নৃবিজ্ঞান পাঠের ভূমিকা



মুহাম্মদ নূরুল করীম খান
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

সম্ভাষণের শুরুতেই আমরা আপনাদের কাছে করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থণা করে নিচ্ছি।

প্রিয় জ্ঞানী ও বিজয়ী বন্ধুগণ, যে গল্পটির কথা উল্লেখ করে আপনাদের আজ এখানে আমন্ত্রণ করেছি, দুর্ভাগ্যবশত সেটি এই মুহূর্তে উপস্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা লজ্জিত এবং আন্তরিকভাবে দুঃখিত। এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা আপনাদের ও আমাদের উভয়ের জন্য নিশ্চয়ই সমান বিব্রতকর। ক্ষমা চাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নাই। আশা করি আপনাদের জ্ঞান এবং বিজয়ী মন আমাদের ক্ষমা করবে।

আমাদের প্রায় সবই প্রস্তুত ছিল। গল্পটি বেশ সুষ্ঠু সুন্দর গাঁথুনীসহ একটি নতুন আঙ্গিক অর্জন করেছিল। এর ভাষায় ছিল অনুপম নির্মেদ বর্ণনা আর ঝরঝরে গতি। চরিত্ররা লাভ করেছিল মর্যদাপূর্ণ বিকাশ। দৃশ্যগুলোয় ভরেছিল প্রয়োজন মতো রোদ, বৃষ্টি, উত্তাপ, আলোড়ন এবং আলো-অন্ধকার। বিশ্বাস করুন, শ্রমে-নিষ্ঠায়-কলায়-কৈবল্যে, আমরা আমাদের সাধ্যের শেষ রেখা পর্যন্ত পরিশ্রম করেছি। আমরা খুব আশাও করেছি গল্পটি আপনাদের পছন্দ হতো কি হতো না, অন্তত কোনো বাস্তবের প্রয়োজনে ঠিকই লেগে যেত। আপনারা হয়তোবা গল্পটিকে আপনাদের বিদগ্ধ অভিজ্ঞতার অংশ করে নিতেন। যা হতে পারত নিশ্চিতভাবে আমাদের জন্য বহু প্রতীক্ষার এক মনোরম গৌরব। নিছক দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কী; এক অব্যখ্যেয় জটিলতার দরুন আজ এই মুহূর্তে গল্পটি আপনাদের সামনে হাজির করা গেল না। সমস্ত দায় স্বীকার করে নিয়ে আন্তরিকভাবে আবারও আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি।

প্রিয় জ্ঞানবিজয়ী সাহসী বন্ধুগণ, আপনাদের অবশ্য একদম আশাহত হওয়ার কারণ নাই। কিছুক্ষণের মধেই আমরা আপনাদের নিয়ে যাব আমাদের হাতে থাকা একটি বিকল্প গল্পে। আপনারা দয়া করে ততক্ষণ আপনাদের মেজাজ ধরে রাখুন। গল্পটির সঙ্গে আপনাদের আশা করি খুব একটা খারাপ কাটবে না।

সন্ধ্যা-নিমন্ত্রিত প্রিয় বীর বন্ধুগণ, সবাইকে স্বাগতম আর আন্তরিক অভিনন্দন! আমাদের এ বিকল্প গল্পটি অনেকাংশেই নিরীক্ষাধর্মী। প্রথাগত বিন্যাশকে সুচারু কায়দায় এফোঁড়-ওফোঁড় করা হয়েছে গল্পটির মূল স্থাপত্যে। যেটা কিছুটা অভিনব। এর ভাষা অবশ্য খুব একটা কারুকার্যময় নয়। বরং বেশ এবড়ো-থেবড়ো। কাহিনীটি ভালো। কিন্ত কাহিনীর মোড়ে মোড়ে স্থান করে নিয়েছে লাগামহীন চমক আর অতি নাটকীয়তা। যা হয়তো কারো কাছে আকর্ষণীয় আবার কারো কাছে নান্দনিক বিচ্যুতি হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। ঘটনার পরম্পরা ঠিক থাকলেও বাঁধনটি অত্যন্ত মজবুত হয়েছে বলে আমাদের দাবি করার সুযোগ নাই। সে আপনাদের সুতীক্ষ দৃষ্টিতে ঠিকই ধরা পড়বে। সর্বপোরি গল্পটি সম্পর্কে আমাদের পূর্বাভাষ বলতে গেলে এক কথায় বলতে হবে—আহামরি কিছু না হলেও মোটামুটি চলনসই। কিন্ত একটা বড় মুশকিল হয়ে গেছে এর অবাধ্য চরিত্রদের নিয়ে। ব্যাপারটা আরেকটু স্পষ্ট করে বলা দরকার। ঘটনাটা হলো—গল্পের চাঞ্চল্যের স্বার্থে আমাদের গল্পকার চরিত্রদের হাতে শুরুতেই কিছু অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দিয়েছিলেন। এক পর্যায়ে তাদের জন্য একে একে তিনটি খুনের ঘটনাকে নিঃশর্ত অনুমোদন করেন। কাহিনী যখন পরিণতির দিকে এগুচ্ছিল তখন হঠাৎ এই খুনি চরিত্ররা গল্পের সকল নিয়ম-নিয়ন্ত্রণ লঙ্ঘন করে আশ্চর্যজনকভাবে বিপথগামী হয়ে ওঠে। গল্পকার শক্তহাতে চেষ্টা করলেন, কিন্ত তখন কিছুতেই আর তাদের রাশ টেনে ধরা গেল না। তাঁকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে অস্ত্রধারী খুনিরা, নির্বিচারে এগারোটি খুন করে গল্পটিকে যাচ্ছেতাই করে তোলে।

জ্ঞানীগণ, আপনারা নিশ্চয়ই আজ খলবলে উজ্জল আলোর এই সন্ধ্যায় এত খুনোখুনি আর অবাধ্য চরিত্রদের গল্প শুনে নিজেদের মূল্যবান মেজাজ খোয়াতে চাইবেন না। বলে দেয়ার নিশ্চয়ই অপেক্ষা রাখে না—নিজের হাতে খুন করার নিষিদ্ধ রোমাঞ্চে আর বসে বসে অন্যের খুন করার বা খুন হওয়ার গল্প শোনার মধ্যে কোনোই তুলনা হতে পারে না। আমাদের তাই প্রস্তাব, চলুন, এই রক্তপাত সর্বস্ব বিকল্প গল্পটি বাদ দিয়ে আমরা তৃতীয় কোনো নিরপেক্ষ গল্পে গিয়ে হাজির হই। তাতে হয়তো, হাত ফসকে যাওয়া আমাদের এই সন্ধ্যাটা, ভিন্নভাবে ভরে উঠতে পারে।

বিজয়ীগণ, নিপাট নির্ভেজাল এ তৃতীয় গল্পটিরও ঠিক এরকম একটি আলোকোজ্জ্বল সন্ধ্যাকে ঘিরেই শুরু। আপনাদের চেয়ে কে আর ভালো জানে—কোনো একটি সন্ধ্যা কখনোই কেবল একটি সন্ধ্যা নয়। তাকে ঘিরে থাকে নানান আকারের আরো হাজারটা সন্ধ্যা, ঢেউ, উপঢেউ, বিস্তীর্ণ বিশাল তটরেখা। কোনোভাবে ঢেউয়ে ঢেউয়ে যদি একবার তীরে ওঠা যায় তাহলেই মিলবে ডাঙ্গা। আর মিলবে মানুষ গন্ধা হাজার হাজার পথের খোঁজ।

