অমর একুশে গ্রন্থমেলার ইতিহাস ও অন্যান্য
আবার চলে এলো বাঙালির প্রাণের মেলা—অমর একুশে গ্রন্থমেলা, যা আমাদের কাছে একুশের বইমেলা নামেই সমধিক পরিচিত। তবে প্রতিবছর সাধারণত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে মাসব্যাপী মেলার শুভারম্ভ হলেও এবছর শুরু হয়েছে ২ ফেব্রুয়ারি থেকে। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের কারণে মেলা একদিন পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এই ফেব্রুয়ারি মাসের জন্য সারাবছর বাংলাদেশের বইপ্রেমী পাঠক, লেখক এবং প্রকাশকরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন। পুরো বইমেলা প্রাঙ্গণ ভরে ওঠে নতুন বইয়ের গন্ধে, হাজারও মানুষের মুখর পদচারণায় যেন প্রাণ ফিরে পায় বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গণ এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান—রূপ নেয় এক মহামিলন মেলায়।
এ তো গেল বর্তমানের কথা। কিন্তু আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি যে ঠিক কী ছিল এই মহা মিলনমেলার ইতিহাস? বলা হয়ে থাকে, বইমেলা্র শুরুটা হয়েছিল চিত্তরঞ্জন সাহার হাত ধরে, ১৯৭২ সালে। কিন্তু না, সেভাবে বলতে গেলে বইমেলা শুরু হয়েছিল তারও আগে।
তখন ১৯৬৫ সাল, হঠাৎ একদিন প্রয়াত কথাসাহিত্যিক জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক—সরদার জয়েনউদদীনের মনে হয়, এতকিছুর মেলা হতে পারে, বইমেলা কেন নয়? তবে আর দেরি কেন! ওই বছরই রাতারাতি তিনি তৎকালীন কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরির (বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি) নিচতলায় আয়োজন করে ফেলেন এই বাংলায় ইতিহাসের প্রথম বইমেলা, যদিও তা ছিল মূলত শিশু গ্রন্থমেলা।
এখানেই থেমে থাকেননি জয়েনউদদীন, আরো বড় পরিসরে গ্রন্থমেলা আয়োজন করার সুযোগ খুঁজতে থাকেন তিনি। কথায় আছে, কোনোকিছু মন থেকে খুঁজলে নাকি তা পাওয়া যায়। হয়তো সেকারণেই জয়েনউদদীন তার সেই কাঙ্ক্ষিত সুযোগটি পেয়ে যান এবং তা কাজেও লাগান। ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সহযোগিতায় নারায়ণগঞ্জেই একটি গ্রন্থমেলার আয়োজন করে ফেলেন তিনি। এ মেলায় আলোচনা সভারও ব্যবস্থা ছিল যাতে অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৎকালীন প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ আব্দুল হাই, শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ও সরদার ফজলুল করিম।
এরপর এলো ১৯৭২, আমরা সবাই তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত এক স্বাধীন দেশের নাগরিক। তার মাঝেও ওই বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি মুক্তধারা প্রকাশনীর চিত্তরঞ্জন সাহা একটা চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বসে পড়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন বর্ধমান হাউস প্রাঙ্গণের বটতলায়। এ ৩২টি বই ছিল চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমান মুক্তধারা প্রকাশনী) থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশি শরণার্থী লেখকদের লেখা। সে বছর বাংলা একাডেমিও একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে হ্রাসকৃত মূল্যে বই বিক্রি করেছিল। তবে চিত্তরঞ্জন সাহার স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (পরে মুক্তধারা প্রকাশনী) ছিল একমাত্র বেসরকারি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। ওই সময় বর্ণমিছিলের তাজুল ইসলামসহ আরো কিছু প্রকাশক একাডেমির ভেতরে পূর্ব দিকের দেয়াল ঘেঁষে বই সাজিয়ে বসেন। এভাবেই চলতে থাকে আগামী কয়েক বছর।
১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমি মেলা উপলক্ষে ১৫ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিশেষ হ্রাসকৃত মূল্যে নিজেদের প্রকাশিত বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। এর পাশাপাশি মুক্তধারা, স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স ও তাদের দেখাদেখি আরো অনেকে বাংলা একাডেমির মাঠে নিজেদের বই বিক্রির উদ্যোগ নেয়। এরমধ্যে ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমিকে মেলার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এদিকে ১৯৭৯ সালে মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি, এ সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা।
