মুক্তিযুদ্ধের গল্প

মাতৃভূমির কুরসিনামা



আলমগীর রেজা চৌধুরী
অলঙ্করণ: কাজী যুবাইর মাহমুদ

অলঙ্করণ: কাজী যুবাইর মাহমুদ

  • Font increase
  • Font Decrease

ঘুটঘুটে অন্ধকার। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ওর ছায়া দীর্ঘ হয়। বিপরীত দিক থেকে হেঁটে আসে একটা নেড়ে কুকুর। শরীরে দগদগে ঘা, লোমগুলো উঠে গেছে। মুখ দিয়ে লালা পরছে। কুকুরের ছায়াও দীর্ঘ হচ্ছে। কারফিউর মতো নির্জন রাস্তায় ওর চলার শব্দ কুকুরটির শব্দ ‘ঘেউ’ ছাড়া শব্দহীন সরণিতে এগোতে থাকে। ওর ছায়া অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। এখন অন্ধকার। বিকট শব্দে শম্ভূগঞ্জ ব্রিজ দিয়ে ট্রেন ছুটে যায়। আজ আকাশে তারার মেলা বসেছে। কালপুরুষ বেশ বীরদর্পে পা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সপ্তর্ষীমণ্ডল সুখেই মিটমিট করছে। ওর কিছুই মনে পড়ে না। বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া ক্লান্ত হোমোসেপিয়েন। দূরে শম্ভূগঞ্জের গায়ে অন্ধকার। কোনো পিদিমের আলো জ্বলে না। হেঁসেলের ধোঁয়া নজরে আসে না। এত তাড়াতাড়ি সব ঘুমিয়ে গেল!

এত শান্ত গ্রাম! ধনচে গাছ আড়াল করে জল বরাবর চোখ বুলাতে থাকে ও। কতক্ষণ। কৃষি বিশ্বদ্যিালয়ের দিকে সিগনাল দিচ্ছে নীলাভ আলো। বলাশপুরের দিকে কনভয় ছুটে চলার বিকট শব্দ ভেসে আসে। প্রায় এক ঘণ্টা জেগে ওঠা চরের মধ্যে বসে আছে। সাহেব কোয়ার্টার, সার্কিট হাউসসহ নদীর পাড় ঘেঁষে সারি সারি বাঙ্কার। কামানসহ অন্যান্য ভারী অস্ত্র নাক বরাবর তাক করা।

একটা টুস শব্দের সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার গুলি ছুটে আসবে। ও ঘড়ির দিকে তাকায়। আটটা সতের। হঠাৎ ওর মনে পড়ে, হাতে কাপড়ে পেঁচানো আগ্নেয়াস্ত্র অত্যন্ত মারাত্মক। এটা হাতে নিয়ে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় হেঁটে আসা ঠিক হয়নি। এস কে হাসপাতালের কাছে একটা ট্রুপস অ্যামবুস করেছে। নদী পথে এসে যেন বটতলার এই বিপদসংকুল রাস্তায় সরাসরি ঢুকে গেরিলা আক্রমণ করতে না পারে। পেছন দিক থেকে কেউ ‘হল্ট’ বললেই ধরা পরে যেত। নইলে গোলাগুলির মধ্যে পরে বেঘোরে প্রাণ হারানো ছাড়া উপায় ছিল না। হঠাৎ করে ওর গায়ের লোম কাঁটা দিয়ে ওঠে। শিড়দাঁড়ায় বয়ে গেল শৈত্যের হলকা। এই বোকামিটা করা ঠিক হয়নি। কমান্ডারকে বলা যাবে না। জাবেদকে বলা যাবে। কিন্তু এখনো আসেনি। আদৌ আসবে কি না! তারও ঠিক নেই। আসলে না হয় প্ল্যানমাফিক এগোনো যাবে। না এলে? আবার এতটা পথ মাড়িয়ে কমান্ডারের নাগাল পাওয়া দুস্কর। সকালের দিকে দুবলাকান্দা পুলিশ ফাঁড়ি আক্রমণ করার কথা। সিগারেটের তৃষ্ণায় কণ্ঠ কাঁপছে। জ্বালানোর উপায় নেই। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে হঠাৎ আলো ভয়ঙ্কর। সহজে টার্গেট করে। ছুটে আসে এক ঝাঁক মেশিনগানের গুলি। ওরা প্রশিক্ষিত। মিস হয় কম। নান্দিয়া পাড়ার সৈয়দ আলী এভাবেই ঝাঁঝরা হয়েছিল। তারপর সবাই সতর্ক। অন্ধকারে মিশে থাকতে হবে। আলোতে নয়।

জুন মাসের গুমোট গরমে ঘামছে ও। আবার আকাশের দিকে তাকায়। তারার মেলা। কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকারে নক্ষত্রের মুখ জ্বলজ্বল করছে। তৃষ্ণা পেয়েছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। এখান থেকে দুইশ গজ দূরে ব্রহ্মপুত্র কলকল করে বয়ে যাচ্ছে। ভারী বর্ষণ হলে গাড়ো পাহাড়ের ঢলে ব্রহ্মপুত্রে জোয়ার বইবে। ও এখানে বসে জাবেদের জন্য অপেক্ষা করছে তাও তলিয়ে যাবে অথৈ জলে। স্রোতের কলকল ধ্বনি, বাঁকে বাঁকে ঘূর্ণনের গোত্তা মেরে দু কূলে ভাঙনের গান গেয়ে বয়ে যাবে। ট্রিগার ধরে অত্যন্ত সন্তর্পণে ও ব্রহ্মপুত্রের দিকে এগিয়ে যায়। জলের কিনারায় অস্ত্র রেখে আজলা ভরে পানি পান করে। শীতল পানি নাকে মুখে ছিটকা মারে। আবার সেই ধনচে গাছের ঢিবির কাছে এসে জাবেদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।

ঘড়িতে এখন পৌনে নয়টা। জাবেদের পাত্তা নেই। জাবেদ না এলে ওর করণীয় কী? ইত্যাকার ভাবে। হ্যান্ড ব্যাগে দুটো গ্রেনেড আছে। যা বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য ওদের মিশন। জাবেদ এলেই কাজটা সম্পন্ন করার ভাবনা করা যেত। মশা, ডাঁশ, ওলা পোকার বিস্তর উৎপাত। নাকে মুখে হিচকা পরছে। তারপরও ও স্থির বসে থাকে। রাত পোকাদের গুঞ্জরণে পৃথিবীকে শব্দহীন করে দিয়েছে।
মাস তিনেক আগেও অন্ধকারকে ভয় ছিল। সাপের ভয়, ভূতের ভয়, মানুষের ভয় মিলিয়ে আঁধার আতঙ্কের মধ্যে যার পৃথিবী, সেই কিনা চার মাইল অন্ধকার মাড়িয়ে কেওয়াটখালী পাষাণবেদী বায়ে রেখে এখন ব্রহ্মপুত্রের চর ভেসে ওঠা ধনচে বনে আশ্রয় নিয়েছে একা। একাকী। ভয় শব্দটা এখন ওর মধ্যে বিরাজ করে না।

বরঞ্চ উন্মত্ত হিংস্রতা বসতি গেড়েছে। ওর হাতে স্টেনগানের মতো মারাত্মক মারণাস্ত্র। যার প্রতিটি কার্তুজের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক একটি মানুষের প্রাণ। না, ও মানুষ হত্যা করতে চায় না। জীবনকে তুল্যমূল্য করে পশু হত্যা করতে চায়। যারা অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পরে সবুজ প্রান্তর জুড়ে রক্তের হলি খেলায় মেতে উঠেছে, তাদের সঙ্গে ফয়সালা না করে ফিরে যাবার পথ নেই। মৃত্যু নইলে স্বাধীনতা। নিরীহ পিতা মাতা, থেকে অবোধ কিশোর হত্যা করে যারা, তাদের জন্য কোনো অনুকম্পা নয়। ওকে কোনো অনুকম্পা করেনি। হাজার হাজার পাকিস্তানী আর্মি এই চর পর্যন্ত ছুটে আসছে। হায়েনার মতো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই শ্যামল প্রান্তর জুড়ে।

হঠাৎ ওর মনে পড়ে, ‘এ দেশের শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি।’ ও ইষৎ মুচকি হাসে। কবি, রমণীরা সব সম্ভ্রম রক্ষায় পালিয়ে বেড়াচ্ছে, এসব খবর কি রাখেন? দরকার কী? এই সুন্দর তো তোমার। মহাকাব্যিক দার্শনিকতা। আহারে শ্যামল রমণী! মাতৃকূল। তোমার জন্য বিরল এই প্রান্তরে ট্রিগারে আঙ্গুল রেখে অপেক্ষা করছি। একটি বুলেট নাক বরাবর ছুটে যাবে। আবার আরেকটি বুলেট আমার দিকে ফিরে আসবে। কী চমৎকার! তুমি ভাবতে পারো? রক্তের মহাজন সেজে বসে আছি।

ঠিক এসময় ক্ষীণ পদশব্দ। ও মাটির সঙ্গে দেহ মিশিয়ে অপেক্ষা করে। জাবেদ না অন্য কেউ? ঢিবিটার অতি কাছে হেঁটে যায় জাবেদ। জলের সঙ্গে ওর দেহের ছায়া মিলিয়ে ডাক দেয়, ‘পুটটুস।’ থমকে দাঁড়ায় জাবেদ। তড়িৎ উত্তর দেয়, ‘টুকু।’

কাছে এসে ধপাস করে ধনচে গাছে পিঠ রেখে শুয়ে পরে। ক্ষীণ কণ্ঠে বলে, ‘জানে বেঁচে গেছি, প্রায় জীবনটা গেছিল।’ টুকু উত্তর দেয়, ‘আমারও। বোকামি করে ফেলেছিলাম। আমিও।’

টুকু ঘড়ির দিকে তাকায়। প্রায় দশটার কাছাকাছি। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে।

‘আমার ক্ষুধা পেয়েছে।’

‘তোর জন্য রুটি এনেছি।’

‘দে।’

জাবেদ কার্তুজের ব্যাগ থেকে একখণ্ড বনরুটি বের করে দেয়।

কোনো কিছু জিজ্ঞাসা না করে টুকু রুটি খেতে খেতে জলের নিকট হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে থাকে। ক’ আজলা জল খেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করে। যেন কতকাল ধরে ও এখানে দাঁড়িয়ে আছে।

প্রস্রাব শেষ হতে চায় না। জলের গায়ে দুয়েকটা নক্ষত্র। তার আলোয় মাছ কিলবিল করে।

জাবেদ ডাক দেয়, ‘টুকু।’

ডাকও যেন শব্দহীন। জাবেদের কণ্ঠ ভরাট সত্ত্বেও ওর কণ্ঠ রাতের পাখির ডাকের মতো শোনায়। টুকু বুঝতে পারে। এই বুঝতে পারার বয়স দুমাস হয়নি। টুকু আবার হামাগুড়ি দিয়ে জাবেদের কাছে ফিরে আসে।

‘এখন?’ টুকু প্রশ্ন করে।

‘অপেক্ষা।’

‘কার জন্য?’

