আমার দেখা মুক্তিযুদ্ধ



ফরিদ কবির
অলঙ্করণ: কাজী যুবাইর মাহমুদ

অলঙ্করণ: কাজী যুবাইর মাহমুদ

  • Font increase
  • Font Decrease

২৫ মার্চ সকাল থেকেই শুনছি কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে।

সকালে আব্বুজি আম্মাকে বললেন, তুমি ফরিদ-শরিফরে লয়া আইনথা চইলা যাও। শুনে আম্মা বললেন, কী কও? নিজের ঘর রাইখা আমি যামু না। এর চাইতে এক কাম করো, তুমি ফরিদ-শরিফরে আইনথায় রাইখা আসো। আইন্তা কেরানিগঞ্জের একটা ছোট্ট গ্রাম। বুড়িগঙ্গার ওপারেই।

আমাদের যাওয়া নিয়া দুজনে কিছুক্ষণ তর্কবিতর্কে জড়িয়ে গেলে কায়কোবাদ কাকা বললেন, ভাবী, আপনে আর দাদায় বাচ্চাগো লয়া আইনথায় যান গা। আমি বাড়ি পাহারা দিমুনে।

আম্মা কিছুতেই যাবেন না। তিনি বলেন, সংসার রাইখা আমি যামু না।

শেষ পর্যন্ত আম্মা গেলেন না। দুপুরের দিকে আমার নানা এসে হাজির। বললেন, সবতে আমার লগে চল। ঢাকা টাউনে থাকনের কাম নাই।

কিন্তু আম্মা যেতে রাজি হলেন না। তিনি আমাকে আর শরিফকে পাঠিয়ে দিলেন।

আমরা ২৫ মার্চ দুপুরে খেয়ে-দেয়েই নানার সঙ্গে কেরানিগঞ্জে নানাবাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলাম। জিন্দাবাহার থেকে ভিক্টোরিয়া পার্ক বেশ দূরেই। কিন্তু নানা আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে হেঁটেই রওনা হলেন। ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকে বাস লোহার পুল হয়ে নারায়ণগঞ্জ যেত। আমরা মার্চের তীব্র গরমের মধ্যেই হেঁটে এসে ভিক্টোরিয়া পার্কের বাসস্টেশনে পৌঁছলাম। বাস স্টেশন ছিল লোকে লোকারণ্য। একটা করে বাস আসে, আর মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে তাতে। নানা আমাদের দু ভাইকে নিয়ে অনেক কষ্টে একটা বাসে উঠলেন। আমরা কোনো সিট পেলাম না। শরিফের তখন মাত্র ৭-৮ বছর বয়স। প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে ও হাঁসফাঁস করছিল। নানা সিটে বসে থাকা একটা লোককে বললেন, বাবা, আমার নাতিটাকে আপনার কোলে দেই?

লোকটা শরিফের দিকে এক নজর দেখে বললো, আচ্ছা, দেন।

নানা শরিফকে সেই লোকের কোলে বসিয়ে দিলেন। আমাকে বললেন, চল, সামনে কুনু বাসস্টপে সিট খালি হইলে তরে বসায়া দিমুনে।

নানা এক হাতে বাসের হাতল ধরলেন অন্য হাতে আমাকে।

বাস এসে মুন্সিখোলায় নামল। আমরা কোনো বাসস্টপেই লোকজন ঠেলে খালি সিটে বসতে পারলাম না।

মুন্সিখোলা থেকে বুড়িগঙ্গা পার হতে হবে আমাদেরকে। নদীর ওপার থেকে মাইল দেড়েক হাঁটাপথ। গ্রামের নাম আইন্তা। ছোট্ট একটা গ্রাম। এর মধ্যে ভূঁইয়া বাড়িই তুলনায় বড়।

আমার নানার পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে একদম বড়টাকে আমরা দেখিনি। পরের জন থাকেন পুরোনো ঢাকার কায়েৎটুলিতে। বাকি তিন ভাই তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে আইন্তায়ই থাকেন।

আমরা যখন মুন্সিখোলায় নামি তখন বিকেল। কিন্তু মার্চের বিকেল। সূর্য পশ্চিমদিকে হেলে পড়লেও তার তেজ এতোটুকু কমেনি। তীব্র গরমে আমরা বেশ কাহিল। শরিফকে খুবই বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। ও এমনিতেই শুকনো, চিকনা-চাকনা। সেই দুপুরে আমরা খেয়ে-দেয়ে জিন্দাবাহার থেকে বেরিয়েছি। পথে আমাদের মুখে আর কিছু পড়েনি। শরিফের মুখ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।

মুন্সিখোলা ঘাটেও অসম্ভব ভিড়। অনেকবার আমি এ পথে নানাবাড়ি গেছি। এত ভিড় কখনো দেখিনি। আমি শুধু এটুকু শুনেছি, আজ রাতে ভয়ংকর একটা কিছু ঘটতে চলেছে। কী ঘটবে, কেন ঘটবে তার কিছুই জানি না।

কায়কোবাদ কাকা আর আব্বুজির কথা থেকে জেনেছি আর্মিরা হামলা করতে পারে। তখন থেকেই আমার মনে একটাই প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে, আমরা কী দোষ করেছি? আর্মি আমাদের ওপর কেন হামলা করবে? এর উত্তর জানা নাই। আম্মা আর আব্বুজি ঢাকা টাউনে রয়ে গেছেন। রয়ে গেছেন কায়কোবাদ কাকাও। তাদের কোনো বিপদ হয় কিনা—এ নিয়ে একটা ভয় থেকে থেকেই আমাকে বিষণ্ণ করে ফেলছে।

অনেকক্ষণ হলো আমরা মুন্সিখোলা ঘাটে এসেছি। গিজগিজ করছে লোকে। নানান বয়সী। অনেকের সঙ্গেই বিশাল বিশাল ব্যাগ। দেখে মনে হবে পুরো সংসারটাই সঙ্গে নিয়ে ফিরছেন। ঈদ-পার্বণের সময় এমনটা দেখা যায়। বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে সবাই গ্রামের বাড়িতে আসেন। কিন্তু তখন সবার চোখে-মুখে যেমনটা হাসি-খুশি ভাব থাকে, আজ তেমনটা মনে হচ্ছে না। সবার চোখে-মুখেই কেমন আতঙ্কের ছাপ। অবশ্য সেটা বড়দের মধ্যেই। তাদের সঙ্গে থাকা ছোটরা ঠিকই নদীর পাড়ে খোলামেলা জায়গা পেয়ে ছুটোছুটি করছে।

ব্যতিক্রম শুধু শরিফ। ও চুপচাপ আমার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। একবার আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো, আমরা কখন যামু?

