সাক্ষাৎকারে সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ
“করপোরেট সাহিত্য, বুরোক্র্যাট সাহিত্য, সবকিছুরই চূড়ান্ত হয়েছে”
অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০-এ প্রকাশিত হয়েছে সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের নতুন কবিতার বই ‘দশ মহাবিদ্যা’। প্রচ্ছদ এঁকেছেন শিল্পী আহমদা মরিয়ম চৌধুরী। ৭২ পৃষ্ঠার বইটির বিনিময় মূল্য ৪০০ টাকা। মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে বৈভবের ৭১৮ নং স্টলে ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকেই বইটি পাওয়া যাচ্ছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ ও তাঁর দশ মহাবিদ্যা প্রসঙ্গে সম্প্রতি নব্বইয়ের মেধাবী কবি কামরুজ্জামান কামু মন্তব্য করেন—“মাইকেল মধুসূদন দত্তের সঙ্গে এই কবির জীবন ও কবিতায় অনেক মিল। জীবিত কবিদের মধ্যে তাঁর সমান ছন্দের ওস্তাদ আর কেউ আছেন বলে আমার জানা নাই।”
বাতিঘর থেকে তাঁর আরেকটি কবিতার বই ‘ছুরিতে ঠিকরানো আঁধিয়ার’—এ বইমেলাতেই প্রকাশ হতে যাচ্ছে। প্রকাশিত ও প্রকাশিতব্য বই দুটি, নিজের লেখালেখি এবং বাংলা সাহিত্যের সাম্প্রতিক হালচাল নিয়ে কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের সঙ্গে কথা বলেছেন বার্তা২৪.কমের অ্যাসিস্ট্যান্ট ফিচার এডিটর রোজেন হাসান
বার্তা২৪: প্রকাশিত ‘দশ মহাবিদ্যা’ বইয়ের কবিতাগুলো সম্পর্কে জানতে চাইব।
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ: ‘দশ মহাবিদ্যা’ একটা সনেট-সিকোয়েন্স। বইটার থিম নারী—ইতিহাস, সাহিত্য, রূপকথা, উপকথা, অভিজ্ঞতা, নানা সূত্রে যত নারী চরিত্রের মুখোমুখি আমি হয়েছি, তারা হঠাৎ অবচেতন ফুঁড়ে চৈতন্যের মাটিতে দাঁড়িয়ে গেছে যেন, ধারালো-সব অস্ত্র, ক্রূর-যত শাস্তি হাতে করে।
বার্তা২৪: দশ মহাবিদ্যা তো দেবীর দশটি রূপকে নির্দেশ করে। শাক্ত ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই দশ মহাবিদ্যা, উত্তর-পৌরাণিক যুগের দেবী ভাবগত পুরাণে পরম সত্তাকে নারীরূপে কল্পনা করা হয়েছে। আপনার এই বইয়ের কবিতাগুলো কি সেই দিকেই মোড় নিতে চেয়েছে?
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ: ঠিক কী চেয়েছে আমার কবিতাগুলো, তা আমি কী করে বলব। বেশ-কিছু কবিতা লেখা হয়েছে নিজে-নিজে প্রায়, কোনো-না-কোনো ইতিহাস-নারী লিখিয়ে নিয়েছে যেন। আবার কিছু লেখা হয়েছে খানিকটা খেলার ছলে, খেলা, ভাষাকে নিয়ে, প্রকাশকে নিয়ে। দশ মহাবিদ্যা আমার কাছে, যেন, নারীসত্তার সম্পূর্ণতা, দশ-প্রহরণ-সমেত দুর্গা, যেন। এখানে নারীকে দেখা হয়েছে নানা-রূপে, নানা-ভাবে, উল্টে-পাল্টে। কখনো খোদ নারীরই চোখ দিয়ে, কখনো পুরুষের, কখনো, বা, এমনকি ঈশ্বরের... যে-ঈশ্বরও, পুরুষ, ধর্ষক, প্রতারক, যে-ঈশ্বর আব্রাহামীয়, হন্তারক, একনায়ক, এবং মিথ্যা। যার ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র নানা রূপ আমরা, পুরুষেরা...
বার্তা২৪: পিতৃতান্ত্রিক সমাজের বিপরীতে মাতৃতান্ত্রিক সমাজের রূপকল্প নিয়ে কি এই বইটিতে কাজ করতে চেয়েছেন?
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ: তা বলা যেতে পারে... তবে তা-ই সব নয় নিশ্চয়ই। তবে পুরুষতন্ত্র, এই বইয়ের তূণে যতগুলি আছে বাণ, তার প্রায় সবক’টির লক্ষ্য।
বার্তা২৪: বইটিতে কয়টি কবিতা আছে, কবিতাগুলো কী কী ছন্দে লেখা হয়েছে?