‘মতি ভাই আসবে।’

‘কখন?’

‘জানি না।’

ধনচে গাছে গায়ের শার্টবিছিয়ে স্টেন জাপটে ধরে টুকু বলে, ‘আমার ঘুম পাচ্ছে।’

‘তুই ঘুমা। আমি অপেক্ষা করি।’

‘শত্রু এলে তুই একা কী করবি?’

‘গুলি করতে করতে ব্রহ্মপুত্রের জলে হারিয়ে যাব।’

‘ওরা আসবে না। ভীতু। রাজাকাররাও আসবে না। ওরা ভয় পায়। ওরা নিরীহ মানুষ হত্যা করে। মুক্তিযোদ্ধার নাগাল পায় না।’

‘তা ঠিক।’

ঠিক এক মিনিটের ভেতর টুকু ঘুমিয়ে যায়। ওলাপোকা একটানা ডেকে যাচ্ছে। দূরে কোথাও শেয়ালের হুক্কাহুয়া ভেসে আসছে। শম্ভূগঞ্জের ব্রিজের পাশেই পাষাণবেদি। এখন শেয়াল-কুকুরের মহোচ্ছব চলছে। গুলিবিদ্ধ বঙ্গসন্তানের নাড়িভুড়ি নিয়ে ওরা মহাসুখে আছে। তাই রাতের নিস্তব্ধতা খানখান করে ডেকে ওঠে। ওটুকুই। এ নিয়ে জাবেদ ভাবতে চায় না। প্ল্যান করে এগোতে হবে। কমান্ডার যেভাবে বলেছেন, সেভাবেই। চুল পরিমাণ এদিক সেদিক হবার জো নেই। ভুলটা করেছিল ও। মণিকাকে খুঁজতে যাওয়া ঠিক হয়নি। দিনমজুরের কেমোফ্লেক্স ঠিক ছিল। কিন্তু কাপড়ের ব্যাগে রাখা স্টেনগান-কার্তুজ-ব্যাগ অত্যন্ত বিপজ্জনক। চ্যালেঞ্জ করলেই আটকে যেত। ধরা পরলেই নির্ঘাত মৃত্যু। সশস্ত্র শত্রুকে কেউ বাঁচিয়ে রাখে না। ও নিজেও রাখবে না।

বড় সড়ক ক্রস করে গলির মাথায় দাঁড়ায়। তখন এদিকটায় বিদ্যুৎ ছিল না। গতকাল কেওয়াটখালি পাওয়ার স্টেশনে হামলা হয়েছে। ভয়ঙ্কর রকেট ল্যান্সার দিয়ে হামলা। তিনটা ইউনিটের মধ্যে একটা পুরোপুরি বিধ্বস্ত। শহরে লোডশেডিং চলছে।

গলি পেরিয়ে মণিকাদের বাড়ির আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে ছিল কতক্ষণ। ঘুটঘুটে অন্ধকার। ভেতরে জনমনিষ্যির আঁচ পাওয়া যায়। অনেকটা বেদিশার মতো মণিকার বাবা এডভোকেট ত্রৈলঙ্গর গোস্বামী বাড়ির টপ-বারান্দায় উঠে আসে। সতর্ক পদক্ষেপ, নিশব্দ পদচারণা, সজাগ কান শুধুই অশুভ ইঙ্গিত করতে থাকে। তারপরও মণিকার পড়ার রুমের বদ্ধ জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ইতিউতি ভাবতে থাকে। ভেতরের মানুষগুলোর কণ্ঠস্বর অচেনা। গোস্বামী কাকা তো না! অন্য কেউ। নারীকণ্ঠ আছে। মণিকা বা মাসীমার নয়। অন্য কারো।

নানা রকম চিন্তা মাথায় কাজ করতে থাকে। হিসাব মতে মণিকাদের থাকার কথা নয়। পঁচিশ মার্চ ক্র্যাক ডাউনের পরপর ওরা এ বাসা থেকে সটকে পরেছে। শহরে দুবার বিমান হামলার পর গোস্বামী কাকা মণিকাদের আর এ শহরে রাখা নিরাপদ মনে করেনি। এখানে মনে হয়, তার সিদ্ধান্ত সঠিক। এ দেশে আর মানুষ বাস করতে পারে না। দখলদার দস্যু আর ফুঁসে ওঠা রাগী যুবকের মুক্তির ‘জয় বাংলা’র গেরিলা।

তারপরও কেন যে মণিকাকে খুঁজতে এলো, তা ও নিজেই জানে না। কেষ্টপুর দিয়ে পাস হওয়ার কথা ছিল। পুরবী’র দুলাল ভাইয়ের কাছ থেকে গ্রেনেড নিয়ে চর ধরে টুকুর কাছে পৌঁছানোর কথা।

‘এ বাড়ির মালিক ইন্ডিয়ায় গেছে গা। আমরার দহলে আছে। বাড়ি আমাগো। পাকিস্তান সরকার লেইক্কা দেব।’

ওর মনে হয় মণিকাদের বাড়ি বেদখল হয়ে গেছে। মণিকার সঙ্গে আর দেখা হবে না। ভাবতে ভাবতে নারকেল গাছের আড়ালে আবার চলে আসে। ঠিক এ সময় বিদ্যুৎ এলো। দুয়েকটা বাতি জ্বললেও ল্যাম্পপোস্ট প্রায় তিনশ গজ দূরে। এদিকে অন্ধকার ছেয়ে আছে। খুব সহজে বের হয়ে যাওয়া যাবে। ঠিক এ সময়ে জিপ ছুটে এলো গলির মুখ থেকে। ধামধাম করে ওপাশের আমগাছের গোড়ায় দুজন পাক আর্মি নেমে আসে। পেছন থেকে দুজন রাজাকার। মুখ বাঁধা প্রায় বিবস্ত্র এক নারী, রাজাকাররা ওকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। দ্রুততায় গোস্বামী কাকার টপ-বারান্দায় উঠে যায় ওরা। অনেকটা টেনে-হেঁচড়ে মেয়েটাকে জাপটে ধরে ডাক দেয়, ‘মানিক স্যার আইছে।’ খুঁট করে দরজা খোলার শব্দ হয়। ওরা ঢোকার পরে আবার দরজা বন্ধ হয়ে যায়। ও নারকেল গাছ আড়াল করে স্টেনগান লোড করে, অপেক্ষায় থাকে। জিপ একলা আম গাছের গোড়া বরাবর। বের হওয়ার উপায় নেই। জিপে ফৌজি থাকতে পারে। ঘড়ির কাঁটা এক সেকেন্ড করে এগিয়ে যেতে থাকে। দুয়েকবার ঐ নারীর আর্তনাদ শুনেছে। তারপর থেকে অপেক্ষা করছে। ওর কিছুই শুনতে ইচ্ছে করে না।

ওই কাতর নারীর কথাও মনে হয় না। অপেক্ষা করে। অপেক্ষারত জিপটা নিথর। ড্রাইভারসহ হয়তো গোস্বামী কাকার বাসায়। ও অপেক্ষা করে। ওরা চারজন, অভাগী নারী, বাড়ির দখলদার। মোট ছয় জন। ও ভাবে লোডেড কার্তুজ আটাশটা। এক ম্যাগাজিন একস্ট্রা। তিনটা গ্রেনেড। দুঃখী নারীকে বাদ দেয়। ওর বেঁচে থাকবার দরকার নেই। ও এই পৃথিবীতে সব অধিকার খুইয়েছে। ব্রাশ ফায়ারে মরে গেলে ক্ষতি কী? বাকি পাঁচজনকে অন্ধকারের এত নিকট থেকে...। সাত-পাঁচ ভাবে। সাহস হারাতে থাকে। একটু এদিক-সেদিক হলেই বিপদ। মৌডালের ঝোঁপ পেছনে রেখে উঠে দাঁড়ায়। এদিক দিয়ে দ্রুত বেরোবার পথ আছে। মসজিদের পাশ ঘেঁষে ধানক্ষেত দিয়ে বড় রাস্তা ক্রস করে বেরিয়েই নদীর পাড়। ধনচের আড়ালে আড়ালে টুকুর কাছে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব। টুকু অপেক্ষা করছে। হঠাৎ করে ওর ভয়ানক সিগারেটের তৃষ্ণা পায়। মণিকাকে মনে পড়ে।

এম কলেজে মণিকা ওর সহপাঠী। কলেজ থেকে পূজাতে দল বেঁধে এ বাড়িতে এসেছে। হইচই করে বাড়ি মাতিয়েছে। গোস্বামী কাকা বেশ শিক্ষিত মানুষ। কন্যার বন্ধুদের প্রতি স্পষ্ট পক্ষপাত দেখিয়েছে। মণিকা সাদামাাঁ তরুণী। বুদ্ধিদীপ্ত ক্লাসের সবাই মণিকাকে মনে রাখতে চায়। অথচ আজ মণিকা কি জানে, কি ভয়ংকর সময়ের মুখোমুখি ও। ওর বিছানায় ধর্ষিত হচ্ছে বঙ্গললনা। একজন অপেক্ষা করছে মৃত্যুর ওপারে। ওর মনে হয় ক্যাচ করে বেয়নেট ঢুকিয়ে দিল। দরজা খুলে টপ-বারান্দায় এসে দাঁড়ালো চারজন। একজনের হাতে সিগারেট। ‘আচ্ছা হ্যায়, মান্তা হ্যায়’ এই জাতীয় বাতচিতের মধ্যে ও স্পষ্ট দেখতে পায়। ও অপেক্ষা করে। ট্রিগারে আঙুল। আরো একজনের জন্য অপেক্ষা করে। সে বেঁচে থাকার অধিকার হারিয়েছে। ও অপেক্ষা করে। ঠিক এ সময় পঞ্চম লোকটি বের হয়।

‘পা-মুখ বাইন্ধা আইলাম।’

ঠিক এ মুহূর্তে আঙুলে চাপ পরে। ঠা-ঠা শব্দ চারদিক প্রকম্পিত করে তোলে। ধপাধপ পাঁচটি দাঁতাল গোস্বামী কাকার টপ-বারান্দায় লুটিয়ে পরে। ও দশ সেকেন্ড অপেক্ষা করে। তারপর মৌডাল আড়াল করে অন্ধকারে মিশে যায়। বড় রাস্তায় কনভয় ছুটিয়ে পাকসেনারা এদিকে আসছে। ও তখন দড়াইখাল পেরিয়ে বলাশপুর পৌঁছে গেছে। এ সময় একবার মনে হয়েছিল স্টেশন কোয়ার্টারে শোয়েব সিদ্দিকীর বাসার কথা। ওর বাবা গার্ড সাহেব। স্টেশন সংলগ্ন কলোনিতে থাকে। বড় ছেলে শোয়েব সিদ্দিকী এপ্রিল থেকে লাপাত্তা। শোয়েব ওর বন্ধু। সবাই জানে। প্রয়োজনে আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ আছে। পুত্র শোকার্ত ওর মায়ের মুখ মনে পরায় কষ্ট পায়, কি জবাব দেবে?

