ক্যাডট কলেজ ক্লাব
মুগ্ধকর শিল্প আয়োজন ‘বই দেখা’
‘বইদেখা’ শীর্ষক এক সাহিত্য আড্ডা ও চলচ্চিত্র আয়োজনে শুক্রবার দিনভর অভ্যাগতদের মুগ্ধ করে রাখলো ক্যাডেট কলেজ ক্লাব। গুলশানস্থ ক্লাব মিলনায়তনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নষ্টনীড় গল্প অবলম্বনে অস্কারবিজয়ী চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘চারুলতা’ ছবি প্রদর্শন করা হয়। চলচ্চিত্র প্রদর্শনেরই নাম দেয়া হয় ‘বই দেখা’। ফাঁকে ফাঁকে ছিল স্বনামখ্যাত চলচ্চিত্রকার, শিল্পসমালোচক, লেখক-সাংবাদিকের অংশগ্রহণে প্রাণবন্ত আলোচনা-বিতর্ক। দিনশেষে ক্যাডেট কলেজ ক্লাবের সভাপতি গ্রুপ ক্যাপ্টেন(অব.) মুহাম্মাদ আলমগীর বলেন, আমাদের ক্লাবটি যে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্পের একটি কেন্দ্রে পরিণত হতে চলেছে এতে কোন সন্দেহ নেই।
ক্লাবের পৃষ্ঠপোকষকতায় মূল আয়োজনটি করে ক্যাডেট কলেজ ক্লাব লিটেরেরি সোসাইটি। ক্লাব সদস্যদের জন্য তিনশ আর অতিথিদের জন্য পাঁচশ’ টাকা দর্শনীর বিনিময়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে নাস্তা, চা বিস্কুট, মধ্যাহ্ন আহার, বিকেলে কেক চা দিয়ে অভ্যাগতদের আপ্যায়িত করা হয়। সকাল নয়টায় শুরু হয়ে টানা সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত অনুষ্ঠান চলে। দর্শনীর বিনিময়ে টানা অনুষ্ঠান হলেও আয়োজনে দর্শকশ্রোতার অভাব হয়নি।
নাস্তার পরই বড় পর্দায় সত্যজিৎ রায়ের ‘চারুলতা’ প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। আধঘণ্টা যেতে না যেতেই আকস্মিক বন্ধ। উদ্যোক্তারা জানালেন, আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে এই ছবি প্রদর্শন করা হবে। ডা. ফাতেমা দোজা পোডিয়ামে এসে মাইক নিয়ে উপস্থাপনা শুরু করলেন। মঞ্চে ডাকা হলো ‘বই দেখা’ সাহিত্য আড্ডার মূল আলোচক সত্যজিৎ গবেষক ও সাংবাদিক আনোয়ার হোসেন পিন্টুকে। অনুষ্ঠানে ভ্রমণলেখক শাকুর মজিদ ও ডা. মিরাজুল ইসলামকে খুব তৎপর দেখা গেল। তাঁরা লিটেরেরি সোসাইটির কর্মকর্তা এবং এই অভিনতুন আইডিয়ার নেপথ্য কারুকার। শুভেচ্ছা বক্তব্য শেষে মূল আলোচককে ডাকা হলে তিনি সত্যজিৎ রায়, চারুলতা ছবিসহ নানা বিষয়ে নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন। বললেন, সাহিত্যকে চলচ্চিত্রে রূপায়ন করতে হলে অনেক সংযোজন-বিয়োজন করতে হয়। মূল গল্পে অনেক সময় ভিজ্যুয়ালাইজ করার মতো উপাদানের ঘাটতি থাকে। ঘাটতি মিটিয়ে একে ভিন্ন একটি শিল্প মাধ্যমে রূপান্তর করার দক্ষতা ভাল নির্মাতার থাকে। ‘চারুলতা’, পথের পাঁচালী সহ অসংখ্য ছবিতে সত্যজিৎ রায় এই দক্ষতা দেখিয়েছেন। এক্ষেত্রে নির্মাতাকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাহিত্যিক কিংবা সমালোচকদের তীব্র রোষের শিকার হতে হয়। সত্যজিৎও হয়েছেন। তিনি বলেন, আবার সব চলচ্চিত্রায়ণ শিল্পের মানে উন্নীত হয় না। তাই যদি হতো, তাহলে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দেবদাস সবচেয়ে শিল্পসফল চলচ্চিত্র হতো। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাষায় অনেকেই এই গল্প নিয়ে ছবি বানিয়েছেন, কিন্তু তা শিল্পমান পায়নি।
আনোয়ার হোসেন পিন্টুর পর আলোচনায় আসেন চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক শামীম আকতার। তিনি ‘চারুলতা’ ছবির শিল্প সফলতা তুলে ধরে বলেন, পত্রিকা সম্পাদক স্বামী ভূপতির ব্যস্ততার মধ্যে গৃহবন্দী চারুলতার নিঃসঙ্গ জীবনে তার দেবর অমল এক আশীর্বাদ হয়ে আসে। একে কারা যে পরকীয়ার তকমা পরিয়ে দিয়েছে। তবে একে ঋণাত্মকভাবে না দেখে শিল্পবিবেচনা এবং সামাজিক প্রেক্ষিতের নিরিখে দেখতে হবে।
