বিখ্যাত সৃষ্টিশীলদের অবসাদ ও স্যাটায়ার



দেবদুলাল মুন্না
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

গভীর অবসাদ থেকে স্যাটায়ারের সৃষ্টি হয়। অবসাদকে কানাডার পশ্চিম অন্টারিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. রড মার্টিন সৃষ্টিশীলতার যোগ্য অস্ত্র বলেছেন। ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে মার্টিন অবসাদ ও হাস্যরসের বিভিন্ন ধরন (আহ্বান পর্যায়) নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং প্রচুর তথ্য যোগাড় করেছেন প্রত্যেক মানুষের দৈনন্দিন জীবনে হাস্যরসের নানা ভূমিকা নিয়ে। মার্টিন চার ধরনের স্যাটায়ারের কথা জানিয়েছেন—১) অনুমোদনকারী : একটি “সামাজিক লুব্রিকেন্ট (তেল জাতীয় দ্রব্য)” হিসাবে হাস্যরসকে অন্তর্ভুক্ত করে, যেমন পার্টি ও অন্যান্য ব্যক্তিগত সমাবেশে পরিবেশের উন্নতি করা। (২) আত্ম-উন্নতি : যা অবসাদের সঙ্গে মোকাবেলা করার জন্য হাস্যরসের ওপর নির্ভর করে, এবং স্থিতিস্থাপকতা একটি ধরন। (৩) আক্রমণাত্মক : যার মধ্যে রয়েছে ব্যক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব বা অধিকারের অনুভূতি বজায় রাখার জন্য তিক্ততা এবং অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীল শব্দসমষ্টি ব্যবহার করা। (৪) আত্ম-পরাজয় : কৌতুকের আড়ালে নিজেকে ছোট করা, এবং যা কয়েক দশক ধরে কৌতুক নামে চলে আসছে।

সিগমুন্ড ফ্রয়েড তার গুরুত্বপূর্ণ বই ‘উইট অ্যান্ড ইটস রিলেশন টু দা আনকনশ্যাস’ বইয়ে বলছেন, “বেশিরভাগ সময় সৃষ্টিশীল মানুষ হাস্যরস ব্যবহার করেন পরোক্ষভাবে নিজেদের এমন অনুভূতি প্রকাশ করার জন্য যা অচেতন মন অন্যভাবে প্রকাশ করতে বাধা সৃষ্টি করে।” একটি ভালো উদাহরণ হলো ব্যঙ্গ, যার নির্ধারণ ফ্রয়েড সঠিকভাবে করেন প্রচ্ছন্ন বিদ্বেষরূপে। তাঁর মতে, “কৌতুক আমাদের চেপে রাখা অনুভূতিগুলিকে (যেমন অভিযোগ বা হিংসা) উপরে উঠে আসতে এবং ব্যাক্ত হতে সাহায্য করে—এর ফলে আমাদের আন্তরিক টানাপোড়েন কমে। আমরা সবাই এমন ব্যক্তিদের চিনি যারা অন্যদের হেয় করার জন্য বিদ্রূপ ব্যবহার করেন, নিজের অভিযোগের কথা সরাসরি না জানিয়ে। এবং সেসব কসমিক লোনলিনেস, জগতের সব রহস্য আবিষ্কার করা অবসাদগ্রস্ত মানুষদের ক্ষেত্রে বেশি ঘটে।” এ কিস্তিতে সৃষ্টিশীল কয়েকজনের সেন্স অব হিউমার ও অবসাদ নিয়ে কিছু বলব।

আরো পড়ুন ➥ মহান শিল্পীদের ক্ষত ও ভালোবাসাসমূহ

সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় একদিন বাজার করতে গেছেন। দোলা বাজারে। পরিচিত এক লোকের সাথে দেখা। তো, দুজনে মিলে ঘুরে ঘুরে সবজি কিনছেন। এক দোকানিকে সন্দীপন বললেন, শিমের বিচি কত করে?
সাথের পরিচিতজন আস্তে আস্তে সন্দীপনকে বললেন, “আপনি শিমের দানা বলতে পারতেন। বিচি বললেন? আপনি একজন সাহিত্যিক।”
সন্দীপন বললেন, “অণ্ডকোষ তো আর বলিনি।”
সেই লোক সন্দীপনের কাছে জানতে চাইলেন, “আপনি বাজারে অণ্ডকোষও বলতে পারবেন?”
সন্দীপন জবাব না দিয়ে হেসে বাজার করলেন। দুজনের বাসা পাশাপাশি। রোববার। ছুটির দিন। তাড়াহুড়ো নেই। ফেরার পথে বইপাড়া। সন্দীপন একটি বইয়ের দোকানে ঢুকলেন। সাথে ওই লোক। সন্দীপন বিক্রেতার কাছে জানতে চাইলেন, “আপনাদের কাছে অণ্ডকোষ হবে কি?”
বিক্রেতা একটা বই এগিয়ে দিলেন। সন্দীপন কিনলেন সেটি। বইয়ের ওপরে লেখা ‘অণ্ডকোষ’। পাশের লোকটি আগ্রহভরে বইটি একসময় হাতে নিয়ে দেখলেন, বইটি আসলেই অনু-রেণু বিষয়ে লেখা।

