কিভাবে চিনবেন জাদুবাস্তবতা
ম্যাজিক রিয়ালিজম বা জাদুবাস্তবতা আধুনিক শিল্পের এক যুগান্তকারী দৃষ্টিভঙ্গি। প্রাত্যহিক জীবনের নানা ফ্যান্টাসি, বিশ্বাস এবং উপকথাগুলো সাহিত্যিকের কলমের আঁচে মূর্তমান হয়ে ওঠে। সত্য কী বস্তু? কল্পনাই বা কোন চিজ? ম্যাজিক রিয়ালিজমের পৃথিবীতে আটপৌরে ঘটনাগুলো পরিণত হয় অদ্ভুত বিস্ময়ে আর জাদুময় কল্পনারা হয়ে ওঠে গতানুগতিক। যেন বাস্তব আর কল্পনা মিলেমিশে একাকার।
জাদুবাস্তবতাকে অনেকে ‘বিস্ময় বাস্তবতা’ কিংবা ‘কাল্পনিক বাস্তবতা’ বলে অভিহিত করতে চান। জাদুবাস্তবতার বেড়ে ওঠা ‘বাস্তবতাকে সংজ্ঞায়ন’-থেকে হলেও গভীরভাবে তাতে ডুবে যায়নি। গল্প, কবিতা, নাটক, সিনেমায় দৈনন্দিন জীবনাচারের সাথে নানাবিধ সংস্কার ও সমাজে লালিত কল্পকাহিনীর মিশেল ঘটে এক স্বতন্ত্র পৃথিবীই প্রস্তুত করে নিয়েছে। এই চিন্তার দাপট এতটাই প্রবল ছিল যে; চিত্রকলা এবং ভাস্কর্যেও তার প্রভাব পড়ে। উদাহরণ হিসাবে ফ্রিদা কাহলোর ছবির কথাই সবার আগে উঠে আসে।
অনেক লেখাতেই পাঠককে বিস্ময়কর পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কাফকার জনপ্রিয় গল্প ‘ম্যাটামরফোসিস’-এর কথাই ধরা যাক। বেচারা গ্রেগর সকালে ঘুম থেকে উঠেই লক্ষ করল তার শরীর পুরো পরিবর্তিত হয়ে আরশোলায় পরিণত হয়েছে। সাধারণ চিন্তায় অবাস্তব মনে হলেও গল্পের প্লট নির্মাণে এই আকস্মিকতা দারুণভাবে সফল করেছে অন্তর্নিহিত তাৎপর্য। বৃহত্তর অর্থের অনুসন্ধানে লেখকের হাতে ধরে উঠে এসেছে নাটকীয়তা। এমিলি ব্রন্টির ‘Passionate’ কিংবা হিথক্লিফের ‘Wuthering Heights’-এর কথাও প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায় প্রথম দিককার নজির হিসাবে। স্পষ্টভাবে শিল্প এবং সাহিত্যের আন্দোলন হিসাবে ম্যাজিক রিয়ালিজমের পত্তন ঘটে বিশ শতকের মধ্যভাগে।
ফ্রাঞ্জ রোহ জাদুবাস্তবতা শব্দটিকে প্রথম সামনে আনেন
১৯২৫ সালে সমালোচক ফ্রাঞ্জ রোহ প্রথম ম্যাজিক রিয়ালিজম বা জাদুবাস্তবতা শব্দের ব্যবহার করেন। তার ইচ্ছা ছিল জার্মান শিল্পীদের অঙ্কিত ছবিতে দৈনন্দিন জীবনের সাথে অতিপ্রাকৃতকে উপস্থান করার ধারাকে বর্ণনা করা। পরে চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে অন্যান্য সংস্কৃতির সমালোচকেরাও ধারণাটাকে নিজেদের মধ্যে আমদানি করল। জর্জ ওকিফে, ফ্রিদা কাহলো এবং এডওয়ার্ড হোপার—সকলেই এই জাদুবাস্তবতা চর্চাকারীদের আওতাভুক্ত।
