মানুষ একটি চতুষ্পদ জন্তু



প্রিন্স আশরাফ
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

ইদানীং শামসাদ আজাদের মনে হয় মানুষ একটি চতুষ্পদ জন্তু, চারিদিকে চোখকান খোলা রাখলেই তা টের পাওয়া যায়। জন্মগতভাবেই চারপেয়ে মানুষ জোর করে দুপেয়ে মানুষ হয়ে নিজেকে একটা ঝামেলাযুক্ত অবস্থানে নিয়ে গেছে। শামসাদ আজাদের এই চারপেয়ে অনূভূতি শুরু হয় সকালে পত্রিকা নিয়ে হাইকমোডে বসার পর থেকেই। পত্রিকার নৈর্ব্যক্তিক খবরগুলোর সাথে দীর্ঘদিনের কোষ্ঠকাঠিন্য মিলিয়ে তার মনে হয় চারপেয়ে জন্তু হলে তাকে এখন এই অদ্ভুত দুপেয়ে পজিশনে বসে পত্রিকা পড়তে পড়তে মলত্যাগের জন্য অপেক্ষা করতে হতো না, চারপেয়ে জন্তুরা শারীরিক গঠনগত কারণেই স্বাভাবিকভাবে মলত্যাগ করে, কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগে না।

দেশের সবচেয়ে নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শুধুমাত্র ভিন্নমত প্রকাশের ধারণায় একটা তরতাজা প্রাণকে তারই সহপাঠী শিক্ষার্থীরা রাতভর নির্যাতন করে মেরে ফেলার ঘটনা পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় দেখে এবং পড়ে শামসাদ আজাদের না হওয়া মলত্যাগ বন্ধ হয়ে গেল। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে বাবা চাচারাই পাঁচ বছরের ছোট্ট শিশুর নাক, কান, লিঙ্গ কেটে সেই ধারালো অস্ত্র দুখানিই নৃশংসভাবে পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে শিশুটিকে গাছে ঝুলিয়ে দিয়েছে। খুন, ধর্ষণ, নৃশংসতার অসংখ্য ঘটনাসহ মানুষের ভেতরের পশু প্রবৃত্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে দেখলে শামসাদের নিজেকেও চতুষ্পদী জন্তু বলে মনে হতে থাকে।

শামসাদ আজাদ হাই কমোডের ওপর বসা অবস্থা থেকেই হামাগুড়ি দিয়ে বাথরুমের মেঝেতে দুহাত সামনের পায়ের মতো ব্যবহার করে যেন সেই সূদূর শৈশবে ফিরে গেলেন। বাথরুমের দরজা খোলাই থাকে তার, একা বাসায় বাথরুম লকের দরকার হয় না, তাছাড়া বাথরুম লক করলে তার সাফোকেশন হয়ে মগজের অক্সিজেন কমে যায়, এর আগেও তিনি মগজে অক্সিজেনের ঘাটতির কারণে বাথরুমে পড়ে দুদুবার মাথা ফাটিয়ে হাসপাতালে গেছেন। সেই কারণে কাজের ছেলের ওপর দায়িত্ব আছে যাতে তিনি বাথরুম লক না করেন। শামসাদ আজাদ খুব সহজে বাথরুমের ভেজানো দরজা টান দিয়ে খুলে ফেললেন। দুরুমের ফ্লাট বাড়িতে তাকে দেখভালের জন্য বছর ষোল সতেরোর মজনু মিয়া তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী। মজনু মিয়া তখন সকালের সাহেবী ব্রেকফাস্ট পুরানো কাঠের ডাইনিং টেবিলে সাজানোতে ব্যস্ত থাকলেও মজনুর মন পড়েছিল মোবাইলের রিংটোনের শব্দের দিকে। এই সময় তার কয়েকটা মিসড কল আসবে, কয়েক বাসা পরের হাউজমেইড লাবণীর মোবাইল থেকে। শুধুমাত্র লাবণীর কারণেই সে এই আধবুড়োর বাসায় মুখ গুঁজে পড়ে আছে।

মোবাইলের রিংটোনের শব্দের জন্য উৎকীর্ণ থাকায় মজনু মিয়া বাথরুমের দরজা খোলার শব্দ শুনতে পেয়ে স্যার যে বেরিয়ে এসেছেন এটা বুঝতে পারলেও প্রথমে পাত্তা দিল না। কিন্তু যখন ডাইনিং থেকে বাথরুমের দিকে তাকিয়ে মানুষটাকে দেখতে পেল না তখন একটু অবাক হলো। মানুষটা শব্দ করে বাথরুমের দরজা খুলল অথচ নেই হয়ে গেল কিভাবে? তখনই ডাইনিং টেবিলের পায়ের কাছে মানুষের গলা শুনে মজনু মিয়া এরকম চমকাল যে তার হাতে থাকা জুসের গ্লাস থেকে ছলকে একটুখানি জুস ডাইনিং টেবিলের ওপর পড়ল।
‘মজনু, সকালের নাস্তা যা বানিয়েছিস ওসব ডিম মামলেট টামলেট সব অফ। আমি এখন শাকপাতা খাব।’
মজনু এমনিতেই স্যারকে চার হাতপায়ে এক বছরের বাচ্চার ভঙ্গিতে হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটতে দেখে এত হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল যে সে স্যারের কথা কিছু বুঝতে পারল না। শুধু বিড়বিড় করে বলল, ‘স্যার, শাকটাক কিছু কেনা নেই স্যার। বাজার করতে হবে।’
‘ওকে। ঠিক আছে। চারপেয়ে জন্তুরা যে শুধু ঘাসলতাপাতা খায় তা নয়, ওরা সব খায়। ঠিক আছে, তুই ডাইনিংয়ে যা খাবার দিয়েছিস তা আমার মুখের সামনে টেবিলের নিচে দে। এখানেই খাওয়ার কাজটা সেরে ফেলি। চারপাওয়ালারা ডাইনিং টেবিলে খায় না।’

শামসাদ আজাদ খাবারের লোভে মুখ থেকে কুকুরের মতো জিহবা বের করেই রাখলেন। মজনু কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। রান্নাঘরে মোবাইলের রিংটোন বেজেই চলেছে, কিন্তু মোবাইল ধরার মতো মনের অবস্থা এখন নেই। মজনু স্যারের দ্বিতীয়বার ধমক খেয়েই পাউরুটি, জেলি, ডিম মামলেট ও জুসের গ্লাস কাঁপা কাঁপা হাতে নিচে দিতে দিতে বলল, ‘স্যার, বাজার থেকে শাকপাতা কিনে নিয়ে আসি?’
শামসাদ আজাদ পাউরুটির ওপর লাগানো জেলি বিড়ালের মতো করে জিহবা দিয়ে একমনে চাটতে চাটতে মজনুর দিকে না তাকিয়েই বললেন, ‘যা, যা, শিগগিরই যা। টাটকা দেখে শাকসবজি নিয়ে আসবি। ফরমালিন দেওয়া ছ্যাতা পড়া না। চারপেয়েরা সব টাটকাই খায়, জানিস না?’

মজনু মিয়া মোবাইলটা হাতে নিয়ে এত দ্রুত ফ্লাটের বাইরে চলে এলো যে স্যারের কাছ থেকে বাজারের টাকাটা নিতেও ভুলে গেল। অন্য সময় এই বাজারের টাকা থেকেই তার দুপাইস ইনকাম হয়, তাতে হাতখরচ, মোবাইল খরচ উঠে আসে। এমনকি লাবণীর তিনটে মিসড কল দেখেও সে কলব্যাকের দিকে না গিয়ে সরাসরি খালাম্মার নাম্বারে ফোন দিল। খালাম্মাকে এরকম হুটহাট কল দেওয়ার কড়া নিষেধ আছে। স্যারকে ছেড়ে স্যারের বিপত্নীক বন্ধুর সাথে সংসার করায় যখন তখন কেউ খালাম্মাকে ফোন দিয়ে জ্বালায় না। বলা আছে, শুধুমাত্র ইর্মাজেন্সি বা অসুখ-বিসুখেই মজনু মিয়া ফোন করতে পারবে। মজনুর মনে হয় এরচেয়ে ইর্মাজেন্সি বোধ হয় হার্ট এ্যাটার্ক করলেও হয় না। খালাম্মা ওপাশে ফোন ধরতেই মজনু তোতলাতে তোতলাতে কোনমতে বলল, ‘খালাম্মা, স্যার কেমন জানি করতেসে!’

খালাম্মা আফরোজা তখন নতুন স্বামীর প্লেটে রাইস তুলে দিচ্ছিলেন, কিন্তু রাইসের চামচ প্লেটের ওপরে গিয়েই থেমে গেল। কানের কাছে ধরা মোবাইলে আতঙ্কিত গলায় বললেন, ‘কী হয়েছে? আবার বাথরুমে পড়ে গিয়ে মাথা ফাটিয়েছে?’
‘না খালাম্মা। কুকুর বেড়ালের মতো কেমন করে জানি চার হাতপায়ে হামাগুড়ি দিয়ে ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। খাবারও খাচ্ছে জিব দিয়ে চেটে চেটে, কুকুর বেড়ালে যেরকম করে খায়। আমি খুব ভয় পাইছি খালাম্মা। আপনি একটু এসে দেখে যান।’

খালাম্মার স্বামী জাফর, যে শামসাদের ভূতপূর্ব বন্ধুও, খাওয়ার প্লেটে হাত গুটিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। স্ত্রীর ফোনে কথা বলা শেষ হলে বললেন, ‘শামসের কী হয়েছে? হার্ট এ্যার্টাক? স্ট্রোক? এক্সিডেন্ট?’
‘কী বলল মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারলাম না। বলল, ঘরজুড়ে নাকি হামাগুড়ি দিয়ে চারপেয়ে জন্তুর মতো হাঁটাহাঁটি করছে।’
‘নতুন কোনো ব্যায়াম ট্যায়াম?’ জাফর প্লেটেই হাত ধুয়ে উঠে পড়লেন। ‘আমার মনে হয় আমাদের এখুনি গিয়ে ব্যাপারটা কী দেখা উচিত?’
‘তোমার না আজ একটা ক্লায়েন্ট মিটিং ছিল?’ আফরোজারও খাওয়ার রুচি নেই, ডাইনিংয়ে খাবার ঢাকা দিতে দিতে বললেন।
‘বাদ দাও, অন্যরা সামলে নেবে। আগে শামসের কী হলো দেখা দরকার। তুমি তার প্রাক্তন স্ত্রী হলেও তার আগে ও আমার বন্ধু। চলো এখনি বেরিয়ে পড়ি।’ জাফর একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘তোমার ছেলেদেরও ব্যাপারটা জানানো দরকার। বাবার ব্যাপার।’
‘হুম।’ আফরোজা একটু গম্ভীর স্বরে বললেন। ‘জানাব। তার আগে চলো আমরাই গিয়ে দেখি ব্যাপারটা কী? না হলে ওদের জানাবটা কী? নিজেই যখন জানি না।’

জাফর নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে আফরোজাকে সাথে নিয়ে সারি সারি এপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের শামসাদের এপার্টমেন্টের সামনে এসে দেখলেন মজনু মিয়া দরজার বাইরে পাংশু মুখে দাঁড়িয়ে আছে। দুজনে মজনুর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ব্যাপার? তুই এভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’
‘ভেতরে যেতে ভয় করছে খালাম্মা।’ মজনু কাঁপা কাঁপা গলায় বলল। আফরোজা দরজার দিকে এগিয়ে ধাক্কার দেওয়ার আগেই মজনু বলল, ‘সাবধানে ধাক্কা দেন। স্যার দরজার কাছে হামাগুড়ি দিয়ে থাকতে পারে।’
আফরোজা আর দরজা ধাক্কা দেওয়ার ঝামেলায় না গিয়ে কাঁপা কাঁপা স্বরে প্রাক্তন স্বামীর নাম ধরে ডাক দিলেন, ‘সামু, সামু?’ পাশ থেকে জাফরও গলা চড়ালেন, ‘শামস? শামস?’
ভেতর থেকে একবারে শান্ত গলা ভেসে এলো। ‘দরজা খোলাই আছে, ভেতরে আয়। মজনু মিয়া দরজা খুলে রেখে বাজার করতে গেছে। আমি আর দরজা লাগাতে পারছি না।’
দুজনে খুব সাবধানে দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেললেন। স্বাভাবিকভাবেই মানুষের চোখ চোখের সমান্তরালে মানুষ খোঁজে। ওরাও সোজাসুজি তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলেন না। তখনই দরজার একপাশে হামাগুড়ি দেওয়া মানুষটাকে এবং তার কণ্ঠস্বরও শুনতে পেলেন। ‘চারপেয়ে হয়ে বেশ আছি। দুপায়ে দাঁড়াতেই এখন আমার বেশি কষ্ট হয়!’
জাফর একটু বিরক্ত স্বরেই বললেন, ‘তুই কি ওভাবেই হামাগুড়ি দিয়ে আমাদের সাথে কথা বলবি নাকি?’
আফরোজার চোখ ততক্ষণে ডাইনিংয়ের নিচের খাবারের প্লেট এবং ছড়ানো ছিটানো খাবার ও উচ্ছিষ্টগুলোর দিকে চলে গেছে। তিনি ভয়ে ভয়ে পেছনে ঢোকা মজনুর দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বললেন, ‘এখান থেকে এগুলো সব পরিষ্কার কর। আমি দেখি ভেতরের ঘরে কোনো ঝামেলা পাকানো আছে কিনা?’ প্রাক্তন স্বামীর সামনে থেকে সরে যাওয়াই আফরোজার মূল উদ্দেশ্য।