সেই সন্ধ্যাটা আরম্ভ হয়েছিল বৃষ্টি দিয়ে। নিয়ম করা আটপৌঢ়ে শোঁশোঁ বৃষ্টি নয়। আচমকা মনে ভয় বাঁধিয়ে দেওয়ার মতো ঝাঁ-ঝাঁ ঝপ-ঝপ একটানা বৃষ্টি। সন্ধ্যার মুখেই শহরের রাস্তাঘাট, অফিসপাড়া, অলিগলি, মার্কেট চত্বর সব পুরো ফাঁকা হয়ে গেল। যারা বাইরে ছিলেন তারা বাড়িতে ঢুকে গেলেন। যারা বাড়িতে তারা আর বের হতে পারলেন না। শূন্য রাস্তার উপর ফ্লাডলাইটগুলো প্রাণপণে জ্বলতে থাকলেও সেটাকে দেখাল একটা কৌতুক দৃশ্যের মতো।

শহরের সবচাইতে বড় পানশালাটিতে এরমধ্যে মাত্র বিশ-পঁচিশজন খদ্দের উপস্থিত হতে পেরেছেন। প্রতি সন্ধ্যায় ধাপে ধাপে এখানে কয়েকশো মদ পিপাসু লোকের হৈচৈ, বাকবিতণ্ডা, পান-পশরা লেগে থাকে। আজ তার সিকিভাগও হলো না। কাঁচাপাকা চুলের আধবুড়ো ম্যানেজার বৃষ্টির গাঢ়ত্ব মেপে বুঝে গেলেন আজ তার ব্যাবসায় ভালোই কমতি আছে। বৃষ্টিকে বিড়বিড় করে দুয়েকটা গালাগাল দিয়ে উপস্থিত খদ্দেরদের দিকে মনযোগ দিলেন তিনি। ভেবে নিলেন আজ যারা দুর্যোগ অতিক্রম করে এসেছেন তারাই তার প্রকৃত পিপাসু। অন্যদিনের অত লোকজন সব মৌসুমী কিংবা শখের মাতাল। তাকে আজ তাই তার সহি খদ্দেরদের ভালো সেবা দেওয়ার সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে। ম্যানেজার তার কর্মীদের নিয়ে ঝটপট ঝটপট হাত চালালেন।

বাইরে তুমুল বৃষ্টি আর ভেতরে আসন-আয়েশের তুলনায় কম লোকজন ছাড়া অন্যদিনের সাথে আজ সন্ধ্যার পানশালার তেমন বিশেষ কোনো পার্থক্য নাই। প্রতিদিন পান করতে করতে কেউ না কেউ ষাঁড়ের মতো উচ্চস্বরে গান গেয়ে ওঠেন। তা আজও ঘটল। কেউ না কেউ ঝগড়া বাঁধান। কেঁদে ফেলেন। নিজের দুর্ভাগ্যের কথা স্মরণ করে নিজেকে এবং নিজের প্রভুকে গালাগাল করেন। একটা-দুইটা গেলাশ বা বোতল হাত ফসকে পড়ে ভেঙে যায়। আজ ঠিকঠাক সবই হচ্ছে।

পানরত মাতাল-আধমাতালদের কয়েকজন পানশালার ভেতর হঠাৎ আরেকটা পার্থক্য খুঁজে পেলেন। বড়সড় পার্থক্য। মদ-ঢুলুঢুলু চেহারায় তারা তা দেখে রীতিমত আঁতকে উঠলেন। যারা এখনো দেখেননি আঙ্গুলের ইশারায় তাদেরকে দেখাতে লাগলেন। প্রথাগত হালকা আলোতেও তারা সবাই ঠিক দেখতে পেলেন—একপাশের একটা টেবিলকে ঘিরে চারজন সোমত্ত রমণী বসে বসে দেদারসে পান করছেন। আর সহজ আমুদে মেজাজে নিজেদের মধ্যে আলাপ করছেন।

সবার চোখে একযোগে জেগে উঠল বিস্ময়ের মদিরাসক্ত জিজ্ঞাসা। যারা বছরের পর বছর এই পানশালায় নিয়মিত পান করতে করতে আয়ু প্রায় ক্ষয় করে ফেলেছেন তারাও কেউ কোনোদিন একজন রমণীকেও এখানে আসতে দেখেননি। তাদের ধারণা এ কেবল পুরুষদের নিজস্বতা উদযাপনের একক বারামখানা। অথচ আজ একসাথে চার চারজন রমণী। তাছাড়া এর প্রবেশদ্বারে বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে—কুকুর, আগ্নেয়াস্ত্র এবং মহিলা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। তাদের মনে প্রশ্ন জাগল তাহলে কি এই ঝাঁ-ঝাঁ ঝপ-ঝপ বৃষ্টি শুধুই বৃষ্টি নয়, অন্য কোনো কিছু উদ্বোধনের ঘোষণা?

মদ্যপদের জন্য বেশিক্ষণ একই বিষয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে ভাবতে থাকা একটু মুশকিলের। তাদের ভাবনা-চিন্তা তাই কিছুক্ষণের মধ্যে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-গড়িয়ে যেতে লাগল। এসময় কেন চার রমণী? কেন চারজন রমণী? কেন আজ বৃষ্টি-সন্ধ্যায় একসাথে চারজন রমণী? এমন সব আঁকাবাঁকা প্রশ্ন চাক বেঁধে উঠল তাদের চিন্তায়, চেহারায়, কথায়। কিন্ত কোথাও কোনো উত্তর নাই। অতি কৌতূহলীদের কেউ কেউ পানশালার কর্মীদের কানের কাছে মুখ নিয়ে (যেন রমণীরা শুনে ফেললে কিছু একটা অন্যায় হয়ে যাবে) ফিসফিস আওয়াজে রমণীদের ব্যাপারে জানতে চাইলেন। কর্মীরা কেউই এ বিষয়ে মুখ খুলতে রাজি হলেন না। পানাসক্ত কৌতূহলীগণ পুনরায় চেষ্টা করলেন, কর্মীদের হাতে বখশিসের মতো করে টাকা গুঁজে দিয়ে। কিন্ত এই অদ্ভুত বৃষ্টি আক্রান্ত সন্ধ্যায় কেন জানি পরিচিত সবকিছু মদ্যপদের কাছে অপরিচিত হয়ে ওঠল। কর্মীরা বখশিসও নিলেন না মুখও খুললেন না।

বাইরে তখনও অরাজক তুমুল বর্ষণ। অলিতে গলিতে রুদ্ধ পানি উপচে ওঠায় ব্যস্ত। রাস্তায় সে পানি স্রোতের মতো এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে। ফ্লাডলাইটের আলোকে ঘিরে ধরে বল্লমের মতো বৃষ্টির ফোঁটা বাড়িয়ে চলল তার আশ্চর্য তাণ্ডব। চারপাশের সবার চোখকে ধাঁধা লাগিয়ে কিশোরীরা যেমন হঠাৎ যুবতী হয়ে ওঠে তেমনি সন্ধ্যাটা একসময় চট করে রাত বনে গেল। লাগামহীন বর্ষণ তার সাথে চলতে থাকল পায়ে পা মিলিয়ে।

