বৈশ্বিক ও দেশীয় পটভূমিতে বর্ণালী সাহার প্রথম উপন্যাস
অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০-এ পাঠক সমাবেশ থেকে প্রকাশিতব্য বর্ণালী সাহার প্রথম উপন্যাস ‘দ্যা নর্থ এন্ড’। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী শিবু কুমার শীল। এর আগে ২০১৫ সালে শুদ্ধস্বর থেকে তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘আম্মা ও দূরসম্পর্কের গানগুলি’ প্রকাশিত হলে ঠাসবুনোট ভাষাশৈলি ও গল্প বলার ধরনের জন্য বোদ্ধামহলে বইটি প্রশংসিত হয়।
দীর্ঘ পাঁচ বছর পর অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী এই কথাসাহিত্যিকের নতুন বই বের হতে যাচ্ছে। বার্তা২৪.কমকে বর্ণালী সাহা জানিয়েছেন, দেশীয় প্রেক্ষাপটের সাথে উপন্যাসের বিষয়স্তু ও প্রসঙ্গসমূহে এসে মিশেছে দারিদ্র্য, যুদ্ধ ও উদ্বাস্তু সমস্যাসহ বৈশ্বিক নানা ইস্যু।
তিনি আরো জানান, একদিকে জলবায়ু পরিবর্তন ও শরণার্থীদের পুনর্বাসন নিয়ে সোচ্চার মানুষেরা। অন্যদিকে দেশে দেশে উগ্র জাতীয়তাবাদী ধ্যান ধারণা নতুন করে বৃদ্ধি পাওয়ায় সব রকমের মানবিক বিপর্যয়ের প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠের অনাগ্রহ—এ সবকিছুই অন্তর্গত প্রতিঘাত হয়ে উপন্যাসটিতে উপস্থিত।
প্রকাশিতব্য নতুন উপন্যাস, প্রবাসে তাঁর জীবন যাপন, পঠন-পাঠন ও লেখালেখি নিয়ে সম্প্রতি বার্তা২৪.কমের পক্ষ থেকে বর্ণালী সাহার সাথে কথা বলেছেন কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট শাহ মখদুম
বার্তা২৪: দুটা বইয়ের মাঝখানে পাঁচ বছরের ব্যবধান। এত সময় লাগল কেন?
বর্ণালী সাহা: টানা তিন বছর লিখতে পারি নাই। মানসিক সংকট পার করলাম। অস্ট্রেলিয়া ব্যাক করার পর ইচ্ছা থাকলেও একলা নতুন জীবনের চাপে লেখা অনিয়মিত হয়। অবশ্য আমার সহকর্মীরা উদার ছিল। সপ্তাহে ৩-৪ দিন কাজ করার সুবিধা ছিল। কিন্তু বাকি দিনগুলিতে লেখার চেয়ে পড়ার ইচ্ছা বেশি কাজ করত।
বার্তা২৪: কী পড়লেন?
বর্ণালী সাহা: পড়লাম অস্ট্রেলিয়ার সাহিত্য। অস্ট্রেলিয়ার বড় সাহিত্যিকদেরকে নিবিড় পাঠের সুযোগ আগে হয় নাই। প্যাট্রিক হোয়াইট, লেস মারে, রিচার্ড ফ্লানাগান, জুডিথ রাইট, ডেভিড মালুফ। এই দেশের ল্যান্ডস্ক্যাপ এবং ঘরের ভিতরকার গল্প আমাকে টানে। সম্পূর্ণ না বোঝার অস্বস্তির কারণে অন্য একটা অর্থ পরিগ্রহ করে।
বার্তা২৪: উপন্যাস লিখতে শুরু করলেন কবে?
বর্ণালী সাহা: শেষ দু বছর ধরে লিখলাম ও সম্পাদনা করলাম।
বার্তা২৪: এরমধ্যে আর কিছু লিখেছেন?
বর্ণালী সাহা: এরমধ্যে ইংরেজি আর বাংলায় বেশ কিছু গল্পের খসড়া তৈরি করলাম। এছাড়া একটা অনুবাদে উৎসাহী হয়েছি।
বার্তা২৪: আপনার কাছে আপনার রচিত ইংরেজি সাহিত্যের প্রত্যাশিত পাঠক কারা?
বর্ণালী সাহা: পাঠক কারা হতে পারে এনিয়ে সেভাবে চিন্তা করি নাই। মূলত সাহিত্যিক ফিকশন পড়তে যারা পছন্দ করে এবং বিচিত্র পটভূমি ও বিষয়ের গল্প গ্রহণে সক্ষম—হয়তো তারা।
বার্তা২৪: আপনার প্রথম বই ছিল গল্পের। আবার আপনি কবিতা অনুবাদ করেন। এবার বের হচ্ছে উপন্যাস। কোন মাধ্যমে আসলে সিরিয়াস আপনি।
বর্ণালী সাহা: মূলত গল্প আর উপন্যাস। গল্পের একটা বাস্তব সুবিধা হলো সাতিহ্য সম্পাদকদের তাগাদায় সময় বের করে কিছু না কিছু লেখা হয়ে যায়।
বার্তা২৪: নতুন কী যেন অনুবাদ শুরু করেছেন বললেন...
