দক্ষিণ এশিয়ার দীর্ঘতম রাজধানী আগ্রা

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

সুরম্য মুঘল নগরী আগ্রা, ছবি: সংগৃহীত

সুরম্য মুঘল নগরী আগ্রা, ছবি: সংগৃহীত

আগ্রার দুর্গ থেকে বের হলাম পড়ন্ত বেলায়। অতীতের উজ্জ্বলতায় ঝলমল আগ্রা শহরের কথায় ইতিহাসের নানা বিষয় মনে পড়ে। যদিও বিশাল ভারতবর্ষের কথা আসলেই চলে আসে দিল্লির নাম, তথাপি দিল্লি নয়, অধিকাংশ সময় আগ্রা ছিল ভারতের রাজধানী।

মধ্যযুগের ভারতবর্ষের রাজধানী হিসাবে যেসব শহরের নাম জানা যায়, তার মধ্যে আগ্রা ছিল সুদীর্ঘকাল। দক্ষিণ এশিয়ার আগ্রা ছাড়া অন্য কোনও শহর এতো অধিক বছর রাজধানীর মর্যাদা পায় নি।

বিজ্ঞাপন

মুসলিমরা ভারত জয় করে রাজধানী গড়েন দিল্লিতে। দিল্লির প্রতিষ্ঠাতা ধরা মুহাম্মদ ঘোরীকে। দিল্লি সালতানাতের শাসনকালেরই এক পর্যায়ে আগ্রায় রাজধানী স্থাপন করা হয়, যেখানে কয়েক শত বছর আগে গজনীর সুলতান মাহমুদ দুর্গ গড়েছিলেন। আগ্রা থেকে উত্তর, মধ্য, পশ্চিম ভারত শাসন ছিল সহজতর। এবং পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতে গমনের পথও ছিল সুগম। ফলে আগ্রা রাজধানী ও কেন্দ্রীয় শহরের মর্যাদা পায় ভারত শাসনকারীদের কাছে।

মুঘলরা বরাবরই ছিলেন আগ্রা কেন্দ্রীক। উপমহাদেশের নানা স্থানে নানা স্থাপনা, দুর্গ, প্রাসাদ নির্মাণ করলেও মুঘলদের মূল আবাস ছিল আগ্রা এবং শাসনের কেন্দ্রবিন্দুও ছিল এই শহর। যদিও আকবর কিছুদিনের জন্য রাজধানী আগ্রার পাশে ফতেহপুর সিক্রিতে স্থানান্তরিত করেন। এবং তারপর বর্তমান ভারতের বাইরে একমাত্র শহর পাকিস্তানের লাহোরে সমগ্র মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী স্থানান্তরিত হয় স্বল্পকালের জন্য। অবশেষে আগ্রা হয়ে দিল্লি হয় ভারতের রাজধানী। রাজধানী বদলালেও মুঘল ক্ষমতা ও স্থাপনার অন্যতম কেন্দ্র ছিল আগ্রা।

বিজ্ঞাপন

কলকাতায় ক্ষমতাসীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে ভারত দখল করে ইংরেজরা রাজধানী বানায় কলকাতায়। তারপর ১৯১৩ সালে আবার ভারতের রাজধানী হয় দিল্লি। এভাবে আগ্রার ক্ষমতা ও শক্তি লোপ পায়। তথাপি আগ্রার চেয়ে সুদীর্ঘ বছর রাজধানী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত থাকার গৌরব ভারত বা সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় অন্য কোনও শহরের নেই।