এই ঘটনাই প্রথমে বলার উদ্দেশ্য হলো—হাস্যরসের সৃষ্টিও হয় মেধা এবং মেধাহীনতার চিন্তাক্ষেত্রে যোগাযোগহীনতা হেতু। কথাটি বলেছিলেন রাশান লেখক লিও টলস্টয়।

একবার তিনি পেত্রোগাদে সেমিনারে বক্তৃতা করছিলেন। বক্তৃতায় সব প্রাণীর প্রতি অহিংস ও সহানুভূতিশীল হওয়ার কথা বলছিলেন এমন সময় একজন প্রশ্ন করেন, “বনের ভেতর একটা বাঘ যদি আমাকে আক্রমণ করে, কী করব বলুন তো?” টলস্টয় বলেছিলেন, “নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করুন। এমন ঘটনা জীবনে বারবার ঘটে না!” সেইজন ভাবল জীবন দেওয়ার কথা আর টলস্টয় বলেছিলেন নিজের সেরা অস্তিত্ব জানান দেওয়ার কথা।

সমাধিস্থলের চারদিকে দেয়ালের জন্য মার্ক টোয়েনের কাছে চাঁদা চাইতে গেলে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “সমাধিস্থলের চারদিকে দেয়াল দেওয়ার কোনো প্রয়োজন দেখি না। কারণ যারা ওখানে থাকে তাদের বাইরে বেরিয়ে আসার ক্ষমতা নেই। আর যারা বাইরে থাকেন তাদের ওখানে যাবার কোনো ইচ্ছে আছে বলে আমার মনে হয় না।” কোনটা দরকারি কোনটা অদরকারি এ নিয়ে মানুষভেদে তফাত অবশ্যই থাকবে। সেই তফাত দৃষ্টিভঙ্গির। উদাহরণ দিই। একবার বিখ্যাত নর্তকী ইসাডোনা ডানকান জর্জ বার্নার্ডশকে লিখলেন, “ভাবুন তো, আপনি আর আমি যদি একটা শিশুর জন্ম দিই, ব্যাপারটা কী চমৎকারই না হবে! সে পাবে আমার রূপ, আর আপনার মতো মেধা।”

আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ওরিয়ল নামের এক নারী নিজের ছেলেকে সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত করার জন্য একবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের কাছে গিয়ে বললেন, “এটা আমার দাবি, এ পদটা আমার ছেলের প্রাপ্য। আমার দাদা কেসিংটনে যুদ্ধ করেছেন, আমার চাচা ব্লাডেনসবার্গ যুদ্ধের মাঠ থেকে পালিয়ে যাননি, আমার দাদা নিউ অরলিয়ান্সে যুদ্ধ করেছেন আর আমার স্বামী তো মন্টেরিরি যুদ্ধে মারাই গেলেন।” ভদ্রমহিলার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনে লিংকন বললেন, “ম্যাডাম, আমার ধারণা আপনার পুরো পরিবার দেশের জন্য অনেক করেছে। দেশ এখন তাদের জন্য করবে। বিশেষ ভাতা পাবে। তবে এবার অন্যদের সেনাবাহিনীতে একটু সুযোগ দেওয়া উচিত।”

এখানে এসে একটা দাড়ি টানা হোক। ব্র্যাকেটে বলা দরকার, জগতের সবাইকে যদি আপনি শুধু বারবার হাসাতে যান তবে তারা আপনাকে জোকার বা ভাঁড় ভাববে, তাই কান্নার গল্পও সিরিয়াসলি শোনাতে হয়। তবে একটা ক্লাইমেক্স তৈরি হয়। কথাটি লেখক প্রেমেন্দ্র মিত্রের। ক্লাইমেক্স কী জিনিস? ঘটনাকে তুঙ্গে তোলা! লেখক প্রেমেন্দ্র মিত্র তখন চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করছেন। তার নতুন একটা ছবি মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু ওই ছবির কাহিনী নিয়ে কথা উঠেছে। বুদ্ধদেব গুহ পত্রিকায় বিবৃতি দিয়েছেন যে, কাহিনীটি তাঁর, প্রেমেন্দ্র মিত্র যা নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছেন। প্রেমেন্দ্র মিত্র কয়েকদিন বাসা থেকেই বের হলেন না। টানা ছয়দিন সিডেটিভ ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমিয়ে হজম করতে হলো এ অপমান। এদিকে সবাই উদগ্রীব, প্রেমেন্দ্র মিত্র কী বলেন! কিন্তু প্রেমেন্দ্র মিত্র কিছু বলছেন না। ক’দিন পর প্রেমেন্দ্র মিত্র বিবৃতি দিলেন। তিনি বললেন, “চলচ্চিত্রের কাহিনীটি আমার না সেটা সত্যি, তবে বুদ্ধদেব গুহ যেখান থেকে গল্পটি নিয়েছে, আমিও ওই একই জায়গা থেকে নিয়েছি।” গল্পটি ছিল জমেস জয়েসের ‘কার্নিভ্যাল’।

