উত্তর-উপনিবেশবাদ ও বাংলাদেশের সাহিত্য : একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা



মাসুদুজ্জামান
অলঙ্করণ: কাজী যুবাইর মাহমুদ

অলঙ্করণ: কাজী যুবাইর মাহমুদ

  • Font increase
  • Font Decrease

১. উত্তর-উপনিবেশবাদ ও বাংলাদেশ
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ। পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশের মতো দীর্ঘকাল ঔপনিবেশিক শাসকদের দ্বারা শাসিত হওয়ার পর একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে অভ্যুদয় ঘটে এর। ঔপনিবেশিক পরিস্থিতিতে অন্যান্য অনেককিছুর মতো সাহিত্য যে বৈশিষ্ট্য অর্জন করে, স্বাধীনতার পর তা অনেকটাই বদলে যায়। একটি সদ্যস্বাধীন দেশের সাহিত্য উপনিবেশের চিহ্ন যেমন তার শরীরে ধারণ করতে বাধ্য হয়, তেমনি উত্তর-ঔপনিবেশিক পরিবেশ পরিস্থিতির দ্বারাও প্রভাবিত হয়। সেজন্যেই দেখা যায়, আধুনিক কালের উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলির সাহিত্যে তার নিজস্ব এমন কিছু লক্ষণ ফুটে ওঠে, যেসব লক্ষণ অন্যান্য রাষ্ট্রের সাহিত্য থেকে আলাদা। বাংলাদেশের সাহিত্যের ওই সব বৈশিষ্ট্য কমবেশি লক্ষ করা যাবে। এদিক থেকে বিবেচনা করলে বাংলাদেশের সাহিত্য বলে আমরা যে সাহিত্যের উল্লেখ করে থাকি, তা অনেকটাই রাজনীতিস্পৃষ্ট। তবে সরলরেখায় নয়, উত্তর-ঔপনিবেশিক বাংলাদেশের রাজনীতি যেমন আঁকাবাকা পথে অগ্রসর হয়েছে, বাংলাদেশের সাহিত্যের গতিপ্রকৃতিও তেমনি বিসর্পিল। উপনিবেশ-উত্তর সাহিত্যের এই লক্ষণগুলি সনাক্ত করতে হলে বাংলাদেশের রাজনীতির একটা রূপরেখা তুলে ধরা জরুরি বলে মনে করি।

একথা আমাদের আজ আর অজানা নেই যে দু-দুটো উপনিবেশের অধীন ছিল বাংলাদেশ; প্রথমে ব্রিটিশদের, পরে পাকিস্তানিদের। দীর্ঘদিন ধরে উপনিবেশের অধীনে থাকলে যেমন হয় বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটাই ঘটেছে। স্বাধীনতার পর অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক এবং জীবনযাপনের নানা ক্ষেত্রে যেমন নৈরাজ্য ও বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে, তেমনি এসব নৈরাজ্য কাটিয়ে এ-দেশকে আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করতে হচ্ছে। লড়তে হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক আত্মস্বাতন্ত্র্য এবং উন্নত জীবনমান অর্জনের জন্যে। এ সংগ্রাম যে খুব সহজে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে, তা বলা যাবে না। কোনো কোনো সময়ে বিরোধের মাত্রাটি বেশ জটিল ও সংঘাতময় ছিল। তবে এতসব জটিলতার মধ্যেও বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে অর্জন করেছে অভূতপূর্ব সাফল্য। আগামী পাঁচ থেকে সাত বছরের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের ভবিষ্যতবাণী হিসেবে ‘মধ্য-আয়ে’র দেশে পরিণত হবে আর তার পরের ধাপেই পৌঁছে যাবে উন্নত দশেরে সারিতে।

তবে এখন বিশ্বব্যাপী কোভিদ-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত সমস্ত পৃথিবী। বাংলাদেশেও এই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে জীবনযাত্রা যেমন থমকে গেছে, তেমনি এর প্রভাবও অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে। এ থেকে মুক্তি কিভাবে ঘটবে, সাম্প্রতিক দুর্যোগ কেটে গেলেই কেবল সেটা বোঝা যাবে। তবে আমাদের জীবনযাপন যে বদলে যাবে, অর্থনীতি যে নতুন রূপ পাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তো, এটা তো ভবিষ্যতের ব্যাপার। আমি না হয়, স্বাধীনতার পর আমাদের সাহিত্য কীরকম চেহারা পেয়েছে তাই নিয়ে কথা বলি।

২. উত্তর-উপনিবেশবাদী বাংলাদেশ ও মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব
আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে তারা জানেন, উপনিবেশের অধীনে থাকার সময়ই কখনো কখনো রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে সংঘাতের বীজ প্রোথিত হয়ে যায়। ঔপনিবেশিক শাসকদের সঙ্গে সংগ্রাম করবার সময় সেই শাসকদের বিরুদ্ধে দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম করলেও স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক চরিত্র কী দাঁড়াবে, তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রাম করবার সময় যদি সেই শাসকগোষ্ঠীকে কেউ মিত্র মনে করে সমর্থন করে থাকে, তাহলে স্বাধীনতা অর্জনের পর মুক্তস্বাধীন ওই জাতিরাষ্ট্রের মধ্যে রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হতে বাধ্য। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ঠিক এই ব্যাপারটিই লক্ষ করেছি আমরা।

স্বাধীনতার সময় যারা ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসকদের সমর্থন করেছে, বা যারা তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল, তারা স্বাধীনতার পর মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নৈরাজ্য তৈরি করে। এটা অবশ্য একদিনে করা হয়নি, ধীরে ধীরে করা হয়েছে। এই গোষ্ঠী মতাদর্শিকভাবে পূর্বের অবস্থানে স্থির থেকে একদিকে যেমন রাজনৈতিকভাবে নিজেদের সুসংহত করেছে, অন্যদিকে তেমনি সমভাবাপন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিজেদের প্রভাববলয় বাড়িয়ে নিয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামে যে-দল (বা দলগুলি) নেতৃত্ব দিয়েছিল, তাদের নানা ভুলের সুযোগও তারা নিয়েছে। অবস্থা তখন এমন দাঁড়িয়েছিল যে, স্বাধীনতা-বিরোধী ওই গোষ্ঠী অনেক দিন বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতে পেরেছে, অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়েছে। বিভ্রান্তিকর মতাদর্শের জাল বিস্তার করে তারা তরুণ-সমাজকে ভুল পথে চালিত করতে পেরেছে।

