কৈশোরের চাঞ্চল্যে পায়, শিহরিত হই। তার প্রতিটি কান্নায় ভয়ানক অস্থির হয়ে উঠি।

পুত্রের প্রতি শরীর ও মনের সাথে লেপ্টে থাকা মমত্ব ও পিতৃত্ববোধ থেকেই ভাবি, জন্মগতভাবে আমার সাথে আমার পুত্রের নানা মিল থাকাটাই তো স্বাভাবিক। মুচকি হাসির ব্যাপারটা আমার কাছে অধিক সুখের বলেই সম্ভবত, পুত্রের পায়ের আঙুলের দাগগুলো আমার পায়ের বিশ্রী দাগগুলোর মতো হতে পারে ভেবে অধিক দুঃখ পাবার আশঙ্কায় ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল আমার।

তার থেকেও বড় ভাবনা ও দুশ্চিন্তা আমায় পেয়ে বসে, যদি আমার কোঁকড়া চুলের সাথে ওর চুল মিলে যায়, যদি আমার মুচকি হাসির মতোই ও সারা জীবন হাসে, যদি আমার পায়ের দাগ ওর পায়েও এসে ঠাঁই নেয় তাহলে আমার কৃতকর্মের ভালো-মন্দও কি ওর জীবনকে একদিন ছুঁয়ে যাবে? যদি তাই হয় তবে সেও কি একটি বিড়ালহত্যার দায় নিয়ে বড় হবে? আমৃত্যু সশব্দ বিড়াল দেখে অনুশোচনায় ভুগবে?

বিড়ালহত্যার ঘটনাটা কি ভুলতে পেরেছি কখনো?

তখন গ্রামে থাকি। আমাদের আর ছোটচাচার ঘরের মাঝখানে ছিল এজমালি রান্নাঘর। রান্নাঘরে একটা গোলাপি ঠোঁটের সাদা বেড়াল সারাদিন ঘুরঘুর করত। বিড়ালটা ছিল ছোটচাচার। ছোটচাচা বিএডিসিতে চাকরি করতেন। বাড়ি আসতেন প্রতি মাসে দুবার। আর এসে সারাক্ষণ এই বিড়াল নিয়ে মেতে থাকতেন। বিড়াল কোলে নিয়ে খেতেন। ঘরের বাইরে যেতে বিড়াল পিছু নিলে মুখে চুচুচু শব্দ করে প্রশ্রয় দিয়ে দিয়ে বিড়ালটিকে তিনি তাঁর সঙ্গে নিয়ে যেতেন। গোসলের সময় পুকুরঘাটে বিড়ালটিকে তিনি কসকো সাবান দিয়ে গোসল করাতেন।

লক্ষ করতাম, ছোটচাচা যতদিন বাড়ি থাকতেন ততদিন বিড়ালটা রাজার হালে থাকত। মাঝে মাঝে অধিক আনন্দে মোচ নাড়িয়ে নাড়িয়ে বিচিত্র সব শব্দ করে গজরাত। অকারণেই বিছানার আশেপাশে এসে গড়াগড়ি দিত। ছোটচাচার উপস্থিতিতে বিড়ালটির রাজাগিরি দেখে আমরা হাসতাম। ক্ষেত্রবিশেষ আমরাও নানা অঙ্গভঙ্গি ও শব্দ করে ওকে গজরানোর উৎসাহ দিতাম। কিন্তু ছোটচাচার বিড়ালপ্রীতির বিপরীতে একজন মানুষ ছিলেন, যিনি আড়চোখে তাকিয়ে থাকতেন আর বিড়ালটিকে অসহ্য বলে তাড়িয়ে দিতে চাইতেন, তিনি আমাদের ছোটচাচী। ছোটচাচার বিড়ালটিকে যত পছন্দ ছোটচাচীর ছিল ঠিক তার বিপরীত কিন্তু অনেক দিন পরপর ছোটচাচা বাড়ি আসেন বলে, বিড়ালটিকে তিনি অনেক অনেক ভালোবাসেন বলে বা অন্য কী কারণে জানি না, ছোটচাচার উপস্থিতিতে ছোটচাচী প্রকাশ্যে বিড়ালটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেন না বা নিতে বলেন না।

