জেমস জয়েসের ইউলিসিস: পৌরাণিক আখ্যান থেকে মানবিক উপাখ্যান
জেমস জয়েস ও তার জগদ্বিখ্যাত উপন্যাস ‘ইউলিসিস’-এর নাম জানেন না, এমন শিক্ষিত লোক বিশ্বে বিরল। কিন্তু ১৯১৪ সালে পৃথিবীর কেউই তাকে চিনতেন না। সে বছর ২২ বার নাকচ হওয়া জয়েসের ছোটগল্পের একটি বই ছাপাতে রাজি হন লন্ডনের এক প্রকাশক। তারপর ক্রমশ তিনি চলে আসেন পাদপ্রদীপের আলোয়। পরিচিত হন বিংশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে।
১৩ জানুয়ারি, ১৯৪১ সালে পরলোকে পাড়ি দেওয়া এই লেখক ২ ফেব্রুয়ারি ১৮৮২ সালে জন্ম নেন আয়ারল্যান্ডের রাজধানী ডাবলিন শহরে। জেমস অগাস্টিন অ্যালওসিয়াস জয়েস নামের আইরিশ লোকটিই ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব, মার্কিন কবি এজরা পাউন্ড যার আরেক বিখ্যাত উপন্যাস ‘A Portrait of the Artist’এর সম্পাদনার কাজ করেন।
‘ইউলিসিস’ উপন্যাস জয়েসকে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে পরিচিত করে। হোমারের মহাকাব্য ‘ওডিসি’র সমান্তরালে উপন্যাসটি তিনি বিশাল কলেবরে রচনা করেন। তার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রচনা হলো ‘ডাবলিনারস’, ‘ফিনেগ্যানস ওয়েক’।
জেমস জয়েস ইউলেসিসের (Ulysses) নামকরণ করেছেন একটি বিখ্যাত গ্রিক বীরত্বগাঁথা থেকে। ইউলেসিসে বর্ণনা করা হয়েছে এক মহান গ্রিক বীরের। যিনি ট্রয় যুদ্ধ জয় শেষে তার নিজ দেশ ইথাকায় ফিরে যাচ্ছেন। উপাখ্যানটি সে ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে আবর্তিত।
মহাকাব্যিক আখ্যান থেকে বের হয়ে এসে ‘ইউলিসিস’-এ জেমস জয়েস নিয়ে আসেন এক আলাদা আবহ ও মাত্রা। তার ‘ইউলিসিস’-এর নায়ক কোনো মহান সম্রাট অথবা কোনো বীর নন, এক অতি সাধারণ, সাদামাটা, দয়ালু, বোকা মানুষ, নাম লিওপারড ব্লুম। খুব ছোটোখাটো একটা চাকরি করা ব্লুমের চরিত্রে সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটির কোনো শেষ নেই। ভাগ্যও তার সঙ্গে বীরের মতো আচরণ করেনি। করেছে দারুণ অসহযোগিতা।
জেমস জয়েস দেখান, তার কাহিনীর নায়ক চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়, তার স্ত্রী অন্যের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। ক্যাথলিক সমাজে ইহুদি ব্লুম উপেক্ষার পাত্র হতে থাকে। কেউই তার দিকে ভালো নজরে তাকায় না পর্যন্ত। তারপরও লিওপারড হেরে যায় না। সে স্বপ্ন দেখে। সে কল্পনা করে একটি সুন্দর, হাসিখুশি জীবনের। লড়াকু মানুষের আশাবাদী স্বপ্ন ও ইতিবাচক কল্পনাই জেমস জয়েসের ‘ইউলিসিস’-এর মূল উপজীব্য।
নায়কোচিত কোনো গুণ না থাকা সত্ত্বেও জয়েস এই রকম ব্যক্তিত্বের দিকে ‘সমাজের দৃষ্টি’ নিয়ে আলোকপাত করেছেন। জয়েস দেখিয়েছেন, ব্লুমের অধিকার রয়েছে সমাজ থেকে যোগ্য সম্মান পাবার। অবশ্যই তাকে নিয়েও সমাজের ততটা আগ্রহ থাকা উচিত যতটা আগ্রহ থাকে মানুষের গ্রিক বীর ইউলিসিসের গল্পের প্রতি। পৌরাণিক আখ্যানকে ছাপিয়ে ব্যক্তিমানুষের অধিকার ও আকাঙ্ক্ষার আধুনিক প্রতিফলন জেমস জয়েসের কথাশিল্পের অন্যতম শক্তিমত্তার পরিচায়ক।
ফলে জেমস জয়েসের ইউলিসিস উপন্যাসটিকে বলা যেতে পারে, পৌরাণিক আখ্যান পেরিয়ে আসা মানবিক উপাখ্যান। কারণ, ইংরেজি ভাষার যে কয়েকজন সাহিত্যিক তাদের সাহিত্যকর্মে সমাজের সব স্তরের মানুষের কথা বলেছেন এবং সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম সেরা হয়ে আছেন আইরিশ সাহিত্যিক জেমস জয়েস। ব্রিটিশ রাজতান্ত্রিক গৌরব ও অভিজাত্য শ্রেণির জ্যাতাভিমান ভিত্তিক সাহিত্যের বিপরীতে জেমস জয়েস হলেন মানবিক মানুষের জয়গানে মুখরিত।
