অদ্ভুত আঁধার এক...



রুমা মোদক
অলঙ্করণ: কাজী যুবাইর মাহমুদ

অলঙ্করণ: কাজী যুবাইর মাহমুদ

  • Font increase
  • Font Decrease

অদ্ভুত আঁধার এক পৃথিবীতে এসেছে আজ, সত্যিকারের আঁধারে ছেয়ে গেছে আমাদের বর্তমান, আমাদের ভবিষ্যৎ। এমন এক আচমকা অন্ধকার যার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না আদৌ। আমরা অর্থনৈতিক কিংবা সামাজিক নিরাপত্তার দিক থেকে যারা তৃতীয় শ্রেণির তারা তো বটেই, প্রথম ও উন্নত বিশ্ব হিমসিম খাচ্ছে এই নতুন উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবেলায়।

আমাদের জন্য বছরটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় জীবনে বছরটি ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকী। বিপুল উদ্দীপনায় জাতি প্রস্তুত ছিল বছরটি উদযাপনের। আয়োজনের ঘাটতি ছিল না। কিন্তু অদৃশ্য শক্তিশালী এক জীবাণু মুহূর্তে সব তছনছ করে দিয়েছে। এক আদেশে থেমে গেছে সব আয়োজন। শুধু কি জাতির পিতার জন্মশতবর্ষের আয়োজন, রাত পোহালে আমাদের ৪৯তম মহান স্বাধীনতা দিবস। দৃষ্টি মেলে দেখা, অভিজ্ঞতার আলোতে অভ্যস্ত আয়োজনগুলি এবার আর দেখা যাবে না। প্যারেড গ্রাউন্ডে ব্যান্ডে তাল উঠবে না আমাদের জাতীয় এই গৌরবের দিনটি। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মঞ্চগুলি মেতে উঠবে না কোরাসে—এক সাগরে রক্তের বিনিময়ে... কিংবা তোমাকে পাওয়ার জন্যে হে স্বাধীনতা...।

এই রোগে মৃত্যুর মিছিল ঠিক কোথায় গিয়ে থামবে তা বলা যাচ্ছে না। এটা অনেকখানি নির্ভর করবে, কোন দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা করোনা মোকাবেলায় কতখানি প্রস্তুত তার ওপর। যে দেশ যতটা প্রস্তুত সে দেশে মৃত্যুর হার তত কম হবে, আর অপ্রস্তুত দেশে অতিরিক্ত রোগীর চাপে বা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্যকর্মী ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদির অভাবের কারণে মৃত্যুর হার সেটা ৫% বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে। ১০০ জনে ৪ জন (যদি ৪% ধরা হয়), ২০০ জনে ৮ জন, দুই হাজারে ৮০ জন, দুই লক্ষে ৮ হাজার জন; আর যদি দশ লক্ষ মানুষ (মোট জনসংখ্যার মাত্র ০.৬%) সংক্রমিত হয়, তবে মৃতের সংখ্যা গিয়ে ঠেকবে ৪০ হাজারে!

আমাদের দেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। ইউরোপীয় দেশগুলো ধারণা করছে এই ভাইরাস তাদের মোট জনসংখ্যার ন্যূনতম ৬০-৭০% মানুষকে আক্রান্ত করবে। তাই আমাদের দেশে ১০ কেন, ২০ কিংবা ৩০ লক্ষ মানুষের মাঝে এই ভাইরাস সংক্রমিত হওয়াটা খুব বিচিত্র কিছু হবে না। ভাবা যায়! দুই থেকে আড়াই লক্ষ মানুষ শেষ হয়ে যাবে এই সংক্রমণ না প্রতিরোধ না করতে পারলে।

কোভিড-১৯ একজন থেকে আরেকজনের দেহে সংক্রমিত হচ্ছে আমাদের সামাজিক মেলামেশার কারণে—বিদেশ থেকে দেশে, পরিবারের একজন থেকে অন্যজন, এক পরিবার থেকে অন্য পরিবারে, এক পাড়া থেকে অন্য পাড়ায়, শহর থেকে গ্রামে, এবং ক্রমান্বয়ে সারাদেশে! আমরা যদি কোনো ধরনের সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কাজ না করি তবে এই রোগ সারা দেশের প্রতিটি মানুষকে সংক্রমিত করবে! আমরা যদি এলাকা-ভিত্তিক কোয়ারেন্টিন করার চেষ্টা করি, তা সাময়িকভাবে কিছুটা উপকার করলেও দ্বিতীয় দফায় তা আবারও ছড়িয়ে পড়বে; আমরা যদি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারে গুরুত্ব দিই, তাহলে সেটা এলাকা-ভিত্তিক কোয়ারেন্টিনের চাইতে ভালো কাজ করবে। তবে, আমরা যদি ব্যাপকভাবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখি, তাহলে সেটা সবচেয়ে বেশি সুফল দেবে।

আচ্ছা এমন দিন এমন যাপন কি আমাদের কল্পনায়ও ছিল কোনোদিন? আমাদের সব আয়োজন তো বটেই থেমে যাবে আমাদের প্রাত্যহিক দিনগুলো? আমরা কেবলই বাড়ির ভেতরে, ঘর থেকে ঘরে, আরো কক্ষের ভেতরে বিচ্ছিন্ন হবো আরো। আমরা ঘুমাতে যাব প্রবল অনিশ্চয়তায়, কে জানে কাল ভোরটা দেখব কিনা!

