না বলা কথা বলে ‘রেডক্লিফ লাইন’
সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া হয়তো ভূখণ্ডকে দ্বিখণ্ডিত করতে পারে কিন্তু মানব হৃদয়কে কতটুকু পৃথক করতে পারে সেই প্রশ্ন বরাবরই থেকে যায়। আর এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে নাট্যকার ও নির্দেশক সঞ্জয় সরকার মুক্তনীল রচিত নাটক ‘রেডক্লিফ লাইন’।
সোমবার (১০ ফেব্রুয়ারি) রাত ৮টায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চে জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটারের (অডিটোরিয়াম) ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ১০ দিনব্যাপী নাট্যোৎসবের দ্বিতীয় দিনে বাতিঘরের প্রযোজনায় নাটক ‘রেডক্লিফ লাইন’ মঞ্চায়িত হয়।
‘রেডক্লিফ লাইন’ নাটকটি মূলত ভারতবর্ষের কাঁটাতারের দেয়ালকে ঘিরে বলা গল্প। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ‘নো-ম্যানস ল্যান্ড’ই এই নাটকের পটভূমি। সীমান্তের শেষ প্রান্তের উঁচু জায়গায় দুজন সীমান্তরক্ষী কথা বলছে, তাদের ভাষা শুনে বোঝা গেল তারা ভারতীয় সীমান্তরক্ষী। এদেরই একজন সীমান্তে হঠাৎ একটা গরুকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছে। অপরজন বলছে, যে করেই হোক সেই গরুটিকে ফিরিয়ে আনতে হবে। হুকুম পালন করার জন্য ভারতীয় সৈন্যটি গরু খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে। হাঁটতে হাঁটতে ভারতীয় সৈন্যটি ‘নো-ম্যানস ল্যান্ডে’ চলে আসে। সেখানে এসে দেখে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীর পোশাক পরিহিত একজন তারই মতো গরুটিকে খুঁজছে। ‘নো-ম্যানস ল্যান্ড’ এলাকায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী ও বাংলাদেশি সীমান্তরক্ষী একে অপরকে দেখে লুকিয়ে পড়ে।
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাংলাদেশিকে দেখে গুপ্তচর ভেবে বসে। তারপর শুরু হয় দুজনের আড়ালে থেকে তর্ক এবং নানা রকম বাকবিতণ্ডা। সীমান্ত প্রহরী দু সেনার তর্কের মধ্য দিয়ে উঠে আসে বাংলাদেশ-ভারতের ইতিহাসের নানা অধ্যায় জঙ্গিবাদ, অবৈধ অনুপ্রবেশ, সীমান্ত হত্যা, ফেলানী হত্যাকাণ্ডসহ নানা বিষয় উঠে আসে।
কথোপকথনের একটা পর্যায়ে দুই দেশের দুই সীমান্ত প্রহরীর তর্কের মধ্য দিয়ে উঠে আসে কোনো এক সময় তারা একই ভূ-খণ্ডের ছিল! জন্ম একই ভূ-খণ্ডে হলেও কাঁটাতারের বিচ্ছেদে তারা দু দেশের অধিবাসী। আবেগ-অনুভূতি-ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি মূলত এক হলেও কাঁটাতারের সীমান্ত রেখা তাদের ভাগ করে দিয়েছে। দুই সীমান্তরক্ষী যখন নাটকের শেষ প্রান্তে এসে বন্ধুত্বের আলিঙ্গন করতে চায়, তখনই বুলেটে বিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ে তাদের দেহ।
দু সেনার মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে নাটক শেষ হলেও তার রেশ থেকে যায় পুরো দর্শক মহলে। মিথ্যা অহমিকা আর সার্বভৌমত্বের বেড়াজালে পিষ্ট হয় মানবতা আর সেখানে ক্ষণিকের জন্য হলেও ভাবতে শেখায় সীমানাহীন পৃথিবীর, যেখানে নেই কোনো কাঁটাতারের বেড়া।
বাতিঘর নাট্যদলের এ নাটকটিতে অভিনয় করেছেন খালিদ হাসান রুমি, স্মরণ বিশ্বাস, শিশির সরকার, তামিম আহমেদ। এছাড়া আলোক পরিকল্পনা করেছেন তানজিল আহমেদ এবং সাউন্ড সিস্টেমে ছিলেন অপূর্ব দে।
নাট্যোৎসবের দ্বিতীয় দিনে সমাজবিজ্ঞানী নাট্যকার ও অভিনেত্রী সামিনা লুৎফা নিত্রাকে অলোক কুমার রায় স্মৃতি পদক প্রদান করা হয়। ১০ দিনব্যাপী এ নাট্যোৎসব চলবে আগামী মঙ্গলবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত। প্রতিদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে নাটক মঞ্চায়িত হবে।
আয়োজনের তৃতীয় দিন মঙ্গলবার জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটারের প্রযোজনায় নাটক ‘চিলেকোঠার সেপাই’, চতুর্থ দিন বুধবার মনিপুরী থিয়েটারের প্রযোজনায় নাটক ‘হ্যাপি ডেজ’, পঞ্চম দিন বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রযোজনায় নাটক ‘দ্য এক্সিডেন্টাল ডেথ অব অ্যান এনার্কিস্ট’, অষ্টম দিন রোববার প্রাচ্যনাট্যের প্রযোজনায় নাটক ‘খোয়াবনামা’ ও নবম দিন সোমবার জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটারের প্রযোজনায় নাটক ‘মলুয়া সুন্দরী’ মঞ্চায়িত হবে।
এছাড়া উৎসবের ষষ্ঠ দিন শুক্রবার জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটারের পুনর্মিলনী ও সপ্তম দিন শনিবার জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটারের গানের প্রযোজনা ‘মধ্যরাতের কবিতা ও গান’ পরিবেশিত হবে। উৎসবের শেষদিন মঙ্গলবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) অনুষ্ঠিত হবে মালেক বয়াতির পরিবেশনায় পালাগান।