বিদেশের মাটিতে একাত্তরের প্রতিবাদ

  • সালেক খোকন
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের বাল্টিমোর সমুদ্রবন্দরে প্রতিবাদ

যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের বাল্টিমোর সমুদ্রবন্দরে প্রতিবাদ

১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামেও দেশে দেশে এমন কিছু মানুষ ছিলেনযাঁরা নানাভাবে প্রতিবাদ করেছিলেন বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যার। সেই প্রতিবাদ আর উদ্যোগগুলোই ১৯৭১-এ বাংলার শোষিত মানুষের পক্ষে বিশ্ববিবেককে জাগ্রত করতে অনন্য ভূমিকা রেখেছিল।  তেমনি কিছু প্রতিবাদ আর উদ্যোগের কথা জানাচ্ছি আজ।

আমাদের সবচেয়ে বন্ধুপ্রতিম দেশ ভারত।  প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিল তারা। বাংলাদেশের গণহত্যার বিরুদ্ধে এবং শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে সেখানেই হয়েছিল সবচেয়ে বেশি প্রতিবাদ ও ঘেরাও কর্মসূচি। বাংলার মানুষের স্বাধীনতা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে ভারতের জনতা বিভিন্ন সময়ে পথেও নেমেছিল।

বিজ্ঞাপন

২৭ মার্চ ১৯৭১। বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যার প্রতিবাদে কলকাতায় ছাত্ররা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।  বিক্ষোভে তারা প্রকাশ্যে ইয়াহিয়ার কুশপুত্তলিকা দাহ করে।  এছাড়া গণহত্যা শুরুর তিন দিনের মাথায় অর্থাৎ ২৯ মার্চ ১৯৭১ তারিখে দিল্লিতে পাকিস্তান এম্বাসি ঘেরাও করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে সহস্রাধিক ভারতীয় নাগরিক।

 ২৫ জুন ১৯৭১:পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের মার্কিন দূতাবাস ঘেরাও কর্মসূচি 

সেদিন তাদের মুখে উচ্চারিত হয়স্বাধীন বাংলা-জিন্দাবাদবাংলাদেশ-জিন্দাবাদগণহত্যা-বন্ধ করো প্রভৃতি স্লোগান। তারপর এম্বাসির সামনেই এক বিক্ষোভ সমাবেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঘৃণ্য হত্যাযজ্ঞের নিন্দা জানায় তারা। বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিসহ অবিলম্বে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের বাংলার মাটি ত্যাগ করার আহ্বান জানানো হয় ওই সমাবেশ থেকে। সেদিন কণ্ঠ আকাশে তুলে তারা স্লোগান দেয়ইয়াহিয়া খানইয়াহিয়া খানওহাপাস যাও পাকিস্তান।

বিজ্ঞাপন

তখন চীন ও আমেরিকার নীতিগত সমর্থন ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে।  তাই ভারতের মানুষ মোটর শোভাযাত্রা করে দিল্লিতে চীনা এম্বাসিও ঘেরাও করে এবং বাংলাদেশের গণহত্যা বন্ধে চীনা উদ্যোগের আহ্বান জানিয়ে স্মারকলিপি দেয়।  জুন মাসের ২৫ তারিখে পশ্চিম বাংলার বাঙালিরাও বাংলাদেশের পতাকা হাতে নিয়ে আমেরিকান দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ করে এবং স্মারকলিপি প্রদান করে। তাদের হাতে হাতে ছিল ফেস্টুন।  সেখানে লেখা দাবিগুলো ‘Arms aid to Pakistan is abetment of genocide’, ‘Stop The Ship’ প্রভৃতি।  সেদিন তাদের মুখে উচ্চারিত হয়—বাংলাদেশ জিন্দাবাদবাংলাদেশ থেকে আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদ-হাত উঠাওহাত উঠাওখুনিকা হাতিয়া চালা-বান করোবান করো প্রভৃতি। তাদের প্রতিবাদ ও আন্দোলন থেমে থাকেনি। ৬ আগস্ট ১৯৭১ তারিখে বাংলাদেশকে স্বীকৃতির দাবিতে ভারতের জনসংঘ পার্টি বড় ধরনের বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং শেখ মুজিবের মুক্তিরও দাবি জানায়

৬ আগস্ট ১৯৭১ : ভারতের জনসংঘ পার্টির সমাবেশ 

বাংলার মানুষের দুঃখকে নিজেদের মনে ধারণ করে ওই দিন তারা আওয়াজ তোলে—হাম সব-এক হে। একই দাবিতে কলকাতায় ছয়টি শ্রমিক ও বাম সংগঠনের উদ্যোগে ২৯ আগস্ট ২৪ ঘণ্টা হরতালও পালিত হয়। 