এমন নয় যে, আমরা জানি আমরা অসুস্থ। বরং আমরা আছি এক গভীর আতঙ্কে কখন কোন মুহূর্তে আমাদের ভেতর প্রবেশ করে অচেনা অদৃশ্য ঘাতক। আমরা ঢুকে পড়ি মৃত্যুকূপে। আমাদের সাথে প্রতিদিন মহড়ায় আসে, গলা মেলায়, ভুলগুলো ঠিক করে, মঞ্চে উঠার আগে পা ছুঁয়ে আশিস চায়। প্রতি সন্ধ্যায় বাসায় চা-মুড়ি...তুমুল আড্ডা। এই জায়গাটায় বডি লেঙ্গুয়েজটা ঠিক কেমন হলে বেশি ভালো হতো? কিংবা কণ্ঠের ভেরিয়েশন। প্রতিদিন, প্রতিটি সন্ধ্যা। কয়েকদিন ওরা আসছে না। কাল এসে দরজার বাইরে, ঘরে ঢুকছে না। দিদি, না দেখে আর ভালো লাগছে না, তাই দেখতে এলাম। কে জানে যদি এটাই হয় শেষ দেখা!

এ কেমন দিন,এ কেমন অচেনা যাপন!

বিশ্বের সামনে এ এক নতুন পরীক্ষা, ভয়াবহ পরীক্ষা। যে পরীক্ষার মুখোমুখি পরপর কয়েকটি জেনারেশান হয়নি এর আগে। এ এক লড়াই। নতুন লড়াই। কিন্তু শত্রু দৃশ্যমান নয়। চিহ্নিত শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই হয়তো সহজ কিছুটা, ঢাল তলোয়ার, অস্ত্র, কিছুটা কৌশল।

কিন্তু শত্রু যখন হয় অদৃশ্য, যার বিরুদ্ধে আমাদের কার্যকর অস্ত্র জানা নেই, জানা নেই কৌশল। জানা নেই এর গতি, স্পষ্ট নয় এর প্রকৃতি। অন্ধকারে দরজা খুললেই মনে হচ্ছে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই গুপ্ত ঘাতক, আমাদের সামান্য অসচেতনতার সুযোগ নিয়ে ঢুকে পড়েছে আমাদের দেহে, বিপন্ন করে দিচ্ছে আমাদের জীবন, মানব জীবন...মানব সভ্যতা...।

কখনো নিরপরাধ আমরা। কোনো ক্ষমা প্রার্থনা, ভুল স্বীকার, কোনো অনুশোচনা কিছুতেই মুক্তি নেই আর। যদি না প্রকৃতি আমার ভেতর থেকে আমাকে রক্ষা না করে, কোনো পদক্ষেপই কাজে লাগবে না আর।

ভাবতে পারেন কেমন বদলে গেছে আমাদের চেনা পৃথিবীটা? হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা, পরিপুষ্ট হওয়া, শ্লাঘা করা বিশ্বাসের ভিতগুলো কেমন বালির বাঁধের মতো ভেঙে পড়েছে। অতিপ্রাকৃত, সর্বশক্তির আধারের উপাসনালয়গুলো থেকে সরে গেছে লক্ষ লক্ষ মানুষ, স্বীকার করি কিংবা না করি পরোক্ষে এ তো আস্থাহীনতাই।

ভাবতে পারেন, হয়তো আপনার সব প্রয়োজন ফুরিয়েছে! এই উদযাপন, উৎসব সবকিছুর। ভাবতে পারেন আর মেলা জমবে না বটতলা হাটতলায়! প্রয়োজন ফুরিয়েছে পা ছুঁয়ে আশিস নেওয়ার, কোলাকুলিতে সৌহার্দ্য বিনিময়ের, হাতে হাত মিলিয়ে ‘হাউ ডু ইউ ডু’ বলে কুশল বিনিময়ের? এক সম্পূর্ণ নতুন পৃথিবী এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের সামনে।

এখানে থিয়েটার নেই, ম্যুভি নেই, ক্লাব নেই, বার নেই, আড্ডা নেই, চায়ের ঠেক নেই কেবল আছে টিকে থাকার অদম্য অসহায় আশা।

সন্তানের গালে চুমু খেয়ে আমরা ভাবছি, এই কি শেষ চুমু! প্রেমের হাত ছুঁয়ে ভাবছি এই কি অন্তিম ছোঁয়া, এরপর আর গন্তব্য নেই কোনো চূড়ান্তের.....? মাকে ফোন দিয়ে ভাবছি, এই কি শেষ শোনা মায়ের কণ্ঠ?