কিন্তু একবার, তখন ছোটচাচা বাড়ি নেই, কিভাবে যেন আমার চার মাসের চাচাত বোন যে চৌকির ওপর ঘুমিয়েছিল তার পায়ে বিড়ালটি আঁচড় কেটে বসে। ছোটবোনটি চিৎকার দিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠলে ছোটচাচী দৌড়ে আসেন ও ওর পায়ে আঁচড়ের দাগ দেখতে পান। দেখতে পান আঁচড়ের স্থানে বিন্দু বিন্দু রক্ত উঁকি দিয়েছে আর ওমনিই ছোটচাচী তীব্র হুংকারে হাতের কাছের ঝাড়ু দিয়ে বিড়ালটিকে মারতে গেলে বিড়ালটি ছোটচাচীর উদ্দেশ্য বুঝে গিয়ে কৌশলে ধানের গোলার নিচে পালিয়ে যায়। ছোটচাচীর নির্দেশে সেদিন থেকে শুরু হয় বিড়াল তাড়াবার কাজ। আর সে কাজ এসে জোটে আমাদের ওপর।

আমরা বিপুল উৎসাহে বিড়াল তাড়াবার কাজে লেগে পড়লাম।

একবার বিড়ালটিকে ধরে পরীক্ষামূলকভাবে আমাদের দশ-বারোটি বাড়ি দূরে একজনের গোয়ালঘরে রেখে আসি। বাড়ি এসে বিরাট কিছু করে আসার ভঙ্গিতে ছোটচাচীকে যখন বিড়াল রেখে আসার কথা বলছিলাম তখন ছোটচাচী তর্জনীর ইশারায় চৌকির নিচে তাকাতে বললেন। চৌকির নিচে তাকিয়ে দেখি, বিড়ালটা দুপায়ের ওপর ভর দিয়ে মাথা সোজা করে বসে আছে। যেন কোথাও কিছু হয়নি এমন একটা আয়েশী ভাব। আমরা বাড়ি পৌঁছার আগেই সে কী করে বাড়ি ফিরে আসে! বিড়ালটির ফিরে আসায় তার স্মৃতিশক্তি ও দক্ষতা যত ফুটে ওঠে, ততই আমাদের ব্যর্থতার কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে আর ততই ক্রোধে আমরা লাল হয়ে উঠি। বারো-তেরোর আমরা ব্যর্থতা মানতে পারি না।

পরদিন বিড়ালটিকে বস্তায় ভরে পাশের গ্রামের সুনশান গোরস্তানে রেখে এলাম। কিন্তু কী আশ্চর্য, তার পরদিন দেখি, গোরস্তানে রেখে আসা বিড়াল ছোটচাচীর ঘরের সামনে এসে জোরে জোরে মিঞমিঞ ডাকছে। যেন কোথাও থেকে বেড়িয়ে এসে ভীষণ ক্ষুধার্ত, খেতে দিতে হবে। ছোটচাচী মুরগি তাড়াবার কোটা দিয়ে দৌড়ানি দেন। বিড়ালটি সে মুহূর্তে দৌড়ে পালালেও কিছুতেই বাড়ি ছাড়ল না। সেবার ছোটচাচা বাড়ি এলে ছোটচাচী আমার চার মাসের চাচাত বোনকে তাঁর কোলে দিয়ে বিড়ালের আঁচড়বৃত্তান্ত শোনান আর হাত দিয়ে বোনের দাগটাও দেখিয়ে দেন। এও বলেন, ‘এত্তগুলা রক্ত গেছে।’

বৃত্তান্ত শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হতাশ ছোটচাচা সিদ্ধান্ত দেন, ‘দাও, এটাকে তাড়িয়েই দাও।’

