নৃবিজ্ঞান পাঠের ভূমিকা
সম্ভাষণের শুরুতেই আমরা আপনাদের কাছে করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থণা করে নিচ্ছি।
প্রিয় জ্ঞানী ও বিজয়ী বন্ধুগণ, যে গল্পটির কথা উল্লেখ করে আপনাদের আজ এখানে আমন্ত্রণ করেছি, দুর্ভাগ্যবশত সেটি এই মুহূর্তে উপস্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা লজ্জিত এবং আন্তরিকভাবে দুঃখিত। এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা আপনাদের ও আমাদের উভয়ের জন্য নিশ্চয়ই সমান বিব্রতকর। ক্ষমা চাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নাই। আশা করি আপনাদের জ্ঞান এবং বিজয়ী মন আমাদের ক্ষমা করবে।
আমাদের প্রায় সবই প্রস্তুত ছিল। গল্পটি বেশ সুষ্ঠু সুন্দর গাঁথুনীসহ একটি নতুন আঙ্গিক অর্জন করেছিল। এর ভাষায় ছিল অনুপম নির্মেদ বর্ণনা আর ঝরঝরে গতি। চরিত্ররা লাভ করেছিল মর্যদাপূর্ণ বিকাশ। দৃশ্যগুলোয় ভরেছিল প্রয়োজন মতো রোদ, বৃষ্টি, উত্তাপ, আলোড়ন এবং আলো-অন্ধকার। বিশ্বাস করুন, শ্রমে-নিষ্ঠায়-কলায়-কৈবল্যে, আমরা আমাদের সাধ্যের শেষ রেখা পর্যন্ত পরিশ্রম করেছি। আমরা খুব আশাও করেছি গল্পটি আপনাদের পছন্দ হতো কি হতো না, অন্তত কোনো বাস্তবের প্রয়োজনে ঠিকই লেগে যেত। আপনারা হয়তোবা গল্পটিকে আপনাদের বিদগ্ধ অভিজ্ঞতার অংশ করে নিতেন। যা হতে পারত নিশ্চিতভাবে আমাদের জন্য বহু প্রতীক্ষার এক মনোরম গৌরব। নিছক দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কী; এক অব্যখ্যেয় জটিলতার দরুন আজ এই মুহূর্তে গল্পটি আপনাদের সামনে হাজির করা গেল না। সমস্ত দায় স্বীকার করে নিয়ে আন্তরিকভাবে আবারও আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি।
প্রিয় জ্ঞানবিজয়ী সাহসী বন্ধুগণ, আপনাদের অবশ্য একদম আশাহত হওয়ার কারণ নাই। কিছুক্ষণের মধেই আমরা আপনাদের নিয়ে যাব আমাদের হাতে থাকা একটি বিকল্প গল্পে। আপনারা দয়া করে ততক্ষণ আপনাদের মেজাজ ধরে রাখুন। গল্পটির সঙ্গে আপনাদের আশা করি খুব একটা খারাপ কাটবে না।
সন্ধ্যা-নিমন্ত্রিত প্রিয় বীর বন্ধুগণ, সবাইকে স্বাগতম আর আন্তরিক অভিনন্দন! আমাদের এ বিকল্প গল্পটি অনেকাংশেই নিরীক্ষাধর্মী। প্রথাগত বিন্যাশকে সুচারু কায়দায় এফোঁড়-ওফোঁড় করা হয়েছে গল্পটির মূল স্থাপত্যে। যেটা কিছুটা অভিনব। এর ভাষা অবশ্য খুব একটা কারুকার্যময় নয়। বরং বেশ এবড়ো-থেবড়ো। কাহিনীটি ভালো। কিন্ত কাহিনীর মোড়ে মোড়ে স্থান করে নিয়েছে লাগামহীন চমক আর অতি নাটকীয়তা। যা হয়তো কারো কাছে আকর্ষণীয় আবার কারো কাছে নান্দনিক বিচ্যুতি হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। ঘটনার পরম্পরা ঠিক থাকলেও বাঁধনটি অত্যন্ত মজবুত হয়েছে বলে আমাদের দাবি করার সুযোগ নাই। সে আপনাদের সুতীক্ষ দৃষ্টিতে ঠিকই ধরা পড়বে। সর্বপোরি গল্পটি সম্পর্কে আমাদের পূর্বাভাষ বলতে গেলে এক কথায় বলতে হবে—আহামরি কিছু না হলেও মোটামুটি চলনসই। কিন্ত একটা বড় মুশকিল হয়ে গেছে এর অবাধ্য চরিত্রদের নিয়ে। ব্যাপারটা আরেকটু স্পষ্ট করে বলা দরকার। ঘটনাটা হলো—গল্পের চাঞ্চল্যের স্বার্থে আমাদের গল্পকার চরিত্রদের হাতে শুরুতেই কিছু অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দিয়েছিলেন। এক পর্যায়ে তাদের জন্য একে একে তিনটি খুনের ঘটনাকে নিঃশর্ত অনুমোদন করেন। কাহিনী যখন পরিণতির দিকে এগুচ্ছিল তখন হঠাৎ এই খুনি চরিত্ররা গল্পের সকল নিয়ম-নিয়ন্ত্রণ লঙ্ঘন করে আশ্চর্যজনকভাবে বিপথগামী হয়ে ওঠে। গল্পকার শক্তহাতে চেষ্টা করলেন, কিন্ত তখন কিছুতেই আর তাদের রাশ টেনে ধরা গেল না। তাঁকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে অস্ত্রধারী খুনিরা, নির্বিচারে এগারোটি খুন করে গল্পটিকে যাচ্ছেতাই করে তোলে।
জ্ঞানীগণ, আপনারা নিশ্চয়ই আজ খলবলে উজ্জল আলোর এই সন্ধ্যায় এত খুনোখুনি আর অবাধ্য চরিত্রদের গল্প শুনে নিজেদের মূল্যবান মেজাজ খোয়াতে চাইবেন না। বলে দেয়ার নিশ্চয়ই অপেক্ষা রাখে না—নিজের হাতে খুন করার নিষিদ্ধ রোমাঞ্চে আর বসে বসে অন্যের খুন করার বা খুন হওয়ার গল্প শোনার মধ্যে কোনোই তুলনা হতে পারে না। আমাদের তাই প্রস্তাব, চলুন, এই রক্তপাত সর্বস্ব বিকল্প গল্পটি বাদ দিয়ে আমরা তৃতীয় কোনো নিরপেক্ষ গল্পে গিয়ে হাজির হই। তাতে হয়তো, হাত ফসকে যাওয়া আমাদের এই সন্ধ্যাটা, ভিন্নভাবে ভরে উঠতে পারে।
বিজয়ীগণ, নিপাট নির্ভেজাল এ তৃতীয় গল্পটিরও ঠিক এরকম একটি আলোকোজ্জ্বল সন্ধ্যাকে ঘিরেই শুরু। আপনাদের চেয়ে কে আর ভালো জানে—কোনো একটি সন্ধ্যা কখনোই কেবল একটি সন্ধ্যা নয়। তাকে ঘিরে থাকে নানান আকারের আরো হাজারটা সন্ধ্যা, ঢেউ, উপঢেউ, বিস্তীর্ণ বিশাল তটরেখা। কোনোভাবে ঢেউয়ে ঢেউয়ে যদি একবার তীরে ওঠা যায় তাহলেই মিলবে ডাঙ্গা। আর মিলবে মানুষ গন্ধা হাজার হাজার পথের খোঁজ।
সেই সন্ধ্যাটা আরম্ভ হয়েছিল বৃষ্টি দিয়ে। নিয়ম করা আটপৌঢ়ে শোঁশোঁ বৃষ্টি নয়। আচমকা মনে ভয় বাঁধিয়ে দেওয়ার মতো ঝাঁ-ঝাঁ ঝপ-ঝপ একটানা বৃষ্টি। সন্ধ্যার মুখেই শহরের রাস্তাঘাট, অফিসপাড়া, অলিগলি, মার্কেট চত্বর সব পুরো ফাঁকা হয়ে গেল। যারা বাইরে ছিলেন তারা বাড়িতে ঢুকে গেলেন। যারা বাড়িতে তারা আর বের হতে পারলেন না। শূন্য রাস্তার উপর ফ্লাডলাইটগুলো প্রাণপণে জ্বলতে থাকলেও সেটাকে দেখাল একটা কৌতুক দৃশ্যের মতো।