চার্লি চ্যাপলিন গ্রেট অভিনেতা ছিলেন। হাসতেন। হাসাতেন। এই হাসানোই ছিল তার রুজির পথ। কিন্তু জানেন কি, তিনি বৃষ্টি হলে রাস্তায় নেমে হাঁটতেন এবং সেসময় কাঁদতেন। তার কান্না কেউ দেখতে পেত না। বৃষ্টির ফোঁটা মনে করত। জওহরলাল নেহেরু ইন্দিরা গান্ধীকে চিঠিতে লিখেছিলেন, “তুমি কখনো তোমার কান্না কাউকে দেখাবে না। যদি কান্না পায় তাহলে বাথরুমে গিয়ে কান্না করবে।” কান্না দেখানোর জিনিস নয়। হাসিই দেখানোর। এমনই মনে করতেন খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা আলফ্রেড হিচকক। অথচ তিনি গভীর বিষাদে ভুগতেন। রাতে ঘুম হতো না। ছিলেন ইনসমনিয়ার রোগী। একসময় তার বউ ডোরা তাকে ছেড়ে চলে গেলেন। তখন এক সন্ধ্যায় তিনি বেলকনিতে বসে মদ খাচ্ছিলেন। দৃষ্টি ছিল আকাশের তারাপানে। পরে ওইদিনের ঘটনা লিখতে গিয়ে ‘অলমোস্ট হ্যাপিনেস’ বইতে লিখেছেন, “ডোরা চলে যাওয়ার পর আমি আবিষ্কার করলাম আমি এ জগতে সত্যিকার অর্থেই একা। কেউ নেই। তখন এক সন্ধ্যাবেলা আকাশের বিশালতা দেখে আমার মনে পড়ল, সবাই এ জগতে আসে। সবাই চলে যায় চিরকালীন। কেউ ফেরে না। এ সত্যটা হঠাৎ খুব গভীরে করোটিতে আমার ঢুকে গেল। এরপর থেকে অবসাদ কেটে যেতে লাগল। চারপাশে সবকিছুই তুচ্ছ মনে হতে লাগল। রসবোধের তৈরি হলো। একটা ঘটনা বলি। একবার পরিচিত এক ব্যক্তির দাওয়াত পেয়ে রাতের ভোজে যোগ দিলাম। সেখানে অনেক খাবারই ছিল। কিন্তু যে খাবারটি আমার সবচেয়ে প্রিয়, তা পরিমাণে খুব কম ছিল। কাজেই মনের ভেতর অতৃপ্তি নিয়ে খাওয়া শেষ করলাম। বিদায় নেওয়ার সময় আয়োজক আমাকে সৌজন্য দেখিয়ে বলেন, ‘আশা করি, শিগগিরই আবার আপনি আমাদের সঙ্গে খাবেন।’ আমি উনার তথাকথিত ভদ্রতায় রসিকতা করে ওই খাবারের কথা উল্লেখ করে বলি, ‘ওই খাবার থাকলে এখনই আবার খাওয়া শুরু করতে কোনো অসুবিধা নেই।”

খ্যাতিমান শিল্পী পাবলো পিকাসোর বাড়িতে একদিন এক অতিথি এলেন বেড়াতে। সারা বাড়ি ঘুরে তিনি ভীষণ অবাক। বাড়িতে অনেক কিছুই আছে, কিন্তু পিকাসোর কোনো চিত্রকর্ম নেই। এত বড় একজন শিল্পীর বাড়িতে তাঁর নিজের আঁকা ছবি থাকবে না, এ কেমন কথা! কৌতূহল দমাতে না পেরে তিনি পিকাসোকে জিজ্ঞেস করে বসলেন, ‘কী ব্যাপার, বাড়িতে আপনার আঁকা কোনো ছবি নেই কেন?’ পিকাসো দীর্ঘশ্বাস ফেলে জবাব দিলেন, ‘আমার এত টাকা কোথায় যে বাড়িতে পিকাসোর ছবি থাকবে? তাঁর ছবিগুলোর যে দাম।” আহা পিকাসো! কত অল্পদামে তিনি ছবিগুলো প্রথমদিকে বিক্রি করেছেন। রোজগার ভালো ছিল না বলে প্রথম স্ত্রী ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। পিকাসো এই শপ থেকে ওই শপে যেতেন আর পেইন্টিং কিনবেন কিনা জানতে চাইতেন।

অ্যাডগার অ্যালান পো’র ধরাবাঁধা চাকরি করতে মন চাইত না। গল্প লেখার নেশা। মাথায় ঘোরাফেরা করে সবসময় অসংখ্য চরিত্র। সেসব চরিত্ররা তাকে ঘোরগ্রস্ত রাখে সবসময়। কিন্তু বাস্তবতা আরেক রকম। তাকেও চাকরি করতে হতো। জীবনের কিছু সময় সামরিক বাহিনীতে ছিলেন। একবার পাবলিক প্যারেডে নির্দেশ এলো—সাদা বেল্ট আর গ্লাভস পরে আসতে হবে। পো ভাবলেন এই নির্দেশকে ব্যঙ্গ করা দরকার। যাতে তার চাকরিটা খারিজ হওয়ার একটা অজুহাত তৈরি হয়। তাই তিনি পরদিন আক্ষরিক অর্থেই দিগম্বর হয়ে পাবলিক প্যারেডে অংশগ্রহণের জন্য যান। গায়ে ছিল শুধু সাদা বেল্ট আর গ্লাভস!