জাফরের পায়ের কাছে হামাগুড়ি দিয়ে চলে আসা শামসাদ আজাদ খুব স্বাভাবিকস্বরে বললেন, ‘তুই আরাম করে সোফায় বস। আমি দুপায়ে দাঁড়িয়ে বসছি।’ তিনি দুপায়ে দাড়িয়ে জাফরের মুখোমুখি সোফায় বসতে বসতে বললেন, ‘দুপায়ে দাঁড়ানোটা প্রকৃতিবিরুদ্ধ কাজ। আমরা মানুষেরা সবসময় সেই কাজটাই করে যাচ্ছি। একারণেই প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তার ফলস্বরূপ এই মারামারি, কাটাকাটি, হানাহানি, হিংসা দ্বেষ। আজ সকালের পেপার দেখেছিস?’
‘হু। চোখ বুলিয়েছি। একটা মিটিং ছিল। মিস দিলাম।’
‘দেখিসনি একটা মেধাবী ছেলেকে কিভাবে তার হলের বন্ধুরা, বড়ভাইরা মিলে সারারাত ধরে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। দুপেয়ে হয়েই এভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলা সম্ভব হয়েছে। চারপেয়ে হলে হতো না। চারপেয়েরা প্রয়োজন ছাড়া কাউকে হত্যা করে না।’

জাফর একটু বিরক্ত হলেন। বন্ধুর মাথা আগে থেকেই একটু অন্যরকম ছিল, এখন আরো বেড়েছে মনে হয়, সে কারণেই তো আফরোজা এই শেষ বয়সে এসেও আর ওর ঘর করতে পারল না, অথচ দোষটা গিয়ে পড়ে তার ওপরে। যত্তসব। এখন ক্লায়েন্ট মিটিং বাদ দিয়ে এই পাগলের সাথে বসে দুপেয়ে চারপেয়ে পার্থক্য শুনছে। যত্তসব!

‘চারপেয়ের সবচেয়ে বড় সুবিধে কী জানিস? ব্যালেন্স! খুব চমৎকার ব্যালেন্স হয়। আমার মনে হয় এই ব্যালেন্স শুধু শারীরিক নয়, প্রাকৃতিকও। সবাই চারপেয়ে থাকলে প্রাকৃতিক ব্যালেন্স ঠিকঠাক থাকত। আমার তো মনে হয়, প্রকৃতির সব নিয়ম ঠিকঠাক মানলে আমরা সবাই আবার চারপেয়ে হয়ে যাব। আমাকে দিয়েই ধর না, আমি তো ধীরে ধীরে চারপায়ে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। আর এটা অভ্যস্ততার কি আছে? আমরা জন্মেছিলাম চারপেয়ে, জোর করে দুপেয়ে হয়ে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করেছি। এখন প্রকৃতিই ভারসাম্য রাখতে আবার আমাদেরকে চারপেয়ে করতে চাচ্ছে। আমি প্রকৃতির সেই তাল রক্ষার চেষ্টা করছি।’ বলেই শামসাদ আবার সোফা থেকে হামাগুড়ি দিয়ে নেমে গেলেন নিচে। জাফরের পায়ের কাছে এসে মুখ তুলে ফিসফিস করে বললেন, ‘আমরা সঙ্গমও করি চারপেয়ে তাই না? চতুষ্পদী জন্তুর মতো। হা হা হা!’

জাফরের অসহ্য লাগছিল। এখনো গাড়ি টেনে গেলে ক্লায়েন্ট মিটিংয়ে এটেন্ড করা যাবে। তাহলে বসে বসে এই পাগলের প্রলাপ শুনতে হবে না। ওর প্রাক্তন স্ত্রী শুনতে চাইলে শুনুক। ইচ্ছে করলে ওরা চারপেয়ে হয়ে সঙ্গমও করতে পারে, আগে তো অসংখ্যবার করেছে। যা ইচ্ছে তাই করুক। জাফর খোলা দরজা দিয়ে কাউকে কিছু না বলে গটগট করে বেরিয়ে গেলেন।

আফরোজা ভেতরের রুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখেন শামস হামাগুড়ি দিয়ে ঘরময় ছুটে বেড়াচ্ছে। জাফর বেরিয়ে গেছে। একটু যেন স্বস্তি পেলেন তিনি। যত যাই হোক, বর্তমান স্বামীর সামনে প্রাক্তন স্বামীকে নিয়ে আদিখ্যেতা দেখানো যায় না। আফরোজা নিজেও বসে প্রায় হামাগুড়ির ভঙ্গিমায় প্রাক্তন স্বামীর মুখোমুখি হয়ে গায়ে মাথায় কপালে হাত দিয়ে নরোম স্বরে বললেন, ‘তোমার শরীর তো ঠিকই আছে মনে হচ্ছে, তাহলে এরকম করছো কেন?’
শামস স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আহবানের স্বরে বললেন, ‘চারপেয়ে হওয়ার পরে আমি খুব ভালো আছি। তুমিও আমার মতো চারপেয়ে হয়ে দেখ শরীরে অদ্ভুত একটা ব্যালেন্স চলে আসবে। মনে হবে শরীরে কোনো রোগব্যাধি নেই, ছিলও না।’
‘না বাবা, আমি তোমার মতো ওরকম করতে পারব না। পুরুষ মানুষ যা পারে নারীরা তা পারে না।’
‘পারে, পারে। চারপেয়ে হয়ে গেলেই পারে। তখন এই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, মান-অপমানবোধ, হিংসা-দ্বেষ, ঈর্ষা কোনো কিছুই আর মাথাচাড়া দিয়ে দাঁড়াতে পারে না। মাথা উঁচু করে দাঁড়ালেই কেবল আমাদের মধ্যে হিংসা-দ্বেষও মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। এবং তখনই যত বিপত্তি ঘটতে থাকে। চারপেয়ে হয়ে গেলে তখন আর আমাদের মধ্যে এইসব মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে না। এবং এই ঘটনাগুলোও ঘটবে না। বন্ধুরা তখন পিটিয়ে বন্ধুদের মেরে ফেলবে না। এই ধরো, এখন আমি হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটছি, আমার মধ্যে কোনো রাগ ক্ষোভ নেই। জাফর যে আমার কাছ থেকে তোমাকে ফুসলিয়ে নিয়ে গেছে দুপেয়ে অবস্থায় থাকলে আমি ওকে কস্মিনকালেও আমার এই ঘরে ঢুকতে দিতাম না, কিন্তু চতুষ্পদী হয়ে ওর ওপরে আমার কোনো রাগ ক্ষোভ নেই। যেমন তোমার ওপরেও আমার কোনো মান অভিমান রাগ-ক্ষোভ-দ্বেষ কোনো কিছুই নেই। তোমাকে সহজেই ক্ষমা করে দিয়েছি। চারপেয়ে হলেই সবাইকে সহজে ক্ষমা করে দেওয়া যায়।’

আফরোজা কিছুই বললেন না। চুপ করে রইলেন। ওকে ছেড়ে যাওয়াটাই কি এই মস্তিষ্ক বিকৃতির কারণ? নাকি এগুলো আগেই ভেতরে চাপা দেওয়া ছিল, তিনি ছেড়ে চলে গেছেন বলেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে? ভালো ডাক্তার দেখাতে হবে। তার আগে সামর্থ্যবান, আলাদা আলাদা এপার্টমেন্ট নিয়ে থাকা দুই সংসারী ছেলেকেও ব্যাপারটা জানাতে হবে। হাজার হোক তাদের বাবা তো!

আফরোজা শামসের গায়ে মুখে একটু হাত বুলাতেই শামস চতুষ্পদী জন্তুর মতো গরগর শব্দ করে আদর খেতে লাগলেন। আফরোজা একটু বিরক্ত হলেও মুখে হাসি ঝুলিয়ে রেখে বললেন, ‘তুমি কি সারাদিন এভাবেই থাকবে? সোজা হবে না?’
‘দেখি কতক্ষণ থাকা যায়। এভাবেই থাকতে ভালো লাগছে। এখন দুপেয়ে হতে গেলেই কষ্ট হয়।’
‘ঠিক আছে, তুমি থাকো এভাবে। আমি মজনু মিয়াকে সব বলে যাচ্ছি। ও তোমার খাবারদাবার যেভাবে চাও গুছিয়ে দেবে। শুনলাম তুমি শাকপাতা খেতে চেয়েছো। ওকে কিনতে পাঠিয়েছিলাম। এখন রান্না করতে বলেছি। আর তুমি তোমার মতো থাকো। ওকে ভয় দেখিয়ো না। বেচারা ভয়ে একদম শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। শোনো, আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। এই কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরব। এরমধ্যে উল্টোপাল্টা কিছু করে বসো না যেন।’

এপার্টমেন্টের বাইরে বেরিয়ে আফরোজা একটু মুক্ত বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নিলেন। সামনে অনেকগুলো করণীয় কাজ। মানুষটা এভাবে উন্মত্ত হয়ে পড়লেও তাকে এই অবস্থায় ছেড়ে যাওয়া যায় না। প্রাক্তন স্বামী হলেও তার সন্তানের বাবা। তারচেয়ে বড় কথা, একজন সুস্থ মানুষকে খুব সহজেই ফেলে চলে যাওয়া যায়, একজন অসুস্থ মানুষকে ফেলে চলে যাওয়া যায় না। মানুষটা অসুস্থ। দেখেই বোঝা যাচ্ছে মানসিকভাবে অসুস্থ। সেই সাথে বয়সজনিত শারীরিক অসুস্থতাগুলোও বেড়েছে কিনা একটু দেখা দরকার। ব্লাড প্রেশারের ওঠানামা, ডায়াবেটিসের বেড়ে যাওয়া, মস্কিষ্কে অক্সিজেন সাপ্লাইজনিত যে সমস্যাটা ওর মাঝেমধ্যে দেখা দিত সেগুলোর চেকআপের জন্য একটা ক্লিনিকে নেওয়া দরকার। কিন্তু সেটা তিনি একা পারবেন না। ছেলেরা এসে বুঝিয়ে সুঝিয়ে যদি কোথাও নিয়ে যেতে পারে এবং মনে হয় কোনো একটা সাইকিয়াট্রিস্টের সাথেও এপয়েনমেন্ট করে রাখা দরকার। কিন্তু তার আগে দরকার ওর চারপেয়ে থেকে দুপেয়ে হওয়া। আফরোজার হঠাৎ মনে হয়, চারপেয়ে হওয়াটা খারাপ কিছু না। চতুষ্পদী জন্তু হলে এত এত অসুখ বিসুখ হয়তো দেখা দিত না!