শহরের সবচাইতে বড় পানশালাটিতে এরমধ্যে মাত্র বিশ-পঁচিশজন খদ্দের উপস্থিত হতে পেরেছেন। প্রতি সন্ধ্যায় ধাপে ধাপে এখানে কয়েকশো মদ পিপাসু লোকের হৈচৈ, বাকবিতণ্ডা, পান-পশরা লেগে থাকে। আজ তার সিকিভাগও হলো না। কাঁচাপাকা চুলের আধবুড়ো ম্যানেজার বৃষ্টির গাঢ়ত্ব মেপে বুঝে গেলেন আজ তার ব্যাবসায় ভালোই কমতি আছে। বৃষ্টিকে বিড়বিড় করে দুয়েকটা গালাগাল দিয়ে উপস্থিত খদ্দেরদের দিকে মনযোগ দিলেন তিনি। ভেবে নিলেন আজ যারা দুর্যোগ অতিক্রম করে এসেছেন তারাই তার প্রকৃত পিপাসু। অন্যদিনের অত লোকজন সব মৌসুমী কিংবা শখের মাতাল। তাকে আজ তাই তার সহি খদ্দেরদের ভালো সেবা দেওয়ার সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে। ম্যানেজার তার কর্মীদের নিয়ে ঝটপট ঝটপট হাত চালালেন।
বাইরে তুমুল বৃষ্টি আর ভেতরে আসন-আয়েশের তুলনায় কম লোকজন ছাড়া অন্যদিনের সাথে আজ সন্ধ্যার পানশালার তেমন বিশেষ কোনো পার্থক্য নাই। প্রতিদিন পান করতে করতে কেউ না কেউ ষাঁড়ের মতো উচ্চস্বরে গান গেয়ে ওঠেন। তা আজও ঘটল। কেউ না কেউ ঝগড়া বাঁধান। কেঁদে ফেলেন। নিজের দুর্ভাগ্যের কথা স্মরণ করে নিজেকে এবং নিজের প্রভুকে গালাগাল করেন। একটা-দুইটা গেলাশ বা বোতল হাত ফসকে পড়ে ভেঙে যায়। আজ ঠিকঠাক সবই হচ্ছে।
পানরত মাতাল-আধমাতালদের কয়েকজন পানশালার ভেতর হঠাৎ আরেকটা পার্থক্য খুঁজে পেলেন। বড়সড় পার্থক্য। মদ-ঢুলুঢুলু চেহারায় তারা তা দেখে রীতিমত আঁতকে উঠলেন। যারা এখনো দেখেননি আঙ্গুলের ইশারায় তাদেরকে দেখাতে লাগলেন। প্রথাগত হালকা আলোতেও তারা সবাই ঠিক দেখতে পেলেন—একপাশের একটা টেবিলকে ঘিরে চারজন সোমত্ত রমণী বসে বসে দেদারসে পান করছেন। আর সহজ আমুদে মেজাজে নিজেদের মধ্যে আলাপ করছেন।
সবার চোখে একযোগে জেগে উঠল বিস্ময়ের মদিরাসক্ত জিজ্ঞাসা। যারা বছরের পর বছর এই পানশালায় নিয়মিত পান করতে করতে আয়ু প্রায় ক্ষয় করে ফেলেছেন তারাও কেউ কোনোদিন একজন রমণীকেও এখানে আসতে দেখেননি। তাদের ধারণা এ কেবল পুরুষদের নিজস্বতা উদযাপনের একক বারামখানা। অথচ আজ একসাথে চার চারজন রমণী। তাছাড়া এর প্রবেশদ্বারে বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে—কুকুর, আগ্নেয়াস্ত্র এবং মহিলা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। তাদের মনে প্রশ্ন জাগল তাহলে কি এই ঝাঁ-ঝাঁ ঝপ-ঝপ বৃষ্টি শুধুই বৃষ্টি নয়, অন্য কোনো কিছু উদ্বোধনের ঘোষণা?
