বই ও বইমেলা
“বই মৃত। পঞ্চদশ শতকের প্রযুক্তিতে পৌরসভার আবর্জনার গাড়িতে তুলে দিন।”
একুশের বইমেলা সামনে রেখে এমন ভয়ঙ্কর কথা শুনলে কাগজ-ছাপা বইয়ের ভক্ত পাঠক মেজাজ তো খারাপ করবেনই। অমন কথা যিনি বলবেন প্রথম ছাপাখানার কারিগর গুটেনবার্গের (Gutenberg) বিদেহী আত্মা রেগেমেগে তার ঘাড়ও মটকে দিতে পারে।
“বই মৃত—এ কথা বলা বন্ধ করুন। বই আগের চেয়েও বেশি জীবিত।”
আমরা বই বলতে যা বুঝি তার দিন কি শেষ? ডিজিটাল বিপ্লব কি ছাপাখানার যুগের অবসান ঘটাচ্ছে? এমন কি যখন ১৯৩৯ সালে যখন প্যাঙ্গুইন পেপারব্যাক প্রথম প্রকাশিত হলো, অনেকেই ভবিষ্যৎবাণী করেছেন প্রকাশনা শিল্পের বারোটা বেজে গেছে। যখন হোম ভিডিও এলো, শুনেছি সিনেমার দিন শেষ। এমন কি ছাপাখানা আবিষ্কারের পর ক্যাথলিসিজমের বিদায়ঘণ্টা বাজার আশঙ্কাও করাও হয়েছে।
যখন কাদামাটি কিংবা ধাতব প্লেটে বই লেখা হতো সেই লেখকরাও শুরুতে ভাবেননি প্যাপিরাস এসে ভারী ভারী এক একটা বই হঠিয়ে দিয়ে কম পরিসরে বই হিসেবে বছরের পর বছর টিকে থাকবে।
বহনযোগ্য ধাতব টাইপ ব্যবহার করে ১৪৫৫ সালে একালের প্রথম বই গুটেনবার্গ বাইবেল প্রকাশিত হয়। টাইপ তৈরির জন্য জন্য যে মণ্ড তৈরি করা হয় তাতে শিসা, টিন ও এন্টিমনি ব্যবহার করা হয়।
গুটেনবার্গ যন্ত্র আবিষ্কারের ৬০০ বছর আগেও চীনে দু একটি করে বই ছাপা হয়েছে কিন্তু বেশি সংখ্যায় ছাপার সূচনা গুটেনবার্গ যন্ত্রের মাধ্যমে।
জার্মানির গুটেনবার্গ বিপ্লব রেনেসাঁ, রিফর্মেশন, দ্য এজ অব এলাইটেনমেন্ট ও সাইন্টিফিক রেভ্যুলুশন-এর পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। তারপর ৫৪০ বছর কেটে যায়। মুদ্রণশিল্পের অভাবনীয় উন্নতি ঘটেছে। তারপরও বই কিন্তু কাগজ, ছাপাখানা, বাঁধাই—এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি।
১৯৯৫ সালে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, দেখা যায়, পড়া যায়, সযত্নে রেখে দেওয়া যায় এমন একটি বই বিক্রি হলো। বইয়ের লেখক ডগলাস হফসতাদার (Douglas Hofstadter), বইয়ের নাম Fluid Concepts of Creative Analogies : Computer Models of the Fundamental Mechanisms of Though—গুটেনবার্গ প্রযুক্তি বাস্তব হুমকির মুখে পড়ল।
গুটেনবার্গের মতোই একটানা লেগে থেকে যিনি এ কাজটি করলেন তিনি জেফ বেজোস নামের আমেরিকান এক যুবক, জন্ম ১২ জানুয়ারি ১৯৬৪। তিনিই আমাজন ডট কম-এর প্রতিষ্ঠাতা।
১৯৯৭ সালে, মাত্র দু বছরের মাথায় আমাজন দাবি করে বসল যে এটা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বইয়ের দোকান। খান্দানি বইয়ের দোকানগুলো চটে গেল। বার্নস অ্যান্ড নোবেল মিথ্যাচারের অভিযোগ এনে আমাজনের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিল ১৯৯৭-র মে মাসে। তাদের দাবি এটা আদৌ কোনো বইয়ের দোকান নয়, বরং জেফকে বলা যায় বইয়ের দালাল। ১৯৯৮-তে ওয়ালমার্ট মামলা করল, আমাজন তাদের ব্যবসায়ের গোপন সূত্র চুরি করেছে।
