মাধবীর বাড়ি ফেরা



ক্যামেলিয়া আলম
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

১.
থিয়েটার থেকে ফিরতে আজ বাড়াবাড়ি রকমের রাত হয়ে গেল। দুশ্চিন্তা হচ্ছে বাড়ি ফিরতে। সিংগেল থাকে বলে ফ্ল্যাটের নিয়ম কানুনের বাড়তি চাপ থাকে মাধবীর মাথায়। নারী হবার কারণে নজরবন্দীও বেশি। আরেক বিরক্তিও মাথার মাঝে ঘুরপাক খেতে থাকে। রাত হলেই থিয়েটারের কোনো না কোনো ছেলেকে সাথে নিয়ে বাড়ি ফেরা। আজ ফিরছে মনা ভাইয়ের সাথে। বিশালদেহী মনা ভাইকে মাধবীর বিরক্ত লাগে বরাবরই। মাধবীর একার জীবন, একা চলবার সাহস নিয়ে সুযোগ পেলেই রসালো মন্তব্য করে বসে।

“কিরে, তসলিমার চামচা, রাত হইলেই তোমগো নারীবাদ কই যায়?”

আজ তারই সাথে ফেরার তাড়া। কিছুই করার নাই, কারণ মনা ভাইয়ের বাসাই একমাত্র মাধবীর বাসার কাছাকাছি। এক রিক্সায় মাধবী আর মনা চুপচাপ ফিরছে। ভাঙা গলায় মনা ভাই গান ধরল, “মন মাঝি খবরদার, আমার তরী যেন ডোবে না, আমার নৌকা যেন ভেড়ে না...’। মাধবী ডুবে গেল ভিন্ন ভাবনায়। সেতুর সাথে অল্প কিছুদিন হলো সম্পর্ক হয়েছে। প্রেমের শুরুটা বরাবরই এত চমৎকার থাকে! রোজ সেতু কলেজ গেটটায় এসে যখন দাঁড়ায়, মাধবীর সারাসময়ের ক্লান্তি নিমিষে উবে যায়। মাধবী ইডেনে বাংলায় পড়ে। সেতু চাকরি করে এক এনজিওতে। সেতু যে প্রাণ থেকে ভালোবাসে তা মাধবী বেশ টের পায়। ওর পড়া, থিয়েটার, টিউশনি, রাত করে ফেরা... সবেতেই সেতুর সমর্থন আর প্রশংসা মাধবীর রুক্ষ্ম জীবনের ঝরণাধারা। বাবা তিনবোন রেখে ছোট বেলায় অন্য সংসার বেঁধেছে। মায়ের সাথে ওদের তিনবোনের প্রতিদিনের সংগ্রাম মাধবীকে পুরোই থমকে দিত যদি সেতুর সাথে ওর প্রেম না হতো! এমন সময়ই হুট করে রিক্সা থামল। চমকে ওঠা মাধবী দেখে মনা ভাই রিক্সায় পাশে নাই। দ্রুত পেছন ফিরে দেখে সংসদ ভবন এলাকার এক অন্ধকার পার্কের দিকে যাচ্ছে।

‘মনা ভাই, কই যান?’
‘খাড়াও আইতেছি’ বলেই পার্কের অন্ধকারে হারিয়ে যায়।
ভয়ংকর বিরক্তি নিয়ে মুখ ঘোরাতেই রিক্সাওয়ালা ‘আফা, একটু বহেন’ বলেই চলে যায় একটু দূরের গাছের আড়ালে প্রকৃতির ডাকে।

চরম বিরক্তি নিয়ে সোজা হয়ে বসতেই দেখে ৫/৬টা ছেলে গল্প করতে করতে আসছে। যদিও তারা এখনো মাধবীর অস্তিত্ব টের পায়নি। কিন্তু কতক্ষণ আস্ত এক অবয়ব না দেখে চলবে? মাধবীর বুক ঢিবঢিব করতে থাকে। রিক্সার হুড তুলবে? নাহ! যদি অন্যরকম ভাবে? হয়তো গল্প করতে করতে পাশ দিয়ে চলে যাবে। ভয় পাওয়ার কিছুই নাই। মানুষই তো! পেছন ঘুরে মনা ভাইকে খুঁজতে থাকে চোখ, ঠিক তখনই শোনে, ‘ওই দ্যাখ, একটা মাল’, ‘আরে, খাসা তো!’

রিক্সার খুব কাছে আসতে আসতেই মাধবীর চোখ শেষ চেষ্টার মতো রাস্তায় টহলদার কোনো পুলিশ খুঁজে বেড়ায়। নাহ, কোথাও কেউ নাই। সামনে সত্যিই দাঁড়ানো ছয় ছয়টা ছেলে। যাদের কাছ থেকে মদের ঝাঁঝালো গন্ধটা নাকে এসে বাড়ি দিচ্ছে।

এক ছেলে রিক্সার হ্যান্ডেলে হাত দেয়। বাকিদের জ্বলজ্বলে চোখগুলোতে মাধবীর ঘেমে ওঠা শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে। হাতড়ে বেড়াতে থাকে মন, কী করা যায়? কিভাবে ঠেকানো যায়? কেবল একটাই কাজ, এদের কালক্ষেপণ করানো। ছয়টা দানবীয় মুখের মাঝে মাধবীর চোখ হাতড়ে বেড়াতে থাকে একটা মানুষের মুখ। ওদের ঠিক পেছনেই খাটো মতো এক ছেলের নরম চোখে মাধবীর চোখ আটকে যায়।

“ভাইয়া, আপনি এত রাতে এখানে? কেমন আছেন? কতদিন পরে আপনাকে দেখলাম? আমায় মনে নাই? আমি আপনার বোনের বান্ধবী, মাধবী। আপনার বাসায় মাঝেমাঝেই আসতাম। আপনি যে কী লাজুক ছিলেন!” বলে নিজের অভিনয়ের হাসিটা নিজের কানেই বেখাপ্পা লাগে।

ছেলেগুলোর মাঝে ইতস্ততা টের পায়। ওদের চাহনি এবার সেই ছেলের দিকে। সে কিছুটা অপ্রস্তুত।

“ঠিক , চিনতে পারছি না...”

কথা কেড়ে নিয়ে মাধবী বলতে থাকে, “আরে ভাইয়া, চিনবেন কী করে? আপনি তো মুখই তুলে তাকাতেন না আমাদের দিকে।” আবারও মাধবীর বেখাপ্পা হাসি শোনা যায় রাত চিড়ে। “তা ভাইয়া, এদিকটাতে কী করছেন এত রাতে? এরা আপনার বন্ধু? জানেন তো আমি থিয়েটারে কাজ করি। রিহার্সেল শেষ হতে হতে এত রাত হয়ে যায় যে কী বলব আর! আপনারা নাটক দেখেন? মহিলা সমিতিতে এই দশ তারিখে আমাদের শো আছে। চলে এসেন। দাওয়াত দিয়ে রাখলাম আগেভাগেই। ওহ ভালো কথা, ভাইয়া, আপনার মা কেমন আছে? কী যে মজার রান্না করত... বিশেষ করে, শুটকি মাছ। এখনো মুখে লেগে আছে, জানেন? আজই গিয়ে বলবেন, মাধবীর সাথে দেখা হয়েছে। দেখবেন কী বলেন! কী ভালেই না বাসতেন।”

এর মাঝে অস্থিরতা টের পায় ছেলেগুলোর মাঝে। “চিনস তুই?” এক ছেলে প্রশ্ন করে। আরেক ছেলে, “বইনের বান্ধবী তো হইছে কী?” “আরে নাহ, পরে ফ্যাসাদে পইড়া যামু”—টুকরো কথাগুলো কানে ভেসে আসতে থাকে মাধবীর। দেখতে পায়, খাটো ছেলেটার ইতস্তত চাহনি। মাধবী আড়চোখে আরেকবার বোঝার চেষ্টা করে মনা ভাই ঠিক কোথায় আছে এখন? এর মাঝে রিক্সাওয়ালা এসে দাঁড়িয়েছে ওদের পেছনে। শীর্ণ দেহটায় কোনোই ভরসা নাই। এরা রিক্সা থেকে এই লোককে সরে যেতে বললে এখনই তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। মাধবী ভাবতে থাকে আর কী বলা যায়! বেশি বললে ধরা পড়ে যাবার আশঙ্কাও আছে। অচেনা মানুষ নিয়ে কত আর গল্প বানানো যায়। ওদের পারস্পরিক চোখাচোখি হয়ে একজনের এগিয়ে আসার মাঝেই কাঙ্ক্ষিত গলা টের পায় মাধবী।

“ওই কেডারে...”

ছেলেগুলোর চমকে ওঠে। রিক্সার অপর প্রান্তে মনার শরীরটা দেখে। “মাধবী, ঠিক আছো...” বিশালদেহী মনাভাইয়ের বজ্রকণ্ঠ ওদের দ্রুত রিক্সা থেকে সরিয়ে নেয়। মাধবী হাসি মুখ রেখেই বলে, “ওকে ভাইয়া, দেখা হবে, খালাম্মাকে অবশ্যই বলেন, আমি আসব কয়েকদিনের মাঝেই।” ছেলেগুলো খুব দ্রুত সরে যায় রিক্সা থেকে।

মনা লাফ দিয়ে রিক্সায় ওঠে। গাঁজার গন্ধ ভুড়ভুড় করছে মুখে। মাধবীর চোখে পানি এসে যায়, “উফ, মনা ভাই, আপনি এভাবে একা রেখে যেতে পারলেন?”

মনার লাল চোখে অবাক চাহনি। “ওরা কিছু কইছে তোমারে? তোমার চোখে পানি ক্যান? ওই রিক্সা থামা তো...”

বলে লাফিয়ে নামতে চাওয়া মনার হাত তড়িৎ গতিতে আকঁড়ে ধরে মাধবী। “না, মনা ভাই, না, আমার কিছু হয় নাই। ওরা আমার বান্ধবীর ভাই। আপনি বসেন তো!” বলতে বলতে গলা ধরে আসে মাধবীর। কেবল আকাশের ওই শূন্যতায় নির্ণিমেষ তাকিয়ে থাকে জলে ভেসে যাওয়া চোখগুলো।

“ও , এইটা কও...”—বলে গলাখাকারি দিয়ে ফুরফুরে মেজাজে উদাত্তকণ্ঠে আরেক গান শুরু করে, “মনে বাবলা পাতার কষ লেগেছে, ধুইলে যায় না সাবানে, গুরু আমার মনের ময়লা যাবে ক্যামনে? ও গুরু, মনের ময়লা, যাবে ক্যামনে?” গাজার সম্মোহনে আবেগ যেন ঝরে পড়ে মনার কণ্ঠে। ভীষণ মিষ্টি শোনায়! ধোয়াচ্ছন্ন মাথায় মনা ভাবতেও পারে না, ছয়জনের সাথে কখনোই একলা পারা যায় না!

রিক্সার প্যাডেলের শব্দ আর জমাট অন্ধকারে ভেসে আসা বাতাস মাধবীকে বলতে থাকে কেবল, “গুরু আমার মনের ময়লা যাবে ক্যামনে?”

