তমসা শেষে



ফাহমিদা বারী
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

সুরমার ছেলে বাবর দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে ছুটে এসে খবর দিল, “ও মা, তোমার বাপজানের নাকি মেলা অসুখ! আর নাকি বাঁচব না। তোমারে ডাইকা পাঠাইছে। বাপজান কইলো তোমারে গিয়া শিগগির খবর দিতে।” সুরমা ছেলের কথা শুনে অনেকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারল না। তার ধাতস্থ হয়ে নিতে সময় লাগছে। যা শুনল ঠিক শুনল কি না! তার বাবা তাকে ডেকে পাঠিয়েছে? এটা কিভাবে সম্ভব!

শীতের সকালের মিষ্টি রোদটা সবেমাত্র জমে এসেছে। সুরমা একগাদা থালাবাসন পাশের পুকুর পাড় থেকে ধুয়ে নিয়ে এসেছে। গতকাল রাতের বাসি থালাবাসনের সাথে সকালেরগুলো একসাথে জমিয়ে তারপরে সে পুকুর পাড়ে যায়। এই নিয়ে স্বামী হারেজ আলী প্রতিদিনই তার সাথে খ্যাঁচখ্যাঁচ করে। “বলি, তুমি কেমন গো! রাইতেরটা রাইতে ধুইবার পারো না? সারারাত আঁইটা থালাবাসন ঘরের মইধ্যে পইড়া থাকে।”

সুরমার নিজেরও পরিষ্কারের বাতিক আছে। দিনমান সে ছোটাছুটি করে ঘরদোর ঝকঝকে তকতকে করে রাখে। কিন্তু রাতের বেলায় পুকুরপাড়ে গিয়ে থালাবাসন ধোওয়া তার পক্ষে অসম্ভব। তার ভূতের ভয় আছে। বলা তো যায় না, ‘উনারা’ কোথায় কিভাবে ঘাঁপ্টি মেরে থাকে! আজ এতগুলো বছরেও এই নিয়মের সে ব্যত্যয় ঘটাতে পারেনি।

ঊনিশ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে সুরমার। এখন সে পঁয়ত্রিশ বছরের ভরা যুবতী। তিন ছেলেমেয়ের মা। এই দীর্ঘ ষোল বছরে অনেক পরিবর্তন এসেছে তার জীবনে। শাশুড়ির সংসারের ভীরু, ব্যক্তিত্বহীন একজন মানুষ থেকে আজ সে তার একক সংসারের সর্বময় কর্ত্রী। কিন্তু একটা বিষয়ে আজও তার জীবনে কোনো পরিবর্তন আসেনি। এতগুলো বছরে একদিনের জন্যও তার বাপের বাড়ি যেতে ইচ্ছে করেনি। ভুলেও কখনো সে বাপের বাড়ির নাম মুখে আনেনি। তার স্বামীই অনেকসময় প্রসঙ্গ টেনে এনে বলেছে, “এদ্দিন হইয়্যা গেল, একবারের জন্যও বাপের বাড়িত যাইবার মন চায় না তুমার? এমুন মাইয়ামানুষ জিন্দিগিতে দেহি নাই আমি।”

সুরমা তার শাশুড়ির সংসার করেছে দশ বছর। এই দশ বছরে তার কারো কাছে অভিযোগ জানানোর কোনো সুযোগ ছিল না। শাশুড়ির কথাই ছিল শেষ কথা। অনেকদিন সে আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে। ঘুমহীন রাতে বুকচাপা দীর্ঘশ্বাসে তার বালিশ ভারী হয়েছে। জন্মের পরেই হারিয়ে ফেলা মায়ের কাল্পনিক অস্তিত্ব জুড়ে নিয়েছে বালিশের সাথে। সেটাকেই আঁকড়ে ধরেছে পরম মমতায়। সহস্র অভিযোগে বিদ্ধ করতে চেয়েছে প্রাণহীন নিষ্ক্রিয় বালিশের অসার দেহটাকে।

পাশে অঘোরে ঘুমে কাদা হয়ে থেকেছে স্বামী। সুরমার দীর্ঘশ্বাস তার শান্তির ঘুমে কোনো ব্যাঘাত ঘটায়নি। বাপের বাড়ি থেকে কানাকড়িও আনতে পারেনি দেখে অজস্র খোঁটায় এফোড় ওফোড় হয়েছে সুরমা। শাশুড়ি একেবারে পাড়া প্রতিবেশিকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেছেন, “ফইন্নির ঘরেত বিয়্যা দিছি পোলারে। এক চিমটি সোনাও লগে আনবার পারেনি। আমার পোলারে নেওনের লাইগা মাইয়ার বাপের লাইন লাগছিল। আমার পোড়া কপাল জুটায় দিছে এমুন বউ...”

সুরমা দাঁতে দাঁত চেপে সর্বংসহা বৃক্ষরূপ ধারণ করেছে। একটা কথারও জবাব দেয়নি। বলুক যা খুশি! বলেই যদি কলিজায় শান্তি আসে তো আসুক! অবশ্য বউ বাপের বাড়ির নাম নেয় না দেখে একদিক দিয়ে শাশুড়ি বেশ খুশিই ছিলেন। বউ যদি বাপের বাড়ির দিকে এক পা দিয়ে রাখে, তাহলে নাকি সেই সংসারে ভর-ভরান্তি আসে না। সারাজীবন দুর্দশা লেগেই থাকে। কিন্তু বাপের বাড়ির দিকে পা দিয়ে না রাখলেও সুরমার সংসারে কখনোই ভর-ভরান্তি আসেনি। নিত্য অভাব যেন লেগেই আছে তার সংসারে। সামান্য যেটুকু সম্বল ছিল, এক ননদের বিয়ে দিতে সেটুকুও খুইয়েছে। সেই সম্বলে হাত দিতে দোনোমোনো করছিল সুরমার স্বামী হারেজ আলী। তাতে ছেলেকেও শাপ-শাপান্ত করতে ছাড়েনি শাশুড়ি।

“দেখ হারেজ, এই আমি কইয়া রাখলাম...আমার মাইয়ার যদি ট্যাকার লাইগা ভালা ঘরে বিয়া না হয়, তর সংসারের মুখে আগুন লাগব। ফইন্নির মাইয়া লইয়াও আর সংসার করবার পারবি না। তোরে খাওয়াইয়া পরাইয়া বড় করছি না? ওহন, বইনের দায়িত্ব নেওনের আগে তোরে দুইবার ভাবন লাগে? ফইন্নির মাইয়া যদি তরে উলটাপালটা কিছু বুঝ দ্যায় তয় এই কইলাম...”
সেই শাপ-শাপান্তে দিশেহারা হয়ে সুরমা ছুটে এসে স্বামীর কাছে মিনতি জানিয়েছে, “আপনার পায়েত ধরি। বেবাক ট্যাকা দিইয়া দেন।”
“বেবাক ট্যাকা দিইয়া দিলে তুমার মাইয়ার কী হইব হেইডা ভাবছো?”
“আল্লাহয় কপালে যা রাখছে একটা কিছু হইব। আপনে ট্যাকা দিতে দেরি কইরেন না!”
হারেজও আপন মনে গজগজ করেছে, “এহন বুঝবার পারতাছো না। দিন আইলে বুঝবার পারবা। দুই মাইয়ারে কেমনে পার করবা হেই চিন্তা আছেনি তুমার? আমার তো আর হেই কপাল নাই যে শ্বশুরের...”
শেষের কথাগুলো এতটাই অস্ফুটে বলা যে, কান পেতে না রাখলে শোনা যায় না। সুরমার কান পাততে হয় না। সে এমনিতেই বুঝতে পারে তার স্বামীর শেষের কথাগুলো।

হারেজ আলী কিছুদিন আগেও শ্বশুরের সয়-সম্পত্তি পাওয়া না পাওয়া নিয়ে কোনো আক্ষেপ করেনি। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে ততই যেন তার চাপা ক্ষোভ আগল খুলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। দিনকে দিন তার সংসারের অবস্থা বেহাল হচ্ছে। টুকটাক ব্যবসাপাতি করে সে। তাতে লাভের মুখ দেখা তো দূরের কথা, এখন মূলধনই বলতে গেলে উঠে আসে না। কাজেই এই পরিস্থিতিতে তার আর মাথা ঠিক রাখার কোনো জো নেই। এতদিন সে কখনোই শ্বশুরের টাকা পয়সার দিকে নজর দেয়নি। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। হারেজ আলী বুঝে গেছে যে, তার অবস্থা এর চেয়ে ভালো কখনোই হবে না।

সুরমার বাপের বাড়ি পাশের গ্রামে। তার বাবা মীর হায়দার আলী তাদের গ্রামের একজন যথেষ্ট ধনাঢ্য ব্যক্তি। কাড়ি কাড়ি না হলেও তার জমা জমির পরিমাণ চোখ ঠাঠানোর মতোই। বলাই বাহুল্য, এই সম্পত্তির গন্ধ পেয়েই হারেজ আলীর মা তার ছেলের সাথে নিজ উদ্যোগে সুরমার বিয়ে দিয়েছিলেন। ‘ফইন্নির মেয়ে’কে অন্য কেউ এসে তার ছেলের ঘাড়ে জুটিয়ে দেয়নি। তিনি নিজেই তাকে খুঁজে পেতে বের করেছিলেন, ভবিষ্যতের সমৃদ্ধির আশায়।

কিন্তু হা হতোস্মি সে আশায়! মীর হায়দার আলীর মতো কৃপণ ব্যক্তি এই তল্লাটে আর একটাও আছে কি না সন্দেহ। তার তিন ছেলে এক মেয়ে। সর্বশেষ সন্তান মেয়েকে জন্ম দিতে গিয়ে স্ত্রী গত হয়েছেন। এই মেয়েকে বড় করতে তিনি তেমন কিছু খরচ পাতি করেননি। ছেলেদের পড়িয়েছেন। তিন ছেলেই মেট্রিক পাশ দিয়েছে। মেয়ে দুদিন পরেই পরের বাড়ি চলে যাবে। তাকে পড়াতে গিয়ে তিনি তার গাঁটের পয়সা নষ্ট করেননি।

