মুক্তিযুদ্ধের গল্প

একাত্তর, মায়ের দুর্মর লজ্জার এক গোপন কথন



নাসরীন জাহান
অলঙ্করণ: কাজী যুবাইর মাহমুদ

অলঙ্করণ: কাজী যুবাইর মাহমুদ

  • Font increase
  • Font Decrease

রুদ্ধশ্বাস সাবধানে মেসের জানালায় ঘাপটি মেরে থাকতে থাকতে হাত-পায়ে টানটান ধরে যায়। যাই যাই শীতের উত্তুরে হাওয়া দুই বাড়ির মাঝের রাস্তায়ই যে কেন ঘাপটি মেরে যায়, ও বাড়ির জানালার পর্দা উড়ছে না। টানা ফোন বন্ধ ছন্দার, অস্থির জাকির এই মফস্বলে কোনোদিনই এই সাহস করে উঠতে পারেনি, এমন মুহূর্তগুলোতে ছন্দার বাড়িতে হাজির হয়ে যাওয়া। মৃদু-ঘন-ধীর লয়ে চলা ছন্দার মন পেতে কম আছারিবিছারি প্রহরের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হয়নি জাকিরকে। অদ্ভুত বিষণ্নতার মাঝে প্রহরের পর প্রহর ডুবে থাকত সে।

এরপর বদ্ধ দিঘির জলে স্রোত সঞ্চারিত হলে দুজন কত আলুলায়িত বিকেলে ব্রহ্মপুত্রের জলে পা ডুবিয়ে কৃষি ভার্সিটির চত্বর পেরিয়ে অদ্ভুত রোমাঞ্চে হেঁটেছে, যেন নিজেকে হাজার উপুড় করেও কেন যেন ছন্দাকে কখনোই তেমন খুলতে পারেনি জাকির।

এই রহস্য তাকে যত নোনা জলে সাঁতলিয়েছে, তত দুর্মর টেনেছে ছন্দার প্রতি নিজের সত্তাকে। ময়মনসিংহ শহরটা রাজধানীর কাছে হওয়ায়ই হয়তো মেয়েরা রাজধানীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অনেক স্মার্ট। ছন্দার তাঁতের অনুজ্জ্বল পোশাক, সজ্জাহীন মুখ, চোখের ঘন পাপড়ি জাকিরকে রীতিমতো মায়ের মুখের উদ্ভাসনে কাঁপাত। আজকাল মায়ের মতো মেয়ে কত জনমে দেখতে পাওয়া যায়? যেদিন ছন্দা ‘হ্যাঁ, ভালোবাসি’ বলল তার পরদিন কপালে যুক্ত করেছিল স্রেফ কালো টিপ, তাতেই দুর্মর কম্পনে জাকিরের পড়িমরি দশা।

ধড়াস!

বুক কেঁপে ওঠে। পর্দার ওপাশে শ্যামল ছন্দার গভীর কালো চোখ…গ্রিলের বাইরে সন্তর্পণে হাত বাড়িয়ে ইঙ্গিত করল জাকিরকে তাদের চিরকালীন রেললাইনটার দিকে যেতে।

বন্ধুরা যার যার মতো বাইরে। কেউ ক্লাসে, কেউ কাজে। নিজ বাড়ি মেইন শহর থেকে কিছুটা দূরে। তাই বন্ধুদের ছোঁকছোঁক পথ ধরে জাকির ঠিক ছন্দাদের সামনের মেসটাতেই মাঝেমধ্যে আসে।

সামনে অবারিত রেললাইন!

কত কত দিন যে এখানে এসে সে ছন্দার জন্য দাঁড়িয়ে থেকেছে। এরপর স্লিপার টপকে টপকে একসঙ্গে আনন্দমোহন কলেজে গেছে।

এই পথ দিয়ে যেতেই কত কী যে চোখে পড়ে ছন্দার! বহু বর্ণিল ঘাসফুল… ঝকঝকে পাথর… মাঝ মাঝে শুকনো গুয়ের গন্ধ নাক কুঁচকাত জাকিরের, ছন্দা বলত, এ দেশের এই দিকটা যখন বদলানো যাইতেছে না, তখন এড়িয়ে যাওয়াই ভালো… কই, কই… জাকির বলত আমি তো বরং চারদিকে কাঁঠালিচাঁপার ঘ্রাণ পাইতেছি… চোখ বুজো… অনুভব করো।

অথচ কলেজে পড়াকালীন, ভার্সিটি ভর্তি হওয়ার অবধি ছন্দার বিপরীত স্বভাবের এক মেয়ের জন্য কী মাখামাখি উথালপাথার প্রেমই না ছিল তার! ছটফট স্বভাবের মেয়েটি সারাক্ষণ মৃত্তিকার থেকে কিছু ওপরে ভাসন্ত রাখত জাকিরকে। চায়নিজে যাওয়া, নৌভ্রমণ, প্রাইভেটকার ভাড়া করে লং জার্নি…সটান কণ্ঠে বলত, মেয়ে-পুরুষ সমান অধিকার, খরচ ফিফটি-ফিফটি।

জাকিরদের পরিবার ধর্মভীরু। বাবা নানা রকম ওয়াজ মাহফিলে যান… জাকিরের বুক টিপ টিপ করত, এই জিন্স ফতুয়া পরা মেয়েটাকে সে কিভাবে পরিবারে উপস্থাপন করবে? কিন্তু সম্পা এসে সামনে দাঁড়ালে সব প্রতিকূলতা অদ্ভুত নিঃসীমে মুছে যেত। চারপাশ অপসৃত হয়ে কেবল পৃথিবীতে দাঁড়াত তারা দুজনই।

সম্পার বান্ধবীর খালি ফ্ল্যাটে দুজনের চুম্বন গড়িয়ে ফাটাফাটি শারীরিক সম্পর্কের পর সম্পা যখন আচমকা হাওয়া… পাগলপ্রায় জাকির বিষ খেয়ে মরতে বসছিল। ‘তুমি আমাকে নষ্ট করেছ’—সম্পার এ কথার মাথামুণ্ডু লেজ না বুঝে যখন প্রায় শেষ আঁধার দেখছে, জাকিরের ছোটবেলার বন্ধু বলল, কাল ওকে আরেক ছেলের সঙ্গে গাড়িতে দেখলাম। তোর অবস্থা দেখে ওর সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছি। স্কুলজীবন থেকেই প্রেম সেক্স ওর ডাল-ভাত। নইলে কিশোরী মেয়ে এত অনায়াসে তোর সঙ্গে শরীরে লিপ্ত হইল?

তুই এতসব কিভাবে জানিস?

সবাই তোর মতো বুদ্ধু না।

এরপর ভেবেছিল জীবনে আর মেয়ে না, আর প্রেম না, আর বিশ্বাস না… না, মানে জাকির এই জীবনে পারবেই না আর কোনো মেয়েকে ভালোবাসতে। বাবা-মা বিয়ের কথা বললে দেশ ছেড়ে পালাবে। এরপর আত্মসম্মোহনে বুঁদ হয়ে থাকা জাকিরের চারপাশে সময়গুলো কখনো কাশফুল কখনো রঙধনু ফড়িংয়ের বিলোড়ন নিয়ে উড়াউড়ি করলেও বিশাল পাহাড়ের গুহামুখ ছাড়া কিচ্ছু চোখে পড়ত না তার। বিড়বিড় করত সে… আমি তো চামড়া খসা হরিণে মতো কেউ… তখনই নিঃশব্দ পা ফেলে সামনে এসে দাঁড়াল ছন্দা। ইন্টারমিডিয়েট থেকেই সে এই কলেজে একেবারে নিজ নিমগ্নতায় ঘোর খেত। হাতেগোনা দু একজন বান্ধবী আর ছেলে বলতে ভাইয়ের মতো পাশে থাকা তুহিনে সাথে চলত। অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে একদিন তখনও জাকির ডুবে ছিল সম্পাতে, সম্পার বিচ্ছেদ মানতেই পারছিল না। আচমকা ফিল্মে নাটকে ঘটার মতোই ছন্দার সাথে ধাক্কাটা লাগে। সমস্ত বই-খাতা কুড়িয়ে না-রাগ-না বিরক্তি অদ্ভুত নিস্পৃহ একটা চোখ জাকিরের সত্তায় গেঁথে ছন্দা নিঃশব্দে হেঁটে যায়। নিজের মধ্যে মূহ্যমান ছন্দাকে জাকির সম্পার বলয়চ্যূত হয়ে মাথা তুলতে তুলতে যত ছুঁতে চায় তত সে দূরবর্তী। একই ক্লাসে পড়ুয়া ছন্দা যেন সমস্ত কলেজে ক্লাসে অন্য এক নির্জীব জগত থেকে আসা কেউ। ‘প্রথম প্রেম ভোলা যায় না’—এই বোধে কল্পনারত জাকির বেমালুম ভুলে গেল সম্পার সাথে তার জীবন এসপার-ওসপার বোধ সম্পর্ককে। বরং উদ্দমিত অনুভব তাকে খাড়া করিয়ে ভাবাল, যে প্রেমে কোনো মেয়েকে ঘরের বউ ভাবা যায় না, সত্যিই বড় অপরিপক্ব সেই প্রেম। তিন বোন এক ভাইয়ের সংসারে মায়ের সোনার টুকরো ছেলের পুরো অবয়বে জীবন রসের পুনর্জাগরণ ঘটল। ধীরে ধীরে ছন্দার একটু একটু খোলস ভাঙতে থাকলে জানা হলো, ছন্দার নানা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন, তার মুক্তিযোদ্ধা বাবা মারা গেছেন রোড অ্যাকসিডেন্টে, এগারো বছর আগে। মা এনজিওতে কাজ করেন।

সময় তো পরতের বড় জখমেও ধুলো-মাটি দিয়ে ঢেকে আস্তর পর্যন্ত দিয়ে দেয়। কেন কিছুতেই ছন্দার বিষণ্নতা কাটে না?

নানুকে যখন বেয়নেট দিয়ে গুঁতিয়ে মারছে রাজাকার আর পাক আর্মি, কিশোরী মা গাছের পেছনে বসে সব দেখছিলেন… সেই দৃশ্য মাকে আজীবন তাড়া করে।

সে তো বিয়াল্লিশ বছর আগের কথা… বিস্মিত জকির বলে, সেটা নিয়ে এখনো পড়ে থাকার কী? তোমার বাবার দুর্ঘটনা তোমাদের কষ্ট দেয় না?

বিয়াল্লিশ বছর আগে কোনো ফাজলামি হয় নাই, শান্ত ছন্দা ফুঁসে উঠেছিল, ওটা তুমি বুঝবা না।

না, আর বুঝতেও চায় না জাকির। তার বাড়িতে কেউ যুদ্ধে মারাও যায়নি, এর কোনো জিকিরও নেই… কেন ছন্দার মধ্যে থেকে তার নানাকে হত্যা করা মায়ের বর্ণিত ফর্সা জরুল মুখের বিজাতীয় ভাষায় কথা বলা বিশেষ এক মিলিটারির চেহারাটা অপসৃত হয় না?