২.
তেতো হওয়া জীবন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে থাকে। জীবন বড় সুন্দর! বারেবারে বিশ্বাস করতে চেষ্টা করে মাধবী। কিন্তু জীবন হয়তো সেজন্যই অট্টহাসি হেসে যাপিত জীবনের গুটিগুলো নিয়ে ফেলে দেয় সাপের মুখে।

রিহার্সেলের শেষ কয়টা দিন সিদ্ধান্ত নেয় বাড়ি না ফেরার। প্রিয়া আপাকে বলে কয়ে তার বাড়িতেই কাটিয়ে দেয়। প্রতিটি বিবর্ণ দিন শেষে সামান্য রোদ্দুর যেমন বিদ্যুৎ চমকায়, মাধবীর চলটে ওঠা জীবনে সেতু ঠিক তেমনই। এ শহরে মাধবীর নাটক বারেবারে দেখতে আসে শুধুমাত্র সেতু। শো শেষে চাঁদের আলোটুকু শহরের এত আলোর মাঝেও ঠিক ঠিক চোখে পড়ে সেতুকে নিয়ে রিক্সায় করে যখন বাসায় ফেরে। সারাটা দিন—সারাটা রাত নিজেকে নিজে চালাতে চালাতে ক্লান্ত শরীর সেতুর কাঁধে ভর দিয়ে দমটুকু যখন ছাড়ে, নিজেকে মনে হয় গ্রাম্য কোনো সরলা কৃষাণ বধূ, যার মুখে সুখের হাসি লেপ্টে থাকে নিজ জীবনের ভার কৃষাণের হাতে তুলে দিয়ে। পরজীবী হবার মাঝেই জীবন যেন পায় স্বার্থকতা।

এর মাঝে ডাক পড়ে মাধবীর বড় পা’র বাসায়। দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে বড় পা’র সমৃদ্ধির ঘর। দুলাভাই ব্যবসায়ী হওয়াতে চারপাশে জমকের ছড়াছড়ি। দমবন্ধ হওয়া বাড়িতে মাধবীর যেতে হয় নিতান্ত প্রয়োজনে। বড় পা’র মেয়ে অনিন্দিতার ভীষণ জ্বর। ছেলেটা মাত্র এক বছরের। সংসার সামলাতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হচ্ছে আপাকে। আর আরেক বিষয়ও আছে, এই দুলাভাই-ই মাধবীদের সংসারে হাতখরচ দেয় আর ওর পড়ার খরচও যোগায়। অগত্যা ধানমন্ডির বিশাল এপার্টমেন্টে বেশ কয়টা দিন থাকার প্রিপারেশন নিয়েই আসা হয় তার।

মাধবীকে পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাসটুকু ছাড়ে সুরভী। দুই বাচ্চা নিয়ে যুদ্ধ করতে করতে চোখের কোণে কালি দেখে আৎকে ওঠে মাধবী। নিজেকে বড় স্বার্থপর মনে হয়। আপাটার কোনো খোঁজই নেয় না সারাটা মাস। কেবল মাসের শুরুতে একরাশ লজ্জা নিয়ে টাকাগুলো নিতে আসে, তখনই কেবল কিছু শব্দ বিনিময় হয় দুই বোনের। টেবিল ভর্তি খাবার কোনোরকম খেয়ে মাধবীর ইতস্তত শরীর এরপরই দ্রুত বেরিয়ে যায়। আপাও কখনো বাধা দেয় না। ফাঁকা হওয়া মনের শ্বাস নেওয়া মাধবী ঘরগুলোয় চোখ বুলায়। আপার বাসায় সবই বিশাল। হাতিলের বড় খাট, উঁচু দেয়ালের মাথা ছোঁয়া আলমারি, ক্রিস্টালের চকচকে ড্রইংরুম, চমৎকার রঙিন খাবারে ঠাসা দুই কপাটের ফ্রিজ, রান্নাঘর ছাড়া বাকি ঘরগুলোয় শীতের আমেজ—এই তীব্র গরমেও খাটগুলোয় কম্বল তাই যত্নে রাখা। কেবল এই বিশাল বাড়িতে বাচ্চাদের পড়ার বই, দৈনিক পত্রিকা, খুচরো কিছু প্রসাধনী ও বিনোদন ম্যাগাজিন ছাড়া ছাপা অক্ষরের কিছুই নাই।

মাধবী এসেই কাজে নেমে পড়ে। অনিন্দিতা আর রাজনকে নিজের কাছে নিয়ে আপাকে প্রথমেই ঘুমাতে পাঠায়। রাজনকে নাওয়ানো, খাওয়ানো, অনিন্দিতার মাথায় পানি ঢেলে গা মুছিয়ে জোর করে স্যুপটুকু খাইয়ে খাটের একপাশে শুয়ে শুয়ে গল্প শোনাতে থাকে। আপার পরিশ্রান্ত মুখটি হা হয়ে আছে। একটু পরপর ছোট ছোট শ্বাস নেওয়া বুকটি দ্রুত ওঠানামা করছে গভীর ঘুমে। দেখে বড় মায়া হয় মাধবীর। একসময় দুলাভাই ফিরে আসে। মাধবীকে দেখেই হইচই করে আনন্দ প্রকাশ করে। চমৎকার এক আড্ডা হয় খাবার টেবিলে। গেস্টরুমটি বেশ দূরে বেডরুম ছেড়ে, তবু মাধবী বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। রুমের দরজা বন্ধ করে স্বস্তির এক নিঃশ্বাস ফেলে মনে পড়ে সেতুর কথা। ভাবতে থাকে, দিনকয়েক কলেজ যাবে না, তাই রোদ্দুরটুকুর সাথেও দেখা হবে না। কেমন যেন উতলা লাগে! পাগলের মতোন ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে হয় এ বাড়ি ছেড়ে। কিন্তু জীবন যে বড় হিসেবের।

পরদিন অনিন্দিতার রিপোর্ট আসে বাসায়। টাইফয়েড। রোগের চাইতেও মিজান চৌধুরীর কাছে যা বড় হয়ে দাঁড়ায়, তা মা হিসেবে সুরভীর ব্যর্থতা। রাতে থমথমে খাবার টেবিলে সবাই। মাধবী হালকা করতে বলতে শুরু করে, “রোগ ডায়াগনসিস করা গেছে, সেটাই জরুরি। এখন কেয়ারফুল থেকে চিকিৎসা চালালেই ঠিক হয়ে যাবে।”

সুরভী আমতা আমতা করে বলার চেষ্টা করে, “এত সাবধানে চলি, এরপরেও কী করে যে হলো? বুঝলাম না...”

মিজান সশব্দে ফেটে পড়ে, “ওই মাতারি, কী রোগ হইছে বুঝছস? বুঝছস কিছু? গু পেটে গেলে এইসব রোগ হয়।... হাত ধোস না!”

সুরভী থামাতে চেষ্টা করে, “কী বলো এসব! আমি...”

ঝনঝন শব্দে টেবিলের থালা মাটিতে ভাঙে। “...ফকিরের গুষ্টি, সারামাস গিলস আর চৌদ্দ পুরুষ গিলাস, সার্ভিস দিতে ভুল ক্যান হয়?”

মাধবীর মাথা ভনভন করতে থাকে। কোনো রকম উঠে দাঁড়ায়। দ্রুত নিজ রুমে যায়। চিৎকার আর ভাঙাচোরার শব্দে মাথার ভেতর কেমন শূন্য লাগে। সদ্য এনেসথিয়ায় চারপাশের শব্দ আর আলো যেমন কমে আসে কিছুক্ষণের মাঝে, তেমন এক স্তব্ধতা বিরাজ করে ব্রেইন সেলগুলোয়।

সেই রাতে অনিন্দিতার জ্বর হুট করে বেড়ে যায়। মাঝরাতে আধো জাগরণ আর আধো ঘুমের মাঝে দরজায় জোরে ধাক্কার শব্দে ধড়মড়িয়ে জাগে মাধবী। দরজায় সুরভীর আলুথালু বেশ, “অনিন্দিতা মরে যাচ্ছে মাধবী, মরে যাচ্ছে...”

এক ছুটে অনিন্দিতার সামনে গেলে দেখতে পায় গাঢ় লাল চোখ, শরীর প্রায় বাঁকা। মাধবী হ্যাচকা টানে অনিন্দিতাকে নিয়ে বাথরুমে যায়। কল ছেড়ে পানি দিতে থাকে।

“আপা, সাপোজিটরি আন, ডিপে রাখা..”

প্রায় আড়াইটার দিকে জ্বর ১০২-এ নেমে আসে। সুরভী মাথার কাছে ঠাঁয় বসা। মাধবী পায়ের কাছে। প্রবল শারীরিক মানসিক চাপে দুজনেরই চোখ লেগে আসে। কতক্ষণ ঘুমিয়েছিল জানে না, আচমকা ঘুম ভাঙে মাধবীর। প্রথমটায় মনে হয় কী যেন চেপে বসেছে গায়ের ওপর। তন্দ্রা কাটতেই টের পায় বুকের আনাচে কানাচে শক্ত এক হাত হাতড়ে বেড়াচ্ছে। প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে শরীর। চেপে বসা হাত ধাক্কা দিয়ে সরাতে না পারলে চিৎকার বেরিয়ে আসে মাধবীর মুখ চিড়ে। আলোকজ্জ্বল ঘরে সুরভীর অবাক চাহনি। দেখতে পায় কেবল মাধবীর জামার তলায় মিজানের হাত!

মাধবী এক ঝটকায় উঠে হতভম্ব মুখে, “ছিঃ, এত জঘন্য আপনি! আপনার মেয়ের এই অবস্থা!”

“এই চুপ, চুপ বেশ্যা কোথাকার! নাটক কইরা এখন আমার জামাইর উপরে দোষ?” চমকে মাধবী তাকায় সুরভীর দিকে।

“বাইর হ, বাইর হ, আমার বাড়ি থেকে, প্রথম দিন থেকেই দেখছি, ক্যামনে আমার জামাইরে উসকাইছস! খালি পিরীতের আলাপ, হাসাহাসি, আজ নিজ চোখের সামনে দেখলাম।”

“আপা, তুই কী বলিস? কী বলিস? তুই কী পাগল হয়ে গেছিস?”

“এখনই বাইর হবি...”