মদ্যপদের জন্য বেশিক্ষণ একই বিষয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে ভাবতে থাকা একটু মুশকিলের। তাদের ভাবনা-চিন্তা তাই কিছুক্ষণের মধ্যে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-গড়িয়ে যেতে লাগল। এসময় কেন চার রমণী? কেন চারজন রমণী? কেন আজ বৃষ্টি-সন্ধ্যায় একসাথে চারজন রমণী? এমন সব আঁকাবাঁকা প্রশ্ন চাক বেঁধে উঠল তাদের চিন্তায়, চেহারায়, কথায়। কিন্ত কোথাও কোনো উত্তর নাই। অতি কৌতূহলীদের কেউ কেউ পানশালার কর্মীদের কানের কাছে মুখ নিয়ে (যেন রমণীরা শুনে ফেললে কিছু একটা অন্যায় হয়ে যাবে) ফিসফিস আওয়াজে রমণীদের ব্যাপারে জানতে চাইলেন। কর্মীরা কেউই এ বিষয়ে মুখ খুলতে রাজি হলেন না। পানাসক্ত কৌতূহলীগণ পুনরায় চেষ্টা করলেন, কর্মীদের হাতে বখশিসের মতো করে টাকা গুঁজে দিয়ে। কিন্ত এই অদ্ভুত বৃষ্টি আক্রান্ত সন্ধ্যায় কেন জানি পরিচিত সবকিছু মদ্যপদের কাছে অপরিচিত হয়ে ওঠল। কর্মীরা বখশিসও নিলেন না মুখও খুললেন না।
বাইরে তখনও অরাজক তুমুল বর্ষণ। অলিতে গলিতে রুদ্ধ পানি উপচে ওঠায় ব্যস্ত। রাস্তায় সে পানি স্রোতের মতো এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে। ফ্লাডলাইটের আলোকে ঘিরে ধরে বল্লমের মতো বৃষ্টির ফোঁটা বাড়িয়ে চলল তার আশ্চর্য তাণ্ডব। চারপাশের সবার চোখকে ধাঁধা লাগিয়ে কিশোরীরা যেমন হঠাৎ যুবতী হয়ে ওঠে তেমনি সন্ধ্যাটা একসময় চট করে রাত বনে গেল। লাগামহীন বর্ষণ তার সাথে চলতে থাকল পায়ে পা মিলিয়ে।
পানশালার মদির বাতাসে ততক্ষণে জমে ওঠেছে দারুণ বিস্ময়, জিজ্ঞাসা আর রহস্যের এক দুর্বোধ্য ঘোর। পান করার বদলে সেগুলোই কেন যেন মদাসক্তদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিস্ময়-জিজ্ঞাসা-রহস্য—রহস্য-জিজ্ঞাসা-বিস্ময়, কিংবা রমণীচার-বৃষ্টিসন্ধ্যা-নিষেধের পানশালা ইত্যাদি যেন বাতাসের সাথে মিলে-মিশে, চারপাশ থেকে, বেষ্টির পানির মতো তাদেরকে ঘিরে ধরে থৈথৈ করে নাচতে লাগল। তারা হঠাৎ মনে মনে কী থেকে কী মিলিয়ে আঁচ করলেন, তাদের সরল নেশার সুযোগে, এখানে অথবা বাইরে, মহাজগতের কোথাও-না-কোথাও, তাদের নিয়ে কোনো একটা গভীর ষড়যন্ত্র হচ্ছে। কেবল তাদের নিয়েই।
নানান বয়সের নানান পেশার চেনা-অচেনা খদ্দেররা অল্পক্ষণের মধ্যে সকলে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে গেলেন। আত্মীয়তা বোধ করলেন পরস্পর পরস্পরের সাথে। তাদের প্রত্যেকের ভেতর সঞ্চার হলো নতুন এক শক্তি, সৌহার্দ্র এবং সাহস। ঝটপট সিদ্ধান্ত স্থির হলো তারা সরাসরি জানতে চাইবেন রমণী চারের কাছেই। তাদের মধ্য থেকে একজন কেউ রমণীদের সামনে গিয়ে প্রশ্ন করবেন। বাকিরা থাকবেন তার পেছনে। জানতে চাইবেন—এখানে এসব হচ্ছেটা কী?