জেফ বেজোসের তখন এমনিতে ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। মামলার কারণে নয়, ক্ষতি সামলে উঠতে পারছেন না। এরই মধ্যে টাইম ম্যাগাজিন আর্থিক দৈন্যদশায় ডুবে থাকা মানুষটিকে ১৯৯৯ সালে ‘পার্সন অব দ্য ইয়ার’ ঘোষণা করল।
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বইয়ের দোকানের মালিকরা স্থানীয় ট্যাক্স অফিসের স্বীকৃতিটুকু কেবল পেয়েছেন আর টাইম ম্যাগাজিন আমাজনের মালিক হিসেবে তাকে ‘বছরের সেরা ব্যক্তি’ নির্বাচন করেছে।
দ্য গার্ডিয়ানের সমীক্ষায় (২০০৮) পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দশটি বইয়ের দোকান হচ্ছে:
১০. হ্যাচার্ড (১৯৯৭-তে প্রতিষ্ঠিত, লন্ডনের পিকডিলিতে)
৯. কিবুনসিয়া (জাপানের কিয়োটোতে)
৮. এল পেনডুলো (মেক্সিকো সিটি)
৭. পোসাডা (ব্রাসেলস)
৬. স্কার্থিন বুকস (ক্রমফোর্ড)
৫. বোর্ডারস্ (গ্লাসগো)
৪. হেডকোয়ার্টার্স কমিক বুকস্টোর (লস অ্যাঞ্জেলেস)
৩. লিব্রারিয়া (লন্ডন)
২. এল অ্যাটেনিও (বুয়েনস আইরেস)
১. বোয়েখান্দেল সেলেক্সিজ ডোমিনিকানেন (মাসট্রিখট)
গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস-এর তালিকায় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বইয়ের দোকান নিউ ইয়র্ক সিটির ফিফথ অ্যাভিনিউ-র বার্নস অ্যান্ড নোবেল কলেজ বুকস্টোর। ফ্লোরস্পেসের হিসেবে ধরলে এটিই সর্ববৃহৎ। বার্নস অ্যান্ড নোবল বইয়ের দোকানের ৭৬৯টি ক্যাম্পাস শাখা।
কিন্তু শেলফ স্পেস বিবেচনা করলে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বইয়ের দোকান যুক্তরাষ্ট্রের পোর্টল্যান্ডের পলওয়েল’স বুকস। টরোন্টোর একটি বইয়ের দোকানের নামই ছিল ওয়ার্ল্ডস বিগেস্ট বুকস্টোর। তিনতলা ভবনের তিনটি তলাতেই মোট ২০ কিলোমিটার শেলফ জুড়ে কেবল বই আর বই। ১৯৮০-তে প্রতিষ্ঠিত এই বইয়ের দোকানটি ২০১৪ সালে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়। ভবনটি গুঁড়িয়ে ফেলা হয়। এখানে চারটি রেস্তোরাঁ নির্মিত হয়।
আমাজনের ধাক্কা পৃথিবীর সব বড় বড় বইয়ের দোকানে লেগেছে। ২০০১ সালে আমাজন প্রথম লাভের মুখ দেখে। এখন আমাজনের কর্মচারীর সংখ্যা ১ লক্ষ ৫৫ হাজার। আর জেফ বেজোস পৃথিবীর পঞ্চম শ্রেষ্ঠ ধনী, সম্পদের পরিমাণ ৭০.৪ বিলিয়ন ডলার। তিনি ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকাটিও অনেক খরিদ্দারকে টেক্কা মেনে কিনে নিয়েছেন। তিনি বুড়ো আঙ্গুল দেখাচ্ছেন সনাতন প্রকাশনা জগতকে। ই-বই ছাপা-বইকে মার দেবেই। ছাপা বই সাড়ে পাঁচশত বছর রাজত্ব করেছে, আর কত?