পেছন ফিরে দেখতে পেলাম, অপসৃয়মান সূর্যের রক্তিমাভায় আগ্রার লালাভ দুর্গ টকটক করছে। ততক্ষণে বৃষ্টি কমে সূর্যের আলো ছড়িয়েছে প্রাসাদ আর উদ্যান ঘেরা নগরী আগ্রার দিগন্তে। পায়ে পায়ে হোটেলের দিকে যেতে যেতে কানে বাজে রণধ্বনি, উৎসব আর হুল্লোড়ের কোলাহল। আগ্রার আশেপাশেই হয়েছে ভারতবর্ষে বিখ্যাত ও ভাগ্যনির্ণায়ক যুদ্ধগুলো। কাছেই মুহাম্মদ ঘোরী আজমিরের শাসক পৃথ্বীরাজ চৌহানকে পরাজিত করে ভারত অধিকার করেন। সন্নিকটের পানিপথে লোদি বংশকে পরাজিত করে বাবুর বসেন ভারতের মসনদে। আকবর এই পানিপথেই হিমুকে হারিয়ে ভারতের ক্ষমতা সুসংহত করেন। আফগান আহমাদ শাহ আবদালি পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে মারাঠা-শিখদের বিতারণ করেন। আগ্রাকে নাভিশূলে রেখেই মধ্যযুগের ভারতের ক্ষমতার পালাবদল আর রাজনৈতিক শক্তির বিন্যাস রচিত হয়েছে।

এতো যুদ্ধ ও দামামার মধ্যেও আগ্রাকে সাজানো হয়েছে সুরম্যভাবে। লোদি গার্ডেন, শাহজাহান গার্ডেন, মাহতাব বাগ ইত্যাদি এখনো অটুট সবুজে-শ্যামলে। আর স্থাপনার তো শেষ নেই! ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্বঐতিহ্যের স্বীকৃতি পাওয়া তাজমহল, ফতেহপুর সিক্রি, আগ্রা দুর্গ ছাড়াও শত শত মসজিদ, প্রাসাদ ছড়িয়ে আছে আগ্রায়।

বিদেশি পর্যটকদের ভ্রমনবৃত্তান্তে আগ্রা লাভ করেছে স্বপ্নের শহরের মর্যাদা। শান-শওকত, আভিজাত্য, সমৃদ্ধিতে আগ্রাতে তুলনা করা হয়েছে ভেনিস, প্যারিসের সঙ্গে। আগ্রার নান্দনিক অবয়ব লোভনীয় হয়ে ধরা দিয়েছিল তৎকালীন পৃথিবীর মানুষের কাছে।

আগ্রা দুর্গের পরিদর্শনের পর প্রাচীন গ্রিক নগর রাষ্ট্রগুলোর কথা মনে পড়ে। কি নেই এই দুর্গে। একটি আস্ত শহর আড়াই-তিন মাইল জায়গা জুড়ে সুপরিকল্পিতভাবে সজ্জিত করার কৃতিত্ব মুঘলদের। আবাস, রাজকার্য, যুদ্ধ, বিনোদন ইত্যাদি সবই হয়েছে এখানে। খেলার মাঠ, মল্লযুদ্ধ, হাতি বা বাঘের লড়াইয়ের ব্যবস্থাও ছিল। শীশ মহল, স্নানাগার, হারেম ও হাভেলিতে মশগুল আগ্রার দুর্গে জীবন যেন প্রবহমান ছিল আরব্য রজনীর মখমল কার্পেটে।

আগ্রা দুর্গের বাইরেও সাধারণদের বসবাসের জায়গায় মিনাবাজার, মসজিদ, প্রমোদালয়, বিশ্রামাগার, সরাইখানার অন্ত ছিল না। এখনো আগ্রার পথে পথে গম্বুজওয়ালা প্রহরী ছাউনির দেখা পাওয়া যায়, যা মুঘল নিরাপত্তা ব্যবস্থার অংশ হয়ে বিরাজমান ছিল।

শুধু ইতিহাস আর ঐতিহ্যই নয়, কিংবা যুদ্ধ আর বিজয়ই নয়, আগ্রার উপর দিয়ে বয়ে গেছে মর্মান্তিক রক্তস্রোত। সিপাহি বিদ্রোহে মুঘল-ভারতীয় পক্ষ পরাজিত হলে দিল্লির মতো আগ্রাতেও বয়ে যায় রক্তের বন্যা। শুধু মুঘল পরিবারের সদস্যই নয়, মুসলিম সম্ভ্রান্ত, অভিজাত ও সৈনিকদের গণহারে হত্যা করা হয়। দিল্লির পতন হলে বিপুল মানুষ এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন আগ্রা দুর্গে। তাদের ধরতে গণহত্যা চালানো হয়।

