থিয়েটারকর্মী নয় লেখক পরিচয়ই মুখ্য হোক আমার
অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০-এ প্রকাশিত হয়েছে রুমা মোদকের দুটি গল্পের বই। সময় প্রকাশনী এনেছে তাঁর ‘সেলিব্রেটি অন্ধকারের রোশনাই’ গল্পগ্রন্থটি এবং ‘নদীর নাম ভেড়ামোহনা’ প্রকাশ করেছে পেন্সিল প্রকাশনী। কথাসাহিত্যিক হিসেবে পরিচিতি-লাভের বহু আগে ২০০০ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম বইটি ছিল কবিতার।
দীর্ঘ বিরতি দিয়ে ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘ব্যবচ্ছেদের গল্পগুলি’। দু বছর পর ‘প্রসঙ্গটি বিব্রতকর’, ২০১৮ সালে ‘গোল’ এবং গত বছর প্রকাশিত হয় গল্পগ্রন্থ ‘অন্তর্গত’। এছাড়া ২০১৮ সালে তাঁর তিনটি নাটকের একটি সংকলন প্রকাশিত হয়।
লেখালেখির পাশাপাশি তিনি জীবন সংকেত নামে একটি থিয়েটার গ্রুপের সাথেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত। নতুন প্রকাশিত বই, তাঁর লেখক হয়ে ওঠার বাস্তবতা ও সাংগঠনিক তৎপরতাসহ নানা বিষয়ে সম্প্রতি বার্তা২৪.কমের সাথে কথা বলেছেন রুমা মোদক
বার্তা২৪: আপনি ঠিক কোন পরিবেশ থেকে লেখক হয়ে উঠলেন?
রুমা মোদক: ২০০০ সালে প্রথম বই কবিতার আর ২০২০ সালে সর্বশেষ প্রকাশিত বই গল্পগ্রন্থ। সময়ের অনুপাতে খুবই কম। কিন্তু এখানে মোটেই আমার আক্ষেপের কোনোই ফাঁকফোঁকর নেই। কারণ আমি যে সমাজ পরিবেশে আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা আর বাস, সেখানে সর্বোতভাবেই বাঙালি রক্ষণশীল মধ্যবিত্তের লক্ষ্মণগণ্ডি ভুক্ত এক নারী আমি। কী সামাজিক বাস্তবতা, কী আধাসামন্ত মূল্যবোধ কী সাধ্যের টানাপোড়েন—কোনো আবশ্যিক অনুষঙ্গই আমার লেখক হয়ে ওঠার পক্ষে ছিল না। উত্তরাধিকার সূত্রে কেবল একটি পাঠের ভুবন প্রাপ্তিই ছিল আমার নিজেকে তৈরি করার নিয়ামক। মূলত আমার সমাজ বাস্তবতায় কোনো নারী লেখক হয়ে ওঠে না। সফল গৃহিণী হয়, সফল মা হয়, স্ত্রী হয়। লেখক হয় না। আমি লেখক হয়ে ওঠার চেষ্টা করছি মানে আমি আমার লালিত বাসনা ছুঁয়ে দেখতে পারছি।
বার্তা২৪: দুটি গল্পগ্রন্থ একত্রে প্রকাশ করার কোনো বিশেষ সুবিধা রয়েছে কি?
রুমা মোদক: দুটি গল্পগ্রন্থ একত্রে প্রকাশের বিশেষ সুবিধা কিছু নেই। বরং অসুবিধাই রয়েছে। কোন বইয়ের গল্পগুলোকে আমি ভালো বলব, কোনগুলোকে ভালো বলব না! সবল বা দুর্বল হিসাবে চিহ্নিত করব কোন বইটি—আমার কাছে বিষয়টি খুব কঠিন। কোনো পাঠক যদি অপশন চায় কোন বইটি কিনবে, আমি আসলে দ্বিধাগ্রস্ত হব যে কোনো একটি নির্দিষ্ট করে নাম বলতে।
বার্তা২৪: আপনার নতুন বই দুটি বাংলা কথাসাহিত্যে নতুন কী যোগ করল?