হাত ধরে একটানে বিছানা থেকে মাধবীকে মাটিতে ফেলে দেয়। দুই বোনের ক্যাচালে না থাকাই শ্রেয় মনে করে মিজান। নিঃশব্দে ঘর ছাড়ে। রাত্রি তিনটায় মাধবীর নামতে হয় পথে। চারপাশ জমাট অন্ধকার। কোথাও কেউ নাই। শুধু ভাবে, বাড়ি ফিরতে হবে এবার।

৩.
মধ্যবিত্ত না সাবঅলটার্ন জানে না মাধবী। এ ঘটনার পরে কেবল বোঝে, নিজের খরচ নিজে যোগাড় করতে হবে, করতেই হবে। পাস করবার আগেই হুট করে সুযোগ পেয়ে যায়। কাজ নেয় এক এনজিওতে। ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ঢাকার বাইরে প্রচুর সময় দিতে হয়। মাধবীর একটিভিটি খুব দ্রুতই তাকে নিয়ে যায় সাফল্যের দরজায়। ইতিমধ্যে অনার্স পাসও করে। গ্রাজুয়েট থাকায় আর কাজের সাবলীলতায় মাধবীর পজিশন বাড়তে থাকে। কাজের শুরুতে সেতু বারেবারে বাধা দিয়েছিল। চেয়েছিল, মাধবী মাস্টার্স শেষ করুক আগে। বিয়ের পর কোনো কলেজ বা স্কুলে মাস্টারি করলে দিব্যি চলে যাবে সংসার। আর এই কয়দিন সেতুই তাকে হাতখরচ দেবে। মাধবী কিছুতেই রাজি হলো না। পরনির্ভরশীলতার অসম্মান ওকে পাল্টে দিয়েছে ভীষণ। খুব আনমনা থাকে। সারাক্ষণই ক্যারিয়ার আর পয়সার চিন্তা। সেতুর সাথেও প্রায়শই রাগারাগি হতে থাকল।

মাধবীর ওপর সেতুর এই বিরক্তভাব মাধবীর চোখে পড়ল বেশ পরেই। মাধবী ধরেই নিয়েছিল, সেতু ওকে ভীষণ বোঝে। ওর সম্মানবোধকে ঠিকই শ্রদ্ধা করবে, ওর ক্যারিয়ারিস্ট হবার স্বপ্নে সেতু থাকবে বরাবরের মতোই উচ্ছল। কিন্তু প্রথম ধাক্কাটা খেল যেদিন মাধবী প্রমোশন পেল প্রোগ্রাম চিফ হিসেবে। সেতুর অফিসের ফোন বেজে উঠল। মাধবীর ফোন, উচ্ছ্বসিত গলা।

“সেতু, আমি প্রোগ্রাম চিফ এখন, বেতন ৫০০০ টাকা বাড়ল।”

ওইপাশ থেকে সেতুর ঠান্ডা কন্ঠস্বর, “আমি তোমায় বহুদিন বলেছি, কাজের সময় অফিসে ফোন দেবে না।”

“আমি জানাব না তোমায় আমার এত বড় সুখবর!”

“ওকে কনগ্রেচুলেশনস।”

ফোন ছাড়ার শব্দে মাধবী থমকে যায়। ধীর হাতে ফোন রাখে। ভাবতে থাকে বিষয়টি নিয়ে। এ সেই সেতু! যার কাছে গেলেই প্রজাপতির জীবন ছেড়ে গুটিপোকার জীবন হবার সাধ জাগত!

মাধবীর ব্যস্ততা বেড়ে যেতে থাকে। বাড়তে থাকে সেতুর সাথে দূরত্বও। অফিস থেকে প্রতিদিনই ফোন করত, দুইটা কথা বলতে না বলতেই সেতুর বিরক্তিতে ফোন রেখে দেওয়ায় একদিন হাজির হয় সেতুর অফিসে।

বহুদিন পরে দুইজন আবার আগের মতো গল্প, আড্ডায় মাতে। জীবন বড় সুন্দর, কথাটা আবার মনে হয় মাধবীর। সেই দিনই হুট করে সেতু প্রপোজ করে বিয়ের। এত দিনের চেনায়ও মাধবীর মুখ লাল হয়, ভালো লাগার ঘাম জমে মুখটায়। সেতু মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে মাধবীর দিকে। কিছুক্ষণের মাঝেই দুইজনের প্রবল হাসি, বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করা, কল্পনার ঘর সাজানো নিয়ে কথা বলতে বলতে সেতু থামায় মাধবীকে।

“এই, সবই যখন কল্পনা করছিস, বাসর রাতের কল্পনাটাও সাজা তো! কী কী করবি, বলতো!”

দুইজনের উচ্চকিত হাসিতে পথ চলতি মানুষগুলো ঘুরে তাঁকায়। ওদের বেপরোয়া হাসি তবু থামে না।

দুজনের পরিবারেই জানানো হয়। পরিবারে বাধা তেমন নাই। মাস ছয়েক পরে বিয়ের সম্ভাব্য দিনক্ষণও ঠিক হয়। এর মাঝে এক চিঠি আসে লন্ডন থেকে। সাইকো ড্রামার ওপর মাস্টার্সের জন্য এপ্লাই করেছিল, সেখানে মাধবীর চিঠি গ্রানটেড হয়েছে। অগাস্ট সেশন থেকে কোর্স শুরু। তবে এর আগে যোগাড় করতে হবে লাখ পাঁচেক টাকা।

অফিস করেসপনডেন্টকে জানায় বিষয়টি। টাকা সংগ্রহের জন্য ফান্ডিং এর যে ব্যবস্থা আছে, তা থেকে কিভাবে কী যোগাড় করা যায় সে বিষয়ে পরামর্শ নিতে গেলে উল্টো চিত্র পায়। তাদের নানা ভাসা ভাসা কথায় টের পায় ওদের আসল বক্তব্য, মাধবী এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে, তার গিয়ে বিদেশি ডিগ্রি কেন নিতে হবে? অবাক করে মাধবীকে।

“আপনারা না নারী উন্নয়নের কথা বলেন! নারীদের জন্য কাজ করেন? আমি আপনাদের অফিসেরই এক সিনসিয়ার কর্মী। আমি উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাব না?”

“উচ্চশিক্ষা নিয়ে তুমি কি আর দেশের জন্য কাজ করবে? বিদেশে পাততাড়ি গুটাবা।”

“তাই বলে, এক লিগ্যাল সুযোগ আমি পাব না?”

মর্জিনা আপার আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে খুঁজতে থাকে পথ। সেতুর কাছে আনন্দের খবর বলার চাইতে দুশ্চিন্তার কথাটি বলতে গিয়ে আরেকবার হোঁচট খায়।

“এর মানে, তুমি বিদেশ যেতে চাইছো?”

“চাইছি মানে? যাব না? ১৩০ জনের মাঝে যে দুইজন সিলেক্টেড হয়েছে অফিস থেকে এর মাঝে আমি একজন। আরেকজন মর্জিনা আপার মেয়ে।”

“বিয়ের কী হবে?”

“বিয়ে করেই যাব।”

“আগস্টে গেলে বিয়ে করবে কী করে? ডিসেম্বরে বিয়ের দিন ঠিক করলাম না? ফ্যামিলিতে তো তা-ই জানানো হলো।”

“আমরা কী পর, সেতু? আপাতত কোর্ট ম্যারেজ করে রাখব। ফিরে এসে প্রোগ্রাম করব।”

সেতু কিছুই বলে না। চুপ হয়ে যায়। বিদায়ের সময় মাধবীর সেদিন কী কারণে যেন অশান্ত হয় মন! এর কারণ কী? সেতুর থেকে এভাবে বিদায় তো প্রায়ই নেয়। আজ কেন এত খারাপ লাগছে?

ফান্ডিংয়ের টাকা যোগাড় করার অসাধ্য কাজটা মাধবী যেদিন করতে পারে, নিজের ভাগ্যকেই নিজের কাছে অবিশ্বাস্য লাগে। হুট করে মনে হয় মাসখানেক সেতুর সাথে দেখা হয় না। ফোন করলে জানে সেতু অসুস্থ, ছুটিতে আছে। সেতুর বাসা চেনে। দ্রুত যায়। দরজা খোলে সেতুর মা। অন্যদিনের মতোন জড়িয়ে না ধরে কেমন যেন আড়ষ্ট দেখায় তাকে।

“সেতু কই ঘরে?”

এরআগেও কয়েকবার এসেছে। সেতুর ঘরটা বেশ চেনে। কোনো জড়তা না করে সেতুর মা বাধা দেবার আগেই ঘরটার কাছে যায়। পরদা সরিয়েই ধাক্কা খায়। মিলা, সেতুর কাজিন, সেতুর মাথায় পানিপট্টি দিচ্ছে। মাধবী থমকে গিয়েও জোর করে হেসে সেতুর পাশে গিয়ে বসে। সেতু অপ্রস্তুত। মিলার মুখ শক্ত।

“জ্বর কবে থেকে?”

“এই তো দিন দুয়েক।”

“ও আচ্ছা।”

তিনজনেই হঠাৎ চুপ হয়ে যায়। পরিবেশটা কেমন যেন জগদ্বলের পাথর চাপার মতো গুমোট হয়ে থাকে। গলাখাকারি দিয়ে সেতু বলে, “তা টাকার যোগাড় করতে পারলে?”

“হ্যাঁ।”

সেতুর জ্বলে ওঠা চোখ শান্ত হয়ে বলে, “বাহ, বেশ ভালো, তা কবে যাচ্ছো, ঠিক করেছো?”

“হুম জুলাইয়ের ২৮-এ বিমানের টিকেট পেয়েছি। এখনো কাটিনি। কাল পরশুর মাঝে কাটব।” বলে চুপ থেকে বলে, “সেতু, আমি পার্সোনালি তোমার সাথে কথা বলতে চাই।” সেতু মিলার দিকে তাকালে, নিঃশব্দে বেরিয়ে যায় সে।

“বিয়ে কবে করছি, সেতু? সামনের সপ্তাহে...”

“আরে এত হুলুস্থূলের কিছু নাই, ফিরে এসো আগে। আর বিয়েতে পরিবারের দোয়ার বিষয়ও তো আছে। হুট করে কোর্ট ম্যারেজ করলে তারা কষ্ট পাবে।”

“তাহলে ঘরোয়া প্রোগ্রাম করি, তোমার বাসাতেই বিয়ে হোক।”

“মাধবী, আমি বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। তাদের একটা সম্মান আছে। মেয়ে এসে ছেলের বাড়িতে বিয়ে করছে, এতে তাদের সম্মান নষ্ট হবে না?”

“ওকে, আপার বাসায় এ্যারেঞ্জ করি।”

“মাধবী, আমার ফ্যামিলির কালচার তোমার মতোন আধুনিক না। বিয়ের দশদিনের মাথাতেই বর ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দেবার বিষয়টি কেউ ভালোভাবে নেবে না। আমরা তো ছন্নছাড়া না। আমাদের ফ্যামিলি বিশাল। সবাইকে নিয়েই তো আমাদের চলতে হয়।”

মাধবীর মনে হতে থাকে পায়ের নিচের মেঝে ওকে টেনে ধরেছে। সব কেমন ফাঁকা লাগছে। এই সেতু, সেই সেতু? যার বুকে রাতের পর রাত কল্পনায় থেকে নিজের ক্লান্তি ভুলেছে, সামনে এগিয়ে চলার আনন্দ পেয়েছে!

মাধবী ফিরে আসে। অভিমানী হয়ে সেতুর সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে। আজীবন অভিমান তো মাধবীই ভাঙাত! এখন বড় ক্লান্ত লাগে। সব যুদ্ধ কি ওরই?