বিকেল গড়াতে থাকে।

একটা ট্রেন তার ধ্বনি চারপাশে কোরাসের মতো ছড়িয়ে স্তিমিত হলে ছন্দা আসে।

দুজন ধীরে স্লিপার টপকায়। অদ্ভুত এক বাতাস এসে দুজনকে মূহ্যমান করে দিয়ে সানকিপাড়ার দিকে চলে যায়।

তুমি দুই দিন যাবত ক্লাসে আসো নাই। দুই দিন তোমার মোবাইল বন্ধ।

ছন্দা তেমনই নিশ্চুপ দূরের ধুলোঘূর্ণির দিকে চেয়ে থাকে।

একটা ম্যাসেজ করতে পারতা না? আমার দিনরাত বাঁচিমরি দশা, এইটুকু
কখন সেন্স নাই তোমার।

দুইদিন ধরে মা খুব কাঁদতেছিল।

তোমার মায়ের কান্না কি সিজনাল, ডিসেম্বরে শুরু হয়, মার্চের শেষে গিয়ে… দুই দিন ছন্দাহীনতয় কাতর জাকির ভেঙে পড়ে, তোমাদের এই ব্যাপারগুলো বুঝি না… রাষ্ট্রীয় শোক বিজয়ের দিবসের মতো তোমাদের কান্না-হাসি কেন শুধু ওইসব মাস দিবসেই উসকে ওঠে? যুদ্ধে তোমার নানার মতো কতজন মরছে তার হিসাব আছে? সবাই যদি ওইসব আঁকড়ায়া পইড়া থাকত… আমি বুঝি না ছন্দা কত বছর আগের সেই ঘটনা নিয়ে জাবর কাটতে বড় মজা তোমার মায়ের, নিজের পাগলামি নিয়া তোমারেও পাগল বানায়া ছাড়তেছে, আরে যে নারীর স্বামীর মৃত্যু নিয়া কান্না নাই সে…।

জাকিরের ভূমণ্ডল কাঁপিয়ে যেন বা সাক্ষাৎ যমদূত, এই চোখে তাকায় ছন্দা... এবং পিছু হটতে থাকে, বড্ড ভুল হয়া গেছে তোমারে চিনতে, আসলে তুমিও তাদের একজন…। বলতে বলতে শান্ত ধীর স্বভাবের মেয়েটি এমন উত্তুঙ্গ উড়ালে দৌড় দেয়, বুকে দম আটকে দাঁড়িয়ে থেকে তার অপসৃয়মাণতার দৃশ্য দেখা ছাড়া আর কিছু থাকে না জাকিরের।

২.
এক সন্ধ্যায় যখন পুরো আঁধারে জমেছে জমকালো কালো… ইলেকট্রিসিটি নেই… যখন পুরো ভেঙে চুরচুর অবয়ব সত্তার সামনে জাগতিকভাবে সুস্থ মাকে এক অদ্ভুত আঁধার থেকে টেনে জিজ্ঞেস করছে ছন্দা, কী হইছে আম্মু? তুমি এত কানতেছো কেন? আমাকেও বলবা না?

ছায়া ফুঁড়ে নিজেকে টেনে তোলে মা, এরপর নিঃশব্দে নিজেকে মেঝেতে নামিয়ে রান্নাঘরের দিকে নিয়ে যেতে যেতে বলে, একটু ধাতস্থ হই, তারপর বলি?

ঠিক আছে।

তোমার কী হয়েছে ছন্দা? একেবারে মরে মরে আছো যে? মা ঘাড় ফেরায় ।

তোমার অবস্থা দেখে আমার খুব ভাবনা হইতেছে, ছন্দা সজোরে কষে নিজের বেদনা সামলায়, না… না, সে জাকিরকে নিয়ে আর ভাববে না। ঠিক আছে, তুমিও ধাতস্থ হয়ে তোমারটা বলো—নিজের ক্রন্দনের মধ্যেও ছন্দাকে লক্ষ করার মায়ের এই ব্যাপার বরাবরের মতোই বিস্মিত করে ছন্দাকে। সারা দেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে গণজোয়ার চলছে। জাকিরের ফ্যামিলি এসব হ্যাপায় পড়তে জাকিরকে কঠিনভাবে নিষেধ করায় জাকিরের সান্নিধ্যে সঞ্চালিত ছন্দা নিজেও এসব এড়িয়েই চলেছে।

কিন্তু দুদিন আগে মা উদ্ভ্রান্তের মতো ঘরে ফিরে যেন সে বিয়াল্লিশ বছর আগের জীবনে ফিরে গেছে এইভাবে তড়পাচ্ছে, থুথু ছুঁড়ছে পাক আর্মি রাজাকারদের উদ্দেশে। আর এইসব দিকচক্রবাকে ঘূর্ণায়িত ছন্দা কিছুতেই এর কূল কিনারা না পেয়ে এই জীবন বাস্তবতার বাইরে মানুষ জাকিরকে এড়াতে শুরু করেছে। যে ছেলে তার এই জীবনের ছিটে মাত্র স্পর্শ করতে পারে না তার সাথে নিজেকে জড়ানো… না না সাংঘাতিক ভুল হয়ে গেছে ছন্দার।

নিজ জীবনে ছন্দা দিনরাত বেদনাভূত মূহ্যমান ঢেউ খেত, তা দেখতে এত আটপৌরে যে কেউ কখনো সেইভাবে একফালি তরঙ্গিত চোখ তুলেও তাকে দেখেনি। সেদিক থেকে তার প্রতি জাকিরের উন্মাদ আকর্ষণ তাকে বোধের এমন উচ্চতায় তুলেছিল… মোমের শিখার দিকে তাকিয়ে বুক মোচড়ানো যন্ত্রণায় চোখ ভেসে যেতে থাকে তার। রাতে নিঃশব্দে ভাত খেয়ে মা-মেয়ে এক শয্যায় শোয় ঠিকই… কিন্তু বেদনার নিঃসঙ্গ তাণ্ডবে দুজনই দুজনের অনিদ্রাকে মৌনতার মধ্যে স্পর্শ করে, কিন্তু কারো কণ্ঠ থেকেই বাক্য স্ফুরণের প্রেরণা পায় না।

নিজের যাতনা দাবিয়ে ছন্দা ভাবে, অথচ এই মা-ই নাকি কৈশোরে এই মফস্বলেই নানার উৎসাহে ক্লাসিক্যাল নাচ প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিল! হা জীবন!

আচমকা দুর্দান্ত শব্দ, রুদ্ধ দরজা খুলে যায়, কতগুলো হায়েনা আসে দলবল নিয়ে, ঘুমন্ত মায়ের পাশ থেকে ছন্দাকে বাকরুদ্ধ করে টেনে নিয়ে যেতে থাকে অন্ধকার অরণ্যের দিকে, কাঁপতে কাঁপতে উঠে বসে ছন্দা। এমন স্বপ্ন প্রায়ই বুনো জন্তুর মতো তাকে তাড়া করে কত রাত যে কাঁপাতে কাঁপাতে উঠে বসাত, কেবল জাকির এসে তাকে সাতরঙা রঙধনুতে ভাসাতে শুরু করলে কিছুদিন এই স্বপ্ন থেকে মুক্তি ঘটেছিল।

ভোরে মা নামাজ শেষে বাইরের তাজা বাতাস নিতে বারান্দায় গিয়ে বসে, কিন্তু নিস্তেজ পড়ে থাকা ছন্দা দীর্ঘদিন পর সেই স্বপ্নে এত সশব্দে কাঁপছে সে?

মার জীবনে ঘটে যাওয়া সেই দাবানলময় ঘটনা আজ স্বপ্নে হায়েনাদের মধ্যে জাকিরের মুখ দেখল সে? আচমকা চলনশক্তিহীন ছন্দা অনুভব করে জ্বর জ্বরবোধে জিভে সাগরের নুন জমেছে।

না… না… এ স্বপ্ন…

কিন্তু কী করে তা এত সত্যের মতো তীব্র হয়, জাকির কি সত্যিই দলবল নিয়ে রাত্তিরে এসেছিল? ছটফট করতে করতে চারপাশে তাকায় সে; আম্মু কই?

নিস্তেজ হাত শরীরের নানা অংশে বিস্তার করে। সমস্ত চামড়া গিঁটে এত ব্যথার টাটানি কেন?

ঠাডা পড়া মানুষের মতো ছন্দা খোলা দরজা দিয়ে বের হওয়া আলোয় দেয়ালে লম্বা পিঁপড়ার সারি দেখতে থাকে। একটা খুদে খাবারের টুকরো নিয়ে ছুটন্ত পিঁপড়েদের মধ্যে ঠোঁট ছুঁয়ে ছুঁয়ে কী যে কথা হচ্ছে… ভাবতে ভাবতেই সেই জীবন্ত স্বপ্ন আর বাস্তবতা তার মাথায় হাতুড়ির বাড়ি মারে, সে দেখে, হাত-পা বাঁধা মায়ের নিশ্চল চোখের সামনে জাকির তার কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে তাকে ধর্ষণ করছে।

আধো জাগরণ আর তন্দ্রার ঘোরে কম্পমান ছন্দা নিজ চক্রে আবর্তিত হয়, আমি জাকিরকে কেন এইরূপ দেখব? সে তো আমাকে সেভাবে স্পর্শই করেনি। তবে?

আম্মু… চাদর আঁকড়ে অস্ফুটে ডাকে সে।

তারই ধ্বনির টানে বারান্দা থেকে মা ঘরে এসে ছন্দার মাথার কাছে বসে, নিঃশ্বাস নিতে বারান্দায় গিয়েছিলাম, কী হয়েছে মা?

পরনে মহা স্বস্তি নিয়ে ঘুমের তলায় তলিয়ে যেতে যেতে সে জাকিরের সঙ্গে জীবনের সুন্দর স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরতে চায়, কিছু না আম্মু…।

আমার কী সুন্দর?

চোখ।

আর?

চোখ… আর জানো তোমার সবচাইতে কী সুন্দর? আমি তোমার মধ্যে আমার মায়ের মুগ্ধ রূপ দেখতে পাই।

জাকির, কখনো প্রেমিকার মধ্যে মায়ের মুখ, মায়ের রূপ খুঁজবা না। তোমার মা তো বেঁচে আছেন। বেঁচে না থাকলেও এই অশ্লীল তুলনা আমি করতে দিতাম না। জীবনে দুজনের দুই রকম সম্পূর্ণ দুই ধরনের ভূমিকা। এই খোঁজা, এই তুলনা দুজনকেই অসম্মানিত করে।

জাকির হতবিহ্বল তাকিয়ে থাকে।

তোমার চোখে দ্বিধা, আচ্ছা জাকির, আমি যদি বলি তোমার মধ্যে আমি আমার বাবার রূপ দেখতে পাই। আমার বাবা পৃথিবীতে নেই, থাকলেও তুমি ন্যূনতম সেনসেটিভ হইলে আমার বারবার বলা এই স্তুতিতে তুমি আমাকে প্রেমিক সত্তায় ছুঁইতে গেলে, আমার বাবার সত্তা তোমাকে স্থবির করত না? কখনো না?