অভাব ছিল প্যারীচাঁদ মিত্রের জীবনে। আর্থিক অনটন লেগেই থাকত। কিন্তু খুব ভোজন রসিক ছিলেন। একবার এলাকার অন্যতম ধনী দেবনারায়ণ দে’র বাড়িতে একটা বড়সড় অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছিল। লেখা হচ্ছিল দেনাপাওনা ও খরচাপাতির ফর্দ। সেখানে উপস্তিত ছিলেন রসিক লেখক প্যারীচাঁদ মিত্র। খরচের ফর্দ দেখে প্যারীচাঁদ মিত্র বললেন, “একি মিষ্টান্নের জন্য এত কম টাকা? ব্রাহ্মণকেও তো তেমন দেওয়া হচ্ছে না। এসব খরচ কিছু বাড়িয়ে দিন।”
দেবনারায়ণ বললেন, “প্যারীচাঁদ বাবু, আপনি শুধু খরচ বাড়াতে বলছেন। টাকাটা কে দেবে শুনি?” প্যারীচাঁদ মিত্রের তড়িৎ জবাব, “কেন, আপনি দেবেন। আপনার নামের আগে দে, নামের পরেও দে। দিতে আপনাকে হবেই।” সেবার প্যারীচাঁদের মিষ্টি খাওয়া হয়নি। কারণ তার কন্যা মালতী মিত্র প্রাইভেট টিউশনি শেষে বাড়ি ফেরার পথে রেপড হন এবং সুইসাইড করেন। সেই ঘটনার পর প্যারীচাঁদ বাসা থেকে মেয়ের লাশ মর্গে রেখে নিজের বাড়িতে টানা একমাস তেইশদিন ফিরতে পারেননি। কেননা, তিনি নিজ বাড়ির এড্রেস ভুলে গিয়েছিলেন। চিনতেন না। সাইকোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতেন। বিড়বিড় করে বলতেন, “মালতি”। বাকি আলাপ বারান্তরে।

   

গড়তে চান বই পড়ার অভ্যাস?



মোঃ শরীফুল ইসলাম, নিউজরুম এডিটর, বার্তা২৪.কম
বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতার বিকাশের জন্য বই পড়ুন

বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতার বিকাশের জন্য বই পড়ুন

  • Font increase
  • Font Decrease

লাইব্রেরিগুলো আজকাল ফাঁকা পড়ে থাকে। ক্যাম্পাসের আড্ডায় বই, সে বড়ই হাস্যকর! বই পড়ার মতো সময় হয়ে ওঠে না কারোরই! আমাদের বর্তমান সময়টা কেড়ে নিয়েছে মোবাইল আর ইন্টারনেট। অথচ বই পড়ার গুরুত্ব কমবেশ সকলেরই জানা।

মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য বই কতটা জরুরি সেটা আমাদের অজানা নয়। কিন্তু একটি বই পড়ার জন্য যে সময় প্রয়োজন, প্রয়োজন উপযুক্ত স্থান। সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো, সঠিক বই নির্বাচন।

বই পড়া শুরুর ক্ষেত্রে নতুন পাঠকরা নানান সমস্যার সম্মুখীন হন। এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে না পেরে অনেকের আর বই পড়াই হয় না। আজকের আলোচনায় আমরা জানব কীভাবে একটি বই পাঠ করা যায়, গড়ে তোলা যায় বই পড়ার অভ্যাস।

সময়: বই পড়ার কথা বললেই সবাই এক বাক্যে বলবে, ‘সময় নেই!’ সময় নিয়ে আমাদের অভিযোগের বড় কারণ হলো, নিজের কাজগুলো গুছিয়ে না করা। প্রতিদিন মাত্র ২০-৩০ মিনিট সময় দিয়েই কিন্তু গড়ে তোলা যায় বই পড়ার অভ্যাস। সময় না পাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হলো ইন্টারনেট আর সোশ্যাল মিডিয়া। তাই, সকাল কিংবা সন্ধ্যা হাতের ফোনটা দূরে সরিয়ে কিছুক্ষণের জন্য বসে যান বই নিয়ে।

পরিবেশ: উপযুক্ত পরিবেশ বই পড়ার মনোযোগ বাড়িয়ে দেয়। জানালার পাশে, বেলকনিতে কিংবা বাসার ছাদে বই পড়ার স্থানটি যেন হয় নির্জন এবং শান্ত। আজকাল বিভিন্ন পার্কে ‘নীরব বই পাঠ কর্মসূচি’ দেখা যায়। চাইলে যোগ দিতে পারেন তাঁদের দলেও। বই পড়ার পাশাপাশি পরিচয় হবে বইপ্রেমী মানুষদের সাথে।

বই নির্বাচন: বই পড়ার ক্ষেত্রে ইচ্ছে যেমন জরুরি তেমনি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সঠিক বই নির্বাচন। এক্ষেত্রে নিজের ভালো লাগাকে প্রাধান্য দিন। যেসব গল্প আপনাকে আকর্ষণ করে শুরুতে সেই বইগুলোকেই আপনার পাঠ্য তালিকায় রাখুন। 

পাঠাগার: পাঠাগারে গেলেই যে বই পড়তেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। বইয়ের সাথে সময় কাটালে এক সময় সেটা ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে হবে। আর ছুঁয়ে দেখতে গিয়ে কখন যে দু’য়েক পাতা পড়ে ফেলবেন, নিজেই টের পাবেন না! তাই বই পড়ার অভ্যাস গড়তে চলে যান পাঠাগারে। বই না পড়ুন, অন্তত সুন্দর সুন্দর ছবি তোলা তো হবে!