আমি বলেছিলাম, দেখছ না, নাওয়ে অনেক ভিড়।

সূর্য যখন প্রায় ডুবুডুবু তখন আমরা একটা নৌকায় উঠতে পারলাম। নৌকার মাঝি নানারই পরিচিত কেউ। তাকে দেখেই মাঝি চেঁচিয়ে উঠেছিলেন, খসরু বাই, আমার নাওয়ে আহেন।

নানা তার চিৎকার শুনেই আমাকে আর শরিফকে নিয়ে দ্রুত সেই নৌকার দিকে এগোলেন। কিন্তু ইচ্ছে করলেই কি ওঠা যায়! নৌকা পাড়ে ভিড়তেই ভিড় সেদিকে হামলে পড়ল। মাঝি এক হাতে ভিড় ঠেলে আমাদেরকে নৌকায় ওঠার জন্য আরেকটা হাত বাড়িয়ে দিলেন।

মাঝি যখন নৌকা ছাড়লেন তখন সেটা প্রায় ডুবুডুবু অবস্থা। নানার দিকে তাকিয়ে দেখি তিনি বিড়বিড় করে সুরা পড়ছেন। আমার কেন জানি মনে হলো, আমাদের নৌকাটা ডুবে যাবে। নানার দেখাদেখি আমিও সুরা পড়তে শুরু করলাম। দুটো সুরা তখন আমার মুখস্ত ছিল। সুরা ফাতিহা আর সুরা ইখলাস। আমি সে দুটোই পড়তে শুরু করলাম।

ঠিক সে সময় একটা লঞ্চ আমাদের প্রায় গা ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। সদরঘাটের দিকে যাচ্ছে সেটা। লঞ্চের একটা বিশাল ঢেউ এগিয়ে আসছে আমাদের নৌকার দিকে। সন্ধ্যের আবছা আলো-ছায়াতেও বুড়িগঙ্গার ঢেউকে মনে হলো সমুদ্রের এক বিশাল ঢেউ। সমুদ্র আমি সামনাসামনি কখনো দেখিনি। সমুদ্র সম্পর্কে আমার ধারণা জোছনা খালাম্মার বাড়িতে টেলিভিশন দেখে। আমি চোখ বুঝলাম। মনে হলো, শক্ত একটা কিছুর সঙ্গে ধাক্কা খেলো আমাদের নৌাকাটা। তারপর থেমে গেল। সেই ধাক্কায় টাল সামলাতে না পেরে আমি প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম। কেউ একজন আমাকে ধরে ফেলল। চোখ খুলতে দেখি, একটা লোক মিটমিট করে হাসছে।

নৌকা ডোবেনি। সেটা পাড়ে এসে লেগেছে। আমি হাঁফ ছাড়লাম।

আইন্তায় যখন এসে পৌঁছলাম তখন চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেছে। ঘরে ঢুকতেই নানি ঘরের ঠিলা থেকে পিতলের একটা গ্লাসে পানি ঢেলে শরিফের দিকে এগিয়ে দিলেন। তারপর নানার দিকে তাকিয়ে বললেন, আহা রে, আমার নাতিটার মুখ এক্কেরে হুগায়া গেছে গা। অরে আপনে কিছু খিলান নাই?

নানা বিরক্তমুখে বললেন, আরে, রাস্তায় কিছু আছে নিহি। মানু জান লয়া পলাইতাছে।

শরিফ পানি খাওয়া শেষ করলে নানি আমাকেও এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলেন। তারপর নানাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনেরও যেমুন কথা। নাতি গো একটা লেবেঞ্চুশও তো মানু কিনা দেয়। কন যে বুইলা গেছিলেন গা।

নানা এসব কথার কোনো জবাব না দিয়ে পাঞ্জাবি খুলতে খুলতে বললেন, হুমায়ুন ফিরছে?

হুমায়ুন আমাদের একমাত্র মামা। তিনি শ্যামপুরের সাত্তার ম্যাচ ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন।

নানি বললেন, না ফিরে নাই তো। আপনে ইট্টু গিয়া দেখেন না, গোলে আইছে নিহি।

গোলে মিয়া আমাদেরই কী রকম আত্মীয়। আমরা ডাকি গোলে ভাই। গোলে ভাইও সাত্তার ম্যাচ ফ্যাক্টরিতেই কাজ করেন।

নানা পাঞ্জাবিটা আবার পরে নিলেন। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

আমিও জামাকাপড় বদলে বাইরে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছি। নানি জিজ্ঞেস করলেন, কী তর সইতাছে না? আগে খায়া-দায়া ল, তারপর যাইছ।

আমি বললাম, আপনে খাওন বাড়তে থাকেন আমি অহনই আইতাছি। এক লৌড়ে যামু, আরেক লৌড়ে আমু।

নানি বললেন, হ তর লৌড় তো জানা আছে। আক্কু-মুজাহিদ গো পাইলে তর তো আর উঁশ থাকব না। আমি কই, খায়া-দায়া তারপর বাইরে যা। নানি সাহিদা খালাম্মার উদ্দেশে চেঁচিয়ে বললেন, সাহিদা, ফরিদ-শরিফ রে খাওন দে।

আমি নিজের জামা-কাপড় বদলালেও নানি শরিফের শার্ট খুলে ওকে একটা গেঞ্জি পরিয়ে দিলেন।

খেয়ে দেয়েই আমি ছুটলাম মুজাহিদের খোঁজে। মুজাহিদ আমারই সমবয়সী। আক্কু, মানে আকতারও আমার সমবয়সী। আকতার সম্পর্কে আমার মামাতো ভাই। আমার মায়ের চাচাতো ভাইয়ের ছেলে। মুজাহিদ আর আক্কু দুজনকেই পাওয়া গেল।

আমরা ভূঁইয়া বাড়ির কবরস্থানের এক পাশে বসলাম। আমাদের সঙ্গে এসে যুক্ত হলো আরো কয়েকজন।

রাতে হুমায়ূন মামা ফিরলেন না। নানিকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, হুমায়ূন মনে অয়, তগো বাড়িতই গেছে।

আমি হুমায়ূন মামার ঘরেই ঘুমুতে গেলাম।

অনেক রাতে হৈ-চৈ আর গোলাগুলির শব্দে ঘুম ভাঙল। আমি উঠে বসলাম। প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ হচ্ছে। ঘরের বাইরে অনেক লোকের কথা শোনা যাচ্ছে। আমি উঠে দরোজা খুললাম। ঘরের বাইরে অসংখ্য মানুষ। আমরা সবাই ‘বন্দে’ চলে গেলাম। সেখানে আশেপাশের বাড়ির মানুষেরাও ভিড় করেছে। দূরে ঢাকা টাউনের যতটুকু দেখা যায়, সেখানে কিছুক্ষণ পরপরই আগুনের ঝিলিক দেখা যাচ্ছে। সঙ্গে দ্রিম-দ্রিম-টা-টা-টাস-টাস শব্দে গুলি আর বোমার আওয়াজ। শহরের একটা জায়গায় আগুনের শিখা আকাশ ছুঁয়েছে। দাউ-দাউ করে বাড়িঘর পুড়ছে! কোথায় আগুন লেগেছে, কারা গুলি করছে, কাদের করছে কিছুই বুঝতে পারছি না।

হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে সেন্টুকে দেখলাম। সেন্টু সম্পর্কে আমার মামা। আমার মায়ের চাচাতো ভাই। বয়সে আমার বেশ কিছুটা বড় হলেও আমি ওকে নাম ধরেই ডাকি। ওকে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, কী অইছে রে? এত্তো গুল্লি কারা মারতাছে?