লন্ডন যাবার আগের দিন ছটফট করতে থাকে মাধবী। এমন সময় বেশ জোরালো শব্দে কলিংবেল বাজে। কুরিয়ারের এক চিঠি। আলতো হাতে খুলতেই ঝলমলে সোনালি ফিতা ঝিলিক দিয়ে ওঠে। সেতুর বিয়ের কার্ড। দশ মিনিট লাগে বুঝতে বিষয়টি।

মাধবীর মনে পড়ে সেতুর কাছ থেকে শোনা এক পুরাকথা। এক কাছিম দিনের পর দিন নিজের আপদ-বিপদ দূর করে এক ম্যাজিক লাঠি দিয়ে। একসময় কাছিমের বড় সাধ জাগে ডায়নোসারের মতোন অতিকায় প্রাণি হবার। নানাভাবে চেষ্টা করেও তা হতে পারে না। ঈশ্বরের কাছে আকুল হয়ে জানতে চায়, কী করে নিজের কচ্ছপের জীবনের ইতি ঘটাবে। ঈশ্বর তার ম্যাজিক লাঠি ফেলে দিতে বললে কচ্ছপ সাথে সাথেই হাত থেকে ফেলে দেয় সমুদ্রের অতলে। এক নিমিষে পরিণত হয় বৃহদাকার ডায়নোসারে!

সঙ্গোপনে এক নিঃশ্বাস আটকে মাধবী বিয়ের কার্ডটা টুকরো করে জানালার কাছে যায়। রাস্তার ওপর ছুড়ে দেয় ছেঁড়া টুকরোগুলো। দাপুটে বাতাসে তা উড়ে উড়ে ছড়িয়ে পড়ে ড্রেনে, রিকসার চাকায়, ভ্যানের ওপর, সাদা গাড়ির উদাম পিঠটায়!

   

গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ধ্রুব এষ



বার্তা২৪ ডেস্ক
শিল্পী ধ্রুব এষ

শিল্পী ধ্রুব এষ

  • Font increase
  • Font Decrease

নান্দনিক প্রচ্ছদ ও অলংকরণশিল্পী হিসেবে দেশে আলাদা অবস্থান তৈরি করেছেন ধ্রুব এষ। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ নিয়ে ঢাকার পান্থপথের হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এই শিল্পী।

হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে বলেন, “তার অবস্থা বর্তমানে স্থিতিশীল।”

জ্বর সঙ্গে তীব্র কাশি নিয়ে বুধবার এ হাসপাতালে আসেন ধ্রুব এষ। পরিস্থিতি দেখে তাকে এইচডিইউতে ভর্তি করে নেওয়া হয়।

লেলিন চৌধুরী বলেন, "শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের কারণে উনার অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে গিয়েছিল। সে কারণে অবস্থা কিছুটা অবনতির দিকে গিয়েছিল। পরে অক্সিজেন সরবারাহ করা হয়, এখন তিনি স্টেবল আছেন। আমরা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছি।"

সুনামগঞ্জের সন্তান ধ্রুব এষের বয়স ৫৭ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলার ছাত্র থাকার সময় বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা শুরু করেন। প্রয়াত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ বইয়ের প্রচ্ছদ ধ্রুব এষেরই আঁকা। তার আঁকা প্রচ্ছদে প্রকাশিত হয়েছে ২৫ হাজারের বেশি বই।

দেশে প্রচ্ছদশিল্পে আধুনিকতা আনার কৃতিত্ব কেউ কেউ ধ্রুব এষকে দেন। আঁকাআঁকির সঙ্গে তিনি লেখালেখিও করেন। শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য ২০২২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান ধ্রুব এষ।

;

তৃতীয় পক্ষ



ওমর শরিফ
অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

 

এ শহরে বাড়ি আর বাড়ি। ছায়া, শান্তি দেবে এমন গাছ কোথায়? গত বারের তুলনায় এবার গরমটা একটু বেশী পড়েছে। দুপুরবেলা তাই খাঁ খাঁ করছে রাস্তাঘাট। প্রায় জনমানব শূন্য চারিদিক। মাঝে মাঝে কিছু রিক্সা, ট্যাক্সি চলছে এদিক সেদিক। ভাগ্যিস দুই রাস্তার মাঝের ডিভাইডারে সারি সারি গাছ আছে। তবু একটু সবুজ দেখা যায়, তা-না হলে কিযে হতো? কথাগুলো ভাবলো মিতু। কলেজ পড়ুয়া তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী মিতু। কলেজে কোন ভাবেই মন বসছিলোনা মিতুর। একটা ঘটনা অস্থির করে রেখেছে তাকে কাল থেকে। তাই মাত্র তিনটা ক্লাস করে বেরিয়েছে ধানমন্ডি লেক যাবে বলে। ধানমন্ডি লেকে অনেক গাছ, অনেক শান্তি। সায়েলা, রবি দু’একবার জিজ্ঞেস করেছে কোথায় যাচ্ছে জানার জন্য। সায়েলা, রবি মিতুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মিতু ওদের মিথ্যে বলেছে।

-বলেছে ‘বড় চাচার বাড়ি যাচ্ছি, চাচা একটু অসুস্থ তাই দেখা করে ওখান থেকেই বাসা চলে যাবো’।     

‘ক্লাস শেষে বন্ধুদের আড্ডা জমে উঠেছিলো খুব তবু ছাড়তে হয়েছে। এই খাঁ খাঁ রোদে কার দায় পড়েছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসার? কল দিলে কল ধরো না, কেটে দাও আবার ব্যাকও করনা! এটা কি ধরনের কথা’? রিক্সার ভাড়া দিতে দিতে বলল মিতু। মিতুর রাগ দেখে সামনে দাঁড়ানো স্বপন মিটমিট হাসছে। ছয় ফিটের মতো লম্বা, ট্রিম করা দাড়ি, মাথার চুল এলোমেলো, একটা হাওয়াই শার্ট সঙ্গে জিন্স পড়া। পায়ে স্যান্ডেলের বদলে স্নিকার পড়েছে আজ। একটু আগোছাল যাকে বলে ‘স্বযত্নে অবহেলা’। স্বপনের এই ব্যাপারটাই দারুণ টানে মিতুকে। ওর মধ্যে কোথায় একটা ব্যাপার আছে। কি নেই, আবার আছে। ঠিক পূর্ণ নয় আবার খালিও নয়। স্বপন মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে। দেশের নামকরা একটা পত্রিকা অফিসে কাজ করে। কথা কম বলে। যা কথা বলে তা ওর গিটার বলে। খুব ভালো গিটার বাজায় স্বপন।      

রিক্সা থেকে নেমে তেড়ে এলো মিতু। ‘কি কানে শোন না। হাসছো আবার, লজ্জা নেই’? রাগে বলল মিতু।

‘আচ্ছা বাবা রাগ পরে হবে। আগে চলো লেকের ভেতরটায় যাই, এখানে অনেক রোদ’। বলল স্বপন। লেকের পার ধরে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে লেকের পাশে থাকা রেস্টুরেন্ট ‘জলসিরি’তে গিয়ে বসলো। রেস্টুরেন্টে লোকজন কম। দাঁড়িয়ে থাকা ওয়েটারকে এসিটা অন করে দিতে বলল স্বপন। মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বলো কি হয়েছে, এতো জরুরি তলব কেন?’

মিতু প্রতিত্তরে বলল, ‘আগে বলো এতক্ষণ ধরে তুমি আমার ফোন ধরছিলে না কেন’? কতোবার ট্রাই করার পর তোমাকে পেয়েছি, তোমার হিসাব আছে? এতো কথার পরও স্বপনকে শান্ত দেখে মিতু আরও খানিকটা রেগে গেলো। বলল, ‘তুমি কি অনুভূতিহীন, তোমার কি জানতে ইচ্ছে করেনা, আমি কেন এতবার ফোন দিয়েছি’?

স্বপন একটু সিরিয়াস হয়ে গলা খাকিয়ে বলল, ‘আসার পর থেকে আমাকে বলার সুযোগ দিয়েছ তুমি? শুধু নিজেই বলে যাচ্ছ’।

এতক্ষণে নিজেকে যেন খুঁজে পেলো মিতু, একটু লজ্জাও পেলো। কিছুটা নমনীয় হয়ে বলল, ‘আচ্ছা বলো কেন ফোন ধরতে এত সময় নিলে’?

স্বপনের সরল উত্তর, ‘খুব জরুরি মিটিং এ ছিলাম তাই তোমার ফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে ফোন ধরতে পারেনি। মিটিং শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছি। তারপর সব কাজ ফেলে এইতো তোমার সামনে আমি’।

মুখের এক্সপ্রেশন দেখে বোঝা গেলো উত্তরে মিতু সন্তুষ্ট হয়েছে। কিন্তু কিসের যেন উদ্বেগ স্পষ্ট। ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়ায়নি স্বপনের।  সে বলল, ‘কি হয়েছে? কোন সমস্যা? আমাকে খুলে বলো’।

মিতু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘স্বপন আমার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে বাসা থেকে। পাত্র পক্ষ জানিয়েছে আমাকে খুব পছন্দ হয়েছে তাদের। আগামীকাল আসবে ডেট ফাইনাল করতে। আমি এখন কি করবো স্বপন? আমাকে বলে দাও’।

স্বপন বলল, ‘বিয়ে করে ফেল। বাবা মা যা চাই তাই করো এতে সবার মঙ্গল’।

মিতু অবাক হয়ে স্বপনের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। বলল, ‘মানে কি? তাহলে এতদিন আমারা কি করলাম। তুমি একটা প্রতারক। তুমি একটা হিপোক্রেট। এখন দায়িত্ব নেয়ার সময় পালাচ্ছো। কাপুরুষ কোথাকার’। তখনও স্বপনের ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখে অবাক হয়ে গেলো মিতু।

স্বপন মিতুর দুহাত টেনে কাছে নিয়ে বলল, ‘এতো দিনেও চিনতে পারলেনা আমাকে। তুমি যা ভাবো আমি তার থেকে অনেক অনেক বেশী ভালোবাসি তোমাকে’। বলে উঠে দাঁড়িয়ে স্বপন বলল,‘চলো’। মিতু বললো,

- ‘চলো’। মিতু বললো,
- ‘কোথায়’?
- চলোই না।
- আগে বলো কোথায়?
- কাজী অফিসে।
- মানে?!
- আমরা আজই এক্ষুনি বিয়ে করছি।
- কি বলো এসব?
- যা বলছি ঠিক বলছি। এছাড়া আমাদের হাতে আর কোন পথ নেই।
- তোমার বাসা?
- আমি ম্যানেজ করবো।
- আমার বাসা?
- ওটা পরে ম্যানেজ হয়ে যাবে।

 

দরজা খুলতেই নাসরিন স্বপনের সঙ্গে একটি মেয়েকে দেখতে পেলো। দুজনেই পা ছুঁয়ে সালাম করতেই নাসরিন অবাক হয়ে পা সরিয়ে নিলো। কিছুটা সংকোচেও। নাসরিন স্বপনের মা। নাসরিন কিছুটা হতভম্ব হয়ে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন। সোফায় বসতে দিলেন। সোফাতে বসে মাকে উদ্দেশ্য করে স্বপন বলল, ‘মা আমরা বিয়ে করে ফেলেছি। তোমাকে  পরিচয় করিয়ে দিই। এ হচ্ছে মিতু। মিতু, ‘ইনি তোমার শাশুড়ি’।

নাসরিন ছেলের দিকে হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, ‘এসব কি বলছিস স্বপন, কাউকে না জানিয়ে এতবড় কাজ তুই কিভাবে করলি? তোর বাবাকে আমি কি উত্তর দিবো। আর চিনি না জানি না একটা মেয়েকে এনে ঘরে তুললি?

