ঘূর্ণাবর্ত
ঝুম বৃষ্টিকে ঘাড় গুঁজে নিচে পড়তে দেখে জীবনে একবারই দেখা সার্কাসে অন্ধকূপের লোকটার কথা বেখাপ্পারকমভাবে মনে পড়ে মিথুনের। অগভীর গর্তে সাঁই সাঁই মোটর সাইকেলের চালক, আর দর্শক সে দম আটকে দাঁড়িয়ে আছে আরো জনাপঞ্চাশেক মানুষের সাথে। চোখ, মাথা কালো টুপি ঢাকা অবস্থায় গতিশীল অন্ধকার নীল দেখায় কিনা এই কূট প্রশ্নের মীমাংসা করতে সে একদিন চোখ, মুখ গলা অব্ধি ঢেকে মোটর সাইকেল চালিয়ে দেখবে ভেবে রেখেছে, এখনো করা হয়নি। অথচ ঘনঘনই তার সেই হোন্ডা আরোহীর কথা মনে আসে।
অফিস আওয়ার শেষ, তবু একটা ফোন এসেছিল। ধরেনি। রাখুক মেসেজ। ‘কাল যাহা করিতে পারো আজকে তাহা লইয়া উতলা হইও না’—এই কিসিমের চিন্তা আজকের মতো করেই দেখা যাক না।
দিদার ভাইয়ের সঙ্গে আজকে ড্রাইভিং লেসন না, এমনি ঘোরাঘুরি। ঘোরাঘুরির ভাবনাতেই প্রায় নেশাগ্রস্ত বোধ করে মিথুন। দিদার ভাই ছুট লাগানো মানুষ, আর মিথুন তার সাথে ছোটার মধ্যে একরকম ধ্যান-মগ্নতার পাঠ নেয়।
“বুঝলা, মানুষ আসলে নিজেকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অংশ মনে করে না। যদি করত তাইলে বইসা সময় পার করা তার কাছে মুসিবতের মতন মনে হইত। অযুত কোটি গ্রহ নক্ষত্র নিরন্তর ছুটে যাচ্ছে, আমি আমাকে কেমনে বিচ্ছিন্ন করি। এর অংশ হিসাবে ছুইটা চলতেই হবে। যা করব ছুটতে ছুটতে।”
“দিদার ভাই, আপনি ছুটতে ছুটতে আপনি কত কী করতে পারবেন না বলব?”
“তুমি কী বলবা আমি বুঝছি। পারব, পারা যায়। আরে সেটাই তো আসল ছোটা। সেইখান থেকেই তো জগৎ সংসারের ছোটাছুটি শুরু, বুঝলা গুরু?”—দিদার ভাই তখন অশ্লীল গল্প জোতেন ঘোড়ায় বা হালের বলদে। তার বলায়, মিথুনের মনে হয়, গল্পটা একটা শ্রী পায়! নাকি সেও সেই অন্ধকূপের অশ্বারোহী, দিদার ভাই সমতল ভূমিপৃষ্ঠের মতো, সন্দেহ কোনোভাবেই তরঙ্গায়িত করে না তাকে।
***
হাই রাইজ বিল্ডিংয়ের আঠারো তলায় অফিস হয়ে চারপাশ দেখার এই সুবিধাটা এই প্রথম। এর আগে মিথুনের কাজ ছিল বেইসমেন্টে। দিনের আলো তখন দুর্লভ জিনিসের লিস্টিতে ছিল।
ড্রাইভিং ইন্সট্রাক্টর দিদার ভাই নিজেই নিজের এজেন্ডা মেইন্টেইন করে। আজকের ক্ষ্যাপ শেষ সাড়ে চারটায়। তাকে তার ঠিকানায় নামিয়ে এখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সাড়ে পাঁচ। তার বেশি দেরি হওয়ার কথা না। অফিস আওয়ার শেষে ডাউন টাউনের স্লিম জ্যাম দশ-পনেরো মিনিটে মিটে যায়। মিথুনের সেলফোন নাই, টেলিমার্কেটিংয়ের চাকরি করার সাইড এফেক্ট, কাজ শেষে ঐ বস্তু থেকে নিজেকে বিযুক্ত রাখতে চায়। দিদার ভাই তাকে খুঁজে না পাবার একটা রিস্ক যদিও থেকে যায়, তারপরও নিচে নামে সে।