সেন্টু আমার কানের কাছে মুখ রেখে ফিসফিস করে বলল, আর্মি গুল্লি করতাছে। ডাকা টাউনের সবতেরে মাইরা ফালাইতাছে।

মাইরা ফালাইতাছে! ক্যান? আমি অবাক হয়ে গেলাম।

সেন্টু ভয়ার্ত গলায় বললো, শেখ মুজিবরে যারা ভোট দিছে, তাগো সবাইরেই নাকি মাইরা ফালাইতাছে! দ্যাখতাছস না, বাড়ি-গরে আগুন লাগায়া দিছে।

শুনেই আমার বুক ধরাস করে উঠল। আমার আম্মা-আব্বুজি তো ঢাকায়! তাদেরকেও মেরে ফেলবে নাকি আর্মি?

কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব সেন্টু দিতে পারবে না। আমি দৌড়ে ঘরে ফিরলাম। নানা-নানি কেউ ঘরে নেই। শরিফ বিছানায় জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে।

আমাকে দেখেই জিজ্ঞেস করলো, কী অইছে, ভাইয়া?

আমি বললাম, কিছু অয় নাই। তুই ঘুমা। আর্মিরা গুল্লি করতাছে। ঘর থেইকা বাইর অইছ না কলাম। ঘরে থাকিছ। আমি নানিরে বিছরায়া লয়া আইতাছি।

ঘরের বাইরে বের হতেই পুঁটি খালাম্মাদের আঙিনায় দেখা গেলো একটা ভিড় জমাট বেঁধে আছে। সেখানে গিয়ে নানির দেখা পাওয়া গেল। তবে তিনি কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলেন না। তিনি মাটি থাপড়াতে থাপড়াতে চিৎকার করে কাঁদছিলেন আর কিছুটা সুর করে গাইছিলেন, আমার মিনার কী অইবো রে খোদা। আমার হুমায়ূনের কী অইবো...!

উপস্থিত লোকজন তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল, আরে, মিনার কিছু অইবো না। আপনে আল্লা আল্লা করেন। আয়াতুল কুরসি পড়েন। আরেকজন তাকে টেনে তোলার চেষ্টা করছিলেন। মুখে বলছিলেন, ও ফুপু, গরে চলেন, মিনা আপার কিছু অইবো না। চলেন, গরে চলেন।

নানি কিছুতে উঠবেন না। তিনি চিৎকার করে কাঁদতে থাকলেন।

নানির কান্না দেখে আমার কিছুটা ভয় লাগতে শুরু করলো। আম্মা-আব্বুজি ঠিক আছে তো? কায়কোবাদ কাকা? হুমায়ূন মামা?

বুকের ভেতরটা ঢিবঢিব করতে লাগল।

আমি ভয় আর আশঙ্কা নিয়েই এক সময় ঘুমুতে গেলাম। কিন্তু ভূঁইয়া বাড়ির মানুষ সারা রাত ঘুমুল না। সারা রাতই ঘরের চারপাশে তাদের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম।

ভোরবেলা ঘুম ভাঙল গোলাগুলি আর অসংখ্য মানুষের কথাবার্তা শুনে। বিছানা থেকে উঠে দেখি দরোজা খোলা। বিছানা ছেড়ে দরোজার বাইরে গিয়ে দেখি, বাড়ির সবাই জেগে। কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে আছে এখানে সেখানে। আমাকে দেখে আক্কু এগিয়ে এসে বলল, তুই গুমাইতাছোস? পাকিস্তান আর্মি তো ঢাকা টাউনে হাজার হাজার মানু মাইরা ফালাইছে। তারপর আস্তে আস্তে এইদিকে আইতাছে। লোকজন ঢাকা ছাইড়া পলাইতাছে।

আমি বললাম, লোকজন পলাইতাছে ক্যামনে বুঝলি?

আক্কু বললো, আমার লগে আয়।

আক্কুর পেছনে পেছনে আমি বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়ালাম।

অসংখ্য মানুষের সারি ভূঁইয়া বাড়ির লাগোয়া সড়কে। নদী পার হয়ে তারা ছুটছে। কারো কারোর শরীরে গুলি লেগেছে। ছেলে-বুড়ো সবার চোখেই আতঙ্ক।

পাকিস্তান আর্মি কেন নির্বিচারে সবাইকে মারছে এটা বুঝতে আমার আরো কয়েকদিন লাগল। এও জানলাম, বাঙালিদের নেতা শেখ মুজিবকে আটক করে পাকিস্তান নিয়ে গেছে আর্মিরা। তিনি জীবিত আছেন, নাকি তাকে আর্মিরা মেরে ফেলেছে কেউ কলতে পারছে না।

সেদিন দুপুরের মধ্যেই ভূঁইয়া বাড়ি লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠল।

শুনলাম ঢাকায় কার্ফিউ চলছে। কার্ফিউ কী জানতাম না। মুজাহিদকে জিজ্ঞেস করলে সে বলল, কার্ফিউ মানে অইলো, কেউ গরের থন বাইর অইতে পারব না। বাইর অইলেই আর্মি তারে গুল্লি কইরা মাইরা ফালাইব।

নিজেকে খুব বোকা বোকা লাগল! কত কিছুই যে জানি না আমি!

সন্ধ্যার একটু পরেই একটা খ্রিস্টান পরিবার আমাদের ভূঁইয়া বাড়িতে এলো। ভদ্ররোকের নাম অশোক খান। ‘খান’ কিভাবে খ্রিস্টান হয় ভেবে পেলাম না। শুনলাম তিনি সাত্তার ম্যাচ ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন। হুমায়ূন মামার বস। সঙ্গে আছেন তার স্ত্রী, দুই ছেলে মিখায়েল ও প্রিন্স, আর এক মেয়ে ঝর্না। ঝর্না আর মিখায়েল আমাদেরই বয়সী। প্রিন্স কিছুটা ছোট।

তা হোক, আমাদের বন্ধুদের দল ভারি হয়ে গেল।

দেশে তখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। হুমায়ূন মামা ঢাকা থেকে ফিরতে পারলেন না। আমরা ভয়ানক দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়লাম। পাকিস্তান আর্মির নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের মধ্যে তারা বেঁচে আছেন কিনা আমরা জানতে পারছি না।

যুদ্ধ শুরু হবার ছয় দিনের মাথায় হুমায়ূন মামা আইন্তায় ফিরে এলে আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। তিনি জানালেন, ঢাকায় আম্মা-আব্বুজিসহ আমাদের আত্মীয়-স্বজনরা ভালো আছেন। তবে, হাজার হাজার লোক মারা গেছে। হুমায়ূন মামা আসার সময় কতগুলি লাশ রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেছেন তার বিবরণ দিলেন। গ্রামের লোকজন ভিড় করে তার গল্প শুনছিল।

ভূঁইয়াবাড়ির লাগোয়া সড়ক দিয়ে ঢাকা থেকে হাজার হাজার মানুষের মিছিল দিন দিন বাড়ছিলোই। নদী পার হয়ে এ পথে ঢাকা ছেড়ে পালাচ্ছিলেন অসংখ্য মানুষ।

কিন্তু আম্মা আর আব্বুজি গ্রামে এলেন না। তারা থেকে গেলেন ঢাকা শহরেই।
জুন মাসের শেষের দিকে আমরা ঢাকা ফিরলাম।