আধবুড়ো ম্যানেজার তাদেরকে শান্ত হওয়ার পরামর্শ দিলেন। মনোযোগ দিতে বললেন নিজ নিজ বোতল আর গেলাশের দিকে। ম্যানেজারের রাশভারি পরামর্শের তারা থোড়াই কেয়ার করলেন। নতুন করে বরং কথা আরম্ভ করলেন তাদের মধ্য থেকে সেই প্রশ্নকর্তাটি কে হবেন এ নিয়ে।
এতজন বিক্ষিপ্ত মনের মদ্যপের ভেতর থেকে সর্বসম্মতিক্রমে একজনকে আলাদা করা তাদের জন্য বেশ মুশকিল হয়ে দেখা দিল। ঘোরঘোর মেজাজে কছুক্ষণ বাদে অবাক হয়ে তারা আবিষ্কার করলেন তাদের মধ্যে প্রায় সবাই সেই প্রশ্নকর্তাটি হতে আগ্রহী। কেউই নিজেকে পেছনে দেখতে রাজি নন। একের ওপর অন্যের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায় তাই তারা এমন এলোমেলোভাবে কথা বলতে আরম্ভ করলেন যে, সেটা শোনাচ্ছে অনেকটা নিচু স্বরের ঝগড়ার মতো। কে কাকে বলছেন, কে কাকে শুনছেন তা বোঝার কোনো উপায় থাকল না। একসময় তাদের গমগমে কথার গমক বৃষ্টির আওয়াজকেও ছাপিয়ে গেল।
এত হৈচৈ এতক্ষণের এত কোলাহল কিছুই যেন অনতিদূরের চার রমণীর টেবিলে পৌঁছাল না। তারা চারজন আগের মতো পরস্পর আলাপ করছেন। পান করছেন মনোযোগ দিয়ে। এবং তাদের নিঃসঙ্কোচ খোশমেজাজ রইল আগের মতোই নিরবিচ্ছন্ন। মাতালদের প্রতি তাদের আগ্রহহীন নির্বিকার ভঙ্গি তাদেরকে মুহূর্ত থেকে মুহূর্তে করে তুলছে আরো আকর্ষণীয়া, আরো রহস্য-মাধুরী।
কিছুতেই কিছু সমাধান হলো না। মতানৈক্যের শাখা-প্রশাখা একের পর এক কেবল বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে সেই সাথে তাদের গলার স্বরও। দুয়েকটা বোতল চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল কারো অসাবধান আচরণে। বুঁদ হয়ে থাকা অনেকের মেজাজে দেখা দিল আচমকা ধৈর্যচ্যুতির সম্ভাবনা। কারো আবার জাঁকিয়ে আনা নেশা মনোযোগের অভাবে হাতছাড়া হয়ে গেল। হঠাৎ একজন মতাল লাফ মেরে একটা টেবিলের ওপর উঠে দাঁড়ালেন। জনসভার বক্তার মতো গর্জনের গলায় শুরু করলেন বক্তৃতা। কিন্ত প্রতিরোধের মুখে কথা তিনি বেশিদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলেন না। অন্যরা তাকে টেনে নামিয়ে দিলেন। বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার আগে কেবল এটুকু তিনি জানাতে পারলেন—তার পিতা ছিলেন দেশের পূর্বাঞ্চলের দীর্ঘদিনের একজন দক্ষ প্রশাসক। তার মধ্যে তাই উত্তরাধিকার সূত্রে নেতৃত্বের সব রকমের যোগ্যতা রয়েছে।
বাইরে তখন উপচে ওঠা পানি বেড়ে হয়েছে প্রায় কোমর অবধি। শহরের অধিকাংশ নিচু এলাকা প্লাবনের মুখে তলিয়ে গেল। বৃষ্টির সাথে যোগ হলো প্রবল ঝড়ো হাওয়া এবং মুহুর্মুহু বজ্রপাত। এখানে ওখানে ভেঙে-উপড়ে পড়ল গাছপালা, বৈদ্যুতিক খুঁটি এবং ছোট বড় দালান-কোঠা। নিশ্চিত এর মধ্যে কিছু হতাহতের ঘটনাও ঘটে থাকবে। এমন দুর্যেগের জন্য এই ছিমছাম সেকেলে শহরটি মোটেও উপযুক্ত ছিল না।
