শতবর্ষে শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানি
আজও আছে সেই কাঠের সিঁড়ি। থাকে থাকে সাজানো ‘লস্ট জেনারেশন’ থেকে ‘বিট জেনারেশন’-এর বই। লাগোয়া ক্যাফেতে গরম কফির কাপে সাহিত্য সমালোচনার তুফান ওঠে। বইপাগলদের রাত্রিবাসের জন্য জায়গাও রয়েছে। রয়েছে পিয়ানো বাজানোর ঘর। সিঁড়ির প্রতিটি ধাপে নতুন-পুরনো আভিজাত্যের মিশেল। লেখা ‘মনুষ্যত্বের জন্য বাঁচো।’ প্যারিসের মাটিতে পা দিলে কিলোমিটার জিরোতে শতাব্দীপ্রাচীন ‘শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানি’ দেখতে যান না এমন পর্যটক খুবই কম।
এখন অবশ্য আর সামর্থ্য মতো দাম দেওয়ার নিয়ম নেই। বেশ চড়া দামেই বিকোয় বিখ্যাত সাহিত্যিকদের বই। তবে বইয়ের স্তূপে পুরনো গন্ধ হারিয়ে যায়নি আজও। গোধূলির পড়ন্ত আলোতে ইতিহাস চুপি চুপি কথা বলে। পুরনো বইয়ের গন্ধে ম ম করে সিন নদীর ধারে কিলোমিটার জিরো। নটরদাম থেকে মিনিট খানেকের হাঁটা পথে সবুজ-হলুদের সেই আটপৌরে দোকানটা এখনো তার কাঠামোয় খুব একটা বদল আনেনি। অতীতের গন্ধ জড়িয়ে রয়েছে এর প্রতিটা ইট-কাঠ-পাথরে। দোকানের সামনে সাজিয়ে রাখা সারি সারি চেয়ারে আজও আড্ডার আসর বসে, অতীতে ঠিক যেমন সাহিত্য সমালোচনায় মুখর হতেন এজরা পাউন্ড, হেনরি মিলার বা আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। দোকানের হলুদ সাইনবোর্ডে লেখা নামটা আজও চুম্বকের মতো টানে বিশ্বের সাহিত্যপ্রেমীদের—‘শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানি।’
সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতি প্যারিসের আত্মার সঙ্গে মিশে গেছে। প্যারিস মানেই শুধু ল্যুভর, আইফেল টাওয়ার, অপেরা হাউস, বাস্তিল দুর্গ বা নোতর দাম নয়, প্যারিস মানে কোনো অচেনা গলিতে পুরনো দিনের গন্ধ মাখা কোনো রেস্তোরাঁ, আধুনিকতা যার প্রাচীনত্বে আঁচড় কাটতে পারেনি। প্যারিস মানে কিলোমিটার জিরোর এই ‘শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানি’ যার বিবর্ণ রঙ ওঠা সোফাতে বিশ্ববরেণ্য সাহিত্যিকদের হাতের ছোঁয়া লেগে রয়েছে। কাঠের চাপা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলে থাকে থাকে বই পুরনো দিনের কথা মনে করাবেই। আমেরিকান লেখক হেনরি মিলার বলেছিলেন, “এ ওয়ান্ডারল্যান্ড অব বুকস।” একসময়কার শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের বইপাড়ার মতো ‘শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানি’ কবি-সাহিত্যিকদের কাছে শুধু বইয়ের দোকান নয়। তাঁদের সাধনার ক্ষেত্রও বটে।
১৯১৯ সাল। প্যারিসে সাহিত্যচর্চার নতুন দিগন্ত খুলে দিলেন মার্কিন লেখিকা, প্রকাশক সিলভিয়া বিচ। ইংরেজি, ফরাসি ও বিশ্বের নানা প্রান্তের সাহিত্য সম্ভার নিয়ে সিন নদীর ধারে পথ চলা শুরু করল ‘শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানি।’ বই বিক্রি একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। সিলভিয়া চাইলেন সাহিত্যচর্চাকে এক অন্যমাত্রায় নিয়ে যেতে। বইয়ের সঙ্গে কফির দেদার ব্যবস্থা। দোকানের ভিতরে কবি, সাহিত্যিকদের থাকারও বন্দোবস্ত। শোনা যায় একসময় নাকি ৩০ হাজার লেখক-সাহিত্যিক রাতে থেকেছেন এখানে। বইয়ের নির্দিষ্ট দাম নেই। একসময় সিলভিয়ার ‘শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানি’-তে লেখা থাকত ‘পছন্দের বই তুলে নিন, সামর্থ্য মতো মূল্য দিন।’ (Take what you need, give what you can) অর্থাৎ বই পড়াতেই আনন্দ। দাম সেখানে নগন্য।