স্বপন পাত্তা না দিয়ে উত্তর দিলো, ‘মিতু ভালো ঘরের মেয়ে। বাবা মা শিক্ষিত। সে নিজেও শিক্ষিত অনার্স করছে। দেখতে ভালো, স্বভাব চরিত্রেও ভালো। তোমার সামনেই আছে দেখে নাও’। বলে হাসতে লাগলো।

নাসরিন আর বেশী কথা না বাড়িয়ে মিতুর দিকে তাকালেন। প্রথমিক কিছু কথা বার্তা জিজ্ঞেস করলেন।

বললেন, ‘বিয়েটা কি কোন ভাবে থামানো যাচ্ছিল না বা বাবা মা কে বুঝিয়ে শুনিয়ে অনার্স শেষ করে তারপর বিয়েটা হলে বোধহয় ভালো ছিল’। মিতু মাথা নিচু করে শুধু শুনে যাচ্ছে।

শুধু বলল, ‘আন্টি আমি বাবাকে খুব ভয় পাই আর বাবা সরকারি চাকরি ছাড়া বিয়ে দিবেন না। বললে আরও ঝামেলা বাড়বে’। 

নাসরিন মিতুকে থামিয়ে দিয়ে ঘরে নিয়ে যেতে বললো।

স্বপন দু’জনের উদ্দেশ্যে বললো, ‘অফিসে বিশেষ কাজ আছে, আমাকে একবার এক্ষুনি অফিস যেতে হবে। এর মধ্যে আশা করি তোমাদের চেনা জানা হয়ে যাবে’।

স্বপনের কথা শুনে মা ও মিতু দুজনেই বেশ অবাক হয়ে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকলো।

নিজের রুমে বসে বসে মিতু ল্যাপটপে হানিমুনের ছবি দেখছিল। কাশ্মীর যে কি সুন্দর ভাবাই যায় না। পাহেলগাম, সোনমার্গ, গুলমার্গ জায়গাগুলো ভোলার মতো না। সেবারই জীবনের প্রথম বরফ পড়া দেখেছিলো মিতু। কিছু ছবি দেখেতো মিতু রীতিমত না হেসে পারল না। সে সময় ওরা দুজনেই কেমন বাচ্চা বাচ্চা ছিল। ‘দেখতে দেখতে বিয়ের প্রায় চার বছর হতে চললো’ ভাবল মিতু। একটু কি দীর্ঘশ্বাসের মতো বয়ে গেলো বুকের ভিতরটায়? হানিমুনের ছবি দেখা শেষে পুরনো কিছু ছবিতে চোখ গেলো মিতুর। বাবা মা’র ছবি। বাবা মা পাশাপাশি বসা। বাবার কোলে মিতু। মিতুর বয়স তখন ছয় কি সাত হবে। কি দারুন একটা ছবি। মনের অগোচরেই চোখটা ভিজে এলো মিতুর। এখনও বাবার বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক হয়নি।

মিতুর বাবা মিতুর বিয়ের কথা শুনে বলেছিলেন, ‘মিতু নামে আমার মেয়ে ছিল আমি ভুলে গেছি। বাবার অপমান করতে যে মেয়ের বিন্দুমাত্র বাঁধে না; সে আমার মেয়ে হতে পারে না। মিতুর মুখ আমি দেখতে চায়না’।

মাস্টার্স পাস করে মিতু চাকরির কথা ভাবেনি, যদিও স্বপন ওকে বার বার বলেছে বাসায় একা একা বোর লাগবে, তবুও। মিতুর শাশুড়িও একই কথা বলেছে, কিন্তু মন থেকে সায় দেয়নি মিতু। বাচ্চা পালন করবে আর সংসার সামলাবে এটিই ছিল তার চিন্তা।

মিতুর বাচ্চার খুব শখ কিন্তু স্বপন এখন বাচ্চা নিতে নারাজ। বললেই বলে, ‘আরে বাচ্চার জন্য এতো তাড়া কিসের, অঢেল সময় পড়ে আছে, আগে নিজেদের মতো করে সময় পার করি’।

স্বপন সকাল সকাল বেরিয়ে যায় ফেরার কোন সময় নির্দিষ্ট নেই। কখনও আটটা কখনও দশটা পেরিয়ে যায়। আবার কখনও কাজের এতো চাপ থাকে যে কোন কোন রাতে বাসা ফেরা হয়না। কাজ নিয়ে খুব সিরিয়াস স্বপন। খুব তাড়াতাড়ি কয়েকটা প্রমশনও পেয়েছে সে। এই বছর প্রমোশন নিয়ে গাড়ি কিনেছে ওরা। মিতুর পছন্দতেই কেনা। লাল রঙের গাড়ি। লাল রঙের গাড়ি মিতুর খুব পছন্দ। স্বপনের উন্নতিতে মিতুর গর্বের শেষ ছিলনা। মিতুর কেবলই মনে হতো স্বপনের যত সাফল্য সবই তার নিজের। সে নিজে অনুভব করতো আর আনন্দ নিয়ে সেলেব্রেট করতো। মিতুর বন্ধু বান্ধবী পাড়া পরশি যার সঙ্গেই কথা হোক না কেন, ইনিয়ে বিনিয়ে স্বপনের সাফল্যের কথা বলবেই। সে কথায় কথায় স্বপন যে তার ক্যারিয়ারে খুব ভালো করছে, সে হাসবান্ড হিসেবে খুব কেয়ারিং, পরিবারের ব্যাপারে যত্নবান সেগুলো অন্যকে বলে আত্মতৃপ্তি পায়। সেদিন পাশের বাসার ভাবি বললেন, ‘মিতু ভাবি কি যে করি বলেন তো? আমার হাসবান্ড তো আমার হাতের রান্না একেবারেই খেতে পারেনা। আপনি কিভাবে যে ম্যানেজ করেন’?

মিতু হাসতে হাসতে বলন, ‘আপনার ভাইতো আমার হাতের রান্না ছাড়া খেতেই পারেনা। আসলে এ হচ্ছে ভালোবাসা, বুঝেছেন ভাবি ভালবাসা থাকলে বিষও মধু মনে হয়’।

মিতুর সেদিনের সেই আত্মতৃপ্তি ভোলার মতো না। কথা যখন বলছিলো তখন দু চোখ চকচক করে উঠছিল যেন। 

কিছুক্ষণ ধরে মোবাইলটা বেজে চলেছে। মিতু রান্না করছিলো তাই ধরতে দেরি হলো।

হাত মুছে ফোনটা ধরে বলল, ‘হ্যালো স্লামালেকুন। কে বলছেন’?  

মোবাইল ওপাশ থেকে ভেসে এলো, ‘ভাবি আমাকে চিনতে পারছেন আমি ফারুক বলছি। ঐযে নিউ মার্কেটে দেখা। আপানারা প্লাস্টিকের কিছু জিনিস কিনছিলেন। মনে আছে’?  

মনে পড়ে গেলো মিতুর। সে বলল, ‘ও হ্যাঁ ফারুক ভাই! কেমন আছেন? বাসায় সবায় কেমন আছে? বাচ্চারা কেমন আছে’? সরি ফারুক ভাই আপনার নম্বারটা আমার মোবাইল সেভ ছিল না’।  

ফারুক উত্তরে বলল, ব্যাপার না ভাবি, হতেই পারে। আপনাদের দোয়ায় সবাই ভালো আছে। আলহামদুলিল্লাহ। ভাবি একটা কাজে একটু ফোন করেছিলাম’।

মিতু বলল, কি ব্যাপার বলুন তো?

স্বপন ভাইকে একটু দরকার ছিল। উনি কি বাসায় আছে না কোন কাজে বাইরে গেছেন?

কেন আপনি জানেন না? আপনার স্বপন ভাইতো আপনাদেরই অফিসের ট্যুরে চট্টগ্রাম গেছে।

ফারুক একটু অবাক হয়ে বলল, ‘কি বলেন ভাবি? আমার জানা মতে স্বপন ভাইতো অফিসের ট্যুরে কোথাও যাননি। বরং উনি তো বাসার কাজের কথা বলে দু’দিন ছুটি নিয়েছেন।!

মিতু আর কথা বাড়ায় না। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে, অনুমানে সে তা বুঝেছে। সে কথাটা ঘুরিয়ে ফারুককে বলল, ‘হ্যাঁ স্বপন বলছিলো বাসার কাজের সঙ্গে অফিসের কাজও সেরে আসবে। তাইতো সেদিন আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলো। আমি হয়তো বুঝতে ভুল করেছি’।

ফারুক ওপাশ থেকে বলল, ‘ও আচ্ছা ঠিক আছে ভাবি, স্বপন ভাইয়ের অন্য কোন নম্বার থাকলে দিলে ভালো হয়। জরুরি আলাপ আছে’।

ফারুক ভাই স্বপনের তো একটাই নম্বার। ও তো আর অন্য কোন নম্বার ব্যবহার করেনা। ও কল দিলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলবো’।

কথা বলার সময় যতদূর সম্ভব মাথাটাকে ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করলো মিতু। কথা শেষ করে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লো সে। সে কিছু একটা গড়বড় আছে অনুমান করছে। কিন্তু আবার এও চিন্তা করছে অনুমান নির্ভর কিছু ভেবে বসা ঠিক না। সে মনে মনে চিন্তা করলো, ‘স্বপন এলে কথা বলবে’।

স্বপন দুই দিন পর অফিসের কাজ করে বাসায় ফিরে এলো। এসেই মিতুকে জরিয়ে ধরে চুমু খেল। গভীর আদরে বুকের মধ্যে নিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘আহা কি শান্তি। তোমাকে বুকে নিলে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। এই কি আছে তোমার মধ্যে? তোমাকে বুকে নিলেই আমার কেন এতো শান্তি শান্তি লাগে?

মিতু শুধু হুম হলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। বেশী কথা বাড়ালো না। স্বপন মিতুর এই ব্যবহারে কিছুটা অবাক হল। বলল, কি ব্যাপার শরীর খারাপ নাকি? কিছু হয়েছে? মন খারাপ?