পাগলে মতো ছন্দার মুখে-ঠোঁটে চুম্বন খেতে খেতে জাকির বলেছিল, ইউ আর গ্রেট, এ জন্যই তো তোমাকে এত ভালোবাসি সোনা।

বান্ধবীদের প্রেমে ‘জান, সোনা জাদু’ এসব শুনে ছন্দার প্যানপ্যান বোধে পা গোলাত, জাকিরের সঙ্গে প্রেমের মোহে কখন যে একজন আরেকজন এ রকম ডাকে আপ্লুত হতো টেরই পেত না ছন্দা।

পরদিন ক্লাসমেট তুহিন এলো।

ভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারেই এই ছেলে প্রথম তাকে বন্ধুত্বে সহজ করেছিল। মায়ের এনজিওতে সে পার্টটাইম কাজও করে। সহপাঠী হিসেবে জাকিরের সঙ্গেও ভালো বন্ধুত্ব। এর চেয়েও বড় কথা, ছন্দার বাবা তুহিনের মাকে আপন বড়বোনের মতো জানত। দীর্ঘ বিচ্ছেদে ফের পরিচয় হলে এ জন্যই মা এই জগতে ছন্দা বাদে তার জীবনের নাজুক অধ্যায় তুহিনকে তার মাকে শেয়ার করতে পেরেছিল।

তুহিনের মা অবশ্য মারা গেছেন কয়েক বছর আগে।

নিজেকে ঝেড়ে মা সহাস্য আপ্যায়নে নাস্তা বানাতে যায়।

হাত-পা শিরশির করে ছন্দার। আড়াই দিন যাবত বুকে পাথর চাপা দিয়ে সে মোবাইল বন্ধ করে রেখেছিল। তুহিন জাকিরের কোনো উদ্দাম বার্তা নিয়ে আসেনি তো? স্তব্ধ প্রহর কাটে। সহসা কিছুক্ষণ কেউ কথা বলতে পারে না।

একসময় রান্নাঘরের দিকে তীক্ষ্ণ চোখ রেখে, কণ্ঠ নামিয়ে তুহিন বলে, আন্টি ক্যান অফিসে যায় না, তা তো জানসই।

হিম স্রোত বয়ে যায় ছন্দার ভিন্ন একটি বিষয়ে পল্টি খেয়ে, না জানি না।

বলছ কী তুই?

আসল কথায় আয়, নিজেকে বিন্যস্ত করে ছন্দা বলে।

আমি তো বেশ কত দিন ধইরাই ক্লাস শেষে চাকরির গুষ্টি বাদ দিয়া গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে আছি। কয়েক দিন যাবত ডিস্টার্ব আছিলাম, যে আমার চৌদ্দগোষ্টি নাস্তিক কারে বলে জানে না, আমিও না, তুইও জানোস, আমার ব্লগে আমার নামে কারা যে ইসলামবিরোধী কথা লেইখা পরিবারে সমাজে আমারে ভিলেন বানানো শুরু করছে… আহা! অস্থির হইস না, এই সূত্র ধইরাই মোদ্দা কথায় আসতেছি, আমি তো এর আগে কয়েক দিন জাকিরের বাসায় গেছি। ভদ্র পরিবার… তার বাবাও শান্ত প্রকৃতির। এর মধ্যে কয়েক দিন আগে শিবিরকর্মীরা অনেক তাণ্ডব করলে পাল্টা ধাওয়া করতে গিয়া দেখি ওরা ছুটতে ছুটতে জাকিরের বাড়িতে ঢুকল। আমি তাজ্জব হয়া দেখি, ওদের শান্ত করতে করতে জাকিরের বাবা বাড়ির বাইরে আসতে। আমি কাঁঠালগাছের নিচে তার কথা শুইন্যা ‘থ’। সে আমাদের রুখতে প্রয়োজনে যা যা অস্ত্র আছে তাদের দিবে বলল।

নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে থাকে ছন্দার। জানালা দিয়ে ঢোকা ফাল্গুন কি চৈত্রের হাওয়ার মধ্যে এত আগুনের হল্কা, চামড়া পুড়ে যেতে থাকে ছন্দার। হুড়মুড় করে এগিয়ে আসে সেই ভয়াল স্মৃতি, যা মায়ের সঙ্গে সঙ্গে ছন্দার এতকাল অবচেতন সত্তাকে পঙ্গু করে রেখেছে। বিয়াল্লিশ বছর আগের এক ভুতুড়ে সন্ধ্যা। নানাকে পিটিয়ে আধমরা করে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে পাক আর্মির সঙ্গে কয়েকজন রাজাকার মিলে নানার চোখ টেনে খুলে রাখে। তার সামনেই মাকে জরুলমুখো এক পাক আর্মি কৈশোরিক কৌমার্য ভাঙার মজায় ধর্ষণের পর ধর্ষণ করে নানার আর্তচিৎকারের মাঝে তাকে গুলি করে মেরে মাকে ধরাধরি করে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। এরপর কত রাত কত দিন মায়ের আর্তকণ্ঠময় অঝোর ধ্বনি, ছন্দা রে, ক্যাম্পে থাকতে, এ দেশের যারেই পাইছি, পা ধইরা মুক্তি চাইছি। ওরা তখন যেন মানুষ না… অশ্লীল অসভ্য গ্রহের কেউ… আমি মুক্তি পাওয়ার পর এই এখনো ওই বর্বরতার জন্য যত না কান্দি যত না আব্বার বুকে গুলির কষ্ট… মৃত্যুময় পীড়ন, পরে স্বামীর মৃত্যুতেও তা তুচ্ছ হয়ে দাঁড়ায় ভয়ংকর লজ্জা, যে আব্বা আমারে খুকি, বেবি, এসব ছাড়া ডাকত না… তার সামনে আমারে উলঙ্গ কইরা… উফ কী দুর্বিষহ… এইটা ভাবতে ভাবতেই লজ্জায় শরমে পঙ্গু থাইক্যা পঙ্গুতর হয়া যাই।

ওই দোজখ আন্ধারে একসময় ফেরেশতার মতো আইসা দাঁড়াইল তোমার যোদ্ধা বাবা। তার দায়িত্বের মধ্যে আমার মৃত সন্তান হইল। এরপর সে আমারে বিয়ে করছে। কিন্তু জীবনে এত যাতনার মধ্যে সংসার কী হয়?

যে দাম্পত্যে একজনের ত্যাগ থাকে, সে না চাইলেও তার মধে করুণা থাকে, উদারতার ঋণ থাকে, সেই দাম্পত্য একজনকে ছুঁইলে আরেকজনের রোমাঞ্চ? অসম্ভব না? একই বিছানায় আমাকে সহজ করতে যখনই সে আমার কাপড়ে হাত দিত, ওই ঝাঁক ঝাঁক নেকড়ের ছোবলে বিক্ষত দেহে চমকায়া উঠতাম। দিনের পর দিন মানসিক ডাক্তার দেখানো হইল… কিন্তু টান দিয়া আব্বার চক্ষের সামনে যে বেদনার লজ্জা… তার তাড়া থাইকা মুক্তি পাইলাম না। পরক্ষণেই মৃত নানা আর বাবার মৃত্যুশোকে মা শিশুর মতো কাঁদতে থাকে। কান্না থামলে ধাতস্থ মা ধীরে ধীরে ছন্দাকে বলে—বেশ কয়েক বছর পর এমন টানাপোড়েনে রোমাঞ্চহীন সম্পর্কের মধ্যেই তোমার জন্ম যেন আমাদের দুজনরে বাঁচায়া দিল, আমরা মুখর হওয়ার, কথা বলার, সহজ হওয়ার মানে তোমারে নিয়া বাঁচার পথ পাইলাম। ছন্দা সভ্যজীবনের নিঃশ্বাস নিয়া বাঁচতে মানুষ নিজেই নিজের শাসক যে কিছু নিয়মে নিজেকে শৃঙ্খলিত করে, আবার নিজেই শোষিত, সেই নিয়মে নিজেকে চলতে বাধ্য করে।

এমন গুম মারলি যে? তুহিনের কণ্ঠ সারা ঘরে কোরাসের মতো ধ্বনিত হয়। আঁধার ঘরে আচমকা বাতির প্রজ্বলন ছন্দাকে চমকে দেয়। সন্ধ্যা হেলান দিচ্ছে রাতের গায়ে। মা নাশতা দিয়ে বলা যায় ছুটতে ছুটতে ভেতরে চলে যায়। যেন ঢোকের সঙ্গে বিষ গিলছে, এমন বোধে হেঁচকি খেয়ে ছন্দা বলে, আম্মুর সঙ্গে কী হইছে? ধীর কণ্ঠে তুহিন শুরু করে, জাকিরের বাবা আমাদের এনজিওতে আসছিল বড় ডোনেশন দিয়ে আরো কিছু আসল নকল মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিজেও যোদ্ধা হয়ে। আমি আন্টির সঙ্গে দর্শকের সারিতে বসা আছিলাম। তুই তো জানোস, আমার খালা একজন বীরাঙ্গনা হয়া হাজারও কটূক্তি সয়া মাথা উঁচু কইরা হাঁটে। তোর নানার সামনের লজ্জাটার কারণে তোরা মা-ময়ে এদ্দিন যা বুকে চাইপ্যা চলছিলি, জাকিরের বাবা মঞ্চে উইঠ্যা কিছুক্ষণ আন্টির দিকে তাকায় সেই দীর্ঘ বছরের গুমর ভাইঙ্গা দিয়া বলতে শুরু করল, এই যে সামনে বসা আমার বীরাঙ্গনা বোন…।

সটান দাঁড়ায়া ছন্দা… যেন তার সমস্ত অস্তিত্বে ভূকম্পন শুরু হয়, ওই কুত্তাটাই কি নানার সামনে…?

টেনে ছন্দাকে বসিয়ে ক্ষান্ত করতে করতে তুহিন বলে, না। তবে ক্যাম্পে আন্টি যাদের পা ধরেছে, যারা আন্টির কাতরতায় চিৎকার হাসিতে লাত্থি দিয়া উল্টা পৈশাচিক নিপীড়ন করছে, তাদের একজন। বাড়ি ফিরতে গিয়া আন্টি বমি করতে করতে নিজেরে শান্ত করে, পরে এ নিয়ে তোরে কিছু না আমারে বলতে প্রমিজ করাইছিল।

জাকির এইসব জানে?

আগে জানত না। এখন তার বাপের ছবি আমরা জায়গায় জায়গায় টানাইছি। তার বাপেও তাতে বেপরোয়া হইতেছে। জাকির জানলেই কী? কোন সন্তানেরে দেখছোস এইসব শুইনা বিশ্বাস কইরা বাপের বিরুদ্ধে যাইতে?