পানশালায় ততক্ষণে আরেকজন স্বঘোষিত নেতৃত্বের দাবিদারকে পাওয়া গেল। আগের জনের তুলনায় বেশ দৃঢ়কণ্ঠে শুদ্ধ-শান্ত উচ্চারণে তিনি ঘোষনা করলেন—আমার পুর্ব পুরুষগণই এশহরের গোড়াপত্তন করেছিলেন। এশহর আমার শহর। এখানকার যে কোনো ছোট বড় নেতৃত্বে আমিই সবচেয়ে যোগ্য। অধিকার যদি কারো থেকে থাকে সেটা কেবল আমারই। মদ্যপ জনতা তাকে শুনলেন কিন্ত মানলেন না। একজন কেউ মশকরার গলায় বললেন, পুর্বপুরুষরা যে শহর গড়েছেন আপনি আজ সেটাকে ধ্বংস করবেন, এইতো! অন্যরা একযোগে হেসে কথাটাকে সমর্থন জানালেন।
বাইরে এসময় পানশালার খুব কাছে কোথাও প্রকাণ্ড আওয়াজে বাজ পড়ল। দেয়ালে দেয়ালে কাঁপন ধরানো গুড়ম্ম্ম্ আওয়াজে সবার ভাবনায় পড়ল সশঙ্ক ছেদ। সংক্ষিপ্ত এক পশলা নীরবতার পর তারা আবার আগের মতো কোলাহল শুরু করলেন। বাজ পড়াটা ছিল যেন দম নেওয়ার বিরতি। কেউ বৃষ্টি প্রসঙ্গে, কেউ বাড়ি ফেরার জটিলতা কেউ কেউ আবার নির্দ্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই হাউমাউ করে উঠলেন। তারা যেন একদম ভুলে গেলেন বাজ পড়ার আগে তারা নেতৃত্ব আর রমণীচার প্রসঙ্গে ছিলেন। কিন্ত এবার তাদের হৈ-হাঙ্গামা ক্রমে সব রকমের মাত্রাকে অতিক্রম করতে লাগল। ম্যানেজারের পাকা চোখ তাদের আচরণে কিসের যেন সংকেত খুঁজে পেলেন। কাউন্টার ছেড়ে সোজা চলে এলেন মাতালদের ভিড়ে। কিন্ত তারা ততক্ষণে বাইরের দুর্যোগের মতোই বিরল অবাধ্যতায় পরস্পরের ওপর ঝাপিয়ে পড়ার মতো পরিস্থিতিতে পৌঁছে গেছেন। যেন তারা দৈবযোগে টের পেয়ে গেছেন আজ সন্ধ্যায় শুরু হওয়া এই ঝড়ো-প্লাবনে তাদের শহরটি নির্ঘাত তলিয়ে যাবে। আর প্রত্যেকে এর জন্য দায়ী মনে করছেন অন্যদের।
মাতালদের কেউই লক্ষ্য করলেন না রমণীদের টেবিল থেকে একজন রমণী খুব সন্তর্পণে তাদের দিকে এগিয়ে আসছেন। তারা বরং তখন একটা উদ্দেশ্যহীন অত্মঘাতী সংঘর্ষের সূচনায় ব্যস্ত। তাদের বেমক্কা তর্জন-গর্জন বলে দিচ্ছে যে কোনো মুহূতেই সংঘর্ষ প্রবল আকার রূপ নিয়ে প্রত্যেককে প্রত্যেকের আক্রমণের ক্ষমাহীন লক্ষ্যে পররিণত করে তুলতে পারে।
তার হাঁটার ভঙ্গিটি ভীষণ মন্থর কিন্ত আকর্ষণহীন নয়। কিছুটা গোপন বার্তাবাহকদের মতো। রমণী যখন এসে তাদের জটলার একদম গাঁ ঘেষে দাঁড়ালেন তখনই কেবল তারা টের পেলেন। মুহূর্তেই প্রত্যেকে ঠিক বাজ পড়ার মতো নীরবতায় স্তব্ধ হয়ে গেলেন। সম্ভবত ভয় কিংবা অন্য কোনো অজানা কারণে তারা একচুলও নড়লেন না কেউই। রমণী নির্ভার জাদুময়ী চেহারায় তাদের দিকে তাকালেন। তাকালেন তাদের প্রত্যেকের দিকে আলাদা আলাদা করে, তার শান্ত-সৌম্য চোখ জোড়ার নরম দৃষ্টি দিয়ে। বিমূঢ় নিস্পলক চোখে তারাও তাকিয়ে আছেন। তাদের চোখে-মুখে-চেহারায় আবার ফুটে উঠল শুরুর দিকের সেই নির্দোষ বিস্ময় আর কাঁপাকাঁপা কৌতূহল।