তারপর অনেক কাঠখড় পেরিয়ে টুকুকে আবিষ্কার করা। টুকু এখন ঘুমুচ্ছে। স্টেনের ম্যাগাজিন খুলে পরিষ্কার করে। এ ম্যাগজিনের চৌদ্দ কার্তুজ পাঁচ দানব খেয়ে ফেলেছে। মনে মনে হাসে। আহারে বেচারারা!

এখনো এক ম্যাগজিনসহ চৌদ্দটা কার্তুজ আছে। গ্রেনেড আছে তিনটা। ও এখন মতি ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করবে। ঘড়ির দিকে তাকায় এগারটা সাতাশ। দূরে শম্ভূগঞ্জের চটকলে অসংখ্য বাতি জ্বলছে। জলের রেখায় বাতির ঝিলিক।
ওর মনে হয়, এতক্ষণের মধ্যে লাশগুলোসহ ওই নারীকে আরেক জিপে তুলে নিয়ে গেছে। অথবা সহযোগী হিসেবে বেয়নেটের খোঁচায় হৃদপিণ্ড এখন এফোঁড়-ওফোঁড়। তাহলে কেউ বাঁচতে পারেনি! পূর্বাপর ঘটনাটি ভাবতে থাকে জাবেদ। এক ইস্টু পাঁচ। মুচকি হাসে। পাঁচ ডেড বডি দেখে কী প্রতিক্রিয়া দাঁতালদের। পাগলা কুত্তা! ভাবনার মধ্যে মণিকাকে মনে পড়ে, পড়বেই তো। মণিকার জন্য। প্রিয় মণিকা, তোমার বিছানায় ধর্ষিত নারীর প্রতিশোধ নিয়েছি। তুমি কি খুশি হও নি? আমি এখন মাতৃভূমির সৈনিক। মাতৃভূমির কন্যা-জায়া-জননীর জন্য...।

মশা-ডাঁশ ছেঁকে ধরেছে। টুকু মাঝে মাঝে হাত নাড়ছে। শরীর ক্লান্ত। তারপরও তন্দ্রা আসছে না। জাবেদের মনের মাঝে তড়পাতে থাকে। হুট-হাট পাঁচটি গুলিবিদ্ধ মানুষ গোস্বামী কাকার টপ-বারান্দায় পড়ে গেছে। ওর জন্য এ এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। এত কাছ থেকে শত্রু নিধনের আনন্দই আলাদা। ওর বুক ভরে উদ্বেলিত আনন্দ। প্রকাশ করতে পারে না। টুকুকে বলা যেত। টুকু ঘুমাচ্ছে। সড়সড় শব্দে দুয়েকটা শেয়াল শন খেতে ঢুকে পরে। হুক্কাহুয়া ডেকে ওঠে। জাবেদ শুধু কান খাড়া করে থাকে, কখন মতি ভাই আসবে? ওর হঠাৎ করে আজিজুল হক স্যারের কথা মনে পড়ে। স্যার এম কলেজে বাংলা পড়ান। অসাধারণ বাগ্মী।

রবীন্দ্রনাথের শত শত কবিতা তার মুখস্ত। কী তার উচ্চারণ! সুমিষ্ট। এখনো কানে লেগে আছে। তার সঙ্গে শেষ ক্লাস ১৩ জানুয়ারি। এরপর আর দেখা হয়নি। উত্তাল বাংলাদেশ। হঠাৎ করে মণিকার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এই মেয়ে, নাজিম হিকমতের নাম জানো?’

মণিকা অসহায়ের মতো মাথা নাড়ে।

‘তুরস্কের কবি। মাতৃভূমির প্রতি ইঞ্চি মাটির প্রতি দায়বদ্ধ সচকিত কণ্ঠস্বর। কবিতা লেখার অপরাধে জেল-জুলুমসহ মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত কবি। ভ্রাম্যমাণ জীবন নিয়ে শুধু মাতৃভূমিকেই মনে রেখেছে। নারীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছে, ‘তুমি আমার কোমল প্রাণ মৌমাছি, চোখ তোমার মধুর মতো মিষ্টি।’ লিখেছে, ‘দড়ির একপ্রান্তে মৃত্যু, সে মৃত্যু আমার কাম্য নয়। তুমি জানো, জল্লাদের লোমশ হাত যদি আমার গলায় ফাঁসির দড়ি পড়ায় নাজিমের নীল চোখে ওরা ব্যথায় খুঁজে ফিরবে ভয়।’ তারপর স্যার ক্লাস থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন নির্ধারিত সময়ের আগে।

মণিকা কি মাতৃভূমির স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখে? ও কি জানে ওর বন্ধুরা প্রতি মুহূর্ত মৃত্যুর সঙ্গে আলিঙ্গন করছে। ওর শান্ত, নির্লিপ্ত স্বভাবের জন্য মণিকা ভাবতেই পারে ওর পক্ষে যুদ্ধফ্রন্টে হামাগুড়ি দেওয়া সম্ভব নয়। আহা! মণিকা, তুমি জানবে না শত্রু নিধনের মধ্যে কী অসীম আনন্দ জড়িয়ে আছে। আসলে মণিকাকে কিছুই বলা হয়নি। সুযোগ কোথায়? আর বললেই বা কী হতো?

মণিকার মুখাবয়বে কে যেন একটি সবুজ চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। ঘড়ির দিকে তাকায়। রাত পৌনে একটা। মতি ভাই আসেনি। অপেক্ষা করছে। শান্ত নির্জন রাতের পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে জাবেদের মনে হয়, এ পৃথিবীতে এত ক্রন্দন কেন? এ সময়ে ঘোর ভাঙে। তাকাতেই চোখের মণিতে নক্ষত্রের ঝিলিক খেলে যায়। আরমোড়া ভেঙ্গে হামাগুড়ি দিয়ে জলের দিকে এগিয়ে যায়। আজলা ভরে জল খায়। নাকে-মুখে জলের ছিটা দেয়। জাবেদের কাছে গিয়ে বলে, ‘মতি ভাইয়ের কী খবর?’

‘আসেনি। সংবাদহীন।’

‘তাহলে?’

‘অপেক্ষা।’

‘মাঝরাত।’

‘অপেক্ষা।’

‘কী ভাবছো?’

‘কিছুই না। ভাবতে চাই না।’

‘খুব শিগগির অপেরেশন শেষ করতে হবে।’

‘জানি।’

‘হাতে সময় আছে।’

‘এতক্ষণ অপেক্ষা করা বিপজ্জনক।’

সুনসান নীরবতা। ওলাপোকা ডাকছে। তারপর ওদের আর কিছুই মনে নেই। ঘুমের অতলে হারিয়ে যায়।

জাবেদের ঘুম ভাঙে শেষ প্রহরের একটু আগে। আকাশের গায়ে তখনও নক্ষত্রের মুখ। তড়িঘরি করে টুকুকে ডাকে।

‘ওঠ। মতি ভাই আসেনি। একটু পরে সকাল হবে।’

টুকু আতঙ্কিত কণ্ঠে বলে, ‘উপায়!’

‘মতি ভাই ছাড়াই প্ল্যান মাফিক আক্রমণ করতে হবে।’

‘সম্ভব!’

‘ভয় পাস?’

‘না।’

‘তাহলে আমার পিছে পিছে আয়।’

জাবেদ স্টেনগান হাতে পেছনে ধনচে গাছ রেখে উঠে দাঁড়ায়। অন্ধকারে সতর্ক দৃষ্টি রেখে সামনে পা বাড়ায়।

টুকু জাবেদকে অনুস্মরণ করে। জাবেদ খুব পথ হাঁটে। অনেকটা তেলেসমাতির মতো জুবলিঘাট বরাবর ব্রহ্মপুত্রের পাড় ঘেঁষে মন্দিরের ভিমের আড়ালে এসে দাঁড়ায়। টুকুর দিকে গ্রেনেডের ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘রুটি আছে। খেয়ে নে। গ্রেনেডগুলো দে। চার্জ করার পরে এক মিনিট অপেক্ষা করবি। ফিরে না এলে কিছুই ভাববি না। কমান্ডার তোর জন্য অপেক্ষা করবে। হিঙ্গানগর রাজাকার ক্যাম্প...।’

টুকু কিছু বুঝে ওঠার আগেই অন্ধকারে হেঁটে গেল জাবেদ। রুটি মুখে দিতেই বিকট শব্দে পরপর তিনটা গ্রেনেড ফাটার ভয়াবহ ভয় নিয়ে শেষ রাতে জেগে উঠল। সাইরেন বাজছে। পটাপট গুলির শব্দ ভেসে আসছে। এই আতঙ্কিত সময়ের মধ্যে ১-২ করে ৩ মিনিট অপেক্ষা করে। তারপর দুর্দান্ত গেরিলা কায়দায় ধনচে ক্ষেত পেরিয়ে ব্রহ্মপুত্রের জলে মিশে যায়। ঠিক এ সময় বড় মসজিদ থেকে ভেসে আসছে, ‘কল্যাণের জন্য এসো।’

পাদটীকা
পরদিন স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এম আর আকতার মুকুল চরমপত্র পড়ে, ‘আমাদের ময়মনসিংয়ের বিচ্ছুরা কলেজ রোডে ব্রাশ ফায়ারে পাঁচ জন, জুবলী ঘাটে গ্রেনেড দিয়া পাকসেনারে খতম। হা হা হা। এর মধ্যে আবার দুজন জন্মের দুশমন, জন্মভূমির কুলাঙ্গার রাজাকার আছে। কে বা কারা এই সফল গেরিলা আক্রমণ করেছে, কেউ জানে না। শুধু গেরিলা টুকুর বরাত দিয়া মিয়া চাঁদ কমান্ডার জানায়, মাতৃভূমির যোগ্য সন্তান জাবেদ শহীদ হয়েছেন, ইন্না...রাজেউন।

   

গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ধ্রুব এষ



বার্তা২৪ ডেস্ক
শিল্পী ধ্রুব এষ

শিল্পী ধ্রুব এষ

  • Font increase
  • Font Decrease

নান্দনিক প্রচ্ছদ ও অলংকরণশিল্পী হিসেবে দেশে আলাদা অবস্থান তৈরি করেছেন ধ্রুব এষ। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ নিয়ে ঢাকার পান্থপথের হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এই শিল্পী।

হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে বলেন, “তার অবস্থা বর্তমানে স্থিতিশীল।”

জ্বর সঙ্গে তীব্র কাশি নিয়ে বুধবার এ হাসপাতালে আসেন ধ্রুব এষ। পরিস্থিতি দেখে তাকে এইচডিইউতে ভর্তি করে নেওয়া হয়।

লেলিন চৌধুরী বলেন, "শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের কারণে উনার অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে গিয়েছিল। সে কারণে অবস্থা কিছুটা অবনতির দিকে গিয়েছিল। পরে অক্সিজেন সরবারাহ করা হয়, এখন তিনি স্টেবল আছেন। আমরা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছি।"

সুনামগঞ্জের সন্তান ধ্রুব এষের বয়স ৫৭ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলার ছাত্র থাকার সময় বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা শুরু করেন। প্রয়াত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ বইয়ের প্রচ্ছদ ধ্রুব এষেরই আঁকা। তার আঁকা প্রচ্ছদে প্রকাশিত হয়েছে ২৫ হাজারের বেশি বই।

দেশে প্রচ্ছদশিল্পে আধুনিকতা আনার কৃতিত্ব কেউ কেউ ধ্রুব এষকে দেন। আঁকাআঁকির সঙ্গে তিনি লেখালেখিও করেন। শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য ২০২২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান ধ্রুব এষ।

;

তৃতীয় পক্ষ



ওমর শরিফ
অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

 

এ শহরে বাড়ি আর বাড়ি। ছায়া, শান্তি দেবে এমন গাছ কোথায়? গত বারের তুলনায় এবার গরমটা একটু বেশী পড়েছে। দুপুরবেলা তাই খাঁ খাঁ করছে রাস্তাঘাট। প্রায় জনমানব শূন্য চারিদিক। মাঝে মাঝে কিছু রিক্সা, ট্যাক্সি চলছে এদিক সেদিক। ভাগ্যিস দুই রাস্তার মাঝের ডিভাইডারে সারি সারি গাছ আছে। তবু একটু সবুজ দেখা যায়, তা-না হলে কিযে হতো? কথাগুলো ভাবলো মিতু। কলেজ পড়ুয়া তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী মিতু। কলেজে কোন ভাবেই মন বসছিলোনা মিতুর। একটা ঘটনা অস্থির করে রেখেছে তাকে কাল থেকে। তাই মাত্র তিনটা ক্লাস করে বেরিয়েছে ধানমন্ডি লেক যাবে বলে। ধানমন্ডি লেকে অনেক গাছ, অনেক শান্তি। সায়েলা, রবি দু’একবার জিজ্ঞেস করেছে কোথায় যাচ্ছে জানার জন্য। সায়েলা, রবি মিতুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মিতু ওদের মিথ্যে বলেছে।

-বলেছে ‘বড় চাচার বাড়ি যাচ্ছি, চাচা একটু অসুস্থ তাই দেখা করে ওখান থেকেই বাসা চলে যাবো’।     

‘ক্লাস শেষে বন্ধুদের আড্ডা জমে উঠেছিলো খুব তবু ছাড়তে হয়েছে। এই খাঁ খাঁ রোদে কার দায় পড়েছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসার? কল দিলে কল ধরো না, কেটে দাও আবার ব্যাকও করনা! এটা কি ধরনের কথা’? রিক্সার ভাড়া দিতে দিতে বলল মিতু। মিতুর রাগ দেখে সামনে দাঁড়ানো স্বপন মিটমিট হাসছে। ছয় ফিটের মতো লম্বা, ট্রিম করা দাড়ি, মাথার চুল এলোমেলো, একটা হাওয়াই শার্ট সঙ্গে জিন্স পড়া। পায়ে স্যান্ডেলের বদলে স্নিকার পড়েছে আজ। একটু আগোছাল যাকে বলে ‘স্বযত্নে অবহেলা’। স্বপনের এই ব্যাপারটাই দারুণ টানে মিতুকে। ওর মধ্যে কোথায় একটা ব্যাপার আছে। কি নেই, আবার আছে। ঠিক পূর্ণ নয় আবার খালিও নয়। স্বপন মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে। দেশের নামকরা একটা পত্রিকা অফিসে কাজ করে। কথা কম বলে। যা কথা বলে তা ওর গিটার বলে। খুব ভালো গিটার বাজায় স্বপন।      

রিক্সা থেকে নেমে তেড়ে এলো মিতু। ‘কি কানে শোন না। হাসছো আবার, লজ্জা নেই’? রাগে বলল মিতু।

‘আচ্ছা বাবা রাগ পরে হবে। আগে চলো লেকের ভেতরটায় যাই, এখানে অনেক রোদ’। বলল স্বপন। লেকের পার ধরে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে লেকের পাশে থাকা রেস্টুরেন্ট ‘জলসিরি’তে গিয়ে বসলো। রেস্টুরেন্টে লোকজন কম। দাঁড়িয়ে থাকা ওয়েটারকে এসিটা অন করে দিতে বলল স্বপন। মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বলো কি হয়েছে, এতো জরুরি তলব কেন?’

মিতু প্রতিত্তরে বলল, ‘আগে বলো এতক্ষণ ধরে তুমি আমার ফোন ধরছিলে না কেন’? কতোবার ট্রাই করার পর তোমাকে পেয়েছি, তোমার হিসাব আছে? এতো কথার পরও স্বপনকে শান্ত দেখে মিতু আরও খানিকটা রেগে গেলো। বলল, ‘তুমি কি অনুভূতিহীন, তোমার কি জানতে ইচ্ছে করেনা, আমি কেন এতবার ফোন দিয়েছি’?

স্বপন একটু সিরিয়াস হয়ে গলা খাকিয়ে বলল, ‘আসার পর থেকে আমাকে বলার সুযোগ দিয়েছ তুমি? শুধু নিজেই বলে যাচ্ছ’।

এতক্ষণে নিজেকে যেন খুঁজে পেলো মিতু, একটু লজ্জাও পেলো। কিছুটা নমনীয় হয়ে বলল, ‘আচ্ছা বলো কেন ফোন ধরতে এত সময় নিলে’?

স্বপনের সরল উত্তর, ‘খুব জরুরি মিটিং এ ছিলাম তাই তোমার ফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে ফোন ধরতে পারেনি। মিটিং শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছি। তারপর সব কাজ ফেলে এইতো তোমার সামনে আমি’।

মুখের এক্সপ্রেশন দেখে বোঝা গেলো উত্তরে মিতু সন্তুষ্ট হয়েছে। কিন্তু কিসের যেন উদ্বেগ স্পষ্ট। ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়ায়নি স্বপনের।  সে বলল, ‘কি হয়েছে? কোন সমস্যা? আমাকে খুলে বলো’।

মিতু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘স্বপন আমার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে বাসা থেকে। পাত্র পক্ষ জানিয়েছে আমাকে খুব পছন্দ হয়েছে তাদের। আগামীকাল আসবে ডেট ফাইনাল করতে। আমি এখন কি করবো স্বপন? আমাকে বলে দাও’।

স্বপন বলল, ‘বিয়ে করে ফেল। বাবা মা যা চাই তাই করো এতে সবার মঙ্গল’।

মিতু অবাক হয়ে স্বপনের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। বলল, ‘মানে কি? তাহলে এতদিন আমারা কি করলাম। তুমি একটা প্রতারক। তুমি একটা হিপোক্রেট। এখন দায়িত্ব নেয়ার সময় পালাচ্ছো। কাপুরুষ কোথাকার’। তখনও স্বপনের ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখে অবাক হয়ে গেলো মিতু।

স্বপন মিতুর দুহাত টেনে কাছে নিয়ে বলল, ‘এতো দিনেও চিনতে পারলেনা আমাকে। তুমি যা ভাবো আমি তার থেকে অনেক অনেক বেশী ভালোবাসি তোমাকে’। বলে উঠে দাঁড়িয়ে স্বপন বলল,‘চলো’। মিতু বললো,

- ‘চলো’। মিতু বললো,
- ‘কোথায়’?
- চলোই না।
- আগে বলো কোথায়?
- কাজী অফিসে।
- মানে?!
- আমরা আজই এক্ষুনি বিয়ে করছি।
- কি বলো এসব?
- যা বলছি ঠিক বলছি। এছাড়া আমাদের হাতে আর কোন পথ নেই।
- তোমার বাসা?
- আমি ম্যানেজ করবো।
- আমার বাসা?
- ওটা পরে ম্যানেজ হয়ে যাবে।

 

দরজা খুলতেই নাসরিন স্বপনের সঙ্গে একটি মেয়েকে দেখতে পেলো। দুজনেই পা ছুঁয়ে সালাম করতেই নাসরিন অবাক হয়ে পা সরিয়ে নিলো। কিছুটা সংকোচেও। নাসরিন স্বপনের মা। নাসরিন কিছুটা হতভম্ব হয়ে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন। সোফায় বসতে দিলেন। সোফাতে বসে মাকে উদ্দেশ্য করে স্বপন বলল, ‘মা আমরা বিয়ে করে ফেলেছি। তোমাকে  পরিচয় করিয়ে দিই। এ হচ্ছে মিতু। মিতু, ‘ইনি তোমার শাশুড়ি’।

নাসরিন ছেলের দিকে হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, ‘এসব কি বলছিস স্বপন, কাউকে না জানিয়ে এতবড় কাজ তুই কিভাবে করলি? তোর বাবাকে আমি কি উত্তর দিবো। আর চিনি না জানি না একটা মেয়েকে এনে ঘরে তুললি?