গানটা মনে পড়ছে—একলা মানুষ মাতৃগর্ভে, একলা মানুষ চিতায়....? কিংবা আবুল হাসানের সেই কবিতা, অবশেষে মানুষ জেনেছে সে তার চিবুকের কাছেও একা...? কিংবা চলচ্চিত্রের সেই মেলোড্রামাটিক দৃশ্যটি প্রতারিত প্রেমিকা চিৎকার করে কাঁদছে—প্লিজ আমাকে একা থাকতে দাও...?

আচ্ছা, বুকে আজ একবার হাত দিয়ে নিজেকে জিজ্ঞেস করি, আমরা কে একা নই? আমাদের এমন কে আছে যার সাথে জীবনের সব গোপন, সব গ্লানি, সব অপমান, সব প্রতারণা ভাগ করে নিতে পারি? গর্ভধারিণী জননী কিংবা ঔরস দেওয়া জনক, এক ছাদের নিচে কাটানো জীবন সঙ্গী কিংবা কাবিন বিহীন বন্ধু কিংবা নাড়ি ছেঁড়া আত্মজ!

যে নিজের জীবন শঙ্কায় ফেলেছে আমাকে জন্ম দিতে গিয়ে কিংবা আমি নিজের জীবন শঙ্কায় ফেলেছি যাদের জন্ম দিতে, যে আমার জন্য দুরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছে লাল কাপড় কেউ কি প্রস্তুত আমার আমিত্বের সকল প্রকাশ্য গোপনের ভাগ নিয়ে আমাকে একাকীত্ব থেকে মুক্তি দিতে? না।

এই যে সামাজিক যত আয়োজন, প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা অপ্রাতিষ্ঠানিক তার অধিকাংশটুকুই কেবল গৌরব ভাগাভাগির, স্বার্থ বিনিময়ের-স্বার্থ শব্দটি সবসময় নেতিবাচক নয়, প্রয়োজনেরও। কখনো দুঃখ কিংবা বেদনা ভাগাভাগিরও। কিন্তু জীবনের প্রতিটি বাঁক উপবাঁকের সত্য বলার মতো একাকীত্বহীন কেউ কি আছে পৃথিবীতে? আসলেই তো মানুষ বড় একা...।

এই নতুন যুদ্ধ আরো ক্রমশ একা হবার যুদ্ধ। কতটা আরো কতটা একা হতে পারে মানুষ, এবার পরীক্ষা তার। মানসিক একাকীত্ব শারীরিক একাকীত্বে স্থানান্তরের পরীক্ষা। তুমি তো একাই ছিলে মানুষ, এবার শুধু বিচ্ছিন্ন হও, সাময়িক বিচ্ছিন্ন হও পুনরায় যুথবদ্ধ হবার প্রত্যাশায়...।

এই একাকীত্বের পরীক্ষায় যত ভালো ফল হবে ততই সম্ভাবনা বাড়বে একটি সভ্যতা বেঁচে যাবার।

মানুষ বাঁচলে সভ্যতা বাঁচবে। সভ্যতা বাঁচলে আবার জমবে মেলা বটতলা, হাটতলা....।আমরা আবার পা ছুঁয়ে ফিরিয়ে আনব প্রিয় মূল্যবোধগুলো, গলাগলির বন্ধুত্বে ফিরে যাব নতুন কোনো মূল্যবোধে। হয়তো আমাদের উৎসব উদযাপনগুলো এই ক্রান্তিকালের সাঁকো পার হয়ে ফিরে আসবে নতুন কোনো পোশাকে। যে পোশাকে থাকবে না প্রকৃতিকর্তৃক নির্ধারিত ভিন্নতা ভিন্ন আর কোনো বৈষম্য!

কে জানে হয়তো সব হতাশার অন্ধকার গুহার পেছনে থাকে একটা সূক্ষ্ম আশার আলোক রেখা।এই মুহূর্তে পৃথিবীর কুড়িটি গবেষণাগারে চলছে নিবিড় গবেষণা। মানুষই নিমগ্ন মানুষকে বাঁচাতে। এর যে কোনো একটির সাফল্য মানব সভ্যতাকে বাঁচিয়ে দেবে কয়েক হাজার বছর। স্পেনে, ইটালিতে পৌঁছে গেছে চীন, কিউবার চিকিৎসক দল। হয়তো এই পুলিসেরাতের পুল পার হয়ে আমরা দেখা পাব নতুন এক পৃথিবীর।

যেখানে ‘রাজনৈতিক মেরুকরণ’ এক হাস্যকর শব্দ, ‘বাণিজ্যিক অবরোধ’ শব্দটি হারাবে তার নিজস্ব অর্থ। মানুষের বিজয় বিলীন করে দেবে সমস্ত কুসংস্কার আর অন্ধ বিশ্বাস।

জনহীন লোকালয়ে নিরাপদে হাঁটছে যে ময়ূর, মানুষের মায়াময় জগত ছেড়ে সে আর ফিরে যাবার প্রয়োজন বোধ করবে না, পানি ছেড়ে ডাঙায় উঠেছে যে ডলফিন মানুষই হবে তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু।