সাহিত্যে জাদুবাস্তবতা একটা স্বতন্ত্র আন্দোলনের তকমা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। বিশেষ করে কিউবায় ১৯৪৯ সালে On the marvelous Real in Spanish America নামে প্রবন্ধ লেখা হয়। লিখেছেন আলেহো কারপেনটিয়ার। লেখকের বিশ্বাস, ল্যাটিন আমেরিকার ইতিহাস, ভূগোল পৃথিবীর চোখে আদর্শ হবার উপযোগী। ১৯৫৫ সালে অ্যাঞ্জেল ফ্লোরেস ল্যাটিন আমেরিকায় ম্যাজিক রিয়ালিজম ধারণার প্রয়োগ ঘটান। এর দ্বারা তিনি তার সময়ের সেইসব ল্যাটিন আমেরিকান লেখকদের বোঝাতে চেয়েছেন; যারা অতিপ্রাকৃত এবং প্রতিদিনকার ঘটনার দুর্দান্ত মিশেল ঘটিয়েছেন।
হোর্হে লুইস বোর্হেস: ম্যাজিক রিয়ালিজমের ভিত্তি স্থাপনের অন্যতম পুরোধা
ফ্লোরেসের মতে, ল্যাটিন আমেরিকায় জাদুবাস্তবতার পত্তন ঘটে ১৯৩৫ সালে আর্জেন্টাইন লেখক হোর্হে লুইস বোর্হেসের মাধ্যমে। অবশ্য অন্যান্য সমালোচকেরা আরো কিছু নাম সামনে আনেন। তবে বোর্হেস সত্যিকার অর্থেই জাদুবাস্তবতার ভিত্তি রচনা করতে মৌলিক অবদান রাখেন। ইউরোপিয়ান লেখক কাফকার লেখার মতোই তার লেখা ছিল নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য নিয়ে উজ্জ্বল। এছাড়া ইসাবেল অ্যালেন্দে, মিগেল অ্যাঞ্জেল, গাব্রিয়াল গার্সিয়া মার্কেস এবং জোয়ান রোলফোর নাম বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে।
বর্তমানে জাদুবাস্তবতাকে আন্তর্জাতিক স্রোত হিসাবে দেখা হয়। বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন সাহিত্যে এর প্রভাব গিয়ে আছড়ে পড়েছে নিজস্ব আবেদন নিয়ে। নিত্যকার দিনের সাথে অলৌকিকতার মিশেল ঘটলেই সমালোচকেরা আজকাল জাদুবাস্তবতার গন্ধ বের করার চেষ্টা করেন। কেউ পান; কেউ পান না। জাদুবাস্তবতার সফল প্রয়োগকারী কয়েকজন সফল লেখক—কেট এটকিনসন, নেইল গেইম্যান, গুন্টার গ্রাস, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, মার্ক হেলপ্রিন, এলিস হফম্যান, হারুকি মুরাকামি, টনি মরিসন, সালমান রুশদি। এছাড়া আরো অনেকের হাত ধরে প্রবাহমানতা অব্যাহত আছে।
মার্কেসের নিঃসঙ্গতার একশো বছর জাদুবাস্তবতাকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করে
সুরিয়ালিজম বা পরাবাস্তবতা কিংবা অনুরূপ কল্পনাধর্মী লেখার সাথে জাদুবাস্তবতাকে গুলিয়ে ফেলা কঠিন কিছু না। বরং অনেকক্ষেত্রে সেটাই হয়। মনে রাখা দরকার, লোককথা ও উপকথা কখনোই ম্যাজিক রিয়ালিজমের আওতায় পড়ে না। অনুরূপভাবে হরর গল্প, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, আধিভৌতিক রচনাবলি, কিংবা জাদুনির্ভর চরিত্রচিন্তাও এর থেকে আলাদা। জাদুবাস্তবতাকে চিনতে হলে তাই কয়েকটি বিষয় মনে রাখতে হবে—
