হ্যাপি ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে



ফাতেমা আবেদীন
অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

ছেলেটা এক মনে তারাবতি, মরিচাবাতি পুড়িয়ে যাচ্ছে। চোখেমুখে কী নিদারুণ আনন্দ। আমি মুগ্ধ হয়ে একজন সুখী মানুষ দেখছি। কিন্তু এই ভর সন্ধ্যাবেলায় পার্কের এই চুপচাপ কোনাটায় কেন এত আনন্দ নিয়ে একটা ছেলে তারাবাতি পোড়াবে এই ঘটনার কোনো সুরাহা করতে না পেরে বেঞ্চিতে গা এলিয়ে আপনমনে দেখছি।

ছেলেটা লেকের দিকে মুখ করে বাতি পোড়াচ্ছে। আমি এক সাইড থেকে ওর মুখ দেখলাম আবারও। ঝলমল করছে আনন্দে। আমাকে এখনো দেখতে পায়নি। এখানে প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা আমি এসে বসি। দুয়েকঘণ্টা বসে থেকে চলে যাই। এই একলা সময়টুকু আমি প্রতিদিন আত্মহত্যার পরিকল্পনা করি। কিন্তু খুব বেশি সাহস নেই বলে গত আট বছরে আত্মহত্যার মতো কোনো কাজ আমি করে উঠতে পারলাম না। বিষয়টা আসলেই খুব খুব কঠিন। জগতের মোহ ছাড়তে পারি না। আসলে আমি আত্মহত্যা কোনোদিনই করব না। আমি না থাকলে আমার পরিবারের কার কেমন লাগবে। কে কেমন করে কাঁদবে এটুকু ভেবেই আমি সুখ নেই নিজে নিজে। অজান্তে যে কতবার নিজের চোখে জল এসেছে তার ইয়ত্তা নেই আমার লাশের ওপর হাত বুলাতে বুলাতে আমার মা কাঁদছেন। আমার স্ত্রী বারবার মুর্ছা যাচ্ছেন, আমার চার বছরের ছেলে টুবলু ‘বাবা না এলে ভাত খাব না’ বলে জেদ করছে। এইসব ভাবনা প্রতিদিন আমাকে এই জগতের জন্য অপরিহার্য করে তোলে। তাই মরে যাওয়ার সব সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমি খুব সন্তর্পণে রাস্তা পার হই, ইলেক্ট্রিকের তারের দিকে নজর দিই। চোর, ছিনতাইকারী পিছু নিল কিনা সারক্ষণ খেয়াল করতে থাকি। আমি মরলে নিজে মরে যেতে চাই। এইসব অপঘাতে নই। অপঘাতে মরব না বলে যেসব খুঁতখুঁতানি সৃষ্টি হয়েছে তাতে আমার স্ত্রী শীলা ভীষণ বিরক্ত। শীলাকে কে বোঝায় আমি চাইলেই মরে যেতে পারি। শুধু টুবলুর জলভরা চোখ গলার কাছে দলা পাকিয়ে ওঠে। মরে গেলে তো ঐপারে মায়ের শাড়ির গন্ধ পাব না।

এই অসুখে-বিসুখে মরে যেতেও ইচ্ছুক নই আমি। তাই বাড়িতে আমার কঠোর ডায়েট। কোলেস্টেরল হাই হওয়া যাবে না, বিপি বাড়তে দেব না, এমনকি চাষের কই-মাগুর খেয়ে শেষ বয়সে ক্যান্সারও হতে দেব না বলে ধণু ভাঙা পণ করেছি আমি। ফলাফল সংসারে অশান্তি। প্রথম প্রথম শুধু শীলা খুব বিরক্ত হতো। মাঝে একবার বাজার-ঘাট নিয়ে অশান্তি করায় বাপের বাড়ি চলেও গেছিল। ইদানীং মা আর টুবলুও আমার ওপর বেশ চোটপাট করে।
আমার বিধবা মা সারাজীবন খুব অভাব-অনটনে পার করেছেন। পছন্দের খেতে পাননি, পরতে পাননি। ছেলেকে মস্ত ইঞ্জিনিয়ার করে এখন একটু আয়েশ শুরু করেছেন মাত্র। মাঝে মাঝেই টুবলুর সঙ্গে ইন্টারনেট দেখে এটা-সেটা বাইরে থেকে আনিয়ে খান দুজনে। শীলার এতে মহা উৎসাহ। বাইরের ফুচকা, গ্রিল, স্যান্ডউইচ, পিজ্জা পেলে ওরা আমাকে ভুলে যায়। অথচ ওদের ভালো রাখতেই তো এসব খাবার খেতে দিতে চাই না। সব খাবারে মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট আছে। স্বাদের লোভ দেখিয়ে কারিনার জায়গায় মর্জিনা গছিয়ে দেয় এ ওদের কে বোঝাবে।

নিজেকে প্রবোধ দিতেই আমি অফিসের পর কিংবা অফিসের ফাঁকে লেকের এই নির্জন জায়গাটায় এসে বসি। এখানে বসে বসেই ছক করি কিভাবে একদিন কোনো ঝুট ঝামেলা ছাড়া এই পানিতে ডুবে যাব। সচরাচর এখানে কেউ এসে বসে না। আসলেও এই ভর সন্ধ্যায় পাঞ্জাবি পরে বাবু সেজে হাতে তারাবাতি, মরিচাবাতি নিয়ে কেউ আসেই না। তাহলে এ কে? মরিচাবাতিতে আগুন দিতে দিতে ছেলেটা বেশ দরাজগলায় গান ধরল—“আমার মুক্তি আলোয় আলোয়”…

কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে ডাক দিলাম, এই যে ভাই, শুনছেন?
ছেলেটার মুখটা এবার স্পষ্ট দেখতে পেলাম। এমন সুপুরুষ অনেকদিন দেখিনি। আমি হতভম্ভ হয়ে তাকিয়ে আছি। কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। ছেলেটা নিজেই বসা থেকে উঠে হেঁটে পাশে এলো। আমার দাদী বলতেন, রূপের মাইয়া ছিনাল, রূপের বেডা মাইগ্যা। এমন সুপুরুষের খুঁত খোঁজার চেষ্টা করলাম। পাশে বসতেই আগরবাতির গন্ধ টের পেলাম। খুব হালকা কিন্তু স্পষ্ট গন্ধ। আগরবাতি তো কেউ গায়ে মাখে না। তার মানে দীর্ঘক্ষণ আগরবাতির পাশ থেকে উঠে এসেছে। মসজিদে গিয়েছিলেন? জিজ্ঞেস করেই জিভ কাটলাম। মসজিদে কেন আগরবাতি জ্বালাবে। তিনি মিষ্টি করে হেসে জবাব দিলেন, না কবরস্থান থেকে এলাম।

এবার আমার চমকাবার পালা। দুটো কারণে চমকেছি। প্রথমত এই সুপুরুষের কণ্ঠও তার চেহারার মতো বিস্ময়কর সুন্দর। আর কবরস্থান থেকে কেউ ফিরে এত আনন্দিত কাউকে হতে দেখিনি। দীর্ঘদিনের শত্রুর কবর জিয়ারত করে থ্রিলার বইয়ের প্রতিশোধকামী নায়কের মতো হাসি দেখলাম তার মুখে।
আমি জানতে চাইলাম, কে মারা গেছেন?
তিনি বললেন, আমার স্ত্রী
: ওহ, স্যরি।
: আরে আপনি স্যরি বলবেন কেন?
: আসলে আপনজনের মৃত্যুতে কী বলতে হয় আমি জানি না।
: সবকিছু কি জানতে হয়? আর যাই হোক স্যরি হয়তো বলতে হয় না।
: কবে মারা গেছেন? প্রায়ই তার কবরে যান?

তার উত্তরে এবার আমার চমকাবার পালা—
সে জবাব দিল, আজ ভোরে মারা গেছেন। তার মৃত্যু উদযাপন করতেই এই জায়গাটা বেছে নিয়েছি। এই জায়গাটায় কেউ থাকবে না মনে হচ্ছিল। কিন্তু আপনি এসে গেছেন। আমি শরীফ, আপনি?

আমি একটা কাষ্ঠের হাসি দিলাম। এতটাই শুষ্ক হাসি যে তেষ্টা পাচ্ছে। পানি না খেলে যেন মরেই যাব। আমি এখানে প্রতিদিনই আসি, সেটা বললাম তাকে। দিনের একটা সময় আমার কিছু ভালো লাগে না, কাউকে ভালো লাগে না, হয়তো বিষণ্নতার কারণে। তাই কিছুটা সময় একা কাটাতে আমি এখানে আসি।

ছেলেটা এবার হো হো করে হেসে উঠল। তার হাসিতে তাচ্ছিল্যের সুর খুব প্রকট। আমায় পালটা প্রশ্ন করল, এত বিষণ্নতা কেন? বউ মরে গেছে? সংসারে কেউ নেই? কাউকে পাননি? কেউ ঠকিয়েছে? দীর্ঘদিন একটা ভালো সেক্স করা হয় না? টাকা-পয়সার অভাব? কারো জন্য এমন বাজি ধরেছেন যে নিঃস্ব হয়ে গেছেন?

হড়বড় করে এত প্রশ্ন আমাকে কোনো ইন্টারভিউতেও কেউ করেছে কিনা মনে পড়ছে না।

আমি সবেগে মাথা নাড়লাম। এসব কিছুই আমার সঙ্গে ঘটেনি। আমার শুধু মরে যেতে ইচ্ছা করে। কিন্তু সেটা এই অচেনা ভীষণ সুখী তরুণকে বলতে ইচ্ছা করতেছে না। ছেলেটাকে খুব সেলফিশ মনে হলো। তার সঙ্গে আলাপ না করাটাই সমীচীন মনে করেও জানতে চাইলাম, আপনার সঙ্গে ঘটেছে এই ঘটনাগুলো?

ছেলেটা মোবাইল আনলক করে সময় দেখে নিয়ে জানতে চাইল, শুনতে চান কী ঘটেছে? সময় আছে?

