পুরস্কৃত চিন্ময় গুহ'র 'ঘুমের দরজা ঠেলে'
'ঘুমের দরজা ঠেলে' বইটি পড়ে আক্ষরিক অর্থেই চমকিত হয়েছিলাম, যদিও লেখক চিন্ময় গুহের চিন্তা ও রচনাশৈলীতে আগেই চমৎকৃত ছিলাম 'দেশ'-এ প্রকাশিত লেখার দ্যুতিতে। চটজদলি তার আরেক বই 'চিলেকোঠার উন্মাদিনী' হাতের কাছে পেয়ে সংগ্রহ করতে বিলম্ব করিনি। তার পর পরই আমার টেবিলে চুম্বকের মতো চলে আসে তার বই 'গাঢ় শঙ্খের খোঁজে ও অন্যান্য প্রসঙ্গ'।
ইউটিউবে মনীষী গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের সঙ্গে আলাপচারিতা কিংবা রমাঁ রল্যাঁ প্রসঙ্গে পাবলিক লেকচারে চিন্ময় গুহকে আরও নিবিড়ভাবে পেয়েছি পরিশীলিত যুক্তি, মেধা ও বিশ্লেষণের প্রাখর্যে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, কেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রাক্তন উপাচার্যকে ফরাসি শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় দুই দুইবার (২০১০ ও ২০১৩ সালে) 'নাইট' উপাধিতে ভূষিত করেছে।
বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) তিনি পেলেন 'ঘুমের দরজা ঠেলে' বইটির জন্য ভারতের সম্মানজনক একটি সাহিত্য পুরস্কার। চারটি ভাষায় কুড়িটির বেশি মননশীল গ্রন্থের রচয়িতা অধ্যাপক চিন্ময় গুহ ২০১৯ সালের জন্য যে 'সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার'-এ ভূষিত হলেন, সে পুরস্কার প্রতিবছরই বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি, মণিপুরী, পাঞ্জাবী সহ ভারতের ২৪টি ভাষার সাহিত্যিকদের মধ্য থেকে শ্রেষ্ঠতম জনকে দেওয়া হয়।
বুধবার দুপুরে দিল্লি থেকে ঘোষণা করা হয় সাহিত্য অকাদেমি প্রাপকদের তালিকা। ২০১৬ সালে কলকাতার সিগনেট প্রেস থেকে প্রকাশিত ‘ঘুমের দরজা ঠেলে’ বইটির জন্য বাংলা ভাষা ক্যাটাগরিতে সাহিত্য অকাদেমি পেলেন চিন্ময় গুহ।
'ঘুমের দরজা ঠেলে' বইটিকে বলতে হয় ৬৪টি গদ্যের একটি সংকলন। প্রতিটি গদ্যই শুরু হয়েছে রাত্রির আবহ দিয়ে। ফলে বইয়ের নামকরণও সার্থক। এই বইয়ে তিনি এনেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শেকসপিয়ার, বঙ্কিমচন্দ্র, শেলি, ভলতেয়ার, রমাঁ রল্যাঁ, বোদল্যের, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অন্নদাশঙ্কর রায়, অরুণ মিত্র, সত্যজিৎ রায়, বুদ্ধদেব বসু সহ আরও অনেকের প্রসঙ্গ। বইটিতে তিনি 'দর্শন আর সাহিত্যের সমুদ্রবেলা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে (এমনই) এক জলকল্লোলকে ছুঁতে' চেয়েছেন, 'যা কবিতার মতো গদ্যের শরীরে মিশে গেছে।'
ফলে তার হাতে তৈরি হয়েছে অভূতপূর্ব, অনাস্বাদিত, নিরীক্ষাধর্মী অথবা পরীক্ষামূলক এক সিনটেক্স, যাকে বলা যায় গদ্য হয়েও কবিতার অধিক, চিন্তা হয়েও সৌন্দর্যের প্রতীক। যেমন:
'এক অনন্ত নক্ষত্রবীথির সামনে আমি দাঁড়িয়ে। শূন্যে কালপুরুষের তরবারি। নীচে স্বেদ, রক্ত, শব্দগুঁড়ো, ভাসমান কাগজের স্তূপ। আর পাসকাল-বর্ণিত ভয়াবহ নৈঃশব্দ। আমি নিচু হয়ে হাতড়ে-হাতড়ে চেনা অক্ষর খুঁজি। শব্দের শরীর এত ভাস্কর্যময় তা কি আমি জানতাম? তার নীল দ্যুতি কি আমার করোটি ভেদ করে চলে যাবে? কয়েকটি কাগজে শিশির পড়ছে। সেগুলো হাতে নিয়ে ঘুমের দরজা ঠেলে আমি আবার ফিরে আসি আমার ছোট ঘরের ছায়ান্ধকার নড়বড়ে টেবিলে। জানলা খোলা। শব্দের ফিসফিসানি।'
তারপর পুরো বই জুড়ে ইতিহাস, দর্শন, নন্দন, সাহিত্যের বৈশ্বিক মহারাজপথ ধরে চলা। পাঠককে বিশ্বমননের একটি সংক্ষিপ্ত, অথচ বিশিষ্ট কক্ষপথে পরিভ্রমণ করানোর অন্য নাম হলো চিন্ময় গুহের 'ঘুমের দরজা ঠেলে'। গতানুগতিক বইয়ের বদলে একে ডাকা ভালো বুদ্ধিবৃত্তিক প্রজেক্ট নামে।
প্রবন্ধ চর্চা করে দেশে বা বিদেশে পুরস্কৃত হওয়া সত্যিই দুরূহ। সাহিত্যের জনপ্রিয়তায় ঠাঁই পাওয়াও কষ্টকর। চিন্ময় গুহের কলমে 'দুরূহ' ও 'কষ্টকর' কাজটিই অনায়াসে সাধিত হয়েছে।
তাকে নিয়ে, বিশেষত তার মননশৈলী ও সৃজনসম্ভার বিষয়ে আলাদা করে বিশ্লেষণের প্রয়োজনীয়তা আছে। তাকে অধ্যয়ন ও অনুধ্যানের আলোকে এক সময় তা করাও যাবে, যেমনটি শহীদুল জহির (পাণ্ডুলিপি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়) এবং রিজিয়া রহমান (কালি ও কলম, বেঙ্গল পাবলিশার্স) প্রসঙ্গে করেছি। আপাতত তাকে অভিনন্দন।