সোশ্যাল মিডিয়া: আমরা সবকিছুতেই সোশ্যাল মিডিয়াকে দায়ী করি। অথচ সোশ্যাল মিডিয়ার সুষ্ঠু ব্যবহার আপনার অভ্যাস গড়ার বড় সহায়ক। ফেসবুকে সাহিত্য তথা বই বিষয়ক বিভিন্ন গ্রুপ রয়েছে। যেখানে বিভিন্ন বই নিয়ে আলোচনা হয়, হয় বই বিষয়ক আড্ডাও। এসব গ্রুপে যুক্ত হয়ে বাড়াতে পারেন বইয়ের সাথে নিজের সম্পৃক্ততা।

ধারাবাহিকতা: বলা হয়ে থাকে টানা ২১ দিন কোনো কাজ করলে সেটা অভ্যাসে পরিণত হয়। বই পড়ার ক্ষেত্রেও তা ব্যতিক্রম নয়। অভ্যাস গড়তে হলে ধরে রাখতে হবে ধারাবাহিকতা। সামান্য হলেও প্রতিদিন পড়ুন। এই ধারাবাহিকতায় আপনার বই পড়াকে অভ্যাসে পরিণত করবে। 

বই পড়ার অভ্যাস রাতারাতি তৈরি হবে না। এজন্য প্রয়োজন ধৈর্য্য এবং অধ্যাবসায়। নতুন পাঠকদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, কিছুদূর পড়ার পর বইটি আর ভালো লাগে না। এক্ষেত্রে ধৈর্য্যহারা হওয়া যাবে। জোর করে সে বই পড়ার প্রয়োজন নেই।

বই মানুষের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়ায়। বই পড়ার অভ্যাস গড়তে পারলে জীবনে উন্নতি সাধন অবধারিত। একাডেমিক পড়ার বাইরেও বইয়ের বিশাল একটি জগত রয়েছে। সেই জগতে মানুষ জানার জন্য পড়ে, পড়ে জ্ঞান অর্জনের জন্য। বই পড়লে মানসিক চাপ হ্রাস পায়, হয় মস্তিস্কের ব্যায়াম, বাড়ে শব্দ ভান্ডার ও স্মৃতি শক্তি। বই পাঠকের চিন্তার জগতকে বিস্তৃত করে, বৃদ্ধি করে বিশ্লেষণ ক্ষমতা। বই পড়ার মাধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতার বিকাশ হয়। তাই বই হোক প্রত্যেক মানুষের উত্তম বন্ধু এবং বইয়ের সঙ্গে হোক আমাদের মিতালি।

;

মায়ের সমাধির খোঁজে



মহীবুল আজিজ
মায়ের সমাধির খোঁজে

মায়ের সমাধির খোঁজে

  • Font increase
  • Font Decrease

কন্ডাক্টরকে বললাম, এখানে নামিয়ে দিন,
এখানে এই মিয়াপাড়ায় আমি নামবো—
মিয়াপাড়া কবরস্থানে শুয়ে আছে আমার মা।
মায়ের কবর দেখতে এলাম আটান্ন বছর পরে,
জ্যাঠা বলেছিলেন, গেট দিয়ে ঢুকে ডানদিকে একটু গেলে
একটা গোলাপ গাছ ঘেঁষে কবরটা,
কবরের আগে আমাকে গোলাপ গাছ খুঁজতে হয়—
জ্যাঠা চলে গেছেন তা-ও বত্রিশ বছর।
ডানদিকে ঘুরতেই জড়িয়ে ধরে তাজা গোলাপের ঘ্রাণ,
পাশাপাশি চারটা কবর, চারটাতেই গোলাপের পাহারা;
এত কবর এত কবর, কবরে ভর্তি কবরস্থান—
কোথায় শেষ শয্যা নিয়েছিলেন আমার মা!
হাওয়ায় পাতা দোলে গোলাপের, চারটাই একসঙ্গে,
চারটা গাছ থেকেই মুখবাড়ানো গোলাপ ডাক দেয়—
এইখানে এইখানে এইখানে—কোন্খানে!
উবু হবো কবরের মাটি নিতে
কিন্তু চারটাই ডানদিকে, চারটাই গোলাপের পাশে,
প্রতিটি কবর থেকে একটি একটি মুঠো নিয়ে
পলিথিনের চারটে ব্যাগে রাখি।
একবার মনে হয় প্রথমটাতে,
তারপর মনে হয় দ্বিতীয়টাতে,
আবার মনে হয় তৃতীয়টাতে
এবং মনে হয় চতুর্থটাতে সন্ধান রয়েছে মায়ের।
মা সুপ্ত থেকে যান অনির্দিষ্ট মাটিতে ,
তবে কোন্ মানবের মাটি ধরে রাখি বুকের কাছে!
ঠিক তখন বিস্ময়ের মতন একটি ফুটন্ত গোলাপ
গাছ থেকে ঝরে পড়ে দ্বিতীয় কবরে,
সংশয়ী মন বলে, তবে কী গোলাপই বার্তাবহ মায়ের!
অদৃষ্টে অবিশ্বাসী মন দোলে সংশয়ে,
তখন আরেকটি গোলাপ ঝরে পড়ে চতুর্থ কবরে।
অর্থাৎ দুই যোগ দুইয়ে এসে আমার আর হিসেব মেলে না,
জ্যাঠা বলেছিলেন, কবরটা গেটের ডানদিকে ঘুরতেই
এবং গোলাপের পাশে।
বত্রিশ বছরে চতুর্গুণ হয়েছে গোলাপ
কিন্তু এক ও অবিভাজ্য আমার মা’কে
এই গোলাপের কারণেই খুঁজে পাই না আমি—
ফিরে আসি শুধু গোলাপের ঘ্রাণ নিয়ে।