বড় ছেলে ইঞ্জিনিয়ার আসিফ একটা সাইটে কনস্ট্রাকশনের কাজ তদারকি করছিল। জেনারেটরের একটানা জোরালো ঘটরঘটর ইঞ্জিনের শব্দে ওপাশ থেকে মায়ের কথাবার্তা তেমন কিছু বোঝা যাচ্ছে না। তবে আসিফ যেটুকু বুঝল মা এখন বাবার বাসায় আছে। বাবার কিছু একটা হয়েছে। তাকে তাড়াতাড়ি যেতে বলছে। শুধু এটুকু বুঝল, বাবা আর মানুষ নেই। চতুষ্পদ জন্তু হয়ে গেছে। মানুষের স্বভাবের সবচেয়ে বড় প্রবৃত্তি হলো দুবোর্ধ্যতা। সাইটে জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার আছে, কাজ চলছে ঠিকঠাকভাবে। সে ঘণ্টা দুয়েকের জন্য ঘুরে এলে কিচ্ছু যাবে আসবে না, তবুও হয়তো সে মায়ের কাছ থেকে বাবার ব্লাড প্রেশার ট্রেশারের কথা শুনলে যেত না। মানুষের বয়স হয়ে গেলে অসুখ বিসুখ লেগেই থাকবে, এ তো স্বাভাবিকই। এজন্য নিজেদের কাজকর্ম বন্ধ করে বাবা মায়ের কাছে কে বসে থাকে? তাছাড়া তার স্ত্রী সোমা শ্বশুর-শাশুড়িকে সহ্যই করতে পারে না। আলাদা ভাড়া বাসা নিয়ে পৃথগন্ন হতে হয়েছে সোমার কারণেই। মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের পরে তো সোমা এখন খোঁটা দেওয়ার নতুন সাবজেক্ট পেয়েছে। ফেসবুকে কোনো অফিসিয়াল মহিলার সাথে চ্যাট করতে দেখলেও মুখ ঝামটি দিয়ে বলে ওঠে, ‘যেমন মা তার পেটে আর কেমন পয়দা হবে। খানকির ঘরে নাঙই জন্মায়!’ বাবা চতুষ্পদ জন্তু হয়ে গেছে শুনে আসিফের আগ্রহটা বেড়ে উঠল, ব্যাপারটা কী সরেজমিনে দেখাই যাক, সিরিয়াস কিছু না হলে মা যে পরিস্থিতিতে বাবাকে ছেড়ে গেছে তাতে এখনো বাবার ওখানে যাওয়ারই কথা না। আসিফ সোমাকে কিছু না জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে জুনিয়রের কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ল।

ছোটছেলে ব্যাংকার সাকিব ব্যাংকের জটিল গাণিতিক হিসাব নিকেশ মেলাচ্ছিল। এখন ব্যাংকে রাশ আওয়ার। দম ফেলাবারও ফুসরত নেই। মায়ের কল দেখেও প্রথমে দুবার সে রিসিভ না করে সাইলেন্ট করে দিল। তিনবারের বার জরুরি কিছু ভেবেই রিসিভ করে গাণিতিক মাথায় মার দুর্বোধ্য কথা কিছুই বুঝতে পারল না। শুধু এটুকু বুঝল, বাবার কিছু একটা হয়েছে। এখনি যেতে হবে। বড়ভাইয়াও আসছে। বড়ভাইয়াও আসছে শুনে সাকিবের মাথার মধ্যে গাণিতিক হিসেব নিকেশ শুরু হয়ে গেল। তার মানে কি বাবার অন্তিম সময় উপস্থিত? তাই কি উইল টুইল করার জন্য এভাবে ডেকে পাঠাচ্ছে? না হলে যে বড় ভাইয়া কখনো বাবার সাথে দেখাও করতে যায় না, সে কেন আগ বাড়িয়ে যাবে? নিশ্চয়ই ধনসম্পত্তি লাভের কোনো ব্যাপার-স্যাপার আছে। এই সময় বাবার মুখের কাছে না থাকলে উইলে যদি ভাইয়াকে লায়ন শেয়ার দিয়ে বসে? বাবার তো কোনো মতিগতির ঠিক নেই!

ব্যাংকার সাকিব তাড়াতাড়ি আসিফ ভাইয়াকে ফোন দিয়ে জানাল, মা কল করেছিল, বাবার ব্যাপারে। অর্থাৎ সে ফোন দিয়ে ভাইয়াকে সাবধান করে দিতে চায় তুমি কিছু ধান্দাবাজি করার চেষ্টা করো না। আসিফও তাড়াতাড়ি বলল, ‘হ্যাঁ, আমাকেও কল করেছিল। আমি গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছি। তুই কই? ব্যাংকে আছিস। তাহলে তোকে লিফট দিয়ে নিয়ে যাই। আমি তোর ব্যাংকের সামনে দিয়েই যাব।’

সাকিব মনে মনে ভাইয়ার নতুন কেনা গাড়ির ফুটানি সহ্য করলেও গাড়িতে গেলে একসাথে যাওয়া যাবে এবং ভাইয়ার সাথে ব্যাপারটা কী তা নিয়ে কথা বলা যাবে ভেবেই রাজি হলো। আসিফ নিজেই ড্রাইভ করছিল। সাকিব ব্যাংকের সামনে থেকে আসিফের পাশে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল, ‘ব্যাপারটা কী তুমি কি কিছু জানো ভাইয়া? আমি মায়ের কথা ঠিক বুঝতে পারিনি।’
‘আমিও না। বলল, বাবা নাকি কেমন করছে। চারপেয়েদের মতো চলাফেরার চেষ্টা করছে। বাবার কি মাথাটাতা খারাপ হয়ে গেল নাকি?’ দুভাই কোনো সিদ্ধান্তে না আসতে পারলেও এই নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করতে করতে কোন ডাক্তার দেখানো যায়, কার কোন পরিচিত ডাক্তার আছে সেইসব নিয়ে আলোচনা করতে করতেই পথ এগুতে লাগল। এমনকি মায়ের এই বয়সে বিয়ে নিয়ে দুভাই রসিকতা করতেও ছাড়ল না। মা বাবা অনেক সুখী মানুষ। কারণ তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে। একজন পুরুষ মানুষের সব চাইতে বড় দুভার্গ্য হচ্ছে সুখী বিবাহিত জীবন, বিবাহবিচ্ছেদের যখন আর কোনো আশা ভরসাই নেই।

বাবার এপার্টমেন্টের দরজার সামনে কোনো ভিড় নেই দেখে দুভাই একটু অবাক হলো। একজন মানুষ গুরুতর অসুস্থ হলে কিছু না হোক আশপাশের দুচারজন মানুষ তো জড়ো হয়ে পরামর্শ দেয়। ব্যাপার কী? কলিংবেল চাপতেই মজনু মিয়াই ভেতর থেকে দরজা খুলে দিল, যেন ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল। মজনু নিচু গলায় বলল, ‘আপনারা ওই ঘরে যান। স্যার ম্যাডাম ওই ঘরেই আছেন।’ কিন্তু তারা বেডরুমের দিকে রওনা দেওয়ার আগেই মা বেডরুম থেকে পায়ে পায়ে হেঁটে বেরিয়ে আসতে থাকে এবং দুভাই অবাক হয়ে দেখে তাদের একসময়ের দাপুটে চাকুরিজীবী, বর্তমান রিটায়ারমেন্টে থাকা বাবা মায়ের পিছু পিছু আদুরে বেড়ালের মতো হামাগুড়ি দিয়ে চারহাতপায়ে হেঁটে এগিয়ে আসছে। দৃশ্যটা দেখে দুভাই এতটাই হতভম্ব হয়ে যায় যে তাদের মুখে রা কাড়ে না। মা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ডাইনিংয়ের চেয়ার টেনে দুই ভাইকে বসতে সাহায্য করেন।

মায়ের আঁচলের পেছন থেকে মুখ বের করে দিয়ে শামসাদ আজাদ কিছুটা লজ্জিত মুখে ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘জীবনে সব প্রাকটিস থাকা ভালো। আগে পরে তো মানুষকে চতুষ্পদীই হতে হবে। তাই আমি আগেভাগে হয়ে গেলাম। ঠিক করেছি না?’
পাগল না ঘাঁটানোর মতো ভয়ার্ত দুভাই একসাথে যন্ত্রচালিত রোবটের মতো মাথা একদিকে কাত করে হীরক রাজার দেশের সভাসদদের মতো ‘ঠিক, ঠিক, ঠিক’-এর সংকেত দেয়। তাই দেখে প্রফুল্ল মুখে শামসাদ আজাদ বলেন, ‘চারপেয়ে হয়ে গেছি দেখে তোর মা ভয় পেয়ে গেছে। আরেক ব্যাটা তো ভয়ে প্যান্টে প্রচ্ছাব করে দিয়ে তড়িঘড়ি আমার সামনে থেকে পালিয়ে গেছে। তা, তোমরা দুভাই আছো কেমন? সংসারে সব ঠিকঠাক চলছে তো?’
দুভাই আবারও হীরক রাজার সভাসদ। ‘ঠিক, ঠিক, ঠিক।’
‘যখনই দেখবা সংসারে কোনো কিছুর ঠিকঠাক নাই, তখনই আমার মতো চতুষ্পদী হয়ে যাবা, দেখবা সবই ঠিক হয়ে যাবে। চতুষ্পদীর কোনো ঝামেলা নাই।’
দুভাই যেন বাবার সামনে থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারলেই বাঁচে। বাবাকে একাকী ছেড়ে দুভাই-ই বউয়ের কথায় আলাদা নিজেদের সংসার পেতেছে, সেই সংসারে বাবার আশ্রয় হয়নি, এক ধরনের অপরাধবোধের তাড়নায় তাদের দুজনেরই মনে হতে থাকে হয়তো এই কারণেই বাবার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, বাবা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছেন।

মজনু মিয়াকে চা-নাস্তার কথা এবং দুপুরে দুভাই মা সবাই যাতে লাঞ্চ করে যায় সে কথা বলে বাবা হামাগুড়ি দিয়েই আবার বেডরুমে ঢুকে যেতেই ওরা দুভাই হাফ ছেড়ে বাঁচল। ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে বলল, ‘মা, মজনু মিয়াকে আগে পানি খাওয়াতে বলো। যা ভয় পেয়েছে না!’ পানি পান করে দুভাই ধাতস্থ হয়ে পরবর্তী করণীয় কী করা যায় তাই ঠিক করতে বসল। দুভাই যখন মায়ের সাথে কথা বলে ডাক্তার, সাইকিয়াট্রিস্টের ব্যাপারে আলোচনা করছে তখনই আসিফের মোবাইল সোমার কল এলো। সোমাকে নিয়ে মায়ের ব্যাপারে কিছু তিক্ত ঘটনা আগে ঘটে গিয়েছিল বলে আসিফ কল রিসিভ করেই দরজা খুলে এপার্টমেন্টের বাইরে এসে চুপি চুপি গোটা ঘটনাটা সোমাকে জানাল। ধুরন্ধর স্বভাবের বিজনেসম্যানের কন্যা সোমা ওপাশ থেকে বলল, ‘এটা তো তোমাদের জন্য শাপেবর হলো। এই তো সুযোগ!’ আসিফ সোমার কথার মমার্থ ধরতে পারল না, তার শুধু মাথায় ভাসছিল বাবার মতো একজন মানুষের ছোট বাচ্চাদের মতো হামাগুড়ি দিয়ে হেঁটে তাদের দিকে আসার দৃশ্য। সে চাপা স্বরেই বলল, ‘তুমি কী বলছো বুঝতে পারছি না।’ ওপাশ থেকে বউয়ের উত্তেজিত কণ্ঠ ভেসে এলো, ‘তুমি তো দুধের শিশু, কিছুই বোঝ না, দুদু খাও! শোন, বাবা চারপেয়ে জন্তুর মতো হাঁটছে মানে বাবা পাগল হয়ে গেছে। এখন এই সুযোগে বাবাকে ধরে বেঁধে পাগলা গারদে পাঠিয়ে দাও। প্রয়োজনে টাকা পয়সা দিয়ে পাগলের ডাক্তারদের হাত করো। তারপর পাগল বাবার সব সম্পত্তির পাওয়ার অব এর্টনি হয়ে তোমরা দুভাই ভোগ দখল করো। তুমি তো মাথামোটা ঠিক বুঝবে না ব্যাপারটা। তোমার ব্যাংকার ভাইকে এই কথাগুলো বলো। সে হিসেব নিকেশের মানুষ। সহজেই বুঝে ফেলবে।’ আসিফ ইতস্তত করে বলল, ‘মাকেও কি বলব?’ ওপাশ থেকে খেকানো গলা, ‘সে মাগিও দরদ দেখাতে এখানে চলে এসেছে নাকি? ছেড়ে যাওয়ার সময় এত দরদ ছিল কই?’ আসিফ বুঝল সোমার সাথে আর কথা বাড়ানো ঠিক হবে না। সে ‘মা ডাকছে,’ বলে সোমার কল কেটে দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে মুখ বাড়িয়ে চাপা স্বরে সাকিবকে বাইরে ডেকে নিল। তারপর সোমার বলা কথাগুলোই আবার পুনরাবৃত্তি করল। কথাগুলো শুনতে শুনতেই সাকিবের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এই ব্যাপারটা তো তার মাথায়ই ঢোকেনি। ভাবী একটা জিনিয়াস! সে ফিসফিস করে বলল, ‘মাকে এসব ব্যাপারে কিছু জানানোর দরকার নেই। সব আমরা দুজনেই করব। তার আগে মাকে এখান থেকে বিদায় করতে হবে। বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গেলেও বাবার উপরে টান যে আছে তা তো দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আর এই টান থাকলে মা আমাদের কাজ হাসিল করতে দেবে না।’