১) যুক্তির তোয়াক্কা না করে পরিস্থিতি ও ঘটনা এগিয়ে যায়। টনি মরিসনের গল্পে দেখা যায় পালিয়ে আসা এক দাস ভূতুড়ে বাড়িতে গিয়ে ওঠে। বহুদিন আগে খুন হওয়া এক শিশুর ভূত। মার্কেসের ‘নিঃসঙ্গতার একশো বছর’-এ বাগান থেকে বাড়ির সুন্দরী মেয়েটা অদৃশ্য হয়ে যায়। আকস্মিকতা থাকলেও বর্ণনার ভঙ্গি একটা পৃথক পৃথিবীতে নিয়ে যাবে।
২) উপকথা, কুসংস্কার, লোককাহিনী, ধর্মীয় রূপক, অতিপ্রাকৃত বর্ণনা প্রভৃতিকে খুবই সহজভাবে টেনে আনা হয় জাদুবাস্তবতায়। লেখকের মুনশিয়ানা এবং বুননে তাই স্থানীয় ইতিহাস, বিশ্বাস এবং চিন্তাধারা খুবই ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে।
৩) ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং সমাজ ও রাজনৈতিক বিষয়াদি নিয়েই বসবাসের পরিধি গড়ে ওঠে। জাদুবাস্তবতার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য তাকে প্রতিফলিত করা। বস্তুত ফ্যান্টাসি গল্পের সাথে ম্যাজিক রিয়ালিজমের মূল পার্থক্য এইখানটাতেই। উদাহরণ হিসাবে সালমান রুশদীর ‘মিডনাইট চিলড্রেন’-এর নাম সামনে আনা যায়।
৪) সময়ের প্রথাগত ধারণাকে ভেঙে দেওয়া জাদুবাস্তবতার সাধারণ বিষয়। চরিত্রগুলো সেখানে ভবিষ্যতের মতো করে অতীতেও যেতে পারে। এজন্য মার্কেসের নিঃসঙ্গতার একশো বছরে দেখা যায় কর্নেল অরেলিয়েনো বুয়েন্দিয়ার কথা বলতে গিয়ে কিভাবে পেছনের দিকে ফিরে আসা হয়েছে। যেখানে অতীত কিংবা ভবিষ্যতের প্রথগত ধারণা বদলে গেছে। বদলে গেছে বিবরণের ধারা।
৫) জাদুবাস্তবতায় আসা জাদুগুলোর সূত্রও সত্যিকার পৃথিবীতেই প্রোথিত। এজন্য হ্যারি পটার কিংবা স্টার ওয়ার্স ম্যাজিক রিয়ালিজমের উদাহরণ হতে পারে না। স্থান, সময় ও সংস্কৃতির প্রেক্ষিতে চর্চিত বিশ্বাস দ্বারা যে জাদু এখানে হাজির হয়; তা বস্তুত সত্যের মতো করেই বিস্তৃত।
৬) ম্যাজিক রিয়ালিজমের চরিত্রেরা খুবই স্বাভাবিকভাবে তাদের অতিপ্রাকৃতিককে মেনে নেয়। সাধারণত হরর গল্পগুলোতে একধরনের কৌতূহল ও উৎকণ্ঠা জাগিয়ে রাখার জন্য চরিত্রদের দিয়ে কারণ আবিষ্কারের চেষ্টা করানো হয়। জাদুবাস্তব সাহিত্যে এমনটা একেবারেই নেই। তাই বাগান থেকে কারো উধাও হয়ে যাওয়া অন্যান্য চরিত্রের কাছে অস্বাভাবিক বলে মনে হয় না। মনে হয় যেন এটা হওয়া খুবই সম্ভব।
ফ্রিদা কাহলোর আঁকায় জাদুবাস্তবতা
তারপরেও ম্যাজিক রিয়ালিজম বা জাদুবাস্তবতাকে একটা ফ্রেমে বাঁধতে চাওয়া ভুল হবে। সাহিত্য কিংবা শিল্প সম্প্রসারমান মাধ্যম। আর লেখক বা শিল্পী মাত্রই যেহেতু পুরোপুরি মুক্ত তাই এই ধারাটির মধ্যেও পরবর্তী লেখকেরা সংযোজন-বিয়োজন করতে পারেন।