ফলে স্বাধীনতার পর স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের শাসনকাঠামো কী হওয়া বাঞ্ছনীয়, তার সাংস্কৃতিক চারিত্র্য কী হওয়া জরুরি—এসব প্রশ্নে দেখা দিয়েছে দ্বিধাবিভক্তি। এরকম একটা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সাহিত্য যে একধরনের ঘূর্ণাবর্তে পড়ে জটিল হয়ে উঠবে, এটাই স্বাভাবিক। বাস্তবে হয়েছেও তাই। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে, বাংলাদেশের লেখকেরা এই ধরনের বিভ্রান্তিকর মতাদর্শের চোরাবালিতে পা দেননি। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়, বেশিরভাগ লেখকই—তাঁরা যে-দেশেরই হোন না কেন, যে-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট থেকে উঠে আসুন না কেন—সত্যনিষ্ঠ হয়ে থাকেন। নিঃসন্দেহে দেশ, সমাজ ও মানুষের প্রতি তাদের একধরনের কমিটমেন্ট থাকে।

৩. বৈদেশিক নির্ভরতা, আমলাতন্ত্র, সামরিকতন্ত্র ও বাংলাদেশ
আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে সমকালীন বাংলাদেশ নানা জটিল ও বিচিত্র পথ ধরে অগ্রসর হচ্ছিল। আর্থসামাজিকভাবে সবাই একমত যে, দেশটি একশ্রেণীর লুটেরা পেশাজীবীর স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছিল। আমলাতন্ত্র, সামরিকতন্ত্রের কবলে পড়ে দেশটির অর্থনীতি প্রায় মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। বিভিন্ন ট্রান্সন্যাশনাল কোম্পানি এবং যেসব ধনী দেশ তাদের মুনাফার সবচেয়ে বড় অংশ ভোগ করে, বাংলাদেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলি ছিল তাদের আগ্রাসী থাবার নিচে। আমাদের সনাতন চাষাবাদ পদ্ধতি, স্বাস্থ্য ইত্যাদিকে তারা তাদের পেস্টিসাইড বা জন্ময়িন্ত্রণের নানা উপকরণ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করেছে। সংস্কারের নামে বিশ্বব্যাংক ও বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা সার্বক্ষণিকভাবে চাপের মধ্যে রেখেছে এই দেশটিকে। আমাদের নিজস্ব গণমাধ্যমের দুর্বলতার সুযোগে বিদেশি স্যাটেলাইট টিভির চোরাস্রোতের টানে বিপন্ন হয়ে পড়েছে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি। এভাবে একদিকে বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা, সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ, অন্যদিকে দেশীয় ক্ষমতাবান লুটেরা শ্রেণির শাসনশোষণ বাংলাদেশকে সবদিক থেকে বিপর্যস্ত করে ফেলে।

সামাজিক অস্থিরতা, সাংস্কৃতিক টানাপোড়েন এবং অর্থনৈতিক অব্যবস্থার পাশপাশি রাজনীতিতেও দেখা গেছে চরম নৈরাজ্য। উপনিবেশ-উত্তর রাষ্ট্রগুলির শাসনব্যবস্থায় একধরনের প্রহসনের পুনরাবৃত্তি দেখা যায়। এরকম পরিস্থিতিতে ঔপনিবেশিক শক্তির কবল থেকে তারা মুক্তি পেয়ে হঠাৎ করেই প্রবেশ করে আধুনিক ইউরোপীয় উদারনৈতিক রাষ্ট্রব্যবস্থায়, যার মূলমন্ত্র হচ্ছে গণতন্ত্র। কিন্তু এই গণতন্ত্রকে হজম করার বা জারিত করে নেওয়ার প্রস্তুতি ও শক্তি তার থাকে না। ফলে গণতন্ত্র পদে পদে বাধাগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটাই ঘটেছে। পাকিস্তানি শাসনের কবল থেকে মুক্তি পেয়ে বাংলাদেশ গণতন্ত্র, সামাজিক সাম্য, মানবিকতা, ধর্মনিরপেক্ষতার উদার ক্ষেত্রে প্রবেশ করবে এটাই ছিল প্রত্যাশিত। আমাদের পূর্বসূরিরা সেই পথেই এগোচ্ছিলেন। বাংলাদেশের প্রথম অসংশোধিত সংবিধানে তার প্রমাণ মিলবে। কিন্তু তারপর? সামরিকতন্ত্রের কবলে পড়ে ছিন্নভিন্ন হলো গণতন্ত্র। পুনরুত্থান ঘটলো ধর্মের, স্বৈরতন্ত্রের, সাম্প্রদায়িকতার। জনরোষের ফুৎকারে সামরিক শাসকগোষ্ঠী বিতাড়িত হলেও অসাম্প্রদায়িকতা ও সামাজিক সাম্যের প্রতিষ্ঠা ঘটতে বিলম্ব হলো। সাংবিধানিকভাবে গণতন্ত্র এলেও মানবিকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিস্থাপিত হলো না। তবে সাংবিধানিকভাবে ধর্মকে এখন প্রত্যক্ষভাবে ব্যবহার করা হয় না। ফলে, বাংলাদেশের আধুনিক উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা এখনও মসৃণ নয়। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী—যারা আমাদের ঋণ দেয়—তারা বিরূপ হবে বলে এ-পথে অগ্রসর হওয়াটাকে নিরাপদ মনে করা হয় না। আশার কথা, বাংলাদেশ এই বিদেশ-নির্ভরতা ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠছে। তবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামো ও শাসনকাঠামোর প্রায় প্রতিটি স্তরে ধর্মের যে প্রচ্ছন্ন ব্যবহার ঘটেছে, সেটা অস্বীকার করবার উপায় নেই। বিপুল জনসংখ্যার কারণে বাঙালিরা আবার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ওপর আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে। দেশের প্রায় এক-চতুর্থাংশ মানুষ এখনো দারিদ্রসীমার নিচে। যদিও গত দেড় দশকে দারিদ্র্য দূরীকরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। ফলে, জনজীবনেও স্বস্তি নেই। সন্ত্রাস, নারী নির্যাতন আর দুর্নীতিতে বাংলাদেশ জর্জরিত। সাম্প্রদায়িকতামুক্ত রাষ্ট্রের স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেছে। এই অবস্থা থেকে বাংলাদেশের মানুষকে মুক্তি দিতে হলে জনকল্যাণমুখী পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে হবে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঋদ্ধ, সেই পথেই এগুচ্ছে। উন্নয়নের দৃশ্যমান ছোঁয়া লেগেছে। উন্নয়নের অনেকগুলি মেগাপ্রজেক্ট নিয়ে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। মুজিববর্ষে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আরো গতি পেয়েছে। বর্তমান সরকার যে উন্নয়নের সরকার, সেকথা বলাই যায়। সার্বিকভাবে এরকম পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সাহিত্য যে নানা দিক থেকে বহুবর্ণিল হয়ে উঠবে তা বলাই বাহুল্য।