মিতু উত্তরে বলল, ‘রান্না করতে করতে একটু টায়ার্ড হয়ে গেছি মনে হয়। ঠিক হয়ে যাবে। তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি’। বলে মিতু রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। স্বপনও ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকে পড়লো।

মিতুর স্বপনের এরকম ব্যবহার দেখে কিছুটা স্বস্তি বোধ করলো। মন থেকে কালো মেঘ যা এতক্ষণ খেলা করছিলো তা কেটে গেলো। নিজেকে খুব হাল্কা হাল্কা বোধ করছে এখন। দুজনে একসঙ্গে বসে খেল। ডাইনিং টেবিলে স্বপন অনেক গল্প করলো মিতুর সঙ্গে। মনে হল এই দুইদিনে অনেক গল্প জমা ছিল। মিতুকে পেয়ে সব বাধা সরে গিয়ে একসঙ্গে বেরিয়ে আসতে লাগলো সব।

এতো কিছুর পরও মিতু লক্ষ্য করলো, ‘আগে কথায় কথায় স্বপন মিতুর গায়ে হাত দিত। ট্যুর থেকে এলে বেডে অনেক আদর করতো। কিন্তু এবার টায়ার্ড বলে পাশ ফিরে শুয়ে গেলো। মিতুর শরীরটাকে কাছে টেনে পর্যন্ত নিলো না। স্বপনের ব্যবহার মিতুর কাছে কিছুটা আলাদা মনে হল। শুয়ে শুয়ে মিতুর কেবলই মনে হতে লাগলো অফিস থেকে দেরিতে ফেরা, হুটহাট ট্যুরের নামে বাইরে যাওয়া। মোবাইল চ্যাট করা আর মোবাইল বেজে উঠলে খুব সন্তর্পণে অন্য রুমে গিয়ে কথা বলা, কেমন যেন আলগা একটা অনুভূতির সৃষ্টি করলো মিতুর কাছে। মিতু ঠিক বুঝতে পারছে কিছু তো একটা আছে যা মোটেও স্বাভাবিক নয়। কোথায় যেন কি নেই। মিতু মনে মনে ছটপট করে উঠলো। এতদিন তাহলে কেন বুঝতে পারেনি সে? নাকি এ সবই তার ভুল, দুর্বল মনের বিকার মাত্র।

শুক্রবার ছুটির দিন। এই দিনটিতে স্বপন কিছুটা বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। মিতু সকালের রান্না করতে ব্যাস্ত সময় পার করছে। আজ পরোটা, ডিমভাজা আর আলুর দম রান্না হচ্ছে। স্বপনের ফেভারিট। নাস্তা প্রায় রেডি। স্বপনকে উঠাতে ঘরে ঢোকা মাত্র স্বপনের মোবাইল মেসাজের শব্দ কানে ভেসে এলো মিতুর। স্বপন তখনও ঘুমে অচেতন। ‘কোন জরুরি মেসেজ নাকি’? ভাবলো মিতু। মিতু কাছে গিয়ে মোবাইল তুলতেই আরেকটি মেসেজ ভেসে উঠলো। রিয়া নামে কেউ লিখেছে, ‘তোমাকে খুব মিস করছি’। মেসেজ দেখে মিতুর কেমন যেন বাজে অনুভূতি হল। সে সম্পূর্ণ মেসেজ পড়ার জন্য মোবাইল আনলক করতেই একগাদা হার্ট ইমজি ভেসে উঠলো। মিতুর চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠলো। সে ধীরে ধীরে স্ক্রল করতে শুরু করলো। সে যতই পড়ছে ততই অবাক হচ্ছে। স্বপন লিখেছে চট্টগ্রামের ট্যুরটা অতুলনীয় ছিল। রিয়ার উত্তর, ‘না মোটেও না। আমার মতে গুলশান হোটেলে আমাদের সময়টা ছিল বেস্ট। তবে কক্সবাজার ট্যুরটাও বেশ উপভোগ্য ছিল। বেডে যে তুমি কি পাগলের মতো করো না। তোমাকে সামলানোই যায় না। ইউ আর আ রিয়েল ওয়াইল্ড টাইগার। আই লাভ ইউ’।

উত্তরে স্বপন লিখেছে, ‘তোমার কোন তুলনা হয় না। তুমি বেস্ট। আই লাভ ইউ ঠু’।

সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছে যেন। নিজেকে দিশেহারা মনে হচ্ছে। পাগল পাগল লাগছে সব। পড়ছে আর মিতুর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ওদের দুজনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি দেখা যাচ্ছে। এসব দেখে মিতুর কেবলই মনে হচ্ছে কেউ যেন ওর হৃৎপিণ্ডটাকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে দিচ্ছে। বুকের ভেতর প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছে সে। কষ্টে কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না যেন। 

হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে মিতুকে তার মোবাইল হাতে কি যেন করছে দেখতে পেলো স্বপন। এমন সময় উঠে এসে পেছন থেকে মিতুর কাছ থকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বললো, ‘হাউ ডেয়াড় ইউ। তুমি আমার মোবাইলে হাত দিয়েছো কেন? মেসাজ কেন পড়ছো? মানুষের প্রাইভেসি বলে একটা কথা আছে। আনশিভিলাইসড কোথাকার’।

মিতু কিছুই বললোনা শুধু ফ্যালফ্যাল করে স্বপনের দিকে চেয়ে থাকলো। স্বপনের উদ্ধতপূর্ণ কথাবার্তা  নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না সে। এ ধরনের অন্যায় করার পর কোন মানুষ যে এতো নির্বিকার হতে পারে মিতুর চিন্তার বাইরে ছিল। শান্ত থাকতে থাকতে হঠাৎ মিতু চিৎকার করে উঠলো। বলল, চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার? অফিসের ট্যুরের নাম করে বান্ধবী কে নিয়ে ঘুরে বেড়াও। ছি ছি তোমার লজ্জা করেনা?

স্বপন মিতুকে থামাতে এগিয়ে আসতেই মিতু একরকম পাগলের মতো চড়, থাপ্পড় দিতে শুরু করে দিলো। আক্রোশে স্বপনের রাতে পড়া জামাটা একটানে ছিঁড়ে ফেললো মিতু। মুখে বলল কুত্তার বাচ্চা তুই আমার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আমার জীবন নিয়ে খেলেছিস। বাস্টার্ড।

স্বপন মিতুকে থামাতে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। মুখে বলল, ‘আর একটা কথা বললে তোকে এখানেই মেরে ফেলবো। কি প্রমাণ আছে তোর কাছে যে আমি লম্পট। ... উল্টাপাল্টা কথা বললে তোকে আমি খুন করে ফেলবো’।

মিতু তখনও স্বপনের জামার কলার ধরে আছে। বলল, ‘ফারুক ভাই কল করেছিলো উনি বলেছেন তুমি অফিসের ট্যুরে যাওনি। তুমি তোমার লাভারের সঙ্গে হানিমুনে গিয়েছ চট্টগ্রামে। তারও আগে কক্সবাজারে আর গুলশানে একসঙ্গে রাত কাটিয়েছ। সবই পড়েছই আমি। তোমাদের একসঙ্গে ইন্টিমেট সব ছবিও দেখেছি। ছি তোমার ঘেন্না করেনা। চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার?

সব শুনে স্বপন একটা ধাক্কা খেল যেন। একটু বোকা বোকা লাগছে নিজেকে। সে আস্তে আস্তে বিছানায় গিয়ে বসলো। কোন উপায় না পেয়ে মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার ভুল হয়েছে মিতু, আমাকে তুমি ক্ষমা করো। এবারের মতো মাফ করে দাও, প্লিজ’।

অপরাধবোধ আর অনুশোচনায় নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছিলো স্বপনের। ক্ষণিকের আনন্দের জন্য এ কোন ভুল করে বসলো স্বপন। সে চাইলেও নিজেকে আর ক্ষমা করতে পারবেনা।  

এতক্ষণে মিতুও কিছুটা ধাতস্ত হয়ে এসেছে। স্বপনের দিকে তাকিয়ে শুধু জিজ্ঞেস করলো, ‘স্বপন আমার কি দোষ ছিল? আমিতো তোমাকে নিজেকে উজাড় করে চেয়েছি। এতো বড় কষ্ট তুমি আমাকে দিতে পারলে? তুমি আমার পৃথিবী ধ্বংস করে দিয়েছ। আমাকে শেষ করে দিয়েছ। কিভাবে পারলে? এসব জানার আগে আমার মৃত্যু হলনা কেন? স্বপন আমি যে তোমাকে খুব খুব ভালোবেসে ছিলাম। এত বড় প্রতারণা তুমি কেন করলে? আমাকে বললে আমিই তোমার জীবন থেকে চলে যেতাম। তাই বলে এতবড় আঘাত তুমি আমাকে দিতে পারলে’?

 

সময় যেন থেমে গেলো। মিতু আর আগের মতো উচ্ছ্বসিত হয়না। স্বপন বিরাট ভুল করেছে এবং তা সে বারবার স্বীকার করেছে। মিতু স্বপনকে মন থেকে ক্ষমাও করেছে। কিন্তু দিন শেষে যখন মুখোমুখি হয় তখন নিজের মূল্য নিয়ে সংশয় দেখা দেয় মিতুর। বড্ড সস্তা লাগে নিজেকে। পরিপূর্ণভাবে কিছু দিতে না পারার বেদনা নিজেকে কুড়ে কুড়ে খায়। মিতু বুঝতে চেষ্টা করে তাদের মাঝে কি ছিলনা যে স্বপনকে অন্য মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। সম্মানবোধ? মিতুর মতে, ‘স্বপন মিতুকে ভালোবাসতো ঠিক কিন্তু তার মধ্যে গভীরতা ছিলনা, সম্মান ছিলনা। যা ছিল তা প্রাত্যহিক জীবনের অভ্যেস। মাপ করে চুমু দেয়া, বাহির থেকে এসে জড়িয়ে ধরা, সাংসারিক কথা বলা, রুটিন করে মিলিত হওয়া। এর মধ্যে নতুনত্ব কি আছে? যা আছে তা সবই অভ্যেস। মিতু স্বপনকে রিয়ার কাছে কেন যাচ্ছে না জানতে চাইলে বলে, ‘রিয়াকে আমি সেভাবে কখনই দেখিনি। এটা একটা মোহ’।

মিতু বুঝতে পারে রিয়া স্বপনের পাঞ্চ লাইন। অনেকটা সারাদিনের ক্লান্তির পর এক পেগ মদ যেমন তেমন। স্বপনের কাছে ঘরটা থাকলো ঠিকই, মাঝে মাঝে একটু বাম্পার রাইডিং ও থাকলো, যা জীবনে স্পাইস যুক্ত করবে। এই সমীকরণ যা বোঝায় তা হচ্ছে। স্বপনের লয়াল থাকা প্রায় অসম্ভব, মিতুও সেটি বোঝে।

আগে দুজনার অনেক কথা হতো এখন সত্তুর শতাংশ কথা কমে গেছে দুজনার মধ্যে। প্রয়োজন ছাড়া কথা হয় না। একে ওপরের দিকে ঠিক ভাবে তাকাতে পর্যন্ত পারে না। অনুশোচনায় আর অপমানে দুজনেই শুধু হারিয়ে থাকে। দুজনেই অনুভব করে, কোন কিছুই আর আগের মতো নেই। ঘটনা প্রবাহে সব কিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে। স্বপন মিতুকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য যথেষ্ট সাহায্য চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মিতু নিজের সামনে নিজেই দাঁড়াতে পারছেনা। দুপুরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মিতু ভাবছে সে আর কি করলে এমন ঘটনা ঘটতো না? কি করলে স্বপনকে আগলে রাখতে পারতো? বার বার একই উত্তর পেলো। অভ্যেস! টানটা আর আগের মতো নেই।