রুপালি সিল্কের মতো লিফটের দেয়াল ঘেঁষে কালো সানগ্লাস পরা ছোটখাটো সুন্দরী। লাল লাল তিলাক্রান্ত হাতে বিশাল জার্মান শেফার্ডের লিশ। কুকুরের অভিজাত ভঙ্গি। সুন্দরী তার হাত বুলিয়ে আদর করে আর ফিসফিস করে ডাকে—“পেনেলোপি, পেনেলোপি…”, এই নামে তার পছন্দের অভিনেত্রীকে চেনে মিথুন। স্প্যানিশ শব্দ নাকি? মানে কী? স্প্যানিশ শেখা হয়নি। দায়ে পড়ে ফরাসি শেখার কসরত করেছিল কিছুদিন। দু একটা শব্দ আর সহজ বাক্য ছাড়া কিছুই মনে নেই। এই তিল সুন্দরীও হয়তো পেনেলোপি ক্রুজের ভক্ত।
পাঁচতলায় কালো স্যুট, ট্রলি-ব্রিফকেস। মাঝারি কোনো এক্সিকিউটিভ, চোখে তাচ্ছিল্য নিয়ে দাঁড়ালে, দৃষ্টি সরাতে পেনেলোপির গলায় চোখ যায়—ইংরেজি নামী সংস্থার ট্যাগ। অন্ধদের জন্য ট্রেইন্ড ডগ। হয়তো তিল সুন্দরীর কেনা, হয়তো স্যোশাল ওয়েলফেয়ার ডিপার্টমেন্ট থেকে পেয়েছে, অথবা পেনেলোপি তার অধীনে চাকরি করে। মায়াভরা মেয়েটি চক্ষুষ্মান না—নাহ মিথুনের খারাপ লাগে না বেশি। এই মেয়ে অরক্ষিত না। পেনেলোপির মতো বিশ্বস্ততা তার অষ্টপ্রহরের সঙ্গী। বেরিয়ে আসার আগে ছোট করে ‘বাই পেনেলোপি’ বললে তিলবতীর ঠোঁট আনন্দিত দেখায়।
***
বৃষ্টি প্রায় ধরে এসেছে তবু ক্যাফের টিন্টেড গ্লাসের ভেতর দিয়ে ছাতা বর্ষাতি ইত্যাদি দেখা যায়। ভেনিল নিয়েইজ্যেৎ কাপের ওপরে ফেনা তুলে স্থির। কফি অত ভালোবাসে না মিথুন। লিয়া, কাউন্টারের গ্রিক মেয়েটা জোর করে গছিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে নিচে নেমে একসাথে সিগারেট ফোঁকে সে আর মিথুন। প্রচণ্ড শীতে, বরফের চাঙ্গর ঠেলে দাঁড়িয়ে কাঁপতে থাকা আঙুলে লাইটার ধরানোয় এক্সপার্ট।
মেয়েটা অন কল। কারো অসুখ করলে তার ডাক পরে।
“আই ডোন্ট মাইন্ড, প্রকৃতিতে বেশিরভাগ জিনিসই তো অন কল। ডাক পড়বে আর তুমি যাবে। কখনো কখনো ডাক পড়বে না, তাও যাবে তুমি… হার জিৎ…ব্যাপার না।”
লিয়া গিয়েছিল। নিউইয়র্ক। পয়ত্রিশ বছর পরে অদেখা বাপের কাছে। যাওয়ার আগে কার্ড পাঠিয়েছে, ফুলও। রীতিমতো একটা গ্রাউন্ডওয়ার্ক করে রওনা দিয়েছিল। বাপ তার এপার্টমেন্টে ঢুকতে দেয়নি। এখনকার বৌ, ছেলেমেয়ের সংসারে বাড়তি ঝামেলা ঢুকিয়ে কী হবে।
“গেলা কেন এতদিন পরে?”
“গেলাম, আমার মেয়েটাও বাপকে দেখেনি, আমিও বুঝতে চাইলাম বাপ কী জিনিস?”