তুহিনের কথার সঙ্গে সঙ্গে জাকিরের প্রতি যাও বুঝ-অবুঝ প্রেম ছিল, হিমস্রোতে উবে যেতে থাকে। কী করে ছন্দা পারল জীবনের এমন বাস্তবতা নিয়ে অত অবাস্তব উদ্দামে ভাসতে? সত্যিকার অর্থে প্রেম বাবা করেছিল মাকে। যুদ্ধ শেষে জঙ্গলে মুমূর্ষু মাকে পরিত্যক্ত অবস্থায় দেখে বাবাই ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যায়। দিনরাত তার শারীরিক মানসিক সেবা করে। এরপর ধর্ষিতা, বীরাঙ্গনার ঘেরাটোপের বাইরে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর সম্মান বাবাই মাকে দিয়েছিল। না না, একে করুণা বলে চরম অপমানের কোনো অর্থই হয় না।

শরীরে বরফ কাটতে থাকলে চেতনারহিত ছন্দা আচমকা ভূতগ্রস্ত চোখে চারপাশে তাকায়, আরে তুই খেয়াল করবি না চারদিকে? আম্মু তোকে প্রমিজ করাইছিল…।

রিলাক্স… ছায়া আঁধার থেকে বেরিয়ে যেনবা হাঁপ ছেড়ে সোফায় হেলান দেয় তুহিন। ঘরের মধ্যের আলো-নিশীথের বিচ্ছুরণে ছন্দার বোধ হতে থাকে, যেন বা অনন্তের ওপারের অদ্ভুত এক দ্বীপে সে কেবল ঘূর্ণিচক্কর খাচ্ছে…এরপরের কথাগুলো তাকে সে সেই চক্কর থেকে স্থিত করে পৃথিবীর চরম বিস্ময়বোধের মধ্যে নিয়ে ফেলে। আজ ভোরে মা নাকি তুহিনকে ফোন করে বিকেলে আসতে বলেছে। দুই দিনের অবিশ্রান্ত কান্নাজলে মা স্মৃতির মধ্যে যে পীড়া যে লজ্জার দহন সব ভাসিয়ে দিয়েছে, মা এখন শক্তিহীন ছন্দাকে হারানোর ভয় পাচ্ছে। তুহিনের কাছে মা এখন একটা প্ল্যাটফর্ম চাইছে, যেখানে গিয়ে সে পৃথিবীর সামনে নিজ মুখে এই ঘটনার বয়ান দেবে। বলেছে, আমাকে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চে নিয়ে চলো। আমি তারে বলেছি, ঢাকা যেতে হবে না, সারা দেশের মতো এই শহরেও আছে সেই জায়গা। আপনি আমাদের কৃষ্ণচূড়া মঞ্চে গিয়ে আপনার জীবন অস্তিত্বের সব জায়গা থাইকা সশব্দে আপনার এই লজ্জাকে ছুড়ে দেবেন।

কচকচে ভোরের সামনে ছককাটা মিহি রোদের ছলছলানি… জীবনের প্রথম মায়ের চোখে কাজল দেখল ছন্দা… সলাজ হাসি মায়ের, একসময় কাজল ছাড়া ভাবাই যাইত না আমাকে। দুজন দুই সখীর মতো হাত ধরাধরি করে সবুজ ঘাসে ডুবো ডুবো তেপান্তরের মতো সার্কিট হাউসটা পেরিয়ে সন্তর্পণে ব্রহ্মপুত্রের জলে পা রাখল। উদ্দাম বাতাসে নৌকো স্রোত কেটে এগোচ্ছে। যেন বা সদ্য ভূমিষ্ঠ ছন্দা আচমকা জলতরঙ্গ থেকে উঠা উদ্দাম শিশু বাতাসে নিৰশ্বাস নিতে নিতে মায়ের ওমে বসে দেখে অদ্ভুত এক দৃশ্য…

বহু বর্ণিল পদ্মপাতার ওপর ঝাঁক ঝাঁক দেবশিশু কলহাস্যে মুখর করছে জলপ্রান্তর। ঝাপসা হতে থাকা প্রেত মুখগুলো নিঃসীম আলোতে মিলিয়ে যাচ্ছে। মহাজলের ওপারে বসে তার মাতামহ তুমুল আঙুল ঢেউয়ে তবলা বাজাচ্ছে… আর তার কাজল কালো সজ্জিতা কিশোরী কন্যা নূপুরের নিক্কণ ধ্বনি তুলে জলের ওপর অবিশ্রান্ত ছন্দে নেচেই চলেছে…।

   

গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ধ্রুব এষ



বার্তা২৪ ডেস্ক
শিল্পী ধ্রুব এষ

শিল্পী ধ্রুব এষ

  • Font increase
  • Font Decrease

নান্দনিক প্রচ্ছদ ও অলংকরণশিল্পী হিসেবে দেশে আলাদা অবস্থান তৈরি করেছেন ধ্রুব এষ। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ নিয়ে ঢাকার পান্থপথের হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এই শিল্পী।

হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে বলেন, “তার অবস্থা বর্তমানে স্থিতিশীল।”

জ্বর সঙ্গে তীব্র কাশি নিয়ে বুধবার এ হাসপাতালে আসেন ধ্রুব এষ। পরিস্থিতি দেখে তাকে এইচডিইউতে ভর্তি করে নেওয়া হয়।

লেলিন চৌধুরী বলেন, "শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের কারণে উনার অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে গিয়েছিল। সে কারণে অবস্থা কিছুটা অবনতির দিকে গিয়েছিল। পরে অক্সিজেন সরবারাহ করা হয়, এখন তিনি স্টেবল আছেন। আমরা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছি।"

সুনামগঞ্জের সন্তান ধ্রুব এষের বয়স ৫৭ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলার ছাত্র থাকার সময় বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা শুরু করেন। প্রয়াত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ বইয়ের প্রচ্ছদ ধ্রুব এষেরই আঁকা। তার আঁকা প্রচ্ছদে প্রকাশিত হয়েছে ২৫ হাজারের বেশি বই।

দেশে প্রচ্ছদশিল্পে আধুনিকতা আনার কৃতিত্ব কেউ কেউ ধ্রুব এষকে দেন। আঁকাআঁকির সঙ্গে তিনি লেখালেখিও করেন। শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য ২০২২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান ধ্রুব এষ।

;

তৃতীয় পক্ষ



ওমর শরিফ
অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

 

এ শহরে বাড়ি আর বাড়ি। ছায়া, শান্তি দেবে এমন গাছ কোথায়? গত বারের তুলনায় এবার গরমটা একটু বেশী পড়েছে। দুপুরবেলা তাই খাঁ খাঁ করছে রাস্তাঘাট। প্রায় জনমানব শূন্য চারিদিক। মাঝে মাঝে কিছু রিক্সা, ট্যাক্সি চলছে এদিক সেদিক। ভাগ্যিস দুই রাস্তার মাঝের ডিভাইডারে সারি সারি গাছ আছে। তবু একটু সবুজ দেখা যায়, তা-না হলে কিযে হতো? কথাগুলো ভাবলো মিতু। কলেজ পড়ুয়া তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী মিতু। কলেজে কোন ভাবেই মন বসছিলোনা মিতুর। একটা ঘটনা অস্থির করে রেখেছে তাকে কাল থেকে। তাই মাত্র তিনটা ক্লাস করে বেরিয়েছে ধানমন্ডি লেক যাবে বলে। ধানমন্ডি লেকে অনেক গাছ, অনেক শান্তি। সায়েলা, রবি দু’একবার জিজ্ঞেস করেছে কোথায় যাচ্ছে জানার জন্য। সায়েলা, রবি মিতুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মিতু ওদের মিথ্যে বলেছে।

-বলেছে ‘বড় চাচার বাড়ি যাচ্ছি, চাচা একটু অসুস্থ তাই দেখা করে ওখান থেকেই বাসা চলে যাবো’।     

‘ক্লাস শেষে বন্ধুদের আড্ডা জমে উঠেছিলো খুব তবু ছাড়তে হয়েছে। এই খাঁ খাঁ রোদে কার দায় পড়েছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসার? কল দিলে কল ধরো না, কেটে দাও আবার ব্যাকও করনা! এটা কি ধরনের কথা’? রিক্সার ভাড়া দিতে দিতে বলল মিতু। মিতুর রাগ দেখে সামনে দাঁড়ানো স্বপন মিটমিট হাসছে। ছয় ফিটের মতো লম্বা, ট্রিম করা দাড়ি, মাথার চুল এলোমেলো, একটা হাওয়াই শার্ট সঙ্গে জিন্স পড়া। পায়ে স্যান্ডেলের বদলে স্নিকার পড়েছে আজ। একটু আগোছাল যাকে বলে ‘স্বযত্নে অবহেলা’। স্বপনের এই ব্যাপারটাই দারুণ টানে মিতুকে। ওর মধ্যে কোথায় একটা ব্যাপার আছে। কি নেই, আবার আছে। ঠিক পূর্ণ নয় আবার খালিও নয়। স্বপন মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে। দেশের নামকরা একটা পত্রিকা অফিসে কাজ করে। কথা কম বলে। যা কথা বলে তা ওর গিটার বলে। খুব ভালো গিটার বাজায় স্বপন।      

রিক্সা থেকে নেমে তেড়ে এলো মিতু। ‘কি কানে শোন না। হাসছো আবার, লজ্জা নেই’? রাগে বলল মিতু।

‘আচ্ছা বাবা রাগ পরে হবে। আগে চলো লেকের ভেতরটায় যাই, এখানে অনেক রোদ’। বলল স্বপন। লেকের পার ধরে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে লেকের পাশে থাকা রেস্টুরেন্ট ‘জলসিরি’তে গিয়ে বসলো। রেস্টুরেন্টে লোকজন কম। দাঁড়িয়ে থাকা ওয়েটারকে এসিটা অন করে দিতে বলল স্বপন। মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বলো কি হয়েছে, এতো জরুরি তলব কেন?’

মিতু প্রতিত্তরে বলল, ‘আগে বলো এতক্ষণ ধরে তুমি আমার ফোন ধরছিলে না কেন’? কতোবার ট্রাই করার পর তোমাকে পেয়েছি, তোমার হিসাব আছে? এতো কথার পরও স্বপনকে শান্ত দেখে মিতু আরও খানিকটা রেগে গেলো। বলল, ‘তুমি কি অনুভূতিহীন, তোমার কি জানতে ইচ্ছে করেনা, আমি কেন এতবার ফোন দিয়েছি’?

স্বপন একটু সিরিয়াস হয়ে গলা খাকিয়ে বলল, ‘আসার পর থেকে আমাকে বলার সুযোগ দিয়েছ তুমি? শুধু নিজেই বলে যাচ্ছ’।

এতক্ষণে নিজেকে যেন খুঁজে পেলো মিতু, একটু লজ্জাও পেলো। কিছুটা নমনীয় হয়ে বলল, ‘আচ্ছা বলো কেন ফোন ধরতে এত সময় নিলে’?

