মহাকবি কালিদাস: কিংবদন্তি এবং ইতিহাস
-
-
|

ভারতীয় ভাষায় চর্চিত সাহিত্য তাকে পূর্বপুরুষ গণ্য করে
চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতকের মাঝামাঝিতে সংস্কৃত-সাহিত্যের জনৈক ব্যক্তি পরবর্তী ভারতীয় ভাষাগুলোকে প্রভাবিত করেছে। পরম যত্নে গ্রন্থিত পঙক্তিগুলো অনুরিত করেছে বাংলা সাহিত্যের মাইকেল বা রবীন্দ্রনাথের মতো বাঘা বাঘা কবিকেও। নাম তার কালিদাস। বলা হয় গুপ্ত সাম্রাজ্যের যুগে মহারাজ বিক্রমাদিত্যের দরবারে সভাকবি ছিলেন তিনি। যদিও তার সময়কাল এবং জন্মস্থান নিয়ে মতবিরোধের কমতি নেই।
কবি হয়ে ওঠা
পিতৃমাতৃহীন অনাথ কালিদাস লালিত পালিত হয়েছেন গরুর রাখালদের কাছে। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া বলতে যা বোঝায়, তা হয়ে ওঠেনি। তবে ভাগ্যচক্রে তার বিয়ে হয় বিদুষী এক রাজকন্যার সাথে। প্রথম দিকে ছিলেন স্বাভাবিকের তুলনায় নির্বোধ। এজন্য রীতিমত খেতে হতো বউয়ের বকা। নির্বুদ্ধিতা নিয়ে গ্রাম বাংলায় এখনো সেই গল্পটা প্রচলিত আছে—
একদা কালিদাস গাছের ডাল কাটছিলেন। কিন্তু ঠিক যে ডালে বসেছেন; সেই ডালটাতেই কোপ বসাচ্ছেন। জনৈক ব্যক্তি তাকে সাবধান করে দিল। কিন্তু ততক্ষণে কালিদাস চিৎপটাং। নিজের কাটা ডাল কেটেই পড়ে গেছেন মাটিতে:
এইরকম নির্বোধ কালিদাসেরই জ্ঞানী কালিদাস হয়ে ওঠার পেছনে আছে আরেক কিংবদন্তি। নিজের নির্বুদ্ধিতার কারণে অপমান, দুঃখ ও অভিমানে নদীতে ঝাপ দেন কালিদাস আত্মহত্যার জন্য। কিন্তু দেবী কালি তাকে সেখান থেকে কেবল উদ্ধার করেই আনলেন না; আশির্বাদ দিলেন বুদ্ধিমান ও মেধাবী হবার। সেই থেকেই কালিদাসের যাত্রা শুরু।
অভিজ্ঞান শকুন্তলম এবং মেঘদূতম
কালিদাসের সবচেয়ে সমাদৃত দুটি লেখা ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ এবং ‘মেঘদূতম’। অভিজ্ঞান শকুন্তলমের প্রশংসা করেছেন জার্মান পণ্ডিত ও কবি ভন গ্যেটে। বনের শান্ত পরিবেশে এক মহর্ষির আশ্রমে পালিত হতে থাকে শকুন্তলা। বস্তুত সে ঋষি বিশ্বামিত্র এবং অপ্সরা মেনকার সন্তান। হস্তিনাপুরের রাজা দুষ্মন্ত হরিণ শিকারে বের হয়ে পথ চলতে চলতে মহর্ষির আশ্রমের কাছে চলে আসেন। হাস্যরত শকুন্তলাকে দেখে তার সঞ্চিত ভালোবাসা উপচে ওঠে। ঘটনার পরিক্রমায় দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার বিয়ে হয়। তাদের কোলে জন্ম নেয় মহাবীর ভরত। সবশেষে তিনজনে পুষ্পরথে করে স্বর্গরাজ্যে যাওয়ার ঘটনাবলি নিয়ে ফ্রেমবন্দী অভিজ্ঞান শকুন্তলম। বইটি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। বাংলার প্রাথমিক টোল ও পাঠশালাগুলোতে সংস্কৃত ভাষার বিষয় হিসেবে কালিদাসের রচনাগুলো অগ্রগণ্য ছিল।
শকুন্তলা ও দুষ্মন্তের সাথে সম্পর্কই প্রধান উপজীব্যে পরিণত হয়েছে