এর মধ্যে ছোটচাচার অনুপস্থিতিতে বিড়ালটি আরেকবার ছোটবোনকে আঁচড়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটায় এবং আঁচড়ের স্থানে রক্তের উপস্থিতি মেলে। ছোটচাচী একহাতে ছোটবোনকে কোলে নিয়ে মেয়ের কান্না থামাবার চেষ্টা করেন আরেক হাতে লাঠি নিয়ে প্রচণ্ড রাগ ও ক্রোধে প্রাণান্ত চেষ্টায় বিড়ালটিকে খুঁজে বের করে আঘাত করার অপেক্ষা করতে থাকেন। তিনি বিড়ালের নাগাল পান না।

তখন বর্ষাকাল। আমরা নৌকা বেয়ে বিরাট হাওর পার হয়ে তিন কিলোমিটার দূরের স্কুলে যাই। একদিন ছোটচাচী স্কুলে যাবার আগে চুপিচুপি আমাদের কাজ বুঝিয়ে দেন আর বলে দেন, আমরা কেউ যেন ছোটচাচার মতো কোনো মায়া দেখাতে না যাই। ছোটচাচীকে এবার চূড়ান্ত সফলতার ব্যাপারে আশ্বস্ত করে বিড়ালটাকে চটের বস্তায় ভরে আমরা রওয়ানা দিই। নৌকা চলতে থাকে। স্রোতের অনুকূলে কিছুক্ষণ নৌকা চালাবার পর আমাদের গ্রামটা যখন নিজেদের চোখে ছোট ও ঝাপসা হয়ে আসে আর যথেষ্ট দূরবর্তী মনে হয় ঠিক তখন আমরা বস্তাবন্দী বিড়ালটিকে স্রোতাল পানিতে ছেড়ে দিই। বিড়ালটি তখন আকস্মিক পড়া বিপদে জোরে জোরে মিঞমিঞ করতে থাকে আর বস্তার ভেসে থাকা অংশগুলো দ্রুত নাড়িয়ে নাড়িয়ে পানির নিচে নামাতে থাকে। পাটের বস্তায় বন্দী বিড়ালটি কিছুক্ষণ ভেসে থাকার চেষ্টা করলেও ধীরে ধীরে বিড়ালটির সাথে আমাদের দূরত্ব বাড়তে থাকে। আমরা কোনো মায়া না দেখিয়ে জোরে জোরে বৈঠা চালাতে থাকি। আর বিড়ালটির করুণ মিঞমিঞ ধীরে ধীরে আমাদের শ্রবণসীমা পার হয়ে যেতে থাকে।

বিড়ালটি আর ফিরে আসবে না আমরা এমন ধারণা করেছিলাম এবং তাই হয়েছিল। আমরা আর কখনোই বিড়ালটিকে দেখতে পাইনি। কিন্তু যেদিন আমরা বিড়ালটিকে হাওরের জলে ভাসিয়ে এলাম সেই রাতে আমি ভয়ানক একটা স্বপ্ন দেখি। দেখি, শিয়রের কাছে এসে বিড়ালটি আমার গাল চাটছে আর কাঁদতে কাঁদতে ডাকছে, ‘এই শোন, তোমার গায়ে এত রক্ত কেন?’ আমি বিড়ালের কথামতো নিজের দিকে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি, সাদা স্যান্ডু গেঞ্জি রক্তে ভিজে লাল হয়ে আছে। একলাফে আমি সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছি আর আমার হাতের দশটি নখ দিয়ে টপটপ করে মাটিতে তাজা রক্ত পড়ছে। রক্তের প্রতিটি ফোঁটার যেন প্রাণ আছে। ঝরছে আর কাতর স্বরে শব্দ করছে, মিঞ মিঞ।

স্বপ্ন দেখে চিৎকার করে ঘুম থেকে জেগে উঠলে কিছুক্ষণের মধ্যেই আম্মা দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, ‘কী হয়েছে বাবা?’ আমি কিছুই বলতে পারি না। কেবল কাঁপতে থাকি। বিরামহীন কাঁপুনিতে সে রাতে প্রচণ্ড জ্বর আসে আমার।

