বসন্তের রাজনীতি
বসন্ত। কিন্তু বসন্তে আমার বিশেষ উচ্ছ্বাস নেই। বসন্ত কেন, কোনো ঋতুই আমার কাছে খুব বিশেষ না। হয়তো শৈশবে মুগ্ধ হতাম। কেন হই না বলছি। এইতো কিছুক্ষণ আগেই শুনলাম কবি নির্মলেন্দু গুণ অসুস্থ। ল্যাব এইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কিন্তু তিনি অসুস্থ বলে কি বসন্ত মাঠে মারা যাবে? বিষয়টা এমন না। তবে কেমন? কারণ সবকিছু যেখানে রাজনৈতিক ও সামাজিক সেখানে উনারই একটা কবিতা স্মরণ করি। কবিতার নাম, কালো কোকিলের গল্প।
কালো বোরকা পরা মেয়েদের কালো চোখ
তবু আমাদের চোখে পড়ে
আবুধাবির শপিংমলে আমি চোখের পাশাপাশি
তাদের সুন্দর নাসিকাও দেখেছি।
অথচ এই বৃক্ষমাতৃক বঙ্গদেশে
হে আমার সুরেলা সুকণ্ঠী কোকিল,
আমি কখনো দেখতে পাইনি তোমাকে।
কী করেই-বা তোমাকে দেখব বলো,
তুমি তো জন্মই নিয়েছো
কালো বোরকার চেয়ে কালো পালকে
তোমার ছোট্ট দেহটিকে আবৃত করে।
তোমার চোখ আমাদের চোখেই পড়ে না।
তদুপরি পাতার আড়ালে থাকতে ভালোবাসো তুমি।
বলো তো, তুমি নিজেকে লুকিয়ে রাখো কেন?
কালো বলে?
এটা কোনো কথা হলো?
কালো বলে আফ্রিকার মেয়েরা লুকিয়ে থাকে নাকি?
প্যারিস ও নিউইয়র্কের পথে পথে আমি তো দেখেছি
কালো মেয়েরা বুক ফুলিয়ে, কোমর দুলিয়ে হাঁটছে।
গর্বে তাদের পা পড়ে না মাটিতে।
বসন্তের সঙ্গে তোমার গোপন সম্পর্কের বিষয়টা
আমাকে বলবে? আমি কাউকে বলব না।
জানি, সব মানুষেরই একটা গোপন গল্প থাকে।
তোমারও একটা আছে নিশ্চয়।
তুমিও কি আমার মতো ব্যর্থ হয়েছো কারো প্রেমে?
আমি আমার বুকে হাত রেখে বলছি—
প্রতিটি বসন্ত সমাগমে তোমার কুহুধ্বনি শুনে
আমি তোমার প্রেমে পড়েছি বারবার।
তা তুমি যতই কালো হও, প্রিয়তমা আমার,
যতই তুমি কালো পালকের বোরকা পরে রও—
একদিন নিশ্চয়ই আমি তোমার দেখা পাব।বিজ্ঞাপন
এরমানে বসন্ত মানেই যে সব সুন্দর তেমন মনে হয় গুণদা বলেননি। আমরা শুরুতে কয়েকবছর আগে আরব বসন্তও দেখেছিলাম মরুভূমিতে। পরে দেখি সেটি অরব বসন্ত। আমিও তাই সুন্দর বসন্তের অপেক্ষায়। অবশ্য সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ‘ফুল ফুটুক, আর না-ই ফুটুক আজ বসন্ত’—এই এক লাইন দিয়েই তিনি পপুলার। তার কবিতা আমার যদিও পছন্দ নয়। কেন এই লাইন এত পপুলার? এর ভেতরেই লুকিয়ে আছে আমাদের রাজনৈতিক মনোজাগতিক বাস্তবতা। কিভাবে? মানে বাস্তবতার শর্তপূরণ না হলেও আমরা মাতোয়ারা থাকতে পারি, বলতে পারি ‘বসন্ত’। মানে ফুলহীন কদর্য বসন্ত হলেই আমরা মাতোয়ারা। সুভাষ মুখোপাধ্যায় বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু এই তার কনসাসনেস। বঙ্গে বসন্ত কি পশ্চিম থেকে আমদানি। আমি এ ব্যাপারে নাদান।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো পুরোপুরিই ন্যাচারেলিস্ট। তিনি বলেন, ‘ফুলের বনে যার পাশে যাই/তারেই লাগে ভালো’; আবার তার গানে ‘আহা, আজি এ বসন্তে এত ফুল ফুটে,/এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়,/সখীর হৃদয় কুসুম-কোমল/কার অনাদরে আজি ঝরে যায়।’—মানে বসন্তে হৃদয়ের ঝরাঝরির কথা কেন-বা যাকে তাকেই-বা ভালো লাগার কথা? এমন প্রশ্ন যদিও একটু ‘র রিজন’ দিয়ে তোলা তবু প্রশ্নটা তুলেছিলেন রবীন্দ্রসমালোচক বিপিন বসু (তথ্য: মেলায় ভেলায় রবীন্দ্রনাথ)। প্রমথ চৌধুরী রসিকতা করে বলেছেন, “বাংলার বসন্ত প্রকৃতিতে নেই।” তবে কোথায় আছে? ক্যালেন্ডারের পৃষ্ঠায়।