এখনো আগ্রার পথে-প্রান্তরে, দুর্গের দেয়ালে কালচে রক্তের ছোপ মিশে আছে। নিহতের আহাজারি আর নিগৃহীত রমণীর বিলাপ গুমড়ে কাঁদে আগ্রায়। একটি প্রচলিত উপকথার বিষয়ে লোকমুখে শুনেছি। শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে পরাজিত করে ইংরেজরা বন্দি বানিয়ে পাঠিয়ে দেয় সুদূর বার্মার রেঙ্গুনে। তার পরিবারের অনেককেই হত্যা করা হয় দিল্লিতে। দিল্লির হুমায়ূন মাকবারা বা কবরগাহে আশ্রয় নিয়েছিলেন তারা। সেই স্থানে কাতার বন্দি করে শত শত মুঘল পরিবারের সদস্যকে হত্যা করে ইংরেজ সেনাপতি। আগ্রায় যারা লুকিয়ে এসেছিলেন, তাদেরকেও দুর্গের ভেতরে চিরুনি তল্লাশি করে খুঁজে বের করে মারা হয়। আজও নাকি সেসব নিহত আত্মা প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে আগ্রা দুর্গে ফিরে আসে। অনেকেই দুর্গের অভ্যন্তরে, খিলান ও স্তম্ভের পাশে নারী ও শিশুদের কান্না শুনতে পান!

এইসব কাহিনীর সত্যাসত্য যাচাই করা দুরূহ। কিন্তু যে বীভৎসতা এ নগরের উপর দিয়ে বয়ে গেছে, তাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। সাজানো-সুন্দর শহরকে ছারখার শ্মশানে পরিণত করার কষ্ট শুধু মানবতার কষ্ট নয়, সভ্যতার জন্যও বেদনার। আগ্রা এখনও বেঁচে আছে মৃত্যু ও বেদনা নিয়ে। সঙ্গে আছে সভ্যতার এমন বহু চিহ্ন, যা ধ্বংস ও আক্রমণের কবল থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে মুঘল সভ্যতার জয়গান গাইছে।

আবার ফিরে যাবো জয়পুরে, সেখান থেকে দিল্লি। ভ্রমণ পরিকল্পনায় ভুল করায় এখান থেকে সহজে দিল্লি যাওয়ার বদলে আবার জয়পুর হয়ে দিল্লি যেতে হচ্ছে। ফেরার পথে গাড়িতে একে একে চোখের সামনে থেকে সরে যাচ্ছিল তাজমহল, অসংখ্য বাগিচা, স্থাপনা, আগ্রা দুর্গের মজবুত দেয়াল, ফতেহপুর সিক্রির আবছা কাঠামো। ভাবছি, ধ্বংস করলেই সব শেষ হয় না। হত্যা করলেও সবকিছুর অবসান ঘটানো যায় না। সাম্রাজ্যবাদী-উপনিবেশিক শাসনের কবলে নিষ্পেষিত হয়েও শত বছরের মুঘল ঐতিহ্য ঠিকই মাথা উঁচিয়ে আছে। সমগ্র বিশ্বে সভ্যতার অংশ হিসাবে ভারতবর্ষ তথা পুরো উপমহাদেশের গৌরব বৃদ্ধি করছে। আর প্রতিনিয়ত শাসক ও শোষকদের দিচ্ছে ইতিহাসের শিক্ষা।

কিন্তু ইতিহাসের শিক্ষণীয় বিষয়ের মধ্যে এই নির্মম সত্যটিও প্রকট হয়ে আছে যে, ইতিহাস শিক্ষা দিলেও ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। তবু ইতিহাস শিক্ষা দিয়েই যাচ্ছে। একদার মুঘল রাজধানী সুমর‌্য আগ্রা নগরী ধ্বংসের করাল গ্রাস থেকে নিজেকে রক্ষা করে তেমনই এক ইতিহাসের শিক্ষালয় হয়ে আছে। জীবন্ত ইতিহাস বইয়ের মতোই আগ্রা ঐতিহাসিক শিক্ষা বিতরণ করছে আজ এবং আগামীর পৃথিবীকে।

আরও পড়ুন: আগ্রা দুর্গে ইতিহাসের প্রতিধ্বনি