লিয়ার চোখে ভারী পাওয়ারের চশমা। কেড়ে নিলে প্রায় অন্ধ। লেবানিজ বয়ফ্রেন্ডের ভালো-মন্দ বোঝার আগেই টিনএজ প্রেগন্যান্সি। এবরশান করায়নি বলে ডেলিভারির আগপর্যন্ত নুয়েমি ছিল সাক্ষাৎ পেটের শত্রু। অনুশোচনা, আহ সব অনুশোচনা যদি নুয়েমির মতো স্বর্গীয় আনন্দে রূপ নিত! এখন মা, মেয়ে আর নাতিন মিলে এক ফ্ল্যাটে থাকে। মা প্রতিবছর তার দেশের গ্রামে যায়, এথেন্স থেকে নব্বই কিলোমিটার উত্তরে। সত্যিকারের ভার্জিন অলিভ অয়েল আনে। লিয়া আর ওর মেয়ে পালা করে মায়ের গায়ে, হাতে পায়ে ম্যাসাজ করে দেয়। আর একটা জিনিস, শীত, বর্ষা সব ঋতুতে মেয়েকে উইকেন্ডের গ্রিক স্কুলে নেয়ই নেয়।
“গতকালকে আমার মেয়ের ষোল বছর হলো। কী দিলাম জানো?”...কাউন্টারের ওপাশ থেকে ঝুঁকে আসে লিয়া, …“ষোলটা একশ ডলারের নোট। অনেকদিন ধরে মা আর আমি জমিয়েছি। আর মেয়েকে বলেছি, ও এবার প্রেম করতে পারে। যদি বাচ্চা নেয়, তাহলে যেন মেয়ে নেয়। আমরা চার জেনারেশান এক সাথে থাকতে চাই।”
“আমারে নেও তোমাগো সাথে। একজন পুরুষ পাহারাদার দরকার। বিয়া করতে কইয়ো না। তিন রমণীর সেবা যত্ন চাই।”
“খাইবা মাইর! তবে হ্যাঁ,…তোমার চেহারা খারাপ না। চাকরিও আছে। বেতনের ফিরিস্তি দেও, আর হ্যাঁ…, তিনজনের একজনরে অন্তত তোমার বিয়া করাই লাগব। আমরা সমবায় সেবা দেই না…হা হা হা আর সেইক্ষেত্রে আমার মা সবার আগে লাইনে খাড়া…”
***
“এই যে হংস মিথুন। আর জন্মে তুমি কি ক্রোঞ্চ ছিলে! সিদ্ধার্থের আমলে জন্ম নিয়েছিলে? তুমি কি সেই হাঁস যাকে তীরবিদ্ধ পেয়ে গৌতম পূর্ণিমার রাতে ঘর ছেড়েছিল?”… নেভিব্লু পোলো শার্ট আর কেডস পায়ে দিদার ভাই, বিরল কেশ হতে হতে হচ্ছেন না, ভুড়ি কমতে কমতে কমছে না। হোন্ডা সিভিকের গিয়ারে হাত রাখলে দ্রুত গতি পালটে যায় গাড়ির।
মিথুন হাসে, “আপনে তো আর গৌতম বুদ্ধের ভূ-খণ্ডে নাই, আপনে ইরোকোয়ার দেশে আসছেন।”
“জানি জানি, আমিই কি ছাতার মাথা এই এব্রাহাম আর ইরোকোয়ার দেশে এভাবে আসতে চাইছি?… এইখানে তো আমি জন্মাইতে চাই। কেন জন্মাইলাম না কওতো? কেন মানুষ তার জন্মের জন্য নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ড নির্ধারণ করতে পারে না? পারে না ভালো কথা কিন্তু কেন সেই জন্মস্থানের জন্য কানতে থাকে সারা জীবন। যেখানেই যাও…, আমি তো বুদ্ধা না…, মায়া আর কান্না আমাকে ছাড়ে না রে ভাই, ছাড়ে না।… আমি তো কখনোই গেণ্ডারিয়ায় জন্মাইতে চাই নাই, চাইছিলাম জন্মের সময় মাথার কাছে একটা সমুদ্র গর্জন করবে…”
“কক্সবাজারে হইতে পারতেন…” শুক্রবার সন্ধ্যায় দিদারভাইয়ের ভালো মুড দেখে মিথুনও ফূর্তিবাজ ।
“দূরো মিয়া…”, মিথুনকে থামিয়ে দেয় দিদার ভাই, “ককশো বাজার একটা…” দিদার ভাই মুখ খারাপ করতে গিয়ে সিরিয়াস মুখ বানায়… “প্রকৃতির সামনে মানুষের ভণ্ডামি এই সরল সৈকতটারে পওম্পাস আর এক্সাজারেটেড কইরা ফেলছে। ভালো লাগে না আমার।”
“আপনার তাহলে ন্যুড বীচে যাওয়া উচিত।”
“কেমনে যাই? আমারে তো কেউ সেই রকম সরলতা শিখায় নাই মঁসিয়ু।”
***
গাড়ি ডাউন টাউনের ভিড় ছেড়ে বেরিয়েছে, স্বস্তি লাগে মিথুনের। ঝিরঝির বৃষ্টির মধ্যেও রোদের মুখ। রংধনু হবে। ক্যাসিনো পার হয়ে জ্যাক কার্তিয়ের ব্রিজ ধরে হাইওয়ে ৭২৫ নিচ্ছেন দিদার ভাই। পঁ জ্যাক কার্তিয়ের-মন্ট্রিয়াল শহরের লাস্যময়ী সেতু। এই অপূর্ব স্থাপত্যের পাশ দিয়ে যায় বলে বিকেলটাকে মহার্ঘ মনে হয় মিথুনের।
“আচ্ছা দিদার ভাই, ধরেন, কুইবেক সরকার আপনাকে এই ব্রিজটা গিফট করে দিল, কী করবেন?