তখনকার সময়ে ৭ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বইমেলা অনুষ্ঠিত হতো। কিন্তু ১৯৮১ সালে বইমেলার মেয়াদ ২১ দিনের পরিবর্তে ১৪ দিন করা হয়। এরপর প্রকাশকদের দাবির মুখে ১৯৮২ সালে মেলার মেয়াদ আবার ২১ দিনে বৃদ্ধি করা হয়। তারপর ১৯৮৩ সালে কাজী মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে বাংলা একাডেমিতে প্রথমবারের মতো অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন এবং ১৯৮৪ সালে এসে গ্রন্থমেলার জন্য বিধিবদ্ধ নীতিমালা প্রণীত হয়, সেই থেকে এই গ্রন্থমেলার নাম হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’।
তবে ইতিহাসের কথা বলতে গেলে যেটা না বললেই নয় তা হলো, মূলত ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার জন্য মহান ভাষা শহীদদের আত্মোৎসর্গের অম্লান স্মৃতিকে চিরস্মরণীয় করে রাখতেই এই বইমেলার নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ এবং তা প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসেই পালিত হয় যা নিয়মিতভাবে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে, তবে ২০১৪ সাল থেকে অমর একুশে গ্রন্থমেলা বাংলা একাডেমির মুখোমুখি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারিত হয়।
বইমেলার অনুষ্ঠান
মেলা চলাকালীন বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে প্রতিদিনই বিভিন্ন আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। এছাড়া মেলাতে লেখককুঞ্জ রয়েছে, যেখানে লেখকেরা উপস্থিত থাকেন এবং তাঁদের বইয়ের ব্যাপারে পাঠক ও দর্শকদের সাথে মতবিনিময় করেন। মেলার তথ্যকেন্দ্র থেকে প্রতিনিয়ত নতুন মোড়ক উন্মোচিত বইগুলোর নাম, লেখক ও প্রকাশকের নাম ঘোষণা করা হয় এবং দৈনিক প্রকাশিত বইয়ের সামগ্রিক তালিকা লিপিবদ্ধ করা হয়।
বইমেলার পদক
২০১০ খ্রিস্টাব্দ থেকে এই মেলায় চিত্তরঞ্জন সাহার নামে একটি পদক প্রবর্তন করা হয়। পূর্ববর্তী বছরে প্রকাশিত বইয়ের গুণমান বিচারে সেরা বইয়ের জন্য প্রকাশককে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়। পুরস্কারটি আনুষ্ঠানিক নাম চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার। এছাড়া স্টল ও অঙ্গসজ্জার জন্য দেওয়া হয় সরদার জয়েনউদদীন স্মৃতি পুরস্কার। সর্বাধিক গ্রন্থ ক্রয়ের জন্য সেরা ক্রেতাকে দেওয়া হয় পলান সরকার পুরস্কার।
প্রকাশনী নির্বাচন
মেলায় কোন প্রকাশনা স্টল পাবে, কেমন স্টল করতে পারবে, তার জন্য বাংলা একাডেমির তত্ত্বাবধানে আলাদা কমিটি গঠিত হয়। ২০১০ খ্রিস্টাব্দ থেকে এই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কিছুটা কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। প্রকাশিত বইয়ের কপি জাতীয় আর্কাইভ ও জাতীয় গণগ্রন্থাগারে জমা দেওয়া হয়েছে কিনা, কর-নির্দেশক-নম্বর (TIN) ঠিক আছে কিনা যাচাই করার পাশাপাশি প্রকাশিত নতুন বইয়ের কপি বাংলা একাডেমির তথ্যকেন্দ্রে জমা দেওয়ার বিষয়টিও বাধ্যতামূলক করা হয়।
বইমেলার মর্মান্তিক ঘটনা
১৯৯৬ সালে প্রথাবিরোধী, নারীবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিন বইমেলায় লাঞ্চিত হন।
২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রথাবিরোধী লেখক অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ বইমেলা থেকে ফেরার পথে পরমাণু শক্তি কমিশনের সামনে অজ্ঞাতনামা জেএমবি সদস্য দ্বারা ছুরিকাঘাতের শিকার হন। পরে ওই বছরের ১১ আগস্ট তাঁর মৃত্যু হয়।
২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে ফেরার পথে মুক্তমনা লেখক অভিজিৎ রায় চাপাতি দ্বারা অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হন। পরে তাঁর মৃত্যু হয়। এরপর থেকে বইমেলা উপলক্ষে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরো জোরদার করা হয়। কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনিতে ঘিরে থাকে মেলা। গত বছর ঘূর্ণিঝড় ও বৃষ্টিতে বইমেলার স্টল বিধ্বস্ত হলে মেলার সময় ২ দিন বৃদ্ধি করা হয়েছিল।