সম্পত্তির উইলও করে ফেলেছেন ইতোমধ্যেই। সেখানে মেয়ের জন্য তিনি নামমাত্র কিছু টাকা রেখেছেন। নেহায়েত চক্ষু লজ্জার খাতিরে রাখতে হয় বলে রাখা। জমাজমির এক কানাও মেয়েকে দেননি। এত কষ্টের সম্পদ তার। খামোখা পরের ছেলেকে দেওয়ার কোনোই মানে হয় না। এই নিয়ে তার মনে কোনো অনুশোচনাও নেই। মেয়েকে বড় করেছেন, ভালো ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছেন...বাবা হিসেবে তার দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন।

সুরমা ছোটবেলা থেকেই তার প্রতি তার পিতার এই বিমাতাসুলভ আচরণ দেখেই বড় হয়েছে। খাবারের পাতে ভালো অংশ কিংবা উৎসব পার্বণে ভালো পোশাক আশাক কোনো কিছুতেই তার অগ্রাধিকার ছিল না। তার নিজেরও কতদিন ইচ্ছে হয়েছে মাছের মুড়ো দিয়ে ভাত খেতে। ভাইয়েরা খেতে না চাইলে তবে কখনো সখনো হয়তো তার ভাগে এসে পড়েছে। নতুন একটা ফ্রকের জন্য কতদিন সে বাবার কাছে বায়না করেছে। বাবা ধমক দিয়ে সরিয়ে দিয়েছে তাকে। চোখের পানি মুছতে মুছতে সরে এসেছে সে। ভাইয়েরাও কোনোদিন আদর করে ছোট বোনটার হাতে কোনোকিছু গুঁজে দেয়নি। অনাদরেই একা একা অগোচরে বেড়ে উঠেছে সুরমা।

তাই একবিন্দু চোখের পানিরও অহেতুক খরচ না করে সুরমা স্বামীর বাড়ি এসেছে। একবারের জন্যও পেছন ফিরে তাকায়নি। যা সে ফেলে এসেছে তাকে চিরতরেই দূরে সরিয়ে দিয়েছে।

কিন্তু স্বামীর এই আর্থিক অনটন আবার যেন তাকে সেই বাড়ির পথে পা বাড়াতেই প্রলুব্ধ করছে। আজ এতদিন বাদে সে কী-ই বা গিয়ে বলবে? আর তাতে কতটুকুই বা ফল মিলবে...সুরমা ভেবে পায় না।

এর মাঝেই এই অকস্মাৎ সংবাদ! তার বাবাই তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন! কিন্তু কেন?

দুই.

হায়দার আলী যেন মৃত্যুকে সামনে দেখতে পাচ্ছেন। কালো পোশাকে আচ্ছাদিত মৃত্যু একেবারে তার দোরগোড়ায় এসে হাজির। একটুখানি অসতর্ক হলেই সে তার মরণথাবা বসিয়ে দেবে। তিনি প্রাণপণ তৎপরতায় তাকে ঠেকাতে চাচ্ছেন। তবু বুঝতে পারছেন, সব আয়োজন নিস্ফল। মৃত্যু তার পরোয়ানা জারি করে দিয়েছে।

হায়দার আলী দিশেহারা হয়ে তার জীবনের হিসেব নিকেশের খাতা খুলে বসলেন। প্রথমেই তার মনে পড়ল মেয়ে সুরমার কথা। মেয়েকে তিনি বঞ্চিত করেছেন। অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত করেছেন। মেয়ের বিয়ের পরে সে একবারের জন্যও তার বৃদ্ধ পিতাকে দেখতে আসেনি। তাতে অবশ্য তার তেমন কিছু মাথাব্যথাও ছিল না। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, ঝামেলাও চুকে গেছে। ছেলেরা তার জমাজমির হাল ধরেছে। দিব্বি তরতর করে বেড়ে চলেছিল সয় সম্পত্তি।

কিন্তু সব হিসেব গণ্ডগোল হয়ে গেল। তিনি বেশ বুঝে গেছেন তার সময় শেষ। এখানকার হিসেব চুকিয়ে দিতে হবে কড়ায় গণ্ডায়। নইলে মৃত্যু তাকে কষ্ট দিয়ে দিয়ে মারবে। একবারে শেষ করবে না।

গ্রামের ডাক্তার আব্দুল হক, হায়দার আলীর বিছানার সামনে রাখা চেয়ারে বসে আছেন। চিন্তিত মুখে রোগীর নাড়ি দেখছিলেন তিনি। শ্বাস প্রশ্বাস দ্রুত। অনিয়মিত নাড়ির স্পন্দন। এই বয়সে বৃদ্ধের শরীর নিমোনিয়ার ধাক্কাটা নিতে পারছে না। আব্দুল হক তেমন বেশি কিছু আশার বাণী শোনাতে পারছেন না। হায়দার আলীও ডাক্তারের মুখ দেখে যা বোঝার বুঝে নিলেন। তিনি ছেলেদের ডেকে পাঠালেন।
“বাবারা, তুমাগো বইন সুরমারে খবর দাও। কও, আমি ডাইকা পাঠাইছি।”
ছেলেরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। তাদের কাছে লক্ষণ ভালো মনে হলো না। মৃত্যুশয্যায় শুয়ে বুড়ো বাপের কী মতিভ্রম হলো নাকি! নতুন করে উইল করতে বসবে না তো!
ছেলেদের আশঙ্কাই সত্যি হলো হায়দার আলীর পরের কথায়, “কাশেম উকিলরেও আসতে কইয়ো। আমি তুমাগো বইনরে ঠকাইছি। হ্যারে কিছু দেই নাই আমি। আইজরাইল তাই আমারে কষ্ট দিয়া মারব। মরার পরে কী হইব আমি জানি না...তুমরা হ্যারে ডাইকা আনো। আমি হ্যার কাছে মাফ চামু...।”

তিন ছেলে একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে গেল। বিষয় আশয় গুছিয়ে নিয়ে তারা তিন ভাই তাদের বাবার সম্পত্তিতে একেবারে জেঁকে বসেছে। উন্নতিও হয়ে চলেছে দুরন্ত গতিতে। হায়দার আলী এতদিন এক হাতে যা কষ্ট করে সামলিয়েছেন, তারা তিন ভাই জোট বেঁধে তিন হাতে তা সামলিয়ে চলেছে নিখুঁত পারদর্শিতায়। একমাত্র বোনকে বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া গেছে নির্ঞ্ঝাটভাবে। এখন এসব কী যন্ত্রণা!

তারা খোঁজ নিয়ে জেনেছে, বোনের আর্থিক অবস্থা তেমন সুবিধার নয়। সে যে খবর দেওয়া মাত্রই ছুটে আসবে সে কথা চোখ বুজে বলে দেওয়া যায়। তাদের বাপের যে মনের অবস্থা, এখন একটু তাপে লোহাও গলে যাবে। বোন এসে যদি দুটো দুঃখের প্যাঁচালী শোনায়, ব্যস! তবেই হয়ে যাবে!

তিনভাই দাওয়ায় বসে নিজেদের মধ্যে শলা পরামর্শ করতে লাগল। এখন যে করেই হোক, এটা ওটা বুঝিয়ে তার বাবাকে শান্ত রাখতে হবে। কিছুতেই সুরমাকে খবর দেওয়ার কথা আর যেন মুখে না আনতে পারে। কী করা যায় তারা জোর আলাপ চালাতে লাগল।

হায়দার আলীর হাঁকডাক ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ছেলেদের আরো বার কয়েক তাগাদা দিলেন তিনি। কাশতে কাশতে গলার নালী ছিঁড়ে যাবার উপক্রম হলো। প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে তার। বুক থেকে ঘরঘর শব্দ শোনা যাচ্ছে। ডাক্তার আব্দুল হক বাইরে বেরিয়ে এলেন। তিন ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “উনি যা করতে বলছেন তাড়াতাড়ি করুন। উনার হাতে কিন্তু সময় বেশি নাই।”
ছেলেদের মধ্যে তবু ভাবান্তর দেখা গেল না। এখন তাদেরকে গ্রাস করে আছে জমির উইল। যাই হোক না কেন, কিছুতেই এই উইল পরিবর্তন করানো যাবে না। তারা প্রসঙ্গ ঘোরানোর জন্য বলল, “বাবারে যদি সদরে নেওয়া যায়, তাইলে কীমুন হয়?”
“নিতে পারেন, কিন্তু উনার অবস্থা পরিবর্তন হওয়ার আমি তেমন সম্ভাবনা দেখি না।”

ছেলেরা বাপের কাকুতি মিনতি, হৈ চৈ অগ্রাহ্য করে তাকে সদর হাসপাতালের নিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় করতে লাগল। আপাতত এটা দিয়েই বুড়োর মনোযোগ সরিয়ে রাখা যাবে। কিন্তু তাদের সব রকম সতর্কতা সত্ত্বেও পরদিন সকালের মধ্যেই সুরমার স্বামীর কাছে খবর পৌঁছে গেল যে, তার শ্বশুর সুরমাকে দেখতে চেয়েছেন। এমন খবর নাকি বাতাসে ছড়ায়। সেরকমভাবেই খবর ছড়িয়ে গেল পাশের গ্রামে।

সুরমার স্বামী হারেজ আলী খবরটা শুনে আর দেরি করে না। তৎক্ষণাৎ ছেলে বাবরকে গিয়ে তার মাকে জানাতে বলে। এমন একটা খবরের অপেক্ষাতেই বসে ছিল হারেজ আলী। আজ এতদিন পরে সেই সুসময়টা এসেছে। শ্বশুর নিশ্চয়ই তার ভুল বুঝতে পেরেছেন। মেয়েকে বঞ্চিত করার জন্য আজ এতদিন বাদে তার অনুশোচনা জেগেছে। তাই মৃত্যুর আগে তিনি নিজের ভুল সংশোধন করে নিতে চান। মেয়েকে সম্পত্তির ভাগ দিতে চান।