“‘দিলা তো মুশকিলে ফালায়া। বইসা বইসা কান্দা ছাড়া উপায় আছে?... কারণ এইটারে উঠায়া দেশে নেওনের কোনো বুদ্ধি নাই। যেই জিনিস নিজের দেশে নেওয়া যাবে না তা গিফট হিসাবে নিতে আমার আগ্রহ নাই। দেশে নেওয়া গেলে ঢাকা-গুলিস্থান একটা ফ্লাই ওভার, নয়তো সিধা পদ্মার উপরে সেট করা…আহা হা রে…।”
হাইওয়ে ফিফটিন থেকে ফোর্টি ওয়েস্টে ক্যাভেন্ডিশ এক্সিট নিয়ে বেরিয়ে গ্যাস কিনতে থামে ওরা। এদিকে বৃষ্টি নাই। গ্যাস স্টেশনভর্তি তিরিশ চল্লিশটা মোটর সাইকেল। বাইকার গ্যাং। আরোহীরা অধিকাংশ চল্লিশোর্ধ, মাসলম্যান, তাদের সঙ্গিনীরাও, শরীরের যত্রতত্র টাট্টু। কালো চামড়ার প্যান্ট, জ্যাকেট। কারো কারো লম্বা চুলে পোনিটেইল। ফাঁকা হাইওয়েতে চল্লিশ পঞ্চাশ কি একশো দুশো মোটর সাইকেল রেস দেখলে নৌকা বাইচের কথা মনে পড়ে। এই এক ফ্যাসাদ হয়েছে মিথুনের, ভালো কিছু, হৃদয়গ্রাহী, দেখলে দেশের কোনো কিছুর সঙ্গে মিল খুঁজতে ইচ্ছে করে। বাজে কোনো কিছুতে না। পক্ষপাতদুষ্ট হতে আগে গ্লানি বোধ হতো। এখন এইসব ভাবাভাবি কমে গেছে।
“বাইকার গ্যাং নাকি সময় সময় মাফিয়াও”… দিদার ভাই কথাটাকে উড়িয়ে দেয়। আসলে এরা প্রায় সবাই ব্লু কলার ওয়ার্কারস। অবসরে কিছু তো করতে হবে। শখের তোলা আশিটাকা!
“শোনো নাই? গত বছর বাঞ্জি জাম্পিং করতে গিয়ে মরল চারজন। কি, না, বাউন্স করতে করতে দড়িটা জাস্ট গলায় পেঁচায়া গেছিল”…দিদার ভাইয়ের কথার সত্যি মিথ্যে নিয়ে মাথা ঘামাতে চায় না মিথুন। দৃশ্যাকাঙ্ক্ষী তার চোখে তখন সেলুলয়েডের থ্রিডি চশমা। এমন মৃত্যু কি সে অবচেতনে কামনা করে? পীড়নহীন, নিতান্ত খুশি মনে, বাঞ্জি জাম্পের মতো লোমহর্ষক একটা কাজ, যে অভিজ্ঞতা জীবনে একবার অর্জন করার সাধ নিয়ে মানুষ দাঁড়ায়। জীবন মৃত্যুর কিনারে, তুমি দাঁড়ায়ে রয়েছো সখা হে। আহা! বুক ভর্তি উত্তেজনা, উদ্বেগ আর উদ্বেলিত আনন্দ। চেহারায় এর ছাপ থাকতে থাকতেই মৃত্যুর অপর পারে। বাঞ্জি জাম্পারদের চেহারা কেমন হয় লাফ দেওয়ার আগের মুহূর্তে?