১১-০৯-২০২৩

;

অর্ধেক রিয়েল, অর্ধেক ভুল



শরীফুল আলম
অর্ধেক রিয়েল, অর্ধেক ভুল

অর্ধেক রিয়েল, অর্ধেক ভুল

  • Font increase
  • Font Decrease

 

আমি সীজার হতে চাইনি
তবুও তুমি ক্লিওপেট্রাই থেকে গেলে
অহেতুক লড়াইয়ে তুমি জয়ী হতে চেয়েছিলে
সম্ভবত একেই পরিযায়ী প্রেম বলে
আলো আঁধারীর খেলা বলে
স্বপ্ন আর জেগে থাকা বলে ,
সমাপ্তি কিম্বা বিবিধ, তা সে যাই হউক
এই সহজ কথাটি
আমরা কেউ কাউকে সহজ ভাবে বলতে পারিনি
অথচ তুমি ফ্রিজিডেয়ারটি বন্ধ করে রাখলে
আর বললে, "নোটেড ",

নিউইয়র্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
হ্যাঁ, এটাই সত্যি
তুমি লৌহশৃংখলে অনুজ্জ্বল এক ডিমলাইট
সুচারু মোহের অভাবে তুমি প্রমত্তা নদী
বাবুই পাখীর বাসার ন্যায় তুমি ঝুলে থাক আমার স্বপ্নে
যা হতে পারতো নির্মল এক সবুজের প্রান্তর ।

তুমি ওঁত পেতে থাকা বাঁশপাতার ফাঁকে পূর্ণিমা
আমি তোলপাড় করে ছুটে চলা এক্সপ্রেস ট্রেন
দলছুট শালিক,
আজ কোন বৈভব নেই
ভালোবাসাবাসি নেই ,
কবিতাও ইদানিং প্রিয় লাগেনা
তবু স্নায়ুরা জেগে থাকে
মনে হয় হলুদ পাতায় যেন ক্লোরোফিল
আমিও প্রবণতায় ফিরে যাই সাইবেরিয়া ।

আনচান মনে কত আকুলতা
কালবৈশাখীর তান্ডব
যেন বাতাসে কাঁপন ধরে,
এসো সখা,
এই শ্রাবণে আবার রিডিজাইন করি,
স্যাটেলাইটে প্যারালাল বার্তা পাঠাই
ভুলে যাই অর্ধেক রিয়েল আর অর্ধেক ভুল
প্লাবনে অবাধ্য ঢেউয়ের উছ্বল ।

________________________________________

 ৯ সেপ্টেম্বর । ২০২৩।
নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।

 

;

পাট পাতার পেলকা সজনে শাকের শোলকা



প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

সোনালী আঁশ বা পাটের দেশ বাংলাদেশ। এক সময় আমাদের প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল পাট। পাটোয়ারী পরিবারগুলো তো বটেই মৌসুমি পাটের ব্যবসায়ীরাও সমাজে মযার্দা পেত। কারণ, যারা পাটের ব্যবসা করতেন তাদের হাতে থাকতো প্রচুর টাকা। তখন পাটকলে যারা চাকরি করতেন তাদের পরিবারেরও অনেক সচ্ছলতা ছিল। নাইলন ও পলিথিনের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হলে পাটের গুরুত্ব কমে যেতে শুরু করে। পাটের চট, রশি, শাড়ি আজকাল কেউ ব্যবহার করতে চায় না। দেশের বন্ধ হয়ে যাওয়া পাটকলগুলোর বড় বড় যন্ত্রপাতি মরিচা ধরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তবে প্রতি বছর গ্রীষ্মের শুরুতে পাট শাকের চাহিদা বেড়ে যায়।

কারণ, পাট পাতার বহুবিধ গুণ। পাট শাক তেতো ও মিষ্টি দুটোই সমভাবে মানুষের কাছে প্রিয়। পাট শাক দিয়ে তৈরি এক ধরণের জনপ্রিয় খাবারের নাম ‘পেলকা’। এই পেলকা ভাজা চালের গুঁড়ো, খাবার সোডা, কাঁঠালবিচি, গোটা রসুন ও কাঁচা মরিচ দিয়ে মিশিয়ে তৈরি করে সাদা ভাতের সাথে পরিবেশন করা হয়ে থাকে। এই রান্নায় নানা ধরণের মশলা ব্যবহার করা হয়। যেগুলো বেশিরভাগ ঘরে তৈরি ভাজা উপকরণের ঢেঁকিছাটা সুগন্ধি গুঁড়ো বা শিলপাটায় পেষানো মিহি মশলা। সাধারণত: পেলকা ও শোলকা রান্নার আগে সরিষা, মেথি, ধনে, মৌরি, কালোজিরা ইত্যাদি ভেজে এই বিশেষ মশলা তৈরি করা হয়। সবকিছুর সংমিশ্রণে ভারী স্যুপের মতো করে সবুজ রংঙের এই রান্না সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। যার ফলে পেলকার স্বাদ হয় খুবই অনন্য ও লোভনীয়।