সাহসী এক লোকের নাম হার্ব ফিথ। অস্ট্রেলিয়ান। মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি অব আর্টসে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন শিক্ষক ছিলেন তিনি। সময়টা মার্চ ১৯৭১। পাকিস্তানি সেনারা তখন ঢাকায় গণহত্যা চালাচ্ছে। ন্দী করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানকে। ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা সারা দেশে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছে। তারা নির্বিচারে হত্যা করে নিরীহ-নিরপরাধ বাঙালিকে। বিশ্ব গণমাধ্যমে এ খবর প্রচার হতে থাকে গুরুত্বের সঙ্গে।

এবিসির আন্তর্জাতিক ব্রডকাস্টিং সার্ভিস রেডিও অস্ট্রেলিয়া ছিল প্রথম বিদেশি মিডিয়াযেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাসহ গণহত্যার নানা খবর প্রচারিত হতো।  সে খবরগুলো স্পর্শ করে হার্ব ফিথ ও তাঁর বন্ধুদের। ফিথকে প্রধান করে তাঁরা তখন গঠন করেন ভিক্টোরিয়ান কমিটি টু সাপোর্ট বাংলাদেশ নামে একটি কমিটিযার মূল উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা। এ কমিটির সদস্যরা বাংলাদেশে গণহত্যার বিরুদ্ধে বিভিন্ন তথ্য লিফলেটপোস্টার ও সেমিনারের মাধ্যমে প্রচার করেন এবং বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়াতে অস্টেলিয়ান সরকারকে চাপ দিতে থাকেন।

একাত্তরের সেপ্টেম্বর মাসের কথা। ফ্লিন্ডার্স বিশ্ববিদ্যালয়ে Asia’s Flashpoint, 1971 : Bangla Desh’ শিরোনামে একটি বক্তব্য প্রদান করেন হার্ব ফিথ। সেখানে তিনি ২৫ মার্চ রাতের গণহত্যাকে ১৫৭২ সালের সেন্ট বার্থোলেমিড গণহত্যার সঙ্গে তুলনা করে এর নিন্দা জানান। পাশাপাশি পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য ও শোষণ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয় লাভ এবং কেন এই যুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষের জন্য ন্যায় যুদ্ধ তা স্পষ্টভাবে যুক্তি দিয়ে বক্তব্যে বিশদভাবে তুলে ধরেন।

হার্ব ফিথ ছাড়াও একাত্তরে বাংলাদেশের পক্ষে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে জনমত গড়ে তুলেছিলেন একদল অ্যাক্টিভিস্ট।  গণহত্যার প্রতিবাদে তাঁরা মেলবোর্ন থেকে ক্যানবেরায় অস্ট্রেলিয়ান পার্লামেন্ট পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ছয়শো কিলোমিটার দীর্ঘপথ হেঁটে পাড়ি দেওয়ার কর্মসূচি হাতে নেন। এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ডেভিড এলিস। আরো ছিলেন মাইক ক্রেমারডক্টর এলক্স রস প্রমুখ। অসুস্থতাদুর্বলতাসানস্ট্রোক ও পানিশূন্যতার কারণে অনেকে পদযাত্রা শেষ করতে না পারলেও লক্ষ্যে পৌঁছলেন সাতজন। পদযাত্রাটি একাত্তরের ২০ নভেম্বর শুরু হয়ে ৭ ডিসেম্বর ক্যানবেরায় এসে শেষ হয়।  সেখানে ফেডারেল পার্লামেন্টের সামনে তাঁরা এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেন এবং অস্ট্রেলিয়া সরকারকে বাংলাদেশের মানুষের নৈতিক অধিকারের পক্ষে কাজ করার আহ্বান জানান

আমেরিকার অবস্থান বাংলাদেশের বিপক্ষে থাকা সত্ত্বেও একাত্তরের গণহত্যার বিরুদ্ধে অভিনব প্রতিবাদ করেছিল আমেরিকার মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের বাল্টিমোর শহরের মানুষ। বাল্টিমোর সমুদ্রবন্দর থেকে অস্ত্র নিচ্ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধজাহাজ পদ্মা।  ১৪ জুলাই ১৯৭১ তারিখের ঘটনা।  একদল শ্রমিক ও স্থানীয় জনসাধারণ যুদ্ধজাহাজে অস্ত্র তুলতে বাধা দেয়। এছাড়া কোয়ার্কাস নামের একটি দল কতগুলো ডিঙি নৌকা নিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করে পাকিস্তানের কার্গো জাহাজের গতিপথও বন্ধ রাখে।  এ প্রতিবাদের নেতৃত্বে ছিলেন চার্লস খান।  তাঁর সঙ্গে ছিলেন মি. ডিক টেলরস্যালি উইলবিস্টেফানি হলিম্যানচার্লস গুডউইনওয়েইন লাউসার প্রমুখ। সেদিন এ আন্দোলনের কারণে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হলেও বাংলাদেশের গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বন্ধ করা যায়নি।  এর পরই ধর্মঘট ডেকে বসে পোর্ট শ্রমিকরা।  রক্তমাখা টাকা নেব নাএমন স্লোগান দিয়ে তারা পাকিস্তানি জাহাজে মালামাল তোলা থেকে বিরত থাকে।