হুমায়ূন আহমেদের বসন্ত বিলাপ বইতে দেখা যায়, তিনি জানাচ্ছেন যে, রবীন্দ্রনাথের যৌবন ইউরোপে কেটেছে বলেই হয়তো বসন্তবন্দনা। শালবনে বসন্তবরণ, ফুলের নাম দেওয়া এসব। হুমায়ূন অকপটে স্বীকারও করেছেন তিনিও বসন্ত প্রেমিক। লিখেছেন এক জায়গায়ঃ “আহা আজি এ বসন্তে এত ফুল ফুটে/ এত বাঁশি বাজে/ এত পাখি গায়—তিনটি মাত্র লাইনে বসন্ত উপস্থিত। বাঁশি বাজার শব্দও কানে আসা শুরু হয়েছে। আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রিয় ঋতু কি বসন্ত? তাঁর বসন্তবিলাস দেখে আমি অবাকই হই। এই ব্যাকুলতার কারণ কী? বঙ্গদেশে শীত প্রায় নেই বলেই বসন্তও নেই। আমাদের অল্প কিছু পাতাঝরা বৃক্ষ, পত্রহীন গাছে বসন্তকালে নতুন পাতা আসার ব্যাপারটা সে জন্যই অনুপস্থিত বলতে হবে। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন শালবনের ভেতর। শালবনে বসন্তকালে নতুন পাতা আসে—এই দৃশ্য অবশ্যই সুন্দর। তখন কিন্তু পুরনো পাতা ঝরতে থাকে। এই দৃশ্য অতি বিরক্তিকর। এমন কি হতে পারে যে, রবীন্দ্রনাথের বসন্তবিলাসের পরোক্ষ কারণ পশ্চিমের দেশ? যৌবনে রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমের দেশে কাটিয়েছেন। তিনি দেখেছেন ভয়ংকর শীতের পর আনন্দময়ী বসন্তের আগমনের সর্বজনীন উচ্ছ্বাস।”
আমরা যদি ইউরোপের দিকে তাকাই তবে দেখি যে, সেখানে প্রচণ্ড শীতের পর বসন্ত আসে। আমাদের এখানে শীতই তো এখন আর আসে না, আর আসতে না আসতেই বসন্ত। জলবায়ু পরিবর্তন। প্রাণ জুড়ানো হাওয়া কি বইবে বসন্ত দিনের ঢাকায়? কোকিলের ডাকের কথা বাদই দিলাম। হয়তো খুব কমই এ ঋতুর ফুল ফুটেছে। এরমানে বসন্ত সেই আগের চিরচেনা রূপ পেতে হলে জলবায়ু পরিবর্তনের রাজনীতিও আপনাকে করতে হবে আবার এটিও ভাবতে হবে এই মুভমেন্ট মানে গ্রেটা থেনবার্গ ম্যানুফ্যাকচারিং পলিটিক্সের পুতুল কিনা!
এসব পলিটিক্সের ব্যাপারগুলোতে দৃষ্টি দিই পরে, তার আগে দেখি, বসন্তকে ঋতু হিসেবে রাজ বলব কিনা? নিজে রিস্কে গেলাম না, প্রথমে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের লেখায় দৃষ্টি রাখি। তাঁর কৃষ্ণকান্তের উইল উপন্যাসে রোহিনী যখন ঘাটের দিকে যাচ্ছে, তখন হঠাৎ কোকিল ডেকে উঠল। এ কোকিল বসন্তসখা। বঙ্কিমে লিখছেন, “কোকিলের ডাক শুনিলে কতকগুলি বিশ্রী কথা মনে পড়ে। কী যেন হারাইয়াছি। যেন তাই হারাইয়া যাওয়াতে জীবনসর্বস্ব অসাড় হইয়া পড়িয়াছে। যেন তাহা আর পাইব না। যেন কী নাই। কেন যেন নাই। কী যেন হইল না। কী যেন পাইব না। কোথায় যেন রত হারাইয়াছি। কে যেন কাঁদিতে ডাকিতেছে। যেন এ জীবন বৃথায় গেল। সুখের মাত্রা যেন পুরিল না।”
মানে বসন্ত এত সুন্দর যে হারানোর হাহাকারও জাগায়। রোহিনী ভয় পায় তাই। এর বহু পরে সন্দীপন চট্রোপাধ্যায় ‘অনিমিষ একা’ জার্নালে লিখেছেন, “বসন্তকে ঋতুরাজ বলার পক্ষে আমি নই। এ ঋতুতে প্রথম আমি প্রেমে প্রত্যাখাত হই। রাতের ময়দানে হাওয়া বইছিল, আকাশে তারা ছিল, কিন্তু মনে হচ্ছিল গুটিবসন্ত ছেয়েছে আমাকে। ফিরে ফিরে বঙ্কিমের রোহিনীর মুখ ভেসেছিল। বসন্ত যেন হারানোর এক হাওয়া বইয়ে দেওয়া সময়।” এবার আসুন জীবনানন্দ দাশের ‘ক্যাম্পে’ কবিতার কিছুটা দেখি—
এখানে বনের কাছে ক্যাম্প আমি ফেলিয়াছি;
সারারাত দখিনা বাতাসে
আকাশের চাঁদের আলোয়
এক ঘাইহরিণীর ডাক শুনি—
কাহারে সে ডাকে!
কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;
বনের ভিতরে আজ শিকারীরা আসিয়াছে,
আমিও তাদের ঘ্রাণ পাই যেন,
এইখানে বিছানায় শুয়ে-শুয়ে
ঘুম আর আসেনাকো
বসন্তের রাতে।
মানে এক অস্থির সময়ে শিকারীরা ব্যস্ত শিকারে। শিকারীরা কি শিকার খোঁজে ঋতু দেখে? সময় এক মেগাটাইমলাইন। অতীত নেই। বর্তমান নেই। ভবিষ্যত নেই। তবু বসন্ত আসে। এ উৎসবের শুরুই-বা কিভাবে? পেছনে ফিরলে দেখি, মধ্যযুগের বঙ্গে বসন্তবরণের একটি অনুষ্ঠান ছিল বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের ফাল্গুনী পূর্ণিমায়। মধ্যযুগে সম্রাট আকবর বাংলা বর্ষপঞ্জী হিসেবে আকবরি সন বা ফসলী সনের প্রবর্তন করার পর ১৪টি উৎসব পালনেরও রীতি চালু হয়। সেসময়ও বসন্ত উৎসব হতো। সেসময় বাংলার সকল সম্প্রদায়ের মানুষই বসন্তবরণে বিভিন্ন মেলায় অংশ নিতেন। অবশ্য পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ‘প্রান্তজনের সংস্কৃতি’ বইতে তিনি বলছেন, “নবান্নের আগেই কৃষককূলের বুঝতে সমস্যা থাকত না যে সামনের দিনগুলো কেমন যাবে, ফলে ফাল্গুনের শুরুতেই তারা ফসলিজমির সঙ্গে আবহাওয়ার একটা যোগাযোগস্থাপনকারীকে দেখতে শুরু করে এঋতু। দুটি মন্বন্তরে বসন্ত উৎসবকে বয়কটের তথ্যও ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয়। এখানে অর্থনীতি যে সংস্কৃতির সিডিয়েটর সেটি না বুঝতে সমস্যা হয় না।”
শুরুতে রাজনীতির প্রসঙ্গে একটা ইশারা ছিল। এই ইশারার উত্তর আমরা মনে হয় কিছুটা পেয়েছি পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বয়ানে। ভারতীয় নৃতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদ অতুল সুর ‘রুদ্রচণ্ডাল ভাষ্য’ বইতে জানাচ্ছেন, “বসন্তকালকে ঋতুরাজ আখ্যা দেওয়ার মধ্যে রয়েছে যৌনচিন্তানির্ভর রাজনীতি। বসন্তকে যৌনতার অনুকূল আবহাওয়া বান্ধব হিসেবে দেখা হয়েছে।” এর বেশি তিনি কিছু বলেননি।
তবে তার আগে এমনই কথা বলেছেন নীরদ সি চৌধুরী ‘আত্মঘাতী বাঙালী’ বইতে। তিনি বলেছেন, “বাঙালির যেন প্রেম করিতে হইলেও বসন্ত অনিবার্য হইয়া পড়ে।”
কবি আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ কাব্যে দেখি তিনি বলছেন—
মলয়া সমীর হৈলা কামের পদাতি।
মুকুলিত কৈল তবে বৃক্ষ বনস্পতি॥
কুসুমিত কিংশুক সঘন বন লাল।
পুষ্পিত সুরঙ্গ মল্লি লবঙ্গ গুলাল॥
ভ্রমরের ঝঙ্কার কোকিল কলরব।
শুনিতে যুবক মনে জাগে মনোভব॥
তবু বসন্ত। বসন্তের শুভেচ্ছা, বাকি আলাপ বারান্তরে।