এরপর থেকে বহু বছর আমি যে কোনো বিড়ালের শব্দে কেঁপে উঠেছি। ছোটচাচার বিড়ালটি মেরে ফেলার দায়বোধ এখনো মন থেকে সরাতে পারিনি।

২.
আমার জন্ম গ্রামে হলেও আমার পুত্রের জন্ম শহরে এবং ও ওর মায়ের সঙ্গে শহরেই থাকে। কিন্তু শহরেও বিড়ালের উৎপাত আছে। প্রায়ই চোখে পড়ে। ভাবতে থাকি, আমার ছেলের জীবনেও কি এমন একটা বিড়ালের ঘটনা ঘটবে? অবশ্য নাও তো ঘটতে পারে। কিন্তু তবু আমার মুচকি হাসির সাথে ওর মুচকি হাসি মিলে যাওয়ায় পায়ের আঙুলের দাগের সাথে আমার পায়ের আঙুলের দাগ মিলে যাবার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েই যায়। আর যদি তাই হয় তবে একটা বিড়ালহত্যাই তো আমার জীবনের একমাত্র পাপ নয় যার জন্যে আমি সব সময় অনুশোচনায় ভুগি?

একহাতে শিশুপুত্রের পায়ের আঙুল আর অন্য হাতে নেইলকাটার নিয়ে তখন আমি গভীর ভাবনায় ডুবে যেতে থাকি। যে সকল ভাবনায় আমার নিষিদ্ধ কৃতকর্ম জড়িয়ে আছে। যেসব কৃতকর্মের সঙ্গে আমার গোপনতর অনৈতিকতা বা পাপ জড়িয়ে আছে। ওসবও কি আমার পুত্রকে স্পর্শ করবে?

ও মাবুদ, আমি দশ বছর বয়সে মসজিদ থেকে দু-দুবার পাঁচ টাকার নোট চুরি করেছি।
ও মাবুদ, পরীক্ষার হলে বিশ্বস্ত বন্ধুদের ইচ্ছাকৃতভাবে আমি ভুল উত্তর বলে দিয়েছি।
ও মাবুদ, সরকারি কোষাগার থেকে ব্যক্তিগত একাউন্টে আমি অর্থ পাচার করেছি।
ও মাবুদ, স্ত্রী ছাড়াও আমি আরো আটটা নারীর স্তনে হাত দিয়েছি, চুমু খেয়েছি।

এমন আরো আরো অজস্র পাপে ভরা আমার জীবন কি মুচকি হাসির মতো, পায়ের আঙুলের মতো, মাথার চুলের মতো, শোয়ার ভঙ্গির মতো আমার নিষ্পাপ শিশুপুত্রকেও কলুষিত করবে? পিতার পাপে সেও কি জড়িয়ে যাবে এসবে? ও মাবুদ!

বাথরুমের ছিটকিনি খোলার শব্দ হয়। আমার স্ত্রী বেরিয়ে আসে। ও আমাকে দেখে অবাক হয়, ‘ছেলের পা ধরে বসে আছো? নখ কাটা হয়নি এখনো?’

আমি পদ্মাসন ছেড়ে সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করতেই ডান পাটা সামনে বেরিয়ে আসে আর পায়ের দিকে চোখ যেতেই আতঙ্কে চুপসে যাই, আমার পায়ের দাগের সাথে পুত্রের পায়ের দাগ অবিকল মিলে গেছে! আমি হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করি। আমার কান্নার শব্দে ছেলে জেগে ওঠে। পলকের আকস্মিকতায় হতবাক স্ত্রী এসে ছেলেকে কোলে নিয়ে মহাবিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। গালে ঠান্ডা হাতে আদর করতে করতে বলে, ‘কী হয়েছে তোমার?’