সব নিরাপদ নিরাপত্তা নিয়ে, সব বুদ্ধি আর মেধা মঙ্গলে নিয়োজিত করে মানুষই হবে প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ অংশ। মানুষই দাঁড়াবে মানুষের পাশে...। এর জন্য সবার আগে ভাইরাসটাকে পরাস্ত করার জন্য, আমাদেরকে সারাবিশ্বের সমস্ত তথ্য আদান-প্রদান করতে হবে। ভাইরাসের ওপর মানুষের একটা বড় বিজয় হবে এটি। কিভাবে করোনাভাইরাসের মোকাবেলা করতে হবে, সে-ব্যাপারে চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অনেক মূল্যবান শিক্ষা প্রদান করতে পারে। সিঙ্গাপুরের একজন চিকিৎসক যা আবিষ্কার করেছেন আজ তা বিকেল নাগাদ ভারতে অসংখ্য জীবন বাঁচিয়ে দিতে পারে।

দেশগুলো উদ্বুদ্ধ হবে নিজেদের মধ্যে মুক্তভাবে তথ্য আদান-প্রদান করতে এবং পরস্পরের পরামর্শ চাইতে। মেডিকেল যন্ত্রপাতি, তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো টেস্টিং কিট আর শ্বাসপ্রশ্বাসের যন্ত্র, উৎপাদন ও বিতরণের জন্য আমাদের একটি বৈশ্বিক প্রয়াসের প্রয়োজন পড়বে। প্রতিটা দেশ স্থানীয়ভাবে এটা করার চেষ্টা চালাচ্ছে, এবং হাতের কাছে যা পাচ্ছে তাই মজুদ করছে, এরকম করার চেয়ে একটি সমন্বিত বৈশ্বিক প্রয়াসই বরং উৎপাদনকে ব্যাপকভাবে ত্বরান্বিত করতে পারবে এবং জীবন-বাঁচানো যন্ত্রপাতি সুষম ভাগ হচ্ছে কিনা সেটাও নিশ্চিত করতে পারবে। ৭১ এর বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে প্রধান প্রধান শিল্পখাতগুলোকে জাতীয়করণ করেছিলেন, তেমনি করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে মানুষের যুদ্ধেও গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন উৎসগুলোর শর্তহীন বিশ্বায়নের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।

যেখানে করোনাভাইরাসের স্বল্পসংখ্যক রোগী ধরা পড়েছে এমন দেশগুলোর অনেক বেশি রোগী ধরা পড়েছে এমন দেশগুলোতে তারা যন্ত্রপাতি পাঠাতে পারে। তাদেরকে এই ব্যাপারে বিশ্বাস থাকতে হবে, পরবর্তীতে যখন তাদের নিজেদের সাহায্যের প্রয়োজন পড়ে, অন্য দেশগুলো সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে।

স্বাস্থ্যকর্মীদের ক্ষেত্রে একই ধরনের আন্তর্জাতিক প্রয়াস বিবেচনায় আনতে হবে যেসব দেশ এখনো ততটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, সবচেয়ে খারাপ দশায় থাকা অঞ্চলগুলোতে সেসব দেশ তার স্বাস্থ্যকর্মী পাঠাতে পারে।
অর্থনৈতিকভাবেও আন্তর্জাতিক সহায়তাটা ব্যাপকভাবেই জরুরি, প্রতিটি সরকার যদি সব ভুলে শুধু নিজের দেশের কথা ভাবে এই গভীর সংকট পার পাওয়া সম্ভব নয়। এ সময় আসলে আমাদের ঘুরে দাঁড়াবার সময় বিশ্বকে বদলে দেওয়ার সময়। সময় রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি সব নতুন করে চেনার। স্বাধীনতা দিবসে এ বছর আমাদের নতুন বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে নতুন প্রত্যয়।

   

দুই দেশের রং মিলেছে এক দেয়ালে



মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, ব্যাংকক, থাইল্যান্ড
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

রঙের শহর, হাসির শহর ব্যাংকক। দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি ভ্রমণ করা শহর ব্যাংকক। ব্যাংককের প্রাণকেন্দ্র সিয়ামেই রয়েছে ব্যাংকক র্আট এন্ড কালচারাল সেন্টার (বিএসিসি)। বাংলাদেশ থেকে যারা ব্যাংককে বেড়াতে যান, তারা যদি এমবিকে মলের পাশ দিয়ে স্কাই ওয়াক হয়ে তৃতীয় তলায় প্রবেশ করেন তাহলে হাতের ডানে চোখ ফেললেই দেখতে পাবেন বাংলাদেশের রঙের খেলা আর জীবনযাত্রার চিত্র।

স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে গত ২৬ র্মাচ থেকে ব্যাংককের র্আট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ ও থাই চিত্রশিল্পীদের অংশগ্রহণে ‘ড্রীম অব কালারস’ বা ‘রঙের স্বপ্ন’ র্শীষক চিত্র প্রর্দশনী। ‘কানেক্টিং টু ল্যান্ডস এন্ড টুপিপলস’ স্লোগানকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের নিমিত্তেই এই আয়োজন।