আমাদের বাসার দরোজায় দেখলাম, লাল কালি দিয়ে উর্দু ভাষায় বিশাল করে লেখা আছে, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ।’ তার একটু ওপরে আরবিতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।’ আব্বুজির হাতের লেখা।

অনেকদিন পর ঢাকায় নিজের বাসায় ফিরে বেশ ভালো লাগছিল।

আমাদের বাসায় কোনো রেডিও ছিল না। বাসায় এসে দেখি আমাদের টেবিলের ওপর রাখা আছে নতুন একটা রেডিও। ফিলিপস ব্রান্ডের।

হঠাৎ রেডিও কেনা হলো কেন তা সন্ধ্যে হতেই বোঝা গেল।

কায়কোবাদ কাকা অনেক কসরৎ করে একটা স্টেশন ধরলেন। শুনলাম, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র সেটা।

রাজনীতি বিষয়ে আমার বিশেষ কোনো জ্ঞান বা উৎসাহ কিছুই সে বয়সে ছিল না। কিন্তু পাকিস্তান আর্মির নির্বিচার হত্যাকাণ্ড আর অত্যাচার-নির্যাতনের নানা বর্ণনা আমার কানে আসছিল। ফলে পাকিস্তান বাহিনীর প্রতি একটা ঘৃণা মনের মধ্যে কিভাবে যেন জায়গা করে নিচ্ছিল।

আইন্তায় থাকতেই কারোর মুখে শুনেছিলাম, আর্মিদের বিরুদ্ধে আমাদের দেশের মানুষ যুদ্ধ করছে। কোনো কোনো জায়গায় যুদ্ধ হচ্ছে, কত পাকবাহিনী মারা যাচ্ছে তার খবর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করা হয়।

আইন্তায়, মানে নানাবাড়ি থাকতে স্বাধীন বাংলা কেতার কেন্দ্র কখনো শোনা হয়নি। কার ঘরে কখন রেডিও ছেড়ে এই স্টেশনের খবর শোনা হয় তা আমরা কখনো জানতে পারিনি! হয়তো খুব গোপনে এই স্টেশন শোনা হয়। অবশ্য গ্রামে থাকতে আমরা এসব খবর শোনার ব্যাপারে খুব যে আগ্রহী ছিলাম তাও না। সন্ধ্যের পর আমরা সমবয়সীরা নানান খেলায় মেতে উঠতাম। স্কুল নেই, পড়া নেই। আমাদের তখন আনন্দ আর আনন্দ।

জিন্দাবাহারে নিজেদের বাসায় ফিরে আসার পর আমাদের বাইরে যাবার উপায় ছিল না। ঘরেই থাকতে হতো। ফলে, কায়কোবাদ কাকা যখন স্বাধীন বাংলা বা বিবিসি বা ভয়েস অব আমেরিকা ধরতেন আমরাও তখন তা শুনতাম। আমাদের ছোট ঘরটিতে রেডিও শোনার জন্য আশেপাশের অনেক মানুষ জড়ো হতেন। পাশের বাসার সাহিদা আপার বাবা মনছুর খলিফা অবধারিতভাবেই উপস্থিত থাকতেন। কায়কোবাদ কাকার সাথে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ করতেন।

কায়কোবাদ কাকা খুব মনোযোগ দিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানগুলো শুনতেন। খবর আর গান ছাড়াও শুনতেন চরমপত্র ও জল্লাদের দরবার।

কায়কোবাদ কাকা আর মনছুর খলিফার আলাপ আমিও কেন জানি না মনোযোগ দিয়ে শুনতাম। তাদের আলাপ থেকেই জেনেছিলাম, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। বিভিন্ন জায়গায় পাকসেনারা ‘গাবুর মাইর’ খাচ্ছে।

আব্বুজি স্বাধীন বাংলার খবর খুব একটা বিশ্বাস করতেন না। তিনি বলতেন, এইগুলি একদমই ফালতু খবর। পাক আর্মিরা অনেক শক্তিশালী। তাদের কাছে আছে আধুনিক সব অস্ত্রশস্ত্র। কোনো ট্রেনিং ছাড়া বাঙালিরা তাদের ধরে ধরে মেরে ফেলছে এটা কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্য না।

কায়কোবাদ কাকা বলতেন, দাদা, গেরিলাযুদ্ধের কাছে কুনু কিছুই টিকব না। আপনের পাঞ্জাব রেজিমেন্ট আর মিলিশিয়ারা দেইখেন ক্যামনে জান লয়া পলায়।

কয়েক মাস পার হতেই কায়কোবাদ কাকার কথাই সত্যি প্রমাণ হতে শুরু করল। সারা দেশে ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে এবং বিভিন্ন জায়গায় পাকবাহিনীর আত্মসমর্পন করার খবর শুনছিলাম।

বিজয়ের দিন

ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে আমরা আবার আমরা নানাবাড়ি আইন্তাতেই ফিরে গেলাম। মার্চের দিকে যখন এসেছিলাম তখন মানুষের মধ্যে যে আতঙ্ক দেখেছিলাম সেটা আর নেই। মানুষ অপেক্ষা করছে, কখন পাকিস্তানি হানাদাররা সারেন্ডার করে।

ডিসেম্বরের তের-চৌদ্দ তারিখের দিকে পাকসেনাদের ওপর বিমান হামলাও তীব্র হয়ে উঠল। সাঁ-সাঁ করে যখন মিগ টুয়েন্টি ওয়ান উড়ে যেতো মানুষ উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠত। কেউ কেউ ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে উঠত।

১৫ ডিসেম্বর আইন্তা ভূঁইয়া বাড়িতে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা এসে আশ্রয় নিলেন। তারা আমাদেরই দূরসম্পর্কের আত্মীয়-স্বজন। হুমায়ূন মামাকে দেখলাম, তাদের সঙ্গে গল্প করছেন। এক সময় দেখা গেল তিনি তাদের একজনের কাছ থেকে একটা লাইট মেশিনগান নিয়ে সেটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন। আমি তার পাশে গিয়ে বললাম, মামা, আমি একটু দেখি?

মামা বললেন, মাম্মা, এইটা তো আপনে তুলতে পারবেন না। অনেক ভারী।

আমি বললাম, পারমু।

মামা আমার দিকে মেশিন গানটা এগিয়ে দিলেন। আমি সেটা নিতে গিয়ে বুঝলাম, বেশ ভারী। হুমায়ূন মামা অস্ত্রটা আমার হাত থেকে নিয়ে যার অস্ত্র তাকে ফিরিয়ে দিলেন।

আগে কখনো মুক্তিযোদ্ধা দেখিনি। ঢাকায় আমার বন্ধুরাও কখনো মুক্তিযোদ্ধা দেখেনি। এরকম কাছ থেকে কোনো অস্ত্রও তারা দেখেনি। আমিও হাত দিয়ে কখনো কোনো অস্ত্র ধরে দেখিনি। আজ একই সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর কয়েকজনকে দেখে এবং নিজের হাতে অস্ত্র নিয়ে ভেতরে কেমন একটা উত্তেজনা টের পাচ্ছিলাম।

আমার পাশে আক্কু আর মুজাহিদ দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের বললাম, চল আমরাও মুক্তিবাহিনীর খাতায় নাম লেখাই।