“আফরিন আফরিন…ইসনে জ্যাদা কি তারিফ মুমকিন নেহি, তুভি দেখে আগর তো ক্যহে হামনাশি”…নুসরাত ফতেহ আলি খান গান শুরুর আগে উপাসনার মতো সুর নিয়ে একপ্রস্থ খেলা করে তারপর নাভির তলদেশ থেকে গেয়ে যায়। ক্লান্তি না, উত্তেজনা দিয়ে মনে হয় ক্লান্তির পরের কোনো স্তর স্পর্শ করে দেখতে চায় তার কণ্ঠ, মহাশূন্যের সীমানা ছুঁতে গিয়ে এক ভঙ্গুর অতলে আটকে থাকে। আফরিনের জন্য হৃদয় মোচড়ানো কষ্ট মিথুনকে তাড়া দিলে সে সিডির কভার হাতে তুলে নেয়। একশো চারটা গান। এমপিথ্রি। শুধু আফরিনই চার রকমে গাওয়া, রিমেক্স ইত্যাদি। এইসব গান নাকি ক্লাবে বাজে, মানুষ উন্মাতাল হয়ে নাচে।
মিথুন তখন আফরিনকে দেখে। থ্রিডি গ্লাসে সব দৃশ্যাবলিকে জান্ত্যব মনে হয়। সুদৃশ্য পাথরখণ্ড ছুড়ে ছুড়ে মেরে ফেলার পর হাহাকাররত একদল জিপসি পুরুষ এক সুন্দরীর প্রশস্তি গাঁথা গেয়ে তার কফিনের পাশে হাঁটে। মিথুনের ইচ্ছে করে ছুড়ে দেওয়া পাথরগুলো কুড়িয়ে জমা করে, কোনো কাচের বৈয়ামে সঞ্চিত মূলধনের মতো রাখে।
“দেখো এই নাক বোঁচা, হোদলের মতো চেহারা…, গলার থেইকা সুর কাইড়া নেও…, মিলানের মাফিয়া টু ধারাবি-র মাফিয়া, যে কোনো ঠ্যাকে মানায়া যাইব, অথচ দেখছো কাণ্ড, ব্যাটা কেমনে কাঁপাইছে দুনিয়া?”
ফতেহ আলী তখন সুরের আলাপ জুড়ে দিয়েছেন—সা ধা নি রে গা মা… মা রে মা…” নিষাদে পৌঁছে তার সুর গাড়ির ভেতরে অভিমান করছে, আছড়িয়ে পড়ে কাঁদছে।
“বুঝলা হংস”… দিদার ভাইয়ের বেমানান উদাস গলা…“এই লোকের গান শুনলে মনে হয়ে সুরকে ধর্মের বাইরে রাখা মোল্লাগো ভারী অন্যায়। তোমারে কই নাই?... মন্ট্রিয়ালে আসার আগে আমি প্রায় কাঠমোল্লা। মিডল ইস্টে ইঞ্জিনিয়ারের কদর কিন্তু খারাপ ছিল না, আই মিন পয়সার কথা ধরলে… কিন্তু প্রত্যেক রাত্রে বিরক্ত হইয়া ঘুমাইতে যাইতাম। আরে, আমি তো মোল্লা হইতে চাই না! কেউ যে বাধ্য করত তাও না, কিন্তু সঙ্গদোষে লোহা ভাসে… সেই কারণেই বলতে পারো আম্রিকা ট্রাই দিলাম। কাঠমোল্লা আমি এখন মালখোর, হাঃ হাঃ হাঃ।”
একটা ওয়াইনারির সামনে গাড়ি পার্ক করতে করতে দিদার ভাই গিয়ারের সঙ্গে যথারীতি নিজের কথার ট্র্যাকও বদলায়।
“ওখানে থেকে গেলে মনে হয় চেঞ্জ হইতেন না।”
“ঐ যে সঙ্গদোষে লোহা ভাসে। তবে মাল খাওয়া নিয়া আমার রিগ্রেট নাই। ওইখানে খাইতাম চুপে চাপে, চুরি চামারির কারবার…দুইটা পাপ। আর এইখানে আমি একটা পাপ করি। ইন্টারভিউতে আমার পক্ষে যুক্তি আছে”—উপরে তর্জনী উঁচিয়ে দিদার ভাই আবার হাসে।
স্মির্নফের শাদা বোতল প্লাস্টিকের ব্যাগ আঙুলে ঝুলিয়ে ফিরতে ফিরতে দিদার ভাই বলে, “চলো আজমলের মায়েরে দেইখা আসি। সে নাকি কাইতন পড়া দেয়।”
আজমলের মা কাঠের ইজি চেয়ারে বসে গুনগুন করে তসবি জপে আর দোলে, যেন এই শব্দ দিয়ে নিজের নিশ্চুপ পারিপার্শ্বে শণ শণ হাওয়ার শব্দ তুলবে। মাথায় শাড়ির ওপর ওড়নার ঘোমটা। কুঁচকে আসা ফর্সা গাল। চোখে কোনো ঘোর নাই। দিদার ভাই গল্প জুড়ে দেয়। মাকে ছেড়ে আজমল চলে গেছে এক মেক্সিকানীর সঙ্গে। বয়স আর সহায়হীন প্রমাণিত হওয়ায় আজমলের মা দুই রুমের চমৎকার সরকারি ফ্ল্যাট পেয়ে গেছে চার মাসের অপেক্ষায়।
“কাইতন পড়া দিলে কী কী সারে চাচী?”