পানশালার মদির বাতাসে ততক্ষণে জমে ওঠেছে দারুণ বিস্ময়, জিজ্ঞাসা আর রহস্যের এক দুর্বোধ্য ঘোর। পান করার বদলে সেগুলোই কেন যেন মদাসক্তদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিস্ময়-জিজ্ঞাসা-রহস্য—রহস্য-জিজ্ঞাসা-বিস্ময়, কিংবা রমণীচার-বৃষ্টিসন্ধ্যা-নিষেধের পানশালা ইত্যাদি যেন বাতাসের সাথে মিলে-মিশে, চারপাশ থেকে, বেষ্টির পানির মতো তাদেরকে ঘিরে ধরে থৈথৈ করে নাচতে লাগল। তারা হঠাৎ মনে মনে কী থেকে কী মিলিয়ে আঁচ করলেন, তাদের সরল নেশার সুযোগে, এখানে অথবা বাইরে, মহাজগতের কোথাও-না-কোথাও, তাদের নিয়ে কোনো একটা গভীর ষড়যন্ত্র হচ্ছে। কেবল তাদের নিয়েই।

নানান বয়সের নানান পেশার চেনা-অচেনা খদ্দেররা অল্পক্ষণের মধ্যে সকলে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে গেলেন। আত্মীয়তা বোধ করলেন পরস্পর পরস্পরের সাথে। তাদের প্রত্যেকের ভেতর সঞ্চার হলো নতুন এক শক্তি, সৌহার্দ্র এবং সাহস। ঝটপট সিদ্ধান্ত স্থির হলো তারা সরাসরি জানতে চাইবেন রমণী চারের কাছেই। তাদের মধ্য থেকে একজন কেউ রমণীদের সামনে গিয়ে প্রশ্ন করবেন। বাকিরা থাকবেন তার পেছনে। জানতে চাইবেন—এখানে এসব হচ্ছেটা কী?

আধবুড়ো ম্যানেজার তাদেরকে শান্ত হওয়ার পরামর্শ দিলেন। মনোযোগ দিতে বললেন নিজ নিজ বোতল আর গেলাশের দিকে। ম্যানেজারের রাশভারি পরামর্শের তারা থোড়াই কেয়ার করলেন। নতুন করে বরং কথা আরম্ভ করলেন তাদের মধ্য থেকে সেই প্রশ্নকর্তাটি কে হবেন এ নিয়ে।

এতজন বিক্ষিপ্ত মনের মদ্যপের ভেতর থেকে সর্বসম্মতিক্রমে একজনকে আলাদা করা তাদের জন্য বেশ মুশকিল হয়ে দেখা দিল। ঘোরঘোর মেজাজে কছুক্ষণ বাদে অবাক হয়ে তারা আবিষ্কার করলেন তাদের মধ্যে প্রায় সবাই সেই প্রশ্নকর্তাটি হতে আগ্রহী। কেউই নিজেকে পেছনে দেখতে রাজি নন। একের ওপর অন্যের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায় তাই তারা এমন এলোমেলোভাবে কথা বলতে আরম্ভ করলেন যে, সেটা শোনাচ্ছে অনেকটা নিচু স্বরের ঝগড়ার মতো। কে কাকে বলছেন, কে কাকে শুনছেন তা বোঝার কোনো উপায় থাকল না। একসময় তাদের গমগমে কথার গমক বৃষ্টির আওয়াজকেও ছাপিয়ে গেল।

এত হৈচৈ এতক্ষণের এত কোলাহল কিছুই যেন অনতিদূরের চার রমণীর টেবিলে পৌঁছাল না। তারা চারজন আগের মতো পরস্পর আলাপ করছেন। পান করছেন মনোযোগ দিয়ে। এবং তাদের নিঃসঙ্কোচ খোশমেজাজ রইল আগের মতোই নিরবিচ্ছন্ন। মাতালদের প্রতি তাদের আগ্রহহীন নির্বিকার ভঙ্গি তাদেরকে মুহূর্ত থেকে মুহূর্তে করে তুলছে আরো আকর্ষণীয়া, আরো রহস্য-মাধুরী।

কিছুতেই কিছু সমাধান হলো না। মতানৈক্যের শাখা-প্রশাখা একের পর এক কেবল বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে সেই সাথে তাদের গলার স্বরও। দুয়েকটা বোতল চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল কারো অসাবধান আচরণে। বুঁদ হয়ে থাকা অনেকের মেজাজে দেখা দিল আচমকা ধৈর্যচ্যুতির সম্ভাবনা। কারো আবার জাঁকিয়ে আনা নেশা মনোযোগের অভাবে হাতছাড়া হয়ে গেল। হঠাৎ একজন মতাল লাফ মেরে একটা টেবিলের ওপর উঠে দাঁড়ালেন। জনসভার বক্তার মতো গর্জনের গলায় শুরু করলেন বক্তৃতা। কিন্ত প্রতিরোধের মুখে কথা তিনি বেশিদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলেন না। অন্যরা তাকে টেনে নামিয়ে দিলেন। বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার আগে কেবল এটুকু তিনি জানাতে পারলেন—তার পিতা ছিলেন দেশের পূর্বাঞ্চলের দীর্ঘদিনের একজন দক্ষ প্রশাসক। তার মধ্যে তাই উত্তরাধিকার সূত্রে নেতৃত্বের সব রকমের যোগ্যতা রয়েছে।

বাইরে তখন উপচে ওঠা পানি বেড়ে হয়েছে প্রায় কোমর অবধি। শহরের অধিকাংশ নিচু এলাকা প্লাবনের মুখে তলিয়ে গেল। বৃষ্টির সাথে যোগ হলো প্রবল ঝড়ো হাওয়া এবং মুহুর্মুহু বজ্রপাত। এখানে ওখানে ভেঙে-উপড়ে পড়ল গাছপালা, বৈদ্যুতিক খুঁটি এবং ছোট বড় দালান-কোঠা। নিশ্চিত এর মধ্যে কিছু হতাহতের ঘটনাও ঘটে থাকবে। এমন দুর্যেগের জন্য এই ছিমছাম সেকেলে শহরটি মোটেও উপযুক্ত ছিল না।

পানশালায় ততক্ষণে আরেকজন স্বঘোষিত নেতৃত্বের দাবিদারকে পাওয়া গেল। আগের জনের তুলনায় বেশ দৃঢ়কণ্ঠে শুদ্ধ-শান্ত উচ্চারণে তিনি ঘোষনা করলেন—আমার পুর্ব পুরুষগণই এশহরের গোড়াপত্তন করেছিলেন। এশহর আমার শহর। এখানকার যে কোনো ছোট বড় নেতৃত্বে আমিই সবচেয়ে যোগ্য। অধিকার যদি কারো থেকে থাকে সেটা কেবল আমারই। মদ্যপ জনতা তাকে শুনলেন কিন্ত মানলেন না। একজন কেউ মশকরার গলায় বললেন, পুর্বপুরুষরা যে শহর গড়েছেন আপনি আজ সেটাকে ধ্বংস করবেন, এইতো! অন্যরা একযোগে হেসে কথাটাকে সমর্থন জানালেন।