খুশি খুশি মনে ঘরে পা রেখে হারেজ আলী দেখতে পায়, সুরমা ঘরের উঠোনে পা ছড়িয়ে নিশ্চল বসে আছে। কেমন যেন নিশি পাওয়া মানুষের মতো চোখের দৃষ্টিতে একটা দিশেহারা ভাব। পাশে ছড়িয়ে আছে ধুয়ে নিয়ে আসা বাসন কোসন। হারেজ আলী সুরমাকে ওইভাবে বসে থাকতে দেখে জোর তাগাদা লাগায়, “তুমি অক্ষনো অমনে বইসা আছো? উঠো শিগগির। তুমার বাপে খবর দিছে। দেরি কইরো না।”
সুরমা ইতস্ততঃ কণ্ঠে ক্ষীণ প্রতিবাদ জানিয়ে বলে, “আমারে আইজ এদ্দিন বাদে বাপজানের কী দরকার? আমি হ্যানে গিয়া কী করমু?”
হারেজ আলীর বিরক্তি সীমা ছাড়ায়। একরকম খেঁকিয়ে বলে ওঠে, “এইসব ভাবের কথা থুইয়া জলদি উঠো কইলাম। দেরি করোন ঠিক অইবো না।”

এদিকে সুরমার বাবা হায়দার আলীর শেষ সময় উপস্থিত। তার শিয়রের কাছে ছেলে ছেলের বউ নাতিপুতি সবাই এসে দাঁড়িয়েছে। তিনি ক্ষণে ক্ষণে সুরমাকে ডেকে চলেছেন। “ও সুরমা! ও মা! আমারে মাফ কইরা দে মা! আমারে এই পাপ থেইকা মুক্তি দে রে মা! আইসা তোর ভাগের জিনিস নিয়্যা যা রে মা।”

কাশেম উকিলকে ডাকতেও একাধিকবার তাগাদা দিয়েছেন। কাশেম উকিলের কাছেও কে যেন গিয়ে খবর দিয়েছেন। হায়দার আলীর ঘরে পাড়া প্রতিবেশিরা ভিড় করেছে। তাদেরই কেউ খবর দিয়ে থাকবে হয়তো! কাশেম উকিল যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল, এমন সময় হায়দার আলীর ছোট ছেলে এসে শাঁসিয়ে গেছে যেন বাড়ির বাইরে পা না দেয়।

হায়দার আলীর অস্থির অবস্থা দেখে একজন এসে তার কানে কানে জানিয়ে যায়, সুরমাকে খবর দেওয়া হয়েছে। সে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়ল বলে! এই খবর জেনে সুরমার বাবা কেমন যেন স্বাভাবিক হয়ে গেলেন। এতক্ষণের হৈ চৈ অস্থিরতা নিমেষে উধাও! বুকের ঘরঘরানিও অনেকটা কমে গেল। তিনি কেমন যেন সুস্থ বোধ করতে লাগলেন। কাল রাত থেকে তার ক্ষুধা তৃষ্ণা সব অনুভূতি চলে গিয়েছিল। এখন একটু যেন ক্ষুধা ক্ষুধাও বোধ হচ্ছে।

ডাক্তার আব্দুল হক কাছেই ছিলেন। তিনি এসে রোগীর নাড়ী দেখলেন। নাড়ী একদম স্বাভাবিক। রোগীকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তার মনে হতো লাগল যেন এই যাত্রায় ফাঁড়া কেটে গেছে। তিনি যারপরনাই বিস্মিত হলেন। তার এত বছরের ডাক্তারী জীবনে এই ঘটনা এবারই প্রথম। গ্রামের ডাক্তার হলেও তার হাতযশ আছে। রোগীর নাড়ী টিপে তিনি ঠিক তার অবস্থা বুঝতে পারেন। অথচ, এ যে একেবারে উল্টো ঘটনা ঘটতে চলেছে!

হায়দার আলী বিছানায় শোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসলেন। মুরগীর মাংস দিয়ে দুগ্রাস ভাত খেলেন। একটা খিলি পানও কিছুক্ষণ চিবুলেন। শরীরটা বেশ হালকা লাগছে। যেন একটা ঝড় শেষে ঠান্ডা শীতল হাওয়া এসে গায়ে লাগছে।

দুপুরের পরে পরেই সুরমা চলে এলো। সাথে তার ছেলে বাবর।

ঘরের দুয়ারে পা রেখে সুরমার মনে কোনো ভাবান্তর জাগল না। সে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারপাশটা দেখতে লাগল। ষোল বছর আগে ফেলে যাওয়া কোনো স্মৃতিই তার ভাবাবেগকে জাগিয়ে তুলল না। বাড়ির আনাচে কানাচে কোথাও সে এক চিলতে মমতার দানা খুঁজে পেল না। তার ছেলে বাবর অবাক বিস্ময়ে তার নানাবাড়ি দেখতে লাগল। সে শুনেছিল তার নানা মস্ত বড়লোক। আজ চাক্ষুষ দেখে তার বিস্ময় যেন বাঁধ মানছে না।

সুরমাকে দেখে হায়দার আলী চোখ পিটপিট করে চাইলেন। সুরমা এগিয়ে গেল বাবার দিকে।

তিন.

কথায় আছে, পৃথিবীতে সবচেয়ে মধুর সম্পর্ক নাকি বাবা-মেয়ের। সেই মধুরতম সম্পর্কের বাঁধনে বাঁধা দুজন মানুষ অত্যন্ত সতর্ক দৃষ্টিতে একজন আরেকজনকে নিরীক্ষণ করছে। হায়দার আলীই নীরবতা ভাঙলেন, “কী রে! একা আইছোস? তোর জামাইও আইছে নি?”
“জামাই আসে নাই। তুমার শরীল কেমন?”
হায়দার আলী তার স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্য আর কাঠিন্যের আবরণে নিজেকে তৎক্ষণাৎ ঢেকে নিলেন। কিছুক্ষণ আগের অযাচিত পাগলামীর জন্য নিজেকে মনে মনে তিরষ্কার করলেন। অকম্পিত স্বরে বললেন, “শরীল ভালা। তুই কি আইজগা থাগবি নাকি...”
সুরমা প্রখর দৃষ্টিতে সামনে বসে থাকা দুর্বল অথচ ঋজু স্বভাবের মানুষটাকে দেখল। সে বুঝতে পেরেছে, ষোল বছর আগের সেই মমতাহীন আশ্রয়টা আজও ঠিক তেমনি আছে।
“থাকুম না বাবা। বাইরে ভ্যান দাঁড় করাইয়া রাখছি। চইলা যামু। আমার পোলাডারে একটু খাওন দিবা? ছোড মানুষ। না খাইয়া আইছে। মুখটা ছোট হইয়া আছে।”

সুরমার ভাইয়েরা তীক্ষ্ণ সজাগ চোখে তাদের বোন আর বাবার কথাবার্তা শুনছিল। এতক্ষণে তারা নিশ্চিত হলো। যাক, কালো মেঘ কেটে গেছে। আর চিন্তা নাই। বাপের সুমতি ফিরেছে।

বিকেলের দিকে সুরমা আবার তার বাপের বাড়ি থেকে চিরবিদায় নিয়ে দ্বিতীয়বারের জন্য স্বামীর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। অনেকখানি আসার পরে সে বেশ দূর থেকে একটা শোরগোল শুনতে পেল। লোকজনের মিলিত পদচারণা, কান্নার আওয়াজ। আওয়াজটা ভেসে আসছে তার বাপের বাড়ির দিক থেকেই।

মেয়েকে দৃপ্ত কণ্ঠে বিদায় জানানোর অল্প কিছু পরেই হায়দার আলী পৃথিবীকেও শেষ বিদায় জানালেন।

বাপের বাড়ির দিকে তাকিয়ে সুরমা একটা কিছু বুঝতে পারল। দু পলক সেদিকে তাকিয়ে নিস্পৃহভাবে ভ্যানওয়ালার দিকে চেয়ে বলল, “জলদি জলদি টান লাগাও। রাইতের আগে আগে বাড়িত যাইবার পারি য্যান।” বাইরে তখন জমতে শুরু করেছে কুয়াশার ঘের। আবার বুঝি তমসা এসে ঘিরে ধরে, এই আশঙ্কায় সুরমা ব্যগ্রভাবে ফেরার তাড়া অনুভব করে।

   

৩ গুণী পাচ্ছেন বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

  • Font increase
  • Font Decrease

রবীন্দ্র ও নজরুল সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার পাচ্ছেন ৩ গুণী গবেষক।

মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) বাংলা একাডেমির জনসংযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ বিভাগের পরিচালক সমীর কুমার সরকার স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র-সাহিত্যের গবেষণায় অবদানের জন্য অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরীকে এবং অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসাকে রবীন্দ্র পুরস্কার ২০২৪-এ ভূষিত করেছে।

অন্যদিকে, বাংলা একাডেমি নজরুল-সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের জন্য অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানাকে নজরুল পুরস্কার ২০২৪-এ ভূষিত করেছে।

আগামী ২৫শে বৈশাখ ১৪৩১/৮ মে ২০২৪ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি আয়োজিত অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র পুরস্কার-২০২৪ ও আগামী ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১/২৩ মে ২০২৪ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে নজরুল পুরস্কার-২০২৪ প্রদান করা হবে।

অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানা 

খ্যাতিমান নজরুল গবেষক অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানার জন্ম ২৫শে জুলাই ১৯৩৭। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় ১৯৫৮ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৫৯ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৮৫ সালে মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিমের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি এইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন।

বাংলাদেশের মহিলাদের মধ্যে তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগের পাণ্ডুলিপি ও সাহিত্য বিষয়ে প্রথম গবেষক। ১৯৮৩ সালে তিনি ফারসি ভাষায় ডিপ্লোমা লাভ করেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রণীত মধ্যযুগের সাহিত্য-সম্পাদনা-গ্রন্থ 'নওয়াজিশ খান বিরচিত গুলে-বকাওলী কাব্য। পরে প্রকাশিত হয় তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ‘আবদুল হাকিম : কবি ও কাব্য (১৯৮৭)। অপর সাহিত্য সম্পাদনা-গ্রন্থ 'আবদুল হাকিম রচনাবলী' (১৯৮৯)।

কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে ড. রাজিয়া সুলতানার গবেষণাগ্রন্থ 'কথাশিল্পী নজরুল (১৯৭৫), 'নজরুল (১৯৮৮), অন্বেষা' (২০০১) এবং 'সাহিত্য-বীক্ষণ' (১৯৮৮)। ড. রাজিয়া সুলতানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। ইতোপূর্বে তিনি বিভিন্ন সরকারি কলেজে ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।

অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রজন্মের বিশিষ্ট সাহিত্য-সমালোচক ভীষ্মদেব চৌধুরীর জন্ম ১৯৫৭ সনের ৩০শে নভেম্বর সিলেট শহরে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি সম্পন্ন করেন। ১৯৮৪ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা। ২০০০ সনে তিনি অধ্যাপক হিসেবে উন্নীত হন। বাংলা উপন্যাস, রবীন্দ্র ছোটগল্প এবং বাংলাদেশের সাহিত্য তাঁর অনুধ্যান ও মূল্যায়নের কেন্দ্রীয় বিষয়। ভীষ্মদেব চৌধুরীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : জগদীশ গুপ্তের গল্প : পঙ্ক ও পঙ্কজ (১৯৮৮); মিরজা আবদুল হাই (১৯৮৯); বাংলাদেশের সাহিত্যগবেষণা ও অন্যান্য (দ্বি সংস্করণ ২০০৪); সৈয়দ মুজতবা আলীর পত্রগুচ্ছ (সম্পা. ১৯৯৩); তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস : সমাজ ও রাজনীতি (১৯৯৮); তারাশঙ্কর স্মারকগ্রন্থ (সম্পা. ২০০১); দু-চারটি অশ্রুজল : রবীন্দ্রগল্পের ভিন্নপাঠ (২০০৫); কথাশিল্পের কথামালা : শরৎচন্দ্র ও তারাশঙ্কর (২০০৭); সাহিত্য-সাধনায় ঢাকার নারী (২০১১); প্রভাতসূর্য :রবীন্দ্রনাথ সার্ধশত জন্মবর্ষ স্মরণ (সম্পা. ২০১১)।

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের শিক্ষক ও সাধারণ সম্পাদক। গুণী এই শিল্পীর জন্ম রাজশাহীতে। বাবা অধ্যাপক মফিজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষক ও মা খানম মমতাজ আহমদ। রবীন্দ্রনাথের গানসহ সুস্থধারার সংগীত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত থেকেও তিনি দেশজুড়ে শুদ্ধ সঙ্গীতের চর্চাকে ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখছেন। 

;

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত



কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

  • Font increase
  • Font Decrease

আবুল মাল আবদুল মুহিত সাবেক অর্থমন্ত্রী। সবচেয়ে বেশিবার বাজেট উপস্থাপন করে রেকর্ড গড়া অর্থমন্ত্রী তিনি। দীর্ঘ চাকরিজীবন শেষে রাজনৈতিক জীবন এবং স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে অবসর—সব ছিল তার বর্ণাঢ্য জীবনে। তার পর দেশের অর্থমন্ত্রী হয়েছেন আবু হেনা মোহাম্মদ মুস্তাফা কামাল ও বর্তমানে আবুল হাসান মাহমুদ আলী; কিন্তু কেউই আবুল মাল আবদুল মুহিতের মতো সাফল্যের সাক্ষর রাখতে পারেননি। মুস্তাফা কামালের মন্ত্রিত্ব কালের পুরোটা সময় কেটেছে ‘অনুপস্থিতি’ আর বিবিধ ব্যর্থতা দিয়ে। নতুন অর্থমন্ত্রী মাত্রই নিয়েছেন দায়িত্ব, তাই তাকে এনিয়ে এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা কঠিন।

আবুল মাল আবদুল মুহিত কেবল অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অর্থমন্ত্রীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন লেখক, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাঙালির মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি সরকারি চাকরি ত্যাগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে কাজ শুরু করেছিলেন। ১৯৫৬ সালে যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি)। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ওয়াশিংটন দূতাবাসে পাকিস্তানের কূটনীতিকের দায়িত্বে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের জুনে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৮১ সালে স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরি ছেড়েও দেন। সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদেরও অর্থমন্ত্রী ছিলেন তিনি। গণতন্ত্রে দেশকে ফেরানো হবে এই শর্তে তিনি এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। এরপর বছরখানেক দিন শেষে যখন দেখেন এরশাদ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছেন না, তখন তিনি স্বেচ্ছায় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ের পর যে মন্ত্রিসভা গঠন করে সেখানে শেখ হাসিনা তাকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। প্রবল প্রতিকূল দেশীয় ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেওয়া আবুল মাল আবদুল মুহিত বৈশ্বিক মন্দা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতিকে যে জায়গায় নিয়ে গেছেন তার সুফল দীর্ঘদিন ভোগ করেছে দেশ। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্পসহ আরও অনেক প্রকল্প তার আমলে শুরু হয়। তিনি আর্থিক ব্যবস্থাপনার দিকটি সুনিপুণভাবে করে গেছেন। তার দায়িত্বকালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যে ঊর্ধ্বগতির সঞ্চার হয়েছিল সেখান থেকে দেশ একটা সময়ে ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায়।

মাথাপিছু আয়, জিডিপি, রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির নানা খাতের ব্যবস্থাপনায় তিনি যে সাফল্যের সাক্ষর রেখেছেন তার পথ ধরে পরের অর্থমন্ত্রীরা সেটা অব্যাহত রাখতে পারেননি। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে পারেননি এবং পদে থেকেও তার কাজে অনুপস্থিতি দেশকে গভীর সংকটে নিপতিত করেছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মুস্তাফা কামাল বিজয়ী হলেও তাকে মন্ত্রিসভায় রাখেননি শেখ হাসিনা, এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে।

নানা কারণে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে এই দেশ স্মরণ রাখবে। তন্মধ্যে একটি যদি পেনশন ব্যবস্থা হয়, অন্যটি নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়ন। নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি এখনো আনুষ্ঠানিক হয়নি যদিও, তবে এনিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। নয় মাস আগে দেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হয়েছে, এবং এই নয় মাসে ব্যাপক সাড়া যদিও পড়েনি, তবে এখন পর্যন্ত ১ লাখ লোক এই সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। অথচ তিনি যখন প্রথমবার সবার জন্যে পেনশন চালুর কথা বলেন, তখন এই উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিলেন অনেকেই। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে তিনি এক বৈঠকে সকলের জন্যে পেনশন চালুর ব্যবস্থার কথা বলে অনেকের বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন। তবু তিনি এর একটা খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব দেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে। আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘সবার জন্য পেনশন চালু করতে পারলে এ দেশ থেকে অনেক কিছু দূর হবে। মানুষ যখন দেখবে তার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত তখন অনেকেই অনিয়ম থেকে সরে আসবে। মানুষ এত অনিয়ম-হানাহানি করে শুধু ভবিষ্যতের জন্য।’ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে খসড়া তৈরি হয়ে আসার পর তিনি জানালেন, কিছুই হয়নি। এরপর তার নিজের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় খসড়া তৈরির কাজ। তিনি এনিয়ে কথা বলতেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবুল মাল আবদুল মুহিতের ওই উদ্যোগের পক্ষে ছিলেন, এবং কাজ করার নির্দেশ দেন। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর পর তথ্যগুলো একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক কর্মকর্তা।

আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের বাজেটে দেশের সকল নাগরিকের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালুর স্বপ্নের কথা বলেছিলেন। তিনি তার বাজেট বক্তৃতার ৫৯ নং পৃষ্ঠার পেনশন অধ্যায়ে বলেছিলেন ‘সরকারি পেনশনারগণ দেশের সমগ্র জনগণের একটি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। তাই সরকারি কর্মচারীদের পাশাপাশি সকলের জন্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অংশগ্রহণমূলক সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুকরণে আমরা কাজ করছি। আমাদের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ-রাষ্ট্রে রূপান্তর করা।’ এর আগের বছরের বাজেটে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ শতাংশ, যাদের প্রায় সবাই সরকারি চাকুরে, এখন পেনশন সুবিধা পান। বাকি ৯৫ শতাংশের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ গ্র্যাচুইটি সুবিধা পেলেও অন্যদের জন্য সে সুবিধাও নেই।’ তার বক্তব্য তখন সে পর্যন্তই ছিল, এবং এক বছর পর পরের বাজেটে এসেছে স্বপ্নের পূর্ণ অবয়ব। আর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারে। এরবাইরে আছে ২০১৮ সালে পেনশন নিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিতের উদ্বোধন করা এক পাইলট প্রকল্পে, যেখানে ৫৭ জন ব্যক্তিকে এই প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা হয়। দেশের মানুষদের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালু নিয়ে যে স্বপ্নের রূপরেখা দিয়েছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত, সেটা তার জীবদ্দশায় পূরণ হয়নি। তার মৃত্যুর কয়েক মাস পর সরকারি তরফে হয়েছে প্রকাশ্য এবং প্রধানমন্ত্রী করেছেন এর বাস্তবায়ন।

সম্প্রতি নারীদের গৃহকর্মের অর্থনৈতিক মূল্য নির্ধারণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। গত ২৩ এপ্রিল সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ সুপারিশ করা হয় বলে সংসদ সচিবালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। নারীদের গৃহকর্মের এই মূল্যায়নে ঘরে হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল পালন, বিভিন্ন জাতের সবজি উৎপাদনসহ নানা হিসাব এর মধ্যে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশের অন্তত ৪৩ শতাংশ নারী পুরোপুরিভাবে গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে যুক্ত। দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান ২০ শতাংশ। তবে নারীর এই গৃহস্থালি কাজকে জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতিতে যোগ করা হলে জিডিপিতে নারীর অবদান দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ বা তার কাছাকাছি। এখন নারীদের গৃহস্থালি কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে, এ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এটাও ছিল সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের স্বপ্ন। দায়িত্ব পালনকালে একাধিকবার তিনি এনিয়ে কথা বলেছেন, নারীদের কাজের রাষ্ট্রীয় মূল্যায়নের গুরুত্বারোপ করেছেন। ২০১৭ সালের অক্টোবরে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে প্রয়াত এই অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে ঘরের সেবামূলক কাজের কোনো মূল্যায়ন নেই। সে কারণে জিডিপিতে এর কোনো অন্তর্ভুক্তি নেই। এটার মূল্যায়ন করা জরুরি।’ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে এই মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘বিষয়টি আমরা পরিসংখ্যান বিভাগে যুক্ত করব এবং সরকারিভাবে আমরা এটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাব।’