সিলভিয়ার নাম ছড়াল। ফরাসি সাহিত্যিক শুধু নয়, ইউরোপের নানা প্রান্ত থেকে বইপ্রেমী আর সাহিত্যিকদের ভিড়ে জমজমাট হয়ে উঠল ‘শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানি’।
স্বপ্ন বুনতে শুরু করলেন তরুণ লেখকরা। এজরা পাউন্ড, জেমস জয়েস, হেনরি মিলার, জর্জ অ্যানথেইল, সিনক্লেয়ার লুইসদের আনাগোনা শুরু হলো নিয়ম করে। ১৯২২ সাল। আইরিশ কবি জেমস অগাস্টিন অ্যালওসিয়াস জয়েসের বিখ্যাত ‘ইউলিসিস’ (Ulysses) ছাপতে রাজি হচ্ছিলেন না কেউ। পরবর্তীকালে বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিক জেমস জয়েস তখন পরিচিতির অনেকটাই আড়ালে। সামান্য চাকরি করেন। এগিয়ে এলেন সিলভিয়া। শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানি থেকে ছাপা হলো ‘ইউলিসিস’। খ্যাতির শিখরে উঠলেন জেমস জয়েস। নাম ছড়াল সিলভিয়ার শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানিরও। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের প্রথম বই ‘থ্রি স্টোরিজ অ্যান্ড টেন পোয়েমস’ (Three Stories and Ten Poems) ছাপা হয়েছিল এখান থেকেই।
শোনা যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানরা প্যারিস দখল করলে ‘শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানি’ তার ঝাঁপ ফেলে দিতে বাধ্য হয়। এক জার্মান সেনা অফিসারের চোখ রাঙানিতে দোকান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন সিলভিয়া। সেটা ১৯৪১ সাল। দোকান বন্ধের আগে জেমস জয়েসের বিখ্যাত বই Finnegans Wake ছাপা হয়েছিল এখান থেকেই। মাঝে দশ বছরের দীর্ঘ সময়। প্যারিসের কেন্দ্রবিন্দুতে সাহিত্যিকদের আনাগোনা বন্ধ হয়েছে। জার্মান বাহিনীর আস্ফালনে ঝাঁপ বন্ধ শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানির। পরে মিত্রবাহিনী প্যারিস পুনরুদ্ধার করলে ধীরে ধীরে অবস্থা বদলাতে থাকে। ১৯৫১ সাল। প্যারিস লেফট ব্যাঙ্কে ফের নতুন করে খুলল ‘শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানি।’ হাল ধরলেন আমেরিকার প্রাক্তন এক সেনাকর্তা জর্জ হুইটম্যান। এটিও সিন নদীর ধারে। নোতর দাম থেকে মিনিট খানেকের হাঁটাপথে। অ্যালেন গিনসবার্গ, গ্রেগোরি করসো, উইলিয়াম বরো—বিট জেনারেশনের লেখক-সাহিত্যিকরা ভিড় জমাতে শুরু করলেন। জর্জ এই দোকানের নাম দিয়েছিলেন ‘লে মিস্ত্রাল (Le Mistral)’। ১৯৬৪ সালে সিলভিয়া বিচের মৃত্যুর পরে ফের দোকানের নাম বদলে রাখা হয় ‘শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানি।’
শেক্সপিয়রের ৪০০তম জন্মবার্ষিকীতে সিলভিয়া বিচের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই হারিয়ে যাওয়া সেই ঐতিহ্য আবার ফিরিয়ে আনেন জর্জ। ৯৮ বছর বয়সে মৃত্যু হয়েছিল তাঁর। ২০০৬ সালে ফ্রান্সের সংস্কৃতির অন্যতম সেরা পুরস্কার Officier de l’Ordre des Arts et des Lettres পেয়েছিলেন জর্জ হুইটম্যান। বর্তমানে ‘শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানি’র দায়িত্ব সামলান জর্জের মেয়ে সিলভিয়া হুইটম্যান।