৪. স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের সাহিত্য
স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশের সাহিত্য অনেকটা সরলরেখার অগ্রসর হচ্ছিল। নিরুদ্বিগ্ন নাগরিক জীবন কিংবা নিস্তরঙ্গ সরল গ্রামীণ জীবনই তাতে উপজীব্য হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সাহিত্য হয়ে উঠেছে জটিল, বহুমাত্রিক, সর্বোপরি বৈশ্বিক নানা অনুষঙ্গে বিজড়িত। কী প্রসঙ্গ, কী প্রকরণ—সবদিক থেকেই স্বাধীনতাপূর্ব সাহিত্যের সঙ্গে ঘটে গেছে স্বাধীনতা-পরবর্তী সাহিত্যের পার্থক্য। উল্লিখিত আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের প্রায় সবটাই উঠে এসেছে আমাদের কথাসাহিত্যে, কবিতায় কিংবা নাটকে। বাংলাদেশের সাহিত্যের গভীরে প্রবেশ করলেই এর মূল প্রবণতাগুলি সনাক্ত করা যাবে। এই লেখাটি সেই লক্ষ্যেই, অর্থাৎ স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি কী দাঁড়িয়েছে তারই সংক্ষিপ্ত রূপরেখা বলা যেতে পারে।

স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের সাহিত্যের প্রধান বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধ। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে জায়মান হয়ে ওঠে একটি জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের ত্যাগ-তিতিক্ষা আর সংগ্রামের মূল ঘটনাটি যে সাহিত্যে প্রাধান্য পাবে, সেকথা বুঝতে কোনো অসুবিধে হয় না। মুক্তিযুদ্ধের বীজ অবশ্য স্বাধীনতার ঠিক পরে নয় অনেক আগেই ভাষা আন্দোলনের সূত্রে বাংলাদেশের সাহিত্যে প্রোথিত হয়ে গিয়েছিল। আইয়ুবি আমলে তা বাংলাদেশের সাহিত্যে অনুসূক্ষ্মভাবে অন্তঃশীল ছিল। ঊনসত্তরে এসে এই প্রবণতাটি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়ে গেলে প্রায় সব লেখকেরই—অবশ্য যারা তখন লেখালেখি করতে পেরেছেন—মুক্তিযুদ্ধ তাদের রচনার প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে। স্বাধীনতার পরে মুক্ত স্বদেশে তাই অনেককেই দেখা গেল এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে গল্প, উপন্যাস বা কবিতা রচনা করতে।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কালজয়ী উপন্যাস ‘চিলেকোঠার সেপাই’তে উপজীব্য হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার উজ্জ্বল পটভূমি—উন্মাতাল ঊনসত্তর। বন্দী সময়ের তমসাচ্ছন্ন পরিবেশে মানুষ যে কিভাবে মুক্তির প্রত্যাশী হয়ে উঠতে পারে, ইলিয়াস তারই এপিক রূপায়ণ ঘটালেন এই উপন্যাসে। আনোয়ার পাশার ‘রাইফেল রোটি আওরাতে’ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী যে-নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল, পাওয়া গেল তারই আত্মজৈবনিক রূপ। মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে সবচেয়ে বেশি সফল উপন্যাস লিখলেন শওকত ওসমান—‘জাহান্নাম হইতে বিদায়’, ‘দুই সৈনিক’, ‘নেকড়ে অরণ্য’ এবং ‘জলাঙ্গী’। এই ধরনের উপন্যাস রচনায় সৈয়দ শামসুল হকের সাফল্যও কম নয়। তার ‘নীল দংশন’, ‘নিষিদ্ধ লোবান’, ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’, ‘অন্তর্গত’, ‘এক যুবকের ছায়াপথ’ ইত্যাদি উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে উপজীব্য করা হয়েছে। উপনিবেশ-উত্তর বাংলাদেশে জাতিরাষ্ট্রের রূপরেখাটি সৈয়দ হকের উপন্যাসে সাফল্যের সঙ্গেই উৎকীর্ণ হয়েছে বলতে পারি।

মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে গত দু-তিন দশকে আরো যেসব উপন্যাস লেখা হয়েছে সেগুলি হচ্ছে রশীদ করীমের ‘আমার যত গ্লানি’, রাবেয়া খাতুনের ‘ফেরারী সূর্য’, আহমদ ছফার ‘ওঙ্কার’, রশীদ হায়দারের ‘খাঁচায়’ ও ‘অন্ধ কথামালা’, সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের ‘জীবনভর’, শওকত আলীর ‘যাত্রা’, সেলিনা হোসেনের ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’, মাহমুদুল হকের ‘জীবন আমার বোন’, মিরজা আবদুল হাইয়ের ‘ফিরে চলো’, হুমায়ুন আহমেদের ‘শ্যামল ছায়া’, হারুন হাবীবের ‘প্রিয়যোদ্ধা, প্রিয়তম’, রিজিয়া রহমানের ‘একটি ফুলের জন্য’, শহীদুল জহিরের ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ ও ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ ইত্যাদি।

ছোটগল্প বাংলাদেশের সাহিত্যের একটি সমৃদ্ধ শাখা। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা হয়েছে বেশকিছু উল্লেখযোগ্য ছোটগল্প। শওকত ওসমানের ‘বারুদের গন্ধ লোবানের ধোঁয়া’, ‘দুই ব্রিগেডিয়ার’, শহীদ আখন্দের ‘ভিতরের মানুষ’, বশীর আল হেলালের ‘সেবিকা’, রশীদ হায়দারের ‘এ কোন ঠিকানা’, হাসান আজিজুল হকের ‘ঘরগেরস্থি ও ফেরা’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোঁয়ারি’, সেলিনা হোসেনের ‘ঘৃণা’ ইত্যাদি গল্পেও মুক্তিযুদ্ধকালীন অবরুদ্ধ ও সংগ্রামমুখর বাংলাদেশের ছবি অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় ও ভঙ্গিতে উপস্থিাপিত হয়েছে।

বাংলাদেশের কবিতাতেও লক্ষ করা যাবে মুক্তিযুদ্ধের বহুমাত্রিক বিস্ময়কর প্রকাশ। বাঙালি জাতির সত্তাতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের ইতিবৃত্তটি কবিতাতেই সবচেয়ে সফলভাবে ধরা পড়েছে। আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, সিকান্দার আবু জাফর, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, রফিক আজাদ, আবদুল মান্নান সৈয়দের মতো কবিরা তো বটেই, স্বাধীনতার অব্যবহিত পূর্বে ষাটের দশকের শেষ দিকে যেসব কবির আবির্ভাব ঘটলো—হুমায়ুন কবির, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, হুমায়ুন আজাদ, আবুল হাসান, মাহবুব সাদিক, সাযযাদ কাদির প্রমুখের কবিতা মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ নিয়ে রচিত হতে থাকল। তবে স্বাধীনতার পর সত্তর দশকে যেসব কবির আবির্ভাব ঘটল, সব কবির কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ যেন পেল বহুমাত্রকি রূপ। যেসব কবির রচনায় মুক্তিযুদ্ধ নানাভাবে উপজীব্য হয়েছে তাদের কয়েকজন হচ্ছেন মাশুক চৌধুরী, আবিদ আজাদ, দাউদ হায়দার, মাসুদুজ্জামান, শিহাব সরকার, মাহবুব হাসান, মুজিবুল হক কবির, ফারুক মাহমুদ, জাহিদ হায়দার, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লা, কামাল চৌধুরী। তবে গতশতকের আশির দশক থেকে শুরু করে এই শতকের দ্বিতীয় দশকে পৌঁছে দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশের কবিতা পূর্বতন কবিদের হাতে তো বটেই তরুণতরদের হাতে আরো নানামাত্রায় নানা অনুষঙ্গে উদ্ভাসিত। এই সময়ে যেসব তরুণ কবি বাংলাদেশের কবিতাকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করে চলেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন : ফরিদ কবির, খালেদ হোসাইন, আবু হাসান শাহরিয়ার, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, মাসুদ খান, খন্দকার আশরাফ হোসেন, মুজিব ইরম, সাজ্জাদ শরিফ, তসলিমা নাসরিন, সৈয়দ তারিক, টোকন ঠাকুর, মজনু শাহ, কামরুজ্জামান কামু, বায়তুল্লাহ কাদেরী, সরকার আমিন, মুজিব ইরম, ইমতিয়াজ মাহমুদ, জাহানার পারভীন, নওশাদ জামিল, পিয়াস মজিদ, বিজয় আহমেদ, মোস্তাক আহমাদ দীন, শামীম রেজা, ওবায়েদ আকাশ, আলতাফ শাহনেওয়াজ, রুহুল মাহফুজ জয়, তানিম কবির, হাসান রোবায়েত, মোস্তফা হামেদী, অরবিন্দ চক্রবর্তী, হিজল জোবায়ের, সৌম্য সালেক, তিথি আফরোজ, অনুপমা অপরাজিতা, রিমঝিম আহমেদ, রোজেন হাসান, নাহিদ ধ্রুব, সালেহীন শিপ্রা, নুসরাত নুসিন প্রমুখ।