স্বপনের সরল উত্তর, ‘খুব জরুরি মিটিং এ ছিলাম তাই তোমার ফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে ফোন ধরতে পারেনি। মিটিং শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছি। তারপর সব কাজ ফেলে এইতো তোমার সামনে আমি’।

মুখের এক্সপ্রেশন দেখে বোঝা গেলো উত্তরে মিতু সন্তুষ্ট হয়েছে। কিন্তু কিসের যেন উদ্বেগ স্পষ্ট। ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়ায়নি স্বপনের।  সে বলল, ‘কি হয়েছে? কোন সমস্যা? আমাকে খুলে বলো’।

মিতু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘স্বপন আমার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে বাসা থেকে। পাত্র পক্ষ জানিয়েছে আমাকে খুব পছন্দ হয়েছে তাদের। আগামীকাল আসবে ডেট ফাইনাল করতে। আমি এখন কি করবো স্বপন? আমাকে বলে দাও’।

স্বপন বলল, ‘বিয়ে করে ফেল। বাবা মা যা চাই তাই করো এতে সবার মঙ্গল’।

মিতু অবাক হয়ে স্বপনের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। বলল, ‘মানে কি? তাহলে এতদিন আমারা কি করলাম। তুমি একটা প্রতারক। তুমি একটা হিপোক্রেট। এখন দায়িত্ব নেয়ার সময় পালাচ্ছো। কাপুরুষ কোথাকার’। তখনও স্বপনের ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখে অবাক হয়ে গেলো মিতু।

স্বপন মিতুর দুহাত টেনে কাছে নিয়ে বলল, ‘এতো দিনেও চিনতে পারলেনা আমাকে। তুমি যা ভাবো আমি তার থেকে অনেক অনেক বেশী ভালোবাসি তোমাকে’। বলে উঠে দাঁড়িয়ে স্বপন বলল,‘চলো’। মিতু বললো,

- ‘চলো’। মিতু বললো,
- ‘কোথায়’?
- চলোই না।
- আগে বলো কোথায়?
- কাজী অফিসে।
- মানে?!
- আমরা আজই এক্ষুনি বিয়ে করছি।
- কি বলো এসব?
- যা বলছি ঠিক বলছি। এছাড়া আমাদের হাতে আর কোন পথ নেই।
- তোমার বাসা?
- আমি ম্যানেজ করবো।
- আমার বাসা?
- ওটা পরে ম্যানেজ হয়ে যাবে।

 

দরজা খুলতেই নাসরিন স্বপনের সঙ্গে একটি মেয়েকে দেখতে পেলো। দুজনেই পা ছুঁয়ে সালাম করতেই নাসরিন অবাক হয়ে পা সরিয়ে নিলো। কিছুটা সংকোচেও। নাসরিন স্বপনের মা। নাসরিন কিছুটা হতভম্ব হয়ে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন। সোফায় বসতে দিলেন। সোফাতে বসে মাকে উদ্দেশ্য করে স্বপন বলল, ‘মা আমরা বিয়ে করে ফেলেছি। তোমাকে  পরিচয় করিয়ে দিই। এ হচ্ছে মিতু। মিতু, ‘ইনি তোমার শাশুড়ি’।

নাসরিন ছেলের দিকে হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, ‘এসব কি বলছিস স্বপন, কাউকে না জানিয়ে এতবড় কাজ তুই কিভাবে করলি? তোর বাবাকে আমি কি উত্তর দিবো। আর চিনি না জানি না একটা মেয়েকে এনে ঘরে তুললি?

স্বপন পাত্তা না দিয়ে উত্তর দিলো, ‘মিতু ভালো ঘরের মেয়ে। বাবা মা শিক্ষিত। সে নিজেও শিক্ষিত অনার্স করছে। দেখতে ভালো, স্বভাব চরিত্রেও ভালো। তোমার সামনেই আছে দেখে নাও’। বলে হাসতে লাগলো।

নাসরিন আর বেশী কথা না বাড়িয়ে মিতুর দিকে তাকালেন। প্রথমিক কিছু কথা বার্তা জিজ্ঞেস করলেন।

বললেন, ‘বিয়েটা কি কোন ভাবে থামানো যাচ্ছিল না বা বাবা মা কে বুঝিয়ে শুনিয়ে অনার্স শেষ করে তারপর বিয়েটা হলে বোধহয় ভালো ছিল’। মিতু মাথা নিচু করে শুধু শুনে যাচ্ছে।

শুধু বলল, ‘আন্টি আমি বাবাকে খুব ভয় পাই আর বাবা সরকারি চাকরি ছাড়া বিয়ে দিবেন না। বললে আরও ঝামেলা বাড়বে’। 

নাসরিন মিতুকে থামিয়ে দিয়ে ঘরে নিয়ে যেতে বললো।

স্বপন দু’জনের উদ্দেশ্যে বললো, ‘অফিসে বিশেষ কাজ আছে, আমাকে একবার এক্ষুনি অফিস যেতে হবে। এর মধ্যে আশা করি তোমাদের চেনা জানা হয়ে যাবে’।

স্বপনের কথা শুনে মা ও মিতু দুজনেই বেশ অবাক হয়ে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকলো।

নিজের রুমে বসে বসে মিতু ল্যাপটপে হানিমুনের ছবি দেখছিল। কাশ্মীর যে কি সুন্দর ভাবাই যায় না। পাহেলগাম, সোনমার্গ, গুলমার্গ জায়গাগুলো ভোলার মতো না। সেবারই জীবনের প্রথম বরফ পড়া দেখেছিলো মিতু। কিছু ছবি দেখেতো মিতু রীতিমত না হেসে পারল না। সে সময় ওরা দুজনেই কেমন বাচ্চা বাচ্চা ছিল। ‘দেখতে দেখতে বিয়ের প্রায় চার বছর হতে চললো’ ভাবল মিতু। একটু কি দীর্ঘশ্বাসের মতো বয়ে গেলো বুকের ভিতরটায়? হানিমুনের ছবি দেখা শেষে পুরনো কিছু ছবিতে চোখ গেলো মিতুর। বাবা মা’র ছবি। বাবা মা পাশাপাশি বসা। বাবার কোলে মিতু। মিতুর বয়স তখন ছয় কি সাত হবে। কি দারুন একটা ছবি। মনের অগোচরেই চোখটা ভিজে এলো মিতুর। এখনও বাবার বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক হয়নি।

মিতুর বাবা মিতুর বিয়ের কথা শুনে বলেছিলেন, ‘মিতু নামে আমার মেয়ে ছিল আমি ভুলে গেছি। বাবার অপমান করতে যে মেয়ের বিন্দুমাত্র বাঁধে না; সে আমার মেয়ে হতে পারে না। মিতুর মুখ আমি দেখতে চায়না’।

মাস্টার্স পাস করে মিতু চাকরির কথা ভাবেনি, যদিও স্বপন ওকে বার বার বলেছে বাসায় একা একা বোর লাগবে, তবুও। মিতুর শাশুড়িও একই কথা বলেছে, কিন্তু মন থেকে সায় দেয়নি মিতু। বাচ্চা পালন করবে আর সংসার সামলাবে এটিই ছিল তার চিন্তা।

মিতুর বাচ্চার খুব শখ কিন্তু স্বপন এখন বাচ্চা নিতে নারাজ। বললেই বলে, ‘আরে বাচ্চার জন্য এতো তাড়া কিসের, অঢেল সময় পড়ে আছে, আগে নিজেদের মতো করে সময় পার করি’।

স্বপন সকাল সকাল বেরিয়ে যায় ফেরার কোন সময় নির্দিষ্ট নেই। কখনও আটটা কখনও দশটা পেরিয়ে যায়। আবার কখনও কাজের এতো চাপ থাকে যে কোন কোন রাতে বাসা ফেরা হয়না। কাজ নিয়ে খুব সিরিয়াস স্বপন। খুব তাড়াতাড়ি কয়েকটা প্রমশনও পেয়েছে সে। এই বছর প্রমোশন নিয়ে গাড়ি কিনেছে ওরা। মিতুর পছন্দতেই কেনা। লাল রঙের গাড়ি। লাল রঙের গাড়ি মিতুর খুব পছন্দ। স্বপনের উন্নতিতে মিতুর গর্বের শেষ ছিলনা। মিতুর কেবলই মনে হতো স্বপনের যত সাফল্য সবই তার নিজের। সে নিজে অনুভব করতো আর আনন্দ নিয়ে সেলেব্রেট করতো। মিতুর বন্ধু বান্ধবী পাড়া পরশি যার সঙ্গেই কথা হোক না কেন, ইনিয়ে বিনিয়ে স্বপনের সাফল্যের কথা বলবেই। সে কথায় কথায় স্বপন যে তার ক্যারিয়ারে খুব ভালো করছে, সে হাসবান্ড হিসেবে খুব কেয়ারিং, পরিবারের ব্যাপারে যত্নবান সেগুলো অন্যকে বলে আত্মতৃপ্তি পায়। সেদিন পাশের বাসার ভাবি বললেন, ‘মিতু ভাবি কি যে করি বলেন তো? আমার হাসবান্ড তো আমার হাতের রান্না একেবারেই খেতে পারেনা। আপনি কিভাবে যে ম্যানেজ করেন’?

মিতু হাসতে হাসতে বলন, ‘আপনার ভাইতো আমার হাতের রান্না ছাড়া খেতেই পারেনা। আসলে এ হচ্ছে ভালোবাসা, বুঝেছেন ভাবি ভালবাসা থাকলে বিষও মধু মনে হয়’।

মিতুর সেদিনের সেই আত্মতৃপ্তি ভোলার মতো না। কথা যখন বলছিলো তখন দু চোখ চকচক করে উঠছিল যেন। 

কিছুক্ষণ ধরে মোবাইলটা বেজে চলেছে। মিতু রান্না করছিলো তাই ধরতে দেরি হলো।

হাত মুছে ফোনটা ধরে বলল, ‘হ্যালো স্লামালেকুন। কে বলছেন’?  

মোবাইল ওপাশ থেকে ভেসে এলো, ‘ভাবি আমাকে চিনতে পারছেন আমি ফারুক বলছি। ঐযে নিউ মার্কেটে দেখা। আপানারা প্লাস্টিকের কিছু জিনিস কিনছিলেন। মনে আছে’?  

মনে পড়ে গেলো মিতুর। সে বলল, ‘ও হ্যাঁ ফারুক ভাই! কেমন আছেন? বাসায় সবায় কেমন আছে? বাচ্চারা কেমন আছে’? সরি ফারুক ভাই আপনার নম্বারটা আমার মোবাইল সেভ ছিল না’।  

ফারুক উত্তরে বলল, ব্যাপার না ভাবি, হতেই পারে। আপনাদের দোয়ায় সবাই ভালো আছে। আলহামদুলিল্লাহ। ভাবি একটা কাজে একটু ফোন করেছিলাম’।

মিতু বলল, কি ব্যাপার বলুন তো?

স্বপন ভাইকে একটু দরকার ছিল। উনি কি বাসায় আছে না কোন কাজে বাইরে গেছেন?

কেন আপনি জানেন না? আপনার স্বপন ভাইতো আপনাদেরই অফিসের ট্যুরে চট্টগ্রাম গেছে।

ফারুক একটু অবাক হয়ে বলল, ‘কি বলেন ভাবি? আমার জানা মতে স্বপন ভাইতো অফিসের ট্যুরে কোথাও যাননি। বরং উনি তো বাসার কাজের কথা বলে দু’দিন ছুটি নিয়েছেন।!

মিতু আর কথা বাড়ায় না। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে, অনুমানে সে তা বুঝেছে। সে কথাটা ঘুরিয়ে ফারুককে বলল, ‘হ্যাঁ স্বপন বলছিলো বাসার কাজের সঙ্গে অফিসের কাজও সেরে আসবে। তাইতো সেদিন আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলো। আমি হয়তো বুঝতে ভুল করেছি’।

ফারুক ওপাশ থেকে বলল, ‘ও আচ্ছা ঠিক আছে ভাবি, স্বপন ভাইয়ের অন্য কোন নম্বার থাকলে দিলে ভালো হয়। জরুরি আলাপ আছে’।

ফারুক ভাই স্বপনের তো একটাই নম্বার। ও তো আর অন্য কোন নম্বার ব্যবহার করেনা। ও কল দিলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলবো’।

কথা বলার সময় যতদূর সম্ভব মাথাটাকে ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করলো মিতু। কথা শেষ করে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লো সে। সে কিছু একটা গড়বড় আছে অনুমান করছে। কিন্তু আবার এও চিন্তা করছে অনুমান নির্ভর কিছু ভেবে বসা ঠিক না। সে মনে মনে চিন্তা করলো, ‘স্বপন এলে কথা বলবে’।

স্বপন দুই দিন পর অফিসের কাজ করে বাসায় ফিরে এলো। এসেই মিতুকে জরিয়ে ধরে চুমু খেল। গভীর আদরে বুকের মধ্যে নিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘আহা কি শান্তি। তোমাকে বুকে নিলে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। এই কি আছে তোমার মধ্যে? তোমাকে বুকে নিলেই আমার কেন এতো শান্তি শান্তি লাগে?