আহারে, আমার স্ত্রী এমনই দরদ নিয়ে আমাকে প্রশ্ন করে যে, প্রশ্ন শুনে আমার কান্না আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ও তখন বাসায় থাকা আর কেউ যাতে আমার কান্না না দেখতে বা শুনতে পায় এজন্য দরজাটা আস্তে করে চাপিয়ে দেয়। এরপর ছেলেকে আমার কোলে নামিয়ে দিয়ে পিঠের কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে ও আমার কাঁধ স্পর্শ করে, ‘কী হয়েছে, আমায় বলবে?’
আমি কিছুটা শান্ত হওয়ার চেষ্টা করি, ‘একটা কথা বলব?’
ও হেসে ফেলে, ‘বলো না..।’

বাবার কান্না দেখেই মনে হয় ছেলে তার কান্না থামিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমার টি-শার্টের ফেব্রিক্স নিয়ে টানতে থাকে। আমি আমার স্ত্রীর দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকি, ‘বিয়ের রাতে একটা কথা বলেছিলে, মনে আছে?’
ও কপাল সোজা করে, ‘কোন কথাটা?’
‘ওই যে বলেছিলে, আমার এমন কোনো কথা আছে কিনা যা তোমার কাছে গোপন করেছি? যদি থেকে থাকে তবে এ রাতে স্বীকার করতে, করলে আমাকে তুমি ক্ষমা করে দেবে!’
ও ভ্রু নাড়ায়, ‘হ্যাঁ, তো?’
‘আমি আজ তোমাকে কিছু গোপন কথা বলব।’
‘বলো না।’
ওর চোখের দিকে আমি তাকাতে পারি না, ‘ছোটবেলায় আমি একটা বিড়াল মেরে ফেলেছিলাম।’

বিড়ালের কথা শুনে আমার স্ত্রী হো হো করে হেসে ওঠে। ওর হঠাৎ হাসি দেখে আমাদের ছেলে একবার হাসতে থাকা মায়ের দিকে আরেকবার ওর কাঁদোমুখো বাবার দিকে তাকায়।
‘একটা বিড়ালের জন্য এখন তুমি এভাবে কেঁদে উঠলে? একটা বিড়াল মেরেছো এই জন্য?’
‘শোন, আমি বিড়ালটাকে বস্তায় ভরে হাওরের জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলাম। আমার সাথে আমার চাচাত ভাইবোনেরাও ছিল।’
ও শুনে কথাটা উড়িয়ে দেয়, ‘এটা কোনো ব্যাপার হলো? ছেলেবেলায় মানুষ বুঝে না-বুঝে অনেক ভুলই করে। এর জন্য এখন এত ভাবছো কেন বলো তো?’
এবার আমি ওর চোখের দিকে তাকাই, ‘আমি বিড়ালটাকে প্রায়ই স্বপ্নে দেখি!’
ও তখন একটু কেঁপে ওঠে মনে হলো কিন্তু স্বীকার করে না, ‘এটা তোমার মনের দুর্বলতা। চলো, এখন খেতে চলো। বিড়ালের গল্প আরেকদিন শুনব।’
আমি থামি না, ‘আমি মসজিদ থেকে টাকা চুরি করেছি!’
খাট ছেড়ে ও উঠে দাঁড়ায়, ‘আজ কী হয়েছে তোমার, বলো তো?’
আমি ওঠার চেষ্টা করি না, ‘আমি কী বলি আগে শোনো…’
দাঁড় করাবার জন্য ও আমার একটা হাত ধরে টান দেয়, ‘বাদ দাও না প্লিজ। ছেলেবেলার ভুলভাল ছেলেবেলায় ফেলে এসেছো। এ বেলায় এসে এসব ভেবে কষ্ট পেয়ে তো লাভ নেই। খেতে চলো।’
‘আমি আমার বন্ধুদের ইচ্ছে করেই ঠকিয়েছি!’
‘আহ, আর নয় প্লিজ। থামো এবার।’
‘আমি আরো আরো অনেক ভুল করেছি, তোমাকে বলা দরকার।’