অনেকে পাটের মৌসুমে পেলকা খাওয়ার লোভে শহর থেকে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে এই বিশেষ রান্নার আয়োজন করতে বায়না ধরে থাকেন। অনেকে পাট শাকের শুকতানি তৈরি করে শুকিয়ে সারা বছরের ভেষজ খাবার হিসেবে যত্ন সহকারে ঘরে সংরক্ষণ করেন। গ্রামের অনেকের কাছে পাট শাকের শুকতানি ভেজা পানি নানা রোগের মহাষৌধ হিসেবে বিবেচিত। অধুনা শহরের বহুতল ছাদ বাগানে পাট শাকের আবাদ করতে দেখা যাচ্ছে।

আরেকটি বিশেষ খাবারের নাম শোলকা। যেটি কচি সজনে পাতা দিয়ে তৈরি কর হয়। পাট শাকের তৈরি পেলকা মৌসুমি রান্না। কিন্তু সজনে পাতার তৈরি শোলকা সারা বছরব্যাপী রান্না করে খাওয়া যায়। বিশেষ করে বারোমাসী সজনে গাছ বাড়িতে থাকলে তো কোন কথাই নেই।

তবে কালের স্রোতে সৌখিন এসব খাবার হারিয়ে যেতে বসেছে। ব্যস্ত কর্মজীবি মানুষ আজকাল সামনে যা পায় তাই ঝট্পট খেয়ে নিতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। পেলকা ও শোলকা রান্নার মতো সময় ও ধৈর্য্যধারণ করার ক্ষমতা আজকাল গ্রামীণ গৃহবধূদেরও নেই। বাজার থেকে পাট শাক কিনে কোন শহুরে পরিবারে রান্না হলে বাচ্চারা সেটা তিতা বলে খেতে চায় না। কিন্তু বিদেশি তিতো চকোলেটযুক্ত দামি চকোপাই বা আইসক্রীম তাদের কাছে খুবই প্রিয়।

এভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে পাট পাতা ও সজনে পাতা দিয়ে তৈরি জনপ্রিয় খাবার দুটো। কিন্তু অবাধ ইন্টারনেটের এই যুগে আবারো পাট ও সজনে পাতা দিয়ে তৈরি বিশেষ খাবার নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়েছে। কচি পাট পাতা দিয়ে তৈরি হচ্ছে শক্তিবর্ধক ভেষজ ওষুধ ও টনিক। আর সজনে পাতা ‘সুপার ফুডের’ তালিকায় নিজের নাম লিখিয়ে সারা বিশ্বে আলোড়ন তৈরি করে ফেলেছে।

একজন জাপানিজ গবেষক আফ্রিকা থেকে সজনে পাতা এনে গবেষণা করে এই মিরাক্কেল শাক থেকে ‘মরিঙ্গা পাউডার’ তৈরি করে এর বহুবিধ গুণ প্রচার করেছিলেন। সজনে গাছকে তিনি অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য উদ্ভিদ হিসেবে জানতেন। কিন্তু বাংলাদেশে ‘ড্রামস্টিক ট্রি’বা সজনে গাছ এত সহজলভ্য এবং এতটাই সুপরিচিত যে তিনি সেটা জানতে পেরে ভীষণ অবাক হয়েছিলেন। সজনে পাতা নামক ‘সুপার ফুডের’প্রতি আমাদের দেশের মানুষের অজ্ঞতা ও অবহেলা তাকে খুবই বিস্মিত করে তুলেছিল।

সজনে পাতা নামক ‘সুপার ফুডের’ প্রচার ও এর চাহিদার দিকে লক্ষ্য করে আজকাল সজনে বাগান তৈরির হিড়িক পড়ে গেছে। সজনে বাগান কেন্দ্রিক কারখানা গড়ে উঠেছে। সেসব কারখনায় মহিলা শ্রমিক সহ অনেকের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে সজনে পাতার পাউডার—এর ব্যাপক গুণকীর্তন চালু থাকায় বাজারে এর চাহিদা বেড়ে গেছে বহুগুণ।

প্রচারে প্রসার—এই তত্ত্ব যেন সজনে পাতাকে আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। সাইবার জগতের এই বিরাট সাড়া আমাদের সমাজের সাধারণ মানুষের মধ্যে তেমন কোন জাগরণ তৈরি করেছে কবলে মনে হচ্ছে না। আগেকার দিনে পাট পাতা ও সজনে পাতা দিয়ে নানাব্যঞ্জন রান্না করা হতো। পরিবারের সদস্যরা সেগুলো মজা করে খেতেন। তাই তখন এত রোগ—বালাই হতো না। এটি মূলত: একটি সাধারণ প্রচলণ অথচ গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ।

আজকাল মানুষ কৃত্রিম খাবারের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। বিভিন্ন ক্ষতিকর কেমিক্যাল ও বাহারি রং মেশানো খাবার পাতে না হলে আধুনিক মানুষের মন ভরে না। আধুনিক মশলার মধ্যে আসলে কি কি উপাদান মিশ্রিত রয়েছে তা যাচাই করা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। ভেজালের এই যুগে বিএসটিআই—এর প্রতীক লাগানো কতকিছুই হরদম জব্দ করে জরিমানা করা হচ্ছে।