বাইরে এসময় পানশালার খুব কাছে কোথাও প্রকাণ্ড আওয়াজে বাজ পড়ল। দেয়ালে দেয়ালে কাঁপন ধরানো গুড়ম্ম্ম্ আওয়াজে সবার ভাবনায় পড়ল সশঙ্ক ছেদ। সংক্ষিপ্ত এক পশলা নীরবতার পর তারা আবার আগের মতো কোলাহল শুরু করলেন। বাজ পড়াটা ছিল যেন দম নেওয়ার বিরতি। কেউ বৃষ্টি প্রসঙ্গে, কেউ বাড়ি ফেরার জটিলতা কেউ কেউ আবার নির্দ্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই হাউমাউ করে উঠলেন। তারা যেন একদম ভুলে গেলেন বাজ পড়ার আগে তারা নেতৃত্ব আর রমণীচার প্রসঙ্গে ছিলেন। কিন্ত এবার তাদের হৈ-হাঙ্গামা ক্রমে সব রকমের মাত্রাকে অতিক্রম করতে লাগল। ম্যানেজারের পাকা চোখ তাদের আচরণে কিসের যেন সংকেত খুঁজে পেলেন। কাউন্টার ছেড়ে সোজা চলে এলেন মাতালদের ভিড়ে। কিন্ত তারা ততক্ষণে বাইরের দুর্যোগের মতোই বিরল অবাধ্যতায় পরস্পরের ওপর ঝাপিয়ে পড়ার মতো পরিস্থিতিতে পৌঁছে গেছেন। যেন তারা দৈবযোগে টের পেয়ে গেছেন আজ সন্ধ্যায় শুরু হওয়া এই ঝড়ো-প্লাবনে তাদের শহরটি নির্ঘাত তলিয়ে যাবে। আর প্রত্যেকে এর জন্য দায়ী মনে করছেন অন্যদের।

মাতালদের কেউই লক্ষ্য করলেন না রমণীদের টেবিল থেকে একজন রমণী খুব সন্তর্পণে তাদের দিকে এগিয়ে আসছেন। তারা বরং তখন একটা উদ্দেশ্যহীন অত্মঘাতী সংঘর্ষের সূচনায় ব্যস্ত। তাদের বেমক্কা তর্জন-গর্জন বলে দিচ্ছে যে কোনো মুহূতেই সংঘর্ষ প্রবল আকার রূপ নিয়ে প্রত্যেককে প্রত্যেকের আক্রমণের ক্ষমাহীন লক্ষ্যে পররিণত করে তুলতে পারে।

তার হাঁটার ভঙ্গিটি ভীষণ মন্থর কিন্ত আকর্ষণহীন নয়। কিছুটা গোপন বার্তাবাহকদের মতো। রমণী যখন এসে তাদের জটলার একদম গাঁ ঘেষে দাঁড়ালেন তখনই কেবল তারা টের পেলেন। মুহূর্তেই প্রত্যেকে ঠিক বাজ পড়ার মতো নীরবতায় স্তব্ধ হয়ে গেলেন। সম্ভবত ভয় কিংবা অন্য কোনো অজানা কারণে তারা একচুলও নড়লেন না কেউই। রমণী নির্ভার জাদুময়ী চেহারায় তাদের দিকে তাকালেন। তাকালেন তাদের প্রত্যেকের দিকে আলাদা আলাদা করে, তার শান্ত-সৌম্য চোখ জোড়ার নরম দৃষ্টি দিয়ে। বিমূঢ় নিস্পলক চোখে তারাও তাকিয়ে আছেন। তাদের চোখে-মুখে-চেহারায় আবার ফুটে উঠল শুরুর দিকের সেই নির্দোষ বিস্ময় আর কাঁপাকাঁপা কৌতূহল।

রমণী কোনো কথা বললেন না। ছোট্ট করে একবার কেবল ঠোঁটের কোণে হাসলেন। সবাইকে আরেক প্রস্থ বিস্মিত করে দিয়ে একলাফে মাঝখানের একটা টেবিলে উঠে টানটান করে দাঁড়ালেন। চেহারায় তখনও তার ঠিকরে পড়ছে কোনো এক সুনির্দ্দিষ্ট প্রত্যয়। সবার উদ্দেশ্যে হঠাৎ ছুড়ে দিলেন হিহিহি স্বরে লাস্যময়ী ছন্দের হাসি। মাতালগণ সে হাসির কোনো জবাব দেওয়ার কোনো কারণ পেলেন না। হাসির রেশটুকু মিলিয়ে যেতে যেতে রমণী ছোট্ট করে একটি নাচের মুদ্রা দেখালেন তার কমনীয় হাতের, পায়ের, কোমরের যৌথ ভঙ্গিযোগে। তারপর চারপাশের নিস্পলক দৃষ্টিগুলোর উদ্দেশ্যে বিনয়সূচক মাথা নোয়ালেন। বিস্ময়ে বিগলিত মাতাল পুরুষদের বিস্ময়কে প্রায় বিস্ফোরিত করে নিজের মুখের ওপর বাধা মিহি পাতলা আড়ালটি উন্মোচন করতে আরম্ভ করলেন—খুব ধীর-স্থির কায়দায়। মদ্যপরা বাজপোড়া গাছের মতো অনড় হয়ে কেবল তাকিয়ে থাকলেন। যেন তারা এই দুস্তর সন্ধ্যার কোনো একটি কাঙ্ক্ষিত তরজমা লাভ করছেন। কেউ চুল পরিমাণ এদিক-ওদিক হওয়ার চেষ্টাও করলেন না। নিজের চেহারা অবমুক্ত করা শেষ হলে রমণী পাথুরে মূর্তির মতো পানশালার মৃদু মন্থর আলোয় আর অকল্পনীয় নীরবতায় নিজেকে ডুবিয়ে রাখলেন। অনেকক্ষণ।

টেবিলের বাকি তিনজন রমণীর একজন হঠাৎ এই দীর্ঘ নীরবতার বুকে একটি ধারালো কণ্ঠের প্রশ্ন গেঁথে দিলেন—কেন তোমরা এগারোটি খুন করতে গেলে? তারপর আবার চলতে থাকল একই রকম নীরবতা। টেবিলের ওপর গ্রীবা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থেকেই রমণী একসময় নিথর ঠান্ডা গলায় ধীরে ধীরে বলতে লাগল—তোমরা কেন আমাদের হাতে অনির্ধারিত অস্ত্র তুলে দিলে? দিলে দিলে, সে অস্ত্রে আবার বেছে বেছে কেবল তিনটি খুনকে অনুমোদন করলে কেন? হাহহা হা হাহ হাহ জানোই যখন রক্ত সবসময়, হাহহা হা হাহ হা আরো রক্ত ডেকে আনে! আরো রক্ত আনবে নিশ্চয়ই।

কথা এবং হাসির ঝংকার মিলিয়ে যাওয়ার পর শুরু হল আবারও অখণ্ড একঘেয়ে নীরবতা। মদ্যপগণ প্রত্যেকে নিশ্চল-নিস্তব্ধতায় কেবল নিজ নিজ হৃদপিণ্ডের আওয়াজ শোনা ছাড়া আর কিছুই করার পেলেন না। তাদের ভেতর সম্ভবত তখন নতুন করে আবার প্রশ্নের নীরব ঢেউ জাগতে লাগল—কেন তিনটি খুন? কেন রক্তপাত? কেন বাইরে এত বৃষ্টি? কেন আরো আনবে নিশ্চয়ই?