মিতু শুধু হুম হলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। বেশী কথা বাড়ালো না। স্বপন মিতুর এই ব্যবহারে কিছুটা অবাক হল। বলল, কি ব্যাপার শরীর খারাপ নাকি? কিছু হয়েছে? মন খারাপ?

মিতু উত্তরে বলল, ‘রান্না করতে করতে একটু টায়ার্ড হয়ে গেছি মনে হয়। ঠিক হয়ে যাবে। তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি’। বলে মিতু রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। স্বপনও ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকে পড়লো।

মিতুর স্বপনের এরকম ব্যবহার দেখে কিছুটা স্বস্তি বোধ করলো। মন থেকে কালো মেঘ যা এতক্ষণ খেলা করছিলো তা কেটে গেলো। নিজেকে খুব হাল্কা হাল্কা বোধ করছে এখন। দুজনে একসঙ্গে বসে খেল। ডাইনিং টেবিলে স্বপন অনেক গল্প করলো মিতুর সঙ্গে। মনে হল এই দুইদিনে অনেক গল্প জমা ছিল। মিতুকে পেয়ে সব বাধা সরে গিয়ে একসঙ্গে বেরিয়ে আসতে লাগলো সব।

এতো কিছুর পরও মিতু লক্ষ্য করলো, ‘আগে কথায় কথায় স্বপন মিতুর গায়ে হাত দিত। ট্যুর থেকে এলে বেডে অনেক আদর করতো। কিন্তু এবার টায়ার্ড বলে পাশ ফিরে শুয়ে গেলো। মিতুর শরীরটাকে কাছে টেনে পর্যন্ত নিলো না। স্বপনের ব্যবহার মিতুর কাছে কিছুটা আলাদা মনে হল। শুয়ে শুয়ে মিতুর কেবলই মনে হতে লাগলো অফিস থেকে দেরিতে ফেরা, হুটহাট ট্যুরের নামে বাইরে যাওয়া। মোবাইল চ্যাট করা আর মোবাইল বেজে উঠলে খুব সন্তর্পণে অন্য রুমে গিয়ে কথা বলা, কেমন যেন আলগা একটা অনুভূতির সৃষ্টি করলো মিতুর কাছে। মিতু ঠিক বুঝতে পারছে কিছু তো একটা আছে যা মোটেও স্বাভাবিক নয়। কোথায় যেন কি নেই। মিতু মনে মনে ছটপট করে উঠলো। এতদিন তাহলে কেন বুঝতে পারেনি সে? নাকি এ সবই তার ভুল, দুর্বল মনের বিকার মাত্র।

শুক্রবার ছুটির দিন। এই দিনটিতে স্বপন কিছুটা বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। মিতু সকালের রান্না করতে ব্যাস্ত সময় পার করছে। আজ পরোটা, ডিমভাজা আর আলুর দম রান্না হচ্ছে। স্বপনের ফেভারিট। নাস্তা প্রায় রেডি। স্বপনকে উঠাতে ঘরে ঢোকা মাত্র স্বপনের মোবাইল মেসাজের শব্দ কানে ভেসে এলো মিতুর। স্বপন তখনও ঘুমে অচেতন। ‘কোন জরুরি মেসেজ নাকি’? ভাবলো মিতু। মিতু কাছে গিয়ে মোবাইল তুলতেই আরেকটি মেসেজ ভেসে উঠলো। রিয়া নামে কেউ লিখেছে, ‘তোমাকে খুব মিস করছি’। মেসেজ দেখে মিতুর কেমন যেন বাজে অনুভূতি হল। সে সম্পূর্ণ মেসেজ পড়ার জন্য মোবাইল আনলক করতেই একগাদা হার্ট ইমজি ভেসে উঠলো। মিতুর চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠলো। সে ধীরে ধীরে স্ক্রল করতে শুরু করলো। সে যতই পড়ছে ততই অবাক হচ্ছে। স্বপন লিখেছে চট্টগ্রামের ট্যুরটা অতুলনীয় ছিল। রিয়ার উত্তর, ‘না মোটেও না। আমার মতে গুলশান হোটেলে আমাদের সময়টা ছিল বেস্ট। তবে কক্সবাজার ট্যুরটাও বেশ উপভোগ্য ছিল। বেডে যে তুমি কি পাগলের মতো করো না। তোমাকে সামলানোই যায় না। ইউ আর আ রিয়েল ওয়াইল্ড টাইগার। আই লাভ ইউ’।

উত্তরে স্বপন লিখেছে, ‘তোমার কোন তুলনা হয় না। তুমি বেস্ট। আই লাভ ইউ ঠু’।

সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছে যেন। নিজেকে দিশেহারা মনে হচ্ছে। পাগল পাগল লাগছে সব। পড়ছে আর মিতুর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ওদের দুজনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি দেখা যাচ্ছে। এসব দেখে মিতুর কেবলই মনে হচ্ছে কেউ যেন ওর হৃৎপিণ্ডটাকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে দিচ্ছে। বুকের ভেতর প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছে সে। কষ্টে কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না যেন। 

হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে মিতুকে তার মোবাইল হাতে কি যেন করছে দেখতে পেলো স্বপন। এমন সময় উঠে এসে পেছন থেকে মিতুর কাছ থকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বললো, ‘হাউ ডেয়াড় ইউ। তুমি আমার মোবাইলে হাত দিয়েছো কেন? মেসাজ কেন পড়ছো? মানুষের প্রাইভেসি বলে একটা কথা আছে। আনশিভিলাইসড কোথাকার’।

মিতু কিছুই বললোনা শুধু ফ্যালফ্যাল করে স্বপনের দিকে চেয়ে থাকলো। স্বপনের উদ্ধতপূর্ণ কথাবার্তা  নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না সে। এ ধরনের অন্যায় করার পর কোন মানুষ যে এতো নির্বিকার হতে পারে মিতুর চিন্তার বাইরে ছিল। শান্ত থাকতে থাকতে হঠাৎ মিতু চিৎকার করে উঠলো। বলল, চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার? অফিসের ট্যুরের নাম করে বান্ধবী কে নিয়ে ঘুরে বেড়াও। ছি ছি তোমার লজ্জা করেনা?

স্বপন মিতুকে থামাতে এগিয়ে আসতেই মিতু একরকম পাগলের মতো চড়, থাপ্পড় দিতে শুরু করে দিলো। আক্রোশে স্বপনের রাতে পড়া জামাটা একটানে ছিঁড়ে ফেললো মিতু। মুখে বলল কুত্তার বাচ্চা তুই আমার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আমার জীবন নিয়ে খেলেছিস। বাস্টার্ড।

স্বপন মিতুকে থামাতে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। মুখে বলল, ‘আর একটা কথা বললে তোকে এখানেই মেরে ফেলবো। কি প্রমাণ আছে তোর কাছে যে আমি লম্পট। ... উল্টাপাল্টা কথা বললে তোকে আমি খুন করে ফেলবো’।

মিতু তখনও স্বপনের জামার কলার ধরে আছে। বলল, ‘ফারুক ভাই কল করেছিলো উনি বলেছেন তুমি অফিসের ট্যুরে যাওনি। তুমি তোমার লাভারের সঙ্গে হানিমুনে গিয়েছ চট্টগ্রামে। তারও আগে কক্সবাজারে আর গুলশানে একসঙ্গে রাত কাটিয়েছ। সবই পড়েছই আমি। তোমাদের একসঙ্গে ইন্টিমেট সব ছবিও দেখেছি। ছি তোমার ঘেন্না করেনা। চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার?

সব শুনে স্বপন একটা ধাক্কা খেল যেন। একটু বোকা বোকা লাগছে নিজেকে। সে আস্তে আস্তে বিছানায় গিয়ে বসলো। কোন উপায় না পেয়ে মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার ভুল হয়েছে মিতু, আমাকে তুমি ক্ষমা করো। এবারের মতো মাফ করে দাও, প্লিজ’।

অপরাধবোধ আর অনুশোচনায় নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছিলো স্বপনের। ক্ষণিকের আনন্দের জন্য এ কোন ভুল করে বসলো স্বপন। সে চাইলেও নিজেকে আর ক্ষমা করতে পারবেনা।  

এতক্ষণে মিতুও কিছুটা ধাতস্ত হয়ে এসেছে। স্বপনের দিকে তাকিয়ে শুধু জিজ্ঞেস করলো, ‘স্বপন আমার কি দোষ ছিল? আমিতো তোমাকে নিজেকে উজাড় করে চেয়েছি। এতো বড় কষ্ট তুমি আমাকে দিতে পারলে? তুমি আমার পৃথিবী ধ্বংস করে দিয়েছ। আমাকে শেষ করে দিয়েছ। কিভাবে পারলে? এসব জানার আগে আমার মৃত্যু হলনা কেন? স্বপন আমি যে তোমাকে খুব খুব ভালোবেসে ছিলাম। এত বড় প্রতারণা তুমি কেন করলে? আমাকে বললে আমিই তোমার জীবন থেকে চলে যেতাম। তাই বলে এতবড় আঘাত তুমি আমাকে দিতে পারলে’?

 

সময় যেন থেমে গেলো। মিতু আর আগের মতো উচ্ছ্বসিত হয়না। স্বপন বিরাট ভুল করেছে এবং তা সে বারবার স্বীকার করেছে। মিতু স্বপনকে মন থেকে ক্ষমাও করেছে। কিন্তু দিন শেষে যখন মুখোমুখি হয় তখন নিজের মূল্য নিয়ে সংশয় দেখা দেয় মিতুর। বড্ড সস্তা লাগে নিজেকে। পরিপূর্ণভাবে কিছু দিতে না পারার বেদনা নিজেকে কুড়ে কুড়ে খায়। মিতু বুঝতে চেষ্টা করে তাদের মাঝে কি ছিলনা যে স্বপনকে অন্য মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। সম্মানবোধ? মিতুর মতে, ‘স্বপন মিতুকে ভালোবাসতো ঠিক কিন্তু তার মধ্যে গভীরতা ছিলনা, সম্মান ছিলনা। যা ছিল তা প্রাত্যহিক জীবনের অভ্যেস। মাপ করে চুমু দেয়া, বাহির থেকে এসে জড়িয়ে ধরা, সাংসারিক কথা বলা, রুটিন করে মিলিত হওয়া। এর মধ্যে নতুনত্ব কি আছে? যা আছে তা সবই অভ্যেস। মিতু স্বপনকে রিয়ার কাছে কেন যাচ্ছে না জানতে চাইলে বলে, ‘রিয়াকে আমি সেভাবে কখনই দেখিনি। এটা একটা মোহ’।

মিতু বুঝতে পারে রিয়া স্বপনের পাঞ্চ লাইন। অনেকটা সারাদিনের ক্লান্তির পর এক পেগ মদ যেমন তেমন। স্বপনের কাছে ঘরটা থাকলো ঠিকই, মাঝে মাঝে একটু বাম্পার রাইডিং ও থাকলো, যা জীবনে স্পাইস যুক্ত করবে। এই সমীকরণ যা বোঝায় তা হচ্ছে। স্বপনের লয়াল থাকা প্রায় অসম্ভব, মিতুও সেটি বোঝে।