আমি মাথা নাড়লাম। পৃথিবীর সবচেয়ে রূপবান একজন পুরুষের জীবনের গল্প মুগ্ধ হয়ে শোনার চেষ্টা করছি। ছেলেটা বলতে শুরু করেছে—

আমার স্ত্রী তৃষাকে আমি ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম। প্রেম করলে যা হয়, মেয়ের বা ছেলের সকল যোগ্যতা থাকার পরেও সে পরিবারে নানা কারণে অচ্ছুত হয়ে ওঠে। তৃষারও তেমনটাই ঘটেছিল। তৃষার তিনকূলে কেউ ছিল না। সে খুব প্রেমিকা মেয়ে ছিল। মফস্বলের একটা সাধারণ অনার্স মেয়ের এত স্মার্টনেস আর এত প্রেম কোথা থেকে এসেছিল জানি না। আমি তখন বিসিএস পাস করেছি মাত্র। নওগাঁয় ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ হয়েছে আমার। মুক্তির মোড়ে আমার অফিস স্টাফরাই আমার জন্য বাসা ঠিক করল। সে কী দুর্বিষহ জীবন। সারাজীবন ঢাকা শহরে মায়ের কোলে বড় হওয়া ছেলে আমি। এমনকি বিসিএসের রিটেন পরীক্ষার সময়গুলোতেও আমার মা আমার হলের সামনে বসে থেকেছেন। আমার বন্ধু-বান্ধব বেশ হাসাহাসি করলেও আমি মায়ের এই কাজগুলোকে কখনোই বাধা দিতাম না। আমার মেঝখালা শুধু বলতেন বড় আপা তুমি তো বুঝবা না এই ছেলেই তোমাকে এমন আঘাত দেবে, এত মা ন্যাওটা ছেলেরাই বড় বড় অন্যায় করে। তুমি মিলিয়ে নিও।

আমিও তাই করেছিলাম তৃষাকে বিয়ে করে। তৃষার আগমণ খালার ভবিষ্যত বাণীকে সত্য করল। আমি তৃষাদের পাশের বাসা ভাড়া নিয়েছিলাম, চাচা-চাচীদের সংসারে আশ্রিত। আমার রান্না-খাবারটা ওদের বাড়ি থেকেই আসত। তৃষার তখন ২১ বছর বয়স। আমার দুর্বিষহ মফস্বল শহরে স্বপ্নের মতো হয়ে এলো সে।

শরীফের মফস্বলের দুর্বিষহ জীবনের কথা শুনে আমার ঢাকা শহরের দুঃসহ প্রতিদিন চাগাড় দিয়ে উঠল। এই শহরে মানুষ থাকে? শীতকালে শীত নেই, কিন্তু ধুলায় ধূসর চারিপাশ। অনেকক্ষণ ধরে মশা পিন পিন করছে কানের কাছে। শরীফের সেসব দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। সে একমনে বলে চলেছে—

সকাল আর রাতের খাবার গুছিয়ে আনত সে। যতক্ষণ না খেয়ে শেষ করতাম ততক্ষণ আমার ঘরে থাকত। আমার বিছানা গোছানো, কাপড় গুছিয়ে রাখার কাজ করত। আমি তখন খেয়ে নিতাম। এই সময়টায় ও অনেক গল্প করত। স্থানীয় একটা ডিগ্রি কলেজে অনার্স পড়ত। রাত-দিন এত কাজ করত, কিন্তু তার চেহারায় কোনো ক্লান্তি দেখিনি আমি, সৌন্দর্যের খামতি নেই। আমার ঘরে যখন ঘুর্ণি তুলে ঘুরে বেড়াত। আমি একদিন জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম, তোমার ভয় লাগে না? ও বিস্ময়ে জানতে চাইল, কিসের ভয়?

একা একটা পুরুষ মানুষের ঘরে তুমি এভাবে আসো সেই ভয় নেই তোমার? ওর উত্তর আমাকে বিস্মিত নয় অভিভূত করেছিল, বলা যায় তখনই প্রেমে পড়েছিলাম ওর।

তৃষা বলেছিল, বড়জোর আমার গায়ে হাত দেবেন, আমাকে ভোগ করবেন। আমার এই দেহ নশ্বর, তেমনটা কেউ করলে আমি গায়ে আগুন লাগিয়ে এই রূপ জ্বালিয়ে দেব। আগুন ছিল মেয়েটির চোখে।

কী ডাকসাইটে মেয়েরে বাবা। বলেই ফেললাম। শরীফ হেসে ফেলল। আমিও হাসতে হাসতে একটা মশা মেরে ফেললাম। এখানে বেশ মশা। কিন্তু এই মশাও এই ছেলেকে থামাতে পারছে না। কথা বলার নেশায় পেয়েছে তাকে—

…ছুটিতে ঢাকায় এসে আমি মাকে তৃষার কথা বললাম। মা কখনো কল্পনাও করতে পারেননি তার কুচুমুচু বেইবি তার অবাধ্য হয়ে কোনো মেয়ের প্রেমে পড়তে পারে। তৃষার ছবি দেখে অনেক খুঁত ধরার চেষ্টা করে তিনি ব্যর্থ হলেন। শেষমেষ বের করতে পারলেন—তৃষা এতিম। বাবা-মা কেউ নেই। আমি শ্বশুড়বাড়ির কোনো আদর পাব না। আমার ছেলে-মেয়ে ভবিষ্যতে নানা-নানীর আদর পাবে না। আর কোনো মানুষের বাবা-মা ছোটবেলায় মারা যায়, যারা অভাগা। আমার মা তো জেনে শুনে তার সৌভাগ্যের বরপুত্র ছেলের জন্য এমন অভাগা মেয়ে আনতে পারেন না। কোনো মানুষের এতিম হওয়াটা যে দোষের হতে পারে সেটা সেদিনই জানলাম। আমি আগেই আপনাকে বললাম আমি ভীষণ মা ন্যাওটা। বাবার কোনো ভূমিকাই নেই আমার জীবনে। আজকের আমি এই মায়ের জন্যই। জেদ চেপে গেল। নিজের অজান্তেই আমার সামনে মা আর তৃষা প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠল। মা আমার সঙ্গে নওগাঁ যাওয়ার জেদ করলেন। আমি মাকে ফেলে একাই ফিরে এলাম। ফিরে এসে তৃষার পরিবারকে জানালাম বিয়ে করতে চাই তাদের মেয়েকে। তৃষার চাচা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। কেবল উচ্ছল তৃষাকেই দেখলাম কেমন একটা মিইয়ে যেতে। মুচমুচে মুড়িতে যেমন দুধ ঢেলে দিলে নেতিয়ে পড়ে, ঠিক তেমন বিষণ্ন হয়ে পড়েছিল তৃষা। আমি ভাবলাম বাবা-মায়ের কথা মনে পড়েছে। তৃষার সেই বিষণ্নতার রহস্য উদ্ধার করি আমাদের বিয়ে তিন বছর পর।

এক সপ্তাহের মধ্যে খুব অনাড়ম্বর আয়োজনে আমার আর তৃষার বিয়েটা হয়ে গেল। বাবা এসেছিলেন আমাদের দোয়া করতে। বিয়ের খবরে আমার মা শয্যা নিলেন। আমি তৃষাকে নিয়ে মাকে দেখতে গেলে মা তাকে ঘরে ঢুকতে দিলেন না। আমার স্ত্রীকে অপমান মানে আমাকে অপমান করা। আমি সে রাতেই ফিরে আসি। সেদিনও মা খুব কাঁদছিলেন। বারবার বলছিলেন অলক্ষ্মী মেয়ে এনেছি এই বাড়িতে। সব ধ্বংস হয়ে যাবে। মায়েদের অভিশাপ বোধ হয় লেগে যায়।

আমি তখন সুখের সমুদ্রে। জীবনে পরিবর্তন বলতে তৃষা আমার ঘরে খাবার নিয়ে এসে রাতে চলে যায় না, আমার চারপাশে আষ্টেপৃষ্ঠে থাকে। দাম্পত্য সম্পর্কে সুখী হতে যা যা লাগে সব কিছু দিয়েই সে আমাকে সুখী করেছিল। উই হ্যাড গুড সেক্স, অ্যাক্সিলেন্ট মেন্টাল অ্যাটাচমেন্ট। এত সুখের মধ্যেও ওর চোখের তীব্র বিষণ্নতা আমার চোখে পড়ত। ওকে জিজ্ঞাসা করলেই বলত মায়ের অভিশাপ ও নিতে পারেনি। ভয় লাগে ওর।

আমার জীবনের আর সব সত্য ঘটনার মতো ভয় সত্য হয়ে এলো। আমরা সেদিন রাতে সিনেমা দেখে ফিরছিলাম। আমাদের বাড়িতে আসার আগে একটা অন্ধকার গলি আছে, সেদিন সন্ধ্যায় কারেন্ট ছিল না। তিনজন লোক আমাদের ওপর হামলা করে। অন্ধকারে একদম বুঝতে পারিনি ওরা কারা। আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। সারাদিন নানান মামলা মোকদ্দমা হ্যান্ডেল করি। তারাই কেউ আক্রমণ করেছে। মফস্বলের লোকেরা ভীষণ প্রতিশোধপরায়ণ বলেই জেনে বড় হয়েছি আমি। ওদের কেউ একজন আমাকে আঘাত করতে চাপাতি নিয়ে আসছিল। সে সময় তৃষা আমার ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফলাফল তৃষার মাথায় তীব্র আঘাত। তৃষা লুটিয়ে পড়তেই ওকে মারলি কেন, ওকে মারলি কেন বলতে বলতে তিনজনের সেই দলটা ছুটে পালিয়ে গেল। তৃষাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে সদর হাসপাতালে ছুটলাম। সেখান থেকে ঢাকায়। অ্যাম্বুলেন্সে করে তৃষাকে নিয়ে ছুটছি। আমার সারা গায়ে রক্ত। কী বিচ্ছিরি হয় রক্তের গন্ধ। জানি না ওকে বাঁচাতে পারবো কিনা। ঢাকা মেডিকেলে পৌঁছে প্রথম মনে হলো মাকে ফোন দিতে হবে। হাসপাতালে ডাক্তারদের জিম্মায় তৃষাকে দিয়ে আমার সঙ্গে আসা সহকর্মীর ফোন থেকে মাকে ফোন দিলাম। আমার বা তৃষার ফোন কোথায় পড়েছে জানা নেই। মা এলেন। খুব শান্ত হয়ে সব ঘটনা শুনলেন। তৃষা তখন আইসিইউতে। ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে আমার সঙ্গে আইসিউতে ঢুকলেন মা। অচেতন তৃষার গায়ে হাত রেখে বললেন, তুমি আমার খোকাকে বাঁচিয়েছো। আমিও তোমায় বাঁচাব।

এটুকু বলেই থামল শরীফ। তার চোখ চিকচিক করছে। চোখে পানি।
আমি কাঁধে হাত রেখে বললাম, প্রকৃতি কী অদ্ভুত মিলিয়ে দেয়, তাই না?
: হ্যাঁ দেয়। তবে জীবিতের সঙ্গে মৃতকে মিলিয়ে দিয়ে কী লাভ হয় আমার জানা নেই।
: আপনার স্ত্রী সেদিন মরে গিয়েছিল? তবে আজ কে মারা গেলেন?
: আজ তৃষা আনুষ্ঠানিকভাবে মারা গেছে, যে মৃত মানুষকে আমি কবরে নামিয়ে দিয়ে আসতে পেরেছি। সেই আঘাতে তৃষার ব্রেন ডেড হয়ে যায়। বেঁচে থাকা মানুষ কিচ্ছু করতে পারবে না, কিচ্ছু শুনবে না, বলবে না, হাত পা নাড়াতে পারবে না। পারার মধ্যে শুধু যদি আমরা খেতে দিই তবে খেতে পারবে, কখনো ভোকাল কাজ করলে শব্দ বের হবে কিছু, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখা ছাড়া তার কোনো কাজ রইল না। সাড়ে তিনমাস তৃষাকে এই হাসপাতাল থেকে সেই হাসপাতালে ছুটে বেড়িয়েছি। ডাক্তাররা জানিয়ে দেন, এভাবেই বেঁচে থাকবে তৃষা।