স্বপন পাত্তা না দিয়ে উত্তর দিলো, ‘মিতু ভালো ঘরের মেয়ে। বাবা মা শিক্ষিত। সে নিজেও শিক্ষিত অনার্স করছে। দেখতে ভালো, স্বভাব চরিত্রেও ভালো। তোমার সামনেই আছে দেখে নাও’। বলে হাসতে লাগলো।

নাসরিন আর বেশী কথা না বাড়িয়ে মিতুর দিকে তাকালেন। প্রথমিক কিছু কথা বার্তা জিজ্ঞেস করলেন।

বললেন, ‘বিয়েটা কি কোন ভাবে থামানো যাচ্ছিল না বা বাবা মা কে বুঝিয়ে শুনিয়ে অনার্স শেষ করে তারপর বিয়েটা হলে বোধহয় ভালো ছিল’। মিতু মাথা নিচু করে শুধু শুনে যাচ্ছে।

শুধু বলল, ‘আন্টি আমি বাবাকে খুব ভয় পাই আর বাবা সরকারি চাকরি ছাড়া বিয়ে দিবেন না। বললে আরও ঝামেলা বাড়বে’। 

নাসরিন মিতুকে থামিয়ে দিয়ে ঘরে নিয়ে যেতে বললো।

স্বপন দু’জনের উদ্দেশ্যে বললো, ‘অফিসে বিশেষ কাজ আছে, আমাকে একবার এক্ষুনি অফিস যেতে হবে। এর মধ্যে আশা করি তোমাদের চেনা জানা হয়ে যাবে’।

স্বপনের কথা শুনে মা ও মিতু দুজনেই বেশ অবাক হয়ে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকলো।

নিজের রুমে বসে বসে মিতু ল্যাপটপে হানিমুনের ছবি দেখছিল। কাশ্মীর যে কি সুন্দর ভাবাই যায় না। পাহেলগাম, সোনমার্গ, গুলমার্গ জায়গাগুলো ভোলার মতো না। সেবারই জীবনের প্রথম বরফ পড়া দেখেছিলো মিতু। কিছু ছবি দেখেতো মিতু রীতিমত না হেসে পারল না। সে সময় ওরা দুজনেই কেমন বাচ্চা বাচ্চা ছিল। ‘দেখতে দেখতে বিয়ের প্রায় চার বছর হতে চললো’ ভাবল মিতু। একটু কি দীর্ঘশ্বাসের মতো বয়ে গেলো বুকের ভিতরটায়? হানিমুনের ছবি দেখা শেষে পুরনো কিছু ছবিতে চোখ গেলো মিতুর। বাবা মা’র ছবি। বাবা মা পাশাপাশি বসা। বাবার কোলে মিতু। মিতুর বয়স তখন ছয় কি সাত হবে। কি দারুন একটা ছবি। মনের অগোচরেই চোখটা ভিজে এলো মিতুর। এখনও বাবার বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক হয়নি।

মিতুর বাবা মিতুর বিয়ের কথা শুনে বলেছিলেন, ‘মিতু নামে আমার মেয়ে ছিল আমি ভুলে গেছি। বাবার অপমান করতে যে মেয়ের বিন্দুমাত্র বাঁধে না; সে আমার মেয়ে হতে পারে না। মিতুর মুখ আমি দেখতে চায়না’।

মাস্টার্স পাস করে মিতু চাকরির কথা ভাবেনি, যদিও স্বপন ওকে বার বার বলেছে বাসায় একা একা বোর লাগবে, তবুও। মিতুর শাশুড়িও একই কথা বলেছে, কিন্তু মন থেকে সায় দেয়নি মিতু। বাচ্চা পালন করবে আর সংসার সামলাবে এটিই ছিল তার চিন্তা।

মিতুর বাচ্চার খুব শখ কিন্তু স্বপন এখন বাচ্চা নিতে নারাজ। বললেই বলে, ‘আরে বাচ্চার জন্য এতো তাড়া কিসের, অঢেল সময় পড়ে আছে, আগে নিজেদের মতো করে সময় পার করি’।

স্বপন সকাল সকাল বেরিয়ে যায় ফেরার কোন সময় নির্দিষ্ট নেই। কখনও আটটা কখনও দশটা পেরিয়ে যায়। আবার কখনও কাজের এতো চাপ থাকে যে কোন কোন রাতে বাসা ফেরা হয়না। কাজ নিয়ে খুব সিরিয়াস স্বপন। খুব তাড়াতাড়ি কয়েকটা প্রমশনও পেয়েছে সে। এই বছর প্রমোশন নিয়ে গাড়ি কিনেছে ওরা। মিতুর পছন্দতেই কেনা। লাল রঙের গাড়ি। লাল রঙের গাড়ি মিতুর খুব পছন্দ। স্বপনের উন্নতিতে মিতুর গর্বের শেষ ছিলনা। মিতুর কেবলই মনে হতো স্বপনের যত সাফল্য সবই তার নিজের। সে নিজে অনুভব করতো আর আনন্দ নিয়ে সেলেব্রেট করতো। মিতুর বন্ধু বান্ধবী পাড়া পরশি যার সঙ্গেই কথা হোক না কেন, ইনিয়ে বিনিয়ে স্বপনের সাফল্যের কথা বলবেই। সে কথায় কথায় স্বপন যে তার ক্যারিয়ারে খুব ভালো করছে, সে হাসবান্ড হিসেবে খুব কেয়ারিং, পরিবারের ব্যাপারে যত্নবান সেগুলো অন্যকে বলে আত্মতৃপ্তি পায়। সেদিন পাশের বাসার ভাবি বললেন, ‘মিতু ভাবি কি যে করি বলেন তো? আমার হাসবান্ড তো আমার হাতের রান্না একেবারেই খেতে পারেনা। আপনি কিভাবে যে ম্যানেজ করেন’?

মিতু হাসতে হাসতে বলন, ‘আপনার ভাইতো আমার হাতের রান্না ছাড়া খেতেই পারেনা। আসলে এ হচ্ছে ভালোবাসা, বুঝেছেন ভাবি ভালবাসা থাকলে বিষও মধু মনে হয়’।

মিতুর সেদিনের সেই আত্মতৃপ্তি ভোলার মতো না। কথা যখন বলছিলো তখন দু চোখ চকচক করে উঠছিল যেন। 

কিছুক্ষণ ধরে মোবাইলটা বেজে চলেছে। মিতু রান্না করছিলো তাই ধরতে দেরি হলো।

হাত মুছে ফোনটা ধরে বলল, ‘হ্যালো স্লামালেকুন। কে বলছেন’?  

মোবাইল ওপাশ থেকে ভেসে এলো, ‘ভাবি আমাকে চিনতে পারছেন আমি ফারুক বলছি। ঐযে নিউ মার্কেটে দেখা। আপানারা প্লাস্টিকের কিছু জিনিস কিনছিলেন। মনে আছে’?  

মনে পড়ে গেলো মিতুর। সে বলল, ‘ও হ্যাঁ ফারুক ভাই! কেমন আছেন? বাসায় সবায় কেমন আছে? বাচ্চারা কেমন আছে’? সরি ফারুক ভাই আপনার নম্বারটা আমার মোবাইল সেভ ছিল না’।  

ফারুক উত্তরে বলল, ব্যাপার না ভাবি, হতেই পারে। আপনাদের দোয়ায় সবাই ভালো আছে। আলহামদুলিল্লাহ। ভাবি একটা কাজে একটু ফোন করেছিলাম’।

মিতু বলল, কি ব্যাপার বলুন তো?

স্বপন ভাইকে একটু দরকার ছিল। উনি কি বাসায় আছে না কোন কাজে বাইরে গেছেন?

কেন আপনি জানেন না? আপনার স্বপন ভাইতো আপনাদেরই অফিসের ট্যুরে চট্টগ্রাম গেছে।

ফারুক একটু অবাক হয়ে বলল, ‘কি বলেন ভাবি? আমার জানা মতে স্বপন ভাইতো অফিসের ট্যুরে কোথাও যাননি। বরং উনি তো বাসার কাজের কথা বলে দু’দিন ছুটি নিয়েছেন।!

মিতু আর কথা বাড়ায় না। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে, অনুমানে সে তা বুঝেছে। সে কথাটা ঘুরিয়ে ফারুককে বলল, ‘হ্যাঁ স্বপন বলছিলো বাসার কাজের সঙ্গে অফিসের কাজও সেরে আসবে। তাইতো সেদিন আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলো। আমি হয়তো বুঝতে ভুল করেছি’।

ফারুক ওপাশ থেকে বলল, ‘ও আচ্ছা ঠিক আছে ভাবি, স্বপন ভাইয়ের অন্য কোন নম্বার থাকলে দিলে ভালো হয়। জরুরি আলাপ আছে’।

ফারুক ভাই স্বপনের তো একটাই নম্বার। ও তো আর অন্য কোন নম্বার ব্যবহার করেনা। ও কল দিলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলবো’।

কথা বলার সময় যতদূর সম্ভব মাথাটাকে ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করলো মিতু। কথা শেষ করে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লো সে। সে কিছু একটা গড়বড় আছে অনুমান করছে। কিন্তু আবার এও চিন্তা করছে অনুমান নির্ভর কিছু ভেবে বসা ঠিক না। সে মনে মনে চিন্তা করলো, ‘স্বপন এলে কথা বলবে’।

স্বপন দুই দিন পর অফিসের কাজ করে বাসায় ফিরে এলো। এসেই মিতুকে জরিয়ে ধরে চুমু খেল। গভীর আদরে বুকের মধ্যে নিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘আহা কি শান্তি। তোমাকে বুকে নিলে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। এই কি আছে তোমার মধ্যে? তোমাকে বুকে নিলেই আমার কেন এতো শান্তি শান্তি লাগে?

মিতু শুধু হুম হলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। বেশী কথা বাড়ালো না। স্বপন মিতুর এই ব্যবহারে কিছুটা অবাক হল। বলল, কি ব্যাপার শরীর খারাপ নাকি? কিছু হয়েছে? মন খারাপ?

মিতু উত্তরে বলল, ‘রান্না করতে করতে একটু টায়ার্ড হয়ে গেছি মনে হয়। ঠিক হয়ে যাবে। তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি’। বলে মিতু রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। স্বপনও ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকে পড়লো।

মিতুর স্বপনের এরকম ব্যবহার দেখে কিছুটা স্বস্তি বোধ করলো। মন থেকে কালো মেঘ যা এতক্ষণ খেলা করছিলো তা কেটে গেলো। নিজেকে খুব হাল্কা হাল্কা বোধ করছে এখন। দুজনে একসঙ্গে বসে খেল। ডাইনিং টেবিলে স্বপন অনেক গল্প করলো মিতুর সঙ্গে। মনে হল এই দুইদিনে অনেক গল্প জমা ছিল। মিতুকে পেয়ে সব বাধা সরে গিয়ে একসঙ্গে বেরিয়ে আসতে লাগলো সব।

এতো কিছুর পরও মিতু লক্ষ্য করলো, ‘আগে কথায় কথায় স্বপন মিতুর গায়ে হাত দিত। ট্যুর থেকে এলে বেডে অনেক আদর করতো। কিন্তু এবার টায়ার্ড বলে পাশ ফিরে শুয়ে গেলো। মিতুর শরীরটাকে কাছে টেনে পর্যন্ত নিলো না। স্বপনের ব্যবহার মিতুর কাছে কিছুটা আলাদা মনে হল। শুয়ে শুয়ে মিতুর কেবলই মনে হতে লাগলো অফিস থেকে দেরিতে ফেরা, হুটহাট ট্যুরের নামে বাইরে যাওয়া। মোবাইল চ্যাট করা আর মোবাইল বেজে উঠলে খুব সন্তর্পণে অন্য রুমে গিয়ে কথা বলা, কেমন যেন আলগা একটা অনুভূতির সৃষ্টি করলো মিতুর কাছে। মিতু ঠিক বুঝতে পারছে কিছু তো একটা আছে যা মোটেও স্বাভাবিক নয়। কোথায় যেন কি নেই। মিতু মনে মনে ছটপট করে উঠলো। এতদিন তাহলে কেন বুঝতে পারেনি সে? নাকি এ সবই তার ভুল, দুর্বল মনের বিকার মাত্র।