আগে দুজনার অনেক কথা হতো এখন সত্তুর শতাংশ কথা কমে গেছে দুজনার মধ্যে। প্রয়োজন ছাড়া কথা হয় না। একে ওপরের দিকে ঠিক ভাবে তাকাতে পর্যন্ত পারে না। অনুশোচনায় আর অপমানে দুজনেই শুধু হারিয়ে থাকে। দুজনেই অনুভব করে, কোন কিছুই আর আগের মতো নেই। ঘটনা প্রবাহে সব কিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে। স্বপন মিতুকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য যথেষ্ট সাহায্য চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মিতু নিজের সামনে নিজেই দাঁড়াতে পারছেনা। দুপুরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মিতু ভাবছে সে আর কি করলে এমন ঘটনা ঘটতো না? কি করলে স্বপনকে আগলে রাখতে পারতো? বার বার একই উত্তর পেলো। অভ্যেস! টানটা আর আগের মতো নেই।

পরের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে মিতু বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকালের আকাশ দেখছে। আনমনে কি যেন ভাবছে। স্বপন মিতুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, ‘অফিসে যাচ্ছি’ বলে বের হয়ে গেলো। মিতু একবার সকালের নাস্তার কথা জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলো না। বারান্দায় বসে দুই হাতের তালুতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে  কাঁদতে শুরু করলো।

রাতে স্বপন অফিস থেকে ফিরে এসে কলিং বেল দিলো। কিন্তু কেউ দরজা খুলছে না দেখে একটু ভয় পেয়ে গেলো সে। ব্যাগে রাখা এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল স্বপন। রাতে লাইট জ্বালায়নি মিতু। পুরো বাসা চুপচাপ। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো স্বপনের। হঠাৎ ভয় পেয়ে মিতু মিতু বলে ডাকতে শুরু করে দিলো স্বপন। বেডরুমে ঢুকে দেখল মিতু সেখানে নেই। লাইটের সুইচ অন করলো স্বপন। বাথরুম, পাশের রুম, বেলকণি ঘুরে ঘুরে দেখল, কয়েকবার ডাকলো মিতু নাম ধরে কিন্তু কোন সাড়া নেই। বেড রুমে ফিরে এসে বিছানায় বসে পড়লো স্বপন। দুই হাতের তালুতে মুখ লুকাল সে। ভয়ে টেনশনে ঘেমে নেয়ে গেছে একেবারে। হাত থেকে মুখ তুলতেই লক্ষ্য করলো এস্ট্রের নিচে চিঠির মতো কি যেন চাপা দেয়া আছে টেবিলের উপর। স্বপন উঠে এসে দেখল হ্যাঁ মিতুর লেখা চিঠি একটা।

চিঠিতে লেখা,

স্বপন, আমরা পছন্দ করে পরিবারের মতের বাইরে গিয়ে সংসার পেতে ছিলাম। সুখে দুখে আমরা সব সময় এক ছিলাম। পাশাপাশি ছিলাম। ভেবেছিলাম জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমার সঙ্গে পাড়ি দিবো। তা আর হলনা। এই ৮ বছরের সম্পর্কে কোনদিন বুঝিনি তুমি আমার কেউ নও। আজকের পর থেকে শুধুই মনে হচ্ছে তুমি আমার কেউ নও, তুমি আর পাঁচটা মানুষের মতো। তুমি নিশ্চয় জানো একটা সম্পর্ক টিকে থাকে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর সম্মান বোধ থেকে। একটা সম্পর্কের আয়ু বেড়ে যায় একে অপরকে বোঝা পড়ার মাধ্যমে। জানিনা কি পাপ করেছিলাম যে আল্লাহ আমাকে এতো বড় শাস্তি দিলেন। হ্যাঁ, শাস্তিই বটে। সম্পর্কে প্রতারণার কোন জায়গা থাকতে পারে না। আমি জানি আমাকে তুমি ঠিক ভালোবাসতে পারোনি। যা তুমি ভালবাসা বলছো তা আমার প্রতি নিছক ইনফাচুয়েসন। পুরনো অভ্যেস। কেন? সেটির উত্তর তুমিই ভালো দিতে পারবে। তুমি আজ আমাকে যে অসম্মান করেছ তার কোন তুলনা হয় না। আয়নার সামনে কোনদিন দাঁড়াতে পারবো এ বিশ্বাস আমার মরে গেছে। তোমার প্রতি রাগ বা ঘৃণা কোনটিই নেই আমার। তুমি আমার কাছে এখন যে কোন পুরুষ। তবু আমি তোমার ভালো চাইবো। তুমি ভালো থেকো। অনেক ভালো থেকো। নিজের যত্ন নিয়ো। শুধু জেন মিতু নামের একটি মেয়ে তোমাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসেছিল। তোমাকে খুব খুব চেয়েছিলো। তার দাম সে পায়নি বলে চলে যাচ্ছে। আমাকে খুঁজনা।-মিতু

চিঠিটা পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বুকের মাঝে ধরে, ‘মিতু আমাকে মাফ করে দাও, আমাকে ক্ষমা করে দাও’ বলে বিলাপ করতে লাগলো স্বপন। কেমন পাগলের মতো মিতু মিতু বলে ডাকতে লাগলো সে। কিছুক্ষণ পর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবনটাকে অসম্ভব ভারি বলে মনে হতে লাগলো স্বপনের। বিস্তীর্ণ আকাশে জীবনের অসীম অনিশ্চয়তার দিকে তাকিয়ে থাকলো শুধু।      

;

নৃত্য-গীতে জীবন্ত হল রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কালজয়ী আখ্যান



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্ব পরিভ্রমণের সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আর্জেন্টিনায় ল্যাটিন আমেরিকার কালজয়ী সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক ও নারীবাদী লেখক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ঐতিহাসিক সাক্ষাতের শতবর্ষ এ বছর।

১৯২৪ সালে এই দুই কালজয়ী লেখকের সাক্ষাত অক্ষয় হয়ে আছে দু’জনের জীবনস্মৃতিতে, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আদান-প্রদানে আর ভিক্টোরিয়াকে রবীন্দ্রনাথের ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করার মতো বহু ঘটনাবহুল আখ্যানকে ঘিরে। দু’জনের এই মধুর এ আখ্যানকে ঢাকার সাহিত্য ও সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে তুলে ধরলো ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি)।

সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ছায়ানট মিলনায়তনে ‘TAGORE AND VICTORIA OCAMPO-VIJAYA the victorious: 100 years on’ শীর্ষক নৃত্য-গীতে সেই অবিস্মরণীয় আখ্যানকেই ফুটিয়ে তুললেন যুক্তরাজ্য থেকে আগত বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও শিল্পী ডা. অনন্ত গুপ্ত এবং তাঁর সহশিল্পীরা।

বক্তব্য রাখছেন ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসা

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি) এর পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী আয়োজনের পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে অতিথি ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসার লাতিন আমেরিকার জনগণের হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির কথা তুলে ধরে তাকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধন রচনকারী মহান লেখক হিসেবে বর্ণনা করেন। অনুষ্ঠানে আর্জেন্টিনায় অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ রচিত বিভিন্ন কালজয়ী গান নৃত্যসহযোগে পরিবেশন করেন শিল্পীরা। একইসঙ্গে সেইসব গানের প্রেক্ষিত তুলে ধরা হয়।

উল্লেখ্য, ১৯২৪ সালে পেরু সরকারের আমন্ত্রণে দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবর্ষ উদযাপনে যোগ দিতে গিয়ে তেষট্টি বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ সমুদ্রপথে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় তিনি আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেসে থামেন এবং ওঠেন সান ইসিদ্রো শহরের এক হোটেলে। সেখানে কবির ভীষণ অনুরাগী আর্জেন্টিনার বিখ্যাত সাহিত্যিক ও নারীবাদী লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো (যিনি কবির গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদ পড়ে তাঁর কবিতার সঙ্গে কবিরও অনুরাগী হয়ে উঠেন)। রবীন্দ্রনাথের আগমনের খবরে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ছুটে যান কবির কাছে। তিনি কবিকে সুস্থ করার জন্য হোটেল থেকে নদী তীরে বাগানবাড়িতে নিয়ে আসেন।

অনুষ্ঠান মঞ্চে অতিথিদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন আইজিসিসি পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী

এরপর এই দুই লেখকের সম্পর্ক গভীর আত্মিক সম্পর্কে পর্যবসিত হয়। কবি তাঁকে বিজয়া বলে সম্বোধন করতেন। কবির বিভিন্ন গানেও ভিক্টোরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে। তাকে উৎসর্গ করেন কাব্যগ্রন্থ ‘পূরবী’। রবীন্দ্রনাথকে চিত্রকর্মে প্রাণিত করেন ওকাম্পো। ব্যবস্থা করেন প্রদর্শনীরও। দুই কালজয়ী সাহিত্যিকের মাঝে যেসব পত্র বিনিময় হয় তা সাহিত্যের চিরকালীন সম্পদে পরিণত হয়েছে।

;

বর্ষবিদায় - বর্ষবরণ

  ‘এসো হে বৈশাখ’



প্রদীপ কুমার দত্ত
মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

আবারও বছর ঘুরে এসেছে বৈশাখের পয়লা দিন। আমাদের জাতীয় উৎসব নববর্ষ। গত বেশ কয়েক বছর ধরে দেখতে পাই এই উৎসব নিকটবর্তী হলেই মঙ্গল,আনন্দ,আশার প্রতীক দিনটিকে বিতর্কিত করে একে বানচাল করার এক অশুভ প্রচেষ্টা দানা বাঁধানোর উদ্দেশ্যে একশ্রেণির লোক মাঠে নামে। পহেলা বৈশাখ উৎযাপন উপলক্ষে যে উৎসবমুখরতা, তা আমাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়,আমাদের কৃষ্টি সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এই জাতীয় নানা বিষয়ের অবতারণা করে দিনটিকে বিতর্কিত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।

বিতার্কিকদের মধ্যে কেউ কেউ আবার এর মধ্যে ধর্মাচরণকেও টেনে আনেন। গত বছর তো আইনগত ব্যবস্থা নেয়াও শুরু হয়েছিল। সেই প্রচেষ্টা অবশ্য হালে পানি পায় নি। এবারেও দন্ত-নখর বের করা শুরু করেছিল আমাদের বাংলার আদি সংস্কৃতির বিরোধীরা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয় সরকার ক্ষমতায় থাকায় অংকুরেই সেই চেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়ে থেমে গেছে। অবশ্য সরকার উভয়পক্ষকে খুশি রাখার চেষ্টা করে উৎসব পালনের সময়সীমা সংক্ষিপ্ত করে নির্দেশনা জারি করেছেন। এই রকম আপোষ করে সেই কুৎসিত শক্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তোলা হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা সরকারের উপযুক্ত মহলের উচিৎ।

উৎসব পালনের কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। সময়ের সাথে সাথে এবং অঞ্চলভেদে বিভিন্ন অনুষঙ্গ ও ধরন পাল্টায়। সংস্কৃতি ও কৃষ্টি গতিশীল। সমাজে গ্রহণযোগ্য এবং শালীনতার মাত্রা অতিক্রম না করা আনন্দে মেতে ওঠার বিভিন্ন কার্যক্রমের সমষ্টিই উৎসব। আদিকাল থেকেই বৈশাখী মেলা, হালখাতা, চৈত্র সংক্রান্তি, গাজন, নীলপূজা, চড়ক, বিভিন্ন প্রকৃতির লোকজ সংস্কৃতির ও খেলাধুলার আয়োজন,সাধ্যমত নতুন পোষাক ও ভালো খাবারের আয়োজন,অতিথি আপ্যায়ন, ইত্যাদি নিয়ে বাঙ্গালীরা পুরাতন বর্ষ বিদায় ও নববর্ষের আগমনকে একটি উৎসবের রূপ দিয়ে আসছে।