“খাস দিলে নিয়া পরলে সব বালা মুছিবত সারব।”
“আজমলরে একটা দেন না কেন? আইসা পড়ত আপনের কাছে।”
আজমলের মা তার চারপাশ আরো নিস্প্রভ ধূসর করে চুপ করে যায়।
ফ্ল্যাট বাড়িটা পার্ক এক্সটেনশানের ঘেট্যোতে হলেও একদম কোনার দিকে। পেছনে জ্যারি পার্কে দেখনদার টেনিস কোর্ট, সানিয়া মির্জারা খেলতে আসে কখনো কখনো। সানিয়া এই পাইক্যা শোয়েবকে কেন বিয়ে করল এই নিয়ে মিথুনের ক্ষোভ আছে। এতবড় ভারতবর্ষে আর কোনো মানুষ পাইলি না? যত্তসব।
পেছনের চিলতে বারান্দা থেকে টেনিস কোর্টের গ্যালারি দেখা যায়। আজমলের মাকে কি টেনিসের মতো সুবিন্যস্ত ক্রীড়া নাড়া দেয়? খেলা মানে তো প্রাণের স্পন্দন, মিথুনের মনে হয় আজমলের মা প্রাণ স্পন্দনহীন হয়ে বেঁচে থাকেন। থাকেন কি? না নিশ্চয়ই, মানুষের নিজ নিজ খেলার ভিন্নতা থাকে। কে জানে হয়তো কাইতন পড়া দেওয়া একটা জবরদস্ত খেলা। লাইন ধরে মানুষ কালো সুতা হাতে এক অনতিক্রম্য খেলার দিকে অগ্রসরমান, এ দৃশ্য ভাবতে ভাবতে মিথুন গাড়িতে ফেরে।
মিনিট পাঁচেক পরেই গাড়ি লাভাল ব্রিজে ওঠে। ব্রিজের নিচে নিস্তরঙ্গ সেইন্ট লরেন্ট নদী, ওপারে আধশোয়া সূর্য, গরমকালে তার দেরি করে অস্ত যাওয়ার অভ্যাস। মিথুনের আগের চাকরি কুরিয়ার কোম্পানিতে কলিগ, টিম মাহিনেহ। বাইশ বছরের প্রাণবন্ত ছেলেটা ঝাঁপ দিয়েছিল এই ব্রিজ থেকে। তাও নিজের বোনের বিয়ের দিন। উৎসবের পোশাক পরেই।
ওর মা মিথুনকে তাদের আর্মেনিয়ান ফিউনারেলে দাওয়াত দিয়েছিল। সদ্য পুত্রহারা মহিলাটি কালো গাউনে আরো শীর্নকায়া। মন্ত্রের মতো গুঞ্জন করে হাইম গেয়ে যায় কয়ারের শিল্পীরা—“স্বর্গের উদ্যানে যেখানে ইনোক আর এলিজাহ রাজহংসের মতো বিচরণ করে, ও দয়াময় ঈশ্বর সেখানে আমাদের এই আদরের আত্মাকে ঠাই দাও…”
টিমের মা ভিড়ের মধ্যেও অনেকক্ষণ মিথুনের হাত ধরে থাকে। তার ছেলে কোন অজানা গভীর দুঃখবোধে আক্রান্ত ছিল, মিথুন জানে কি? অবিবাহিত ছেলেটি কাকে দর্শক করতে চাইল তার এই অন্তিম নাটকের? বিবাহিত লোকেরা, মিথুন কোথায় যেন পড়েছিল—তাদের স্ত্রীকে এই নাটকের একমাত্র দর্শক হিসেবে চায়।
অফিসের ক্রিসমাস পার্টিতে টিম দু জগ বিয়ার খেয়ে রেস্তোরাঁতেই অল্প মাতাল হয়েছিল। ওদের বস, তাড়া থাকায় আগেই চলে গিয়েছিল। সুযোগ পেয়ে সবাই মিলে তারপর বসের গুষ্টি উদ্ধার। গালের বা পাশে একটা লাল জন্মদাগ, নীল চোখের টিম উঠে দাঁড়িয়ে ‘বসের মায়রে’… বলতে গিয়ে নিজের পশ্চাৎদেশে হাত চালানোর ভঙ্গি করলে মুহূর্তের জন্য মিথুনের মনে হয়েছিল—টিম কি গে?