তৃতীয় তলার করিডোর ধরে হাঁটতেই চোখে পড়বে শিল্পী মুস্তাফিজুল হকের নিহঙ্গ। ওয়াসি পেপারের ওপর জাপানি ধরনের চিত্রকর্মের জন্য প্রসিদ্ধ তিনি। ক্যানভাসের ওপর আর্কিলিকের চিত্রকর্ম ‘হর্স’ মনযোগ আকর্ষন করছিল দর্শনার্থীদের। তার চিত্রকর্মের বড় বৈশিষ্ট্য নাটকীয়তা এবং বিষয়ের গভীর উপস্থিতি।

নগরের জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলতে শিল্পী কামাল উদ্দিনের জুড়ি নেই। তবে এখানে ব্যক্তির পোর্ট্রেট নয় বরং পেস্টেলে তবলার রং ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী।

আবার থামাসাত বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রকলার শিক্ষক খাজোনসাক মাহাকুন্নাওয়ানের তুলিতে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নগরের জীবন। রিকশার সঙ্গে যাত্রীদের ছুটে চলা। সময়কে যেন পাশ কাটিয়ে ছুটে চলছে তার চিত্রকর্ম।


ঢাকার গ্যালারি চিত্রকের ১৮ জন শিল্পী এবং থামাসাত ইউনিভার্সিটির ফাইন অ্যান্ড এপ্লাইড আর্টস বিভাগের ৪ জন শিল্পীর যৌথ অংশগ্রহণে চলছে এই আয়োজন। চলবে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত। গত ২৬ মার্চ চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন থাইল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহা. আব্দুল হাই।

চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন নিয়ে তিনি বলেন, দুটি দেশের ভূমি আর মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে এনেছে এই আয়োজন। চিত্রকর্মের মাধ্যমে যে যোগাযোগ সেটা শুধু বাহ্যিক নয়, বরং আত্মার যোগাযোগ। শুধু দেশকে চেনায় না, বরং সেখানকার জীবনযাত্রার ধারণা দেয়, মানুষকে কাছে নিয়ে আসে।


ব্যাংককের বাংলাদেশ দূতাবাসের এই চিত্রপ্রদর্শনীতে রফিকুন্নবী, আব্দুস সাকুর শাহ, সৈয়দ আবুল বার্ক আলভি, শেখ আফজাল, মাহফুজুর রহমান, সুমনা হক, মুনিরুজ্জামান, জহির উদ্দিন, কনক চাপা চাকমা, বিপাশা হায়াত, মোহাম্মদ ইউনুস, সুলেখা চৌধুরী, রেজাউন নবী, কামাল উদ্দিন, পারভীন জামান, সুমন ওয়াহিদ, মোস্তাফিজুল হক, আহমেদ সামসুদ্দোহার চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে।

এছাড়াও থাইল্যান্ডের চিত্রশিল্পী খাওজনসাক মাহাকুন্নাওয়ান, ওয়ারাপান সামপাও, জিরাতচায়া ওয়ানচান, প্রারুনরপ প্রিউসোপির চিত্রকর্মও স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে।

ব্যাংকক আর্ট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে সকাল থেকেই বিভিন্ন বয়সী শিল্প প্রিয় মানুষের আনাগোনা থাকে। সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এই প্রদর্শনী উপভোগ করতে পারছেন দর্শনার্থীরা।

;

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাসবিদ-দার্শনিক মুঈন উদ-দীন আহমদ খান জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন এক মনীষীর নাম। বাংলাদেশের বিদ্যাবৃত্তে ক্লাসিক্যাল চরিত্রের শেষ দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। ২৮ মার্চ (বৃহস্পতিবার) ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। 

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান (১৮ এপ্রিল, ১৯২৫-২৮ মার্চ, ২০২১) নির্জলা তথ্যভিত্তিক ইতিহাসের খোঁজে সুদীর্ঘ জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চার কষ্টসাধ্য দিনগুলো অতিবাহিত করেন নি। তিনি মনে করতেন, ইতিহাসের সত্য সন্ধান শুধু তথ্য আর যুক্তি ভিত্তিক নয়। প্রকৃত ইতিহাস মূলত ইতিহাসের দর্শন, ইতিহাসের পুনর্গঠন, কল্পনা, সমকালীন পর্যালোচনা ও ইনটুইশনের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সান্নিধ্যে এলে সবাই এই সত্য টের পেতেন যে, ইতিহাস প্রধানত দর্শন ও সাহিত্যের সমধর্মীতায় বর্তমানের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বাস্তবতা ভিত্তিক সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণের এবং দিকনির্দেশনা দেওয়ার অপরিহার্য মাধ্যম। তাঁর স্বকীয় চিন্তার দ্যুতিতে তিনি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা চর্চা ও গবেষণায় একটি বিশিষ্ট ধারার প্রতিভূ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবং একটি পুরো জীবন সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাচর্চার ধ্যানজ্ঞানে যাপন করেছেন। আর চট্টগ্রামের নিরিখে তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা কাঠামোর আদি নির্মাতাদের অন্যতম। যেমনভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র ড. আবদুল করিম ছিলেন ইতিহাসচর্চার প্রতিষ্ঠাতা, প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ইংরেজির, ড. আর. আই চৌধুরী রাজনীতি বিজ্ঞানের, তেমনিভাবে তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবদ্ধ বিদ্যাচর্চা ধারার সূচনাকারী। চট্টগ্রামের আধুনিক উচ্চশিক্ষা বিস্তারের আদি মুঘলদের একজন ছিলেন তিনি।  