রমণী কোনো কথা বললেন না। ছোট্ট করে একবার কেবল ঠোঁটের কোণে হাসলেন। সবাইকে আরেক প্রস্থ বিস্মিত করে দিয়ে একলাফে মাঝখানের একটা টেবিলে উঠে টানটান করে দাঁড়ালেন। চেহারায় তখনও তার ঠিকরে পড়ছে কোনো এক সুনির্দ্দিষ্ট প্রত্যয়। সবার উদ্দেশ্যে হঠাৎ ছুড়ে দিলেন হিহিহি স্বরে লাস্যময়ী ছন্দের হাসি। মাতালগণ সে হাসির কোনো জবাব দেওয়ার কোনো কারণ পেলেন না। হাসির রেশটুকু মিলিয়ে যেতে যেতে রমণী ছোট্ট করে একটি নাচের মুদ্রা দেখালেন তার কমনীয় হাতের, পায়ের, কোমরের যৌথ ভঙ্গিযোগে। তারপর চারপাশের নিস্পলক দৃষ্টিগুলোর উদ্দেশ্যে বিনয়সূচক মাথা নোয়ালেন। বিস্ময়ে বিগলিত মাতাল পুরুষদের বিস্ময়কে প্রায় বিস্ফোরিত করে নিজের মুখের ওপর বাধা মিহি পাতলা আড়ালটি উন্মোচন করতে আরম্ভ করলেন—খুব ধীর-স্থির কায়দায়। মদ্যপরা বাজপোড়া গাছের মতো অনড় হয়ে কেবল তাকিয়ে থাকলেন। যেন তারা এই দুস্তর সন্ধ্যার কোনো একটি কাঙ্ক্ষিত তরজমা লাভ করছেন। কেউ চুল পরিমাণ এদিক-ওদিক হওয়ার চেষ্টাও করলেন না। নিজের চেহারা অবমুক্ত করা শেষ হলে রমণী পাথুরে মূর্তির মতো পানশালার মৃদু মন্থর আলোয় আর অকল্পনীয় নীরবতায় নিজেকে ডুবিয়ে রাখলেন। অনেকক্ষণ।
টেবিলের বাকি তিনজন রমণীর একজন হঠাৎ এই দীর্ঘ নীরবতার বুকে একটি ধারালো কণ্ঠের প্রশ্ন গেঁথে দিলেন—কেন তোমরা এগারোটি খুন করতে গেলে? তারপর আবার চলতে থাকল একই রকম নীরবতা। টেবিলের ওপর গ্রীবা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থেকেই রমণী একসময় নিথর ঠান্ডা গলায় ধীরে ধীরে বলতে লাগল—তোমরা কেন আমাদের হাতে অনির্ধারিত অস্ত্র তুলে দিলে? দিলে দিলে, সে অস্ত্রে আবার বেছে বেছে কেবল তিনটি খুনকে অনুমোদন করলে কেন? হাহহা হা হাহ হাহ জানোই যখন রক্ত সবসময়, হাহহা হা হাহ হা আরো রক্ত ডেকে আনে! আরো রক্ত আনবে নিশ্চয়ই।
কথা এবং হাসির ঝংকার মিলিয়ে যাওয়ার পর শুরু হল আবারও অখণ্ড একঘেয়ে নীরবতা। মদ্যপগণ প্রত্যেকে নিশ্চল-নিস্তব্ধতায় কেবল নিজ নিজ হৃদপিণ্ডের আওয়াজ শোনা ছাড়া আর কিছুই করার পেলেন না। তাদের ভেতর সম্ভবত তখন নতুন করে আবার প্রশ্নের নীরব ঢেউ জাগতে লাগল—কেন তিনটি খুন? কেন রক্তপাত? কেন বাইরে এত বৃষ্টি? কেন আরো আনবে নিশ্চয়ই?
ম্যানেজার হঠাৎ গম্ভীর গলায় ঘোষণা করলেন—অনেক হয়েছে। এবার যে যার বাড়ি ফিরে যাও। বৃষ্টি থেমে গেছে। রাতও আর খুব একটা বাকি নাই।