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ: বইটা চারটা প্রধান পর্বে ভাগ করা, তাতে মোট ১০৫টা সনেট আছে, আর আছে প্রতিটা পর্বের একটা করে প্রবেশক সনেট। একুনে ১০৯। ছন্দ সর্বত্রই অক্ষরবৃত্ত। তবে দুই-এক জায়গায় অক্ষরবৃত্তের মোড়কে গোপনে অন্য ছন্দও আছে। তারা গোপন থাকুক। স্নেহভাক্ হিজল জোবায়ের তাদের ধরে ফেলবার আগ-পর্যন্ত।
বার্তা২৪: ‘ছুরিতে ঠিকরানো আঁধিয়ার’ বইটি সম্পর্কেও জানতে চাইব।
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ: ‘দশ মহাবিদ্যা’র মতো, এটি কোনো থিম-ভিত্তিক বই নয়। কবিতার সঙ্কলন বরং। গত বেশ-কবছর ধরে লেখা নানা কবিতা, যেগুলিকে কোনো বইয়ে পোরা হয় নাই, তারাই হেথা বিরাজমান।
বার্তা২৪: আপনার পূর্ববর্তী কবিতার বইগুলোর সাথে ‘দশ মহাবিদ্যা’ এবং ‘ছুরিতে ঠিকরানো আঁধিয়ার’-এর পার্থক্য আছে কি, থাকলে কী সেই পার্থক্য?
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ: ঠিক ওভাবে নিজের কবিতার ব্যাপারে কথা বলা কঠিন, খানিকটা হঠকারীও বটে সে-চেষ্টা। ‘মহামায়া’ (‘দশ মহাবিদ্যা’-র আদি নাম) যেভাবে লেখা হয়েছে, তেমনভাবে আর কোনো লেখাই আমি লিখিনি। তাই, অন্ততঃ লিখন-প্রক্রিয়ার দিক থেকে এটি অভিনব। আবার ‘ছুরি’-তে বেশ-কিছু লেখা আছে যাদেরকে, আমার কাব্যপরিক্রমায় বেশ বড়-ধরনের উল্লম্ফন বলা যায়, তবে সেগুলি কোনগুলি তা আমি বলব না। এসব বলাবলি অন্যের করবার কথা।
বার্তা: আপনার প্রথম বই তো ছিল চর্যাপদের অনুবাদ—‘অন্তউড়ি’, প্রথম বই হিসেবে কেন চর্যাপদ অনুবাদ-কে বেছে নিয়েছিলেন?
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ: বেছে নিইনি। ইট জাস্ট্ হ্যাপেন্ড দ্যাট ওয়ে। অনুবাদটা হয়ে গেছিল, ভাবলাম বই করি। তখন তো জানিও না বই কিভাবে করে... ওভাবেই।
বার্তা২৪: আপনি একবার বলেছিলেন, বর্তমান সময়ে পুরুষ কবিদের তুলনায় নারী কবিদের কবিতা উৎকৃষ্ট মনে হয় আপনার কাছে, এ বক্তব্যের একটা ব্যাখ্যা দেন। নারী কবিদের কবিতার কী-কী গুণ আপনাকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত করেছে সে বিষয়টি জানতে চাই।
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ: বই নিয়ে আলাপে এই প্রসঙ্গ কেন ঠিক বুঝতে পারলাম না। তবে জবাব দিতে দ্বিধা নাই আমার। নারী কবিদের কবিতা পড়লে মনে হয়, তাদের বলবার আছে কিছু। হয়তো বলবার সব কলাকৌশল আয়ত্ত হয়নি এখনো, কারো-কারো, কিন্তু সেরেফ তারিফাশে তারা লেখে না। ফ্রি তারিফ অবশ্য পায় তারা, কিন্তু সেগুলো আসলে কবিতার নয়, চেকনাইয়ের, হয়তো।
বার্তা২৪: বাংলা সাহিত্যের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আপনার অভিমত কী?
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ: পরিস্থিতি মারহাবা। উন্নয়নের পথে এত ধাপ এগিয়েছে বাংলা সাহিত্য যে এখন পিক্সি-ডাস্ট দরকার, উড়তে। সিঁড়ি আর অবশিষ্ট নাই। করপোরেট সাহিত্য, এনজিও সাহিত্য, বুরোক্র্যাট সাহিত্য, সবকিছুরই চূড়ান্ত হয়েছে। বড়-বড় হাতির দাপাদাপি আমাদের বাদাবনে। আর পাঁচটা শিল্প-মাধ্যম (যথা গান, নাটক, সিনেমা) কবিতাও স্টার-ইজমের তাঁবেতে ঢুকে যখন গেছে, এবার হবে উচ্চ ফলন এবং বিপণন... সামনের সোনালি দিনের ধাঁধায় আমার নয়ন আঁধার।
বার্তা২৪: আপনি কি এখন পরবর্তী কোনো বই নিয়ে কাজ করছেন বা পরিকল্পনা করছেন?
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ: করছি না। বই লেখা আমার পেশা বা নেশা নয়। হলে হয়, নাইলে নাই। লেখা হয় না, সময় হয় না, তার ক্ষোভ খুবই আছে। আশা করি কোনোদিন লিখব। একটা কবিতা... যার অভিঘাতে একজন অন্তত মরে যাবে।