ম্যানেজার হঠাৎ গম্ভীর গলায় ঘোষণা করলেন—অনেক হয়েছে। এবার যে যার বাড়ি ফিরে যাও। বৃষ্টি থেমে গেছে। রাতও আর খুব একটা বাকি নাই।

   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাসবিদ-দার্শনিক মুঈন উদ-দীন আহমদ খান জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন এক মনীষীর নাম। বাংলাদেশের বিদ্যাবৃত্তে ক্লাসিক্যাল চরিত্রের শেষ দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। ২৮ মার্চ (বৃহস্পতিবার) ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। 

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান (১৮ এপ্রিল, ১৯২৫-২৮ মার্চ, ২০২১) নির্জলা তথ্যভিত্তিক ইতিহাসের খোঁজে সুদীর্ঘ জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চার কষ্টসাধ্য দিনগুলো অতিবাহিত করেন নি। তিনি মনে করতেন, ইতিহাসের সত্য সন্ধান শুধু তথ্য আর যুক্তি ভিত্তিক নয়। প্রকৃত ইতিহাস মূলত ইতিহাসের দর্শন, ইতিহাসের পুনর্গঠন, কল্পনা, সমকালীন পর্যালোচনা ও ইনটুইশনের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সান্নিধ্যে এলে সবাই এই সত্য টের পেতেন যে, ইতিহাস প্রধানত দর্শন ও সাহিত্যের সমধর্মীতায় বর্তমানের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বাস্তবতা ভিত্তিক সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণের এবং দিকনির্দেশনা দেওয়ার অপরিহার্য মাধ্যম। তাঁর স্বকীয় চিন্তার দ্যুতিতে তিনি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা চর্চা ও গবেষণায় একটি বিশিষ্ট ধারার প্রতিভূ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবং একটি পুরো জীবন সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাচর্চার ধ্যানজ্ঞানে যাপন করেছেন। আর চট্টগ্রামের নিরিখে তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা কাঠামোর আদি নির্মাতাদের অন্যতম। যেমনভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র ড. আবদুল করিম ছিলেন ইতিহাসচর্চার প্রতিষ্ঠাতা, প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ইংরেজির, ড. আর. আই চৌধুরী রাজনীতি বিজ্ঞানের, তেমনিভাবে তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবদ্ধ বিদ্যাচর্চা ধারার সূচনাকারী। চট্টগ্রামের আধুনিক উচ্চশিক্ষা বিস্তারের আদি মুঘলদের একজন ছিলেন তিনি।  

তিনি ছিলেন আড়ম্বরহীন জ্ঞানসাধক। নিজস্ব বিদ্যাবলয়ের বাইরে তাঁর কোনও আত্মপ্রচার বা আত্মগরিমা ছিল না। যদিও তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার মতো যোগ্য লোকের সংখ্যা তাঁর আশেপাশে খুব বেশি ছিল না, তথাটি যারা তাঁর রচনা খেয়াল করে পড়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে কিংবা অনানুষ্ঠানিক পরিসরে আলাপ, আলোচনা, সংলাপ ও বিতর্কের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন, কত ভাষা, কত বিষয়, কত তত্ত্ব ও তথ্যাদি সম্পর্কে অনায়াস দক্ষতা ও পা-িত্য ছিল প্রাচ্যদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের এই জ্ঞানতাপসের। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চুনতী গ্রামের আদিবাস আর পুরনো চট্টগ্রাম শহরের রুমঘাটা থেকে এই মান্যবর জ্ঞানবৃদ্ধের কাছ থেকে বিচ্যুরিত দীপ্তি কিছু কিছু অনুভব স্পর্শ করেছে দেশে-বিদেশে তাঁর কর্ম ও গবেষণা ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

তাঁর জ্ঞান, গবেষণা, মনীষা, বুদ্ধির দীপ্তি, বহু ভাষায় পারঙ্গমতা তাঁর সমকালে অন্য কারও মধ্যে বিশেষ পরিলক্ষিত হয় নি। বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চায় প্রবাদপ্রতীম ড. আহমদ হাসান দানি যে তিনজন ছাত্রকে গবেষণায় প্রণোদিত ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান তাঁদের একজন। অন্য দুইজন হলেন আবদুল করিম ও মোহর আলী। এই তিনজনই বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় সত্যিকারের মৌলিক অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান প্রাথমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষাজীবনে প্রথম বিভাগ, স্বর্ণপদক, ফেলোশিপ ও বৃত্তি লাভ করেন একজন মেধাবী ছাত্র রূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর তিনি মোটেই থেমে থাকেন নি। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার বিখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। ফিরে এসে খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ড. আহমদ হাসান দানির তত্ত্বাবধানে ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ বিষয়ে পথপ্রদর্শনকারী পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেন। তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েট ফেলোশিপ লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বার্কলের ‘ইন্সটিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’-এ রাজনীতি বিজ্ঞানের ‘সেমিনার ইন ফিল্ড ওয়ার্ক কোর্স’ অধ্যয়ন করেন। তিনি কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রখ্যাত প-িত, ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের সান্নিধ্যে এসে বহুবিদ্যায় পারদর্শী হন। যে কারণে, পরবর্তী জীবনে তিনি ইসলামিক স্টাডিজ ও ইসলামের ইতিহাসকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, বিশেষত এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের ক্ষেত্রেও নিজের অবদান রাখেন এবং তাঁর গুণমুগ্ধ শিক্ষার্থীদের ছাড়াও তাঁর মূল-বিষয়ের বাইরের লোকজনকেও প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন নেতৃস্থানীয় শিক্ষক যথাক্রমে মর্শন বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান বদিউর রহমান এবং কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন শব্বির আহমদ তাঁর অধীনে পিএউচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

গবেষণা তত্ত্বাবধানে তিনি ছিলেন প্রচ- রকমের শুদ্ধতাবাদী। একটি প্রকৃষ্ট গবেষণার জন্য ¯œাতকোত্তর ও এমফিল পর্যায়ের গবেষকদেরও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত করতেন, যাতে তারা ভবিষ্যতে গবেষক হিসাবে স্বাধীনভাবে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। তাঁর সাথে গবেষণার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ড. আফম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, “তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর অনুমোদন নিয়ে কলকাতা, লক্ষেœৗ, দিল্লি, তুঘলকাবাদ, করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ, মক্কা ও মদিনা সফর করি।” কোনও মতে একটি ডিগ্রি দিয়ে দেওয়ার অসৎ পন্থার বিপরীতে গবেষণাকে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর করতে তিনি ছিলেন একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী শুদ্ধতম তত্ত্বাবধায়ক। শেষজীবনে তাঁর সঙ্গে বা পরামর্শে যারা গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মানস গঠনে ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নির্মাণে তিনি শ্রমবিমুখ ছিলেন না। ঘন্টার পর ঘণ্টা তিনি তাঁদের সঙ্গে আলোচনা কিংবা বই-পুস্তক পর্যালোচনায় লিপ্ত হতেন। এমন চিত্র আমি নিজে তাঁর বাসভবনে উপস্থিত কালে লক্ষ্য করেছি। কখনও নবাগত গবেষকদের তিনি অন্যান্য শিক্ষক ও গবেষকদের কাছে পাঠাতেন। তাঁর রেফারেন্সে একাধিক তরুণ গবেষক আমার কাছে এসে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাঁর রেফারেন্সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন। একটি বস্তুনিষ্ঠ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণা সম্পন্ন করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ত ও প্রণোদনাদাতা রূপে ছিলেন নিরলস।   