শুক্রবার ছুটির দিন। এই দিনটিতে স্বপন কিছুটা বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। মিতু সকালের রান্না করতে ব্যাস্ত সময় পার করছে। আজ পরোটা, ডিমভাজা আর আলুর দম রান্না হচ্ছে। স্বপনের ফেভারিট। নাস্তা প্রায় রেডি। স্বপনকে উঠাতে ঘরে ঢোকা মাত্র স্বপনের মোবাইল মেসাজের শব্দ কানে ভেসে এলো মিতুর। স্বপন তখনও ঘুমে অচেতন। ‘কোন জরুরি মেসেজ নাকি’? ভাবলো মিতু। মিতু কাছে গিয়ে মোবাইল তুলতেই আরেকটি মেসেজ ভেসে উঠলো। রিয়া নামে কেউ লিখেছে, ‘তোমাকে খুব মিস করছি’। মেসেজ দেখে মিতুর কেমন যেন বাজে অনুভূতি হল। সে সম্পূর্ণ মেসেজ পড়ার জন্য মোবাইল আনলক করতেই একগাদা হার্ট ইমজি ভেসে উঠলো। মিতুর চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠলো। সে ধীরে ধীরে স্ক্রল করতে শুরু করলো। সে যতই পড়ছে ততই অবাক হচ্ছে। স্বপন লিখেছে চট্টগ্রামের ট্যুরটা অতুলনীয় ছিল। রিয়ার উত্তর, ‘না মোটেও না। আমার মতে গুলশান হোটেলে আমাদের সময়টা ছিল বেস্ট। তবে কক্সবাজার ট্যুরটাও বেশ উপভোগ্য ছিল। বেডে যে তুমি কি পাগলের মতো করো না। তোমাকে সামলানোই যায় না। ইউ আর আ রিয়েল ওয়াইল্ড টাইগার। আই লাভ ইউ’।

উত্তরে স্বপন লিখেছে, ‘তোমার কোন তুলনা হয় না। তুমি বেস্ট। আই লাভ ইউ ঠু’।

সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছে যেন। নিজেকে দিশেহারা মনে হচ্ছে। পাগল পাগল লাগছে সব। পড়ছে আর মিতুর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ওদের দুজনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি দেখা যাচ্ছে। এসব দেখে মিতুর কেবলই মনে হচ্ছে কেউ যেন ওর হৃৎপিণ্ডটাকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে দিচ্ছে। বুকের ভেতর প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছে সে। কষ্টে কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না যেন। 

হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে মিতুকে তার মোবাইল হাতে কি যেন করছে দেখতে পেলো স্বপন। এমন সময় উঠে এসে পেছন থেকে মিতুর কাছ থকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বললো, ‘হাউ ডেয়াড় ইউ। তুমি আমার মোবাইলে হাত দিয়েছো কেন? মেসাজ কেন পড়ছো? মানুষের প্রাইভেসি বলে একটা কথা আছে। আনশিভিলাইসড কোথাকার’।

মিতু কিছুই বললোনা শুধু ফ্যালফ্যাল করে স্বপনের দিকে চেয়ে থাকলো। স্বপনের উদ্ধতপূর্ণ কথাবার্তা  নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না সে। এ ধরনের অন্যায় করার পর কোন মানুষ যে এতো নির্বিকার হতে পারে মিতুর চিন্তার বাইরে ছিল। শান্ত থাকতে থাকতে হঠাৎ মিতু চিৎকার করে উঠলো। বলল, চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার? অফিসের ট্যুরের নাম করে বান্ধবী কে নিয়ে ঘুরে বেড়াও। ছি ছি তোমার লজ্জা করেনা?

স্বপন মিতুকে থামাতে এগিয়ে আসতেই মিতু একরকম পাগলের মতো চড়, থাপ্পড় দিতে শুরু করে দিলো। আক্রোশে স্বপনের রাতে পড়া জামাটা একটানে ছিঁড়ে ফেললো মিতু। মুখে বলল কুত্তার বাচ্চা তুই আমার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আমার জীবন নিয়ে খেলেছিস। বাস্টার্ড।

স্বপন মিতুকে থামাতে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। মুখে বলল, ‘আর একটা কথা বললে তোকে এখানেই মেরে ফেলবো। কি প্রমাণ আছে তোর কাছে যে আমি লম্পট। ... উল্টাপাল্টা কথা বললে তোকে আমি খুন করে ফেলবো’।

মিতু তখনও স্বপনের জামার কলার ধরে আছে। বলল, ‘ফারুক ভাই কল করেছিলো উনি বলেছেন তুমি অফিসের ট্যুরে যাওনি। তুমি তোমার লাভারের সঙ্গে হানিমুনে গিয়েছ চট্টগ্রামে। তারও আগে কক্সবাজারে আর গুলশানে একসঙ্গে রাত কাটিয়েছ। সবই পড়েছই আমি। তোমাদের একসঙ্গে ইন্টিমেট সব ছবিও দেখেছি। ছি তোমার ঘেন্না করেনা। চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার?

সব শুনে স্বপন একটা ধাক্কা খেল যেন। একটু বোকা বোকা লাগছে নিজেকে। সে আস্তে আস্তে বিছানায় গিয়ে বসলো। কোন উপায় না পেয়ে মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার ভুল হয়েছে মিতু, আমাকে তুমি ক্ষমা করো। এবারের মতো মাফ করে দাও, প্লিজ’।

অপরাধবোধ আর অনুশোচনায় নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছিলো স্বপনের। ক্ষণিকের আনন্দের জন্য এ কোন ভুল করে বসলো স্বপন। সে চাইলেও নিজেকে আর ক্ষমা করতে পারবেনা।  

এতক্ষণে মিতুও কিছুটা ধাতস্ত হয়ে এসেছে। স্বপনের দিকে তাকিয়ে শুধু জিজ্ঞেস করলো, ‘স্বপন আমার কি দোষ ছিল? আমিতো তোমাকে নিজেকে উজাড় করে চেয়েছি। এতো বড় কষ্ট তুমি আমাকে দিতে পারলে? তুমি আমার পৃথিবী ধ্বংস করে দিয়েছ। আমাকে শেষ করে দিয়েছ। কিভাবে পারলে? এসব জানার আগে আমার মৃত্যু হলনা কেন? স্বপন আমি যে তোমাকে খুব খুব ভালোবেসে ছিলাম। এত বড় প্রতারণা তুমি কেন করলে? আমাকে বললে আমিই তোমার জীবন থেকে চলে যেতাম। তাই বলে এতবড় আঘাত তুমি আমাকে দিতে পারলে’?

 

সময় যেন থেমে গেলো। মিতু আর আগের মতো উচ্ছ্বসিত হয়না। স্বপন বিরাট ভুল করেছে এবং তা সে বারবার স্বীকার করেছে। মিতু স্বপনকে মন থেকে ক্ষমাও করেছে। কিন্তু দিন শেষে যখন মুখোমুখি হয় তখন নিজের মূল্য নিয়ে সংশয় দেখা দেয় মিতুর। বড্ড সস্তা লাগে নিজেকে। পরিপূর্ণভাবে কিছু দিতে না পারার বেদনা নিজেকে কুড়ে কুড়ে খায়। মিতু বুঝতে চেষ্টা করে তাদের মাঝে কি ছিলনা যে স্বপনকে অন্য মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। সম্মানবোধ? মিতুর মতে, ‘স্বপন মিতুকে ভালোবাসতো ঠিক কিন্তু তার মধ্যে গভীরতা ছিলনা, সম্মান ছিলনা। যা ছিল তা প্রাত্যহিক জীবনের অভ্যেস। মাপ করে চুমু দেয়া, বাহির থেকে এসে জড়িয়ে ধরা, সাংসারিক কথা বলা, রুটিন করে মিলিত হওয়া। এর মধ্যে নতুনত্ব কি আছে? যা আছে তা সবই অভ্যেস। মিতু স্বপনকে রিয়ার কাছে কেন যাচ্ছে না জানতে চাইলে বলে, ‘রিয়াকে আমি সেভাবে কখনই দেখিনি। এটা একটা মোহ’।

মিতু বুঝতে পারে রিয়া স্বপনের পাঞ্চ লাইন। অনেকটা সারাদিনের ক্লান্তির পর এক পেগ মদ যেমন তেমন। স্বপনের কাছে ঘরটা থাকলো ঠিকই, মাঝে মাঝে একটু বাম্পার রাইডিং ও থাকলো, যা জীবনে স্পাইস যুক্ত করবে। এই সমীকরণ যা বোঝায় তা হচ্ছে। স্বপনের লয়াল থাকা প্রায় অসম্ভব, মিতুও সেটি বোঝে।

আগে দুজনার অনেক কথা হতো এখন সত্তুর শতাংশ কথা কমে গেছে দুজনার মধ্যে। প্রয়োজন ছাড়া কথা হয় না। একে ওপরের দিকে ঠিক ভাবে তাকাতে পর্যন্ত পারে না। অনুশোচনায় আর অপমানে দুজনেই শুধু হারিয়ে থাকে। দুজনেই অনুভব করে, কোন কিছুই আর আগের মতো নেই। ঘটনা প্রবাহে সব কিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে। স্বপন মিতুকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য যথেষ্ট সাহায্য চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মিতু নিজের সামনে নিজেই দাঁড়াতে পারছেনা। দুপুরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মিতু ভাবছে সে আর কি করলে এমন ঘটনা ঘটতো না? কি করলে স্বপনকে আগলে রাখতে পারতো? বার বার একই উত্তর পেলো। অভ্যেস! টানটা আর আগের মতো নেই।

পরের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে মিতু বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকালের আকাশ দেখছে। আনমনে কি যেন ভাবছে। স্বপন মিতুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, ‘অফিসে যাচ্ছি’ বলে বের হয়ে গেলো। মিতু একবার সকালের নাস্তার কথা জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলো না। বারান্দায় বসে দুই হাতের তালুতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে  কাঁদতে শুরু করলো।