কালিদাসের কবি প্রতিভার চরমতম প্রকাশ ঘটেছে ‘মেঘদূতম’ নামক কাব্যে। হাল আমলে একে বর্ষাকাব্য বা গীতিকাব্য বলে তকমা দেওয়া হয়। সেই সময়ে বর্ষা ছিল মূলত বাধ্যতামূলক অবসর যাপন। যুদ্ধ বা বাণিজ্য কোনোটাই সম্ভব না বলে মানুষ বর্ষা আরম্ভের আগেই ঘরে ফিরে আসত। সেই জন্য বর্ষা ও বিরহ ভারতবর্ষের সাহিত্যের অন্যতম প্রধান বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। রামায়ণের কিষ্কিন্ধাকাণ্ড, জয়দেবের গীতগোবিন্দ থেকে আধুনিক সময়ের গান এবং কবিতাগুলোর পেছনে বর্ষা এক গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক।
মেঘদূত রচিত হয়েছে মন্দাক্রান্তা ছন্দে। পরিশুদ্ধ বিরহকে অবলম্বন করে সংস্কৃত-সাহিত্যের প্রথম ও পূর্ণাঙ্গ কাব্য মেঘদূত। মূল উপজীব্য নির্বাসিত এক যক্ষের প্রিয়াবিরহ। কাহিনী সরল অথচ কাব্যগুণ সমন্বিত। কর্তব্যে অবহেলার কারণে প্রভুর অভিশাপে যক্ষকে রামগিরি পর্বতের বিজন আশ্রমে নির্বাসনে দেওয়া হয়। সেখানে বসে আষাঢ়ের প্রথম দিবসে নববর্ষার মেঘ দেখে তারই মাধ্যমে অলকাপুরীর প্রাসাদে তার বিরহী প্রিয়ার উদ্দেশ্যে বার্তা প্রেরণ করার মনস্থির করে সে।
“তৈলশূন্য কুন্তল জালে আয়ত লোচন পড়েছে ঢাকা,
অজ্ঞনহীন নয়ন প্রান্তে কটাক্ষবান নাহিক আঁকা;
মদির-অলস ভ্রু-বিলাস ভুলে মৃগাক্ষী মোর তোমার প্রাণে
তুল আঁখি দুটি চাহিবে যখন, স্পন্দন ঘন জাগিবে প্রাণে
হয়তো ফুটিবে নয়নে তখন চাহিন চপল কৌতূহলে
যেন চঞ্চল মীনদল ক্ষোভে আহত কমল কাঁপিছে জলে।”
বিরহের আতিশয্যে যক্ষ জড় ও জীব পৃথক করতে পারে না। মেঘকে জানাতে থাকে নিজের আবদার। তাকে পৌঁছাতে হবে নদী, বন, পর্বত পেরিয়ে অলকায়। বস্তুত প্রাচীন ভারতের ভৌগোলিক বিবরণ ও পরিবেশ দারুণভাবে চিত্রিত হয়েছে এ কাব্যে।
বিরহী প্রেমিক খবর পাঠিয়ে দিচ্ছেন মেঘের কাছে
অন্যান্য রচনা
কালিদাসের খ্যাতির বড় অংশ জুড়ে আছে তার ধাঁধা। যদিও ধাঁধার জন্য কালিদাসকে আলাদা সময় ব্যয় করতে হতো না। চলতে, উঠতে, বসতে তিনি ধাঁধা বেঁধে ফেলতে পারতেন। উপরন্তু কালিদাস ছিলেন নাট্যকার, মহাকাব্য রচয়িতা এবং কবি। ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’, ‘বিক্রমোর্বশীয়ম’ এবং ‘মালবিকাগ্নিমিত্রম নাটক; ‘রঘুবংশম’ ও ‘কুমারসম্ভব’ মহাকাব্য এবং ‘মেঘদূতম’, ঋতুসংহার গীতিকাব্য হিসাবে অতুলনীয়। সংস্কৃত ভাষাকে তিনি অনন্য উচ্চতায় উড্ডীন করেছেন। সাহিত্যে ব্যবহার করেছেন ৩০টির মতো স্বতন্ত্র গ্রন্থ। অসাধারণ প্রতিভার জন্য তাকে ঠাঁই দেওয়া হয় ভার্জিল, হোমার প্রভৃতির পাশে।
বিশ ও একুশ শতকে এসেও কালিদাস প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। অভিজ্ঞান শকুন্তলম অবলম্বনে ১৯৩০ সালে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র ‘স্ত্রী’। ১৯৬৬ সালে সামনে আসে তামিল সিনেমা মহাকবি কালিদাস। ১৯৬০ সালে হয়েছে তেলেগু সিনেমা। যার মাধ্যমে ধ্রুপদী সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য বীণার মতো অনুরণিত হয়; তার নাম কালিদাস। তার সমকক্ষ কবি কেবল তার যুগেই নয়; পরবর্তী ভারতীয় ভাষাগুলোতেও বিরল।