কঠোর তথ্যনিষ্ঠা ও শুদ্ধতার প্রতিফলন ঘটেছে মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের প্রতিটি রচনায়। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ও প্রবন্ধগুলো যে কারণে একই সাথে পাঠকপ্রিয় এবং অ্যাকাডেমিক জ্ঞান ভা-ারে মণি-মুক্তা তুল্য। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব ফরায়েজি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল’ একটি পথিকৃৎ গবেষণা, যা ‘বাংলায় ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়েছে। যে ফরায়েজি আন্দোলনকে ওয়াহাবি আন্দোলন বা তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া নামেই সবাই জানতো, তিনি তাঁর বহুমাত্রিক চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত করেন।  ফারায়েজি আন্দোলন যে কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক গতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রথম ও আদি প্রচেষ্টা, তিনিই সর্বপ্রথম তা প্রমাণ করেন। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে উত্থিত এই আন্দোলনের গণমুখী চরিত্র, ঔপনিবেশিকবাদ বিরোধী বৈশিষ্ট্য, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার বিরোধী মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াকু মানসিকতার বিষয়াবলী তিনি ঐতিহাসিক তথ্য ও ধর্মতাত্ত্বিক মাত্রায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে উপস্থাপন করেন। বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও বৃহৎ ক্যানভাসে গবেষণার কৃতিত্বে তিনি এই বিষয়ে এবং ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস বিনির্মাণের পথিকৃৎ প্রাণিত স্বরূপে সর্বমহলে সম্মানীত হয়েছেন। 

পরবর্তীতে প্রকাশিত মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের গ্রন্থ ও প্রবন্ধে তিনি তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ রেখেছেন। প্রতিটি লেখাতেই তিনি নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর লেখায় দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইত্যাদি বহুবিদ্যার প্রকাশ ঘটেছে। শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও গবেষণার বাইরে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাধারাকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করার প্রয়াস। তিনি ছিলেন ধ্রুপদী দার্শনিকদের মতো সংলাপ-প্রবণ ব্যক্তিত্ব। কেউ আগ্রহী হলে কিংবা কারো প্রতি তিনি আগ্রহী হলে তাঁকে বা তাঁদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হতেন। তিনি তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানদের মতো বইয়ের পাতার শুকনো অক্ষরে বন্দি ছিলেন না, জ্ঞানবৃত্তের মানুষের সঙ্গে প্রাণবন্ত সংলাপ ও সংশ্লেষের মাধ্যমে সদা জীবন্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে তো বটেই, বৃহৎ বঙ্গদেশে খুব কম সংখ্যক প-িতই এমন ছিলেন, যারা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় অন্যকে প্রণোদিত করার ক্ষমতা ধারণ করতেন। ঢাকায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং চট্টগ্রামে ড. আবদুল করিম, ড. আর. আই. চৌধুরী ছাড়া কম প-িতই ছিলেন, যারা শিক্ষার্থীদের প্রাণিত করার ক্ষেত্রে মনীষী মুঈন উদ-দীন খানের সঙ্গে তুলনাযোগ্য।

জ্ঞানের সঞ্চার ও বিস্তারে তাঁর অসীম কষ্ট সহিষ্ণুতা, আগ্রহ ও বিনয় তাঁকে ক্লাসিক্যাল যুগের প্রাচীন জ্ঞানতাপসের আধুনিক প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সান্নিধ্যে এসে আমি তা স্পষ্টভাবে অনুভব করি। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। এবং বয়সের দিক থেকে তিনি ছিলেন আমার চেয়ে কয়েক প্রজন্ম অগ্রগামী। তথাপি অশীতিপর বয়সে এসেও তিনি আমার কোনও লেখার প্রতি আগ্রহী হলে নিজে ফোন করে জানিয়েছেন। ডেকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং বিষয়টিকে তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে আরও সমৃদ্ধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেসব আলোচনায় জ্ঞানতত্ত্ব ও তুলনামূলক দর্শন সম্পর্কে তাঁর অতলস্পর্শী পা-িতের দীপ্তিমান প্রভার আঁচ পাওয়ার বিরল সুযোগ আমার হয়েছে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছিল, বহু তরুণকে তিনি গবেষণার দিক-নির্দেশনা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দিতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর মধ্যে পথ প্রদর্শনের একটি বিরল গুণ ছিল। আর ছিল জ্ঞানকে অকাতরে ছড়িয়ে দেওয়ার উদার মানসিকতা, যা আজকের অ্যাকাডেমিক প্রতিযোগিতার পঙ্কিল ও সঙ্কীর্ণমনা ধারার প্রেক্ষিতে অকল্পনীয় বিষয়। বড় মন ও মুক্ত মানসিকতার কারণে তিনি ‘বাংলাদেশের লিলিপুট প-িতদের সমাবেশে’ মহীরূহ-সম ব্যক্তিত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন।   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের মতো বিটপী ব্যক্তিত্বকে দৃশ্যপটে রেখে আজকের ক্ষুদ্রতর পরিসরে আলোচনা করা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমানের ঊন-মানুষ ও ঊন-মানসিকতার পরিম-লে তাঁর মতো বড় মানুষের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। তিনি এবং তাঁর সমগোত্রীয়রা শেষ মুঘলের মতো দৃশ্যপট থেকে চলে গিয়েছেন। কিন্তু রেখে গিয়েছেন ধ্রুপদী ঐতিহ্য, ব্যক্তিত্বের দীপ্তি ও বিভা। তিনি ছিলেন প্রথম প্রজন্মের আধুনিক বাঙালির হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে সকল অগ্রণী প-িত, গবেষক ও শিক্ষাব্রতীগণের শ্রেষ্ঠতম ও উজ্জ্বল প্রতিনিধি, যারা  জাগতিক প্রাপ্তির আশায় জ্ঞানের সাধনা করেন নি। জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাচর্চার নিতান্ত আবশ্যক পরিসীমার বাইরেও তাঁরা সচরাচর যান নি। তাঁদের নিতান্ত আবশ্যক বস্তুর তালিকায় সর্বাগ্রে ছিল জ্ঞানচর্চা, বিদ্যার্জন ও গ্রন্থপাঠ। বিষয় ভিত্তিক প্রয়োজনীয় বইয়ের বাইরেও অন্য বিষয় সংক্রান্ত রচনা তাঁরা পড়তেন আনন্দ ও কৌতূহল নিবৃত্তির সুতীব্র আকর্ষণে। কারও কারও পুস্তক সংগ্রহ আর রোজগারের মধ্যে কোনও ভারসাম্য থাকতো না। জাগতিক উন্নতির বিষয়গুলোকে তাঁরা তুচ্ছ বিবেচনা করে অবজ্ঞা করেছেন। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর মতে, “যে জীবনে বৈষয়িক উন্নতির সম্ভাবনা বিরল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ সত্যিই সারস্বত-কর্মে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বর্তমানের বিশ্লেষণপ্রবণ গবেষণার ধারা তখনও প্রবল হয় নি। কিন্তু অনেক গবেষণাই গভীর পা-িত্যের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতো।” মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান সম্পর্কে এই বক্তব্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আত্মমগ্ন ধ্যানীর মতো সারা জীবন তিনি জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থেকে গভীর পা-িত্যের পরিচয় দিয়েছেন। শুধু নিজেই নন, প্রণোদিত করেছেন পরবর্তী বেশ কিছু প্রজন্মের উৎসাহী তরুণদের, যাদের অনেকেই বিদ্যাচর্চায় লিপ্ত রয়েছেন।