দুভাই পরিকল্পনা গুছিয়ে বাসার ভেতরে ঢোকে। মাকে পরামর্শ দেয়, ‘মা, আমরা ডাক্তার, সাইকিয়াট্রিস্ট সব ব্যবস্থা করছি। কিন্তু আমাদের মনে হয় বাবার আর তোমার সম্পর্কের ব্যাপারটা তুমি সামনে থাকলে আপনাতেই চলে আসবে। তাতে তুমিও বিব্রতবোধ করবে, এদিকে বাবারও সুস্থ হতে সময় লাগবে। তারচেয়ে ভালো হয়, আমি গাড়ি চালিয়ে তোমাকে তোমার বাসায় দিয়ে আসি। তারপর বাবাকে এ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে হাসপাতাল ডাক্তার, টেস্ট সব করিয়ে নেব। তোমাকে ফোনে সব খবরাখবর জানাব।’

ছেলেদের কথার উপর কথা চলে না বিবেচনা করেই মা বাবার সাথে বিদায় নেওয়ার জন্য বেডরুমে দেখা করতে গেলেন। বাবা বিছানার নিচে মেঝেতে দুপায়ের ওপর বসে দুহাতে থাবা মেলে ছিলেন। মাকে রুমের ভেতর আসতে দেখে বিব্রত স্বরে বললেন, ‘বয়স হয়ে গেছে। একটানা বেশিক্ষণ চললে ফিরলে ক্লান্ত লাগে। তাও চতুষ্পদী হয়ে ক্লান্তি কম লাগছে। চুতষ্পদীর সুবিধে কি জানো? স্পিড।’
মা ছলছল চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ছেলেরা তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। ওদের কথা শুনে ডাক্তার দেখাও। তোমার একটু থরো চেক-আপ দরকার। ওদের কথা শুনো। পাগলামী করো না। আর আমি মাঝে মধ্যে এসে তোমাকে দেখে যাব।’
স্ত্রীর মমতা দেখে বাবারও মন দ্রবীভূত হয়ে গেল। তিনি ভেজা ভেজা কণ্ঠে বললেন, ‘তোমার যখন মন টন খারাপ হবে তখন রুমের মধ্যে চারপেয়ে হামাগুড়ি দিয়ে হেঁটে দেখো। মন ভালো হয়ে যাবে। একবার চতুষ্পদী জন্তু হতে পারলে বাঁচোয়া। মনটন খারাপের তখন আর কোনো বালাই নেই।’
আফরোজার মনটা এতটাই খারাপ হলো তিনি আর প্রাক্তন স্বামীর সামনে দাঁড়াতে পারলেন না। মজনু মিয়াকে সব দেখভালের কথা বলে পার্স থেকে একশ টাকা বের করে মজনু হাতে গুঁজে দিয়ে বড় ছেলের সাথে গাড়িতে বেরিয়ে পড়লেন।

এই সময়ে সাকিব অনেকগুলো কাজ গুছিয়ে আনল। তার মধ্যে প্রধান কাজ একজন মানসিক রোগের ডাক্তারকে বাসায় এপয়নমেন্ট দিয়ে আনা এবং তার সাজেশন মতোই প্রথমে মানসিক হাসপাতালে এবং সেখান থেকে যাতে পাগলা গারদে পাঠানো যায় সেই ব্যবস্থা করার জন্য উপযুক্ত অর্থ ঢালার প্রতিশ্রুতিও দিল।

চতুষ্পদী জন্তুও খায়, ঘুমায়, রেচনক্রিয়া করে। শামসাদ আজাদও দুপুরে ডাইনিং টেবিলের নিচে বসে হামাগুড়ি দেওয়া অবস্থায় খাবারের প্লেটের ভেতরে মুখ ঢুকিয়ে, জিহবা দিয়ে চেটেপুটে দুপুরের খাবার খাওয়া শেষ করলেন। ছোটছেলে সাকিব যে পুরো খাওয়ার দৃশ্যটাই ডাইনিং টেবিলের আড়ালে দাঁড়িয়ে উপর থেকে মোবাইলে ভিডিও করে নিয়েছে তা চতুষ্পদী হয়ে মাথা নিচু হয়ে থাকায় শামসাদ আজাদের চোখে পড়েনি। এই ভিডিওটাই বাবার পাগল হয়ে যাওয়ার জন্য জোরালো সাক্ষ্য প্রমাণ হিসাবে কাজ দেবে। দৃশ্য মুখের কথার চেয়ে অনেক শক্তিশালী।

শামসাদ আজাদ নিজের মতো করে খেয়ে, ছেলেকে খেয়ে নিতে বললে সাকিব, ‘ভাইয়া এলে একসাথে খাব, তুমি ঘুমিয়ে যাও’ বলল। কারণ সে জানে বাবা কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে যাবে, মানসিক ডাক্তারের পরামর্শে রোগী যাতে ভায়োলেন্ট না হয়ে যায় সেজন্য ডাক্তারের প্রেসক্রাইব করা ঘুমের ওষুধ মজনু মিয়ার মাধ্যমে বাবার খাবারের সাথে মিশিয়ে দিয়ে রেখেছিল সাকিব।

ঘুম থেকে উঠে শামসাদ আজাদ খুবই অবাক হলেন, এমনকি তার চতুষ্পদী হয়ে যাওয়ার কথাও কিছুই মনে রইল না। তিনি অন্ধকারে ঘরে চোখ সয়ে আসা আলোয় দেখতে পেলেন তার গলায় একটা চামড়ার মোটা বেল্ট। সেই বেল্টের সাথে একটা শিকল জাতীয় কিছু আটকানো এবং সেই শিকলের শেষ মাথা একটা খাঁচার সাথে বাঁধা। তিনি শিকল ধরে টান দিতেই ঝনঝন শব্দে চারিদিকের নিস্তব্ধতা ভেঙে খান খান হয়ে গেল। আর সাথে সাথে গোটা কক্ষ উজ্জ্বল আলোয় ভরে উঠল। এবং সেই উজ্জ্বল আলোতে তিনি দেখতে পেলেন তিনি একটা সাদাটে রঙের দেয়াল ঘেরা কক্ষের মধ্যে আছেন, যে কক্ষে কোনো জানালা নেই, শুধু একটা বন্ধ দরজা এবং সেই কক্ষের মধ্যে একটা মজবুত লোহার খাঁচা, হিংস্র চতুষ্পদী জন্তুকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তরের সময় সর্তকতার সাথে যে খাঁচা ব্যবহার করা হয়। তিনি দুহাতে গলার শিকল আকড়ে ধরে জোরে জোরে ঝাঁকি দিয়ে ঝনঝন আওয়াজ তুলতেই কক্ষের দরজা খুলে সাদা এপ্রন পরা দশাসই একজন হাতে একটা লোহার ডাণ্ডি উঁচিয়ে ভেতরে ঢুকেই লোহার খাঁচার ওপর বারকয়েক আঘাত করে হিসহিস করে বলল, ‘কোনো শব্দ হবে না। চতুষ্পদী জন্তুরা অযথা শব্দ করে না।’

শামসাদ আজাদ ভয় পেয়ে চুপ করে গেলেন। হাতের ধরে রাখা শিকলটা ছেড়ে দিয়ে খাঁচার এককোণে ভয় পাওয়া চতুষ্পদী জন্তুর মতো হাতপা গুটিয়ে বসে রইলেন। শামসাদের ভয় পাওয়া দেখে বিকৃত স্বরে হেসে উঠল এপ্রনপরা লাঠিধারী। তারপর মুখে ক্রুর হাসি ধরে রেখে বিকৃত ঘড়ঘড়ে কণ্ঠে আদেশ দিল, ‘বল, আমার সাথে বল, মানুষ একটি চতুষ্পদী জন্তু। মানুষ একটি চতুষ্পদী জন্তু। মানুষ একটি চতুষ্পদী জন্তু।’
শামসাদ আজাদ কিছুই বললেন না। কারণ তিনি জানেন, চতুষ্পদী জন্তুরা কথা বলতে পারে না।

   

গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ধ্রুব এষ



বার্তা২৪ ডেস্ক
শিল্পী ধ্রুব এষ

শিল্পী ধ্রুব এষ

  • Font increase
  • Font Decrease

নান্দনিক প্রচ্ছদ ও অলংকরণশিল্পী হিসেবে দেশে আলাদা অবস্থান তৈরি করেছেন ধ্রুব এষ। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ নিয়ে ঢাকার পান্থপথের হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এই শিল্পী।

হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে বলেন, “তার অবস্থা বর্তমানে স্থিতিশীল।”

জ্বর সঙ্গে তীব্র কাশি নিয়ে বুধবার এ হাসপাতালে আসেন ধ্রুব এষ। পরিস্থিতি দেখে তাকে এইচডিইউতে ভর্তি করে নেওয়া হয়।

লেলিন চৌধুরী বলেন, "শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের কারণে উনার অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে গিয়েছিল। সে কারণে অবস্থা কিছুটা অবনতির দিকে গিয়েছিল। পরে অক্সিজেন সরবারাহ করা হয়, এখন তিনি স্টেবল আছেন। আমরা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছি।"

সুনামগঞ্জের সন্তান ধ্রুব এষের বয়স ৫৭ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলার ছাত্র থাকার সময় বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা শুরু করেন। প্রয়াত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ বইয়ের প্রচ্ছদ ধ্রুব এষেরই আঁকা। তার আঁকা প্রচ্ছদে প্রকাশিত হয়েছে ২৫ হাজারের বেশি বই।

দেশে প্রচ্ছদশিল্পে আধুনিকতা আনার কৃতিত্ব কেউ কেউ ধ্রুব এষকে দেন। আঁকাআঁকির সঙ্গে তিনি লেখালেখিও করেন। শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য ২০২২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান ধ্রুব এষ।

;

তৃতীয় পক্ষ



ওমর শরিফ
অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

 

এ শহরে বাড়ি আর বাড়ি। ছায়া, শান্তি দেবে এমন গাছ কোথায়? গত বারের তুলনায় এবার গরমটা একটু বেশী পড়েছে। দুপুরবেলা তাই খাঁ খাঁ করছে রাস্তাঘাট। প্রায় জনমানব শূন্য চারিদিক। মাঝে মাঝে কিছু রিক্সা, ট্যাক্সি চলছে এদিক সেদিক। ভাগ্যিস দুই রাস্তার মাঝের ডিভাইডারে সারি সারি গাছ আছে। তবু একটু সবুজ দেখা যায়, তা-না হলে কিযে হতো? কথাগুলো ভাবলো মিতু। কলেজ পড়ুয়া তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী মিতু। কলেজে কোন ভাবেই মন বসছিলোনা মিতুর। একটা ঘটনা অস্থির করে রেখেছে তাকে কাল থেকে। তাই মাত্র তিনটা ক্লাস করে বেরিয়েছে ধানমন্ডি লেক যাবে বলে। ধানমন্ডি লেকে অনেক গাছ, অনেক শান্তি। সায়েলা, রবি দু’একবার জিজ্ঞেস করেছে কোথায় যাচ্ছে জানার জন্য। সায়েলা, রবি মিতুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মিতু ওদের মিথ্যে বলেছে।

-বলেছে ‘বড় চাচার বাড়ি যাচ্ছি, চাচা একটু অসুস্থ তাই দেখা করে ওখান থেকেই বাসা চলে যাবো’।     

‘ক্লাস শেষে বন্ধুদের আড্ডা জমে উঠেছিলো খুব তবু ছাড়তে হয়েছে। এই খাঁ খাঁ রোদে কার দায় পড়েছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসার? কল দিলে কল ধরো না, কেটে দাও আবার ব্যাকও করনা! এটা কি ধরনের কথা’? রিক্সার ভাড়া দিতে দিতে বলল মিতু। মিতুর রাগ দেখে সামনে দাঁড়ানো স্বপন মিটমিট হাসছে। ছয় ফিটের মতো লম্বা, ট্রিম করা দাড়ি, মাথার চুল এলোমেলো, একটা হাওয়াই শার্ট সঙ্গে জিন্স পড়া। পায়ে স্যান্ডেলের বদলে স্নিকার পড়েছে আজ। একটু আগোছাল যাকে বলে ‘স্বযত্নে অবহেলা’। স্বপনের এই ব্যাপারটাই দারুণ টানে মিতুকে। ওর মধ্যে কোথায় একটা ব্যাপার আছে। কি নেই, আবার আছে। ঠিক পূর্ণ নয় আবার খালিও নয়। স্বপন মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে। দেশের নামকরা একটা পত্রিকা অফিসে কাজ করে। কথা কম বলে। যা কথা বলে তা ওর গিটার বলে। খুব ভালো গিটার বাজায় স্বপন।      

রিক্সা থেকে নেমে তেড়ে এলো মিতু। ‘কি কানে শোন না। হাসছো আবার, লজ্জা নেই’? রাগে বলল মিতু।

‘আচ্ছা বাবা রাগ পরে হবে। আগে চলো লেকের ভেতরটায় যাই, এখানে অনেক রোদ’। বলল স্বপন। লেকের পার ধরে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে লেকের পাশে থাকা রেস্টুরেন্ট ‘জলসিরি’তে গিয়ে বসলো। রেস্টুরেন্টে লোকজন কম। দাঁড়িয়ে থাকা ওয়েটারকে এসিটা অন করে দিতে বলল স্বপন। মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বলো কি হয়েছে, এতো জরুরি তলব কেন?’