একটা সময় ভীষণ দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ি। তৃষাকে আমি হাসপাতালে রাখব নাকি বাসায়। মা সিদ্ধান্ত নিলেন তৃষাকে নিয়ে বাসায় ফিরবেন তিনি। তার সন্তানকে রক্ষাকারী এই তরুণীকে তিনি কথা দিয়েছিলেন যে বাঁচাবেন। আমার জীবন ঋণ শোধ করতে মা তৃষাকে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। ফেরার আগে সব ব্যবস্থা তিনিই করেছিলেন। পঙ্গু হাসপাতালের সামনে থেকে হাসপাতালের বিছানা, হুইল চেয়ার কিনলেন তিনি। আমার ঘর একটা হাসপাতাল হয়ে গেল। স্যালাইন স্ট্যান্ড, ক্লিনিক্যাল প্ল্যাম্পার্স, ক্যাথেটার, অষুধের তীব্র গন্ধের সঙ্গে যোগ হলো অ্যান্টিবেডসোর ক্রিম। আমাদের একটু অযত্নে পচে যেতে পারে তৃষার শরীর। মাত্র দেড়মাস সংসার করেছিলাম ওর সঙ্গে। কী নরম মাখনের মতো শরীর, কী আদর কাঙাল একটা মেয়ে ছিল। ওর শরীরের প্রতিটি রোমকূপ চিনে নিয়েছিলাম আমি। আজ আমার সামনে সে একতাল কাদা হয়ে পড়ে আছে। একটা প্রায় মৃতদেহ। কিন্তু কী অদ্ভুত সুন্দর সেই শরীর।

তৃষার দেখাশোনার জন্য মা একজন নার্স ঠিক করেন। নার্স আর মায়ের জিম্মায় তৃষাকে দিয়ে আমি দীর্ঘ চারমাস পর কাজে জয়েন করি। নওগাঁ থেকে আমাকে স্ট্যান্ড রিলিজ দেওয়া হয় নিরাপত্তার খাতিরে। আনুষ্ঠানিকতার খাতিরেই আমার সহকর্মীরা একটা হত্যাচেষ্টা মামলা করে। সেটায় সাক্ষ্য দিয়ে আমি ঢাকায় ফিরে আসি। সন্দেহভাজন কাউকেই পাওয়া যায় না।

সারাদিন কাজ করি, রাতে তৃষার পাশে, বসে শুয়ে গল্প করি। অনেক গল্প। শুধু সে জবাব দেয় না। মাঝে মাঝে অক্সিজেন আর রাইস টিউবের নল খুলে আমি চুমু খাই। কেউ আমায় পালটা চুমু দেয় না। তৃষার নরম পেলব বুকে নাক ডুবিয়ে আমি শুধু বেডসোর ক্রিমের গন্ধ পাই, অষুধের গন্ধ পাই। কখনো কখনো ভীষণ ঘেন্না লাগত। কখনো পাগলের মতো তাকে চাইতাম। মানুষ তো আমি পুরুষ মানুষ।

আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শরীফের কথা শুনছি। কোনো পুরুষের এত সরল স্বীকারোক্তি আমি শুনিনি। একটু করে বাতাস বইছে, বেশ ঠান্ডা লাগতে শুরু করছে। সব উপেক্ষা করে আমি এই ছেলেটার গল্প শুনছি।

তৃষার সঙ্গে সারাদিন কী হলো তার গল্প করা আমার একটা নেশার মতো হয়ে গেল। রাতে ওর সঙ্গে আমিই থাকা শুরু করলাম। নার্সের কাছ থেকে শিখে নিলাম ওকে খাইয়ে দেওয়া, পোশাক পালটে দেওয়া। ওকে পরিচ্ছন্ন করে দেওয়া।

একদিন এক বন্ধু এলো বাসায়। তৃষার কথা একটু আধটু শুনেছে। সামনাসামনি আমার সেবা করা দেখে সেটি ভিডিও করে ফেসবুকে ছেড়ে দেয়। ব্যাস আর যায় কই। আকাশে-বাতাসে আমার আর মায়ের স্তুতি। মৃতপ্রায় একজন মানুষকে আমরা কী অসীম ভালোবাসা দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছি। বড় বড় টিভি চ্যানেল, পত্রিকা থেকে লোক আসতে লাগল আমাদের বাড়িতে। আমার ভালোবাসার গুণকীর্তন হতে লাগলো পত্র-পত্রিকায়। একজন লেখক আমাদের গল্প নিয়ে বই লিখলেন, উৎসর্গ করলেন আমাদেরকে। উৎসর্গপত্রে লিখলেন, ভালোবাসার অমর জুটি তৃষা-শরীফকে।

এভাবে কেটে গেল তিনটা বছর। আমি ভুলেই গেছিলাম আমার মা আমাদের অভিশাপ দিয়েছিলেন। আমি এখন ফেসবুক সেলেব। তৃষার মাথার কাছে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেসবুকে থাকি। ইনবক্সে আসা নানা প্রশ্নের উত্তর দিই। কতজন ভালোবাসার কথা জানতে চায়। সরকারি কেরানি আমি ভালোবাসার বাণী বিলিয়ে যাই। অজানা-অচেনা মানুষের কৌতূহল মেটাতেই নিত্য ইনবক্স, আউটবক্স সব চেক করি।

একদিন আউটবক্সে একটা ম্যাসেজ এলো। ফেইক একটা আইডি থেকে। কোনো পরামর্শ চেয়ে বা ভালোবাসার স্তুতি গেয়ে নয়। চরম সত্য ভালোবাসার গল্পটা জানাতে। সেই ম্যাসেজে লেখা ছিল—“আপনি তৃষাকে এতটা ভালোবাসবেন আমার কল্পনাতেও ছিল না, আমি ক্ষমা চাইতে লিখছি আপনাকে। তৃষা আসলে আমায় ভালোবাসত। আমাদের পালিয়ে বিয়ে করার কথা ছিল। কিন্তু আপনি ম্যাজিট্রেট হওয়ায় সেই সাহস করিনি, একবার তৃষা আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। সেটি তাকে করতে দিইনি। আপনার সঙ্গে বিয়ের পরও আমাদের দেখা হয়েছে, ভালোবাসা হয়েছে। আমরা দুজনে মিলেই ঠিক করি, আপনাকে খুন করে আমরা পালিয়ে যাব। গোপনে সব গুছিয়ে রেখেছিলাম। তৃষা যদি সামনে এসে আপনাকে না বাঁচাত তাহলে সেদিন আপনি মরে যেতেন, তৃষা কেন আপনাকে বাঁচাল জানি না, হয়তো আপনাকে সে ভালোবেসে ফেলেছিল।”

আইপি ট্রেস করে কিছুই ধরতে পারলাম না। পুলিশে বলব নাকি না, সেটি নিয়ে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লাম।

সেদিন রাতে কেন জানি খুব বমি হলো। ঘেন্নায় বমি বুঝলাম, কিন্তু কাকে ঘৃণা করব বুঝতে পারলাম না। ঘরে দরজা আটকে মুখে কাপড় দিয়ে চিৎকার করে কাঁদলাম। আমার এক মন তৃষাকে তীব্র ঘৃণা করতে শুরু করে সেসময়, আরেক মন আমাকে বাঁচিয়ে দেওয়ার কৃতজ্ঞতায় নুইয়ে পড়ে। এই প্রথম আমি মায়ের কাছ থেকে লুকিয়ে গেলাম আমার জীবনের আরো একটি চরম সত্য। যাকে এত এত ভালোবেসেছি, তার এই দ্বিচারণ মা নিতে পারবে না। হয়তো মেরেই ফেলবে তৃষাকে। যত যা-ই হোক শেষ পর্যন্ত সেই তো আমায় বাঁচিয়েছিল।

তবে আমি আর লোক দেখানো বা মন থেকে কোনোভাবেই ভালোবাসতে পারছিলাম না তৃষাকে। কেমন অসহায় লাগতে শুরু করে আমার। সেসময় থেকে তৃষার শরীরও খুব খারাপ হতে শুরু করে। ভালোবাসার অভাবে চারাগাছ মরে যায়, আর সে তো জলজ্যান্ত মানুষ। সারাদিন আগলে রাখা সেই সুন্দর শরীরে ঘা ছড়িয়ে পড়তে লাগল। আজ সকালে সে মারা যায়। সে মারা যাওয়ার পর আমি এতটা নির্ভার হয়েছি, এতটা স্বাধীন হয়েছি যে ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না

শরীফ ছেলেটা কাঁদছে। এত সুপুরুষ মানুষের কান্না খুব কদর্য হয়। খুব বিশ্রি লাগে সে অনুভূতি। তবু আমার প্রশ্ন থেকেই যায়, আপনাকে বাঁচাতেই তো তৃষার এই পরিণতি, তবু এত খুশি হতে পারলেন আপনি?

শরীফ এবার হো হো করে হেসে ওঠে, পালটা প্রশ্ন করে, প্রাপ্তবয়স্ক একটা মানুষের পায়খানার গন্ধ সহ্য করেছেন কখনো? প্রস্রাবের কাপড় বদলে দিয়েছেন, বেড সোর হয়ে যাওয়া পিঠে মলম মালিশ করেছেন কখনো? নাকে দেওয়া রাইস টিউব থেকে ইনফেকশন হয়ে বিচ্ছিরি গন্ধের পুঁজ পরিষ্কার করেছেন কখনো? গলায় ফুটো করে খাদ্য নালীতে নল ঢোকানো সুন্দরী রমণীকে সহ্য করার গল্প শুনেছেন আগে কখনো?

আমার গা গুলিয়ে উঠল!