রুমা মোদক: লেখক মূলত তার লেখায় সমকালীন সমাজ ও সময় বাস্তবতাকে ধারণ করেন। একজন লেখক কিন্তু আসলে একজন ইতিহাসবিদ। একটা সময়ের সমাজ মানুষ রাজনৈতিক সমাজনৈতিক বাস্তবতা কী ছিল হাজার বছর পর মানুষ সাহিত্য থেকেই জানবে। যেমন চর্যাপদ থেকে ময়ুরপুচ্ছ পরিহিতা শবরীর কথা আমরা জানি, জানি সেই সমাজ বাস্তবতার কথা, সন্তানের জন্য দুধভাত প্রত্যাশা করাই একজন ঈশ্বরী পাটুনির যেখানে সর্বোচ্চ প্রত্যাশা।
একজন ইতিহাসবিদ যে ইতিহাস লিখেন, রাজরাজড়াদের ইতিহাস সেটি আমার কাছে ইতিহাস নয়। সেদিক থেকে যা লিখছি প্রতিটি লেখাই তো সমকালীন সময় ও সমাজের ভাষ্য হিসাবে নতুন কথাই বলে। সময় যেমন বহমান, সাহিত্য তারই প্রতিনিধি। কোনোভাবেই পুনরাবৃত্তি নয়।
বার্তা২৪: আপনি তো হবিগঞ্জে থাকছেন। ঢাকার বাইরে থেকে সাহিত্যচর্চা করে মেইনস্ট্রিমে থাকা যাচ্ছে তাহলে?
রুমা মোদক: এখন তো প্রযুক্তির কল্যাণে হাতের মুঠোয় বিশ্ব। এক স্মার্টফোনে নিমিষে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু আমার সামনে দৃশ্যমান। আমি চাইলেই নিজেকে বিশ্বের দর্পণে যাচাই করে নিতে পারছি। চাইলেও এখন পারস্পরিক বিচ্ছিন্ন থাকার সুযোগ নেই। অন্তত যোগাযোগের ক্ষেত্রে পুরো পৃথিবীটা এখন একটা গ্রাম।
সাহিত্যের ক্ষেত্রে দেখুন, নার্সিজমে মগ্ন না থেকে আমি বিশ্বসাহিত্যের সংযোগে প্রতিনিয়ত নিজেকে আপডেট করতে পারছি। আমার লেখার মান যাচাই করতে পারছি, বুঝতে পারছি আমি সোকল্ড মফস্বলে পড়ে আছি নাকি নিজেকে মেইনস্ট্রিমে যুক্ত করতে পেরেছি।
বার্তা২৪: হবিগঞ্জে আপনি একটি থিয়েটারের সাথে যুক্ত। থিয়েটারে আপনার কাজ কী?
রুমা মোদক: আমি সিরিয়াস থিয়েটার কর্মী। যদিও লেখাটাই আমার মূল কাজ। মঞ্চের জন্য নাটকই লিখি। আমি বারবার বলি আমি লেখার মানুষ। আমার লেখা মঞ্চনাটকের সংখ্যা বিশটিরও অধিক। আমরা পুরো পরিবার থিয়েটার করি। থিয়েটার আমার অন্য আইডেন্টিটি৷ ভালোবাসা এবং আবেগ। থিয়েটার অঙ্গনের বন্ধু, সুহৃদ, সহকর্মী, সহযোদ্ধা, গুরুজনেরা আমাকে ভীষণভাবে উৎসাহিত করেন৷ থিয়েটারকর্মীদের বিরাট অংশ আমার লেখার পাঠক।
তবে আমার একটা বেদনার জায়গা আছে। আমি হতে চাই, হতে চেয়েছি লেখক কিন্তু থিয়েটার এক্টিভিজম আমার লেখক পরিচয়কে বারবার ছাপিয়ে যায়। আমার যত পুরস্কার সম্মাননা থিয়েটার থেকেই। বিভিন্ন মিডিয়া আমাকে ডাকে থিয়েটার নিয়ে কথা বলার জন্যই। আমার লেখক পরিচয়টা মুখ্য হোক এটাই চাই। মঞ্চের জন্যও তো আমি মূলত লিখিই।