ওরা আমার কথা শুনে রাজি হয়ে গেল। আক্কু বলল, অরা তো আমগো নিব না। আঠারো বছর অইলে নিত। আমি হুনছি, আঠারো বচ্ছর বয়স অইলে মুক্তিবাহিনিতে যাওন যায়।

ওর কথা শুনে আমাদের মনের কথা মনেই রয়ে গেল।

সেদিন সন্ধ্যায় ভূঁইয়াবাড়ির উঠোনে একটা নাটক মঞ্চস্থ হলো। গত কয়েক মাস ধরেই এর রিহার্সাল চলছিল। নাটকের নাম: নবাব সিরাজুদ্দৌলা। হুমায়ূন মামাও এতে অভিনয় করলেন। তিনি হলেন লর্ড ক্লাইভ।

অনেক রাত পর্যন্ত নাটক চলল।

তখন তেমন কারোর কাছে ঘড়ি ছিল না। কিংবা আমাদের ঘড়ি দেখার কেনো প্রয়োজনও ছিল না। রাত দশটা হোক কিংবা দুটো। দুটোই আমার কাছে সমার্থক। ভূঁইয়া বাড়িতে আমরা সমবয়সীরা সংখ্যায় নেহায়েৎ কম না।

সারাদিন আমাদের তাস খেলে, দাড়িয়াবান্ধা কিংবা হাডুডু খেলে কাটত। এই তাস অবশ্য বড়দের তাস ছিল না। আমরা খেলতাম সিগারেটের প্যাকেট দিয়ে। কিংস্টর্ক, সিজর্স, প্যারট, ক্যাপস্টান- এসব সিগারেটের খালি প্যাকেট সংগ্রহ করে আমরা খেলতাম।

নাটক শেষ করে আমরা প্রায় ভোরের দিকে ঘুমুতে গেলাম। পরের দিন একটু দেরিতেই ঘুম ভাঙল। নাস্তা করছি এমন সময়ে দেখলাম, বাইরে বেশ হৈ-চৈ হচ্ছে। কে একজন বলল, দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে!

আইন্তা গ্রামটা একটা অদ্ভুত গ্রাম। বেশিরভাগ মানুষই এখানে অশিক্ষিত। আমি যখনই গ্রামে এসেছি, কোনো না কোনো গুজব আমি শুনেছি।

মার্চে যখন এখানে এসেছিলাম, তখনও শুনেছিলাম, শেখ মুজিবকে পাকবাহিনী মেরে ফেলেছে। পরে, শুনেছি তাকে বন্দী করে পাকিস্তান নিয়ে গেছে! অবশ্য কোনটা যে ঠিক আমরা তখনও জানি না।

তবে, চারদিকে বেশ গোলাগুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। এরই মধ্যে সড়কে একটা ছোটখাটো মিছিলও বের হতে দেখলাম। মিছিল থেকে স্লোগান উঠছে, বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। জয় বাংলা।

আমরাও সেই মিছিলে মিশে গেলাম।

মিছিল নিয়ে আমরা দোলেশ্বর চলে গেলাম। দোলেশ্বরে গিয়ে দেখা গেল একটা লঞ্চ বুড়িগঙ্গার তীরে অপেক্ষা করছে। মুক্তিযোদ্ধাসহ অনেক মানুষ তাতে গিজগিজ করছে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অস্ত্র থেকে ফাঁকা গুলি ছুঁড়ছিলো আর ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিচ্ছিল।

আমরাও ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে দিতে লঞ্চে উঠে পড়লাম। বুড়িগঙ্গা দিয়ে যেসব নৌকা ও লঞ্চ যাচ্ছিল সেগুলো থেকেও ‘জয় বাংলা’ স্লোগান চারদিক কাঁপিয়ে দিচ্ছিল।

কিছুক্ষণ পর আমাদের লঞ্চও চলতে শুরু করল। লঞ্চে মুক্তিযোদ্ধা ছাড়াও ছিল শ খানেক মানুষ। বিভিন্ন বয়সের শিশু-কিশোরও ছিল দশ-বারোজন।

লঞ্চ বিকেলের দিকে সদরঘাটে এসে ভিড়ল। আমরা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে দিতে নামতে যাচ্ছিলাম, মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের নামতে দিল না।

মুক্তিযোদ্ধাদের নেতাগোছের একজন চিৎকার করে সকলের উদ্দেশে বললেন, দয়া কইরা আপনারা কেউ নামবেন না। সবাই লঞ্চে থাকেন।

আমরা ডেকে এসে দাঁড়ালাম। মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকজন লঞ্চঘাটে নেমে গেলেন। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল একটা লোককে চোখ বেঁধে ঘাটের একপাশে এনে দাঁড় করাচ্ছে। তার দু হাত পিছমোড়া করে বাঁধা।

নিশ্চয়ই রাজাকার কিংবা আল বদর।

আমরা লঞ্চের ডেকে দাঁড়িয়ে আছি। কী ঘটতে যাচ্ছে আমরা কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। আমার পাশেই দাঁড়িয়েছিল আক্কু। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, লোকটারে কি অহন মাইরধর করব?

আক্কু বিজ্ঞের মতো ভঙ্গি করে বললো, দেখ না কী অয়! চোদনাটারে মনে অয় ভালোই ঠেঙ্গানি দিব।

আক্কুর কথা শেষ না হতেই গুলির আওয়াজ হলো। প্রথমে পিস্তলের একটা গুলি ছুটল। পর মুহূর্তেই এলএমজি টা-টা-টা করে ব্রাশ ফায়ারের শব্দ আমাদের কানে তালা লাগিয়ে দিল। আমাদের চোখের সামনেই চোখ আর হাত-পা বাঁধা লোকটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। একজন মুক্তিযোদ্ধা তাকে লাথি দিয়ে নদীতে ফেলে দিলেন।

এত কাছ থেকে কাউকে মেরে ফেলার দৃশ্য আমি কখনো দেখিনি। আমার বুকটা ঢিবঢিব করতে লাগল।

লঞ্চ যখন সদরঘাটে এসে ভেড়ে তখন আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলাম, আমি এখানে নেমে যাব। সদরঘাট থেকে জিন্দাবাহার সেকেন্ড লেনে আমাদের বাসা আধাঘণ্টার পথ। আম্মা-আব্বুজি আর কায়কোবাদ কাকাকে দেখতে খুব মন চাইছিলো। তা ছাড়া, ঢাকায় আজ অনেক কিছু ঘটবে। সেসব দেখার ইচ্ছেটাও মনের মধ্যে প্রবল হয়ে উঠেছিল।

কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় আমার কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। আমার পা লঞ্চে কেউ যেন পেরেক দিয়ে আটকে দিয়েছে। বেশ কিছু লোক লঞ্চ থেকে তখন নেমে গেলেও আমি নামতে পারলাম না।

কিছুক্ষণ পরই লঞ্চ ছেড়ে দিল। ধীরে ধীরে লঞ্চটা তখন ঘাট ছেড়ে আবার দোলেশ্বরের দিকে যাত্রা করেছে। একটু পরেই সদরঘাট টার্মিনাল আমার চোখের সামনে অদৃশ্য হয়ে গেল। তখনো লঞ্চের মুক্তিযোদ্ধাসহ অন্যরা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান আর রাইফেলের ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে বিজয় উদযাপন করছে।