প্রতিদিন দুই থেকে তিন বা চার বেলা সেই পায়খানা পরিষ্কার করতাম আমি আর আমার মা, মানবসেবা আর ভালোবাসার দৃষ্টান্ত স্থাপনের মোহে। কতদিন ভাতের থালা হাতে নিয়ে ফেলে রেখে উঠে পড়েছি। ভোকাল চলে যাওয়া একজন মানুষের জান্ত্যব গোঙানি শুনেছেন রাতের পর রাত? তখন আল্লারাখার সেতার বাজলেও অসহ্য লাগত। পুরুষ হয়ে শুধু সততার বিমূর্ত প্রতীক হতে আমি কোনো নারীকে স্পর্শ করিনি। আমার কামনা-বাসনাকে বিসর্জন দিয়েছি। আজ আমি সব থেকে মুক্ত। অষুধের গন্ধ থেকে, আমার নকল ভালোবাসার বেড়াজাল থেকে। আজ আমার স্বাধীনতা দিবস।

প্রায় নটা বেজে গেছে। ইদানীং আমার দেরি হলে টুবলুটা ভীষণ কাঁদে। ওর কথা মনে পড়তেই আমার চোখ জ্বালা শুরু হলো, যেন ছেলের শোকে আমি কেঁদেই ফেলব। শরীফ উঠে দাঁড়িয়েছে। তার ফোন বাজছে। রিসিভ করে খুব শান্ত গলায় বলল, হ্যাঁ মা আমি আসছি।

বিদায় নিয়ে একটু এগিয়ে এসে শরীফকে আবার ডাক দিলাম। ‘হ্যাপি ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে’ বলে একটা হাসি দিয়ে এগিয়ে গেলাম, ফের তাকালাম না, মুক্তি পাওয়া পুরুষের হাসি দেখতে আমার ভীষণ হিংসা হবে।

   

গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ধ্রুব এষ



বার্তা২৪ ডেস্ক
শিল্পী ধ্রুব এষ

শিল্পী ধ্রুব এষ

  • Font increase
  • Font Decrease

নান্দনিক প্রচ্ছদ ও অলংকরণশিল্পী হিসেবে দেশে আলাদা অবস্থান তৈরি করেছেন ধ্রুব এষ। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ নিয়ে ঢাকার পান্থপথের হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এই শিল্পী।

হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে বলেন, “তার অবস্থা বর্তমানে স্থিতিশীল।”

জ্বর সঙ্গে তীব্র কাশি নিয়ে বুধবার এ হাসপাতালে আসেন ধ্রুব এষ। পরিস্থিতি দেখে তাকে এইচডিইউতে ভর্তি করে নেওয়া হয়।

লেলিন চৌধুরী বলেন, "শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের কারণে উনার অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে গিয়েছিল। সে কারণে অবস্থা কিছুটা অবনতির দিকে গিয়েছিল। পরে অক্সিজেন সরবারাহ করা হয়, এখন তিনি স্টেবল আছেন। আমরা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছি।"

সুনামগঞ্জের সন্তান ধ্রুব এষের বয়স ৫৭ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলার ছাত্র থাকার সময় বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা শুরু করেন। প্রয়াত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ বইয়ের প্রচ্ছদ ধ্রুব এষেরই আঁকা। তার আঁকা প্রচ্ছদে প্রকাশিত হয়েছে ২৫ হাজারের বেশি বই।

দেশে প্রচ্ছদশিল্পে আধুনিকতা আনার কৃতিত্ব কেউ কেউ ধ্রুব এষকে দেন। আঁকাআঁকির সঙ্গে তিনি লেখালেখিও করেন। শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য ২০২২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান ধ্রুব এষ।

;

তৃতীয় পক্ষ



ওমর শরিফ
অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

 

এ শহরে বাড়ি আর বাড়ি। ছায়া, শান্তি দেবে এমন গাছ কোথায়? গত বারের তুলনায় এবার গরমটা একটু বেশী পড়েছে। দুপুরবেলা তাই খাঁ খাঁ করছে রাস্তাঘাট। প্রায় জনমানব শূন্য চারিদিক। মাঝে মাঝে কিছু রিক্সা, ট্যাক্সি চলছে এদিক সেদিক। ভাগ্যিস দুই রাস্তার মাঝের ডিভাইডারে সারি সারি গাছ আছে। তবু একটু সবুজ দেখা যায়, তা-না হলে কিযে হতো? কথাগুলো ভাবলো মিতু। কলেজ পড়ুয়া তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী মিতু। কলেজে কোন ভাবেই মন বসছিলোনা মিতুর। একটা ঘটনা অস্থির করে রেখেছে তাকে কাল থেকে। তাই মাত্র তিনটা ক্লাস করে বেরিয়েছে ধানমন্ডি লেক যাবে বলে। ধানমন্ডি লেকে অনেক গাছ, অনেক শান্তি। সায়েলা, রবি দু’একবার জিজ্ঞেস করেছে কোথায় যাচ্ছে জানার জন্য। সায়েলা, রবি মিতুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মিতু ওদের মিথ্যে বলেছে।

-বলেছে ‘বড় চাচার বাড়ি যাচ্ছি, চাচা একটু অসুস্থ তাই দেখা করে ওখান থেকেই বাসা চলে যাবো’।     

‘ক্লাস শেষে বন্ধুদের আড্ডা জমে উঠেছিলো খুব তবু ছাড়তে হয়েছে। এই খাঁ খাঁ রোদে কার দায় পড়েছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসার? কল দিলে কল ধরো না, কেটে দাও আবার ব্যাকও করনা! এটা কি ধরনের কথা’? রিক্সার ভাড়া দিতে দিতে বলল মিতু। মিতুর রাগ দেখে সামনে দাঁড়ানো স্বপন মিটমিট হাসছে। ছয় ফিটের মতো লম্বা, ট্রিম করা দাড়ি, মাথার চুল এলোমেলো, একটা হাওয়াই শার্ট সঙ্গে জিন্স পড়া। পায়ে স্যান্ডেলের বদলে স্নিকার পড়েছে আজ। একটু আগোছাল যাকে বলে ‘স্বযত্নে অবহেলা’। স্বপনের এই ব্যাপারটাই দারুণ টানে মিতুকে। ওর মধ্যে কোথায় একটা ব্যাপার আছে। কি নেই, আবার আছে। ঠিক পূর্ণ নয় আবার খালিও নয়। স্বপন মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে। দেশের নামকরা একটা পত্রিকা অফিসে কাজ করে। কথা কম বলে। যা কথা বলে তা ওর গিটার বলে। খুব ভালো গিটার বাজায় স্বপন।      

রিক্সা থেকে নেমে তেড়ে এলো মিতু। ‘কি কানে শোন না। হাসছো আবার, লজ্জা নেই’? রাগে বলল মিতু।

‘আচ্ছা বাবা রাগ পরে হবে। আগে চলো লেকের ভেতরটায় যাই, এখানে অনেক রোদ’। বলল স্বপন। লেকের পার ধরে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে লেকের পাশে থাকা রেস্টুরেন্ট ‘জলসিরি’তে গিয়ে বসলো। রেস্টুরেন্টে লোকজন কম। দাঁড়িয়ে থাকা ওয়েটারকে এসিটা অন করে দিতে বলল স্বপন। মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বলো কি হয়েছে, এতো জরুরি তলব কেন?’

মিতু প্রতিত্তরে বলল, ‘আগে বলো এতক্ষণ ধরে তুমি আমার ফোন ধরছিলে না কেন’? কতোবার ট্রাই করার পর তোমাকে পেয়েছি, তোমার হিসাব আছে? এতো কথার পরও স্বপনকে শান্ত দেখে মিতু আরও খানিকটা রেগে গেলো। বলল, ‘তুমি কি অনুভূতিহীন, তোমার কি জানতে ইচ্ছে করেনা, আমি কেন এতবার ফোন দিয়েছি’?

স্বপন একটু সিরিয়াস হয়ে গলা খাকিয়ে বলল, ‘আসার পর থেকে আমাকে বলার সুযোগ দিয়েছ তুমি? শুধু নিজেই বলে যাচ্ছ’।

এতক্ষণে নিজেকে যেন খুঁজে পেলো মিতু, একটু লজ্জাও পেলো। কিছুটা নমনীয় হয়ে বলল, ‘আচ্ছা বলো কেন ফোন ধরতে এত সময় নিলে’?

স্বপনের সরল উত্তর, ‘খুব জরুরি মিটিং এ ছিলাম তাই তোমার ফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে ফোন ধরতে পারেনি। মিটিং শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছি। তারপর সব কাজ ফেলে এইতো তোমার সামনে আমি’।

মুখের এক্সপ্রেশন দেখে বোঝা গেলো উত্তরে মিতু সন্তুষ্ট হয়েছে। কিন্তু কিসের যেন উদ্বেগ স্পষ্ট। ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়ায়নি স্বপনের।  সে বলল, ‘কি হয়েছে? কোন সমস্যা? আমাকে খুলে বলো’।

মিতু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘স্বপন আমার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে বাসা থেকে। পাত্র পক্ষ জানিয়েছে আমাকে খুব পছন্দ হয়েছে তাদের। আগামীকাল আসবে ডেট ফাইনাল করতে। আমি এখন কি করবো স্বপন? আমাকে বলে দাও’।

স্বপন বলল, ‘বিয়ে করে ফেল। বাবা মা যা চাই তাই করো এতে সবার মঙ্গল’।

মিতু অবাক হয়ে স্বপনের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। বলল, ‘মানে কি? তাহলে এতদিন আমারা কি করলাম। তুমি একটা প্রতারক। তুমি একটা হিপোক্রেট। এখন দায়িত্ব নেয়ার সময় পালাচ্ছো। কাপুরুষ কোথাকার’। তখনও স্বপনের ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখে অবাক হয়ে গেলো মিতু।

স্বপন মিতুর দুহাত টেনে কাছে নিয়ে বলল, ‘এতো দিনেও চিনতে পারলেনা আমাকে। তুমি যা ভাবো আমি তার থেকে অনেক অনেক বেশী ভালোবাসি তোমাকে’। বলে উঠে দাঁড়িয়ে স্বপন বলল,‘চলো’। মিতু বললো,

- ‘চলো’। মিতু বললো,
- ‘কোথায়’?
- চলোই না।
- আগে বলো কোথায়?
- কাজী অফিসে।
- মানে?!
- আমরা আজই এক্ষুনি বিয়ে করছি।
- কি বলো এসব?
- যা বলছি ঠিক বলছি। এছাড়া আমাদের হাতে আর কোন পথ নেই।
- তোমার বাসা?
- আমি ম্যানেজ করবো।
- আমার বাসা?
- ওটা পরে ম্যানেজ হয়ে যাবে।

 

দরজা খুলতেই নাসরিন স্বপনের সঙ্গে একটি মেয়েকে দেখতে পেলো। দুজনেই পা ছুঁয়ে সালাম করতেই নাসরিন অবাক হয়ে পা সরিয়ে নিলো। কিছুটা সংকোচেও। নাসরিন স্বপনের মা। নাসরিন কিছুটা হতভম্ব হয়ে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন। সোফায় বসতে দিলেন। সোফাতে বসে মাকে উদ্দেশ্য করে স্বপন বলল, ‘মা আমরা বিয়ে করে ফেলেছি। তোমাকে  পরিচয় করিয়ে দিই। এ হচ্ছে মিতু। মিতু, ‘ইনি তোমার শাশুড়ি’।

নাসরিন ছেলের দিকে হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, ‘এসব কি বলছিস স্বপন, কাউকে না জানিয়ে এতবড় কাজ তুই কিভাবে করলি? তোর বাবাকে আমি কি উত্তর দিবো। আর চিনি না জানি না একটা মেয়েকে এনে ঘরে তুললি?