‘No arms to pakistan’, ‘End all Us Aid to pakistan’ লেখা ফেস্টুন নিয়ে তারা সেদিন ধর্মঘট করে। এ আন্দোলনের খবর ফলাও করে প্রচার করে গণমাধ্যমগুলো। ফলে মার্কিন জনগণ ভিন্নভাবে জেনে যায় বাংলাদেশে সংঘটিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যার কথা।

প্রতিবাদ হয়েছিল পাকিস্তানেও। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন বাংলাদেশের নিরস্ত্র ও নিরপরাধ মানুষের ওপর বর্বর হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছিলতখন পাকিস্তানেও এর বিরুদ্ধে কেউ কেউ প্রতিবাদ করেছিলেন। পঁচিশে মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট নামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশে হত্যার মাধ্যমে যে নিধনযজ্ঞ চালায়পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বেগম নাসিম আখতার ছিলেন তার প্রত্যক্ষদর্শী। এর প্রতিবাদে মার্চের শেষ সপ্তাহে বেগম তাহিরা মাজহার আলীসহ সহযোদ্ধাদের নিয়ে তিনি বিক্ষোভ করেন পাকিস্তানের লাহোরের মল রোডে। ফলে ওই দিনই তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। বাঙালির স্বাধীনতাসংগ্রামের পক্ষে কথা বলায় তাঁর পরিবারকেও পোহাতে হয় নানা বিড়ম্বনা। ১৬ ডিসেম্বর লাহোর কারাগারে বন্দী ছাত্রদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে মিষ্টি বিতরণ করেছিলেন পাকিস্তানের এ নেত্রী।

লন্ডনেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সক্রিয় ছিলেন কিছু মানুষ। ব্রিটিশ তরুণ পল কনেট ছিলেন স্কুলশিক্ষক। তাঁকে ভালোবেসে বিয়ে করেন নিউ জার্সির মেয়ে এলেন। দুজনই লন্ডনভিত্তিক ওয়ার রেজিস্টার্স ইন্টারন্যাশনালের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। একাত্তরে বাংলাদেশে নিরীহ ও নিরপরাধ জনমানুষের ওপর নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও জনমত গড়ে তোলার গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেছিল এই দম্পতি। পাকিস্তানি সেনারা পূর্ব পাকিস্তানের নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরাচ্ছে এমন খবরে বসে থাকতে পরেননি তাঁরা। মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন ও অসহায় বাঙালিদের সাহায্য করতে অপারেশন ওমেগা নামের একটি সংস্থা গড়ে তোলেন।

এছাড়া লন্ডনের ক্যামডেনে ছিল অ্যাকশন বাংলাদেশ নামে তাঁদের একটি কার্যালয়।  ১ আগস্ট ১৯৭১ তারিখে লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে তাঁরা বিশাল এক জনসভার আয়োজন করেন।  যেখানে উত্থাপিত মূল দাবি ছিল বাংলাদেশে গণহত্যায় পাকিস্তানি সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান।  জনসভা শেষে বেশ কিছু ত্রাণসামগ্রীসহ একটি অ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে পলের স্ত্রী এলেন কনেট চলে আসেন ভারতে। অক্টোবরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যশোরের উপকণ্ঠ শিমুলিয়া দিয়ে ঢোকেন বাংলাদেশেকিন্তু পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁকে গ্রেপ্তার করে এবং দুই বছরের কারাদণ্ড দেয়।

ভৌগোলিক সীমারেখায় আবদ্ধ থাকে না কোনো কোনো মানুষ।  কেউ কেউ দেশকালের গণ্ডি ছাড়িয়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষ নিজেদের শামিল করে গণমানুষের কাতারে।  রুখে দাঁড়ায় সব অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধেমানবতার পক্ষে। কখনো গর্জে ওঠে তার কণ্ঠহাতিয়ার কিংবা সে ঝাঁপিয়ে পড়ে জীবন বিপন্ন করেই।  এ কারণেই তারা স্মরণীয় হয়ে থাকে।  গণহত্যার বিরুদ্ধে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে দেশে দেশে যে মানুষগুলো কাজ করেছিলইতিহাসই তাদের বাঁচিয়ে রাখবে।


সালেক খোকন, লেখক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক
আলোকচিত্র সংগ্রহ: লেখক