কেন ই-বইয়ের জন্য পক্ষপাত বেড়েই যাবে, আমরা যারা প্রযুক্তির সড়কে পা রাখতে পারব না পিছিয়েই পড়ব, তার কিছু কারণ জানলে বরং ভালো
১. ই-বুক হচ্ছে গ্রিন বুক (লিবিয়ার মুয়ামের গাদ্দাফির গ্রিন বুক নয়)—পরিবেশ বান্ধব বই। বইয়ের কাগজ উৎপাদনের জন্য একটি গাছও কাটতে হবে না।
২. বাসায় বই রাখার কোনো জায়গা না থাকলেও সমস্যা নেই। ই-বুক নিজের জায়গা করে নেবে।
৩. ঘরে বসে তাৎক্ষণিক ই-বুকের সরবরাহ নেওয়া যাবে। বইপত্র আমদানি-রফতানির আইন কানুন ও প্রক্রিয়া তাৎক্ষণিকভাবে নাকচ করা যাবে।
৪. বইয়ের জন্য গাড়ি ভাড়া দিয়ে এ দোকানে ও দোকানে এ লাইব্রেরিতে ও লাইব্রেরিতে ছুটোছুটি করতে হবে না।
৫. ফটোকপি করা স্ক্যান করা এসব ঝামেলা পোহাতে হবে না।
৬. ই-বুক গুদামজাত করার জন্য গুদামঘর লাগে না, বড় দোকান লাগে না। ব্যবহারের জন্য বিশাল লাইব্রেরি লাগে না। ল্যাপটপ কি রিডিং ডিভাইসে হাজার বই সঞ্চিত রাখা যায়।
৭. বাসে ট্রেনে প্লেনে স্টিমারে কোর্ট কাচারিতে যে কোনো জায়গায় পড়া সম্ভব।
৮. অতি সহজে বহন করা যায়। শত মেট্রিক টন ওজনের বইও ই-বুক হিসেবে অনায়াসে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়, এক দেশ থেকে অন্যদেশে নিয়ে যাওয়া যায়।
৯. ই-বুক পরিবহনে রোদ-বৃষ্টিতে নষ্ট হবার কোনো আশঙ্কা থাকে না।
১০. ই-বুক বাজারজাত করার সময় মেগা স্টোরের যে কোনো পণ্যের মতো বোনাস দেওয়া যায়। মূল্যমানের ওপর পয়েন্ট দেওয়া যায়। পয়েন্ট ঠিক টাকার মতোই আরো বই কিনতে সুযোগ করে দেয়।
১১. ই-বুক লিঙ্ক ধরিয়ে দিয়ে জ্ঞানের আরো জানালা খুলে দেয়।
১২. ই-বুকে পাতা উল্টে উল্টে খোঁজার দরকার হয় না, সার্চ দিয়েই নির্দিষ্ট বিষয় বের করা যায়।
১৩. ই-বুক পাঠাতে, আনাতে প্যাকেজিং করাতে হয় না, শিপিং খরচও নেই।
১৪. কাগজে ছাপা অবস্থায় পড়তে চাইলে কোনো সমস্যা নেই, কেবল প্রিন্টার থাকলেই হলো। ই-বুক থেকে কমান্ড দিয়ে মুদ্রিত পাতা পাওয়া সম্ভব।
১৫. ই-বুক আরামে পড়ার জন্য ফন্ট সাইজ ছোট-বড় সোজা-ইটালিক যেমন ইচ্ছে করা যায়।
১৬. ই-বুকের বিপণন ও বিতরণ অত্যন্ত সহজ। শুধু দরকার ব্যবহারকারীর ভালো নেটওয়ার্ক।
১৭. ই-বুক বৈষম্য দূর করে। কসমোপলিটান সিটিতে হোক কি অজপাড়া গাঁয়ে—ই-বুকে সবার প্রবেশাধিকার সমান।
১৮. কম্পিউটারের সামনে যেহেতু আপনাকে অনেকক্ষণ থাকতেই হচ্ছে, আর একটি উইন্ডো খুলে একই সঙ্গে আপনার প্রিয় লেখকের বইটিও পড়তে পারেন।
১৯. খেতে খেতে শুয়ে শুয়ে যে কোনো সময় যে কোনো অবস্থায় ই-বুক পড়তে পারেন।
২০. ভুলবশত মূল্যবান বইটি কোথাও হারিয়ে ফেলার কিংবা লোপাট হতে দেবার সুযোগও নেই।
২১. আইপ্যাড, আইফোন থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকম ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেট ব্যবহার করে বই পড়া যায়।