স্বপন পাত্তা না দিয়ে উত্তর দিলো, ‘মিতু ভালো ঘরের মেয়ে। বাবা মা শিক্ষিত। সে নিজেও শিক্ষিত অনার্স করছে। দেখতে ভালো, স্বভাব চরিত্রেও ভালো। তোমার সামনেই আছে দেখে নাও’। বলে হাসতে লাগলো।

নাসরিন আর বেশী কথা না বাড়িয়ে মিতুর দিকে তাকালেন। প্রথমিক কিছু কথা বার্তা জিজ্ঞেস করলেন।

বললেন, ‘বিয়েটা কি কোন ভাবে থামানো যাচ্ছিল না বা বাবা মা কে বুঝিয়ে শুনিয়ে অনার্স শেষ করে তারপর বিয়েটা হলে বোধহয় ভালো ছিল’। মিতু মাথা নিচু করে শুধু শুনে যাচ্ছে।

শুধু বলল, ‘আন্টি আমি বাবাকে খুব ভয় পাই আর বাবা সরকারি চাকরি ছাড়া বিয়ে দিবেন না। বললে আরও ঝামেলা বাড়বে’। 

নাসরিন মিতুকে থামিয়ে দিয়ে ঘরে নিয়ে যেতে বললো।

স্বপন দু’জনের উদ্দেশ্যে বললো, ‘অফিসে বিশেষ কাজ আছে, আমাকে একবার এক্ষুনি অফিস যেতে হবে। এর মধ্যে আশা করি তোমাদের চেনা জানা হয়ে যাবে’।

স্বপনের কথা শুনে মা ও মিতু দুজনেই বেশ অবাক হয়ে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকলো।

নিজের রুমে বসে বসে মিতু ল্যাপটপে হানিমুনের ছবি দেখছিল। কাশ্মীর যে কি সুন্দর ভাবাই যায় না। পাহেলগাম, সোনমার্গ, গুলমার্গ জায়গাগুলো ভোলার মতো না। সেবারই জীবনের প্রথম বরফ পড়া দেখেছিলো মিতু। কিছু ছবি দেখেতো মিতু রীতিমত না হেসে পারল না। সে সময় ওরা দুজনেই কেমন বাচ্চা বাচ্চা ছিল। ‘দেখতে দেখতে বিয়ের প্রায় চার বছর হতে চললো’ ভাবল মিতু। একটু কি দীর্ঘশ্বাসের মতো বয়ে গেলো বুকের ভিতরটায়? হানিমুনের ছবি দেখা শেষে পুরনো কিছু ছবিতে চোখ গেলো মিতুর। বাবা মা’র ছবি। বাবা মা পাশাপাশি বসা। বাবার কোলে মিতু। মিতুর বয়স তখন ছয় কি সাত হবে। কি দারুন একটা ছবি। মনের অগোচরেই চোখটা ভিজে এলো মিতুর। এখনও বাবার বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক হয়নি।

মিতুর বাবা মিতুর বিয়ের কথা শুনে বলেছিলেন, ‘মিতু নামে আমার মেয়ে ছিল আমি ভুলে গেছি। বাবার অপমান করতে যে মেয়ের বিন্দুমাত্র বাঁধে না; সে আমার মেয়ে হতে পারে না। মিতুর মুখ আমি দেখতে চায়না’।

মাস্টার্স পাস করে মিতু চাকরির কথা ভাবেনি, যদিও স্বপন ওকে বার বার বলেছে বাসায় একা একা বোর লাগবে, তবুও। মিতুর শাশুড়িও একই কথা বলেছে, কিন্তু মন থেকে সায় দেয়নি মিতু। বাচ্চা পালন করবে আর সংসার সামলাবে এটিই ছিল তার চিন্তা।

মিতুর বাচ্চার খুব শখ কিন্তু স্বপন এখন বাচ্চা নিতে নারাজ। বললেই বলে, ‘আরে বাচ্চার জন্য এতো তাড়া কিসের, অঢেল সময় পড়ে আছে, আগে নিজেদের মতো করে সময় পার করি’।

স্বপন সকাল সকাল বেরিয়ে যায় ফেরার কোন সময় নির্দিষ্ট নেই। কখনও আটটা কখনও দশটা পেরিয়ে যায়। আবার কখনও কাজের এতো চাপ থাকে যে কোন কোন রাতে বাসা ফেরা হয়না। কাজ নিয়ে খুব সিরিয়াস স্বপন। খুব তাড়াতাড়ি কয়েকটা প্রমশনও পেয়েছে সে। এই বছর প্রমোশন নিয়ে গাড়ি কিনেছে ওরা। মিতুর পছন্দতেই কেনা। লাল রঙের গাড়ি। লাল রঙের গাড়ি মিতুর খুব পছন্দ। স্বপনের উন্নতিতে মিতুর গর্বের শেষ ছিলনা। মিতুর কেবলই মনে হতো স্বপনের যত সাফল্য সবই তার নিজের। সে নিজে অনুভব করতো আর আনন্দ নিয়ে সেলেব্রেট করতো। মিতুর বন্ধু বান্ধবী পাড়া পরশি যার সঙ্গেই কথা হোক না কেন, ইনিয়ে বিনিয়ে স্বপনের সাফল্যের কথা বলবেই। সে কথায় কথায় স্বপন যে তার ক্যারিয়ারে খুব ভালো করছে, সে হাসবান্ড হিসেবে খুব কেয়ারিং, পরিবারের ব্যাপারে যত্নবান সেগুলো অন্যকে বলে আত্মতৃপ্তি পায়। সেদিন পাশের বাসার ভাবি বললেন, ‘মিতু ভাবি কি যে করি বলেন তো? আমার হাসবান্ড তো আমার হাতের রান্না একেবারেই খেতে পারেনা। আপনি কিভাবে যে ম্যানেজ করেন’?

মিতু হাসতে হাসতে বলন, ‘আপনার ভাইতো আমার হাতের রান্না ছাড়া খেতেই পারেনা। আসলে এ হচ্ছে ভালোবাসা, বুঝেছেন ভাবি ভালবাসা থাকলে বিষও মধু মনে হয়’।

মিতুর সেদিনের সেই আত্মতৃপ্তি ভোলার মতো না। কথা যখন বলছিলো তখন দু চোখ চকচক করে উঠছিল যেন। 

কিছুক্ষণ ধরে মোবাইলটা বেজে চলেছে। মিতু রান্না করছিলো তাই ধরতে দেরি হলো।

হাত মুছে ফোনটা ধরে বলল, ‘হ্যালো স্লামালেকুন। কে বলছেন’?  

মোবাইল ওপাশ থেকে ভেসে এলো, ‘ভাবি আমাকে চিনতে পারছেন আমি ফারুক বলছি। ঐযে নিউ মার্কেটে দেখা। আপানারা প্লাস্টিকের কিছু জিনিস কিনছিলেন। মনে আছে’?  

মনে পড়ে গেলো মিতুর। সে বলল, ‘ও হ্যাঁ ফারুক ভাই! কেমন আছেন? বাসায় সবায় কেমন আছে? বাচ্চারা কেমন আছে’? সরি ফারুক ভাই আপনার নম্বারটা আমার মোবাইল সেভ ছিল না’।  

ফারুক উত্তরে বলল, ব্যাপার না ভাবি, হতেই পারে। আপনাদের দোয়ায় সবাই ভালো আছে। আলহামদুলিল্লাহ। ভাবি একটা কাজে একটু ফোন করেছিলাম’।

মিতু বলল, কি ব্যাপার বলুন তো?

স্বপন ভাইকে একটু দরকার ছিল। উনি কি বাসায় আছে না কোন কাজে বাইরে গেছেন?

কেন আপনি জানেন না? আপনার স্বপন ভাইতো আপনাদেরই অফিসের ট্যুরে চট্টগ্রাম গেছে।

ফারুক একটু অবাক হয়ে বলল, ‘কি বলেন ভাবি? আমার জানা মতে স্বপন ভাইতো অফিসের ট্যুরে কোথাও যাননি। বরং উনি তো বাসার কাজের কথা বলে দু’দিন ছুটি নিয়েছেন।!

মিতু আর কথা বাড়ায় না। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে, অনুমানে সে তা বুঝেছে। সে কথাটা ঘুরিয়ে ফারুককে বলল, ‘হ্যাঁ স্বপন বলছিলো বাসার কাজের সঙ্গে অফিসের কাজও সেরে আসবে। তাইতো সেদিন আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলো। আমি হয়তো বুঝতে ভুল করেছি’।

ফারুক ওপাশ থেকে বলল, ‘ও আচ্ছা ঠিক আছে ভাবি, স্বপন ভাইয়ের অন্য কোন নম্বার থাকলে দিলে ভালো হয়। জরুরি আলাপ আছে’।

ফারুক ভাই স্বপনের তো একটাই নম্বার। ও তো আর অন্য কোন নম্বার ব্যবহার করেনা। ও কল দিলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলবো’।

কথা বলার সময় যতদূর সম্ভব মাথাটাকে ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করলো মিতু। কথা শেষ করে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লো সে। সে কিছু একটা গড়বড় আছে অনুমান করছে। কিন্তু আবার এও চিন্তা করছে অনুমান নির্ভর কিছু ভেবে বসা ঠিক না। সে মনে মনে চিন্তা করলো, ‘স্বপন এলে কথা বলবে’।

স্বপন দুই দিন পর অফিসের কাজ করে বাসায় ফিরে এলো। এসেই মিতুকে জরিয়ে ধরে চুমু খেল। গভীর আদরে বুকের মধ্যে নিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘আহা কি শান্তি। তোমাকে বুকে নিলে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। এই কি আছে তোমার মধ্যে? তোমাকে বুকে নিলেই আমার কেন এতো শান্তি শান্তি লাগে?

মিতু শুধু হুম হলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। বেশী কথা বাড়ালো না। স্বপন মিতুর এই ব্যবহারে কিছুটা অবাক হল। বলল, কি ব্যাপার শরীর খারাপ নাকি? কিছু হয়েছে? মন খারাপ?