কালক্রমে বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে বাংলা সংস্কৃতির উপর পাক সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন কতৃপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার অংশ হিসাবে ছায়ানট রমনা বটমূলের বর্ষবরণ উৎসব আয়োজন শুরু করে। সেই আয়োজন আজ ডালপালা বিস্তার করে সারা দেশে এমনকি দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিহাস স্বাক্ষী, মৌলবাদের কালো থাবা সেই আয়োজন থামিয়ে দিতে রমনা বটমূলের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে নিরীহ সংস্কৃতি প্রেমীদের হত্যা করেও সফল হয়নি।২০০১ সালের সেই হামলার পর নিরীহ বাঙ্গালী গর্জে উঠে ২০০২ সালে আরও অধিক সংখ্যায় রমনায় হাজির হয়েছে। দেশের শহর ও গ্রামের দিকে দিকে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আরও ব্যপ্তি লাভ করেছে।

ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট বিগত শতাব্দীর আশির দশকে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু করে। এই আনন্দ উৎসব পরবর্তীতে মঙ্গল শোভাযাত্রার রূপ ধারণ করে। এই সফল আয়োজন ইতোমধ্যে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভ করেছে। আনন্দ প্রকাশের এই বহিঃপ্রকাশ নিয়ে এক শ্রেণির লোকের প্রচন্ড গাত্রদাহ রয়েছে।ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে তারা এই শোভাযাত্রা বন্ধ করতে চায়।দেশের প্রাগ্রসর প্রগতিশীল নাগরিকরা এই জাতীয় অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে চায় না। মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান সহ বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের সকল আয়োজন দিন দিন আরও সবল,সতেজ ও পরিশীলিতভাবে অগ্রসর হবেই।

বৈশাখী উৎসবের বিরোধিতাকারী কূপমণ্ডূকদের অনেকের জানাই নেই যে এই উৎসব একই সময়ে দুই একদিন আগে বা পরে বহু জায়গায় বিভিন্ন নামে পালিত হয়। আমাদের নববর্ষ, আসামে বিহু,পাণ্জাবে বৈসাখ,থাইল্যান্ডে সাংক্রান,বার্মায় থিংইয়ান,নেপাল ও সংলগ্ন উত্তর ভারতে বিক্রম সম্ভত,কম্বোডিয়ায় চউল চ্নাম থিমে, সিংহলে আলুথ অনুরুদ্ধা, লাওসে বা পি মেই, কেরালায় ভিষু, তামিলনাড়ুতে পুথান্ডু, এই সব উৎসবই দক্ষিণ /দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রাচীণ কাল থেকে চলে আসা বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ। অনেক এলাকায়,এমনকি আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামেও ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল বা একে অপরের শরীরে পানি ছিটানো এই উৎসবের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। জল শুচি,পবিত্রতা ও শুভ্রতার প্রতীক। পুরনো বছরের ভুল, অসাফল্য, গ্লাণি সব ধুয়ে নতুন বছর আরও উন্নততর জীবনযাত্রায় এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক এই জল ক্রীড়া।

যে সকল অন্ধকারের শক্তি এই বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ উৎসবকে হিন্দুয়ানীর সাথে সম্পর্কিত অনুষ্ঠান বলে প্রচার করেন তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে সনাতনী ধর্মাচার ও সামাজিক আচার কিছু এই সময়ে অবশ্যই থাকে। সেগুলো সবই তাঁরা পালন করেন পণ্জিকা অনুযায়ী। সেই পঞ্জিকার সনাতনী ধর্মের পূজা বা উৎসব সমূহ নির্ধারিত হয় বিক্রম সম্ভত বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চন্দ্র/সূর্য/নক্ষত্র এর অবস্থান সমন্বয় করে বিভিন্ন মাস ২৯,৩০,৩১ এমনকি ৩২ দিনেও হয়।

সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী পহেলা বৈশাখ বেশির ভাগ বছর ১৫ এপ্রিল তারিখে হয়ে থাকে।লিপ ইয়ার সেই বর্ষপণ্জিতে না থাকার কারনে মোটামুটি চার বছরে একবার এটি ১৪ এপ্রিলে হয়। বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের জন্য বহু বছর গবেষণার পর বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে নিজস্ব বর্ষপঞ্জি চালু করেছে। সেই বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে প্রায় বছরই বাংলাদেশের সনাতনী সম্প্রদায় নববর্ষের দিন (১৪ এপ্রিল) তাঁদের সামাজিক/ধর্মীয় চৈত্র সংক্রান্তির পালনীয় ক্রিয়াকর্ম নিজেদের ঘরে পালন করেন।কিন্তু পহেলা বৈশাখের নববর্ষের সকল উৎসব ও কর্মকাণ্ডে আপামর দেশবাসীর সাথে সানন্দে অংশগ্রহণ করে থাকেন। একই কথা তাঁদের অন্য সকল পূজা পার্বণের বেলায়ও খাটে।


আমাদের পার্বত্য এলাকায় এই নববর্ষ পালন হয় জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে। এই অঞ্চলে বহু বাঙ্গালী তো আছেনই। কিন্তু বৃহৎ সংখ্যায় থাকেন ১৪টি বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মানুষ। নৃতাত্ত্বিক,সাংস্কৃতিক,ভাষাগত এবং বিভিন্ন ভাবে তাঁরা সমতলের বাঙ্গালীদের চাইতে তো বটেই, এমনকি একে অপরের চাইতেও আলাদা। এই বিভিন্নতা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এই সৌন্দর্যের নামই বহুল প্রচলিত শব্দবন্ধ ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি বা বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্য।

এখানকার বম,খিয়াং,লুসাই,পাঙ্খোয়া ও খুমিরা বৃহত্তর সংখ্যায় খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী। তাঁদের বড় উৎসব বড়দিন(ক্রিসমাস)।বকি সকলের জন্য তিন দিন ব্যাপী বর্ষবিদায় /বর্ষবরণ উৎসবই বছরের সেরা পার্বণ। এই সময় সব পাহাড় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে উৎযাপনে।যোগ দেন তাঁদের খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী অন্যান্য জাতিসত্ত্বার প্রতিবেশীরা এবং পাহাড়ে থাকা বাঙ্গালীরা। আমোদে অংশ নিতে দেখা যায় সমতল থেকে এই উপলক্ষে ছুটে আসা পর্যটকদেরও।

তাঁদের উৎসব আনন্দ উৎযাপনের মধ্যে অনেক উপাদান। মঙ্গল শোভাযাত্রার আলোকে র‍্যালী হয় সবাইকে নিয়ে।আয়োজনে থাকে প্রশাসন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। হয় বিচিত্রানুষ্ঠান। খাওয়া দাওয়ার আয়োজন সকলে করেন সাধ্যানুযায়ী উঁচুমানের। তার মধ্যে বিশেষ একটি আয়োজন হল বিভিন্ন তরিতরকারির মিশ্রণে পাঁজন বা লাবড়া। কে কত পদের তরকারি/শাক/ওষধি দিয়ে পাঁজন রেঁধেছেন তার চলে অঘোষিত প্রতিযোগিতা। ক্ষেত্র বিশেষে এই সংখ্যা পণ্চাশ ছাড়িয়ে যায় বলে শুনেছি।


উৎসবমালা শুরু হয় দেবতা ও প্রয়াতঃ পূর্বপুরুষদের স্মৃতিতে পাহাড়ি ঝরণা বা নদীতে ফুল ও প্রদীপ ভাসিয়ে। নতুন কাপড় পরিধান নতুন বছরের আগমনকে স্বাগত জানানোর প্রতীক।মন্দিরে চলে মহামতি বুদ্ধদেবের আরাধনা আগত বছরে সকলের মঙ্গল কামনায়। অনেক বড় মন্দিরে বহু লোক সমাগম হয় প্রথম দিন রাতে।সারা রাত উৎসবমুখর পরিবেশে পিঠা তৈরিতে সবাই হাত লাগায়। প্রত্যুষে সেই পিঠা দেবতাকে নিবেদন করা হয়। প্রথম দিন বহু মন্দিরের বুদ্ধ মূর্তি বাদ্য সহযোগে আনন্দ মিছিল করে নিয়ে যাওয়া হয় নিকটবর্তী নদীর পানিতে স্নান করানোর জন্য।

পাহাড়ে নববর্ষের সবচাইতে বড় আকর্ষণ সাংগ্রাইং জলক্রীড়ার কথা আগে উল্লিখিত হয়েছে। এছাড়াও থাকে পিঠা তৈরির প্রতিযোগিতা, কুস্তি,তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার প্রতিযোগিতা, ইত্যাদি। সৌহার্দ্য বাড়াতে একে অপরের বাড়িতে যাওয়া,দলবদ্ধ ভাবে পান ভোজনের ব্যবস্থা করাও এই তিন দিনের কার্যক্রমের বিশেষ একটি দিক। চাকমারা বিজু, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বৈসুক,মারমারা সাংগ্রাইং, ম্রো জনগণ চাক্রান নামে এই উৎসবকে অভিহিত করেন। তণ্চঙ্গাদের কাছে বিষু,অসমীয়া সম্প্রদায়ের কাছে বিহু নামে পরিচিতি এই উৎসবের।

নামে কি বা আসে যায়। যে যেই নামেই জানুক এই উৎসব আমাদের লোকজ সংস্কৃতির একটি প্রাণের উৎসব। বাঙ্গালী ক্ষুদ্রতর নৃগোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাই যার যার পছন্দ ও সাধ্য অনুযায়ী উৎসব পালন করবেন এটাই স্বাভাবিক। কারো যদি পছন্দ না হয় তিনি উৎসব পালনে বিরত থাকতেই পারেন। সেটা তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতা। কিন্তু অন্যের উৎযাপনে বাধা সৃষ্টি করার অধিকার কারও নেই।

প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা এই নববর্ষের সাথে সাথে হিজরি সাল;চন্দ্র,সূর্য, নক্ষত্র মন্ডলীর অবস্থান;ফসল তোলা;খাজনা পরিশোধ; ইত্যাদি বিষয়ের সমণ্বয় করে জ্যোতির্বিদ ফতেহউল্লাহ্ সিরাজী ও রাজা টোডরমলের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বাদশাহ আকবর চালু করেন আমাদের বর্তমানে চলিত বাংলা বর্ষপঞ্জি। সেই বর্ষপঞ্জির ১৪৩১ সাল সমাগত।

আসুন আমরা ১৪৩০ কে বিদায় জানিয়ে আবাহন করে নেই ১৪৩১কে। দেশবাসী ও বিশ্ববাসী সকলকে জানাই নববর্ষের শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি সকলের। কামনা করি ক্ষুধা মুক্ত,বণ্চনা মুক্ত, প্রতারণা মুক্ত, ব্যথা মুক্ত ও যুদ্ধ মুক্ত পৃথিবী। কল্যাণ হোক সকলের।সুখী ও সমৃদ্ধ হোন সবাই।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;