ইসলাম ও মহানবী (সা.) বিষয়ক দু'টি অনন্য অনুবাদগ্রন্থ
আকচার ঘোষণায় ও পোস্টারে আল্লামা, ইসলামি স্কলার, আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বক্তা ইত্যাদি সুপারলেটিভ উপাধি স্বেচ্ছায় ধারণ করে বা আবেগতাড়িত-অনুগত ভক্তদের দ্বারা প্রাপ্ত হয়ে বিচরণকারীদের সংখ্যা বাংলাদেশে নেহাতই কম নয়। ইসলাম সম্পর্কে মৌলিক জ্ঞানের বিষয়ে এদের বুৎপত্তি ও দখল সম্পর্কে প্রশ্ন না করেও তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বলা যায়, বাংলা ভাষায় ইসলামের ধর্মতাত্ত্বিক বা মতাদর্শিক বিষয়ে তত্ত্বপূর্ণ বইপত্র রচনায় এরা পিছিয়ে। যা কিছু প্রকাশ পায়, তা-ও ফাজায়েল (ফজিলত), তাজকিয়া-ওয়াকেয়া(কাহিনি) নির্ভর।
ফলে ইসলামের ফিলসফিক্যাল অ্যাসপেক্টস সম্পর্কে জানতে ভরসা করতে হয় আরবি, ফারসি, উর্দু কিংবা ইংরেজি ভাষার লেখক-পণ্ডিতদের উপর। বাংলা ভাষা ও ইসলাম-চর্চার আলোচনাতেও এই দুঃখজনক সীমাবদ্ধতার বিষয়টি কারোই নজর এড়ায় না।
এমতাবস্থায়, বিশ্বজনীন মানবিকতার ধর্ম ইসলাম প্রসঙ্গে অ্যাকাডেমিক আলোচনার স্পেস বাংলা ভাষায় সংকুচিত। তদুপরি উপযুক্ত লিটারেচার ও রিচার্সের অভাবে হাজার হাজার ভ্রান্তি ভিড় করেছে ইসলাম ও মুসলমানদের ঘিরে। ইসলাম, মৌলবাদ, জেহাদ, সন্ত্রাস, নারী, পর্দা, সুদ ইত্যাদি বহু বিষয়ে সমকালীন বাস্তবতায় যেরূপ চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, তার ইসলাম-সম্মত অথেনটিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পাওয়াও দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইসলাম নিয়ে জ্ঞান-তাত্ত্বিক, বুদ্ধিবৃত্তিক সংলাপেরও সুযোগ থাকছে না এবং শিক্ষিত, প্র্যাকটিসিং মুসলমানদের পক্ষে নানা সমালোচনা ও গুজব প্রতিহত করাও কষ্টকর হচ্ছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, ইসলামের পক্ষে বা বিপক্ষে পদ্ধতিগত, লজিক্যাল লিটারেচারের প্রাধান্যের মধ্যে ওরাল বাক-বিতণ্ডা, হুংকার ও আবেগ-নির্ভর কথামালার প্রাবল্য যে কাজের কাজ কিছুই করতে পারছেনা, এই বোধোদয়ও সংশ্লিষ্টদের মধ্যে হতাশাজনকভাবে অনুপস্থিত, যা ইসলামের বিকৃতি ও বিভ্রান্তিকরণ প্রক্রিয়া ঠেকাতে দারুণভাবে ব্যর্থ। যেকারণে ধর্ম, বিশেষত, ইসলাম ধর্ম যুগপৎ অজ্ঞ অনুসারী ও সুচতুর প্রতিপক্ষের দ্বারা বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সামরিক দিক থেকে সবচেয়ে বেশি অপব্যবহৃত হচ্ছে।
আমাদের মানতেই হবে যে, ধর্মকে পুঁজি করে রাজনীতির নামে সন্ত্রাস সম্ভবত বর্তমান সময়ে মুসলিম বিশ্বে একটি সাধারণ ঘটনা। খারাপ মুদ্রা যেমন বাজারে ভালো মুদ্রাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয় ঠিক তেমনি ইসলামের অপব্যাখ্যাগুলো বর্তমানকালে ইসলামের প্রকৃত বক্তব্য ও ব্যাখ্যাগুলোকে হটিয়ে দিতে তৎপর। যার ফলে, এই আধুনিক যুগে নারীদের অধিকার সঙ্কোচন, ভিন্ন ধর্ম ও মতের মানুষের প্রতি ঘৃণা, আত্মঘাতী হামলা, ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে মানুষ হত্যা করার মত বিষয়গুলোকে ইসলাম সম্মত হিসেবে বিবেচনা করার বা চালিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সাধারণ মুসলমান, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম অনেক ক্ষেত্রে এসব অপব্যাখ্যার দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে আবেগতাড়িতভাবে ভুল পথে অগ্রসর হচ্ছেন। যে কারণে এসব বিভ্রান্তির বিপরীতে ইসলামের সঠিক দিক নির্দেশনা ও যুক্তির অনুসন্ধান করা যেমন যুগের চাহিদা তেমনি ইমানি-ধর্মীয় দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