মিতু উত্তরে বলল, ‘রান্না করতে করতে একটু টায়ার্ড হয়ে গেছি মনে হয়। ঠিক হয়ে যাবে। তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি’। বলে মিতু রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। স্বপনও ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকে পড়লো।

মিতুর স্বপনের এরকম ব্যবহার দেখে কিছুটা স্বস্তি বোধ করলো। মন থেকে কালো মেঘ যা এতক্ষণ খেলা করছিলো তা কেটে গেলো। নিজেকে খুব হাল্কা হাল্কা বোধ করছে এখন। দুজনে একসঙ্গে বসে খেল। ডাইনিং টেবিলে স্বপন অনেক গল্প করলো মিতুর সঙ্গে। মনে হল এই দুইদিনে অনেক গল্প জমা ছিল। মিতুকে পেয়ে সব বাধা সরে গিয়ে একসঙ্গে বেরিয়ে আসতে লাগলো সব।

এতো কিছুর পরও মিতু লক্ষ্য করলো, ‘আগে কথায় কথায় স্বপন মিতুর গায়ে হাত দিত। ট্যুর থেকে এলে বেডে অনেক আদর করতো। কিন্তু এবার টায়ার্ড বলে পাশ ফিরে শুয়ে গেলো। মিতুর শরীরটাকে কাছে টেনে পর্যন্ত নিলো না। স্বপনের ব্যবহার মিতুর কাছে কিছুটা আলাদা মনে হল। শুয়ে শুয়ে মিতুর কেবলই মনে হতে লাগলো অফিস থেকে দেরিতে ফেরা, হুটহাট ট্যুরের নামে বাইরে যাওয়া। মোবাইল চ্যাট করা আর মোবাইল বেজে উঠলে খুব সন্তর্পণে অন্য রুমে গিয়ে কথা বলা, কেমন যেন আলগা একটা অনুভূতির সৃষ্টি করলো মিতুর কাছে। মিতু ঠিক বুঝতে পারছে কিছু তো একটা আছে যা মোটেও স্বাভাবিক নয়। কোথায় যেন কি নেই। মিতু মনে মনে ছটপট করে উঠলো। এতদিন তাহলে কেন বুঝতে পারেনি সে? নাকি এ সবই তার ভুল, দুর্বল মনের বিকার মাত্র।

শুক্রবার ছুটির দিন। এই দিনটিতে স্বপন কিছুটা বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। মিতু সকালের রান্না করতে ব্যাস্ত সময় পার করছে। আজ পরোটা, ডিমভাজা আর আলুর দম রান্না হচ্ছে। স্বপনের ফেভারিট। নাস্তা প্রায় রেডি। স্বপনকে উঠাতে ঘরে ঢোকা মাত্র স্বপনের মোবাইল মেসাজের শব্দ কানে ভেসে এলো মিতুর। স্বপন তখনও ঘুমে অচেতন। ‘কোন জরুরি মেসেজ নাকি’? ভাবলো মিতু। মিতু কাছে গিয়ে মোবাইল তুলতেই আরেকটি মেসেজ ভেসে উঠলো। রিয়া নামে কেউ লিখেছে, ‘তোমাকে খুব মিস করছি’। মেসেজ দেখে মিতুর কেমন যেন বাজে অনুভূতি হল। সে সম্পূর্ণ মেসেজ পড়ার জন্য মোবাইল আনলক করতেই একগাদা হার্ট ইমজি ভেসে উঠলো। মিতুর চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠলো। সে ধীরে ধীরে স্ক্রল করতে শুরু করলো। সে যতই পড়ছে ততই অবাক হচ্ছে। স্বপন লিখেছে চট্টগ্রামের ট্যুরটা অতুলনীয় ছিল। রিয়ার উত্তর, ‘না মোটেও না। আমার মতে গুলশান হোটেলে আমাদের সময়টা ছিল বেস্ট। তবে কক্সবাজার ট্যুরটাও বেশ উপভোগ্য ছিল। বেডে যে তুমি কি পাগলের মতো করো না। তোমাকে সামলানোই যায় না। ইউ আর আ রিয়েল ওয়াইল্ড টাইগার। আই লাভ ইউ’।

উত্তরে স্বপন লিখেছে, ‘তোমার কোন তুলনা হয় না। তুমি বেস্ট। আই লাভ ইউ ঠু’।

সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছে যেন। নিজেকে দিশেহারা মনে হচ্ছে। পাগল পাগল লাগছে সব। পড়ছে আর মিতুর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ওদের দুজনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি দেখা যাচ্ছে। এসব দেখে মিতুর কেবলই মনে হচ্ছে কেউ যেন ওর হৃৎপিণ্ডটাকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে দিচ্ছে। বুকের ভেতর প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছে সে। কষ্টে কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না যেন। 

হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে মিতুকে তার মোবাইল হাতে কি যেন করছে দেখতে পেলো স্বপন। এমন সময় উঠে এসে পেছন থেকে মিতুর কাছ থকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বললো, ‘হাউ ডেয়াড় ইউ। তুমি আমার মোবাইলে হাত দিয়েছো কেন? মেসাজ কেন পড়ছো? মানুষের প্রাইভেসি বলে একটা কথা আছে। আনশিভিলাইসড কোথাকার’।

মিতু কিছুই বললোনা শুধু ফ্যালফ্যাল করে স্বপনের দিকে চেয়ে থাকলো। স্বপনের উদ্ধতপূর্ণ কথাবার্তা  নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না সে। এ ধরনের অন্যায় করার পর কোন মানুষ যে এতো নির্বিকার হতে পারে মিতুর চিন্তার বাইরে ছিল। শান্ত থাকতে থাকতে হঠাৎ মিতু চিৎকার করে উঠলো। বলল, চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার? অফিসের ট্যুরের নাম করে বান্ধবী কে নিয়ে ঘুরে বেড়াও। ছি ছি তোমার লজ্জা করেনা?

স্বপন মিতুকে থামাতে এগিয়ে আসতেই মিতু একরকম পাগলের মতো চড়, থাপ্পড় দিতে শুরু করে দিলো। আক্রোশে স্বপনের রাতে পড়া জামাটা একটানে ছিঁড়ে ফেললো মিতু। মুখে বলল কুত্তার বাচ্চা তুই আমার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আমার জীবন নিয়ে খেলেছিস। বাস্টার্ড।

স্বপন মিতুকে থামাতে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। মুখে বলল, ‘আর একটা কথা বললে তোকে এখানেই মেরে ফেলবো। কি প্রমাণ আছে তোর কাছে যে আমি লম্পট। ... উল্টাপাল্টা কথা বললে তোকে আমি খুন করে ফেলবো’।

মিতু তখনও স্বপনের জামার কলার ধরে আছে। বলল, ‘ফারুক ভাই কল করেছিলো উনি বলেছেন তুমি অফিসের ট্যুরে যাওনি। তুমি তোমার লাভারের সঙ্গে হানিমুনে গিয়েছ চট্টগ্রামে। তারও আগে কক্সবাজারে আর গুলশানে একসঙ্গে রাত কাটিয়েছ। সবই পড়েছই আমি। তোমাদের একসঙ্গে ইন্টিমেট সব ছবিও দেখেছি। ছি তোমার ঘেন্না করেনা। চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার?

সব শুনে স্বপন একটা ধাক্কা খেল যেন। একটু বোকা বোকা লাগছে নিজেকে। সে আস্তে আস্তে বিছানায় গিয়ে বসলো। কোন উপায় না পেয়ে মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার ভুল হয়েছে মিতু, আমাকে তুমি ক্ষমা করো। এবারের মতো মাফ করে দাও, প্লিজ’।

অপরাধবোধ আর অনুশোচনায় নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছিলো স্বপনের। ক্ষণিকের আনন্দের জন্য এ কোন ভুল করে বসলো স্বপন। সে চাইলেও নিজেকে আর ক্ষমা করতে পারবেনা।  

এতক্ষণে মিতুও কিছুটা ধাতস্ত হয়ে এসেছে। স্বপনের দিকে তাকিয়ে শুধু জিজ্ঞেস করলো, ‘স্বপন আমার কি দোষ ছিল? আমিতো তোমাকে নিজেকে উজাড় করে চেয়েছি। এতো বড় কষ্ট তুমি আমাকে দিতে পারলে? তুমি আমার পৃথিবী ধ্বংস করে দিয়েছ। আমাকে শেষ করে দিয়েছ। কিভাবে পারলে? এসব জানার আগে আমার মৃত্যু হলনা কেন? স্বপন আমি যে তোমাকে খুব খুব ভালোবেসে ছিলাম। এত বড় প্রতারণা তুমি কেন করলে? আমাকে বললে আমিই তোমার জীবন থেকে চলে যেতাম। তাই বলে এতবড় আঘাত তুমি আমাকে দিতে পারলে’?

 

সময় যেন থেমে গেলো। মিতু আর আগের মতো উচ্ছ্বসিত হয়না। স্বপন বিরাট ভুল করেছে এবং তা সে বারবার স্বীকার করেছে। মিতু স্বপনকে মন থেকে ক্ষমাও করেছে। কিন্তু দিন শেষে যখন মুখোমুখি হয় তখন নিজের মূল্য নিয়ে সংশয় দেখা দেয় মিতুর। বড্ড সস্তা লাগে নিজেকে। পরিপূর্ণভাবে কিছু দিতে না পারার বেদনা নিজেকে কুড়ে কুড়ে খায়। মিতু বুঝতে চেষ্টা করে তাদের মাঝে কি ছিলনা যে স্বপনকে অন্য মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। সম্মানবোধ? মিতুর মতে, ‘স্বপন মিতুকে ভালোবাসতো ঠিক কিন্তু তার মধ্যে গভীরতা ছিলনা, সম্মান ছিলনা। যা ছিল তা প্রাত্যহিক জীবনের অভ্যেস। মাপ করে চুমু দেয়া, বাহির থেকে এসে জড়িয়ে ধরা, সাংসারিক কথা বলা, রুটিন করে মিলিত হওয়া। এর মধ্যে নতুনত্ব কি আছে? যা আছে তা সবই অভ্যেস। মিতু স্বপনকে রিয়ার কাছে কেন যাচ্ছে না জানতে চাইলে বলে, ‘রিয়াকে আমি সেভাবে কখনই দেখিনি। এটা একটা মোহ’।

মিতু বুঝতে পারে রিয়া স্বপনের পাঞ্চ লাইন। অনেকটা সারাদিনের ক্লান্তির পর এক পেগ মদ যেমন তেমন। স্বপনের কাছে ঘরটা থাকলো ঠিকই, মাঝে মাঝে একটু বাম্পার রাইডিং ও থাকলো, যা জীবনে স্পাইস যুক্ত করবে। এই সমীকরণ যা বোঝায় তা হচ্ছে। স্বপনের লয়াল থাকা প্রায় অসম্ভব, মিতুও সেটি বোঝে।

আগে দুজনার অনেক কথা হতো এখন সত্তুর শতাংশ কথা কমে গেছে দুজনার মধ্যে। প্রয়োজন ছাড়া কথা হয় না। একে ওপরের দিকে ঠিক ভাবে তাকাতে পর্যন্ত পারে না। অনুশোচনায় আর অপমানে দুজনেই শুধু হারিয়ে থাকে। দুজনেই অনুভব করে, কোন কিছুই আর আগের মতো নেই। ঘটনা প্রবাহে সব কিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে। স্বপন মিতুকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য যথেষ্ট সাহায্য চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মিতু নিজের সামনে নিজেই দাঁড়াতে পারছেনা। দুপুরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মিতু ভাবছে সে আর কি করলে এমন ঘটনা ঘটতো না? কি করলে স্বপনকে আগলে রাখতে পারতো? বার বার একই উত্তর পেলো। অভ্যেস! টানটা আর আগের মতো নেই।