২২. বইয়ের প্যাসেজ সার্চ করা, স্কিমিং করা ই-বুকে খুব সহজ হয়ে গেছে। হাইলাইট করা ও আংশিক অনুবাদ করাও সহজ ব্যাপার।
২৩. বাধ্যতামূলক মিটিং, কনফারেন্স বিরক্তিকর বক্তৃতা—এসব এড়াতে ই-বুক শ্রেষ্ঠ সহায়ক। চেয়ারটা দখল করে অমনি পড়তে বসে যান।
২৪. ই-বুক পড়ার জন্য সন্ধ্যা কিংবা রাতের ভূমিকা নেই। অন্ধকারেও বিষয়ভিত্তিক পাঠ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব।
২৫. একহাতে নিয়ে পড়া চালিয়ে যেতে পারেন।
২৬. পৃষ্ঠা ভেঙে রাখার কোনো দরকার হবে না।
২৭. ডিকশনারি কেনার দরকার নেই। কম্পিউটারে কিংবা রিডিং ডিভাইসে ডিকশনারি থাকছেই।
২৮. ই-বুক যদি কষ্ট করে না পড়তে চান তাহলে অডিও অপশনে গিয়ে শুনুন, অন্যকেউ পড়ে শোনাবে; ভিডিও দেখতে পারেন।
২৯. চব্বিশ ঘণ্টার যে কোনো সময় ই-বুক কিনতে পারেন; যে কোনো দিন, যে কোনো মাস, যে কোনো বছর—কোনো ছুটি নেই ই-বুক শপে।
৩০. ই-বুকের দাম ছাপা বইয়ের সিকিভাগেরই কম।
৩১. একবার আগুন ধরিয়ে দিতে পারলে ছাপা বইয়ের পুরো লাইব্রেরিই ভষ্মীভূত করে ফেলা সম্ভব। ই-লাইব্রেরি আগুন আগুন আতঙ্কে নেই।
৩২. উঁইপোকার সাধ্য নেই ই-বুকে কামড় বসায়।
৩৩. বই বহন করে কোমর ব্যথার দিন ফুরোবে।
বইমেলা
১৪৫৫ সালে জোহানেস গুটেনবার্গ উদ্ভাবিত ছাপাখানায় মুদ্রিত হলো পৃথিবীর প্রথম বই। তার পরপরই স্থানীয় বই বিক্রেতারা ফ্রাঙ্কফুর্টের পাশেই একটি উপশহরে আয়োজন করলেন পৃথিবীর প্রথম বইমেলা। এই মেলাতে পাণ্ডুলিপি বেচাকেনাও চলেছে। সপ্তদশ শতক পর্যন্ত এই মেলা নিয়মিতই চলেছে। তখন এটাই ছিল ইউরোপের, বরং বলা যায় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বইমেলা। পরে মহাসমারোহে লিপজিগ বইমেলা চালু হলে ফ্রাঙ্কফুর্ট মার খেয়ে যায়। রাজনীতি ও সংস্কৃতির কেন্দ্র তখন লিপজিগ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বিধ্বস্ত ও দ্বিখণ্ডিত জার্মানির পশ্চিমাংশে ১৯৪৯ সালে ফ্রাঙ্কফুর্টের সেইন্ট পল চার্চে আবার বইমেলা শুরু হয়। এর উদ্যোক্তা প্রকাশক ও বই বিক্রেতারাই। ক বছরের মধ্যেই ফ্রাঙ্কফুর্ট হারানো গৌরব ফিরে পায়—আকারে বৈচিত্র্যে ও আর্থিক লেনদেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বইমেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। অবশ্য হালে জনসমাগমের হিসেবে শীর্ষে অবস্থান করছে ইতালির তুরিন আন্তর্জাতিক বইমেলা।
ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা চার্চের বাইরে ফ্রাঙ্কফুর্ট ট্রেড গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। প্রতিবছর অক্টোবরে ৫ দিনের এই মেলায় প্রথম তিনদিন কেবল বাণিজ্যিক দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে। মেলার স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে রয়েছেন প্রকাশক, লেখক, সম্পাদক, লেখক ও প্রকাশনের এজেন্ট, বই ব্যবসায়ী, লাইব্রেরিয়ান, শিক্ষাবিদ, চিত্রশিল্পী, অনুবাদক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, মুদ্রণকারী, বাণিজ্য সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান, সফটওয়ার ও মাল্টি মিডিয়া সরবরাহকারী, ইলেক্ট্রনিক রিডিং ডিভাইস সরবরাহকারী এবং অবশ্যই বৃহত্তর পাঠক গোষ্ঠী।