বিশেষ করে, সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক ইসলাম বা রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার প্রবণতা ইসলাম সম্মত কিনা, তা নিয়েও ঐতিহাসিক ও দার্শনিক আলোচনার অবকাশ রয়েছে। ইসলামের মহান নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) কখনোই আক্রমণাত্মক ভূমিকায় অবতীর্ণ হননি, ইসলাম তরবারির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা পায়নি; এই সত্যগুলোকে পুনরাবিষ্কার করারও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
এমন গবেষণামূলক কাজ আরবি, উর্দু ও ইংরেজি ভাষায় মর্মস্পর্শীভাবে করেছেন ক্যারেন আর্মস্ট্রং, মাওলানা শিবলি নোমানি, সুলাইমান নদভি, আবুল হাসান আলি নদভি প্রমুখ বিদ্বজ্জন। অনুবাদের মাধ্যমে এগুলো বাংলাভাষী পাঠকের হাতে এসেছে। এর বাইরেও সমকালীন প্রেক্ষাপটে ইসলাম নিয়ে সৃজনশীলভাবে মগ্ন দক্ষিণ এশিয়ার দু'জন উল্লেখযোগ্য গবেষক হলেন ইঞ্জিনিয়ার আসগর আলী ও মৌলানা ওয়াহিদুদ্দীন খান।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশিষ্ট ইসলামিক চিন্তাবিদ মৌলানা ওয়াহিদুদ্দীন খান কোরআন, হাদিস ও সুন্নাহর আলোকে ইসলামের মৌলিক বিষয়াবলী ও নবী (স.) জীবনের নানাদিক ফুটিয়ে তুলেছেন। তার উল্লেখযোগ্য দু'টি বই এবারের বইমেলায় বাংলায় অনূদিত হয়ে এসেছে, যার শিরোনাম 'দি প্রফেট অব পিস' (অনিন্দ্য) এবং 'দ্য ট্রু ফেস অব ইসলাম' (অঙ্কুর)।
ইসলামের বিভিন্ন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপব্যাখ্যার বিপরীতে কোরআন-হাদিসের সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়ার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ইসলামের প্রকৃত রূপ ফুটিয়ে তোলার প্রচেষ্টা বইদ্বয়ে সম্পন্ন করা হয়েছে। বিশেষত, বইগুলো পাঠে যে-কোনও ধর্মের মানুষই বুঝতে পারবেন, কেন হযরত মোহাম্মদ (সা.) একজন শান্তির নবী ও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ।
বই দু'টি বাংলা ভাষায় উপস্থাপনের কৃতিত্ব প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আবদুর রশীদের। তার সহলেখক হিসাবে রয়েছেন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী স্টাডিজ বিভাগের তরুণ অধ্যাপক কামরুজ্জামান।
প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আবদুর রশীদ দীর্ঘকাল অধ্যাপনা করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগে। পূর্ব ইউরোপের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি সম্পন্নকারী এই প্রবীণ অধ্যাপক বিভাগীয় সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন তিনি এবং সেখানে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ অ্যাকাডেমিক দায়িত্ব সুচারুভাবে সম্পন্ন করে তিনি সদ্যই কর্ম জীবন শেষ করে অবসর গ্রহণ করেছেন।