রাতে স্বপন অফিস থেকে ফিরে এসে কলিং বেল দিলো। কিন্তু কেউ দরজা খুলছে না দেখে একটু ভয় পেয়ে গেলো সে। ব্যাগে রাখা এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল স্বপন। রাতে লাইট জ্বালায়নি মিতু। পুরো বাসা চুপচাপ। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো স্বপনের। হঠাৎ ভয় পেয়ে মিতু মিতু বলে ডাকতে শুরু করে দিলো স্বপন। বেডরুমে ঢুকে দেখল মিতু সেখানে নেই। লাইটের সুইচ অন করলো স্বপন। বাথরুম, পাশের রুম, বেলকণি ঘুরে ঘুরে দেখল, কয়েকবার ডাকলো মিতু নাম ধরে কিন্তু কোন সাড়া নেই। বেড রুমে ফিরে এসে বিছানায় বসে পড়লো স্বপন। দুই হাতের তালুতে মুখ লুকাল সে। ভয়ে টেনশনে ঘেমে নেয়ে গেছে একেবারে। হাত থেকে মুখ তুলতেই লক্ষ্য করলো এস্ট্রের নিচে চিঠির মতো কি যেন চাপা দেয়া আছে টেবিলের উপর। স্বপন উঠে এসে দেখল হ্যাঁ মিতুর লেখা চিঠি একটা।

চিঠিতে লেখা,

স্বপন, আমরা পছন্দ করে পরিবারের মতের বাইরে গিয়ে সংসার পেতে ছিলাম। সুখে দুখে আমরা সব সময় এক ছিলাম। পাশাপাশি ছিলাম। ভেবেছিলাম জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমার সঙ্গে পাড়ি দিবো। তা আর হলনা। এই ৮ বছরের সম্পর্কে কোনদিন বুঝিনি তুমি আমার কেউ নও। আজকের পর থেকে শুধুই মনে হচ্ছে তুমি আমার কেউ নও, তুমি আর পাঁচটা মানুষের মতো। তুমি নিশ্চয় জানো একটা সম্পর্ক টিকে থাকে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর সম্মান বোধ থেকে। একটা সম্পর্কের আয়ু বেড়ে যায় একে অপরকে বোঝা পড়ার মাধ্যমে। জানিনা কি পাপ করেছিলাম যে আল্লাহ আমাকে এতো বড় শাস্তি দিলেন। হ্যাঁ, শাস্তিই বটে। সম্পর্কে প্রতারণার কোন জায়গা থাকতে পারে না। আমি জানি আমাকে তুমি ঠিক ভালোবাসতে পারোনি। যা তুমি ভালবাসা বলছো তা আমার প্রতি নিছক ইনফাচুয়েসন। পুরনো অভ্যেস। কেন? সেটির উত্তর তুমিই ভালো দিতে পারবে। তুমি আজ আমাকে যে অসম্মান করেছ তার কোন তুলনা হয় না। আয়নার সামনে কোনদিন দাঁড়াতে পারবো এ বিশ্বাস আমার মরে গেছে। তোমার প্রতি রাগ বা ঘৃণা কোনটিই নেই আমার। তুমি আমার কাছে এখন যে কোন পুরুষ। তবু আমি তোমার ভালো চাইবো। তুমি ভালো থেকো। অনেক ভালো থেকো। নিজের যত্ন নিয়ো। শুধু জেন মিতু নামের একটি মেয়ে তোমাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসেছিল। তোমাকে খুব খুব চেয়েছিলো। তার দাম সে পায়নি বলে চলে যাচ্ছে। আমাকে খুঁজনা।-মিতু

চিঠিটা পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বুকের মাঝে ধরে, ‘মিতু আমাকে মাফ করে দাও, আমাকে ক্ষমা করে দাও’ বলে বিলাপ করতে লাগলো স্বপন। কেমন পাগলের মতো মিতু মিতু বলে ডাকতে লাগলো সে। কিছুক্ষণ পর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবনটাকে অসম্ভব ভারি বলে মনে হতে লাগলো স্বপনের। বিস্তীর্ণ আকাশে জীবনের অসীম অনিশ্চয়তার দিকে তাকিয়ে থাকলো শুধু।      

;

নৃত্য-গীতে জীবন্ত হল রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কালজয়ী আখ্যান



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্ব পরিভ্রমণের সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আর্জেন্টিনায় ল্যাটিন আমেরিকার কালজয়ী সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক ও নারীবাদী লেখক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ঐতিহাসিক সাক্ষাতের শতবর্ষ এ বছর।

১৯২৪ সালে এই দুই কালজয়ী লেখকের সাক্ষাত অক্ষয় হয়ে আছে দু’জনের জীবনস্মৃতিতে, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আদান-প্রদানে আর ভিক্টোরিয়াকে রবীন্দ্রনাথের ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করার মতো বহু ঘটনাবহুল আখ্যানকে ঘিরে। দু’জনের এই মধুর এ আখ্যানকে ঢাকার সাহিত্য ও সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে তুলে ধরলো ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি)।

সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ছায়ানট মিলনায়তনে ‘TAGORE AND VICTORIA OCAMPO-VIJAYA the victorious: 100 years on’ শীর্ষক নৃত্য-গীতে সেই অবিস্মরণীয় আখ্যানকেই ফুটিয়ে তুললেন যুক্তরাজ্য থেকে আগত বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও শিল্পী ডা. অনন্ত গুপ্ত এবং তাঁর সহশিল্পীরা।

বক্তব্য রাখছেন ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসা

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি) এর পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী আয়োজনের পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে অতিথি ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসার লাতিন আমেরিকার জনগণের হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির কথা তুলে ধরে তাকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধন রচনকারী মহান লেখক হিসেবে বর্ণনা করেন। অনুষ্ঠানে আর্জেন্টিনায় অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ রচিত বিভিন্ন কালজয়ী গান নৃত্যসহযোগে পরিবেশন করেন শিল্পীরা। একইসঙ্গে সেইসব গানের প্রেক্ষিত তুলে ধরা হয়।

উল্লেখ্য, ১৯২৪ সালে পেরু সরকারের আমন্ত্রণে দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবর্ষ উদযাপনে যোগ দিতে গিয়ে তেষট্টি বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ সমুদ্রপথে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় তিনি আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেসে থামেন এবং ওঠেন সান ইসিদ্রো শহরের এক হোটেলে। সেখানে কবির ভীষণ অনুরাগী আর্জেন্টিনার বিখ্যাত সাহিত্যিক ও নারীবাদী লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো (যিনি কবির গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদ পড়ে তাঁর কবিতার সঙ্গে কবিরও অনুরাগী হয়ে উঠেন)। রবীন্দ্রনাথের আগমনের খবরে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ছুটে যান কবির কাছে। তিনি কবিকে সুস্থ করার জন্য হোটেল থেকে নদী তীরে বাগানবাড়িতে নিয়ে আসেন।

অনুষ্ঠান মঞ্চে অতিথিদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন আইজিসিসি পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী

এরপর এই দুই লেখকের সম্পর্ক গভীর আত্মিক সম্পর্কে পর্যবসিত হয়। কবি তাঁকে বিজয়া বলে সম্বোধন করতেন। কবির বিভিন্ন গানেও ভিক্টোরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে। তাকে উৎসর্গ করেন কাব্যগ্রন্থ ‘পূরবী’। রবীন্দ্রনাথকে চিত্রকর্মে প্রাণিত করেন ওকাম্পো। ব্যবস্থা করেন প্রদর্শনীরও। দুই কালজয়ী সাহিত্যিকের মাঝে যেসব পত্র বিনিময় হয় তা সাহিত্যের চিরকালীন সম্পদে পরিণত হয়েছে।

;

বর্ষবিদায় - বর্ষবরণ

  ‘এসো হে বৈশাখ’



প্রদীপ কুমার দত্ত
মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

আবারও বছর ঘুরে এসেছে বৈশাখের পয়লা দিন। আমাদের জাতীয় উৎসব নববর্ষ। গত বেশ কয়েক বছর ধরে দেখতে পাই এই উৎসব নিকটবর্তী হলেই মঙ্গল,আনন্দ,আশার প্রতীক দিনটিকে বিতর্কিত করে একে বানচাল করার এক অশুভ প্রচেষ্টা দানা বাঁধানোর উদ্দেশ্যে একশ্রেণির লোক মাঠে নামে। পহেলা বৈশাখ উৎযাপন উপলক্ষে যে উৎসবমুখরতা, তা আমাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়,আমাদের কৃষ্টি সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এই জাতীয় নানা বিষয়ের অবতারণা করে দিনটিকে বিতর্কিত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।

বিতার্কিকদের মধ্যে কেউ কেউ আবার এর মধ্যে ধর্মাচরণকেও টেনে আনেন। গত বছর তো আইনগত ব্যবস্থা নেয়াও শুরু হয়েছিল। সেই প্রচেষ্টা অবশ্য হালে পানি পায় নি। এবারেও দন্ত-নখর বের করা শুরু করেছিল আমাদের বাংলার আদি সংস্কৃতির বিরোধীরা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয় সরকার ক্ষমতায় থাকায় অংকুরেই সেই চেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়ে থেমে গেছে। অবশ্য সরকার উভয়পক্ষকে খুশি রাখার চেষ্টা করে উৎসব পালনের সময়সীমা সংক্ষিপ্ত করে নির্দেশনা জারি করেছেন। এই রকম আপোষ করে সেই কুৎসিত শক্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তোলা হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা সরকারের উপযুক্ত মহলের উচিৎ।

উৎসব পালনের কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। সময়ের সাথে সাথে এবং অঞ্চলভেদে বিভিন্ন অনুষঙ্গ ও ধরন পাল্টায়। সংস্কৃতি ও কৃষ্টি গতিশীল। সমাজে গ্রহণযোগ্য এবং শালীনতার মাত্রা অতিক্রম না করা আনন্দে মেতে ওঠার বিভিন্ন কার্যক্রমের সমষ্টিই উৎসব। আদিকাল থেকেই বৈশাখী মেলা, হালখাতা, চৈত্র সংক্রান্তি, গাজন, নীলপূজা, চড়ক, বিভিন্ন প্রকৃতির লোকজ সংস্কৃতির ও খেলাধুলার আয়োজন,সাধ্যমত নতুন পোষাক ও ভালো খাবারের আয়োজন,অতিথি আপ্যায়ন, ইত্যাদি নিয়ে বাঙ্গালীরা পুরাতন বর্ষ বিদায় ও নববর্ষের আগমনকে একটি উৎসবের রূপ দিয়ে আসছে।