তবে উপন্যাস ও কবিতার তুলনায়, অনেকের ধারণা, নাটকে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলন ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। আসলে আজ বাংলাদেশে গ্রুপ থিয়েটারের যে ব্যাপক চর্চা দেখা যাচ্ছে, কলকাতা থেকে প্রত্যাগত মুক্তিযোদ্ধারাই আমাদের নাট্যান্দোলনে সেই ধারণারই বাস্তব রূপায়ন ঘটিয়েছেন বলা যায়। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট নাট্যকার ও নাট্যকর্মী মামুনুর রশিদ বলেছেন, ‘যুদ্ধকালীন অবস্থায় অনেক নাট্যকর্মীর সুযোগ ঘটে কোলকাতার নাটক, নাট্যসংগঠন, নাট্যকার, অভিনেতা-অভিনেত্রী ও কুশলীদের সাথে পরিচিত হবার।... বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়নরত যেসব ছাত্র-ছাত্রীরা যুদ্ধে গিয়েছিল তারাও ফিরে এসে দ্রুত সংগঠিত করতে লাগল নাটককে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলিতে, ডাকসুতে, সর্বত্র একটা সাড়া পড়ে গেল।’ লক্ষ করলে দেখা যাবে, মুক্তিযুদ্ধের নাটকগুলির বেশিরভাগই আবেগনির্ভর, মননঋদ্ধ নয়। তবু এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে বেশকিছু কালোত্তীর্ণ নাটক। এসব নাটকের মধ্যে মমতাজউদ্দীন আহমদের ‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা’, ‘এবারে সংগ্রাম’ ও ‘বিবাহ ও কি চাহ শঙ্খচিল’, জিয়া হায়দারের ‘সাদা গোলাপে আগুন ও পঙ্কজ বিভাস’, সাঈদ আহমদের ‘প্রতিদিন একদিন’, রণেশ দাশগুপ্তের ‘ফেরী আসছে’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ উল্লেখযোগ্য। সেলিম আল দীন, মামুনুর রশিদ, আবদুল্লাহ আল মামুন প্রমুখ নাট্যকারও মুক্তিযুদ্ধকে তাদের নাটকে উপজীব্য করেছেন বিভিন্ন সময়ে। বাংলাদেশের গ্রুপথিয়েটার আন্দোলনকে তাই বলা যায় মুক্তিযুদ্ধেরই প্রত্যক্ষ অবদান।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সাহিত্যের আর একটি উল্লেখযোগ্য প্রবণতা লক্ষ করা যায় মধ্যবিত্তের জীবনযাপনের নানামাত্রিক উপস্থাপনে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাওয়া স্বাধীন দেশে মধ্যবিত্তের বিকাশ নানা কারণে রুদ্ধ হয়ে যাওয়ায় তার প্রকাশ হয়ে উঠেছে বহুমুখী ও জটিল। বৃহত্তর জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিমানসের আত্মযন্ত্রণা, আত্মরতি, রিরংসা, হতাশা ও ভোগবাদের চূড়ান্ত প্রতিফলন লক্ষ করা যাবে এই সময়ের বাংলাদেশের সাহিত্যে। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বিপর্যয়ের সংবেদনশীল অভিব্যক্তি হিসেবে এই বিষয়টি কথাসাহিত্যিকদেরতো বটেই কবিদেরও আন্দোলিত করেছে।

হুমায়ূন আহমদের ‘নন্দিত নরকে’, ‘শঙ্খনীল কারাগার’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘খেলারাম খেলে যা’, সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের ‘একজন’, রশীদ করীমের ‘প্রেম একটি লাল গোলাপ’ ও ‘সাধারণ লোকের কাহিনী’, রিজিয়া রহমানের ‘রক্তের অক্ষর’, শওকত আলীর ‘অপেক্ষা’, বশীর আল হেলালের ‘কালো ইলিশ’, হাসনাত আবদুল হাইয়ের ‘আমার আততায়ী’, সেলিনা হোসেনের ‘মগ্নচৈতন্যে শিস’ ও ‘পদশব্দ’, রাজিয়া খানের ‘চিত্রকাব্য’, শামসুর রাহমানের ‘অক্টোপাস’ ও ‘নিয়ত মন্তাজ’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘স্তব্ধতার অনুবাদ’ ইত্যাদি উপন্যাসে রিরংসায় আক্রান্ত আত্মকেন্দ্রিক ভঙ্গুর জীবন, বিচ্ছিন্নতা, হতাশা, বিনষ্টি, লুণ্ঠন, দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংকটের সামগ্রিক চিত্র উপজীব্য হয়েছে। সিরাজুল ইসলামের উপন্যাসগুলি কথাও এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।

ঝর্না রহমান, আহমাদ মোস্তফা কামাল, প্রশান্ত মৃধা, শাহীন আখতার, মোহিত কামাল, জাকির তালুকদার, স্বকৃত নোমান, মাহবুব আজীজ, খালিদ মারুফ, রাসেল রায়হান, মোস্তফা কামাল, মাসরুর আরেফিন, মাহবুব ময়ূখ রিশাদ, অদিতি ফাল্গুনী, পাপড়ি রহমান, হাবিব আনিসুর রহমান, আবুল কাসেম, তাশরিক-ই-হাবিব, হামিম কামাল, ইশরাত তানিয়া, নাসিমা আনিস, বর্ণালী সাহা, মোজাফ্ফর হোসেন, নিলুফা আক্তার, রিমঝিম আহমেদ এঁরাও সাম্প্রতিক কালে এই সময়ের উল্লেখযোগ্য ঔপন্যাসিক হিসেবে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছেন। ভিন্নধারার ঔপন্যাসিক হিসেবে সাদাত হোসাইন, আবদুল্লাহ আল ইমরান, কিঙ্কর আহসানও পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছেন।

এই সময়ের ছোটগল্পেও বিচিত্রভাবে সমকালীন জীবনের উপস্থিতি লক্ষ করা যাবে। বাংলাদেশের ছোটগল্পেও মূর্ত হয়েছে মধ্যবিত্তের জটিল ভঙ্গুর, আত্মকেন্দ্রিক কুণ্ডলায়িত জীবন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত আলী, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, কায়েস আহমেদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, রাহাত খান, রশীদ হায়দার, সিরাজুল ইসলাম, মঈনুল আহসান সাবের, সৈয়দ ইকবাল, নাসরীন জাহান, আবু সাঈদ জুবেরী, ইমতিয়ার শামীম, সেলিম মোরশেদ, পারভেজ হোসেন, আকিমুন রহমান, শাহনাজ মুন্নী, মামুন হুসাইন, শাহাদুজ্জামান, মোস্তফা কামাল, তাপস রায়, আশান উজ জামান, কিযী তাহ্নীন, আনিফ রুবেদ, প্রমুখের গল্পে এই জীবনের বহুমাত্রিক রূপ খুঁজে পাওয়া যাবে সহজেই।