কিন্তু আমার চোখের সামনে অচেনা এক রাজাকারের গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ার দৃশ্য বারবার ভেসে উঠতে লাগল।

দেশ স্বাধীন হবার পরের দিনই আমরা ঢাকায় ফিরে এলাম।

   

দুই দেশের রং মিলেছে এক দেয়ালে



মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, ব্যাংকক, থাইল্যান্ড
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

রঙের শহর, হাসির শহর ব্যাংকক। দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি ভ্রমণ করা শহর ব্যাংকক। ব্যাংককের প্রাণকেন্দ্র সিয়ামেই রয়েছে ব্যাংকক র্আট এন্ড কালচারাল সেন্টার (বিএসিসি)। বাংলাদেশ থেকে যারা ব্যাংককে বেড়াতে যান, তারা যদি এমবিকে মলের পাশ দিয়ে স্কাই ওয়াক হয়ে তৃতীয় তলায় প্রবেশ করেন তাহলে হাতের ডানে চোখ ফেললেই দেখতে পাবেন বাংলাদেশের রঙের খেলা আর জীবনযাত্রার চিত্র।

স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে গত ২৬ র্মাচ থেকে ব্যাংককের র্আট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ ও থাই চিত্রশিল্পীদের অংশগ্রহণে ‘ড্রীম অব কালারস’ বা ‘রঙের স্বপ্ন’ র্শীষক চিত্র প্রর্দশনী। ‘কানেক্টিং টু ল্যান্ডস এন্ড টুপিপলস’ স্লোগানকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের নিমিত্তেই এই আয়োজন।


তৃতীয় তলার করিডোর ধরে হাঁটতেই চোখে পড়বে শিল্পী মুস্তাফিজুল হকের নিহঙ্গ। ওয়াসি পেপারের ওপর জাপানি ধরনের চিত্রকর্মের জন্য প্রসিদ্ধ তিনি। ক্যানভাসের ওপর আর্কিলিকের চিত্রকর্ম ‘হর্স’ মনযোগ আকর্ষন করছিল দর্শনার্থীদের। তার চিত্রকর্মের বড় বৈশিষ্ট্য নাটকীয়তা এবং বিষয়ের গভীর উপস্থিতি।

নগরের জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলতে শিল্পী কামাল উদ্দিনের জুড়ি নেই। তবে এখানে ব্যক্তির পোর্ট্রেট নয় বরং পেস্টেলে তবলার রং ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী।

আবার থামাসাত বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রকলার শিক্ষক খাজোনসাক মাহাকুন্নাওয়ানের তুলিতে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নগরের জীবন। রিকশার সঙ্গে যাত্রীদের ছুটে চলা। সময়কে যেন পাশ কাটিয়ে ছুটে চলছে তার চিত্রকর্ম।


ঢাকার গ্যালারি চিত্রকের ১৮ জন শিল্পী এবং থামাসাত ইউনিভার্সিটির ফাইন অ্যান্ড এপ্লাইড আর্টস বিভাগের ৪ জন শিল্পীর যৌথ অংশগ্রহণে চলছে এই আয়োজন। চলবে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত। গত ২৬ মার্চ চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন থাইল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহা. আব্দুল হাই।

চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন নিয়ে তিনি বলেন, দুটি দেশের ভূমি আর মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে এনেছে এই আয়োজন। চিত্রকর্মের মাধ্যমে যে যোগাযোগ সেটা শুধু বাহ্যিক নয়, বরং আত্মার যোগাযোগ। শুধু দেশকে চেনায় না, বরং সেখানকার জীবনযাত্রার ধারণা দেয়, মানুষকে কাছে নিয়ে আসে।


ব্যাংককের বাংলাদেশ দূতাবাসের এই চিত্রপ্রদর্শনীতে রফিকুন্নবী, আব্দুস সাকুর শাহ, সৈয়দ আবুল বার্ক আলভি, শেখ আফজাল, মাহফুজুর রহমান, সুমনা হক, মুনিরুজ্জামান, জহির উদ্দিন, কনক চাপা চাকমা, বিপাশা হায়াত, মোহাম্মদ ইউনুস, সুলেখা চৌধুরী, রেজাউন নবী, কামাল উদ্দিন, পারভীন জামান, সুমন ওয়াহিদ, মোস্তাফিজুল হক, আহমেদ সামসুদ্দোহার চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে।

এছাড়াও থাইল্যান্ডের চিত্রশিল্পী খাওজনসাক মাহাকুন্নাওয়ান, ওয়ারাপান সামপাও, জিরাতচায়া ওয়ানচান, প্রারুনরপ প্রিউসোপির চিত্রকর্মও স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে।

ব্যাংকক আর্ট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে সকাল থেকেই বিভিন্ন বয়সী শিল্প প্রিয় মানুষের আনাগোনা থাকে। সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এই প্রদর্শনী উপভোগ করতে পারছেন দর্শনার্থীরা।

;

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাসবিদ-দার্শনিক মুঈন উদ-দীন আহমদ খান জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন এক মনীষীর নাম। বাংলাদেশের বিদ্যাবৃত্তে ক্লাসিক্যাল চরিত্রের শেষ দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। ২৮ মার্চ (বৃহস্পতিবার) ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। 

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান (১৮ এপ্রিল, ১৯২৫-২৮ মার্চ, ২০২১) নির্জলা তথ্যভিত্তিক ইতিহাসের খোঁজে সুদীর্ঘ জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চার কষ্টসাধ্য দিনগুলো অতিবাহিত করেন নি। তিনি মনে করতেন, ইতিহাসের সত্য সন্ধান শুধু তথ্য আর যুক্তি ভিত্তিক নয়। প্রকৃত ইতিহাস মূলত ইতিহাসের দর্শন, ইতিহাসের পুনর্গঠন, কল্পনা, সমকালীন পর্যালোচনা ও ইনটুইশনের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সান্নিধ্যে এলে সবাই এই সত্য টের পেতেন যে, ইতিহাস প্রধানত দর্শন ও সাহিত্যের সমধর্মীতায় বর্তমানের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বাস্তবতা ভিত্তিক সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণের এবং দিকনির্দেশনা দেওয়ার অপরিহার্য মাধ্যম। তাঁর স্বকীয় চিন্তার দ্যুতিতে তিনি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা চর্চা ও গবেষণায় একটি বিশিষ্ট ধারার প্রতিভূ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবং একটি পুরো জীবন সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাচর্চার ধ্যানজ্ঞানে যাপন করেছেন। আর চট্টগ্রামের নিরিখে তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা কাঠামোর আদি নির্মাতাদের অন্যতম। যেমনভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র ড. আবদুল করিম ছিলেন ইতিহাসচর্চার প্রতিষ্ঠাতা, প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ইংরেজির, ড. আর. আই চৌধুরী রাজনীতি বিজ্ঞানের, তেমনিভাবে তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবদ্ধ বিদ্যাচর্চা ধারার সূচনাকারী। চট্টগ্রামের আধুনিক উচ্চশিক্ষা বিস্তারের আদি মুঘলদের একজন ছিলেন তিনি।  