আবুল মাল আবদুল মুহিত নেই আজ দুই বছর। ২০২২ সালের ৩০ এপ্রিল না ফেরার দেশে চলে যান বরেণ্য এই ব্যক্তিত্ব। মৃত্যুর মাস দেড়েক আগে তাকে দেওয়া সিলেটে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি নিজের জীবনের মূল্যায়নে বলেছিলেন, ‘আমি আমার জীবনকে নিয়ে গর্বিত।… অনেকে হয়ত একে আত্মগরিমা বলবেন। কিন্তু এটা অন্যায় নয়। বরং এরজন্য নিজেকে গড়ে তুলতে হয়।’ ৮৮ বছরের দীর্ঘ সময়কে তিনি বলতেন ‘মহাতৃপ্তির-মহাপ্রাপ্তির জীবন’।

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত।

;

চতুর ঘুঘু



শরীফুল আলম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

নেশাখোরের মত কখনো কখনো খিলখিল করে হাসি
প্রথমত দহন উষ্ণতায় ,
তারপর সুবিশাল শূন্যতায় ,
কখনো কখনো ছুঁয়ে ফেলি সাজানো প্রতিমা
জীবনের দাবী ,
তবে আপাতত গন্তব্য বলে কিছু নেই আমার
কবিতার অবয়ব এখনো যেটুকু আছে
তাকে আমি রঙ্গের উৎসবই বলি
কিম্বা যেটুকু আছে তা জীবনের দাবী ।

ক্রমাগত অন্তর্গত দ্বন্দে
অবাধ্য ভাষা এখন প্রাচীর তোলে
প্রসারিত মৃত্যুর কথা বলে ,
আমি তার গল্পের শেষটা জানার চেষ্টা করি
রাতের গহ্বর থেকে তোলে আনি মৃত্যুর পরোয়ানা ,
কিন্তু অস্পষ্টতা কিছু থেকেই যায়
আবার নিজে নিজেই বলি
আমার জলভূমিতে আবার কিসের নিঃসঙ্গতা ?

স্বপ্নবাসর ? সে এক চতুর ঘুঘু
আমি তার ক্ষণিকের হটকারীতা বুঝতে পারি
এমনকি চোখ বুজে
আমি ভুলে যাই তার সন্ধ্যার ঘায়েল
যেন দেখেও দেখিনা
বিনা মোহে সারারাত অহেতুক তার অহংকার
নিরর্থক বাজি ধরে সে
অর্কিড নিরালায় আমিও একা থাকি
ভাঙ্গা চোরা রাত জেগে থাকে আমার পাশে
মনে হয় চোখ দিয়ে ছুঁয়ে দেখি তার ঢাকাঢাকি
ফিরতি নজরে সেও আমায় দেখে
আমার মিষ্টি কবিতার মতই
আমিও থমকে যাই পাখীর ডাকে
দূর দরিয়ায় তখন উলুধ্বনি শংখ বাজে ,
ইচ্ছে হয় নাগরদোলায় আবার গিয়ে দুলি
আর জানই তো কবিরাই প্রেমে পড়ে
কবিরাও চুমু খায়
সুন্দরী পেলে তাঁরাও শুয়ে পরে।

*************************
শরীফুল আলম ।
২১এপ্রিল । ২০২৪ইং
নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।

;

শিশু সুভাষচন্দ্রের চেতনায় স্বদেশপ্রেমের উন্মেষ যেভাবে



উৎপল আইচ
-নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। ছবি: সংগৃহীত

-নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুকে আমরা প্রায় সকলেই বৃহত্তর ভারতবর্ষের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক বলে মানি এবং শ্রদ্ধা করি। তাঁর তুলনাহীন দেশপ্রেমের সামগ্রিক পর্যালোচনা শুধু একটা নাতিদীর্ঘ রচনার পরিসরে লিপিবদ্ধ করা সম্ভব নয়। তাই বালক-কিশোর সুভাষচন্দ্রের জীবনে দেশাত্মবোধের অঙ্কুরোদয় আর তার উন্মেষই এই রচনার উপজীব্য থাকলো।

১৯০২ সালের জানুয়ারি মাসে ৫ বছর বয়স থেকে ১৯০৮ সালের ডিসেম্বর মাস অবধি, অর্থাৎ প্রায় ১২ বছর বয়স অবধি, দীর্ঘ ৭ বছর, সুভাষচন্দ্র ব্যাপ্টিস্ট মিশনারিদের দ্বারা পরিচালিত কটকের প্রটেস্ট্যান্ট ইউরোপিয়ান স্কুলে পড়াশুনা করেন। বিলিতি আদর্শে নিয়ন্ত্রিত এই স্কুলের বেশির ভাগ ছাত্রই ছিল ইউরোপীয় কিংবা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। যদিও এই স্কুলে খুব ভালো ইংরেজি শেখানো হতো, আসল প্রচেষ্টা ছিল ছাত্রদের মনেপ্রাণে ইংরেজ করে গড়ে তোলার। তাই বাইবেলের উপর খুব জোর দেওয়া হত। তাছাড়া গ্রেটবৃটেনের ইতিহাস ও ভূগোল, ল্যাটিন ইত্যাদি শেখানো হতো। সেই স্কুলে সংস্কৃত বা অন্য কোন ভারতীয় ভাষা শেখাবার প্রশ্নই উঠে না। তবে পড়াশুনার সাথে সাথে স্কুলের প্রধান শিক্ষক নিয়মানুবর্তিতা এবং ভদ্র-ব্যবহারকে শিক্ষার বড় অঙ্গ বলে মনে করতেন।

এই স্কুলে প্রবেশের কয়েক বছর পরই বালক সুভাষচন্দ্র বঙ্গভঙ্গ-জনিত দেশের রাজনৈতিক নবজাগরণের ব্যাপারটা বুঝতে শিখেছিলেন। প্রথম দিকে না বুঝতে পারলেও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এটাও অনুভব করতে পারলেন যে তাঁদের বাড়ির বা তাঁদের সমাজের জীবন আর স্কুলের জীবন একদম ভিন্ন ধরণের। সুভাষচন্দ্র এও জানলেন যে ভারতীয়রা পরীক্ষায় সর্বোচ্চ স্থানাধিকারী হলেও শুধুমাত্র ভারতীয় বলে স্কলারশিপ-পরীক্ষা দেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। তাছাড়া, ইউরোপীয় এবং অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ছেলেরাই ভলান্টিয়ার কোর-এ যোগ দিতে পারে, বন্দুক ব্যবহার করা শিখতে পারে যা ভারতীয় ছাত্রদের জন্য নিষিদ্ধ।

নেতাজী সুভাষচন্দ্র তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ‘অ্যান ইন্ডিয়ান পিলগ্রিম’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘এইসব ছোটোখাটো ব্যাপার থেকেই আমাদের চোখ খুলতে শুরু হল, বুঝলাম যে এক বিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও ভারতীয় হিসাবে আমরা কতটা আলাদা’ (“Small incidents like these began to open our eyes to the fact that as Indians we were a class apart, though we belonged to the same institution.”) । সুভাষচন্দ্র তাঁর আত্মজীবনীর শুরুতেই লিখেছেন যে তাঁর মন স্পর্শকাতর এবং তিনি একজন অন্তর্মুখী ব্যক্তি। (“I was and still remain an introvert.”) সুভাষচন্দ্র সেই আত্মজীবনী অসুস্থ অবস্থায় ১৯৩৭ সালের ডিসেম্বর মাসে দশদিনে অস্ট্রিয়ার ব্যাডগাসটেন-এ অবস্থানকালে লিখেছিলেন। তিনি সেখানে স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য গিয়েছিলেন।

আত্মজীবনীতে তিনি আরও লিখেছেন, “সব কিছু বিচার করে আমি এখন একজন ভারতীয় বালক বা বালিকাকে এরকম স্কুলে পাঠাবো না। সে নিশ্চিত সুসমন্বয়ের অভাবে এবং তজ্জনিত অশান্তিতে ভুগবে, বিশেষতঃ সে যদি স্পর্শকাতর স্বভাবের হয়। (“Considering everything, I should not send an Indian boy or girl to such a school now. The child will certainly suffer from a sense of mal-adaptation and from consequent unhappiness, especially if he or she is of a sensitive nature.”)