অবশ্য শুধু কথাসাহিত্য নয়, এই সময়ের কবিতাতেও লক্ষ করা যাবে মধ্যবিত্তের জীবনযাপন ও মানসিকতার সার্বিক প্রতিচ্ছবি। শামসুর রাহমান এজন্যেই লিখতে পেরেছেন ‘আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি’, ‘শূন্যতায় তুমি শোকসভা’, ‘প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে’, ‘মাতাল ঋত্বিক’, ‘নায়কের ছায়া’, ‘এক ফোঁটা কেমন অনল’, হাসান হাফিজুর রহমান ‘শোকার্ত তরবারি’, ‘ভবিতব্যের বাণিজ্যতরী’, সৈয়দ শামসুল হক ‘অপর পুরুষ’, ‘রজ্জুপথে চলেছি’, ‘এক আশ্চর্য সংগমের স্মৃতি’, শহীদ কাদরী ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’, ‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই’, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ‘তৃতীয় তরঙ্গে’, ‘কোলাহলের পর’, ফজল শাহাবুদ্দীন ‘আততায়ী সূর্যাস্ত’, ‘অন্তরীক্ষে অরণ্য’, ‘আলোহীন অন্ধকারহীন’, নির্মলেন্দু গুণ ‘না প্রেমিক না বিপ্লবী’ ও ‘দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী’, আবুল হাসান ‘যে তুমি হরণ করো’ ও ‘পৃথক পালঙ্ক’, মহাদেব সাহা ‘এই গৃহ এই সন্ন্যাস’, ‘কী সুন্দর অন্ধ’, ‘একা হয়ে যাও’, সিকদার আমিনুল হক ‘বহুদিন উপেক্ষায় বহুদিন অন্ধকারে’, ‘এক রাত্রি এক ঋতু’, ‘কাফকার জামা’ ইত্যাদি কাব্যগ্রস্থ।

বাংলাদেশের সাহিত্যের আর একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এইসময়ে যে গ্রামজীবন ও আঞ্চলিক জীবনের ছবি আমাদের সাহিত্যে পাওয়া যায় পূর্বের তুলনায় তা অনেকটাই আলাদা। আগে লেখকেরা গ্রামকেন্দ্রিক প্রবহমান জীবনকে দেখেছেন অনেকটাই অনড় অচল নিস্তরঙ্গ হিসেবে। কিন্তু স্বাধীনতার পর এই গ্রামজীবনে যে চাঞ্চল্য দেখা গেল—স্বার্থান্বেষীদের হানাহানি, দ্বন্দ্ব আর রাজনৈতিক অস্থিরতার স্পর্শ লাগে, বাংলাদেশের লেখকেরা, বিশেষ করে কথাসাহিত্যিকেরা সেই ছবি চমৎকারভাবে তুলে এনেছেন তাদের লেখায়। সেইসঙ্গে ভুলে যাননি সাধারণ মানুষের প্রতিরোধের চিত্রটি আঁকতে। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠেছে যে-বিষয়টি তা হলো নিম্নবর্গের মানুষদের প্রতি সহমর্মিতা। গ্রামীণ কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা, ফতোয়াবাজি, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদিকে তারা উপজীব্য করছেনে তাদের লেখায়। সাধারণ ব্রাত্যজীবনকে পরম মমতার সঙ্গে উপন্যাসের বিষয় করে তুলেছেন। এ সংক্রান্ত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হচ্ছে সৈয়দ শামসুল হকের ‘দূরত্ব’, ‘মহাশূন্যে পরান মাস্টার’, ‘আয়না বিবির পালা’, হাসনাত আবদুল হাইয়ের ‘তিমি’, সেলিনা হোসেনের ‘জলোচ্ছ্বাস’, ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’, আবুবকর সিদ্দিকের ‘জলরাক্ষস’, ‘খরাদাহ’, হরিপদ দত্তর ‘ঈশানে অগ্নিদাহ’, ‘অন্ধকূপে জন্মোৎসব’, বশীর আল-হেলালের ‘শেষ পানপাত্র’, মুহম্মদ নূরুল হুদার ‘জন্মজাতি’ ও ‘মৈনপাহাড়’, ইমদাদুল হক মিলনের ‘ভূমিপুত্র’, ‘নূরজাহান’, ইমতিয়ার শামীদের ‘অন্ধ মেয়েটি জ্যোৎস্না দেখার পর’ ইত্যাদি। বাংলাদেশে ছোটগল্পেও গ্রামীণ জীবনের নানা টানাপোড়েনের ছবি পাওয়া যায়। হাসান আজিজুল হক (‘জীবন ঘষে আগুন’, ‘নামহীন গোত্রহীন’), শওকত আলী (‘লেলিহান সাধ’, ‘শুন হে লখিন্দর’), আবদুস শাকুর (‘ক্রাইসিস’, ‘সরস গল্প’), সেলিনা হোসেন (‘খোল করতাল’) এবং সাম্প্রতিককলের একঝাঁক তরুণ গল্পকার গ্রামজীবনকেই প্রধানত তাদের গল্পের কেন্দ্রবিন্দু করে তুলেছেন।

স্বাধীনতার পরে নতুন আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে আমাদের উপন্যাসে আরো বেশ কিছু অভিনব অথচ অনিবার্য বিষয় যুক্ত হয়। এর একটি হচ্ছে বেসরকারি সংস্থাগুলির (এনজিও) কর্মতৎপরতা গ্রামগুলিকে আন্দোলিত করার সঙ্গে সঙ্গে এই বিষয়টি আমাদের কথাসাহিত্যেও প্রতিফলিত হতে থাকে। প্রধানত নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতেই এজিওকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডকে উপন্যাসে তুলে এনেছেন আমাদের লেখকেরা। এ প্রসঙ্গে ইমতিয়ার শামীমের ‘ডানা কাটা হিমের ভেতর’ উপন্যাসের কথা উল্লেখ করা যায় বিশেষভাবে। শুধু এনজিও নয়, বিশ্বায়নের প্রভাবে আমাদের জনপদ ও জনজীবন যে আমূল বদলে যাচ্ছে, তাও তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। এ বিষয়টি উপজীব্য হয়েছে ইমতিয়ার শামীমের ‘গ্রামায়নের ইতিকথা’ উপন্যাসে। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পটভূমিতে ‘দ্যা নর্থ এন্ড’ নামে চমৎকার একটি উপন্যাস লিখেছেন বর্ণালী সাহা।