তাঁর সঙ্গে ইতিহাসের আরেক মহান সাধক যদুনাথ সরকারের কিছু কিছু বিষয় তুলনীয়, যার মধ্যে রয়েছে প্রবল পরিশ্রম, জ্ঞান তৃষ্ণা এবং অনুসন্ধান। যদুনাথের বিশ্লেষণের নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বিতর্ক থাকার পরেও ইতিহাসচর্চায় তিনি সর্বজনমান্য আচার্য। তিনি নিজের কর্ম ও জীবন আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি করতেন: “পথের প্রান্তরে করি নাই খেলা/শুধু বাজায়েছি বসি সারাবেলা/ছিন্নতন্ত্রী বীণা।” মনীষী প্রফেসর ড. মুইন উদ-দীন আহমদ খানও সারাজীবন জ্ঞানচর্চার বাঁশরী বাজিয়েছেন। একটি আস্ত জীবনকে উৎসর্গ করেছেন জ্ঞানের সাগরে অবগাহনের মাধ্যমে। বিদ্যার্চচাকে পেশাগত পরিম-লে জিম্মি না করে জীবন ও যাপনের মূলমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। আর সব কিছুই তিনি করেছেন নিজের সুমৃত্তিকা ও মানুষকে কেন্দ্র করেই। জীবনের পর্বে পর্বে নানা দেশে, নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তিনি অবশেষে ফিরে এসে আলোকিত করেছেন প্রিয় মাটির প্রিয় মানুষদের, প্রিয় জনপদকে। জীবনের দিনগুলোর মতোই মৃত্যুর পরেও তিনি আলোর দিশারী হয়ে দেদীপ্যমান রয়েছেন জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যামুখী অভিযাত্রীদের চৈতন্যের মর্মমূলে।  

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম  সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;

তোমার বীণায় সুর ছিল



প্রদীপ্তকুমার স্যানাল
দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘দিল্লী চলো, চলো দিল্লী’ সুভাষকণ্ঠে আটত্রিশ কোটি আশি লক্ষ হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর যেন এই মুহূর্তে পাচ্ছি আবার শুনতে। দিল্লীর মাটিতে স্বাধীন বাংলার প্রথম রাষ্ট্রপতি পা দিলেন-অবিস্মরণীয় সেই মুহূর্তে শুনি বিস্ময়কর অভিভাষণ, ভারতের আকাশে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত সাড়ে সাত কোটির কণ্ঠস্বর একটি কণ্ঠে। মুজিবর রহমান ..সেই নাম। আমি জানি, নামমাত্র নয় সেই নাম; সমস্ত বাঙালীর সংগ্রামের নামান্তর সে নাম আমাদের আগামীকালের ইতিহাস গড়বে।

লন্ডনের হোটেলে ছিন্নবেশে পা দিয়েছিলেন তিনি যাঁর নির্দেশে বীণা তুলে নিয়েছে ছিন্নকণ্ঠ, মানুষ শুনেছে মৃত্যুর গর্জন সঙ্গীতের মতো। সেই নেতার গলায় স্বাধীন বাংলার প্রথম বরমাল্য তুলে দেওয়ার মহত্তম সৌভাগ্যের অধিকারী আমরা। ভারতবর্ষ তাঁর ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছে কণায় কণায়। এই মুহূর্তে সমস্ত কিছুর রং বদলে গেছে। এপারের মানুষও উন্মাদ হয়েছে ওপারের মানুষের উদ্বেল হওয়ার মুহূর্তে।

স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি থেকে-যে বিপ্লবী বীর এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে অগ্রসর প্রথম পদাতিক মুজিব (?) তুমি আমাদের ..চিত্তের প্রণতি গ্রহণ করো। তোমার মুখে ‘আমার সোনার বাংলা তোমায় ভালোবাসি’ বাংলার জাতীয় সঙ্গীত হল..। কত আন্দোলনে যে বাংলা ভাষা প্রাণ ফিরে পেয়েছিল তা প্রাণবন্ত হল দিল্লীর জনসভায় তোমার অভিভাষণের জোযারে। দেশবন্ধুর মৃত্যুহীন প্রাণ নেতাজী, আর সেই প্রাণের নিঃসীম স্পন্দন তোমার নেতৃত্বের অঙ্গে অঙ্গে।

শেখ মুজিব তাঁর বক্তৃতায় বলেছেনঃ আমি মানুষ, আমি বাঙালী, আমি মুসলমান। বাঙালীর হৃদয় থেকে উৎসারিত যত কথা যত ভাব সব নেতার একটি ঘোষণায় সুস্পষ্ট চেহারা নিয়েছে। এর চেয়ে সত্য ভাষণ আর কি হতে পারে! সবার উপরে মানুষ সত্য-মনুষ্যত্বের দাবী সবার আগে। মানুষের বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠায় পৌঁছবার লক্ষ্যে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, তার প্রথম পর্যায় সমাপ্তির মুখে। এর চেয়ে সত্যোন্মুক্ত বাণী নেতৃত্বের জবানীতে আর কি হতে পারে? সর্ব প্রথম মানবমুক্তি তার পর অন্য প্রয়োজন। ভাই শেখ সাহেব তাঁর ভাষণের প্রথমেই বলেছেন, প্রতিহিংসার নয় ক্ষমার ক্ষমা সুন্দর মুখকে বাঙালী নিভৃতেও ফুটিয়ে তোলার কথা। এই অন্যায় অবিচারের তুলনা বিরল, দুর্ঘটনায় পরিসমাপ্তির সন্ধিক্ষণে শত্রুকে ক্ষমা করার ঔদার্যে মহিমান্বিত প্রসন্নোক্তি আর কবে কোথায় শোনা গেছে? দেশের মানুষকে কবে কোথায় কোন নেতৃত্বের অভয়বাণী যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই শোনাতে পেরেছে শান্তির ললিতবাণী। তাই মনুষ্যত্বের কথা, মানুষের কথা ওঁর মুখে মানায়। অসহযোগ আন্দোলন পূর্ণতম সাফল্যকে সর্বাত্মক মুক্তির আগমন মুহূর্তে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ দেওয়া যাঁর নেতৃত্বে সম্ভব সেই নেতার মুখেই মানায় শান্তির বাণী। দুর্বলের মুখে শান্তির প্রয়াস হাস্যকর নয় শুধু অট্টহাসিকরও বটে।

বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম শুরু হওয়ার পরেই-বিভিন্ন মুখে শুনেছি এর নানা বিশ্লেষণ, বৃহত্তর হিসেব নিকেশ। তবু যা একবারও শুনিনি, একটি মানুষের মুখেও যে সত্য উক্তি একবারের জন্যও শোনা যায়নি, তা হল, এ সংগ্রাম সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর সংগ্রাম, এ সংগ্রাম বাঙালীর জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম। সেই দুর্ণিবার জাতীয়তাবোধকে ইজমের ধোঁয়ায় অন্ধকারে যদি বিপথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হত তবে ইয়াহিয়া চক্রের পক্ষেও সম্ভব ছিল এ যুদ্ধ জয় করা। বাঙালীয়ানাই বাঙালীর সবচেয়ে উজ্জ্বল সত্য চরিত্রচিত্র। তাই দিল্লীর জনসভায় মুজিবের কম্বুকণ্ঠে যখন শুনিঃ

‘‘আমি জানতাম না আবার আপনাদের মধ্যে ফিরে আসতে পারব। আমি ওদের বলেছিলাম তোমরা আমাকে মারতে চাও, মেরে ফেল। শুধু আমার লাশটা বাংলাদেশে আমার বাঙালীদের কাছে ফিরিয়ে দিও।’’

তখন তাঁকে শুধু বাংলা বলব, না, সমস্ত মানুষের দুঃখে তার নেতার কণ্ঠে একে বেদনার করুণ বিপ্রলম্ভ বলব। তবু এত ভালবাসা, এত ¯েœহসিক্ত আনন্দের নির্ভরতা বাঙালীর জাতীয়তাবোধ ছাড়া আর কোন পথে আসা সম্ভব। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সঙ্গীতের এই প্রথম লাইনেই বঙ্গহৃদয় সোনা হয়ে গেছে। এই গান মুখে নিয়ে বাঙালী প্রাণ দিয়েছে। তবু এই সংগ্রামকে যদি বাঙালী জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম না বলি, তবে মিথ্যা ভাষণের ফল আমাদের পেতেই হবে। বাঙালীর বাঁচারও বটে মরারও বটে একমাত্র প্রশ্ন তার ভাষা। এ সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মুহূর্তে। বাঙালীর সবচেয়ে কোমল সবচেয়ে নিভৃত মর্মকোষ তার ভাষা। সেই কোমল স্থানেই আঘাত করে শাসনচক্র চেয়েছিল বাঙালীকে নিশ্চিহ্ন করতে। বেদনায় বিক্ষত বাঙালী হৃদয় কঠিনতম প্রতিজ্ঞায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। সে প্রতিজ্ঞা সফল হয়েছে। সেই সফলতার উৎসে বাঙালীর সবচেয়ে প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ। বাঙালী কবি। তাই কবিতাই তাকে রক্তাক্ত করেছে, করেছে সুজলা সুফলা।

এমন কঠোরে, কোমলে, আনন্দ বেদনায়, হাসিকান্নার হীরাপান্নায় আর কোন দেশের ইতিহাস হয়ে আছে গাঁথা। ধর্ম নিয়ে অধর্মের রাজনীতি করার পুরণো পথ পরিত্যাগ করেছে বাংলাদেশ। দুর্দিনে অশ্রুজলধারায় বাঙালীর চেতনা থেকে ধর্মান্ধতার ক্লেদ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। বাঙালী মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ অথবা খৃষ্টান এসব কিছুই নয়। বাঙালীর একমাত্র পরিচয় যে বাঙালী। এই সত্যটুকু বাঙালীকে বুঝে নিতে রক্তের মূল্য দিতে হয়েছে বারংবার। যতদিন বাঙালী হিন্দু, মুসলমান অথবা বৌদ্ধ, খৃষ্টান ছিল, ততদিন জঙ্গীশাহীর শোষণের থাবাও ছিল অপ্রতিহত শক্তিতে উদ্যত। যে মুহুর্তে বাঙালীর মুখ থেকে খসে পড়েছে ধর্মীয় বাধানিষেধের মিথ্যে মুখোশ সেই ক্ষণ থেকেই শোষণে কায়েমী সিংহাসন বাংলার মাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেল। কারণ এই ধর্মীয় বাধানিষেধকে সম্বল করেই দীর্ঘদিনের শোষণে পাক জঙ্গীচক্র বাংলার মানুষকে নিঃস্ব করেছে, সব কিছু লুঠে নিয়েছে বাংলার বুক থেকে। রক্তস্নাত বাংলা আজ শোষণহীন, বাঙালীর আজ একটি মাত্র পরিচয় সে-বাঙালী।

বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক এবং সবার বড় কথা সে আজ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। মুসলিম ইতিহাসে এ এক বিরাট নজির। ধর্ম আজ বাংলাদেশে ব্যক্তিগত বিষয় ছাড়া কিছুই নয়। তার নেতার কণ্ঠেও আজ এরই প্রতিধ্বনি। বাংলাদেশের সাথে ভারতবর্ষের পরবর্তীকালে কি সম্পর্ক দাঁড়াবে তা এই প্রথম দিনেও সুস্পষ্ট। বাংলা এবং ভারতের নীতি এক এবং সে নীতি দুর্ণীতির মুলোচ্ছেদ। বাংলাদেশের পাশে বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে এগুতে পেরে, পৃথিবীর পৃথিবীর মহত্তম স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশে একমাত্র সাহায্যদাতা হিসেবে থাকতে পেরে ভারতবর্ষ বিশ্বের শক্তির ভারসাম্য সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। অন্যের কৃপাকণায় বেঁচে থাকার দুর্দিন আজ ভারতবর্ষের সৌভাগ্যের ঊষা লগ্নে অপসৃত। মুজিবের কণ্ঠে কৃতজ্ঞতার সহৃদয় সম্ভাষণ ভারতবর্ষের মানুষকে ঘিরে, ইন্দিরাকে ঘিরে। বাংলাদেশ তার চরম দুর্ভাগ্যের মধ্যে ভারতবর্ষকে যে বন্ধুত্বের মর্যাদায় বসিয়েছে তা ক্ষুন্ন হওয়া কোন চক্রান্তেই সম্ভব নয় আর।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সাফল্যের দ্বারে উপনীত করার প্রতিটি পদক্ষেপে নেতা মুজিব পেয়েছেন নেতাজীর ভাব নির্দেশ। আমরা আজ গর্বিত। বাংলার মানুষের দুঃখের বটে সুখেরও বটে সমান অংশীদার ভারতবর্ষ। মুজিবের নেতৃত্বে নেতাজীর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে আসমুদ্র হিমাচল। (নিবন্ধে প্রদীপ্তকুমার স্যানাল ব্যবহৃত বানানরীতি অবিকৃত রাখা হয়েছে)।

প্রথম প্রকাশ: রবিবারের বসুমতী সাময়িকী, ১৬ই জানুয়ারি ১৯৭২; দৈনিক বসুমতী

সংগ্রহ ও সম্পাদনা: আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম

ঋণস্বীকার: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা।

;