পরের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে মিতু বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকালের আকাশ দেখছে। আনমনে কি যেন ভাবছে। স্বপন মিতুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, ‘অফিসে যাচ্ছি’ বলে বের হয়ে গেলো। মিতু একবার সকালের নাস্তার কথা জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলো না। বারান্দায় বসে দুই হাতের তালুতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে  কাঁদতে শুরু করলো।

রাতে স্বপন অফিস থেকে ফিরে এসে কলিং বেল দিলো। কিন্তু কেউ দরজা খুলছে না দেখে একটু ভয় পেয়ে গেলো সে। ব্যাগে রাখা এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল স্বপন। রাতে লাইট জ্বালায়নি মিতু। পুরো বাসা চুপচাপ। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো স্বপনের। হঠাৎ ভয় পেয়ে মিতু মিতু বলে ডাকতে শুরু করে দিলো স্বপন। বেডরুমে ঢুকে দেখল মিতু সেখানে নেই। লাইটের সুইচ অন করলো স্বপন। বাথরুম, পাশের রুম, বেলকণি ঘুরে ঘুরে দেখল, কয়েকবার ডাকলো মিতু নাম ধরে কিন্তু কোন সাড়া নেই। বেড রুমে ফিরে এসে বিছানায় বসে পড়লো স্বপন। দুই হাতের তালুতে মুখ লুকাল সে। ভয়ে টেনশনে ঘেমে নেয়ে গেছে একেবারে। হাত থেকে মুখ তুলতেই লক্ষ্য করলো এস্ট্রের নিচে চিঠির মতো কি যেন চাপা দেয়া আছে টেবিলের উপর। স্বপন উঠে এসে দেখল হ্যাঁ মিতুর লেখা চিঠি একটা।

চিঠিতে লেখা,

স্বপন, আমরা পছন্দ করে পরিবারের মতের বাইরে গিয়ে সংসার পেতে ছিলাম। সুখে দুখে আমরা সব সময় এক ছিলাম। পাশাপাশি ছিলাম। ভেবেছিলাম জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমার সঙ্গে পাড়ি দিবো। তা আর হলনা। এই ৮ বছরের সম্পর্কে কোনদিন বুঝিনি তুমি আমার কেউ নও। আজকের পর থেকে শুধুই মনে হচ্ছে তুমি আমার কেউ নও, তুমি আর পাঁচটা মানুষের মতো। তুমি নিশ্চয় জানো একটা সম্পর্ক টিকে থাকে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর সম্মান বোধ থেকে। একটা সম্পর্কের আয়ু বেড়ে যায় একে অপরকে বোঝা পড়ার মাধ্যমে। জানিনা কি পাপ করেছিলাম যে আল্লাহ আমাকে এতো বড় শাস্তি দিলেন। হ্যাঁ, শাস্তিই বটে। সম্পর্কে প্রতারণার কোন জায়গা থাকতে পারে না। আমি জানি আমাকে তুমি ঠিক ভালোবাসতে পারোনি। যা তুমি ভালবাসা বলছো তা আমার প্রতি নিছক ইনফাচুয়েসন। পুরনো অভ্যেস। কেন? সেটির উত্তর তুমিই ভালো দিতে পারবে। তুমি আজ আমাকে যে অসম্মান করেছ তার কোন তুলনা হয় না। আয়নার সামনে কোনদিন দাঁড়াতে পারবো এ বিশ্বাস আমার মরে গেছে। তোমার প্রতি রাগ বা ঘৃণা কোনটিই নেই আমার। তুমি আমার কাছে এখন যে কোন পুরুষ। তবু আমি তোমার ভালো চাইবো। তুমি ভালো থেকো। অনেক ভালো থেকো। নিজের যত্ন নিয়ো। শুধু জেন মিতু নামের একটি মেয়ে তোমাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসেছিল। তোমাকে খুব খুব চেয়েছিলো। তার দাম সে পায়নি বলে চলে যাচ্ছে। আমাকে খুঁজনা।-মিতু

চিঠিটা পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বুকের মাঝে ধরে, ‘মিতু আমাকে মাফ করে দাও, আমাকে ক্ষমা করে দাও’ বলে বিলাপ করতে লাগলো স্বপন। কেমন পাগলের মতো মিতু মিতু বলে ডাকতে লাগলো সে। কিছুক্ষণ পর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবনটাকে অসম্ভব ভারি বলে মনে হতে লাগলো স্বপনের। বিস্তীর্ণ আকাশে জীবনের অসীম অনিশ্চয়তার দিকে তাকিয়ে থাকলো শুধু।      

;

নৃত্য-গীতে জীবন্ত হল রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কালজয়ী আখ্যান



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্ব পরিভ্রমণের সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আর্জেন্টিনায় ল্যাটিন আমেরিকার কালজয়ী সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক ও নারীবাদী লেখক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ঐতিহাসিক সাক্ষাতের শতবর্ষ এ বছর।

১৯২৪ সালে এই দুই কালজয়ী লেখকের সাক্ষাত অক্ষয় হয়ে আছে দু’জনের জীবনস্মৃতিতে, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আদান-প্রদানে আর ভিক্টোরিয়াকে রবীন্দ্রনাথের ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করার মতো বহু ঘটনাবহুল আখ্যানকে ঘিরে। দু’জনের এই মধুর এ আখ্যানকে ঢাকার সাহিত্য ও সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে তুলে ধরলো ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি)।

সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ছায়ানট মিলনায়তনে ‘TAGORE AND VICTORIA OCAMPO-VIJAYA the victorious: 100 years on’ শীর্ষক নৃত্য-গীতে সেই অবিস্মরণীয় আখ্যানকেই ফুটিয়ে তুললেন যুক্তরাজ্য থেকে আগত বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও শিল্পী ডা. অনন্ত গুপ্ত এবং তাঁর সহশিল্পীরা।

বক্তব্য রাখছেন ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসা

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি) এর পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী আয়োজনের পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে অতিথি ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসার লাতিন আমেরিকার জনগণের হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির কথা তুলে ধরে তাকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধন রচনকারী মহান লেখক হিসেবে বর্ণনা করেন। অনুষ্ঠানে আর্জেন্টিনায় অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ রচিত বিভিন্ন কালজয়ী গান নৃত্যসহযোগে পরিবেশন করেন শিল্পীরা। একইসঙ্গে সেইসব গানের প্রেক্ষিত তুলে ধরা হয়।

উল্লেখ্য, ১৯২৪ সালে পেরু সরকারের আমন্ত্রণে দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবর্ষ উদযাপনে যোগ দিতে গিয়ে তেষট্টি বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ সমুদ্রপথে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় তিনি আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেসে থামেন এবং ওঠেন সান ইসিদ্রো শহরের এক হোটেলে। সেখানে কবির ভীষণ অনুরাগী আর্জেন্টিনার বিখ্যাত সাহিত্যিক ও নারীবাদী লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো (যিনি কবির গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদ পড়ে তাঁর কবিতার সঙ্গে কবিরও অনুরাগী হয়ে উঠেন)। রবীন্দ্রনাথের আগমনের খবরে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ছুটে যান কবির কাছে। তিনি কবিকে সুস্থ করার জন্য হোটেল থেকে নদী তীরে বাগানবাড়িতে নিয়ে আসেন।

অনুষ্ঠান মঞ্চে অতিথিদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন আইজিসিসি পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী

এরপর এই দুই লেখকের সম্পর্ক গভীর আত্মিক সম্পর্কে পর্যবসিত হয়। কবি তাঁকে বিজয়া বলে সম্বোধন করতেন। কবির বিভিন্ন গানেও ভিক্টোরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে। তাকে উৎসর্গ করেন কাব্যগ্রন্থ ‘পূরবী’। রবীন্দ্রনাথকে চিত্রকর্মে প্রাণিত করেন ওকাম্পো। ব্যবস্থা করেন প্রদর্শনীরও। দুই কালজয়ী সাহিত্যিকের মাঝে যেসব পত্র বিনিময় হয় তা সাহিত্যের চিরকালীন সম্পদে পরিণত হয়েছে।

;

বর্ষবিদায় - বর্ষবরণ

  ‘এসো হে বৈশাখ’



প্রদীপ কুমার দত্ত
মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

আবারও বছর ঘুরে এসেছে বৈশাখের পয়লা দিন। আমাদের জাতীয় উৎসব নববর্ষ। গত বেশ কয়েক বছর ধরে দেখতে পাই এই উৎসব নিকটবর্তী হলেই মঙ্গল,আনন্দ,আশার প্রতীক দিনটিকে বিতর্কিত করে একে বানচাল করার এক অশুভ প্রচেষ্টা দানা বাঁধানোর উদ্দেশ্যে একশ্রেণির লোক মাঠে নামে। পহেলা বৈশাখ উৎযাপন উপলক্ষে যে উৎসবমুখরতা, তা আমাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়,আমাদের কৃষ্টি সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এই জাতীয় নানা বিষয়ের অবতারণা করে দিনটিকে বিতর্কিত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।

বিতার্কিকদের মধ্যে কেউ কেউ আবার এর মধ্যে ধর্মাচরণকেও টেনে আনেন। গত বছর তো আইনগত ব্যবস্থা নেয়াও শুরু হয়েছিল। সেই প্রচেষ্টা অবশ্য হালে পানি পায় নি। এবারেও দন্ত-নখর বের করা শুরু করেছিল আমাদের বাংলার আদি সংস্কৃতির বিরোধীরা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয় সরকার ক্ষমতায় থাকায় অংকুরেই সেই চেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়ে থেমে গেছে। অবশ্য সরকার উভয়পক্ষকে খুশি রাখার চেষ্টা করে উৎসব পালনের সময়সীমা সংক্ষিপ্ত করে নির্দেশনা জারি করেছেন। এই রকম আপোষ করে সেই কুৎসিত শক্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তোলা হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা সরকারের উপযুক্ত মহলের উচিৎ।

উৎসব পালনের কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। সময়ের সাথে সাথে এবং অঞ্চলভেদে বিভিন্ন অনুষঙ্গ ও ধরন পাল্টায়। সংস্কৃতি ও কৃষ্টি গতিশীল। সমাজে গ্রহণযোগ্য এবং শালীনতার মাত্রা অতিক্রম না করা আনন্দে মেতে ওঠার বিভিন্ন কার্যক্রমের সমষ্টিই উৎসব। আদিকাল থেকেই বৈশাখী মেলা, হালখাতা, চৈত্র সংক্রান্তি, গাজন, নীলপূজা, চড়ক, বিভিন্ন প্রকৃতির লোকজ সংস্কৃতির ও খেলাধুলার আয়োজন,সাধ্যমত নতুন পোষাক ও ভালো খাবারের আয়োজন,অতিথি আপ্যায়ন, ইত্যাদি নিয়ে বাঙ্গালীরা পুরাতন বর্ষ বিদায় ও নববর্ষের আগমনকে একটি উৎসবের রূপ দিয়ে আসছে।