এ পর্যায়ে দর্শকস্তর থেকে আলোচনার ওপর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হোসেন আরা জলি বলেন, চারুলতা-অমলের যে প্রেম-দুর্বলতার কথা বলা হচ্ছে, তা মানসিক বন্ধুত্বের পর্যায়ে মাত্র, এখানে জৈবিক বিষয় নেই। এর চেয়ে অনেক বেশি পরকীয়া আমরা বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, বুদ্ধদেব বসুসহ অনেকের রচনায় পেয়েছি। পরে আলোচনায় অংশ নেন চলচ্চিত্রামোদী ডা. মিরাজুল ইসলাম ও চলচ্চিত্রকার শবনম ফেরদৌসী।
মধ্যাহ্ন আহারের পর আলোচনায় আসেন স্বনামখ্যাত চলচ্চিত্রকার মোরশেদুল ইসলাম। তিনি ‘চারুলতা’ চলচ্চিত্রের শিল্পসফলতা তুলে ধরে বলেন, সাহিত্য আলাদা শিল্প মাধ্যম, চলচ্চিত্র আলাদা। তাই রবীন্দ্রনাথের নষ্টনীড় গল্পকে চলচ্চিত্রায়ন করতে গিয়ে সত্যজিৎ এমন সব বিষয় সংযোজ বিয়োজন করেছেন, যা মূল গল্পে খুজে পাওয়া যাবে না।
মিথস্ক্রিয়া পর্যায়ে লেখক-সাংবাদিক মাহমুদ হাফিজ প্রশ্ন তোলেন, আজকের আলোচনায় বার বারই ঘুরে ফিরে আসছে সাহিত্য-চলচ্চিত্রে রূপায়ণ নিয়ে। সত্যজিৎ রায়ের পর্যায়ের অস্কারবিজয়ী চলচ্চিত্রকারকেও সাহিত্য ও শিল্পসমালোচকদের তোপের মুখে পড়তে হয়েছে চারুলতাসহ সাহিত্য অবলম্বনে ছবি বানাতে গিয়ে। তাহলে সাহিত্য ও চলচ্চিত্র মাধ্যমে অন্তর্গত কোন বিরোধ আছে কিনা? আর চলচ্চিত্র নির্মাতারাই কেন সাহিত্যকে অবলম্বন করছেন, তাদের কাছে কি গল্প নেই ? গল্পটি নিজস্ব হলে তো আর সাহিত্য আর চলচ্চিত্রের যে বিরোধ থাকতো না।
জবাবে মোরশেদুল ইসলাম বলেন, সাহিত্য ও চলচ্চিত্র দু্টি ভিন্ন শিল্প মাধ্যম। বিরোধ আছে বলে আমি মনে করি না। রবীন্দ্রনাথই বলে গেছেন, চলচ্চিত্র সাহিত্যের চাটুকারিতা থেকে যতোদিন না বেরুতে পারবে, ততোদিন চলচ্চিত্রের মুক্তি নেই। তারপরও আমরা দেখি অনেক সময় বিরোধ হয়ে যায়। সত্যজিৎ রায়কেও অনেক বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়েছে। তিনি তার বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘চাকা’র প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, নাট্যজন সেলিম আল দীনের ‘চাকা’ নাটক থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আমি একে চলচ্চিত্রে রূপ দিই। প্রথম প্রদর্শনী দেখে অনেকে কিছুই হয়নি বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, তবে সেলিম আল দীন আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। প্রথমদিকে আমার সঙ্গে তাঁর তিক্ততা তৈরি হয়েছিল। তিনি তাঁর চিত্রনাট্য ও সংলাপ ছাড়া নাটকটিকে চলচ্চিত্রে রূপদান করতে দিতে রাজি হননি। আমার অনঢ় অবস্থানের পর তিনি অনুমতি দেন। তিনি বলেন, আমাদের মানতে হবে, চলচ্চিত্র আলাদা শিল্পমাধ্যম। এতে চলচ্চিত্রকার নিজস্ব স্বাধীনতা নেন এবং নিজস্ব ইন্টারপ্রিটেশন দাঁড় করান। তখন বিরোধের তৈরি হতে পারে।
এ পর্যায়ে কবি ও ভ্রমণলেখক কামরুল হাসান প্রশ্ন করেন, বাংলা চলচ্চিত্র মেধাহীন লোকের প্রবেশ এবং বাণিজ্যিক খারাপ ছবির কারণে দিন দিন মানুষ চলচ্চিত্রবিমুখ হতে শুরু করে এবং দেশের সিনেমাহলগুলো বন্ধ হয়ে যায়। আজ আবার চলচ্চিত্র শিল্পের বেশে ফেরৎ আসতে শুরু করেছে মেধাবী নির্মাতাদের হাতে। এটি আমাদের আশাবাদী করে তোলে।