তিনি ছিলেন আড়ম্বরহীন জ্ঞানসাধক। নিজস্ব বিদ্যাবলয়ের বাইরে তাঁর কোনও আত্মপ্রচার বা আত্মগরিমা ছিল না। যদিও তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার মতো যোগ্য লোকের সংখ্যা তাঁর আশেপাশে খুব বেশি ছিল না, তথাটি যারা তাঁর রচনা খেয়াল করে পড়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে কিংবা অনানুষ্ঠানিক পরিসরে আলাপ, আলোচনা, সংলাপ ও বিতর্কের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন, কত ভাষা, কত বিষয়, কত তত্ত্ব ও তথ্যাদি সম্পর্কে অনায়াস দক্ষতা ও পা-িত্য ছিল প্রাচ্যদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের এই জ্ঞানতাপসের। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চুনতী গ্রামের আদিবাস আর পুরনো চট্টগ্রাম শহরের রুমঘাটা থেকে এই মান্যবর জ্ঞানবৃদ্ধের কাছ থেকে বিচ্যুরিত দীপ্তি কিছু কিছু অনুভব স্পর্শ করেছে দেশে-বিদেশে তাঁর কর্ম ও গবেষণা ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

তাঁর জ্ঞান, গবেষণা, মনীষা, বুদ্ধির দীপ্তি, বহু ভাষায় পারঙ্গমতা তাঁর সমকালে অন্য কারও মধ্যে বিশেষ পরিলক্ষিত হয় নি। বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চায় প্রবাদপ্রতীম ড. আহমদ হাসান দানি যে তিনজন ছাত্রকে গবেষণায় প্রণোদিত ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান তাঁদের একজন। অন্য দুইজন হলেন আবদুল করিম ও মোহর আলী। এই তিনজনই বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় সত্যিকারের মৌলিক অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান প্রাথমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষাজীবনে প্রথম বিভাগ, স্বর্ণপদক, ফেলোশিপ ও বৃত্তি লাভ করেন একজন মেধাবী ছাত্র রূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর তিনি মোটেই থেমে থাকেন নি। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার বিখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। ফিরে এসে খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ড. আহমদ হাসান দানির তত্ত্বাবধানে ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ বিষয়ে পথপ্রদর্শনকারী পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেন। তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েট ফেলোশিপ লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বার্কলের ‘ইন্সটিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’-এ রাজনীতি বিজ্ঞানের ‘সেমিনার ইন ফিল্ড ওয়ার্ক কোর্স’ অধ্যয়ন করেন। তিনি কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রখ্যাত প-িত, ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের সান্নিধ্যে এসে বহুবিদ্যায় পারদর্শী হন। যে কারণে, পরবর্তী জীবনে তিনি ইসলামিক স্টাডিজ ও ইসলামের ইতিহাসকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, বিশেষত এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের ক্ষেত্রেও নিজের অবদান রাখেন এবং তাঁর গুণমুগ্ধ শিক্ষার্থীদের ছাড়াও তাঁর মূল-বিষয়ের বাইরের লোকজনকেও প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন নেতৃস্থানীয় শিক্ষক যথাক্রমে মর্শন বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান বদিউর রহমান এবং কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন শব্বির আহমদ তাঁর অধীনে পিএউচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

গবেষণা তত্ত্বাবধানে তিনি ছিলেন প্রচ- রকমের শুদ্ধতাবাদী। একটি প্রকৃষ্ট গবেষণার জন্য ¯œাতকোত্তর ও এমফিল পর্যায়ের গবেষকদেরও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত করতেন, যাতে তারা ভবিষ্যতে গবেষক হিসাবে স্বাধীনভাবে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। তাঁর সাথে গবেষণার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ড. আফম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, “তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর অনুমোদন নিয়ে কলকাতা, লক্ষেœৗ, দিল্লি, তুঘলকাবাদ, করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ, মক্কা ও মদিনা সফর করি।” কোনও মতে একটি ডিগ্রি দিয়ে দেওয়ার অসৎ পন্থার বিপরীতে গবেষণাকে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর করতে তিনি ছিলেন একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী শুদ্ধতম তত্ত্বাবধায়ক। শেষজীবনে তাঁর সঙ্গে বা পরামর্শে যারা গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মানস গঠনে ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নির্মাণে তিনি শ্রমবিমুখ ছিলেন না। ঘন্টার পর ঘণ্টা তিনি তাঁদের সঙ্গে আলোচনা কিংবা বই-পুস্তক পর্যালোচনায় লিপ্ত হতেন। এমন চিত্র আমি নিজে তাঁর বাসভবনে উপস্থিত কালে লক্ষ্য করেছি। কখনও নবাগত গবেষকদের তিনি অন্যান্য শিক্ষক ও গবেষকদের কাছে পাঠাতেন। তাঁর রেফারেন্সে একাধিক তরুণ গবেষক আমার কাছে এসে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাঁর রেফারেন্সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন। একটি বস্তুনিষ্ঠ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণা সম্পন্ন করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ত ও প্রণোদনাদাতা রূপে ছিলেন নিরলস।   

কঠোর তথ্যনিষ্ঠা ও শুদ্ধতার প্রতিফলন ঘটেছে মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের প্রতিটি রচনায়। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ও প্রবন্ধগুলো যে কারণে একই সাথে পাঠকপ্রিয় এবং অ্যাকাডেমিক জ্ঞান ভা-ারে মণি-মুক্তা তুল্য। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব ফরায়েজি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল’ একটি পথিকৃৎ গবেষণা, যা ‘বাংলায় ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়েছে। যে ফরায়েজি আন্দোলনকে ওয়াহাবি আন্দোলন বা তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া নামেই সবাই জানতো, তিনি তাঁর বহুমাত্রিক চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত করেন।  ফারায়েজি আন্দোলন যে কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক গতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রথম ও আদি প্রচেষ্টা, তিনিই সর্বপ্রথম তা প্রমাণ করেন। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে উত্থিত এই আন্দোলনের গণমুখী চরিত্র, ঔপনিবেশিকবাদ বিরোধী বৈশিষ্ট্য, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার বিরোধী মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াকু মানসিকতার বিষয়াবলী তিনি ঐতিহাসিক তথ্য ও ধর্মতাত্ত্বিক মাত্রায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে উপস্থাপন করেন। বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও বৃহৎ ক্যানভাসে গবেষণার কৃতিত্বে তিনি এই বিষয়ে এবং ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস বিনির্মাণের পথিকৃৎ প্রাণিত স্বরূপে সর্বমহলে সম্মানীত হয়েছেন। 