তিনি ছিলেন আড়ম্বরহীন জ্ঞানসাধক। নিজস্ব বিদ্যাবলয়ের বাইরে তাঁর কোনও আত্মপ্রচার বা আত্মগরিমা ছিল না। যদিও তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার মতো যোগ্য লোকের সংখ্যা তাঁর আশেপাশে খুব বেশি ছিল না, তথাটি যারা তাঁর রচনা খেয়াল করে পড়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে কিংবা অনানুষ্ঠানিক পরিসরে আলাপ, আলোচনা, সংলাপ ও বিতর্কের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন, কত ভাষা, কত বিষয়, কত তত্ত্ব ও তথ্যাদি সম্পর্কে অনায়াস দক্ষতা ও পা-িত্য ছিল প্রাচ্যদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের এই জ্ঞানতাপসের। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চুনতী গ্রামের আদিবাস আর পুরনো চট্টগ্রাম শহরের রুমঘাটা থেকে এই মান্যবর জ্ঞানবৃদ্ধের কাছ থেকে বিচ্যুরিত দীপ্তি কিছু কিছু অনুভব স্পর্শ করেছে দেশে-বিদেশে তাঁর কর্ম ও গবেষণা ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

তাঁর জ্ঞান, গবেষণা, মনীষা, বুদ্ধির দীপ্তি, বহু ভাষায় পারঙ্গমতা তাঁর সমকালে অন্য কারও মধ্যে বিশেষ পরিলক্ষিত হয় নি। বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চায় প্রবাদপ্রতীম ড. আহমদ হাসান দানি যে তিনজন ছাত্রকে গবেষণায় প্রণোদিত ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান তাঁদের একজন। অন্য দুইজন হলেন আবদুল করিম ও মোহর আলী। এই তিনজনই বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় সত্যিকারের মৌলিক অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান প্রাথমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষাজীবনে প্রথম বিভাগ, স্বর্ণপদক, ফেলোশিপ ও বৃত্তি লাভ করেন একজন মেধাবী ছাত্র রূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর তিনি মোটেই থেমে থাকেন নি। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার বিখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। ফিরে এসে খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ড. আহমদ হাসান দানির তত্ত্বাবধানে ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ বিষয়ে পথপ্রদর্শনকারী পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেন। তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েট ফেলোশিপ লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বার্কলের ‘ইন্সটিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’-এ রাজনীতি বিজ্ঞানের ‘সেমিনার ইন ফিল্ড ওয়ার্ক কোর্স’ অধ্যয়ন করেন। তিনি কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রখ্যাত প-িত, ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের সান্নিধ্যে এসে বহুবিদ্যায় পারদর্শী হন। যে কারণে, পরবর্তী জীবনে তিনি ইসলামিক স্টাডিজ ও ইসলামের ইতিহাসকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, বিশেষত এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের ক্ষেত্রেও নিজের অবদান রাখেন এবং তাঁর গুণমুগ্ধ শিক্ষার্থীদের ছাড়াও তাঁর মূল-বিষয়ের বাইরের লোকজনকেও প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন নেতৃস্থানীয় শিক্ষক যথাক্রমে মর্শন বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান বদিউর রহমান এবং কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন শব্বির আহমদ তাঁর অধীনে পিএউচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

গবেষণা তত্ত্বাবধানে তিনি ছিলেন প্রচ- রকমের শুদ্ধতাবাদী। একটি প্রকৃষ্ট গবেষণার জন্য ¯œাতকোত্তর ও এমফিল পর্যায়ের গবেষকদেরও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত করতেন, যাতে তারা ভবিষ্যতে গবেষক হিসাবে স্বাধীনভাবে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। তাঁর সাথে গবেষণার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ড. আফম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, “তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর অনুমোদন নিয়ে কলকাতা, লক্ষেœৗ, দিল্লি, তুঘলকাবাদ, করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ, মক্কা ও মদিনা সফর করি।” কোনও মতে একটি ডিগ্রি দিয়ে দেওয়ার অসৎ পন্থার বিপরীতে গবেষণাকে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর করতে তিনি ছিলেন একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী শুদ্ধতম তত্ত্বাবধায়ক। শেষজীবনে তাঁর সঙ্গে বা পরামর্শে যারা গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মানস গঠনে ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নির্মাণে তিনি শ্রমবিমুখ ছিলেন না। ঘন্টার পর ঘণ্টা তিনি তাঁদের সঙ্গে আলোচনা কিংবা বই-পুস্তক পর্যালোচনায় লিপ্ত হতেন। এমন চিত্র আমি নিজে তাঁর বাসভবনে উপস্থিত কালে লক্ষ্য করেছি। কখনও নবাগত গবেষকদের তিনি অন্যান্য শিক্ষক ও গবেষকদের কাছে পাঠাতেন। তাঁর রেফারেন্সে একাধিক তরুণ গবেষক আমার কাছে এসে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাঁর রেফারেন্সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন। একটি বস্তুনিষ্ঠ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণা সম্পন্ন করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ত ও প্রণোদনাদাতা রূপে ছিলেন নিরলস।   