১৯৭৬ থেকে প্রতিবছর একটি দেশকে গেস্ট অব অনার হিসেবে মেলায় আমন্ত্রণ জানানো হয়, সে দেশের সাহিত্য হয় মেলার থিম। ২০১৭-র বইমেলায় ফ্রান্স ছিল গেস্ট অব অনার এবং ফরাসি সাহিত্য এর থিম। ২০১৬-তে গেস্ট অব অনারে ছিল ফ্ল্যান্ডার্স ও নেদারল্যান্ডস আর থিম ফ্লেমিশ ও ডাচ সাহিত্য। ২০১৮-তে গেস্ট অব অনার জর্জিয়া, ২০১৯ সালে নরওয়ে। এ বছরের মেলায় অতিথি দেশ কানাডা।
ফ্রাঙ্কফুর্ট ও তুরিন আন্তর্জাতিক বইমেলা ছাড়া প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হচ্ছে তাইপেই, কলকাতা, নয়াদিল্লি, জেরুজালেম, ডাবলিন, প্যারিস, বোলোনা, ব্যাঙ্কক, লন্ডন, বোগোটা, বুয়েলস আইরেস, আবুধাবি, জেনেভা, প্রাগ, উয়ারশ সওল, নিউ ইয়র্ক, কেপটাউন, টোকিও, বেইজিং, মস্কো, কলম্বো, বার্সেলোনা, ইস্তাম্বুল ও শারজাহ বইমেলা। ঢাকার মাসব্যাপী একুশে বইমেলা তো রয়েছেই।
আগামী দিনের বইমেলা কেমন হবে ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলা এর মধ্যেই তার একটি বার্তা দিয়ে দিয়েছে। ২০১১-র বইমেলায় ৪৭ শতাংশ প্রদর্শক তাদের মুদ্রিত পণ্যের সাথে ডিজিটাল পণ্যের প্রদর্শনীও করেছে। প্রদর্শকদের মধ্যে ৭ শতাংশ কেবল ডিজিটাল সামগ্রীরই প্রদর্শনী করেছে। আর এই হার ক্রমেই বেড়ে আসছে। পঞ্চাশ বছর পর ২০৭০ সালে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় কেবলমাত্র ছাপা-বই প্রদর্শকের অনুপাত যদি ৭-এ নেমে আসে আমরা অবাক হব না।
ইত্যাদি
২০০৯-২০১০ অর্থ বছরে আমেরিকার বেস্ট সেলার ফিকশন লেখক জেমস প্যাটারসন তখনকার ডলার-টাকা বিনিময় হার অনুযায়ী কামিয়েছেন ৫০১ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা। দিনের কামাই ১ কোটি ৩৭ লক্ষ ৫১ হাজার টাকা। ১৬ কোটি মানুষের এই বাংলাদেশের সকল ফিকশন লেখক মিলে এক বছরে জেমস প্যাটারসনের এক দিনের ধারে কাছেও পৌঁছতে পারেননি—এটা বেশ জোর দিয়েই বলা যায়।
হ্যারি পটার সিরিজের জন্য এক বছরে জে কে রাউলিং কামিয়েছেন ৫০০ মিলিয়ন ডলার। চোরাবাজারের ডলারের দর অনুযায়ী প্রতিদিন ৬ কোটি ৫৭ লক্ষ টাকা; জেমস প্যাটারসনের পাঁচগুণ। তিন বছরে এক মুদ্রণের ৫০০ বই বেচতে আমাদের শ্রেষ্ঠ প্রকাশকরাও হিমশিম খেয়ে যান।
এমন ঘটনা ইউরোপেও ঘটে। ১৭১৬ সালে কপটিক থেকে ল্যাটিনে ভাষান্তরিত নিউ টেস্টামেন্টের ৫০০ কপির মুদ্রণের শেষ বইটি বিক্রি হয়েছে ১৯০৭ সালে। ১৯১ বছরে ৫০০ কপি বইয়ের সদগতি হওয়া একটি বিশ্বরেকর্ড। এটি পড়তে পড়তে মনে হয়েছে ওদের বইয়ের গুদামে উঁই নেই?