তবে এসব বিষয়কে ছাপিয়ে সাম্প্রতিকালে অন্য যে বিষয়টি কথাসাহিত্যিকদের, বিশেষ করে নারী লেখকদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে তা হচ্ছে নারী। নারীর জীবনযাপন, স্বপ্নকল্পনা, আশাআকাঙ্ক্ষা, পুরুষের আধিপত্য, নির্যাতন, নিপীড়নকেই নানা দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের লেখায় উপজীব্য করেছেন। সেলিনা হোসেনের ‘দ্বিপান্বিতা’, ‘মোহিনীর বিয়ে’, রাজিয়া খানের ‘হে মহাজীবন’, নাসরীন জাহানের ‘উরুক্কু’, ঝর্ণা রহমানের ‘অন্য এক অন্ধকার’, ‘ঘুম-মাছ ও একটুকরো নারী’, শাহীন আখতারের ‘পালাবার পথ নেই’, ‘বোনের সঙ্গে অমরলোকে’ শীর্ষক উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থে পাওয়া যাবে এই বহুমাত্রিক বিচিত্র জীবনের ছবি। তবে সেলিনা হোসেনের আগ্রহ যেখানে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নারীর অধস্তন অবস্থাকে নিরীক্ষণ করা, নাগরিক ও গ্রামীণ জীবনের জটিলতার মধ্যদিয়ে আবার চলতে থাকে শাহীন আখতারের উপন্যাস ও গল্পের চরিত্রগুলি। উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামো ও সামাজিক পরিস্থিতিতে নারীর জীবন যে কিভাবে বদলে যাচ্ছে, বদলে যাচ্ছে তার জীবনদৃষ্টি, উল্লিখিত নারী লেখকদের রচনা সেই দিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তবে পুরুষ লেখকেরাও যে নারীবিষয়ের প্রতি সহমর্মী হয়ে উঠতে পারেন, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে শক্তিশালী গল্পকার হাসান আজিজুল হকের ‘মা মেয়ের সংসার’-এ টুকরো টুকরো মর্মভেদী কাহিনী আর ‘আগুনপাখি’, ‘সাবিত্রী উপখ্যানে’র আখ্যানে।

মুক্তিযুদ্ধ, মধ্যবিত্তের জীবনযাপন বা নারীর অধস্তন অবস্থা আমাদের সাহিত্যের একটি বড় অংশ জুড়ে থাকলেও রাজনীতিই হচ্ছে বাংলাদেশের সাহিত্যের প্রধান প্রবণতা। এই বিষয়টির প্রতি আমাদের লেখকদের ঝোঁক যে দুর্মর, সেকথা বলা যায় নিঃসন্দেহে। একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যদিয়ে উপনিবেশের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর বিশ্বায়নের খপ্পরে পড়ার আশঙ্কা থেকেই লেখকদের মধ্যে তৈরি হয়েছে এই ঝোঁক। বৈশ্বিক রাজনীতির পাশাপাশি আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রটিও নানা মতাদর্শিক বিভ্রান্তি, সংঘাত ও হানাহানিতে পূর্ণ। একাত্তরে যেসব প্রসঙ্গের প্রায় মীমাংসা হয়ে গিয়েছিল, পাকিস্তানের প্রতি সহমর্মী রাজনীতিবিদ ও ভ্রান্ত বুদ্ধিজীবীরা আবার সেইসব প্রসঙ্গকেই রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছেন। ফলে, এদেশে সামরিক শাসনের আবির্ভাব ঘটেছে, পুনর্বাসিত হয়েছে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। কিন্তু লেখকেরা, আগেই যেমন বলেছি, সত্যনিষ্ঠ হওয়ার ফলে ইতিহাসকে বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। এরই প্রতিক্রিয়ায় লিখেছেন গল্প, উপন্যাস, কবিতা ও নাটক। সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ প্রতিরোধকে তারা তাদের লেখার বিষয়বস্তু করে তুলেছেন।

স্বাধীনতা পূর্বকাল ও পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক উত্থান-পতন ও প্রতিবাদ-প্রতিরোধের কাহিনী যেসব উপন্যাসে নানা আঙ্গিকে ধরা পড়েছে সেগুলি হচ্ছে শওকত ওসমানের ‘পতঙ্গ পিঞ্জর’, ‘আর্তনাদ’, সেলিনা হোসেনের ‘যাপিত জীবন’, ‘নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি’, শওকত আলীর ত্রয়ী উপন্যাস ‘দক্ষিণায়নের দিন’, ‘কুলায় কালস্রোত’, ‘পূর্বরাত্রি পূর্বদিন’, ‘ওয়ারিশ’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’, ‘খোয়াবনামা’, প্রশান্ত মৃধার ‘মৃত্যুর আগে মাটি’ শীর্ষক উপন্যাস। এসব উপন্যাসের বিষয়বস্তু দেশভাগ পরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতা, স্বাধীকার আন্দোলন, মতাদর্শিক ঘাতপ্রতিঘাত থেকে শুরু করে ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মধ্যদিয়ে এই সময় কেউ কেউ বাংলাদেশের মর্মমূলকে ছুঁতে চেয়েছেন। শওকত আলীর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ উপন্যাসে পাওয়া যাবে তারই চমৎকার ভাষ্য।