অন্যদিকে উন্নয়নের অতিপ্রচার দেখে বিদেশিরা বাংলাদেশের দিকে ঘন ঘন তাকানো শুরু করেছে। তবে ঋণ ও ক্ষমতা লাভের জন্য তাদের দিকে আমরা আরো বেশি করে তাকিয়ে থাকি। এই পরনির্ভরশীলতা আমাদেরকে আরো বেশি পঙ্গু করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এবছর দেশের একদিকে দারুণ খরা, অন্যদিকে হঠাৎ বন্যা শুরু হয়েছে। কেউ বষার্কালে গভীর নলকূপের পানিতে সেচ দিয়ে রোপা আমন ধানের চারা লাগাচ্ছে আবার কারো বীজতলা তলিয়ে গেছে ঢলের পানিতে। এরই মাঝে এডিস মশা দেশের সব জেলায় সংক্রমণ ছড়িয়ে দেয়ায় সেপ্টেম্বর ০৫, ২০২৩ পর্যন্ত রেকর্ড সংখ্যাক ৬৫৭ জন মারা গেছেন। মফস্বলের হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসার সুযোগ না পেয়ে জীবন বাঁচাতে হন্যে হয়ে ছুটে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকার দিকে।

ঢাকায় গিয়ে হাসপাতালের বেডে জায়গা না পেয়ে মেঝে, বারান্দায়, ওয়েটিং রুমে মাদুর পেতে রোগী নিয়ে শুয়ে আছেন। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে যখন কোন জটিল রোগীর জন্য জরুরি ভিত্তিতে রক্তের প্রয়োজন তখন। মফস্বল থেকে আসা অধিকাংশ রোগীর আত্মীয়—স্বজন রক্ত দেয়ার ব্যাপারে সজাগ নন। রক্ত দেয়ার কথা শুনলেই তারা অনেকে আঁৎকে উঠেন। কেউ কেউ কান্নাকাটি শুরু করে দেন। এছাড়া বাইরে থেকে রক্ত সংগ্রহ, খরচ বহন ইত্যাদির জন্য তারা মোটেও প্রস্তুত নন।

এরই মাঝে রাজপথের একটি লেনে একটি বিরোধী রাজনৈতিক দলের মিছিলের লম্বা লাইন যখন ৪—৫ মাইল লম্বা হচ্ছে তখন পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি নিয়ে সরকারি দলও অপর দিকের বাকি লেনটি দখল করে মিছিল শুরু করে দিচ্ছে। ডেঙ্গুর হটস্পট রাজধানী ঢাকায় সারা দেশ থেকে ভাড়ায় মানুষ ডেকে এনে সম্মেলন ও মিছিল করাচ্ছে সরকারি দলও! এর ফলে প্রতিটি জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে ভয়াবহ ডেঙ্গু।

অন্যদিকে দেশে কেউ যেন কিছকেইু ঠিকমতো পাত্তা দিতে চাচ্ছে না। স্থানীয় জনগণের উপলব্ধিকে পাত্তা না দেয়া আমাদের দেশজ উন্নয়ন অবনমনের প্রধান কারণ বা অন্তরায় হিসেবে আবিভূর্ত হয়েছে। এদেশে কেউ তার নিজের দোষ সহজে স্বীকার করতে অভ্যস্ত নয়। তাই মিথ্যা-জালিয়াতির বেসাতিতে বিপদ বেড়েই চলেছে চারদিকে। সেজন্য অতিদ্রুত পারস্পরিক দোষারোপ ও পরনির্ভরশীলতা পরিহার করে দেশজ তথ্য-উপাত্ত ভিত্তিক গবেষণা করে, দেশজ সম্পদ রক্ষা করতে হবে।

আমরা যখন ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞা মেনে ঘুমিয়ে থাকি তখন অন্যেরা এসে ধরে উজাড় করে দেয়। আমরা যখন জাল ফেলি তখন নদী মাছশূন্য। বিদেশি লুটেরাদের হাতে উজাড় হচ্ছে জাতীয় মৎস্য সম্পদ। ইলিশ মাছের শুধু এক ভিডিও সব ইউটিউবারদের ‘তুমি সুড়ংঙ্গে’ ছড়াছড়ি। অথচ ইলিশের এই ভরা মৌসুমে কাঁচাবাজার ইলিশ শূন্য। বাড়ছে অবৈধ রোহিঙ্গা অভিবাসীদের ফুলে ফেঁপে উঠা সংখ্যার মতো বিষফোঁড়া। মিয়ানমার থেকে পাচার হয়ে ইয়াবা আসা বন্ধ হলে শুধু কক্সবাজার জেলাতেই দশ হাজার মানুষ বেকার হয়ে যাবে বলে ভাষ্য দেন কোন বিচারক!

খুব দ্রুত আধুনিক হবার জন্য শোলকা পেলকার মতো দেশজ খাবার ত্যাগ করে যখন দুর্বল শরীর নিয়ে কালাতিপাত করছি ঠিক তখন জাপানিজ গবেষকের উদ্ভাবিত সজনে পাতার পাউডার আমাদেরকে নবজীবন দান করতে পারবে বলে সেই আশায় সেদিকে হন্যে হয়ে দৌড়াচ্ছি। তবে শোলকা—পেলকার মতো দেশজ খাবার গ্রহণ করে মেরুদণ্ড সোজা করে চলতে শুরু না করলে বৈশ্বিক উজানের হঠাৎ ঢল এসে সাতকানিয়ার নতুন রেললাইন বাঁকা করে দেয়ার মতো ঘটনা আরো ঘন ঘন জেঁকে বসতে থাকবে বৈ—কি?

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

 

;