ট্যুরিস্ট হটস্পট পুষ্কর

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

ভারতের রাজস্থান রাজ্যে ইতিহাসের স্পর্শময় বহু স্থাপনা ও জনপদের পাশাপাশি রয়েছে দুটি ধর্মীয় পবিত্র স্থান। একটি হল মুসলমানদের কাছে অতীব প্রিয় আজমির শরিফ আর অন্যটি হিন্দুদের তীর্থস্থল পুষ্কর।

ধর্মীয় গুরুত্ব ছাড়াও এসব স্থান প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও স্বাস্থ্যকর আবাস রূপে পরিচিত। যে কারণে সারা বছর পর্যটকদের ভিড় উপচে পড়ে। বিশেষত পুষ্করকে বলা হয় ভারতের ট্যুরিস্ট হটস্পট।

বিজ্ঞাপন

আজমির আর পুষ্কর হল 'প্রাকৃতিক টুইন সিটি'। নাগ পাহাড় আজমির আর পুষ্করকে পৃথক করেছে। পাহাড়ে দুই পাশের দুই উপত্যকায় শহর দু'টি অবস্থিত।

রাজস্থানী ড্রাইভার সুখবিন্দর আজমির থেকে পুষ্কর যেতে ১০ কিলোমিটার পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ পেরুতে জানান নানা তথ্য। বিশেষত, এই মোহনীয় পথে বহু বিখ্যাত হিন্দি ছবির রোমান্টিক দৃশ্যের চিত্রায়ন হয়েছে। মরুভূমির দৃশ্য দেখাতেও বেছে নেওয়া হয়েছে পুষ্করকে। কারণ, পাহাড়ের ঢালে যে পুষ্কর, সেখান থেকে মরুভূমির শুরু। তারপর বিশাল থর মরুভূমি গিয়ে মিশেছে একদিকে কচ্ছের রানে, একদিকে গুজরাতে আর অন্য একদিক দিয়ে পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে।

বিজ্ঞাপন

ফলে ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে পুষ্কর গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে সমতলের সবুজ আর মরুময় ঊষর ভূমির শেষ সাক্ষাত আর কৌশল জনক বহু স্থানে যাওয়ার পথের শুরু। এসব ছাড়াও পুষ্করের রয়েছে ধর্মীয় তাৎপর্য।

হিন্দু শাস্ত্রমতে, সৃষ্টিকর্তা বলে মান্য করা হয় 'প্রজাপতি ব্রহ্মা'কে। ব্রহ্মা ছাড়াও হিন্দুদের আরও ৩৩ কোটি দেবতা আছে বলে পুরাণ অনুযায়ী জানা যায়। সারা পৃথিবীতে যেখানে যত হিন্দু রয়েছে, সেখানেই গড়ে উঠেছে নানা হিন্দু দেবতাদের মন্দির। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, শত শত দেবতার শত শত মন্দির থাকলেও সমগ্র পৃথিবীতে ব্রহ্মার মন্দিরের সংখ্যাটা মাত্র একটিই। রাজস্থানের পুষ্করে এই মন্দিরটি অবস্থিত।

পুষ্করের ব্রহ্মা মন্দির সম্পর্কে অনেক জনশ্রুতি প্রচলিত। জানা যায়, এটি তৈরি করা হয়েছিল সেই ১৪’শ শতকে। স্থানীয়দের বিশ্বাস, মন্দিরটি ২ হাজার বছরের পুরনো। বলা হয়ে থাকে, মন্দিরটি স্বয়ং ঋষি বিশ্বমিত্র তৈরি করেন। সেই প্রাচীন মন্দির আর নেই। ১৮০৯ সালে পার্শ্ববর্তী মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়রের সিন্ধিয়া রাজবংশের মন্ত্রী গোকুল পারেখ মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করেন।

ব্রহ্মা মন্দিরের সামনে মহা ভিড়। ভিড়ের একপাশে দাঁড়িয়ে দেখি শত শত ভক্ত আসা-যাওয়া করছেন। গাঢ় গোলাপি রঙের এই মন্দির ৫০ টি সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে হয়। এর দু'ধারের দোকানে পাওয়া যায় পূজা সামগ্রী। রাজস্থানের লোকশিল্প, রাজপুত তরবারি, ছোরা, ক্যামেল লেদারের সামগ্রী, কাঁসা, পিতলের তৈজসপত্র, বিচিত্র ভাস্কর্য ছড়িয়ে আছে গ্রামীণ হাট বা মেলার আবহে নির্মিত শত শত দোকানে।

ড্রাইভার সুখবিন্দরই জানান, মহাভারত আর রামায়ণেও তীর্থ স্থান হিসেবে উল্লেখ আছে পুষ্করের নাম। তিনি নিয়ে চললেন, মন্দিরের কাছেই পুষ্কর সরোবরে। এর পাড়ে আছে ৫২টি ঘাট । অন্তত ৪০০ মন্দির আছে সরোবরটিকে ঘিরে। আছে মঠ আর মসজিদও।