কালক্রমে বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে বাংলা সংস্কৃতির উপর পাক সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন কতৃপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার অংশ হিসাবে ছায়ানট রমনা বটমূলের বর্ষবরণ উৎসব আয়োজন শুরু করে। সেই আয়োজন আজ ডালপালা বিস্তার করে সারা দেশে এমনকি দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিহাস স্বাক্ষী, মৌলবাদের কালো থাবা সেই আয়োজন থামিয়ে দিতে রমনা বটমূলের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে নিরীহ সংস্কৃতি প্রেমীদের হত্যা করেও সফল হয়নি।২০০১ সালের সেই হামলার পর নিরীহ বাঙ্গালী গর্জে উঠে ২০০২ সালে আরও অধিক সংখ্যায় রমনায় হাজির হয়েছে। দেশের শহর ও গ্রামের দিকে দিকে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আরও ব্যপ্তি লাভ করেছে।

ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট বিগত শতাব্দীর আশির দশকে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু করে। এই আনন্দ উৎসব পরবর্তীতে মঙ্গল শোভাযাত্রার রূপ ধারণ করে। এই সফল আয়োজন ইতোমধ্যে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভ করেছে। আনন্দ প্রকাশের এই বহিঃপ্রকাশ নিয়ে এক শ্রেণির লোকের প্রচন্ড গাত্রদাহ রয়েছে।ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে তারা এই শোভাযাত্রা বন্ধ করতে চায়।দেশের প্রাগ্রসর প্রগতিশীল নাগরিকরা এই জাতীয় অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে চায় না। মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান সহ বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের সকল আয়োজন দিন দিন আরও সবল,সতেজ ও পরিশীলিতভাবে অগ্রসর হবেই।

বৈশাখী উৎসবের বিরোধিতাকারী কূপমণ্ডূকদের অনেকের জানাই নেই যে এই উৎসব একই সময়ে দুই একদিন আগে বা পরে বহু জায়গায় বিভিন্ন নামে পালিত হয়। আমাদের নববর্ষ, আসামে বিহু,পাণ্জাবে বৈসাখ,থাইল্যান্ডে সাংক্রান,বার্মায় থিংইয়ান,নেপাল ও সংলগ্ন উত্তর ভারতে বিক্রম সম্ভত,কম্বোডিয়ায় চউল চ্নাম থিমে, সিংহলে আলুথ অনুরুদ্ধা, লাওসে বা পি মেই, কেরালায় ভিষু, তামিলনাড়ুতে পুথান্ডু, এই সব উৎসবই দক্ষিণ /দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রাচীণ কাল থেকে চলে আসা বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ। অনেক এলাকায়,এমনকি আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামেও ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল বা একে অপরের শরীরে পানি ছিটানো এই উৎসবের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। জল শুচি,পবিত্রতা ও শুভ্রতার প্রতীক। পুরনো বছরের ভুল, অসাফল্য, গ্লাণি সব ধুয়ে নতুন বছর আরও উন্নততর জীবনযাত্রায় এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক এই জল ক্রীড়া।

যে সকল অন্ধকারের শক্তি এই বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ উৎসবকে হিন্দুয়ানীর সাথে সম্পর্কিত অনুষ্ঠান বলে প্রচার করেন তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে সনাতনী ধর্মাচার ও সামাজিক আচার কিছু এই সময়ে অবশ্যই থাকে। সেগুলো সবই তাঁরা পালন করেন পণ্জিকা অনুযায়ী। সেই পঞ্জিকার সনাতনী ধর্মের পূজা বা উৎসব সমূহ নির্ধারিত হয় বিক্রম সম্ভত বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চন্দ্র/সূর্য/নক্ষত্র এর অবস্থান সমন্বয় করে বিভিন্ন মাস ২৯,৩০,৩১ এমনকি ৩২ দিনেও হয়।

সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী পহেলা বৈশাখ বেশির ভাগ বছর ১৫ এপ্রিল তারিখে হয়ে থাকে।লিপ ইয়ার সেই বর্ষপণ্জিতে না থাকার কারনে মোটামুটি চার বছরে একবার এটি ১৪ এপ্রিলে হয়। বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের জন্য বহু বছর গবেষণার পর বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে নিজস্ব বর্ষপঞ্জি চালু করেছে। সেই বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে প্রায় বছরই বাংলাদেশের সনাতনী সম্প্রদায় নববর্ষের দিন (১৪ এপ্রিল) তাঁদের সামাজিক/ধর্মীয় চৈত্র সংক্রান্তির পালনীয় ক্রিয়াকর্ম নিজেদের ঘরে পালন করেন।কিন্তু পহেলা বৈশাখের নববর্ষের সকল উৎসব ও কর্মকাণ্ডে আপামর দেশবাসীর সাথে সানন্দে অংশগ্রহণ করে থাকেন। একই কথা তাঁদের অন্য সকল পূজা পার্বণের বেলায়ও খাটে।


আমাদের পার্বত্য এলাকায় এই নববর্ষ পালন হয় জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে। এই অঞ্চলে বহু বাঙ্গালী তো আছেনই। কিন্তু বৃহৎ সংখ্যায় থাকেন ১৪টি বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মানুষ। নৃতাত্ত্বিক,সাংস্কৃতিক,ভাষাগত এবং বিভিন্ন ভাবে তাঁরা সমতলের বাঙ্গালীদের চাইতে তো বটেই, এমনকি একে অপরের চাইতেও আলাদা। এই বিভিন্নতা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এই সৌন্দর্যের নামই বহুল প্রচলিত শব্দবন্ধ ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি বা বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্য।

এখানকার বম,খিয়াং,লুসাই,পাঙ্খোয়া ও খুমিরা বৃহত্তর সংখ্যায় খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী। তাঁদের বড় উৎসব বড়দিন(ক্রিসমাস)।বকি সকলের জন্য তিন দিন ব্যাপী বর্ষবিদায় /বর্ষবরণ উৎসবই বছরের সেরা পার্বণ। এই সময় সব পাহাড় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে উৎযাপনে।যোগ দেন তাঁদের খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী অন্যান্য জাতিসত্ত্বার প্রতিবেশীরা এবং পাহাড়ে থাকা বাঙ্গালীরা। আমোদে অংশ নিতে দেখা যায় সমতল থেকে এই উপলক্ষে ছুটে আসা পর্যটকদেরও।

তাঁদের উৎসব আনন্দ উৎযাপনের মধ্যে অনেক উপাদান। মঙ্গল শোভাযাত্রার আলোকে র‍্যালী হয় সবাইকে নিয়ে।আয়োজনে থাকে প্রশাসন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। হয় বিচিত্রানুষ্ঠান। খাওয়া দাওয়ার আয়োজন সকলে করেন সাধ্যানুযায়ী উঁচুমানের। তার মধ্যে বিশেষ একটি আয়োজন হল বিভিন্ন তরিতরকারির মিশ্রণে পাঁজন বা লাবড়া। কে কত পদের তরকারি/শাক/ওষধি দিয়ে পাঁজন রেঁধেছেন তার চলে অঘোষিত প্রতিযোগিতা। ক্ষেত্র বিশেষে এই সংখ্যা পণ্চাশ ছাড়িয়ে যায় বলে শুনেছি।


উৎসবমালা শুরু হয় দেবতা ও প্রয়াতঃ পূর্বপুরুষদের স্মৃতিতে পাহাড়ি ঝরণা বা নদীতে ফুল ও প্রদীপ ভাসিয়ে। নতুন কাপড় পরিধান নতুন বছরের আগমনকে স্বাগত জানানোর প্রতীক।মন্দিরে চলে মহামতি বুদ্ধদেবের আরাধনা আগত বছরে সকলের মঙ্গল কামনায়। অনেক বড় মন্দিরে বহু লোক সমাগম হয় প্রথম দিন রাতে।সারা রাত উৎসবমুখর পরিবেশে পিঠা তৈরিতে সবাই হাত লাগায়। প্রত্যুষে সেই পিঠা দেবতাকে নিবেদন করা হয়। প্রথম দিন বহু মন্দিরের বুদ্ধ মূর্তি বাদ্য সহযোগে আনন্দ মিছিল করে নিয়ে যাওয়া হয় নিকটবর্তী নদীর পানিতে স্নান করানোর জন্য।

পাহাড়ে নববর্ষের সবচাইতে বড় আকর্ষণ সাংগ্রাইং জলক্রীড়ার কথা আগে উল্লিখিত হয়েছে। এছাড়াও থাকে পিঠা তৈরির প্রতিযোগিতা, কুস্তি,তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার প্রতিযোগিতা, ইত্যাদি। সৌহার্দ্য বাড়াতে একে অপরের বাড়িতে যাওয়া,দলবদ্ধ ভাবে পান ভোজনের ব্যবস্থা করাও এই তিন দিনের কার্যক্রমের বিশেষ একটি দিক। চাকমারা বিজু, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বৈসুক,মারমারা সাংগ্রাইং, ম্রো জনগণ চাক্রান নামে এই উৎসবকে অভিহিত করেন। তণ্চঙ্গাদের কাছে বিষু,অসমীয়া সম্প্রদায়ের কাছে বিহু নামে পরিচিতি এই উৎসবের।

নামে কি বা আসে যায়। যে যেই নামেই জানুক এই উৎসব আমাদের লোকজ সংস্কৃতির একটি প্রাণের উৎসব। বাঙ্গালী ক্ষুদ্রতর নৃগোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাই যার যার পছন্দ ও সাধ্য অনুযায়ী উৎসব পালন করবেন এটাই স্বাভাবিক। কারো যদি পছন্দ না হয় তিনি উৎসব পালনে বিরত থাকতেই পারেন। সেটা তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতা। কিন্তু অন্যের উৎযাপনে বাধা সৃষ্টি করার অধিকার কারও নেই।

প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা এই নববর্ষের সাথে সাথে হিজরি সাল;চন্দ্র,সূর্য, নক্ষত্র মন্ডলীর অবস্থান;ফসল তোলা;খাজনা পরিশোধ; ইত্যাদি বিষয়ের সমণ্বয় করে জ্যোতির্বিদ ফতেহউল্লাহ্ সিরাজী ও রাজা টোডরমলের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বাদশাহ আকবর চালু করেন আমাদের বর্তমানে চলিত বাংলা বর্ষপঞ্জি। সেই বর্ষপঞ্জির ১৪৩১ সাল সমাগত।

আসুন আমরা ১৪৩০ কে বিদায় জানিয়ে আবাহন করে নেই ১৪৩১কে। দেশবাসী ও বিশ্ববাসী সকলকে জানাই নববর্ষের শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি সকলের। কামনা করি ক্ষুধা মুক্ত,বণ্চনা মুক্ত, প্রতারণা মুক্ত, ব্যথা মুক্ত ও যুদ্ধ মুক্ত পৃথিবী। কল্যাণ হোক সকলের।সুখী ও সমৃদ্ধ হোন সবাই।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;