প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আবদুর রশীদের তাৎপর্যপূর্ণ কাজের মধ্যে রয়েছে দুই খণ্ডে রচিত 'রাজনৈতিক ও সামাজিক বিজ্ঞান জ্ঞানকোষ' (অনিন্দ্য প্রকাশ)। ২০০৬ সালে 'বাংলাদেশের রাজনীতি: দুঃসময়ের চালচিত্র' এবং ২০০৭ সালে 'বাংলাদেশের রাজনীতি: দুঃসময় উত্তরণ প্রয়াস' শিরোনামে তার দু'টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ২০০৮-২০১৪ সালে 'বাংলাদেশের রাজনীতি: যুদ্ধাপরাধী, জামায়াত এবং জঙ্গি প্রসঙ্গ' শীর্ষক পুস্তকের ১ম থেকে ৬ষ্ঠ খণ্ডের সম্পাদক তিনি।
প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আবদুর রশীদের মৌলিক কাজের সঙ্গে উজ্জ্বল হয়ে আছে একাধিক অনুবাদকর্ম। রাজনীতি ও সামাজিক বিজ্ঞানের সর্বাধুনিক বৈশ্বিক জ্ঞান-প্রবাহকে বাংলা ভাষায় অনুবাদের ক্ষেত্রে তিনি একজন অগ্রগণ্য লেখক। ২০০৯ সালে তিনি অনুবাদ করেন স্যামুয়েল পি. হান্টিংটনের দুনিয়াব্যাপী সমাদৃত গ্রন্থ 'দ্যা ক্লাস অব সিভিলাইজেশনস অ্যান্ড দ্য রিমেকিং অব ওয়ার্ল্ড অর্ডার' এবং নোয়াম চমস্কির 'ফেইল স্টেটস'। ২০১২ সালে তার অনূদিত নোয়াম চমস্কি'র 'ইন্টারভেনশনস' গ্রন্থটি প্রকাশ পায়। ২০১০ সালে জোসেফ ই. স্টিগলিজ'র 'গ্লোবালাইজেশন অ্যান্ড ইটস ডিসকনটেন্টস' এবং ২০১০ সালে স্যামুয়েল পি. হান্টিংটনের ' পলিটিক্যাল অর্ডার ইন চেঞ্জিং সোসাইটিজ'র বাংলা অনুবাদ করেন তিনি।
এখানেই তার কাজের তালিকা শেষ নয়। তিনি ২০১১ সালে কথাসাহিত্যিক 'শহীদুল জহির স্মারকগ্রন্থ' সম্পাদনা করেন। ২০১৪ সালে সম্পাদনা করেন 'শহীদুল জহির সমগ্র'। পাঠক সমাবেশ প্রকাশিত বই দু'টি ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা ও চিত্তরঞ্জন সাহা পুরস্কার লাভ করে।
প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আবদুর রশীদ ২০১২ সালে নেলসন ম্যান্ডেলার 'কনভারসেশনস উইথ মাইসেলফ' এবং ফরিদ জাকারিয়ার 'দ্য ফিউচার অব ফ্রিডম' অনুবাদ করেন। 'জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক স্মারক গ্রন্থ'র তিনি সহযোগী সম্পাদক। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে তিনি অনুবাদ করেন 'হামদুর রহমান কমিশন প্রতিবেদন' (গোধূলি প্রকাশ)।
এ বছর (২০২০) পাঠক সমাবেশ থেকে বের হয়েছে তার অনূদিত জোসেফ ই. স্টিগলিজ'র 'অসাম্যের খেসারত' এবং অনিন্দ্য প্রকাশ থেকে মৌলানা ওয়াহিদুদ্দীন খানের 'দি প্রফেট অব পিস' ও অঙ্কুর প্রকাশনী থেকে 'দ্য ট্রু ফেস অব ইসলাম'।
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ইসলাম ও মুসলমানের যত সমালোচনা হচ্ছে, অন্য কাউকে নিয়ে এতোটা হচ্ছেনা। সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি নিপীড়িত, নিগৃহীত জনগোষ্ঠীও ইসলামের অনুসারী মুসলমানরা। তথাপি, এতো বিরূপতার পরেও বিশ্বে সবচেয়ে দ্রুত বিকাশমান ধর্ম ইসলাম। প্রাচ্য ও প্রতীচীতে দ্রুতলয়ে ইসলামের সবুজ জমিন প্রসারিত হচ্ছে এবং আদি-অন্তহীন নীলাকাশে প্রতিনিয়ত উদ্ভাসিত হচ্ছে মসজিদের শান্তিময় গম্বুজ।
বিরূপতায় ভরা পৃথিবীতে ইসলামের এই বিকাশ শক্তি ও অস্ত্রের বলে হয়নি, হয়েছে অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য ও শক্তিতে। ইসলামের সেই মর্মবাণীর স্পর্শ পাওয়া আজকের আক্রান্ত মুসলিম উম্মাহর জন্য জরুরি। সর্বব্যাপী ইসলাম বিরোধিতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য সর্বাবস্থায় অস্ত্র নয়, ইসলামের প্রকৃত দর্শন ও শিক্ষা আত্মস্থ ও প্রচার করা অপরিহার্য। বাংলা ভাষায় ইসলামের জ্ঞানতত্ত্বীয় গ্রন্থের প্রকাশ বৃদ্ধি পেলে এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সহজ হবে।