কথায় কথায় জানা গেলো, পৌরাণিক মতে, ব্রহ্মা একবার যজ্ঞ করবার কথা ঠিক করেন আর হাতের থেকে পদ্মফুল ছুড়ে দেন। তিনি স্থির করেন ফুল যেখানে গিয়ে পড়বে, সেখানেই যজ্ঞ করবেন। ফুলটি এসে পড়ে এখানে (পুষ্করে), যার থেকে দুটো পাপড়ি খসে পড়ে কাছাকাছি দুটি জায়গায়। ফলে তিন জায়গায় সরোবরের সৃষ্টি হয় । ব্রহ্ম কর বা হাত থেকে ফেলা পুষ্প থেকে এর সৃষ্টি বলে এর নাম হলো পুষ্কর। মূল পদ্মটি যেখানে পড়েছিল তার নাম জ্যেষ্ঠ পুষ্কর। এর তিন কিলোমিটার দূরে মধ্যম পুষ্কর। তার পাশেই হল কনিষ্ঠ পুষ্কর। পুষ্করের আরেক নাম এজন্য নীলপদ্ম শহর।

পুষ্করে আরও আছে রঙ্গনাথজির মন্দির, বরাহ মন্দির, রাজবৈকুন্ঠর মন্দির, অষ্টপাটেশ্বর মন্দির ও অজগন্ধেশ্বর মন্দির। অষ্টপাটেশ্বর মন্দির সম্বন্ধে বলা হয়, স্বয়ং ব্রহ্মা নাকি এখানে শিবের অষ্টপটেশ্বর নামে লিঙ্গ স্থাপন করে পূজা করেন।

পুষ্কর সরোবরের পশ্চিম দিকে সাবিত্রী পাহাড় আর উওর দিকে গায়ত্রী পাহাড়। সাবিত্রী পাহাড়ের উপর ব্রহ্মার পত্নী সাবিত্রী মাতার মন্দির। পুষ্করকে মন্দিরের শহর বললে ভুল হয়না।

আজমির থেকে পুষ্করকে পৃথক করেছে যে নাগ পাহাড়, তাতেও রয়েছে অনেক মন্দির। থর মরুভূমির একেবারে ধারে অবস্থিত পুষ্করে সম্মিলিত হয়েছে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক ধারা। এখানে উটের বাজার আর রাজস্থানী লোকজ কারুশিল্পের বিখ্যাত বাজার সারা বছরই বসে। আর চলে বারো মাসে তেরো পার্বণ। পুষ্করে প্রতিদিন কোনও না কোনও মেলা বা মন্দিরের প্রার্থনা চলছেই। ফলে সাংবৎসরিক জনসমাগম এখানকার সাধারণ বৈশিষ্ট্য।

তবে, কার্তিক পূর্ণিমাতে মোহনীয় রূপ ধারণ করে পুরো জনপদ। পুষ্কর সরোবরের পাশে অক্টোবর মাসে ৫ দিন ব্যাপী পুষ্করমেলাও বসে। সে মেলায় গরু, ছাগল আর ভেড়াও বিক্রি হয় বটে, কিন্তু উটকে কেন্দ্র করেই মূলত জমে এই মেলা । এ মেলা শুরুই হয় উট দৌড়ের প্রতিযোগিতা দিয়ে। তাছাড়া পুষ্করে সারা বছরই উটের পিঠে সাওয়ার হয়ে ডেজার্ট সাফারি করা যায়। সারি সারি উট এজন্য বিচিত্র রঙের পোশাকে সজ্জিত হয়ে পর্যটকদের আকর্ষণ করতে অপেক্ষমাণ।

বিশিষ্ট হিন্দুতীর্থ পুষ্কর সম্পূর্ণভাবে আমিষ-বর্জিত এলাকা। মাছ, মাংস, ডিম দূরস্থ, পেয়াজ বা রসুনের গন্ধও পুষ্করে পাওয়া অসম্ভব। তবে বহু রকমের পানীয় পাওয়া যায় পুষ্করে, যার অধিকাংশই রাজস্থান বা থর মরু অঞ্চলের দেশীয় পদ্ধতিতে তৈরি এবং এসবের মধ্যে নেশা ও মাদকতার প্রাধান্য রয়েছে।

ভারতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা জীবনে একবার হলেও বিশ্বের একমাত্র ব্রহ্মা মন্দিরের শহর পুষ্করে আসতে চেষ্টা করেন। ফলে সারা বছরই চলছে ভিড়। ব্রহ্মা মন্দিরের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে দেখতে পাই, জনারণ্যে বিদেশিদের সংখ্যা অনেক। ভারতে যে কয়েকটি স্থান পর্যটক সমাগমের নিরিখে শীর্ষে, পুষ্কর তার অন্যতম। মেলা, লোকশিল্প, লোকজ সামগ্রী আর উত্তর ও পশ্চিম ভারতের গ্রামীণ লোক ঐতিহ্যের ছোঁয়া পেতে বিদেশিরা হোটেলে, তাঁবুতে ঠাঁই নেন।

চলে আসার পথে ক্রমশ অপস্রিয়মাণ পুষ্করের দিকে ফিরে তাকিয়ে দেখি, অস্তায়মান সূর্যের রক্তিমাভা লেকে, পাহাড়ে, মন্দিরের শিখরে সৃষ্টি করেছে এক পৌরাণিক আবহ।