আমার স্ত্রী তখন খুব সহজভাবে এ প্রসঙ্গটা চাপা দেয়, ‘যে ভুলের কথা তুমি প্রথম রাতে বলতে পারোনি সে ভুলের কথা আমি আর কখনোই শুনতে চাই না। আমরা তো ভালো আছি। সেসবের চর্চা করে এখন আর কী লাভ? চলো তো, অনেক হয়েছে। এবার খেতে চলো। বাবুর ঘুম হয়নি। আবার ঘুম পাড়াতে হবে।’

আমার দৃষ্টি থেকে অসহায়ত্ব সরে না। স্ত্রীর চোখের দিকে একবার তাকাই, ও হাসিমুখে মাথা নাড়িয়ে আমাকে উঠে আসতে বলে। ছেলের দিকে তাকাতেই ছেলেও মুচকি হাসে। আহারে, কী মধুর আর মায়াময় সেই হাসি! আমি তখন ছেলেকে বুকের মধ্যে জোরে চেপে ধরি আর মনে মনে বলি, হে পরম করুণাময়, আমার পাপের জন্য ছেলেকে তুমি কষ্ট দিও না। আমার ছেলেকে তুমি রক্ষা করো। প্লিজ, রক্ষা করো।

   

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী আজ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ পঁচিশে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী। ১৮৬১ সালের (বঙ্গাব্দ ১২৬৮) এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই দিকপাল। তার বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মা সারদা সুন্দরী দেবী। তার পূর্বপুরুষেরা খুলনা জেলার রুপসা উপজেলার পিঠাভোগে বাস করতেন।

তিনি একাধারে কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী-গল্পকার। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তার প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশিত হয়। অসাধারণ সৃষ্টিশীল লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সমসাময়িক বিশ্বে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত ও পাঠ্য সূচিতে সংযোজিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

লেখালেখির পাশাপাশি বিশ্বকবি ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রাহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে কবিগুরু সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮৯১ সাল থেকে বাবার আদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পাবনা, নাটোরে ও উড়িষ্যায় জমিদারিগুলো তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিলাইদহে তিনি দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন। এখানে জমিদার বাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে সপরিবারে কবি বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন তিনি। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ (৭ আগস্ট ১৯৪১) কলকাতায় পৈত্রিক বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবী ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীতে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার দেওয়া বাণীতে বলেন, ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধের প্রধান পাথেয় ছিল মনুষ্যত্বের বিকাশ, মানবমুক্তি ও মানবপ্রেম। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য অঙ্গনের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার ও প্রবন্ধকার। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি।

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি গেয়েছেন মানবতার জয়গান। শুধু সাহিত্য সাধনা নয়, পূর্ববঙ্গের জমিদারি পরিচালনার পাশাপাশি দরিদ্র প্রজাসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি ও মানবিক বিকাশের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দেওয়া বাণীতে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক। তার হাতেই বাংলা কবিতা, গান, ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতি নাট্য, নৃত্য নাট্য পূর্ণতা পেয়েছে। বাংলা সাহিত্য স্থান করে নিয়েছে বিশ্বসভায়। তিনিই প্রথম বাঙালি কবি, যিনি এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রবীন্দ্রনাথ শান্তি ও মানবতার কবি। বিশ্বমানবতার সংকটে তিনি সবসময় গভীর উদ্বেগ বোধ করতেন। রবীন্দ্র দর্শনের প্রধান বিষয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বিশ্বমানবতাবোধ ও মানুষে মানুষে মিলন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা বিজ্ঞানভিত্তিক, যা আধুনিক শিক্ষায় অগ্রগামী হতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তার (রবীন্দ্রনাথের) রচনা আলোক শিখা হয়ে বাঙালিকে দেখিয়েছে মুক্তির পথ। বাঙালির সুখে-দুঃখে তার গান যেমন দিশা দিয়েছে, বাঙালির জাতীয় সংকটেও তার গান হয়ে উঠেছে একান্ত সহায়। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী বাঙালির চেতনা সঞ্চারী বিজয় মন্ত্র।

 

 

;