মিতু প্রতিত্তরে বলল, ‘আগে বলো এতক্ষণ ধরে তুমি আমার ফোন ধরছিলে না কেন’? কতোবার ট্রাই করার পর তোমাকে পেয়েছি, তোমার হিসাব আছে? এতো কথার পরও স্বপনকে শান্ত দেখে মিতু আরও খানিকটা রেগে গেলো। বলল, ‘তুমি কি অনুভূতিহীন, তোমার কি জানতে ইচ্ছে করেনা, আমি কেন এতবার ফোন দিয়েছি’?

স্বপন একটু সিরিয়াস হয়ে গলা খাকিয়ে বলল, ‘আসার পর থেকে আমাকে বলার সুযোগ দিয়েছ তুমি? শুধু নিজেই বলে যাচ্ছ’।

এতক্ষণে নিজেকে যেন খুঁজে পেলো মিতু, একটু লজ্জাও পেলো। কিছুটা নমনীয় হয়ে বলল, ‘আচ্ছা বলো কেন ফোন ধরতে এত সময় নিলে’?

স্বপনের সরল উত্তর, ‘খুব জরুরি মিটিং এ ছিলাম তাই তোমার ফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে ফোন ধরতে পারেনি। মিটিং শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছি। তারপর সব কাজ ফেলে এইতো তোমার সামনে আমি’।

মুখের এক্সপ্রেশন দেখে বোঝা গেলো উত্তরে মিতু সন্তুষ্ট হয়েছে। কিন্তু কিসের যেন উদ্বেগ স্পষ্ট। ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়ায়নি স্বপনের।  সে বলল, ‘কি হয়েছে? কোন সমস্যা? আমাকে খুলে বলো’।

মিতু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘স্বপন আমার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে বাসা থেকে। পাত্র পক্ষ জানিয়েছে আমাকে খুব পছন্দ হয়েছে তাদের। আগামীকাল আসবে ডেট ফাইনাল করতে। আমি এখন কি করবো স্বপন? আমাকে বলে দাও’।

স্বপন বলল, ‘বিয়ে করে ফেল। বাবা মা যা চাই তাই করো এতে সবার মঙ্গল’।

মিতু অবাক হয়ে স্বপনের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। বলল, ‘মানে কি? তাহলে এতদিন আমারা কি করলাম। তুমি একটা প্রতারক। তুমি একটা হিপোক্রেট। এখন দায়িত্ব নেয়ার সময় পালাচ্ছো। কাপুরুষ কোথাকার’। তখনও স্বপনের ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখে অবাক হয়ে গেলো মিতু।

স্বপন মিতুর দুহাত টেনে কাছে নিয়ে বলল, ‘এতো দিনেও চিনতে পারলেনা আমাকে। তুমি যা ভাবো আমি তার থেকে অনেক অনেক বেশী ভালোবাসি তোমাকে’। বলে উঠে দাঁড়িয়ে স্বপন বলল,‘চলো’। মিতু বললো,

- ‘চলো’। মিতু বললো,
- ‘কোথায়’?
- চলোই না।
- আগে বলো কোথায়?
- কাজী অফিসে।
- মানে?!
- আমরা আজই এক্ষুনি বিয়ে করছি।
- কি বলো এসব?
- যা বলছি ঠিক বলছি। এছাড়া আমাদের হাতে আর কোন পথ নেই।
- তোমার বাসা?
- আমি ম্যানেজ করবো।
- আমার বাসা?
- ওটা পরে ম্যানেজ হয়ে যাবে।

 

দরজা খুলতেই নাসরিন স্বপনের সঙ্গে একটি মেয়েকে দেখতে পেলো। দুজনেই পা ছুঁয়ে সালাম করতেই নাসরিন অবাক হয়ে পা সরিয়ে নিলো। কিছুটা সংকোচেও। নাসরিন স্বপনের মা। নাসরিন কিছুটা হতভম্ব হয়ে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন। সোফায় বসতে দিলেন। সোফাতে বসে মাকে উদ্দেশ্য করে স্বপন বলল, ‘মা আমরা বিয়ে করে ফেলেছি। তোমাকে  পরিচয় করিয়ে দিই। এ হচ্ছে মিতু। মিতু, ‘ইনি তোমার শাশুড়ি’।

নাসরিন ছেলের দিকে হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, ‘এসব কি বলছিস স্বপন, কাউকে না জানিয়ে এতবড় কাজ তুই কিভাবে করলি? তোর বাবাকে আমি কি উত্তর দিবো। আর চিনি না জানি না একটা মেয়েকে এনে ঘরে তুললি?

স্বপন পাত্তা না দিয়ে উত্তর দিলো, ‘মিতু ভালো ঘরের মেয়ে। বাবা মা শিক্ষিত। সে নিজেও শিক্ষিত অনার্স করছে। দেখতে ভালো, স্বভাব চরিত্রেও ভালো। তোমার সামনেই আছে দেখে নাও’। বলে হাসতে লাগলো।

নাসরিন আর বেশী কথা না বাড়িয়ে মিতুর দিকে তাকালেন। প্রথমিক কিছু কথা বার্তা জিজ্ঞেস করলেন।

বললেন, ‘বিয়েটা কি কোন ভাবে থামানো যাচ্ছিল না বা বাবা মা কে বুঝিয়ে শুনিয়ে অনার্স শেষ করে তারপর বিয়েটা হলে বোধহয় ভালো ছিল’। মিতু মাথা নিচু করে শুধু শুনে যাচ্ছে।

শুধু বলল, ‘আন্টি আমি বাবাকে খুব ভয় পাই আর বাবা সরকারি চাকরি ছাড়া বিয়ে দিবেন না। বললে আরও ঝামেলা বাড়বে’। 

নাসরিন মিতুকে থামিয়ে দিয়ে ঘরে নিয়ে যেতে বললো।

স্বপন দু’জনের উদ্দেশ্যে বললো, ‘অফিসে বিশেষ কাজ আছে, আমাকে একবার এক্ষুনি অফিস যেতে হবে। এর মধ্যে আশা করি তোমাদের চেনা জানা হয়ে যাবে’।

স্বপনের কথা শুনে মা ও মিতু দুজনেই বেশ অবাক হয়ে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকলো।

নিজের রুমে বসে বসে মিতু ল্যাপটপে হানিমুনের ছবি দেখছিল। কাশ্মীর যে কি সুন্দর ভাবাই যায় না। পাহেলগাম, সোনমার্গ, গুলমার্গ জায়গাগুলো ভোলার মতো না। সেবারই জীবনের প্রথম বরফ পড়া দেখেছিলো মিতু। কিছু ছবি দেখেতো মিতু রীতিমত না হেসে পারল না। সে সময় ওরা দুজনেই কেমন বাচ্চা বাচ্চা ছিল। ‘দেখতে দেখতে বিয়ের প্রায় চার বছর হতে চললো’ ভাবল মিতু। একটু কি দীর্ঘশ্বাসের মতো বয়ে গেলো বুকের ভিতরটায়? হানিমুনের ছবি দেখা শেষে পুরনো কিছু ছবিতে চোখ গেলো মিতুর। বাবা মা’র ছবি। বাবা মা পাশাপাশি বসা। বাবার কোলে মিতু। মিতুর বয়স তখন ছয় কি সাত হবে। কি দারুন একটা ছবি। মনের অগোচরেই চোখটা ভিজে এলো মিতুর। এখনও বাবার বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক হয়নি।

মিতুর বাবা মিতুর বিয়ের কথা শুনে বলেছিলেন, ‘মিতু নামে আমার মেয়ে ছিল আমি ভুলে গেছি। বাবার অপমান করতে যে মেয়ের বিন্দুমাত্র বাঁধে না; সে আমার মেয়ে হতে পারে না। মিতুর মুখ আমি দেখতে চায়না’।

মাস্টার্স পাস করে মিতু চাকরির কথা ভাবেনি, যদিও স্বপন ওকে বার বার বলেছে বাসায় একা একা বোর লাগবে, তবুও। মিতুর শাশুড়িও একই কথা বলেছে, কিন্তু মন থেকে সায় দেয়নি মিতু। বাচ্চা পালন করবে আর সংসার সামলাবে এটিই ছিল তার চিন্তা।

মিতুর বাচ্চার খুব শখ কিন্তু স্বপন এখন বাচ্চা নিতে নারাজ। বললেই বলে, ‘আরে বাচ্চার জন্য এতো তাড়া কিসের, অঢেল সময় পড়ে আছে, আগে নিজেদের মতো করে সময় পার করি’।

স্বপন সকাল সকাল বেরিয়ে যায় ফেরার কোন সময় নির্দিষ্ট নেই। কখনও আটটা কখনও দশটা পেরিয়ে যায়। আবার কখনও কাজের এতো চাপ থাকে যে কোন কোন রাতে বাসা ফেরা হয়না। কাজ নিয়ে খুব সিরিয়াস স্বপন। খুব তাড়াতাড়ি কয়েকটা প্রমশনও পেয়েছে সে। এই বছর প্রমোশন নিয়ে গাড়ি কিনেছে ওরা। মিতুর পছন্দতেই কেনা। লাল রঙের গাড়ি। লাল রঙের গাড়ি মিতুর খুব পছন্দ। স্বপনের উন্নতিতে মিতুর গর্বের শেষ ছিলনা। মিতুর কেবলই মনে হতো স্বপনের যত সাফল্য সবই তার নিজের। সে নিজে অনুভব করতো আর আনন্দ নিয়ে সেলেব্রেট করতো। মিতুর বন্ধু বান্ধবী পাড়া পরশি যার সঙ্গেই কথা হোক না কেন, ইনিয়ে বিনিয়ে স্বপনের সাফল্যের কথা বলবেই। সে কথায় কথায় স্বপন যে তার ক্যারিয়ারে খুব ভালো করছে, সে হাসবান্ড হিসেবে খুব কেয়ারিং, পরিবারের ব্যাপারে যত্নবান সেগুলো অন্যকে বলে আত্মতৃপ্তি পায়। সেদিন পাশের বাসার ভাবি বললেন, ‘মিতু ভাবি কি যে করি বলেন তো? আমার হাসবান্ড তো আমার হাতের রান্না একেবারেই খেতে পারেনা। আপনি কিভাবে যে ম্যানেজ করেন’?

মিতু হাসতে হাসতে বলন, ‘আপনার ভাইতো আমার হাতের রান্না ছাড়া খেতেই পারেনা। আসলে এ হচ্ছে ভালোবাসা, বুঝেছেন ভাবি ভালবাসা থাকলে বিষও মধু মনে হয়’।

মিতুর সেদিনের সেই আত্মতৃপ্তি ভোলার মতো না। কথা যখন বলছিলো তখন দু চোখ চকচক করে উঠছিল যেন। 

কিছুক্ষণ ধরে মোবাইলটা বেজে চলেছে। মিতু রান্না করছিলো তাই ধরতে দেরি হলো।

হাত মুছে ফোনটা ধরে বলল, ‘হ্যালো স্লামালেকুন। কে বলছেন’?  