১৯০৯ সালের জানুয়ারি মাসে সুভাষচন্দ্র কটকের র‍্যাভেন্-শ কলেজিয়েট স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে (এখনকার হিসাবে সপ্তম শ্রেণিতে) ভর্তি হন। এই স্কুলে তিনি চার বছর পড়াশুনা করে ১৯১৩ সালের মার্চ মাসে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন। সুভাষচন্দ্র বসু যখন র‍্যাভেন্শ কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন তখন সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন শ্রী বেণীমাধব দাস। সুভাষচন্দ্রের বয়স তখন ১২ বছর। কিশোর সুভাষ তার আগে এক বর্ণও বাঙলা পড়েননি। এদিকে তাঁর সহপাঠীরা সবাই বাঙলায় পারদর্শী ছিল। কিন্তু চরম অধ্যবসায়ী সুভাষ এক বছরের মধ্যেই বাঙলাটা রপ্ত করে ফেলেন। সংস্কৃতের ব্যাপারও একই কথা বলা যায়। এই নতুন স্কুলে তাঁর বন্ধুও জুটে যায় যেটা প্রোটেস্ট্যান্ট ইউরোপিয়ান স্কুলে হয়নি।

সুভাষচন্দ্র ছিলেন নিরহংকারী এবং প্রচারবিমুখ মহাপুরুষ, তাই অনেক কথা বিস্তারিতভাবে আত্মজীবনীতে লেখেননি বা হয়তো আত্মপ্রশংসা হবে মনে করে এড়িয়ে গেছেন। র‍্যাভেন্শ কলেজিয়েট স্কুলে তাঁর বাল্যবন্ধু ও সহপাঠী ছিলেন শ্রী চারুচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি সুভাষচন্দ্রদের প্রতিবেশীও ছিলেন। আমাদের সৌভাগ্য যে চারুচন্দ্র তাঁর স্মৃতি রোমন্থন করে শ্রী সুবোধচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়কে দিয়ে “সুভাষচন্দ্রের ছাত্রজীবন” নামে একটা বই লিখে গেছেন। তাঁর কাছ থেকে আরো অনেক তথ্য জানা যায়। এছাড়া অন্যান্য সূত্র থেকেও কিছু নতুন তথ্য জানা যায় এবং কিছু তথ্যের সমর্থন মেলে।

প্রথম ভর্তি হবার দিন সুভাষচন্দ্র কোট-প্যান্ট পরে র‍্যাভেন্শ কলেজিয়েট স্কুলে গিয়ে দেখতে পান যে সমস্ত শিক্ষক এবং অন্যান্য সব ছাত্ররা দেশীয় পোশাক পরে আছেন। তার পরদিন থেকে তিনিও ধুতি-পাজ্ঞাবি পরে স্কুলে যেতে শুরু করেন। সুভাষচন্দ্র তাঁর আত্মজীবনীতে ক্ষুদিরাম বসুর নাম উল্লেখ না করে লিখেছেন যে ১৯০৮ সালে যখন প্রথম বোমা নিক্ষেপ করা হয় তখন চারদিকে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল এবং তাঁদের মধ্যেও সাময়িক উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল। সুভাষচন্দ্র তাঁর আত্মজীবনীতে এও লিখেছেন যে সেসময় বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে, স্বদেশি জিনিস ব্যবহারের পক্ষে মিছিল ও আন্দোলন চলছিল এবং তাঁরা কিছুটা সেদিকে ঝুঁকেছিলেন, কিন্তু বাড়ির নিষেধ থাকায় রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগদান করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয় নি। তবে তাঁরা বিপ্লবীদের ছবি কেটে কেটে পড়ার ঘরে টাঙিয়ে রাখতেন। এক আত্মীয় পুলিশ অফিসার দেখে ফেলায় সেগুলোও পরে অপসৃত হয়েছিল এবং এতে তাঁদের মন খারাপ হয়েছিল।

আমরা “সুভাষচন্দ্রের ছাত্রজীবন” গ্রন্থ থেকে জানতে পারি যে, ১৯১১ সালের ১১ আগস্ট তারিখে র‍্যাভেন্শ কলেজিয়েট স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র (বর্তমান নবম শ্রেণি) সুভাষচন্দ্র নিজ উদ্যোগে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসির তৃতীয় বাৎসরিক স্মরণ দিবস উপযুক্ত ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে পালন করেছিলেন স্কুলে এবং র‍্যাভেন্শ কলেজ ও স্কুল হোস্টেলে। সুভাষচন্দ্রের প্রস্তাব মত সব ছাত্ররা উপবাস করে এই পূণ্য দিনটি অতিবাহিত করেছিল সেদিন। অবশ্য এর পরিণতি ভালো হলোনা; ডিভিশনাল কমিশনারের কাছে খবর পৌঁছে যায় আর ফলস্বরূপ ম্যাজিষ্ট্রেট এই বিষয়ে তদন্ত করে প্রধান শিক্ষক শ্রীবেণীমাধব দাসকে কটক থেকে কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে বদলি করে দেয়।

র‍্যাভেন্শ কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই সুভাষচন্দ্র শিক্ষক শ্রীবেণীমাধব দাসের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন তাঁর প্রখর ব্যক্তিত্বের জন্য। তিনি প্রধান শিক্ষককে মনেপ্রাণে শ্রদ্ধা করতে শুরু করেন। যেহেতু বেণীমাধববাবু দ্বিতীয় শ্রেণির নীচে কোন ক্লাস নিতেন না তাই অধীর আগ্রহে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উঠার জন্য অপেক্ষায় থেকে যখন সেই সুযোগ সুভাষচন্দ্র পেলেন তখন তাঁর সে ভাগ্যও দীর্ঘস্থায়ী হলো না। তবে এই কয়েক মাসের মধ্যেই শ্রী বেণীমাধব দাস ছাত্র সুভাষের মধ্যে একটা নৈতিক মূল্যবোধ জাগিয়ে দিয়ে গেলেন।

এই বিচ্ছেদ সুভাষের জন্য খুব বেদনার হয়েছিল কিন্তু তাঁর সাথে বেণী মাধবাবুর চিঠিপত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ রইল। সুভাষচন্দ্র আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে, প্রকৃতিকে কিভাবে ভালবাসতে হয়, প্রকৃতির প্রভাবকে জীবনে কিভাবে গ্রহণ করতে হয় তা মাস্টারমশাই শ্রী বেণীমাধব দাসই তাঁকে শিখিয়েছিলেন। প্রকৃতি তো দেশমাতৃকারই অবিচ্ছিন্ন অঙ্গ। কিন্তু মাস্টারমশাই যে তাঁকে স্বদেশপ্রেম শিখিয়েছেন তা অবশ্য স্পষ্ট করে সুভাষচন্দ্র তাঁর আত্মজীবনীতে লেখেননি। হয়ত ১৯৩৮ সালে ছাপা বইতে তেমন কিছু কথা লিখে বেণীমাধব বাবুকে ইংরেজ-পুলিশের কুনজরে পড়তে দিতে চাননি।

বেণী মাধববাবুর বদলির কিছুদিন পর থেকেই সুভাষচন্দ্র বয়ঃসন্ধিজনিত কিছু মানসিক অশান্তিতে ভুগছিলেন। সৌভাগ্যবশতঃ ঠিক এই সময়ই তিনি কটক শহরে নবাগত এক আত্মীয়ের বাসায় অপ্রত্যাশিতভাবে স্বামী বিবেকানন্দের রচনাবলী পেয়ে যান এবং তা অতি উৎসাহে পড়ে ফেলেন। সুভাষচন্দ্র বুঝতে পারেন যে এই জিনিষই তিনি এতদিন ধরে খুঁজছিলেন এবং এগুলোর মধ্যেই তিনি তাঁর মানসিক অশান্তির সমাধান খুঁজে পেলেন। স্বামী বিবেকানন্দের জীবনের আদর্শই সুভাষচন্দ্র হৃদয়ঙ্গম করে নিলেন, যার মূল কথাটা হল, “আত্মনঃ মোক্ষার্থম জগৎহিতায় চ” অর্থাৎ ‘মানবজাতির সেবা এবং আত্মার মুক্তি’।

মানবজাতির সেবা বলতে স্বামী বিবেকানন্দ স্বদেশের সেবাও বুঝিয়েছেন। স্বামীজীর প্রধান শিষ্যা এবং জীবনীকার ভগিনী নিবেদিতা আমাদের জানিয়েছেন যে, মাতৃভূমিই ছিল স্বামী বিবেকানন্দের আরাধ্যা দেবী। আত্মজীবনীতে সুভাষচন্দ্র আরও লিখেছেনঃ ‘একটি বক্তৃতায় স্বামীজী বলেছেন, “সদর্পে বল মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী, আমার ভাই।”

নেতাজী সুভাষচন্দ্র লিখেছেন যে তাঁর বয়স যখন ১৫ ছুঁই ছুঁই, ঠিক তখন বিবেকানন্দ তাঁর জীবনে প্রবেশ করলেন; বিবেকানন্দের প্রভাব তাঁর জীবনে আমূল পরিবর্তন এনে দিল এবং তিনি স্বামী বিবেকানন্দের পথই বেছে নিলেন। বিবেকানন্দের সাথে সাথে তাঁর গুরু রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের প্রতিও সুভাষচন্দ্র আকৃষ্ট হলেন এবং কটকে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভক্তবৃন্দের একটা সংগঠন গড়ে তুললেন। সেই সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল অধ্যাত্মচর্চা করা আর দুঃস্থের সেবা করা। স্কুল ছাড়ার সময় যত এগিয়ে আসছিল, সুভাষের মধ্যে ধর্মভাব আর মানবসেবা করার প্রবণতা ততই বেড়ে যাচ্ছিল। লেখাপড়ায় আর মন বসছিল না।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শিশু সুভাষ (দণ্ডায়মান, ডান থেকে প্রথম)

এরপর ১৯১২ সালের অক্টোবর মাসে মহাসপ্তমীর দিন কৃষ্ণনগর থেকে মাস্টারমশাই শ্রী বেণীমাধব দাসের পরিচয়পত্র নিয়ে হাজির হলেন সুভাষেরই সমবয়সী একই (ফার্স্ট) ক্লাসের ছাত্র শ্রী হেমন্তকুমার সরকার। হেমন্ত কলকাতার একটা রাজনৈতিক দলের সভ্য ছিলেন যাদেরও আদর্শ ছিল আধ্যাত্মিক উন্নতি এবং দেশসেবা। সেই প্রথম সুভাষ ও তাঁর কটকের বন্ধুরা প্রথমবারের মত কলকাতার রাজনৈতিক প্রেরণার আস্বাদন পেলেন। হেমন্তের কাছে তাদের দলের নানাবিধ কাজের বর্ণনা শুনে সুভাষচন্দ্র মুগ্ধ হলেন।