আমেরিকান স্কুল জরিপে পাওয়া একটি তথ্য : বাইরের বই পড়ে না এ সংখ্যাটিই বেশি। কিন্তু তাদের পাঁচ ভাগের এক ভাগ বই পড়ে না, যারা পড়ে না তাদের ভয়ে। বইয়ের পাঠক জানতে পারলে ছাত্রটিকে অন্যান্যদের বুলির শিকার হতে হয়। এটা বাংলাদেশেও শুরু হয়েছে।
সেরা ৩০ লেখক
সাহিত্যিকদের মধ্যে যারা সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছেন ড্যানিয়েল বার্ট তাদের একশো জনের একটি তালিকা করেছেন। বিশ্বজুড়ে অনূদিত হয় তাদের রচনাবলী। সেই তালিকার প্রথম ৩০ জন—১. উইলিয়াম শেকসপিয়ার (১৫৬৪-১৬১৬) ২. দান্তে অ্যালিঘেরি (১২৬৫-১৩২১) ৩. হোমার (খ্রিস্টজন্মের ৭৫০ বছর আগে জন্মেছেন বলে অনুমান) ৪. লেভ তলস্তয় (১৮২৮-১৯১০) ৫. জিওফ্রে চসার (১৩৪০-১৪০০) ৬. চার্লস ডিকেন্স (১৮১২-১৮৭০) ৭. জেমস জয়েস (১৮৮২-১৯৪১) ৮. জন মিল্টন (১৬০৮-১৬৭৪) ৯. ভার্জিল (খ্রিস্টপূর্ব ৭০-১৯ অব্দ) ১০. ইউহান উলফগ্যাঙ্গ ফন গ্যায়টে (১৭৪৯-১৮৩২) ১১. মিগুয়েল সার্ভেন্টিস (১৫৪৭-১৮৩২) ১২. মুরাকামি শিকিবু (৯৭৮-১০৩০) ১৩. সোপোক্লেস (খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৬-৪০৬ অব্দ) ১৪. উইলিয়াম ফকনার (১৮৯৭-১৯৬২) ১৫. ফিউদর দস্তয়েভস্কি (১৮২১-১৮৮১) ১৬. টি এস এলিয়ট (১৮৮৮-১৯৬৫) ১৭. মার্শেল প্রুস্ত (১৮৭১-১৯২২) ১৮. জেইন অস্টিন (১৭৭৫-১৮১৭) ১৯. জর্জ এলিয়ট (১৮১৪-১৮৮০) ২০. উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস (১৮৬৫-১৯৩৯) ২১. আলেক্সান্ডার পুশকিন (১৭৯৯-১৮৩৭) ২২. ইউরিপিডেস (খ্রিস্টপূর্ব ৪৮০-৪০৬ অব্দ) ২৩. জন ডান (১৫৭২-১৬৩১) ২৪. হারমান মেলভিল (১৮১৯-১৮৯১) ২৫. জন কিটস (১৭৯৫-১৮২১) ২৬. ওভিদ (খ্রিস্টপূর্ব ৪৩-১৭ অব্দ) ২৭. তু ফু (৭১২-৭৭০) ২৮. উইলিয়াম ব্ল্যাক (১৭৫৭-১৮২৭) ২৯. অ্যাস্কিলাস (খ্রিস্টপূর্ব ৫২৫-৪৫৬ অব্দ) ৩০. গুস্তাব ফ্লবেয়র (১৮২১-১৮৮০)।
ড্যানিয়েল বার্ট প্রভাব বিস্তারকারী ১০০ জন সাহিত্যিকের তালিকা করেছেন। তালিকায় অন্তর্ভুক্তি ও অবস্থান নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ‘ইংলিশ বায়াস’ স্পষ্ট; ইংরেজি সাহিত্যের কম গুরুত্বপূর্ণ লেখকও জায়গা করে নিতে পেরেছেন। এই তালিকায় অ-ইংরেজ লেখকদের মধ্যে আরো রয়েছেন—ফ্রানৎজ কাফকা, মলিয়ের, থোমাস মান, হেনরিস ইবসেন, আন্তন শেখভ, ভ্লাদিমির নবোকভ, বালজাক, স্তাদাল, ফ্রান্সেস্কো পেত্রার্ক, আলবেয়ার কামু, ভোলতেয়ার, মার্কেজ, বোর্হেস প্রমুখ।
বই নিয়ে আরো কথা
বই হচ্ছে একটি আয়না। একটি গাধা যখন এই আয়নার দিকে তাকাবে সে একটি ঘোড়া দেখবে এটা আশা করা উচিত নয়। গ্রন্থ-সভ্যতার সূচনা থেকে এ পর্যন্ত বহুবার লাইব্রেরিতে আগুন দেওয়া হয়েছে। যে কোনো একনায়ক ও স্বৈরাচারী শাসক ও তার সৈন্যবাহিনীর আক্রোশের শিকার হয় বইপত্র। বইয়ের অগ্ন্যুৎসব অবশ্যই অপরাধ। তবে জোসেফ ব্রডস্কি বলেছেন, আগুন দিয়ে বই পোড়ানোর চেয়েও বড় অপরাধ আছে। সেগুলোর একটি হচ্ছে—বই না পড়া।