মোবাইল ওপাশ থেকে ভেসে এলো, ‘ভাবি আমাকে চিনতে পারছেন আমি ফারুক বলছি। ঐযে নিউ মার্কেটে দেখা। আপানারা প্লাস্টিকের কিছু জিনিস কিনছিলেন। মনে আছে’?  

মনে পড়ে গেলো মিতুর। সে বলল, ‘ও হ্যাঁ ফারুক ভাই! কেমন আছেন? বাসায় সবায় কেমন আছে? বাচ্চারা কেমন আছে’? সরি ফারুক ভাই আপনার নম্বারটা আমার মোবাইল সেভ ছিল না’।  

ফারুক উত্তরে বলল, ব্যাপার না ভাবি, হতেই পারে। আপনাদের দোয়ায় সবাই ভালো আছে। আলহামদুলিল্লাহ। ভাবি একটা কাজে একটু ফোন করেছিলাম’।

মিতু বলল, কি ব্যাপার বলুন তো?

স্বপন ভাইকে একটু দরকার ছিল। উনি কি বাসায় আছে না কোন কাজে বাইরে গেছেন?

কেন আপনি জানেন না? আপনার স্বপন ভাইতো আপনাদেরই অফিসের ট্যুরে চট্টগ্রাম গেছে।

ফারুক একটু অবাক হয়ে বলল, ‘কি বলেন ভাবি? আমার জানা মতে স্বপন ভাইতো অফিসের ট্যুরে কোথাও যাননি। বরং উনি তো বাসার কাজের কথা বলে দু’দিন ছুটি নিয়েছেন।!

মিতু আর কথা বাড়ায় না। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে, অনুমানে সে তা বুঝেছে। সে কথাটা ঘুরিয়ে ফারুককে বলল, ‘হ্যাঁ স্বপন বলছিলো বাসার কাজের সঙ্গে অফিসের কাজও সেরে আসবে। তাইতো সেদিন আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলো। আমি হয়তো বুঝতে ভুল করেছি’।

ফারুক ওপাশ থেকে বলল, ‘ও আচ্ছা ঠিক আছে ভাবি, স্বপন ভাইয়ের অন্য কোন নম্বার থাকলে দিলে ভালো হয়। জরুরি আলাপ আছে’।

ফারুক ভাই স্বপনের তো একটাই নম্বার। ও তো আর অন্য কোন নম্বার ব্যবহার করেনা। ও কল দিলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলবো’।

কথা বলার সময় যতদূর সম্ভব মাথাটাকে ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করলো মিতু। কথা শেষ করে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লো সে। সে কিছু একটা গড়বড় আছে অনুমান করছে। কিন্তু আবার এও চিন্তা করছে অনুমান নির্ভর কিছু ভেবে বসা ঠিক না। সে মনে মনে চিন্তা করলো, ‘স্বপন এলে কথা বলবে’।

স্বপন দুই দিন পর অফিসের কাজ করে বাসায় ফিরে এলো। এসেই মিতুকে জরিয়ে ধরে চুমু খেল। গভীর আদরে বুকের মধ্যে নিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘আহা কি শান্তি। তোমাকে বুকে নিলে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। এই কি আছে তোমার মধ্যে? তোমাকে বুকে নিলেই আমার কেন এতো শান্তি শান্তি লাগে?

মিতু শুধু হুম হলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। বেশী কথা বাড়ালো না। স্বপন মিতুর এই ব্যবহারে কিছুটা অবাক হল। বলল, কি ব্যাপার শরীর খারাপ নাকি? কিছু হয়েছে? মন খারাপ?

মিতু উত্তরে বলল, ‘রান্না করতে করতে একটু টায়ার্ড হয়ে গেছি মনে হয়। ঠিক হয়ে যাবে। তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি’। বলে মিতু রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। স্বপনও ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকে পড়লো।

মিতুর স্বপনের এরকম ব্যবহার দেখে কিছুটা স্বস্তি বোধ করলো। মন থেকে কালো মেঘ যা এতক্ষণ খেলা করছিলো তা কেটে গেলো। নিজেকে খুব হাল্কা হাল্কা বোধ করছে এখন। দুজনে একসঙ্গে বসে খেল। ডাইনিং টেবিলে স্বপন অনেক গল্প করলো মিতুর সঙ্গে। মনে হল এই দুইদিনে অনেক গল্প জমা ছিল। মিতুকে পেয়ে সব বাধা সরে গিয়ে একসঙ্গে বেরিয়ে আসতে লাগলো সব।

এতো কিছুর পরও মিতু লক্ষ্য করলো, ‘আগে কথায় কথায় স্বপন মিতুর গায়ে হাত দিত। ট্যুর থেকে এলে বেডে অনেক আদর করতো। কিন্তু এবার টায়ার্ড বলে পাশ ফিরে শুয়ে গেলো। মিতুর শরীরটাকে কাছে টেনে পর্যন্ত নিলো না। স্বপনের ব্যবহার মিতুর কাছে কিছুটা আলাদা মনে হল। শুয়ে শুয়ে মিতুর কেবলই মনে হতে লাগলো অফিস থেকে দেরিতে ফেরা, হুটহাট ট্যুরের নামে বাইরে যাওয়া। মোবাইল চ্যাট করা আর মোবাইল বেজে উঠলে খুব সন্তর্পণে অন্য রুমে গিয়ে কথা বলা, কেমন যেন আলগা একটা অনুভূতির সৃষ্টি করলো মিতুর কাছে। মিতু ঠিক বুঝতে পারছে কিছু তো একটা আছে যা মোটেও স্বাভাবিক নয়। কোথায় যেন কি নেই। মিতু মনে মনে ছটপট করে উঠলো। এতদিন তাহলে কেন বুঝতে পারেনি সে? নাকি এ সবই তার ভুল, দুর্বল মনের বিকার মাত্র।

শুক্রবার ছুটির দিন। এই দিনটিতে স্বপন কিছুটা বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। মিতু সকালের রান্না করতে ব্যাস্ত সময় পার করছে। আজ পরোটা, ডিমভাজা আর আলুর দম রান্না হচ্ছে। স্বপনের ফেভারিট। নাস্তা প্রায় রেডি। স্বপনকে উঠাতে ঘরে ঢোকা মাত্র স্বপনের মোবাইল মেসাজের শব্দ কানে ভেসে এলো মিতুর। স্বপন তখনও ঘুমে অচেতন। ‘কোন জরুরি মেসেজ নাকি’? ভাবলো মিতু। মিতু কাছে গিয়ে মোবাইল তুলতেই আরেকটি মেসেজ ভেসে উঠলো। রিয়া নামে কেউ লিখেছে, ‘তোমাকে খুব মিস করছি’। মেসেজ দেখে মিতুর কেমন যেন বাজে অনুভূতি হল। সে সম্পূর্ণ মেসেজ পড়ার জন্য মোবাইল আনলক করতেই একগাদা হার্ট ইমজি ভেসে উঠলো। মিতুর চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠলো। সে ধীরে ধীরে স্ক্রল করতে শুরু করলো। সে যতই পড়ছে ততই অবাক হচ্ছে। স্বপন লিখেছে চট্টগ্রামের ট্যুরটা অতুলনীয় ছিল। রিয়ার উত্তর, ‘না মোটেও না। আমার মতে গুলশান হোটেলে আমাদের সময়টা ছিল বেস্ট। তবে কক্সবাজার ট্যুরটাও বেশ উপভোগ্য ছিল। বেডে যে তুমি কি পাগলের মতো করো না। তোমাকে সামলানোই যায় না। ইউ আর আ রিয়েল ওয়াইল্ড টাইগার। আই লাভ ইউ’।

উত্তরে স্বপন লিখেছে, ‘তোমার কোন তুলনা হয় না। তুমি বেস্ট। আই লাভ ইউ ঠু’।

সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছে যেন। নিজেকে দিশেহারা মনে হচ্ছে। পাগল পাগল লাগছে সব। পড়ছে আর মিতুর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ওদের দুজনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি দেখা যাচ্ছে। এসব দেখে মিতুর কেবলই মনে হচ্ছে কেউ যেন ওর হৃৎপিণ্ডটাকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে দিচ্ছে। বুকের ভেতর প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছে সে। কষ্টে কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না যেন। 

হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে মিতুকে তার মোবাইল হাতে কি যেন করছে দেখতে পেলো স্বপন। এমন সময় উঠে এসে পেছন থেকে মিতুর কাছ থকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বললো, ‘হাউ ডেয়াড় ইউ। তুমি আমার মোবাইলে হাত দিয়েছো কেন? মেসাজ কেন পড়ছো? মানুষের প্রাইভেসি বলে একটা কথা আছে। আনশিভিলাইসড কোথাকার’।

মিতু কিছুই বললোনা শুধু ফ্যালফ্যাল করে স্বপনের দিকে চেয়ে থাকলো। স্বপনের উদ্ধতপূর্ণ কথাবার্তা  নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না সে। এ ধরনের অন্যায় করার পর কোন মানুষ যে এতো নির্বিকার হতে পারে মিতুর চিন্তার বাইরে ছিল। শান্ত থাকতে থাকতে হঠাৎ মিতু চিৎকার করে উঠলো। বলল, চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার? অফিসের ট্যুরের নাম করে বান্ধবী কে নিয়ে ঘুরে বেড়াও। ছি ছি তোমার লজ্জা করেনা?

স্বপন মিতুকে থামাতে এগিয়ে আসতেই মিতু একরকম পাগলের মতো চড়, থাপ্পড় দিতে শুরু করে দিলো। আক্রোশে স্বপনের রাতে পড়া জামাটা একটানে ছিঁড়ে ফেললো মিতু। মুখে বলল কুত্তার বাচ্চা তুই আমার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আমার জীবন নিয়ে খেলেছিস। বাস্টার্ড।

স্বপন মিতুকে থামাতে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। মুখে বলল, ‘আর একটা কথা বললে তোকে এখানেই মেরে ফেলবো। কি প্রমাণ আছে তোর কাছে যে আমি লম্পট। ... উল্টাপাল্টা কথা বললে তোকে আমি খুন করে ফেলবো’।

মিতু তখনও স্বপনের জামার কলার ধরে আছে। বলল, ‘ফারুক ভাই কল করেছিলো উনি বলেছেন তুমি অফিসের ট্যুরে যাওনি। তুমি তোমার লাভারের সঙ্গে হানিমুনে গিয়েছ চট্টগ্রামে। তারও আগে কক্সবাজারে আর গুলশানে একসঙ্গে রাত কাটিয়েছ। সবই পড়েছই আমি। তোমাদের একসঙ্গে ইন্টিমেট সব ছবিও দেখেছি। ছি তোমার ঘেন্না করেনা। চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার?

সব শুনে স্বপন একটা ধাক্কা খেল যেন। একটু বোকা বোকা লাগছে নিজেকে। সে আস্তে আস্তে বিছানায় গিয়ে বসলো। কোন উপায় না পেয়ে মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার ভুল হয়েছে মিতু, আমাকে তুমি ক্ষমা করো। এবারের মতো মাফ করে দাও, প্লিজ’।

অপরাধবোধ আর অনুশোচনায় নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছিলো স্বপনের। ক্ষণিকের আনন্দের জন্য এ কোন ভুল করে বসলো স্বপন। সে চাইলেও নিজেকে আর ক্ষমা করতে পারবেনা।  

এতক্ষণে মিতুও কিছুটা ধাতস্ত হয়ে এসেছে। স্বপনের দিকে তাকিয়ে শুধু জিজ্ঞেস করলো, ‘স্বপন আমার কি দোষ ছিল? আমিতো তোমাকে নিজেকে উজাড় করে চেয়েছি। এতো বড় কষ্ট তুমি আমাকে দিতে পারলে? তুমি আমার পৃথিবী ধ্বংস করে দিয়েছ। আমাকে শেষ করে দিয়েছ। কিভাবে পারলে? এসব জানার আগে আমার মৃত্যু হলনা কেন? স্বপন আমি যে তোমাকে খুব খুব ভালোবেসে ছিলাম। এত বড় প্রতারণা তুমি কেন করলে? আমাকে বললে আমিই তোমার জীবন থেকে চলে যেতাম। তাই বলে এতবড় আঘাত তুমি আমাকে দিতে পারলে’?