***
হাইওয়ে ফোরটি ওয়েস্ট এক্সিট বাইশ। গাড়ি একশো বিশ কিলোমিটার বেগে চলে। হঠাৎ মিথুনের মনে হয় সে একটা খাপ খোলা তরবারির মতো মসৃণ বিশাল মাঠ অতিক্রম করছে। বাতাসের রেণুতে বেনীআসহকলা ছড়িয়ে আছে। দিদার ভাই গুনগুন করে গান গায়—কে যাস রে ভাটির গাং বাইয়া…
“কই যাচ্ছি দিদার ভাই?”
“খাড়াও, গেলেই দেখবা”…গানের কথা সুর সমেত সুড়ুৎ করে বেড়িয়ে যেতে চায় সাঁটা জানালার ভেতর থেকে।
এক্সিট বাইশ থেকে ডাইনের রাস্তায় গেলে সারি সারি খামার। ভুট্টার খামারই বেশি। মিথুনের মাথায় বিনয় মুজুমদার চাঁদ ও ভুট্টার গল্প নিয়ে উঁকি মেরে যায়। সামনে কৃষকের সাজানো গোছানো বাড়ি, পেছনে তাদের কৃষিকাজের যন্ত্রপাতি। সুযোগ পেলে এদেরকে বিনয়ের এই ক্ষ্যাপাটে কবিতাগুচ্ছ পড়ানো যেত যদি!
দিদার ভাই একটা মাটির রাস্তায় গাড়ি ঢুকিয়ে দেয়, পাশে সাইনবোর্ডে তীরচিহ্নের পাশে ফরাসিতে লেখা—‘বাগান এই দিকে।’ হাতের বায়ে সহসাই চোখে পড়ে, ক্ষেত। আরে এ যে দেশের শাক সব্জির ক্ষেত! সত্যি সত্যি লাল শাক দেখতে পাচ্ছে সে, ধনে পাতার লকলকে আগা। ঘাসে ঢাকা পার্কিং। সামনে গ্রিন হাউসে মৌসুমী ফুলের ঝোলানো ঝাড়, এখন মূল্যহ্রাসে পাওয়া যাচ্ছে, সামার প্রায় শেষ। একটু ভেতরে টিন শেডে ফরাসি মহিলা কাউন্টার সাজিয়ে বসেছে। মিথুনকে বোকা বানিয়ে সব বাংলাদেশি শাক সব্জির ছাপানো লিস্টি হাতে তুলে দেয়। রোমান হরফে বাংলায় লেখা লাউশাক, শিম, পাশে দাম। মিথুনের বুকের মধ্যে ছলাৎ ছলাৎ খুশি উপচায়। আহ, এমনটা কতদিন ভেবেছে। কুমড়ো ফুলের হলুদ বুক জুড়ে সোনালি রেণুর তির তির কাঁপন। শাদা শাদা লাউফুল। দিদার ভাই একটা ছুরি আর গাদা খানেক প্লাস্টিক ব্যাগ নিয়ে নেমেছে মাঠে।
“এত শাক কে খাবে দিদার ভাই?”