বর্ণালী সাহা: ভ্যান গঘের লেখা চিঠির সংকলন। থিও’র কাছে লেখা। আর্ট এবং আর্টিস্ট হয়ে ওঠার জার্নি নিয়ে উৎসাহী থাকায় শুরু করি।
বার্তা২৪: প্রকাশিতব্য উপন্যাসটা কলেবরে কেমন হচ্ছে?
বর্ণালী সাহা: খুব বড় না। কমপ্যাক্ট রাখার চেষ্টা করেছি। আবার নভেলাও না এটা। সাধারণত আমার গল্পই তো বেশ বড় হয়, যে কারণে অনেক সময় সাহিত্য পাতায় ছাপানো সম্ভব হয় না।
বার্তা২৪: কথাসাহিত্যে নিজেকে কাদের ধারাবাহিকতা বলে মনে করেন?
বর্ণালী সাহা: বাংলা কথাসাহিত্যে বা যে কোনো সাহিত্যে ধারাবাহিকতা দেখার মতো চোখ বা অবকাশ আমার হয় নাই। প্রভাব তো অনেকের, কিন্তু সেটা ধারা বা পরম্পরা বহন করার মতো কিছু করছি মনে হয় না। ইলিয়াস, শওকত আলী, ওয়ালিউল্লাহ, মাহমুদুল হক দিয়ে আমাদের সাম্প্রতিক গদ্যের রস চেনা শুরু। কিন্তু আমার দৃষ্টি বাংলা গদ্যে বা কথাসাহিত্যে কম নিবদ্ধ। মানে বাংলা গদ্যের পরম্পরা চিহ্নের ওপর কম নিবদ্ধ। কম বয়সে কমলকুমার হতে চাইতাম। আরো কম বয়সে তারাশঙ্কর, বিভূতি, মানিক।
বার্তা২৪: এখনকার কাদের লেখা পড়েন?
বর্ণালী সাহা: এখন যাদের লেখা আলাদা করে সময় নিয়ে পড়ি, তারা হলেন শাহীন আপা (শাহীন আখতার), মাসরুর ভাই (মাসরুর আরেফিন), সাগুফতা শারমীন তানিয়া, মশিউল আলম। শুধু গদ্য বললাম। কবিতা নিয়ে বলতে গেলে খেই হারিয়ে ফেলব। নিজে কবিতা লিখি কম বিধায় মুগ্ধতা অধিক।
বার্তা২৪: আপনার সাহিত্যিক বন্ধুরা কারা?
বর্ণালী সাহা: আমি সাহিত্যিক দেখে বন্ধুত্ব করি না যদিও। সাহিত্যের সূত্রে পরিচয় কিন্তু পরে বন্ধুত্ব বা বন্ধুস্থানীয় হয়েছেন এমন হচ্ছেন—রাইসু (ব্রাত্য রাইসু), হক ভাই (সিদ্ধার্থ হক)। শুভানুধ্যায়ীদের মধ্যে আছেন আফসান চৌধুরী, ওয়াসি আহমেদ। আমি এমনিতে সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে খুব বেশি মানুষ চিনি না।
বার্তা২৪: আপনার উপন্যাসটি মূলত কী নিয়ে?
বর্ণালী সাহা: একদিকে কোপেনহেগেন ও ব্রিস্টল, আরেকদিকে ঢাকার বুকে চলমান রোমান্টিক সাসপেন্স, বন্ধুত্ব, প্রেম ও বিশ্বাসহননের গল্প নিয়ে এই উপন্যাস।
বার্তা২৪: উপন্যাসের পটভূমি নিয়ে আরেকটু শুনতে শুনতে শেষ করি।
বর্ণালী সাহা: দ্যা নর্থ এন্ড উপন্যাসের পটভূমিতে রয়েছেন প্রাক্তন স্কুলশিক্ষিকা রোজম্যারি ইম্যাকুলেট—যাকে কেউ-না-কেউ প্রায় প্রতিদিনই ফোন করত। বলত ইয়েমেনের স্কুলে বাচ্চাদের ওপর শিলাবৃষ্টির মতো বোমাবর্ষণের গল্প, বলত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দুঃখদুর্দশার কথা। কিছু করতে না পেরে একসময় বিশ্বাস করতে শুরু করেন পৃথিবীকে দেওয়ার মতো আর কিছু উনার বাকি নাই। মর্নিং ওয়াকে গিয়ে একদিন ব্রিস্টলের ঝুলন্ত ব্রিজ থেকে উনি লাফিয়ে পড়েন।
ঠিক সেই সময়েই রোজম্যারির ফোটোগ্রাফার নাতি কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শরণার্থীদের ছবি তোলায় ব্যস্ত। এক বিবাহিত বাঙালি উন্নয়নকর্মীর সাথে তার প্রেমের পরিণাম চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা হয়ে কোপেনহেগেন পর্যন্ত একটা বক্ররেখায় সঞ্চারিত।