 

সময় যেন থেমে গেলো। মিতু আর আগের মতো উচ্ছ্বসিত হয়না। স্বপন বিরাট ভুল করেছে এবং তা সে বারবার স্বীকার করেছে। মিতু স্বপনকে মন থেকে ক্ষমাও করেছে। কিন্তু দিন শেষে যখন মুখোমুখি হয় তখন নিজের মূল্য নিয়ে সংশয় দেখা দেয় মিতুর। বড্ড সস্তা লাগে নিজেকে। পরিপূর্ণভাবে কিছু দিতে না পারার বেদনা নিজেকে কুড়ে কুড়ে খায়। মিতু বুঝতে চেষ্টা করে তাদের মাঝে কি ছিলনা যে স্বপনকে অন্য মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। সম্মানবোধ? মিতুর মতে, ‘স্বপন মিতুকে ভালোবাসতো ঠিক কিন্তু তার মধ্যে গভীরতা ছিলনা, সম্মান ছিলনা। যা ছিল তা প্রাত্যহিক জীবনের অভ্যেস। মাপ করে চুমু দেয়া, বাহির থেকে এসে জড়িয়ে ধরা, সাংসারিক কথা বলা, রুটিন করে মিলিত হওয়া। এর মধ্যে নতুনত্ব কি আছে? যা আছে তা সবই অভ্যেস। মিতু স্বপনকে রিয়ার কাছে কেন যাচ্ছে না জানতে চাইলে বলে, ‘রিয়াকে আমি সেভাবে কখনই দেখিনি। এটা একটা মোহ’।

মিতু বুঝতে পারে রিয়া স্বপনের পাঞ্চ লাইন। অনেকটা সারাদিনের ক্লান্তির পর এক পেগ মদ যেমন তেমন। স্বপনের কাছে ঘরটা থাকলো ঠিকই, মাঝে মাঝে একটু বাম্পার রাইডিং ও থাকলো, যা জীবনে স্পাইস যুক্ত করবে। এই সমীকরণ যা বোঝায় তা হচ্ছে। স্বপনের লয়াল থাকা প্রায় অসম্ভব, মিতুও সেটি বোঝে।

আগে দুজনার অনেক কথা হতো এখন সত্তুর শতাংশ কথা কমে গেছে দুজনার মধ্যে। প্রয়োজন ছাড়া কথা হয় না। একে ওপরের দিকে ঠিক ভাবে তাকাতে পর্যন্ত পারে না। অনুশোচনায় আর অপমানে দুজনেই শুধু হারিয়ে থাকে। দুজনেই অনুভব করে, কোন কিছুই আর আগের মতো নেই। ঘটনা প্রবাহে সব কিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে। স্বপন মিতুকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য যথেষ্ট সাহায্য চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মিতু নিজের সামনে নিজেই দাঁড়াতে পারছেনা। দুপুরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মিতু ভাবছে সে আর কি করলে এমন ঘটনা ঘটতো না? কি করলে স্বপনকে আগলে রাখতে পারতো? বার বার একই উত্তর পেলো। অভ্যেস! টানটা আর আগের মতো নেই।

পরের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে মিতু বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকালের আকাশ দেখছে। আনমনে কি যেন ভাবছে। স্বপন মিতুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, ‘অফিসে যাচ্ছি’ বলে বের হয়ে গেলো। মিতু একবার সকালের নাস্তার কথা জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলো না। বারান্দায় বসে দুই হাতের তালুতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে  কাঁদতে শুরু করলো।

রাতে স্বপন অফিস থেকে ফিরে এসে কলিং বেল দিলো। কিন্তু কেউ দরজা খুলছে না দেখে একটু ভয় পেয়ে গেলো সে। ব্যাগে রাখা এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল স্বপন। রাতে লাইট জ্বালায়নি মিতু। পুরো বাসা চুপচাপ। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো স্বপনের। হঠাৎ ভয় পেয়ে মিতু মিতু বলে ডাকতে শুরু করে দিলো স্বপন। বেডরুমে ঢুকে দেখল মিতু সেখানে নেই। লাইটের সুইচ অন করলো স্বপন। বাথরুম, পাশের রুম, বেলকণি ঘুরে ঘুরে দেখল, কয়েকবার ডাকলো মিতু নাম ধরে কিন্তু কোন সাড়া নেই। বেড রুমে ফিরে এসে বিছানায় বসে পড়লো স্বপন। দুই হাতের তালুতে মুখ লুকাল সে। ভয়ে টেনশনে ঘেমে নেয়ে গেছে একেবারে। হাত থেকে মুখ তুলতেই লক্ষ্য করলো এস্ট্রের নিচে চিঠির মতো কি যেন চাপা দেয়া আছে টেবিলের উপর। স্বপন উঠে এসে দেখল হ্যাঁ মিতুর লেখা চিঠি একটা।

চিঠিতে লেখা,

স্বপন, আমরা পছন্দ করে পরিবারের মতের বাইরে গিয়ে সংসার পেতে ছিলাম। সুখে দুখে আমরা সব সময় এক ছিলাম। পাশাপাশি ছিলাম। ভেবেছিলাম জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমার সঙ্গে পাড়ি দিবো। তা আর হলনা। এই ৮ বছরের সম্পর্কে কোনদিন বুঝিনি তুমি আমার কেউ নও। আজকের পর থেকে শুধুই মনে হচ্ছে তুমি আমার কেউ নও, তুমি আর পাঁচটা মানুষের মতো। তুমি নিশ্চয় জানো একটা সম্পর্ক টিকে থাকে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর সম্মান বোধ থেকে। একটা সম্পর্কের আয়ু বেড়ে যায় একে অপরকে বোঝা পড়ার মাধ্যমে। জানিনা কি পাপ করেছিলাম যে আল্লাহ আমাকে এতো বড় শাস্তি দিলেন। হ্যাঁ, শাস্তিই বটে। সম্পর্কে প্রতারণার কোন জায়গা থাকতে পারে না। আমি জানি আমাকে তুমি ঠিক ভালোবাসতে পারোনি। যা তুমি ভালবাসা বলছো তা আমার প্রতি নিছক ইনফাচুয়েসন। পুরনো অভ্যেস। কেন? সেটির উত্তর তুমিই ভালো দিতে পারবে। তুমি আজ আমাকে যে অসম্মান করেছ তার কোন তুলনা হয় না। আয়নার সামনে কোনদিন দাঁড়াতে পারবো এ বিশ্বাস আমার মরে গেছে। তোমার প্রতি রাগ বা ঘৃণা কোনটিই নেই আমার। তুমি আমার কাছে এখন যে কোন পুরুষ। তবু আমি তোমার ভালো চাইবো। তুমি ভালো থেকো। অনেক ভালো থেকো। নিজের যত্ন নিয়ো। শুধু জেন মিতু নামের একটি মেয়ে তোমাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসেছিল। তোমাকে খুব খুব চেয়েছিলো। তার দাম সে পায়নি বলে চলে যাচ্ছে। আমাকে খুঁজনা।-মিতু

চিঠিটা পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বুকের মাঝে ধরে, ‘মিতু আমাকে মাফ করে দাও, আমাকে ক্ষমা করে দাও’ বলে বিলাপ করতে লাগলো স্বপন। কেমন পাগলের মতো মিতু মিতু বলে ডাকতে লাগলো সে। কিছুক্ষণ পর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবনটাকে অসম্ভব ভারি বলে মনে হতে লাগলো স্বপনের। বিস্তীর্ণ আকাশে জীবনের অসীম অনিশ্চয়তার দিকে তাকিয়ে থাকলো শুধু।      

;

নৃত্য-গীতে জীবন্ত হল রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কালজয়ী আখ্যান



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্ব পরিভ্রমণের সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আর্জেন্টিনায় ল্যাটিন আমেরিকার কালজয়ী সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক ও নারীবাদী লেখক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ঐতিহাসিক সাক্ষাতের শতবর্ষ এ বছর।

১৯২৪ সালে এই দুই কালজয়ী লেখকের সাক্ষাত অক্ষয় হয়ে আছে দু’জনের জীবনস্মৃতিতে, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আদান-প্রদানে আর ভিক্টোরিয়াকে রবীন্দ্রনাথের ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করার মতো বহু ঘটনাবহুল আখ্যানকে ঘিরে। দু’জনের এই মধুর এ আখ্যানকে ঢাকার সাহিত্য ও সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে তুলে ধরলো ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি)।

সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ছায়ানট মিলনায়তনে ‘TAGORE AND VICTORIA OCAMPO-VIJAYA the victorious: 100 years on’ শীর্ষক নৃত্য-গীতে সেই অবিস্মরণীয় আখ্যানকেই ফুটিয়ে তুললেন যুক্তরাজ্য থেকে আগত বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও শিল্পী ডা. অনন্ত গুপ্ত এবং তাঁর সহশিল্পীরা।

বক্তব্য রাখছেন ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসা

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি) এর পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী আয়োজনের পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে অতিথি ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসার লাতিন আমেরিকার জনগণের হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির কথা তুলে ধরে তাকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধন রচনকারী মহান লেখক হিসেবে বর্ণনা করেন। অনুষ্ঠানে আর্জেন্টিনায় অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ রচিত বিভিন্ন কালজয়ী গান নৃত্যসহযোগে পরিবেশন করেন শিল্পীরা। একইসঙ্গে সেইসব গানের প্রেক্ষিত তুলে ধরা হয়।

উল্লেখ্য, ১৯২৪ সালে পেরু সরকারের আমন্ত্রণে দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবর্ষ উদযাপনে যোগ দিতে গিয়ে তেষট্টি বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ সমুদ্রপথে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় তিনি আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেসে থামেন এবং ওঠেন সান ইসিদ্রো শহরের এক হোটেলে। সেখানে কবির ভীষণ অনুরাগী আর্জেন্টিনার বিখ্যাত সাহিত্যিক ও নারীবাদী লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো (যিনি কবির গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদ পড়ে তাঁর কবিতার সঙ্গে কবিরও অনুরাগী হয়ে উঠেন)। রবীন্দ্রনাথের আগমনের খবরে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ছুটে যান কবির কাছে। তিনি কবিকে সুস্থ করার জন্য হোটেল থেকে নদী তীরে বাগানবাড়িতে নিয়ে আসেন।

অনুষ্ঠান মঞ্চে অতিথিদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন আইজিসিসি পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী

এরপর এই দুই লেখকের সম্পর্ক গভীর আত্মিক সম্পর্কে পর্যবসিত হয়। কবি তাঁকে বিজয়া বলে সম্বোধন করতেন। কবির বিভিন্ন গানেও ভিক্টোরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে। তাকে উৎসর্গ করেন কাব্যগ্রন্থ ‘পূরবী’। রবীন্দ্রনাথকে চিত্রকর্মে প্রাণিত করেন ওকাম্পো। ব্যবস্থা করেন প্রদর্শনীরও। দুই কালজয়ী সাহিত্যিকের মাঝে যেসব পত্র বিনিময় হয় তা সাহিত্যের চিরকালীন সম্পদে পরিণত হয়েছে।

;

বর্ষবিদায় - বর্ষবরণ

  ‘এসো হে বৈশাখ’



প্রদীপ কুমার দত্ত
মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

আবারও বছর ঘুরে এসেছে বৈশাখের পয়লা দিন। আমাদের জাতীয় উৎসব নববর্ষ। গত বেশ কয়েক বছর ধরে দেখতে পাই এই উৎসব নিকটবর্তী হলেই মঙ্গল,আনন্দ,আশার প্রতীক দিনটিকে বিতর্কিত করে একে বানচাল করার এক অশুভ প্রচেষ্টা দানা বাঁধানোর উদ্দেশ্যে একশ্রেণির লোক মাঠে নামে। পহেলা বৈশাখ উৎযাপন উপলক্ষে যে উৎসবমুখরতা, তা আমাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়,আমাদের কৃষ্টি সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এই জাতীয় নানা বিষয়ের অবতারণা করে দিনটিকে বিতর্কিত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।

বিতার্কিকদের মধ্যে কেউ কেউ আবার এর মধ্যে ধর্মাচরণকেও টেনে আনেন। গত বছর তো আইনগত ব্যবস্থা নেয়াও শুরু হয়েছিল। সেই প্রচেষ্টা অবশ্য হালে পানি পায় নি। এবারেও দন্ত-নখর বের করা শুরু করেছিল আমাদের বাংলার আদি সংস্কৃতির বিরোধীরা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয় সরকার ক্ষমতায় থাকায় অংকুরেই সেই চেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়ে থেমে গেছে। অবশ্য সরকার উভয়পক্ষকে খুশি রাখার চেষ্টা করে উৎসব পালনের সময়সীমা সংক্ষিপ্ত করে নির্দেশনা জারি করেছেন। এই রকম আপোষ করে সেই কুৎসিত শক্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তোলা হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা সরকারের উপযুক্ত মহলের উচিৎ।