“খাবো কেন? বিলাবো…, হাসিয়া হাসিয়া মুঠি মুঠি তাহা বিলাইব দুইজনে, হা হা হা…।”
“শিম কই?”
“আছে আছে? ঐ বেড়ার কাছে যাও…” খোলা মাঠে দিদার ভাইকে গলা তুলতে হয়।
অলীক তারার মতো ফুটে থাকা বেগুনী শাদাটে শিম ফুল, ঝিঙ্গে ফুল, পাতার ফাঁকে ফাঁকে। কিছুক্ষণ শিম ফুলের দিকে তাকিয়ে থেকে মিথুনের চোখ কাড়ে একটু দূরে চৌকোনা সবুজ, যেন পুকুর উপচিয়ে উঠে এসেছে উপরে। কাছে গেলে ছোট সাইনবোর্ড। জুট, পাটশাক। সোনালি আঁশ। চারটে পাতার মিলিত গোড়াগুলো উৎসুক তাকিয়ে থাকে। মিথুন “পাটের ক্ষেতের” মধ্যে গিয়ে দাঁড়ায়। চৌকোনা চাদরের অন্যপারে দুই নাকবোঁচা মহিলা, চাইনিজই হবে, মরিচ ক্ষেতে দাঁড়িয়ে দুটি পাতা একটি কুড়ি তোলার ভঙ্গিতে মরিচের পাতা তোলে। মিথুন ‘পাটের ক্ষেতের মইধ্যে’ দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখে। বাতাসের শরীরে শীত সওয়ার হয়েছে। শিহরণ লাগা হাত পা গুটিয়ে মিথুন পাট গাছের গোড়া দেখতে উবু হয়ে বসে। ক্রমশ দিনের আলোতে ভয়বোধ ঘিরে ধরে, নিচু হয়ে শীর্ণ পাটগাছের পরস্পরের ফাঁক ধরে দূরে দেখার চেষ্টা করে। তেমন কিছু দেখা যায় না, একটা সবুজাভ ধোঁয়াটে বাতাসের ঘনত্বে নাক ডোবাতে পারে শুধু। দেশের পাট ক্ষেতের গোড়া আরো ঘন? ভেতরে মানুষ বসতে পারে? শুতে? সে তো পাট বুনেছে নিজেদের জমিতে। সবগুলো পরীক্ষার শেষে, ছুটিতে। এমন কি ক্যানাডা আসার আগেও। আফরিন দু একবার পাশে দাঁড়িয়ে থেকেছে।
দু চারজন তাজাসব্জি-বিলাসী উৎসুক মানুষের বিচরণ বাদ দিলে চারপাশ সুনশান। মিথুন কেবল শিল-নোড়ার শব্দ শোনে—ঠুক ঠুক ঠুক ঠুক…“চেয়ারম্যানের ছেলে কাকে পাটের ক্ষ্যেতের মইদ্যে নিয়ে… আর সেই মেয়ে পোকের ওষুধ খাইয়া মরছে?” সহসা অপরিসর পাট ক্ষেতে বেসামাল যুবতী শাড়ি এলোমেলো করে শুয়ে থাকে। এটা কি আফরিন? মিথুনের বোন আফরিন কি? একটু একটু করে কর্নিয়ার ফাংশান ফেইল করা আফরিনকে ‘কে বা কাহারা পাটের ক্ষ্যাতের মইধ্যে…’… আফরিন পোকের ওষুধ কিনতে যেতে পারে না। একলা শাদা ছড়ি নিয়ে চলাফেরা করাও বন্ধ। আফরিন পোকের ওষুধ দেখলে বমি করে।
মিথুন ছুটি চায় নাই। তার টেলিমার্কেটিংয়ের বস বুঝবে না নাকি বুঝতে চাইবে না, সে নিশ্চিত হতে পারে না। “ইউ নো, ইন আ জুট ফিল্ড…, মাই অলমোস্ট ব্লাইন্ড ইয়াঙ্গার সিস্টার, শি ওয়াজ রেইপড বাই সাম আননোন হুলিগানস… পাটের ক্ষ্যাতের মইধ্যে… ইউ নো পাটের ক্ষ্যাত, দ্যা গোল্ডেন ফাইবার…।”
কোমর সমান পাট ক্ষেতে সোজা হয়ে দাঁড়ালে চারপাশে একঝাঁক অচেনা সবুজ পোকার সঙ্গে মিথুনের দেখা হয়। পোকাগুলো চেনা ভঙ্গিতে উড়ছে।