কঠোর তথ্যনিষ্ঠা ও শুদ্ধতার প্রতিফলন ঘটেছে মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের প্রতিটি রচনায়। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ও প্রবন্ধগুলো যে কারণে একই সাথে পাঠকপ্রিয় এবং অ্যাকাডেমিক জ্ঞান ভা-ারে মণি-মুক্তা তুল্য। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব ফরায়েজি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল’ একটি পথিকৃৎ গবেষণা, যা ‘বাংলায় ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়েছে। যে ফরায়েজি আন্দোলনকে ওয়াহাবি আন্দোলন বা তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া নামেই সবাই জানতো, তিনি তাঁর বহুমাত্রিক চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত করেন।  ফারায়েজি আন্দোলন যে কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক গতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রথম ও আদি প্রচেষ্টা, তিনিই সর্বপ্রথম তা প্রমাণ করেন। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে উত্থিত এই আন্দোলনের গণমুখী চরিত্র, ঔপনিবেশিকবাদ বিরোধী বৈশিষ্ট্য, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার বিরোধী মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াকু মানসিকতার বিষয়াবলী তিনি ঐতিহাসিক তথ্য ও ধর্মতাত্ত্বিক মাত্রায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে উপস্থাপন করেন। বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও বৃহৎ ক্যানভাসে গবেষণার কৃতিত্বে তিনি এই বিষয়ে এবং ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস বিনির্মাণের পথিকৃৎ প্রাণিত স্বরূপে সর্বমহলে সম্মানীত হয়েছেন। 

পরবর্তীতে প্রকাশিত মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের গ্রন্থ ও প্রবন্ধে তিনি তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ রেখেছেন। প্রতিটি লেখাতেই তিনি নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর লেখায় দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইত্যাদি বহুবিদ্যার প্রকাশ ঘটেছে। শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও গবেষণার বাইরে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাধারাকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করার প্রয়াস। তিনি ছিলেন ধ্রুপদী দার্শনিকদের মতো সংলাপ-প্রবণ ব্যক্তিত্ব। কেউ আগ্রহী হলে কিংবা কারো প্রতি তিনি আগ্রহী হলে তাঁকে বা তাঁদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হতেন। তিনি তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানদের মতো বইয়ের পাতার শুকনো অক্ষরে বন্দি ছিলেন না, জ্ঞানবৃত্তের মানুষের সঙ্গে প্রাণবন্ত সংলাপ ও সংশ্লেষের মাধ্যমে সদা জীবন্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে তো বটেই, বৃহৎ বঙ্গদেশে খুব কম সংখ্যক প-িতই এমন ছিলেন, যারা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় অন্যকে প্রণোদিত করার ক্ষমতা ধারণ করতেন। ঢাকায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং চট্টগ্রামে ড. আবদুল করিম, ড. আর. আই. চৌধুরী ছাড়া কম প-িতই ছিলেন, যারা শিক্ষার্থীদের প্রাণিত করার ক্ষেত্রে মনীষী মুঈন উদ-দীন খানের সঙ্গে তুলনাযোগ্য।