পরের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে মিতু বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকালের আকাশ দেখছে। আনমনে কি যেন ভাবছে। স্বপন মিতুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, ‘অফিসে যাচ্ছি’ বলে বের হয়ে গেলো। মিতু একবার সকালের নাস্তার কথা জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলো না। বারান্দায় বসে দুই হাতের তালুতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে  কাঁদতে শুরু করলো।

রাতে স্বপন অফিস থেকে ফিরে এসে কলিং বেল দিলো। কিন্তু কেউ দরজা খুলছে না দেখে একটু ভয় পেয়ে গেলো সে। ব্যাগে রাখা এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল স্বপন। রাতে লাইট জ্বালায়নি মিতু। পুরো বাসা চুপচাপ। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো স্বপনের। হঠাৎ ভয় পেয়ে মিতু মিতু বলে ডাকতে শুরু করে দিলো স্বপন। বেডরুমে ঢুকে দেখল মিতু সেখানে নেই। লাইটের সুইচ অন করলো স্বপন। বাথরুম, পাশের রুম, বেলকণি ঘুরে ঘুরে দেখল, কয়েকবার ডাকলো মিতু নাম ধরে কিন্তু কোন সাড়া নেই। বেড রুমে ফিরে এসে বিছানায় বসে পড়লো স্বপন। দুই হাতের তালুতে মুখ লুকাল সে। ভয়ে টেনশনে ঘেমে নেয়ে গেছে একেবারে। হাত থেকে মুখ তুলতেই লক্ষ্য করলো এস্ট্রের নিচে চিঠির মতো কি যেন চাপা দেয়া আছে টেবিলের উপর। স্বপন উঠে এসে দেখল হ্যাঁ মিতুর লেখা চিঠি একটা।

চিঠিতে লেখা,

স্বপন, আমরা পছন্দ করে পরিবারের মতের বাইরে গিয়ে সংসার পেতে ছিলাম। সুখে দুখে আমরা সব সময় এক ছিলাম। পাশাপাশি ছিলাম। ভেবেছিলাম জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমার সঙ্গে পাড়ি দিবো। তা আর হলনা। এই ৮ বছরের সম্পর্কে কোনদিন বুঝিনি তুমি আমার কেউ নও। আজকের পর থেকে শুধুই মনে হচ্ছে তুমি আমার কেউ নও, তুমি আর পাঁচটা মানুষের মতো। তুমি নিশ্চয় জানো একটা সম্পর্ক টিকে থাকে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর সম্মান বোধ থেকে। একটা সম্পর্কের আয়ু বেড়ে যায় একে অপরকে বোঝা পড়ার মাধ্যমে। জানিনা কি পাপ করেছিলাম যে আল্লাহ আমাকে এতো বড় শাস্তি দিলেন। হ্যাঁ, শাস্তিই বটে। সম্পর্কে প্রতারণার কোন জায়গা থাকতে পারে না। আমি জানি আমাকে তুমি ঠিক ভালোবাসতে পারোনি। যা তুমি ভালবাসা বলছো তা আমার প্রতি নিছক ইনফাচুয়েসন। পুরনো অভ্যেস। কেন? সেটির উত্তর তুমিই ভালো দিতে পারবে। তুমি আজ আমাকে যে অসম্মান করেছ তার কোন তুলনা হয় না। আয়নার সামনে কোনদিন দাঁড়াতে পারবো এ বিশ্বাস আমার মরে গেছে। তোমার প্রতি রাগ বা ঘৃণা কোনটিই নেই আমার। তুমি আমার কাছে এখন যে কোন পুরুষ। তবু আমি তোমার ভালো চাইবো। তুমি ভালো থেকো। অনেক ভালো থেকো। নিজের যত্ন নিয়ো। শুধু জেন মিতু নামের একটি মেয়ে তোমাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসেছিল। তোমাকে খুব খুব চেয়েছিলো। তার দাম সে পায়নি বলে চলে যাচ্ছে। আমাকে খুঁজনা।-মিতু

চিঠিটা পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বুকের মাঝে ধরে, ‘মিতু আমাকে মাফ করে দাও, আমাকে ক্ষমা করে দাও’ বলে বিলাপ করতে লাগলো স্বপন। কেমন পাগলের মতো মিতু মিতু বলে ডাকতে লাগলো সে। কিছুক্ষণ পর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবনটাকে অসম্ভব ভারি বলে মনে হতে লাগলো স্বপনের। বিস্তীর্ণ আকাশে জীবনের অসীম অনিশ্চয়তার দিকে তাকিয়ে থাকলো শুধু।      

;

নৃত্য-গীতে জীবন্ত হল রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কালজয়ী আখ্যান



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্ব পরিভ্রমণের সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আর্জেন্টিনায় ল্যাটিন আমেরিকার কালজয়ী সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক ও নারীবাদী লেখক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ঐতিহাসিক সাক্ষাতের শতবর্ষ এ বছর।

১৯২৪ সালে এই দুই কালজয়ী লেখকের সাক্ষাত অক্ষয় হয়ে আছে দু’জনের জীবনস্মৃতিতে, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আদান-প্রদানে আর ভিক্টোরিয়াকে রবীন্দ্রনাথের ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করার মতো বহু ঘটনাবহুল আখ্যানকে ঘিরে। দু’জনের এই মধুর এ আখ্যানকে ঢাকার সাহিত্য ও সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে তুলে ধরলো ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি)।

সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ছায়ানট মিলনায়তনে ‘TAGORE AND VICTORIA OCAMPO-VIJAYA the victorious: 100 years on’ শীর্ষক নৃত্য-গীতে সেই অবিস্মরণীয় আখ্যানকেই ফুটিয়ে তুললেন যুক্তরাজ্য থেকে আগত বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও শিল্পী ডা. অনন্ত গুপ্ত এবং তাঁর সহশিল্পীরা।

বক্তব্য রাখছেন ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসা

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি) এর পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী আয়োজনের পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে অতিথি ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসার লাতিন আমেরিকার জনগণের হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির কথা তুলে ধরে তাকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধন রচনকারী মহান লেখক হিসেবে বর্ণনা করেন। অনুষ্ঠানে আর্জেন্টিনায় অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ রচিত বিভিন্ন কালজয়ী গান নৃত্যসহযোগে পরিবেশন করেন শিল্পীরা। একইসঙ্গে সেইসব গানের প্রেক্ষিত তুলে ধরা হয়।

উল্লেখ্য, ১৯২৪ সালে পেরু সরকারের আমন্ত্রণে দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবর্ষ উদযাপনে যোগ দিতে গিয়ে তেষট্টি বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ সমুদ্রপথে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় তিনি আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেসে থামেন এবং ওঠেন সান ইসিদ্রো শহরের এক হোটেলে। সেখানে কবির ভীষণ অনুরাগী আর্জেন্টিনার বিখ্যাত সাহিত্যিক ও নারীবাদী লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো (যিনি কবির গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদ পড়ে তাঁর কবিতার সঙ্গে কবিরও অনুরাগী হয়ে উঠেন)। রবীন্দ্রনাথের আগমনের খবরে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ছুটে যান কবির কাছে। তিনি কবিকে সুস্থ করার জন্য হোটেল থেকে নদী তীরে বাগানবাড়িতে নিয়ে আসেন।

অনুষ্ঠান মঞ্চে অতিথিদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন আইজিসিসি পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী

এরপর এই দুই লেখকের সম্পর্ক গভীর আত্মিক সম্পর্কে পর্যবসিত হয়। কবি তাঁকে বিজয়া বলে সম্বোধন করতেন। কবির বিভিন্ন গানেও ভিক্টোরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে। তাকে উৎসর্গ করেন কাব্যগ্রন্থ ‘পূরবী’। রবীন্দ্রনাথকে চিত্রকর্মে প্রাণিত করেন ওকাম্পো। ব্যবস্থা করেন প্রদর্শনীরও। দুই কালজয়ী সাহিত্যিকের মাঝে যেসব পত্র বিনিময় হয় তা সাহিত্যের চিরকালীন সম্পদে পরিণত হয়েছে।

;

বর্ষবিদায় - বর্ষবরণ

  ‘এসো হে বৈশাখ’



প্রদীপ কুমার দত্ত
মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

আবারও বছর ঘুরে এসেছে বৈশাখের পয়লা দিন। আমাদের জাতীয় উৎসব নববর্ষ। গত বেশ কয়েক বছর ধরে দেখতে পাই এই উৎসব নিকটবর্তী হলেই মঙ্গল,আনন্দ,আশার প্রতীক দিনটিকে বিতর্কিত করে একে বানচাল করার এক অশুভ প্রচেষ্টা দানা বাঁধানোর উদ্দেশ্যে একশ্রেণির লোক মাঠে নামে। পহেলা বৈশাখ উৎযাপন উপলক্ষে যে উৎসবমুখরতা, তা আমাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়,আমাদের কৃষ্টি সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এই জাতীয় নানা বিষয়ের অবতারণা করে দিনটিকে বিতর্কিত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।

বিতার্কিকদের মধ্যে কেউ কেউ আবার এর মধ্যে ধর্মাচরণকেও টেনে আনেন। গত বছর তো আইনগত ব্যবস্থা নেয়াও শুরু হয়েছিল। সেই প্রচেষ্টা অবশ্য হালে পানি পায় নি। এবারেও দন্ত-নখর বের করা শুরু করেছিল আমাদের বাংলার আদি সংস্কৃতির বিরোধীরা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয় সরকার ক্ষমতায় থাকায় অংকুরেই সেই চেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়ে থেমে গেছে। অবশ্য সরকার উভয়পক্ষকে খুশি রাখার চেষ্টা করে উৎসব পালনের সময়সীমা সংক্ষিপ্ত করে নির্দেশনা জারি করেছেন। এই রকম আপোষ করে সেই কুৎসিত শক্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তোলা হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা সরকারের উপযুক্ত মহলের উচিৎ।

উৎসব পালনের কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। সময়ের সাথে সাথে এবং অঞ্চলভেদে বিভিন্ন অনুষঙ্গ ও ধরন পাল্টায়। সংস্কৃতি ও কৃষ্টি গতিশীল। সমাজে গ্রহণযোগ্য এবং শালীনতার মাত্রা অতিক্রম না করা আনন্দে মেতে ওঠার বিভিন্ন কার্যক্রমের সমষ্টিই উৎসব। আদিকাল থেকেই বৈশাখী মেলা, হালখাতা, চৈত্র সংক্রান্তি, গাজন, নীলপূজা, চড়ক, বিভিন্ন প্রকৃতির লোকজ সংস্কৃতির ও খেলাধুলার আয়োজন,সাধ্যমত নতুন পোষাক ও ভালো খাবারের আয়োজন,অতিথি আপ্যায়ন, ইত্যাদি নিয়ে বাঙ্গালীরা পুরাতন বর্ষ বিদায় ও নববর্ষের আগমনকে একটি উৎসবের রূপ দিয়ে আসছে।