পরবর্তীতে প্রকাশিত মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের গ্রন্থ ও প্রবন্ধে তিনি তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ রেখেছেন। প্রতিটি লেখাতেই তিনি নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর লেখায় দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইত্যাদি বহুবিদ্যার প্রকাশ ঘটেছে। শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও গবেষণার বাইরে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাধারাকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করার প্রয়াস। তিনি ছিলেন ধ্রুপদী দার্শনিকদের মতো সংলাপ-প্রবণ ব্যক্তিত্ব। কেউ আগ্রহী হলে কিংবা কারো প্রতি তিনি আগ্রহী হলে তাঁকে বা তাঁদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হতেন। তিনি তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানদের মতো বইয়ের পাতার শুকনো অক্ষরে বন্দি ছিলেন না, জ্ঞানবৃত্তের মানুষের সঙ্গে প্রাণবন্ত সংলাপ ও সংশ্লেষের মাধ্যমে সদা জীবন্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে তো বটেই, বৃহৎ বঙ্গদেশে খুব কম সংখ্যক প-িতই এমন ছিলেন, যারা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় অন্যকে প্রণোদিত করার ক্ষমতা ধারণ করতেন। ঢাকায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং চট্টগ্রামে ড. আবদুল করিম, ড. আর. আই. চৌধুরী ছাড়া কম প-িতই ছিলেন, যারা শিক্ষার্থীদের প্রাণিত করার ক্ষেত্রে মনীষী মুঈন উদ-দীন খানের সঙ্গে তুলনাযোগ্য।

জ্ঞানের সঞ্চার ও বিস্তারে তাঁর অসীম কষ্ট সহিষ্ণুতা, আগ্রহ ও বিনয় তাঁকে ক্লাসিক্যাল যুগের প্রাচীন জ্ঞানতাপসের আধুনিক প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সান্নিধ্যে এসে আমি তা স্পষ্টভাবে অনুভব করি। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। এবং বয়সের দিক থেকে তিনি ছিলেন আমার চেয়ে কয়েক প্রজন্ম অগ্রগামী। তথাপি অশীতিপর বয়সে এসেও তিনি আমার কোনও লেখার প্রতি আগ্রহী হলে নিজে ফোন করে জানিয়েছেন। ডেকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং বিষয়টিকে তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে আরও সমৃদ্ধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেসব আলোচনায় জ্ঞানতত্ত্ব ও তুলনামূলক দর্শন সম্পর্কে তাঁর অতলস্পর্শী পা-িতের দীপ্তিমান প্রভার আঁচ পাওয়ার বিরল সুযোগ আমার হয়েছে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছিল, বহু তরুণকে তিনি গবেষণার দিক-নির্দেশনা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দিতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর মধ্যে পথ প্রদর্শনের একটি বিরল গুণ ছিল। আর ছিল জ্ঞানকে অকাতরে ছড়িয়ে দেওয়ার উদার মানসিকতা, যা আজকের অ্যাকাডেমিক প্রতিযোগিতার পঙ্কিল ও সঙ্কীর্ণমনা ধারার প্রেক্ষিতে অকল্পনীয় বিষয়। বড় মন ও মুক্ত মানসিকতার কারণে তিনি ‘বাংলাদেশের লিলিপুট প-িতদের সমাবেশে’ মহীরূহ-সম ব্যক্তিত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন।   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের মতো বিটপী ব্যক্তিত্বকে দৃশ্যপটে রেখে আজকের ক্ষুদ্রতর পরিসরে আলোচনা করা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমানের ঊন-মানুষ ও ঊন-মানসিকতার পরিম-লে তাঁর মতো বড় মানুষের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। তিনি এবং তাঁর সমগোত্রীয়রা শেষ মুঘলের মতো দৃশ্যপট থেকে চলে গিয়েছেন। কিন্তু রেখে গিয়েছেন ধ্রুপদী ঐতিহ্য, ব্যক্তিত্বের দীপ্তি ও বিভা। তিনি ছিলেন প্রথম প্রজন্মের আধুনিক বাঙালির হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে সকল অগ্রণী প-িত, গবেষক ও শিক্ষাব্রতীগণের শ্রেষ্ঠতম ও উজ্জ্বল প্রতিনিধি, যারা  জাগতিক প্রাপ্তির আশায় জ্ঞানের সাধনা করেন নি। জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাচর্চার নিতান্ত আবশ্যক পরিসীমার বাইরেও তাঁরা সচরাচর যান নি। তাঁদের নিতান্ত আবশ্যক বস্তুর তালিকায় সর্বাগ্রে ছিল জ্ঞানচর্চা, বিদ্যার্জন ও গ্রন্থপাঠ। বিষয় ভিত্তিক প্রয়োজনীয় বইয়ের বাইরেও অন্য বিষয় সংক্রান্ত রচনা তাঁরা পড়তেন আনন্দ ও কৌতূহল নিবৃত্তির সুতীব্র আকর্ষণে। কারও কারও পুস্তক সংগ্রহ আর রোজগারের মধ্যে কোনও ভারসাম্য থাকতো না। জাগতিক উন্নতির বিষয়গুলোকে তাঁরা তুচ্ছ বিবেচনা করে অবজ্ঞা করেছেন। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর মতে, “যে জীবনে বৈষয়িক উন্নতির সম্ভাবনা বিরল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ সত্যিই সারস্বত-কর্মে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বর্তমানের বিশ্লেষণপ্রবণ গবেষণার ধারা তখনও প্রবল হয় নি। কিন্তু অনেক গবেষণাই গভীর পা-িত্যের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতো।” মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান সম্পর্কে এই বক্তব্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আত্মমগ্ন ধ্যানীর মতো সারা জীবন তিনি জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থেকে গভীর পা-িত্যের পরিচয় দিয়েছেন। শুধু নিজেই নন, প্রণোদিত করেছেন পরবর্তী বেশ কিছু প্রজন্মের উৎসাহী তরুণদের, যাদের অনেকেই বিদ্যাচর্চায় লিপ্ত রয়েছেন।

তাঁর সঙ্গে ইতিহাসের আরেক মহান সাধক যদুনাথ সরকারের কিছু কিছু বিষয় তুলনীয়, যার মধ্যে রয়েছে প্রবল পরিশ্রম, জ্ঞান তৃষ্ণা এবং অনুসন্ধান। যদুনাথের বিশ্লেষণের নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বিতর্ক থাকার পরেও ইতিহাসচর্চায় তিনি সর্বজনমান্য আচার্য। তিনি নিজের কর্ম ও জীবন আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি করতেন: “পথের প্রান্তরে করি নাই খেলা/শুধু বাজায়েছি বসি সারাবেলা/ছিন্নতন্ত্রী বীণা।” মনীষী প্রফেসর ড. মুইন উদ-দীন আহমদ খানও সারাজীবন জ্ঞানচর্চার বাঁশরী বাজিয়েছেন। একটি আস্ত জীবনকে উৎসর্গ করেছেন জ্ঞানের সাগরে অবগাহনের মাধ্যমে। বিদ্যার্চচাকে পেশাগত পরিম-লে জিম্মি না করে জীবন ও যাপনের মূলমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। আর সব কিছুই তিনি করেছেন নিজের সুমৃত্তিকা ও মানুষকে কেন্দ্র করেই। জীবনের পর্বে পর্বে নানা দেশে, নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তিনি অবশেষে ফিরে এসে আলোকিত করেছেন প্রিয় মাটির প্রিয় মানুষদের, প্রিয় জনপদকে। জীবনের দিনগুলোর মতোই মৃত্যুর পরেও তিনি আলোর দিশারী হয়ে দেদীপ্যমান রয়েছেন জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যামুখী অভিযাত্রীদের চৈতন্যের মর্মমূলে।  

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম  সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;