জয়েসের উপন্যাস মানুষের সংগ্রামশীলতার প্রতি প্রচলিত নজর বা দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের কথা বলে। মানুষকে মর্যাদা দেওয়া, নিজেদেরকেই নিজেদের সমাদর করার শিক্ষা দেন জেমস জয়েস। তিনি মনে করেন, প্রাচীন বীরপূজা নয়, আধুনিক জীবনে এটাই মেনে নিতে হবে যে, মানুষের ক্ষুদ্র জীবনে নানা সংগ্রাম প্রতিটি মানুষকেই ঘিরে আছে এবং মানুষের জীবন নাট্যের নায়ক বা নিয়ন্ত্রক মানুষ নিজেই, অন্য কেউ নয়।
জয়েস মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন, মানুষের জীবনে যে প্রতিদিনের কাজগুলো করা হয়, যেমন, খাওয়া, নিজের দুঃখে ও মানুষের দুঃখে দুঃখিত হওয়া, বাজার করা, কাপড় ধোয়া ইত্যাদি, সেগুলো তুচ্ছ বা উপেক্ষা করার মতো নয়। এই ব্যাপারগুলো সুন্দর, গভীর এবং আসলেই প্রশংসার দাবিদার। মানুষের প্রতিদিনের জীবন ঐ গ্রিক বীরের তুলনায় কোনো অংশে কম নয়। কারণ প্রত্যেকের জীবনটা একেকটা ছোট ছোট যুদ্ধক্ষেত্র আর এখানে প্রতিটি মানুষই জীবনসংগ্রামের সৈনিক। পৌরাণিক যুদ্ধকে জেমস জয়েস দেখেছেন প্রতিদিনের জীবনযুদ্ধে।
নিজেও তিনি জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। ফলে সাহিত্যিক জীবনে সেই কঠিন বাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন জেমস জয়েস। আধুনিক জীবন সংগ্রামকে মহাকালের নিরিখে ফুটিয়ে তুলেছেন। সমাজের বাস্তব ছবি দেখার জন্য তিনি সরেজমিনে ঘুরেছেন পথে-প্রান্তরে, দেশে দেশে। প্রচণ্ড শব্দ ও বাক্য শক্তির অধিকারী এই প্রথিতযশা কথা সাহিত্যিক তার লেখনীতে ফুটিয়ে তুলেছেন জীবনের গল্প, সমাজের গল্প। তার উপন্যাস ও গল্পে কাহিনীর বয়ান এতোই নিখুঁত যে চোখের সামনে সব কিছু বাস্তবের মতো দেখতে পাওয়া যায়। তার কলমে ডাবলিন শহর ও সেখানকার মানুষগুলো পাঠকের সামনে জীবন্ত সত্তায় প্রতিভাত হয়।
জেমস জয়েসের লেখায় একাধারে স্থান পেয়েছে খুব সাধারণ জীবনের বর্ণাঢ্যতা, আবার মানব মনের বিচিত্র সব চিন্তা প্রবাহ (যা stream of consciousness নামে পরিচিত)। এমনকি শেষ উপন্যাসে তিনি আবিষ্কারই করে ফেলেন এমন এক বিচিত্র ভাষা শৈলী ও শিল্পবোধ, যা তার অনন্য স্বকীয়তার স্মারক।
তার শিল্প তৃষ্ণা ছিল প্রবল। মানুষ, সমাজ ও জগতের নানা বিষয় জানতে ও বুঝতে চেষ্টা করেছেন তিনি জীবনভর। জানতে চেয়েছেন, শিল্প কী, কেন? তার বিখ্যাত আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘The Portrait of the Artist as a Young Man’-এ বলেছেন, একজন শিল্পীর সত্যিকারের শিল্পী হয়ে উঠতে দুটি গুণ থাকা দরকার, তা হলো:
এক) Integritas বা শিল্পী হিসেবে একজনের শৈল্পিক সত্ত্বার অখণ্ডতা, দুই) Claritas বা পাঠকের কাছে একজন শিল্পীর দায়বদ্ধতা।
জয়েস তার পুরো জীবনের প্রথম ২০ বছর জন্মভূমি ডাবলিন শহরেই কাটিয়েছেন। এ সময় তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন অলিতে-গলিতে, পথে-প্রান্তরে। খুব কাছ দিয়ে দেখেছেন মানুষের জীবন। পরবর্তীতে ইউরোপের বিভিন্ন শহর যেমন, ইতালির অড্রিয়াটিক সমুদ্র তীরের ট্রিএস্ট, সুইজারল্যান্ডের জুরিখ এবং ফ্রান্সের প্যারিসের মতো শহরগুলোই হয়ে ওঠে তার আবাস ও ঠিকানা। দীর্ঘ তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি লিখেছেন। এগুলোর মধ্যে আছে দুটি কবিতার বইও। আরো আছে, একটি ছোটগল্পের সংকলন, একটি নাটক এবং তিনটি উপন্যাস।