কালক্রমে বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে বাংলা সংস্কৃতির উপর পাক সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন কতৃপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার অংশ হিসাবে ছায়ানট রমনা বটমূলের বর্ষবরণ উৎসব আয়োজন শুরু করে। সেই আয়োজন আজ ডালপালা বিস্তার করে সারা দেশে এমনকি দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিহাস স্বাক্ষী, মৌলবাদের কালো থাবা সেই আয়োজন থামিয়ে দিতে রমনা বটমূলের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে নিরীহ সংস্কৃতি প্রেমীদের হত্যা করেও সফল হয়নি।২০০১ সালের সেই হামলার পর নিরীহ বাঙ্গালী গর্জে উঠে ২০০২ সালে আরও অধিক সংখ্যায় রমনায় হাজির হয়েছে। দেশের শহর ও গ্রামের দিকে দিকে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আরও ব্যপ্তি লাভ করেছে।

ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট বিগত শতাব্দীর আশির দশকে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু করে। এই আনন্দ উৎসব পরবর্তীতে মঙ্গল শোভাযাত্রার রূপ ধারণ করে। এই সফল আয়োজন ইতোমধ্যে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভ করেছে। আনন্দ প্রকাশের এই বহিঃপ্রকাশ নিয়ে এক শ্রেণির লোকের প্রচন্ড গাত্রদাহ রয়েছে।ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে তারা এই শোভাযাত্রা বন্ধ করতে চায়।দেশের প্রাগ্রসর প্রগতিশীল নাগরিকরা এই জাতীয় অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে চায় না। মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান সহ বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের সকল আয়োজন দিন দিন আরও সবল,সতেজ ও পরিশীলিতভাবে অগ্রসর হবেই।

বৈশাখী উৎসবের বিরোধিতাকারী কূপমণ্ডূকদের অনেকের জানাই নেই যে এই উৎসব একই সময়ে দুই একদিন আগে বা পরে বহু জায়গায় বিভিন্ন নামে পালিত হয়। আমাদের নববর্ষ, আসামে বিহু,পাণ্জাবে বৈসাখ,থাইল্যান্ডে সাংক্রান,বার্মায় থিংইয়ান,নেপাল ও সংলগ্ন উত্তর ভারতে বিক্রম সম্ভত,কম্বোডিয়ায় চউল চ্নাম থিমে, সিংহলে আলুথ অনুরুদ্ধা, লাওসে বা পি মেই, কেরালায় ভিষু, তামিলনাড়ুতে পুথান্ডু, এই সব উৎসবই দক্ষিণ /দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রাচীণ কাল থেকে চলে আসা বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ। অনেক এলাকায়,এমনকি আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামেও ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল বা একে অপরের শরীরে পানি ছিটানো এই উৎসবের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। জল শুচি,পবিত্রতা ও শুভ্রতার প্রতীক। পুরনো বছরের ভুল, অসাফল্য, গ্লাণি সব ধুয়ে নতুন বছর আরও উন্নততর জীবনযাত্রায় এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক এই জল ক্রীড়া।

যে সকল অন্ধকারের শক্তি এই বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ উৎসবকে হিন্দুয়ানীর সাথে সম্পর্কিত অনুষ্ঠান বলে প্রচার করেন তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে সনাতনী ধর্মাচার ও সামাজিক আচার কিছু এই সময়ে অবশ্যই থাকে। সেগুলো সবই তাঁরা পালন করেন পণ্জিকা অনুযায়ী। সেই পঞ্জিকার সনাতনী ধর্মের পূজা বা উৎসব সমূহ নির্ধারিত হয় বিক্রম সম্ভত বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চন্দ্র/সূর্য/নক্ষত্র এর অবস্থান সমন্বয় করে বিভিন্ন মাস ২৯,৩০,৩১ এমনকি ৩২ দিনেও হয়।

সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী পহেলা বৈশাখ বেশির ভাগ বছর ১৫ এপ্রিল তারিখে হয়ে থাকে।লিপ ইয়ার সেই বর্ষপণ্জিতে না থাকার কারনে মোটামুটি চার বছরে একবার এটি ১৪ এপ্রিলে হয়। বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের জন্য বহু বছর গবেষণার পর বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে নিজস্ব বর্ষপঞ্জি চালু করেছে। সেই বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে প্রায় বছরই বাংলাদেশের সনাতনী সম্প্রদায় নববর্ষের দিন (১৪ এপ্রিল) তাঁদের সামাজিক/ধর্মীয় চৈত্র সংক্রান্তির পালনীয় ক্রিয়াকর্ম নিজেদের ঘরে পালন করেন।কিন্তু পহেলা বৈশাখের নববর্ষের সকল উৎসব ও কর্মকাণ্ডে আপামর দেশবাসীর সাথে সানন্দে অংশগ্রহণ করে থাকেন। একই কথা তাঁদের অন্য সকল পূজা পার্বণের বেলায়ও খাটে।


আমাদের পার্বত্য এলাকায় এই নববর্ষ পালন হয় জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে। এই অঞ্চলে বহু বাঙ্গালী তো আছেনই। কিন্তু বৃহৎ সংখ্যায় থাকেন ১৪টি বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মানুষ। নৃতাত্ত্বিক,সাংস্কৃতিক,ভাষাগত এবং বিভিন্ন ভাবে তাঁরা সমতলের বাঙ্গালীদের চাইতে তো বটেই, এমনকি একে অপরের চাইতেও আলাদা। এই বিভিন্নতা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এই সৌন্দর্যের নামই বহুল প্রচলিত শব্দবন্ধ ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি বা বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্য।

এখানকার বম,খিয়াং,লুসাই,পাঙ্খোয়া ও খুমিরা বৃহত্তর সংখ্যায় খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী। তাঁদের বড় উৎসব বড়দিন(ক্রিসমাস)।বকি সকলের জন্য তিন দিন ব্যাপী বর্ষবিদায় /বর্ষবরণ উৎসবই বছরের সেরা পার্বণ। এই সময় সব পাহাড় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে উৎযাপনে।যোগ দেন তাঁদের খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী অন্যান্য জাতিসত্ত্বার প্রতিবেশীরা এবং পাহাড়ে থাকা বাঙ্গালীরা। আমোদে অংশ নিতে দেখা যায় সমতল থেকে এই উপলক্ষে ছুটে আসা পর্যটকদেরও।

তাঁদের উৎসব আনন্দ উৎযাপনের মধ্যে অনেক উপাদান। মঙ্গল শোভাযাত্রার আলোকে র‍্যালী হয় সবাইকে নিয়ে।আয়োজনে থাকে প্রশাসন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। হয় বিচিত্রানুষ্ঠান। খাওয়া দাওয়ার আয়োজন সকলে করেন সাধ্যানুযায়ী উঁচুমানের। তার মধ্যে বিশেষ একটি আয়োজন হল বিভিন্ন তরিতরকারির মিশ্রণে পাঁজন বা লাবড়া। কে কত পদের তরকারি/শাক/ওষধি দিয়ে পাঁজন রেঁধেছেন তার চলে অঘোষিত প্রতিযোগিতা। ক্ষেত্র বিশেষে এই সংখ্যা পণ্চাশ ছাড়িয়ে যায় বলে শুনেছি।


উৎসবমালা শুরু হয় দেবতা ও প্রয়াতঃ পূর্বপুরুষদের স্মৃতিতে পাহাড়ি ঝরণা বা নদীতে ফুল ও প্রদীপ ভাসিয়ে। নতুন কাপড় পরিধান নতুন বছরের আগমনকে স্বাগত জানানোর প্রতীক।মন্দিরে চলে মহামতি বুদ্ধদেবের আরাধনা আগত বছরে সকলের মঙ্গল কামনায়। অনেক বড় মন্দিরে বহু লোক সমাগম হয় প্রথম দিন রাতে।সারা রাত উৎসবমুখর পরিবেশে পিঠা তৈরিতে সবাই হাত লাগায়। প্রত্যুষে সেই পিঠা দেবতাকে নিবেদন করা হয়। প্রথম দিন বহু মন্দিরের বুদ্ধ মূর্তি বাদ্য সহযোগে আনন্দ মিছিল করে নিয়ে যাওয়া হয় নিকটবর্তী নদীর পানিতে স্নান করানোর জন্য।

পাহাড়ে নববর্ষের সবচাইতে বড় আকর্ষণ সাংগ্রাইং জলক্রীড়ার কথা আগে উল্লিখিত হয়েছে। এছাড়াও থাকে পিঠা তৈরির প্রতিযোগিতা, কুস্তি,তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার প্রতিযোগিতা, ইত্যাদি। সৌহার্দ্য বাড়াতে একে অপরের বাড়িতে যাওয়া,দলবদ্ধ ভাবে পান ভোজনের ব্যবস্থা করাও এই তিন দিনের কার্যক্রমের বিশেষ একটি দিক। চাকমারা বিজু, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বৈসুক,মারমারা সাংগ্রাইং, ম্রো জনগণ চাক্রান নামে এই উৎসবকে অভিহিত করেন। তণ্চঙ্গাদের কাছে বিষু,অসমীয়া সম্প্রদায়ের কাছে বিহু নামে পরিচিতি এই উৎসবের।

নামে কি বা আসে যায়। যে যেই নামেই জানুক এই উৎসব আমাদের লোকজ সংস্কৃতির একটি প্রাণের উৎসব। বাঙ্গালী ক্ষুদ্রতর নৃগোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাই যার যার পছন্দ ও সাধ্য অনুযায়ী উৎসব পালন করবেন এটাই স্বাভাবিক। কারো যদি পছন্দ না হয় তিনি উৎসব পালনে বিরত থাকতেই পারেন। সেটা তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতা। কিন্তু অন্যের উৎযাপনে বাধা সৃষ্টি করার অধিকার কারও নেই।

প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা এই নববর্ষের সাথে সাথে হিজরি সাল;চন্দ্র,সূর্য, নক্ষত্র মন্ডলীর অবস্থান;ফসল তোলা;খাজনা পরিশোধ; ইত্যাদি বিষয়ের সমণ্বয় করে জ্যোতির্বিদ ফতেহউল্লাহ্ সিরাজী ও রাজা টোডরমলের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বাদশাহ আকবর চালু করেন আমাদের বর্তমানে চলিত বাংলা বর্ষপঞ্জি। সেই বর্ষপঞ্জির ১৪৩১ সাল সমাগত।

আসুন আমরা ১৪৩০ কে বিদায় জানিয়ে আবাহন করে নেই ১৪৩১কে। দেশবাসী ও বিশ্ববাসী সকলকে জানাই নববর্ষের শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি সকলের। কামনা করি ক্ষুধা মুক্ত,বণ্চনা মুক্ত, প্রতারণা মুক্ত, ব্যথা মুক্ত ও যুদ্ধ মুক্ত পৃথিবী। কল্যাণ হোক সকলের।সুখী ও সমৃদ্ধ হোন সবাই।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;