জ্ঞানের সঞ্চার ও বিস্তারে তাঁর অসীম কষ্ট সহিষ্ণুতা, আগ্রহ ও বিনয় তাঁকে ক্লাসিক্যাল যুগের প্রাচীন জ্ঞানতাপসের আধুনিক প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সান্নিধ্যে এসে আমি তা স্পষ্টভাবে অনুভব করি। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। এবং বয়সের দিক থেকে তিনি ছিলেন আমার চেয়ে কয়েক প্রজন্ম অগ্রগামী। তথাপি অশীতিপর বয়সে এসেও তিনি আমার কোনও লেখার প্রতি আগ্রহী হলে নিজে ফোন করে জানিয়েছেন। ডেকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং বিষয়টিকে তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে আরও সমৃদ্ধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেসব আলোচনায় জ্ঞানতত্ত্ব ও তুলনামূলক দর্শন সম্পর্কে তাঁর অতলস্পর্শী পা-িতের দীপ্তিমান প্রভার আঁচ পাওয়ার বিরল সুযোগ আমার হয়েছে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছিল, বহু তরুণকে তিনি গবেষণার দিক-নির্দেশনা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দিতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর মধ্যে পথ প্রদর্শনের একটি বিরল গুণ ছিল। আর ছিল জ্ঞানকে অকাতরে ছড়িয়ে দেওয়ার উদার মানসিকতা, যা আজকের অ্যাকাডেমিক প্রতিযোগিতার পঙ্কিল ও সঙ্কীর্ণমনা ধারার প্রেক্ষিতে অকল্পনীয় বিষয়। বড় মন ও মুক্ত মানসিকতার কারণে তিনি ‘বাংলাদেশের লিলিপুট প-িতদের সমাবেশে’ মহীরূহ-সম ব্যক্তিত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন।   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের মতো বিটপী ব্যক্তিত্বকে দৃশ্যপটে রেখে আজকের ক্ষুদ্রতর পরিসরে আলোচনা করা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমানের ঊন-মানুষ ও ঊন-মানসিকতার পরিম-লে তাঁর মতো বড় মানুষের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। তিনি এবং তাঁর সমগোত্রীয়রা শেষ মুঘলের মতো দৃশ্যপট থেকে চলে গিয়েছেন। কিন্তু রেখে গিয়েছেন ধ্রুপদী ঐতিহ্য, ব্যক্তিত্বের দীপ্তি ও বিভা। তিনি ছিলেন প্রথম প্রজন্মের আধুনিক বাঙালির হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে সকল অগ্রণী প-িত, গবেষক ও শিক্ষাব্রতীগণের শ্রেষ্ঠতম ও উজ্জ্বল প্রতিনিধি, যারা  জাগতিক প্রাপ্তির আশায় জ্ঞানের সাধনা করেন নি। জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাচর্চার নিতান্ত আবশ্যক পরিসীমার বাইরেও তাঁরা সচরাচর যান নি। তাঁদের নিতান্ত আবশ্যক বস্তুর তালিকায় সর্বাগ্রে ছিল জ্ঞানচর্চা, বিদ্যার্জন ও গ্রন্থপাঠ। বিষয় ভিত্তিক প্রয়োজনীয় বইয়ের বাইরেও অন্য বিষয় সংক্রান্ত রচনা তাঁরা পড়তেন আনন্দ ও কৌতূহল নিবৃত্তির সুতীব্র আকর্ষণে। কারও কারও পুস্তক সংগ্রহ আর রোজগারের মধ্যে কোনও ভারসাম্য থাকতো না। জাগতিক উন্নতির বিষয়গুলোকে তাঁরা তুচ্ছ বিবেচনা করে অবজ্ঞা করেছেন। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর মতে, “যে জীবনে বৈষয়িক উন্নতির সম্ভাবনা বিরল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ সত্যিই সারস্বত-কর্মে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বর্তমানের বিশ্লেষণপ্রবণ গবেষণার ধারা তখনও প্রবল হয় নি। কিন্তু অনেক গবেষণাই গভীর পা-িত্যের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতো।” মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান সম্পর্কে এই বক্তব্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আত্মমগ্ন ধ্যানীর মতো সারা জীবন তিনি জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থেকে গভীর পা-িত্যের পরিচয় দিয়েছেন। শুধু নিজেই নন, প্রণোদিত করেছেন পরবর্তী বেশ কিছু প্রজন্মের উৎসাহী তরুণদের, যাদের অনেকেই বিদ্যাচর্চায় লিপ্ত রয়েছেন।

তাঁর সঙ্গে ইতিহাসের আরেক মহান সাধক যদুনাথ সরকারের কিছু কিছু বিষয় তুলনীয়, যার মধ্যে রয়েছে প্রবল পরিশ্রম, জ্ঞান তৃষ্ণা এবং অনুসন্ধান। যদুনাথের বিশ্লেষণের নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বিতর্ক থাকার পরেও ইতিহাসচর্চায় তিনি সর্বজনমান্য আচার্য। তিনি নিজের কর্ম ও জীবন আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি করতেন: “পথের প্রান্তরে করি নাই খেলা/শুধু বাজায়েছি বসি সারাবেলা/ছিন্নতন্ত্রী বীণা।” মনীষী প্রফেসর ড. মুইন উদ-দীন আহমদ খানও সারাজীবন জ্ঞানচর্চার বাঁশরী বাজিয়েছেন। একটি আস্ত জীবনকে উৎসর্গ করেছেন জ্ঞানের সাগরে অবগাহনের মাধ্যমে। বিদ্যার্চচাকে পেশাগত পরিম-লে জিম্মি না করে জীবন ও যাপনের মূলমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। আর সব কিছুই তিনি করেছেন নিজের সুমৃত্তিকা ও মানুষকে কেন্দ্র করেই। জীবনের পর্বে পর্বে নানা দেশে, নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তিনি অবশেষে ফিরে এসে আলোকিত করেছেন প্রিয় মাটির প্রিয় মানুষদের, প্রিয় জনপদকে। জীবনের দিনগুলোর মতোই মৃত্যুর পরেও তিনি আলোর দিশারী হয়ে দেদীপ্যমান রয়েছেন জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যামুখী অভিযাত্রীদের চৈতন্যের মর্মমূলে।  

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম  সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;