সব লেখকের কাছে নিজ শহর যেমন একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য পায়, ডাবলিন জয়েসের কাছে তেমনই। পরবর্তীতে ওরহাম পামুকের মধ্যে ইস্তাম্বুলের প্রভাব দেখা গেছে। এমন উদাহরণ বহু দেওয়া যায়। ‘মাত্রা ও পটভূমি’তে ভিন্ন ভিন্ন হলেও প্রিয় শহর ডাবলিনের প্রভাব ছিল তার সব লেখাতেই। ডাবলিন এমনই এক শহর ছিল তার কাছে, যে শহরকে তিনি একইসাথে পাগলের মতো ভালোবাসতেন এবং ঘৃণাও করতেন। তার লেখাতেই উঠে এসেছে সেসব কথা। এর পেছনে একটি প্রেক্ষাপট আছে। আর আছে স্বাধীনতার স্পৃহা।
উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ডাবলিন তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একটা অংশ ছিল এবং পরাধীনতার এই বিষয়টি কোনো আইরিশ নাগরিক কখনোই মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। ফলে সকল আইরিশের মতো একটা স্বাধীন, সুন্দর ডাবলিনের স্বপ্ন দেখতেন তিনি ছোটবেলাতেই। তার পড়াশোনার শুরু জেজুইটে (Jesuits), এসময়েই তিনি বিদেশি ভাষাতে অসামান্য দক্ষতা দেখাতে শুরু করেন। যখন তিনি ডাবলিনের ইউনিভার্সিটি কলেজের ছাত্র, তখন থেকেই তিনি পুরোদমে বই রিভিউ, কবিতা, ছোটগল্প এগুলো লেখা শুরু করেন।
কিন্তু পেশা হিসাবে সাহিত্যকর্ম একজন মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য ছিল না। সাহিত্য করে পেট চলবে না, এমনই ছিল পরিস্থিতি। ফলে তিনি প্যারিসে চলে গেলেন চিকিৎসা বিজ্ঞানে পড়াশোনা করার জন্য। কিন্তু ফল হল উল্টো, কলেজ ও লাইব্রেরিমুখী হবার বদলে সমানতালে ভিড় জমাতে শুরু করলেন তিনি মদখানা আর পতিতালয়ে। জীবনকে তিনি দেখতে লাগলেন বিভিন্ন পরিসরে এবং নিজের অভিজ্ঞতার আয়নায়।
জীবনের এমনই জটিল ও এলোমেলো পর্যায়ে, ১৯০৪ সালে, হঠাৎ করেই জয়েসের ভালো লেগে গেল গ্যালওয়ের এক অশিক্ষিত কিন্তু অত্যন্ত আবেদনময়ী নারীকে, যার নাম নোরা বার্নাকেল। নোরাও পড়ে গেলেন ভালোবাসার এক মায়াবী জালে। তাদের মধ্যে গভীর প্রেম ও প্রণয় সঞ্চারিত হয়। জীবনে কেউ কাউকে ছেড়ে যাননি। জয়েসের অত্যন্ত জটিল এবং কঠিন জীবন সংগ্রামের সময়ে নোরা জয়েসের পাশেই ছিলেন।
নোরাকে নিয়েই জয়েস ইউরোপের দেশে দেশে পাড়ি জমান। পরবর্তী ১০ বছর যাযাবরের মতো ঘুরতে থাকেন বিভিন্ন শহরে। সংসার পাতেন, হয়ে ওঠেন বাচ্চাকাচ্চার জন্মদাতা। জয়েসের সকল কর্মপ্রয়াসের পেছনে নেপথ্যের প্রণোদনা ছিল নোরার।
আর তার সাহিত্যের সাফল্যের পেছনে ছিল বাস্তব অভিজ্ঞতায় আহরিত উপাদান, যা তিনি গভীরতমভাবে দেখেছেন এবং ভাষার আখরে বাস্তবে রূপায়িত করেছেন। মানুষের বীরত্ব ও ক্ষুদ্রতা, মহত্ত্ব ও শঠতা পাশাপাশি রেখে দেখেছেন তিনি। বলেছেন, ‘অনুপস্থিতই সবচেয়ে বড় উপস্থিতি’, ‘জীবনে ভুল বলে কিছু নেই, প্রতিটি ভুলই একেকটি অভিজ্ঞতা।’ জেমস জয়েসের লেখায় পাওয়া উক্তিগুলো কেবল বইয়ে নয়, বহুল উল্লেখিত ও ব্যবহৃত হয়েছে বাস্তব জীবনেও।
জেমস জয়েস তার সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে এমনই এক স্থায়ী প্রভাব রেখেছেন, যা কাল ও ভাষার গণ্ডি পেরিয়ে নিত্য প্রবহমান। নিজের সমকালকে ছুঁয়ে তিনি তার সাহিত্য সম্ভারের মধ্য দিয়ে পৌঁছে গেছেন আজকের পাঠকের কাছেও, লেখক হিসাবে যা তার শক্তিমত্তা ও বিশিষ্টতার গতিময়তাকেই প্রমাণিত করে।