হেমন্ত একদিন সুভাষের দলের ছেলেদের দেশের প্রতি তাদের কর্তব্য সম্বন্ধে অনুপ্রাণিত করে একটা আবেগময় বক্তৃতাও দিলেন। এইসঙ্গে সুভাষচন্দ্রের সাথে তাঁর নিবিড় সখ্যতাও গড়ে উঠল। চারদিন কটকে থেকে বিজয়া দশমীর সন্ধ্যায় হেমন্তকুমার পুরী চলে গেলেন এবং কলকাতায় ফিরে গিয়ে তাঁর দলের প্রধানকে সব জানালেন। সেই দলনেতা চিঠির মাধ্যমে কটকের এই দলটার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন এবং কয়েক বছর এই যোগাযোগ ছিল।

হেমন্তকুমার পরে তাঁকে লেখা সুভাষের বেশ কিছু চিঠি প্রকাশ করেন যার থেকে সুভাষচন্দ্র বসুর কৈশোরের এবং যৌবনের অনেক কথা জানা যায়। তিনি তাঁর বিখ্যাত “সুভাষের সঙ্গে বারো বছর (১৯১২ – ১৯২৪)” বইতে জানান যে, সুভাষের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের সময়ই তাঁদের মধ্যে স্থির হয়েছিল যে পাশ করে তাঁরা চাকরি করবেন না এবং সুভাষ আই-সি-এস আর হেমন্ত আই-ই-এস-এ ঢুকে সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে চাকরি-মোহগ্রস্ত বাঙালীর সামনে আদর্শ দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন।

১৯১৩ সালের ১ মার্চ সুভাষচন্দ্র আর হেমন্তদের ম্যাট্রিক পরীক্ষা শুরু হয়। দুজনেই তাঁদের এই নূতন বন্ধুত্বের আর নতুন জীবনের আলোড়নে পড়াশুনায় তেমন মন দিতে পারেন নি। সুভাষচন্দ্র তো তারও আগে থেকেই পড়াশুনায় অমনোযোগী হয়ে গিয়েছিলেন। তৎসত্ত্বেও সুভাষ ৭০০-র মধ্যে ৬০৯ নম্বর পেয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। পরীক্ষার পর আগের পরিকল্পনা মত সুভাষচন্দ্র কিছুদিনের জন্য হেমন্তের কাছে কৃষ্ণনগরে যান।

কলকাতার দলের কয়েকজন সদস্যও সেখানে আসেন এবং তাঁরা সদলবলে পলাশী, মুর্শিদাবাদ ইত্যাদি ঐতিহাসিক স্থানগুলি দেখতে বের হন। পলাশীতে তাঁরা দেখতে পান যে সেই আম্রকানন আর নেই আর লর্ড কার্জনের আদেশে বিজয় স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। হেমন্ত নবীনচন্দ্র সেনের “পলাশীর যুদ্ধ” আবৃত্তি করতে করতে যখন নবাব সিরাজদৌল্লার সেনাপতি মোহনলালের মুখনিঃসৃত অংশে আসেন তখন সুভাষচন্দ্র আর চোখের জল চেপে রাখতে পারেন না। তাঁর দলের সেই ভ্রমণ সাতদিনে সমাপ্ত হয়েছিল।

এরপর সুভাষচন্দ্র কলকাতায় এসে তাঁর বড় দাদাদের মত প্রেসিডেন্সি কলেজে আই এ ক্লাসে ভর্তি হলেন ১৯১৩ সালের জুলাই মাসে। তখন তাঁর বয়স সাড়ে ষোল। ভর্তি হওয়ার সাথে সাথেই তিন মাসের গ্রীষ্মের বন্ধ হয়ে যায়। সেই তিন মাসে তিনি কলকাতার সেই দলটাকে খুঁজে বার করলেন আর পছন্দমত কিছু নতুন বন্ধুও জুটিয়ে ফেললেন। কটকের পরিবেশ আর কলকাতার পরিবেশে আকাশ-পাতাল পার্থক্য।

অবশ্য এর প্রায় বছর দেড়েক আগে স্বদেশী আন্দোলনের জোয়ার সমাপ্ত হয়েছে। বঙ্গভঙ্গ রদ হয়েছে তবে তার জন্য বঙ্গ প্রদেশকে (বাংলা প্রেসিডেন্সিকে) অনেক খেসারত দিতে হয়েছে। হিন্দী-উড়িয়া-অসমীয়া-ভাষী অঞ্চলগুলোকে বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে আর ব্রিটিশ-ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। তবে এই স্বদেশী আন্দোলন স্বাধীনতা সংগ্রামকে এক নতুন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল এবং এজন্য সশস্ত্র বিপ্লব আন্দোলনের তৎপরতাও বৃদ্ধি পেয়েছিল।

সুভাষের আত্মজীবনী থেকে জানা যায় যে এসময় সুভাষচন্দ্র শ্রীঅরবিন্দের লেখা ও চিঠিপত্র পড়ে তাঁর প্রতিও আকৃষ্ট হয়েছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের কিছু ছাত্রদের মধ্যেও এই বিপ্লবী চিন্তাধারা সক্রিয় ছিল। কিন্তু সুভাষচন্দ্র কলকাতায় এসেছিলেন মানবসেবা আর আধ্যাত্মিক উন্নতির সঙ্কল্প নিয়ে, যদিও তাঁর মধ্যে বিপ্লবীদের প্রতি সহানুভূতি ছিল এবং স্বদেশচিন্তা তাঁকে গভীরভাবে আলোড়িত করত। আত্মজীবনীতে সুভাষচন্দ্র লিখে গেছেন, ‘কলেজ-জীবনে প্রবেশ করবার সময় জীবন সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা জন্মে গিয়েছিল। বুঝেছিলাম যে জীবনের একটা উদ্দেশ্য আছে এবং এই উদ্দেশ্য সফল করার জন্য নিয়মিত শরীর ও মনের অনুশীলনের প্রয়োজন।’

এসময় তাঁর সাথে কয়েক মাস আগে প্রয়াত বিখ্যাত কবি, নাট্যকার, গীতিকার, স্বদেশী-সংগীতস্রষ্টা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র দিলীপ কুমার রায়ের বন্ধুত্ব হয়। দিলীপ কুমার রায় সুভাষচন্দ্রের সমবয়সী ছিলেন এবং সেবছরই প্রেসিডেন্সি কলেজে আই-এস-সি ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলেন। তাঁরা কাছাকাছিই থাকতেন। সুভাষ একদিন দিলীপকুমারের বাড়ীতে এসে দিলীপকুমারকে তাঁর উদ্যোগে কলেজে সদ্য প্রতিষ্ঠিত বিতর্কসভায় যোগ দেবার জন্য আমন্ত্রণ জানান। সেই প্রথম পরিচয়ের বর্ণনা খুবই সুন্দর।

সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন যে, আমাদের দেশে তর্ক-বিতর্কের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে কারণ স্বাধীনতার জন্য বড় বড় বক্তার, বাক-যোদ্ধার খুব প্রয়োজন। শ্রী দিলীপকুমার রায় তাঁর “আমার বন্ধু সুভাষ” বইতে লিখেছেন যে তিনি বলেছিলেন, রামকৃষ্ণ তো বলে গেছেন তর্ক দিয়ে সত্যের সন্ধান পাওয়া যায় না। সুভাষচন্দ্র উত্তরে বলেছিলেন, “তিনি কি বলেছিলেন তাতে আমাদের দরকার কি? ... আমাদের গড়ে তুলতে হবে ভবিষ্যৎকে। কেন, আপনার বাবা কি বলেননিঃ ‘চোখের সামনে ধরিয়া রাখিয়া অতীতের সেই মহা আদর্শ, জাগিব নূতন ভাবের রাজ্যে রচিব প্রেমের ভারতবর্ষ?” দিলীপকুমার আশ্চর্য হয়ে জানতে চেয়েছিলেন, ‘তাঁর কবিতা আপনার মনে আছে?’ উত্তরে সুভাষের দৃষ্টি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। তিনি বলেছিলেন, “অন্তরে গাঁথা আছে।”

সুভাষের দলের সকলেই ব্রহ্মচর্যের ব্রত নিয়েছিলেন। দলের প্রধান লক্ষ্য ছিল ধর্ম আর জাতীয়তাবাদের সমন্বয় ঘটানো – শুধু চিন্তায় নয় কাজের মাধ্যমে। তাঁর দলের ছেলেরা নতুন নতুন ভাবধারার সন্ধানে দর্শন, ইতিহাস, জাতীয়তাবাদের উপর বই খুঁজে খুঁজে পড়তেন এবং নিজেদের মধ্যে তা আলোচনা করতেন। তাছাড়া নতুন সদস্য সংগ্রহ করতেন এবং নামকরা লোকদের সাথে আলাপ পরিচয় করতেন। এছাড়া সাধু-সন্তদের সন্ধানে থাকা এবং ছুটির সময় তীর্থস্থানে তাঁদের সন্ধান করাও একটা কাজ ছিল। ১৯১৩ সালে বড়দিনের ছুটিতে তাঁরা দলবেঁধে গিয়ে কলকাতা থেকে ৫০ মাইল দূরে শান্তিপুরে কিছুদিন গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী হয়ে বাস করেছিলেন। ১৯১৪ সালে তাঁরা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সাথেও দেখা করতে গিয়েছিলেন। বেলুড় রামকৃষ্ণ মঠ ও অন্যান্য জায়গায় প্রায়ই যেতেন। দক্ষিণ কলকাতার অনাথ ভাণ্ডার দরিদ্র সেবা প্রতিষ্ঠানের জন্য রবিবার বাড়ি বাড়ি ঘুরে অর্থ ও চালডালও সংগ্রহ করেছেন।