কালক্রমে বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে বাংলা সংস্কৃতির উপর পাক সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন কতৃপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার অংশ হিসাবে ছায়ানট রমনা বটমূলের বর্ষবরণ উৎসব আয়োজন শুরু করে। সেই আয়োজন আজ ডালপালা বিস্তার করে সারা দেশে এমনকি দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিহাস স্বাক্ষী, মৌলবাদের কালো থাবা সেই আয়োজন থামিয়ে দিতে রমনা বটমূলের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে নিরীহ সংস্কৃতি প্রেমীদের হত্যা করেও সফল হয়নি।২০০১ সালের সেই হামলার পর নিরীহ বাঙ্গালী গর্জে উঠে ২০০২ সালে আরও অধিক সংখ্যায় রমনায় হাজির হয়েছে। দেশের শহর ও গ্রামের দিকে দিকে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আরও ব্যপ্তি লাভ করেছে।

ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট বিগত শতাব্দীর আশির দশকে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু করে। এই আনন্দ উৎসব পরবর্তীতে মঙ্গল শোভাযাত্রার রূপ ধারণ করে। এই সফল আয়োজন ইতোমধ্যে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভ করেছে। আনন্দ প্রকাশের এই বহিঃপ্রকাশ নিয়ে এক শ্রেণির লোকের প্রচন্ড গাত্রদাহ রয়েছে।ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে তারা এই শোভাযাত্রা বন্ধ করতে চায়।দেশের প্রাগ্রসর প্রগতিশীল নাগরিকরা এই জাতীয় অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে চায় না। মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান সহ বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের সকল আয়োজন দিন দিন আরও সবল,সতেজ ও পরিশীলিতভাবে অগ্রসর হবেই।

বৈশাখী উৎসবের বিরোধিতাকারী কূপমণ্ডূকদের অনেকের জানাই নেই যে এই উৎসব একই সময়ে দুই একদিন আগে বা পরে বহু জায়গায় বিভিন্ন নামে পালিত হয়। আমাদের নববর্ষ, আসামে বিহু,পাণ্জাবে বৈসাখ,থাইল্যান্ডে সাংক্রান,বার্মায় থিংইয়ান,নেপাল ও সংলগ্ন উত্তর ভারতে বিক্রম সম্ভত,কম্বোডিয়ায় চউল চ্নাম থিমে, সিংহলে আলুথ অনুরুদ্ধা, লাওসে বা পি মেই, কেরালায় ভিষু, তামিলনাড়ুতে পুথান্ডু, এই সব উৎসবই দক্ষিণ /দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রাচীণ কাল থেকে চলে আসা বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ। অনেক এলাকায়,এমনকি আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামেও ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল বা একে অপরের শরীরে পানি ছিটানো এই উৎসবের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। জল শুচি,পবিত্রতা ও শুভ্রতার প্রতীক। পুরনো বছরের ভুল, অসাফল্য, গ্লাণি সব ধুয়ে নতুন বছর আরও উন্নততর জীবনযাত্রায় এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক এই জল ক্রীড়া।

যে সকল অন্ধকারের শক্তি এই বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ উৎসবকে হিন্দুয়ানীর সাথে সম্পর্কিত অনুষ্ঠান বলে প্রচার করেন তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে সনাতনী ধর্মাচার ও সামাজিক আচার কিছু এই সময়ে অবশ্যই থাকে। সেগুলো সবই তাঁরা পালন করেন পণ্জিকা অনুযায়ী। সেই পঞ্জিকার সনাতনী ধর্মের পূজা বা উৎসব সমূহ নির্ধারিত হয় বিক্রম সম্ভত বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চন্দ্র/সূর্য/নক্ষত্র এর অবস্থান সমন্বয় করে বিভিন্ন মাস ২৯,৩০,৩১ এমনকি ৩২ দিনেও হয়।

সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী পহেলা বৈশাখ বেশির ভাগ বছর ১৫ এপ্রিল তারিখে হয়ে থাকে।লিপ ইয়ার সেই বর্ষপণ্জিতে না থাকার কারনে মোটামুটি চার বছরে একবার এটি ১৪ এপ্রিলে হয়। বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের জন্য বহু বছর গবেষণার পর বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে নিজস্ব বর্ষপঞ্জি চালু করেছে। সেই বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে প্রায় বছরই বাংলাদেশের সনাতনী সম্প্রদায় নববর্ষের দিন (১৪ এপ্রিল) তাঁদের সামাজিক/ধর্মীয় চৈত্র সংক্রান্তির পালনীয় ক্রিয়াকর্ম নিজেদের ঘরে পালন করেন।কিন্তু পহেলা বৈশাখের নববর্ষের সকল উৎসব ও কর্মকাণ্ডে আপামর দেশবাসীর সাথে সানন্দে অংশগ্রহণ করে থাকেন। একই কথা তাঁদের অন্য সকল পূজা পার্বণের বেলায়ও খাটে।


আমাদের পার্বত্য এলাকায় এই নববর্ষ পালন হয় জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে। এই অঞ্চলে বহু বাঙ্গালী তো আছেনই। কিন্তু বৃহৎ সংখ্যায় থাকেন ১৪টি বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মানুষ। নৃতাত্ত্বিক,সাংস্কৃতিক,ভাষাগত এবং বিভিন্ন ভাবে তাঁরা সমতলের বাঙ্গালীদের চাইতে তো বটেই, এমনকি একে অপরের চাইতেও আলাদা। এই বিভিন্নতা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এই সৌন্দর্যের নামই বহুল প্রচলিত শব্দবন্ধ ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি বা বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্য।

এখানকার বম,খিয়াং,লুসাই,পাঙ্খোয়া ও খুমিরা বৃহত্তর সংখ্যায় খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী। তাঁদের বড় উৎসব বড়দিন(ক্রিসমাস)।বকি সকলের জন্য তিন দিন ব্যাপী বর্ষবিদায় /বর্ষবরণ উৎসবই বছরের সেরা পার্বণ। এই সময় সব পাহাড় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে উৎযাপনে।যোগ দেন তাঁদের খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী অন্যান্য জাতিসত্ত্বার প্রতিবেশীরা এবং পাহাড়ে থাকা বাঙ্গালীরা। আমোদে অংশ নিতে দেখা যায় সমতল থেকে এই উপলক্ষে ছুটে আসা পর্যটকদেরও।

তাঁদের উৎসব আনন্দ উৎযাপনের মধ্যে অনেক উপাদান। মঙ্গল শোভাযাত্রার আলোকে র‍্যালী হয় সবাইকে নিয়ে।আয়োজনে থাকে প্রশাসন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। হয় বিচিত্রানুষ্ঠান। খাওয়া দাওয়ার আয়োজন সকলে করেন সাধ্যানুযায়ী উঁচুমানের। তার মধ্যে বিশেষ একটি আয়োজন হল বিভিন্ন তরিতরকারির মিশ্রণে পাঁজন বা লাবড়া। কে কত পদের তরকারি/শাক/ওষধি দিয়ে পাঁজন রেঁধেছেন তার চলে অঘোষিত প্রতিযোগিতা। ক্ষেত্র বিশেষে এই সংখ্যা পণ্চাশ ছাড়িয়ে যায় বলে শুনেছি।


উৎসবমালা শুরু হয় দেবতা ও প্রয়াতঃ পূর্বপুরুষদের স্মৃতিতে পাহাড়ি ঝরণা বা নদীতে ফুল ও প্রদীপ ভাসিয়ে। নতুন কাপড় পরিধান নতুন বছরের আগমনকে স্বাগত জানানোর প্রতীক।মন্দিরে চলে মহামতি বুদ্ধদেবের আরাধনা আগত বছরে সকলের মঙ্গল কামনায়। অনেক বড় মন্দিরে বহু লোক সমাগম হয় প্রথম দিন রাতে।সারা রাত উৎসবমুখর পরিবেশে পিঠা তৈরিতে সবাই হাত লাগায়। প্রত্যুষে সেই পিঠা দেবতাকে নিবেদন করা হয়। প্রথম দিন বহু মন্দিরের বুদ্ধ মূর্তি বাদ্য সহযোগে আনন্দ মিছিল করে নিয়ে যাওয়া হয় নিকটবর্তী নদীর পানিতে স্নান করানোর জন্য।

পাহাড়ে নববর্ষের সবচাইতে বড় আকর্ষণ সাংগ্রাইং জলক্রীড়ার কথা আগে উল্লিখিত হয়েছে। এছাড়াও থাকে পিঠা তৈরির প্রতিযোগিতা, কুস্তি,তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার প্রতিযোগিতা, ইত্যাদি। সৌহার্দ্য বাড়াতে একে অপরের বাড়িতে যাওয়া,দলবদ্ধ ভাবে পান ভোজনের ব্যবস্থা করাও এই তিন দিনের কার্যক্রমের বিশেষ একটি দিক। চাকমারা বিজু, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বৈসুক,মারমারা সাংগ্রাইং, ম্রো জনগণ চাক্রান নামে এই উৎসবকে অভিহিত করেন। তণ্চঙ্গাদের কাছে বিষু,অসমীয়া সম্প্রদায়ের কাছে বিহু নামে পরিচিতি এই উৎসবের।

নামে কি বা আসে যায়। যে যেই নামেই জানুক এই উৎসব আমাদের লোকজ সংস্কৃতির একটি প্রাণের উৎসব। বাঙ্গালী ক্ষুদ্রতর নৃগোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাই যার যার পছন্দ ও সাধ্য অনুযায়ী উৎসব পালন করবেন এটাই স্বাভাবিক। কারো যদি পছন্দ না হয় তিনি উৎসব পালনে বিরত থাকতেই পারেন। সেটা তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতা। কিন্তু অন্যের উৎযাপনে বাধা সৃষ্টি করার অধিকার কারও নেই।

প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা এই নববর্ষের সাথে সাথে হিজরি সাল;চন্দ্র,সূর্য, নক্ষত্র মন্ডলীর অবস্থান;ফসল তোলা;খাজনা পরিশোধ; ইত্যাদি বিষয়ের সমণ্বয় করে জ্যোতির্বিদ ফতেহউল্লাহ্ সিরাজী ও রাজা টোডরমলের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বাদশাহ আকবর চালু করেন আমাদের বর্তমানে চলিত বাংলা বর্ষপঞ্জি। সেই বর্ষপঞ্জির ১৪৩১ সাল সমাগত।

আসুন আমরা ১৪৩০ কে বিদায় জানিয়ে আবাহন করে নেই ১৪৩১কে। দেশবাসী ও বিশ্ববাসী সকলকে জানাই নববর্ষের শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি সকলের। কামনা করি ক্ষুধা মুক্ত,বণ্চনা মুক্ত, প্রতারণা মুক্ত, ব্যথা মুক্ত ও যুদ্ধ মুক্ত পৃথিবী। কল্যাণ হোক সকলের।সুখী ও সমৃদ্ধ হোন সবাই।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;