পরবর্তী আলোচকবৃন্দ সাহিত্য-চলচ্চিত্র বিরোধ প্রসঙ্গটিকে কেন্দ্রে রেখেই আলোচনা চালিয়ে যান। মঞ্চে আসেন প্রখ্যাত নির্মাতা মামুনুর রশীদ। তিনি বলেন, আমাদের কিশোরকালে লোকজন সিনেমা বলতে ‘বই’ই দেখতে যেতো। বই থেকে বই হয়ে যাওয়া চলচ্চিত্র প্রদর্শনকে ‘বই দেখা’ শিরোনাম দিয়ে এই আয়োজনে তিনি উৎসাহিত। তিনি বলেন, প্রশ্ন উঠেছে সাহিত্য-চলচ্চিত্রের বিরোধ নিয়ে। মোরশেদুল ইসলাম বললেন, বিরোধ নেই। আমি বলবো প্রবল বিরোধ আছে। কারণ সাহিত্যকে চলচ্চিত্রে রূপ দিতে গেলে বিরোধ হবেই। আমরা যখন ধ্রূপদী একটি ছবি দেখি তখন সেটি একটি কবিতা বলে মনে হয়। সেটি মূল সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্রকারের হাতে কবিতা হয়ে যায়।
চলচ্চিত্রকার তৌকির আহমেদ বলেন, দর্শক কিভাবে বিশেষভাবে গল্পটি শুনতে চায়, চলচ্চিত্রকারকে সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হয়। চলচ্চিত্র এবং পোয়েটিকস হাত ধরাধরি করেই চলে। একজন সুসাহিত্যিকের ইতোমধ্যে লেখা গল্পকে চলচ্চিত্রের গল্প হিসেবে নিতে দোষের কিছু নেই।
তবে জীবিত লেখককে সন্তুষ্ট করা খুব কষ্টকর। কারণ লেখক যা সৃষ্টি করেছেন তা তার কাছে প্রিয়। তিনি পরিবর্ধন, পরিমার্জন দেখতে চাইবেন না, নিজস্ব ইন্টারপ্রিটেশনের রূপান্তর দেখতে চাইবেন। এ জন্য জীবিত লেখকের বদলে প্রয়াত লেখকের গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র করা অধিকতর শ্রেয়। তৌকির বলেন, তাছাড়া আপনি নতুন যা কিছুই করেন, ওভারল্যাপিং বা অন্যের মতো কিছুটা হতেই পারে।
নাগরিক টিভির প্রধান নির্বাহী আবদুন নূর তুষার বলেন, চলচ্চিত্রায়ণের মতো ভাল গল্পের যোগান আমাদের দেশে খুব কম। সব সময়ই চলচ্চিত্র বিখ্যাত সাহিত্যের কাছ থেকে গল্প নিয়ে থাকে। শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বসাহিত্যের ক্ষেত্রেও এই কথা সত্য। জেমস বন্ড, জোরাসিক পার্ক এসব বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র সাহিত্য থেকেই এসেছে। তিনি বলেন, একটি ভাল সাহিত্যকে চলচ্চিত্রায়ণ করতে গেলে যে বাজেট ও রসদ প্রয়োজন তার ঘাটতি রয়েছে এখানে। এ ব্যাপারে অতীত ঐতিহ্য সংরক্ষণের ওপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন। যাতে নির্মাতারা শতবছরের পুরনো জিনিসপত্র সহজে পায় এবং চলচ্চিত্রে রূপদান করতে পারে। পশ্চিমাদের ঐতিহ্য নেই বলে তারা এলিয়ন, সুপারম্যানের মতো অতিমানবীয় চরিত্র তৈরি করে তা শিল্প করে তোলে।
লেখক-স্থপতি ও নির্মাতা শাকুর মজিদ বৌদি কাদম্বরী দেবীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পর্কের টানাপোড়েনের ছায়াপাত নষ্টনীড়ি গল্পটিতে রয়েছে এবং তা চারুলতা অনেক কিছুতে রূপায়ন হয়েছ বলে প্রামাণিক দলিল উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, আজ কলকাতা শহর মানেই সিটি অব টেগোর। আর তা শুরু হয়েছিল ১০ সদর স্ট্রীট থেকে। এ বিষয়েবিস্তর গবেষণা করে তিনি ভ্রমণগদ্য এই নামে বই লিখেছেন বলে উল্লেখ করেন।
পরে অমিত মল্লিক চারুলতা ছবিটিতে মোজার্টের একটি সঙ্গীতভাষ্যকে ফর্ম হিসেবে নিয়ে শিল্পে দাঁড় করিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন।
পরে শাকুর মজিদ ঘোষণা করেন, ক্যাডেট কলেজের লেখাপড়ার বাইরে সাহিত্য চর্চাটিও জমজমাট ছিল। আজ ক্যাডেট থেকে পেশাদার হয়ে যাওয়া অনেকেই আবার সাহিত্যে ফিরে আসছেন। লিটেরেরি সোসাইটি সাবেক ক্যাডেটদের লেখা সাহিত্য বিকাশের নানা উদ্যোগ নিয়েছে।