সেসময় কলেজে অধ্যাপকদের পড়ানো সুভাষচন্দ্রের একঘেয়ে লাগতো। এই একঘেয়েমি কাটানোর জন্য জনহিতকর কাজে মেতে থাকতেন। বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা, বন্যা বা দুর্ভিক্ষপীড়িতদের জন্য টাকা তোলা, সহপাঠীদের নিয়ে বেড়াতে যাওয়া–এই ধরণের কাজ তাঁর ভালো লাগত। প্রথম বছরের কলেজের ছুটিতে কটক গিয়ে কাছের একটা গ্রামে কলেরা হওয়ায় সে গ্রামে রোগীর শুশ্রূষা করতেও যান। সেই এক সপ্তাহে তিনি দেশের দারিদ্র্য, মৃত্যুর তাণ্ডবলীলা আর নিরক্ষরতার অভিশাপ প্রত্যক্ষ করেন। কলকাতায় ফিরে এসে ষাট মাইল দূরে কৃষ্ণনগরে এক উদাসী পাঞ্জাবী শিখ তরুণ সাধুর সন্ধান পেয়ে হেমন্তকে নিয়ে পায়ই তাঁর কাছে যেতে শুরু করেন। সেই সন্ন্যাসীকে দেখে সুভাষের মনে দীক্ষা নেবার ইচ্ছা জাগে।

১৯১৪ সালের গরমের ছুটির সময় সুভাষচন্দ্র প্রায় দুমাস গুরু খুঁজতে উত্তর ভারতের প্রায় সবকটা তীর্থস্থান ঘুরে বেড়ান। বাড়িতে শুধু একটা পোস্টকার্ড পাঠিয়ে জানিয়েছিলেন মাত্র। এই তীর্থভ্রমণের সময় হিন্দু সমাজব্যবস্থার মূল গলদগুলি তাঁর কাছে ধরা পড়ে। অবশ্য অনেক প্রকৃত ধার্মিক সন্ন্যাসীরও দর্শন পান। সেখান থেকে ফিরে এসে কিছুদিনের মধ্যেই সুভাষচন্দ্র টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হন। সেবার তাঁর ৬৩ দিন জ্বর ছিল। জ্বর সেরে গেলে সুভাষচন্দ্র স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে কার্সিয়াং গিয়ে এক মাস থেকে আসেন। এরপর ১৯১৪ সালের নভেম্বর মাসে হেমন্ত ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়াতে আক্রান্ত হন এবং সুভাষ কৃষ্ণনগরে গিয়ে বন্ধুর সেবা করেন। এসব গোলযোগে পড়াশুনার ব্যাঘাত হওয়ায় ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার ফল ভাল হলনা। তবুও ১৯১৫ সালে তিনি ফার্স্ট ডিভিশনে আই এ পাশ করেছিলেন এবং দর্শনে অনার্স নিয়ে একই কলেজে বি এ ভর্তি হলেন।

কৈশোরে সুভাষচন্দ্র বসু

১৯১৬ সালের জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাস সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনে একটা তাৎপর্যপূর্ণ সময়। তখন তাঁর বয়স ১৯ বছর। ঘটনাটা সবার জানা। অনেকেই এই সম্বন্ধে বিস্তারিত লিখেছেন। তাই খুব সংক্ষেপে সেই ঘটনাটার বিবরণ দিয়ে এই লেখাটা শেষ করব। প্রেসিডেন্সি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন এডওয়ার্ড ফারলে ওটেন। এই ইংরাজ অধ্যাপক ছিলেন I.E.S. (ইন্ডিয়ান এডুকেশান সার্ভিসের সদস্য) এবং বর্ণবিদ্বেষী। তিনি ১৯১৫ সালে ইডেন হিন্দু হোস্টেলে আমন্ত্রিত হয়ে ভাষণ দেন এবং সেই বক্তৃতায় ভারতীয়দের সম্বন্ধে খারাপ মন্তব্য করেন। অসন্তুষ্ট হলেও তাঁকে সভাপতি করে ডেকে আনা হয়েছে বলে ছাত্রেরা সেদিন কোন গোলযোগ করেনি। কিন্তু ১০ জানুয়ারি ১৯১৬ তারিখে তিনি কয়েকজন ছাত্রকে কলেজের বারান্দায় ধাক্কা দেন।

ছেলেরা যেহেতু থার্ড ইয়ার অর্থাৎ বি এ ফার্স্ট ইয়ারের ছিল এবং সুভাষচন্দ্র সেই ক্লাসের প্রতিনিধি ছিলেন, তিনি অধ্যক্ষ মিঃ এইচ আর জেমসের কাছে গিয়ে প্রতিবাদ জানান। অধ্যক্ষ মিঃ জেমস জানান, যেহেতু অধ্যাপক ওটেন ইন্ডিয়ান এডুকেশান সার্ভিসের সদস্য তাই তিনি অধ্যাপক ওটেনকে শাসন করতে পারবেন না। পরদিন ছাত্ররা ধর্মঘট শুরু করে এবং ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিন কর্তৃপক্ষ ওটেনকে চাপ দিলে ওটেন ছাত্র প্রতিনিধিদের সাথে কথা বলে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলেন। কিন্তু প্রায় একমাস পর ওটেন একই কাজ করে ফেলেন।

যদিও সেবারের ছাত্রটি আই এ ফার্স্ট ইয়ারের ছিল, সুভাষচন্দ্র ছাত্র-প্রতিনিধিদের মিটিংয়ে জানান, এই অধ্যাপককে এভাবে শোধরানো যাবে না এবং তাকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে। ছাত্র-প্রতিনিধিদের সভায় তাঁর এই প্রস্তাব অনুমোদিত হয় এবং পরদিন, ১৫ই ফেব্রুয়ারি ১৯১৬, মিঃ ওটেন কলেজের করিডোরে প্রহৃত হন। এই ঘটনার জন্য সুভাষচন্দ্র এবং শ্রী অনঙ্গ মোহন দাম কলেজ ও ইউনিভারসিটি থেকে বহিষ্কৃত হন। যদিও সুভাষচন্দ্র নিজে মিঃ ওটেনকে প্রহার করেননি, তিনি নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে চুপ করে থাকেন। সত্যি বলে দায়িত্ব এড়িয়ে বহিষ্কার এড়াতে রাজি হন না।

নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ছোটবেলায় প্রথমে তিনি ইংরেজি শিক্ষা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসেছেন এবং ইংরেজদের সঙ্গে মিশেছেন। তারপর তিনি নিজের দেশের সংস্কৃতির সঙ্গেও পরিচিত হন। যখন তিনি স্কুলে পড়েন তখন বিভিন্ন প্রদেশের ছেলেদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। মুসলমানদের সম্বন্ধে উদারতার জন্য তাঁর ছেলেবেলার অভিজ্ঞতাই বহুল পরিমাণে দায়ী। তাঁদের কটকের বাড়ী ছিল মুসলমান এলাকায় এবং প্রতিবেশীরা বেশীরভাগই ছিল মুসলমান। তাঁর বাবাকে সবাই খুব শ্রদ্ধা করতেন।

তাঁরাও মুসলমানদের উৎসব অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন। তাঁদের বাড়ীর কাজের লোকেরা অনেকেই মুসলমান ছিলেন এবং তাঁরাও সুভাষচন্দ্রদের খুব অনুরক্ত ছিলেন। স্কুলে মুসলমান শিক্ষক আর ছাত্রদের সাথেও তাঁদের খুব সৌহার্দ্য ছিল। মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করা ছাড়া কোন ব্যাপারেই তিনি কোন প্রভেদ দেখতেন না। এই জন্যই আজাদ হিন্দ ফৌজে হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খ্রিষ্টান-সব ধর্মাবলম্বীরা এক হয়ে ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পেরেছিল।

বাল্যকাল আর কৈশোর ছিল সুভাষচন্দ্রের প্রস্তুতির সময়। যে দেশপ্রেম তাঁর পরবর্তী জীবনে প্রস্ফুটিত হয়েছে, তার ব্যাপকতা, গভীরতা, বিস্তীর্ণটা ইত্যাদি বুঝতে হলে তাঁর বাল্যকাল আর কৈশোরকে ভাল করে জানতেই হবে। যারাই নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনী অধ্যয়ন করেছেন তাঁরাই একমত হবেন যে তিনি এই উপমহাদেশের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক।

পূর্বেই বলেছি, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর মধ্যে কোন প্রাদেশিক, ধার্মিক বা জাতপাতের সঙ্কীর্ণতা ছিল না। তিনি মনে করতেন, ধর্ম যার যার নিজস্ব ব্যাপার। তিনি নিজেকে সম্পূর্ণভাবে দেশের জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন এবং তাঁর এই দেশপ্রেম কৈশোরেই অঙ্কুরিত হয়েছিল। এমনকি তিনি যে আই.সি.এস পাস করে তা থেকে পদত্যাগ করবেন তাও সেই কৈশোরেই স্থির করে ফেলেছিলেন। বালক-কিশোর সুভাষচন্দ্রই পরে নেতাজী হয়ে আমাদের দেশকে ইংরেজের হাত থেকে স্বাধীন করেছিলেন।

সেসময়কার ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এ্যাটলি নিজমুখে একথা স্বীকার করে গেছেন। শুধু দুঃখের কথা এই যে কিছু স্বার্থান্বেষী নেতার জন্য যে অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন নেতাজী দেখেছিলেন, তা পূরণ করা সম্ভব হয়নি। আজ এত বছর পর নেতাজীর আকাঙ্ক্ষিত বৃহত্তর ভারতের প্রয়োজনীয়তা কিছুটা হলেও আমরা উপলব্ধি করতে পারছি। নেতাজীর জীবনযাপন, চিন্তাভাবনা, কার্যকলাপ সব একটি মাত্র আবেগ দ্বারাই সঞ্চালিত হয়েছে এবং তা হচ্ছে দেশপ্রেম।

অহিংসার পূজারি গান্ধীজী পর্যন্ত তাঁকে “Patriot of Patriots” আখ্যা দিতে বাধ্য হয়েছেন। নেতাজীর দেশপ্রেম নেলসন ম্যান্ডেলা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং আরও অনেককে অনুপ্রাণিত করেছে। আজও ভারতবাসী এবং বাঙালী নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর তুলনাহীন দেশপ্রেম থেকে অনুপ্রাণিত হন। যতদিন মানবজাতি থাকবে এবং দেশপ্রেম আলোচিত হবে, ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জনক নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর নাম পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হবে। জয়তু নেতাজী।।

লেখক: সাবেক কুটনীতিক ও ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু, নয়াদিল্লি; ভারত। ইমেল: [email protected]

;