উৎসব পালনের কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। সময়ের সাথে সাথে এবং অঞ্চলভেদে বিভিন্ন অনুষঙ্গ ও ধরন পাল্টায়। সংস্কৃতি ও কৃষ্টি গতিশীল। সমাজে গ্রহণযোগ্য এবং শালীনতার মাত্রা অতিক্রম না করা আনন্দে মেতে ওঠার বিভিন্ন কার্যক্রমের সমষ্টিই উৎসব। আদিকাল থেকেই বৈশাখী মেলা, হালখাতা, চৈত্র সংক্রান্তি, গাজন, নীলপূজা, চড়ক, বিভিন্ন প্রকৃতির লোকজ সংস্কৃতির ও খেলাধুলার আয়োজন,সাধ্যমত নতুন পোষাক ও ভালো খাবারের আয়োজন,অতিথি আপ্যায়ন, ইত্যাদি নিয়ে বাঙ্গালীরা পুরাতন বর্ষ বিদায় ও নববর্ষের আগমনকে একটি উৎসবের রূপ দিয়ে আসছে।

কালক্রমে বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে বাংলা সংস্কৃতির উপর পাক সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন কতৃপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার অংশ হিসাবে ছায়ানট রমনা বটমূলের বর্ষবরণ উৎসব আয়োজন শুরু করে। সেই আয়োজন আজ ডালপালা বিস্তার করে সারা দেশে এমনকি দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিহাস স্বাক্ষী, মৌলবাদের কালো থাবা সেই আয়োজন থামিয়ে দিতে রমনা বটমূলের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে নিরীহ সংস্কৃতি প্রেমীদের হত্যা করেও সফল হয়নি।২০০১ সালের সেই হামলার পর নিরীহ বাঙ্গালী গর্জে উঠে ২০০২ সালে আরও অধিক সংখ্যায় রমনায় হাজির হয়েছে। দেশের শহর ও গ্রামের দিকে দিকে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আরও ব্যপ্তি লাভ করেছে।

ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট বিগত শতাব্দীর আশির দশকে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু করে। এই আনন্দ উৎসব পরবর্তীতে মঙ্গল শোভাযাত্রার রূপ ধারণ করে। এই সফল আয়োজন ইতোমধ্যে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভ করেছে। আনন্দ প্রকাশের এই বহিঃপ্রকাশ নিয়ে এক শ্রেণির লোকের প্রচন্ড গাত্রদাহ রয়েছে।ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে তারা এই শোভাযাত্রা বন্ধ করতে চায়।দেশের প্রাগ্রসর প্রগতিশীল নাগরিকরা এই জাতীয় অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে চায় না। মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান সহ বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের সকল আয়োজন দিন দিন আরও সবল,সতেজ ও পরিশীলিতভাবে অগ্রসর হবেই।

বৈশাখী উৎসবের বিরোধিতাকারী কূপমণ্ডূকদের অনেকের জানাই নেই যে এই উৎসব একই সময়ে দুই একদিন আগে বা পরে বহু জায়গায় বিভিন্ন নামে পালিত হয়। আমাদের নববর্ষ, আসামে বিহু,পাণ্জাবে বৈসাখ,থাইল্যান্ডে সাংক্রান,বার্মায় থিংইয়ান,নেপাল ও সংলগ্ন উত্তর ভারতে বিক্রম সম্ভত,কম্বোডিয়ায় চউল চ্নাম থিমে, সিংহলে আলুথ অনুরুদ্ধা, লাওসে বা পি মেই, কেরালায় ভিষু, তামিলনাড়ুতে পুথান্ডু, এই সব উৎসবই দক্ষিণ /দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রাচীণ কাল থেকে চলে আসা বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ। অনেক এলাকায়,এমনকি আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামেও ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল বা একে অপরের শরীরে পানি ছিটানো এই উৎসবের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। জল শুচি,পবিত্রতা ও শুভ্রতার প্রতীক। পুরনো বছরের ভুল, অসাফল্য, গ্লাণি সব ধুয়ে নতুন বছর আরও উন্নততর জীবনযাত্রায় এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক এই জল ক্রীড়া।

যে সকল অন্ধকারের শক্তি এই বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ উৎসবকে হিন্দুয়ানীর সাথে সম্পর্কিত অনুষ্ঠান বলে প্রচার করেন তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে সনাতনী ধর্মাচার ও সামাজিক আচার কিছু এই সময়ে অবশ্যই থাকে। সেগুলো সবই তাঁরা পালন করেন পণ্জিকা অনুযায়ী। সেই পঞ্জিকার সনাতনী ধর্মের পূজা বা উৎসব সমূহ নির্ধারিত হয় বিক্রম সম্ভত বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চন্দ্র/সূর্য/নক্ষত্র এর অবস্থান সমন্বয় করে বিভিন্ন মাস ২৯,৩০,৩১ এমনকি ৩২ দিনেও হয়।

সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী পহেলা বৈশাখ বেশির ভাগ বছর ১৫ এপ্রিল তারিখে হয়ে থাকে।লিপ ইয়ার সেই বর্ষপণ্জিতে না থাকার কারনে মোটামুটি চার বছরে একবার এটি ১৪ এপ্রিলে হয়। বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের জন্য বহু বছর গবেষণার পর বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে নিজস্ব বর্ষপঞ্জি চালু করেছে। সেই বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে প্রায় বছরই বাংলাদেশের সনাতনী সম্প্রদায় নববর্ষের দিন (১৪ এপ্রিল) তাঁদের সামাজিক/ধর্মীয় চৈত্র সংক্রান্তির পালনীয় ক্রিয়াকর্ম নিজেদের ঘরে পালন করেন।কিন্তু পহেলা বৈশাখের নববর্ষের সকল উৎসব ও কর্মকাণ্ডে আপামর দেশবাসীর সাথে সানন্দে অংশগ্রহণ করে থাকেন। একই কথা তাঁদের অন্য সকল পূজা পার্বণের বেলায়ও খাটে।


আমাদের পার্বত্য এলাকায় এই নববর্ষ পালন হয় জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে। এই অঞ্চলে বহু বাঙ্গালী তো আছেনই। কিন্তু বৃহৎ সংখ্যায় থাকেন ১৪টি বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মানুষ। নৃতাত্ত্বিক,সাংস্কৃতিক,ভাষাগত এবং বিভিন্ন ভাবে তাঁরা সমতলের বাঙ্গালীদের চাইতে তো বটেই, এমনকি একে অপরের চাইতেও আলাদা। এই বিভিন্নতা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এই সৌন্দর্যের নামই বহুল প্রচলিত শব্দবন্ধ ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি বা বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্য।

এখানকার বম,খিয়াং,লুসাই,পাঙ্খোয়া ও খুমিরা বৃহত্তর সংখ্যায় খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী। তাঁদের বড় উৎসব বড়দিন(ক্রিসমাস)।বকি সকলের জন্য তিন দিন ব্যাপী বর্ষবিদায় /বর্ষবরণ উৎসবই বছরের সেরা পার্বণ। এই সময় সব পাহাড় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে উৎযাপনে।যোগ দেন তাঁদের খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী অন্যান্য জাতিসত্ত্বার প্রতিবেশীরা এবং পাহাড়ে থাকা বাঙ্গালীরা। আমোদে অংশ নিতে দেখা যায় সমতল থেকে এই উপলক্ষে ছুটে আসা পর্যটকদেরও।

তাঁদের উৎসব আনন্দ উৎযাপনের মধ্যে অনেক উপাদান। মঙ্গল শোভাযাত্রার আলোকে র‍্যালী হয় সবাইকে নিয়ে।আয়োজনে থাকে প্রশাসন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। হয় বিচিত্রানুষ্ঠান। খাওয়া দাওয়ার আয়োজন সকলে করেন সাধ্যানুযায়ী উঁচুমানের। তার মধ্যে বিশেষ একটি আয়োজন হল বিভিন্ন তরিতরকারির মিশ্রণে পাঁজন বা লাবড়া। কে কত পদের তরকারি/শাক/ওষধি দিয়ে পাঁজন রেঁধেছেন তার চলে অঘোষিত প্রতিযোগিতা। ক্ষেত্র বিশেষে এই সংখ্যা পণ্চাশ ছাড়িয়ে যায় বলে শুনেছি।


উৎসবমালা শুরু হয় দেবতা ও প্রয়াতঃ পূর্বপুরুষদের স্মৃতিতে পাহাড়ি ঝরণা বা নদীতে ফুল ও প্রদীপ ভাসিয়ে। নতুন কাপড় পরিধান নতুন বছরের আগমনকে স্বাগত জানানোর প্রতীক।মন্দিরে চলে মহামতি বুদ্ধদেবের আরাধনা আগত বছরে সকলের মঙ্গল কামনায়। অনেক বড় মন্দিরে বহু লোক সমাগম হয় প্রথম দিন রাতে।সারা রাত উৎসবমুখর পরিবেশে পিঠা তৈরিতে সবাই হাত লাগায়। প্রত্যুষে সেই পিঠা দেবতাকে নিবেদন করা হয়। প্রথম দিন বহু মন্দিরের বুদ্ধ মূর্তি বাদ্য সহযোগে আনন্দ মিছিল করে নিয়ে যাওয়া হয় নিকটবর্তী নদীর পানিতে স্নান করানোর জন্য।

পাহাড়ে নববর্ষের সবচাইতে বড় আকর্ষণ সাংগ্রাইং জলক্রীড়ার কথা আগে উল্লিখিত হয়েছে। এছাড়াও থাকে পিঠা তৈরির প্রতিযোগিতা, কুস্তি,তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার প্রতিযোগিতা, ইত্যাদি। সৌহার্দ্য বাড়াতে একে অপরের বাড়িতে যাওয়া,দলবদ্ধ ভাবে পান ভোজনের ব্যবস্থা করাও এই তিন দিনের কার্যক্রমের বিশেষ একটি দিক। চাকমারা বিজু, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বৈসুক,মারমারা সাংগ্রাইং, ম্রো জনগণ চাক্রান নামে এই উৎসবকে অভিহিত করেন। তণ্চঙ্গাদের কাছে বিষু,অসমীয়া সম্প্রদায়ের কাছে বিহু নামে পরিচিতি এই উৎসবের।

নামে কি বা আসে যায়। যে যেই নামেই জানুক এই উৎসব আমাদের লোকজ সংস্কৃতির একটি প্রাণের উৎসব। বাঙ্গালী ক্ষুদ্রতর নৃগোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাই যার যার পছন্দ ও সাধ্য অনুযায়ী উৎসব পালন করবেন এটাই স্বাভাবিক। কারো যদি পছন্দ না হয় তিনি উৎসব পালনে বিরত থাকতেই পারেন। সেটা তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতা। কিন্তু অন্যের উৎযাপনে বাধা সৃষ্টি করার অধিকার কারও নেই।

প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা এই নববর্ষের সাথে সাথে হিজরি সাল;চন্দ্র,সূর্য, নক্ষত্র মন্ডলীর অবস্থান;ফসল তোলা;খাজনা পরিশোধ; ইত্যাদি বিষয়ের সমণ্বয় করে জ্যোতির্বিদ ফতেহউল্লাহ্ সিরাজী ও রাজা টোডরমলের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বাদশাহ আকবর চালু করেন আমাদের বর্তমানে চলিত বাংলা বর্ষপঞ্জি। সেই বর্ষপঞ্জির ১৪৩১ সাল সমাগত।

আসুন আমরা ১৪৩০ কে বিদায় জানিয়ে আবাহন করে নেই ১৪৩১কে। দেশবাসী ও বিশ্ববাসী সকলকে জানাই নববর্ষের শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি সকলের। কামনা করি ক্ষুধা মুক্ত,বণ্চনা মুক্ত, প্রতারণা মুক্ত, ব্যথা মুক্ত ও যুদ্ধ মুক্ত পৃথিবী। কল্যাণ হোক সকলের।সুখী ও সমৃদ্ধ হোন সবাই।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;