বাংলাদেশের নাটকে প্রধানত সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে উপজীব্য হয়েছে এই রাজনৈতিক প্রসঙ্গ। এসব নাটকে প্রাধান্য পেয়েছে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের চেতনা। রাজনৈতিক ও সামাজিক অসঙ্গতি, শোষক ও শোষিতের শ্রেণিদ্বন্দ্ব নাট্যকারদের আকৃষ্ট করেছে। এসব নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মামুনুর রশীদের ‘ওরা কদম আলী’, ‘ওরা আছে বলেই’, ‘ইবলিশ’, ‘এখানে নোঙর’, ‘গিনিপিগ’, আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘শপথ’, ‘সেনাপতি’, ‘এখনো ক্রীতদাস’, ‘সুবচন নির্বাসনে’, ‘এখন দুঃসময়’, ‘চারিদিকে যুদ্ধ’ ইত্যাদি। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পুনরাবিষ্কারের মধ্যদিয়েও আমাদের নাট্যকারগণ সমকালীন রাজনৈতিক চেতনাকে স্পর্শ করতে চেয়েছেন। ব্রতী হয়েছেন বাঙালি জাতিসত্তার উৎস ও অস্তিত্ব সন্ধানে। এই ধারায় রচিত উল্লেখযোগ্য নাটক হচ্ছে সৈয়দ শামসুল হকের ‘নূরলদীনের সারাজীবন’, সাঈদ আহমদের ‘শেষ নবাব’, সেলিম আল দীনের ‘শকুন্তলা’, ‘কীত্তনখোলা’, ‘কেরামতমঙ্গল’ প্রভৃতি। প্রতিবাদী নাটকের ধারাতেই বাংলাদেশে বেশকিছু নাট্যাঙ্গিকের সূত্রপাত ঘটে। এই আঙ্গিকগুলি হচ্ছে পথনাটক, গ্রামথিয়েটার, মুক্তনাটক ইত্যাদি।

তবে কথাসাহিত্য ও নাটকের তুলনায় রাজনৈতিক প্রসঙ্গ সবচেয়ে প্রবলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে বাংলাদেশের কবিতায়। শামসুর রাহমানের উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ থেকে শুরু করে রফিক আজাদের ভাত দে হারামজাদা পর্যন্ত কবিতাগুলি পাঠকের একান্ত অভিনিবেশের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। পঁচাত্তরের পটভূমিতে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ লেখেন, ‘জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরনো শকুন’। এছাড়া হাসান হাফিজুর রহমানের ‘আমার ভেতরের বাঘ’, শামসুর রাহমানের ‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে’, ‘অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই’, ‘ধুলায় গড়ায় শিরস্ত্রাণ’, ‘দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে’, ‘বুকে তার বাংলাদেশের হৃদয়’, আল মাহমুদের ‘সোনালি কাবিন’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘অগ্নি ও জলের কবিতা’, নির্মলেন্দু গুণের ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’, ‘তার আগে চাই সমাজতন্ত্র’, ‘পৃথিবীজোড়া গান’, ‘দূর হ দুঃশাসন’, ‘ইসক্রা’, রফিক আজাদের ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’, ‘অঙ্গীকারের কবিতা’, মহাদেব সাহার ‘ফুল কই শুধু অস্ত্রের উল্লাস’, ‘কোথা সে বিদ্রোহ’, ‘যদুবংশ ধ্বংসের আগে’, মুহম্মদ নূরুল হুদার ‘আমরা তামাটে জাতি’, ‘জাতিসত্তার কবিতা’ ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থে বাংলাদেশের রাজনীতির ব্যক্তিক শৈল্পিক প্রকাশ ঘটেছে নানা মাত্রায়।

৫. দীর্ঘ সময়, বহুমুখী প্রকাশ
১৯৭২ থেকে ২০২০ সাল—এক দীর্ঘ সময়। স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশ এইসময় নানা ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্যদিয়ে অগ্রসর হয়েছে। রাজনীতির ক্ষেত্রটি হয়ে উঠেছে জটিল ও সংক্ষুব্ধ, বাঁক নিয়েছে কয়েকবার। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা ও মতাদর্শিক সংঘাত; বাদ-প্রতিবাদ। পুনরুত্থান ঘটেছে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির; তাদের সহযোগিতায় রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে অতিডানপন্থী শক্তি। সামাজিক সাম্য, অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রকৃত চর্চার জায়গা থেকে সরে আসবার ফলে বহির্বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ চিহ্নিত হয়েছে মৌলবাদী দেশ হিসেবে। এখন আবার অবশ্য বাংলাদেশ ফিরে যাচ্ছে তার রাষ্ট্রিক উৎসে, মুক্তিযুদ্ধের মতাদর্শিক জায়গায়। এই লেখার সংক্ষিপ্ত পরিসরে আমাদের সাহিত্যে উল্লিখিত ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়টি কিভাবে রূপায়িত হয়েছে, তুলে ধরা সহজ হয়নি। তবু চেষ্টা করেছি এই সময়ে রচিত বাংলাদেশের সাহিত্যের একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরার। কিন্তু এর মাধ্যমে যে বাংলাদেশের সাহিত্যের সামগ্রিক পরিচয় তুলে ধরা যায়নি, লেখাটির উপসংহারে পৌঁছে তা বিলক্ষণ মনে হচ্ছে।

বাংলাদেশের সাহিত্যের মনোযোগী পাঠকমাত্রেই লক্ষ করবেন, এদেশের সাহিত্য নানা সময়ে নানা বাঁক নিয়েছে। স্বাধীনতার পর যে ধরনের উদ্দীপনামূলক লেখা আমরা কবি ও কথাসাহিত্যিকদের কাছ থেকে পেয়েছি, শাহবাগের গণজাগরণের পর তা আবার প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের রূপ নেয়। কবিতার ক্ষেত্রে আমরা দেখছি আত্মস্বীকারোক্তিমূলক এবং রাজনৈতিকভাবে ঝাঁঝালো কবিতার পরিবর্তে এখন লেখা হচ্ছে ‘অন্তর্মুখী ব্যক্তিক’ কবিতা, অন্তর্লীনতার হার্দ্র কারুণ্যে যে কবিতা স্নাত। এখন আবার দেখা যাচ্ছে আশির দশকের বিমূর্ত কবিতার পরিবর্তে সহজ কবিতার প্রতি কবিদের ঝোঁক। আবার শাহবাগের গণজাগরণে প্রভাবে লেখা হয়েছে প্রতিবাদমূলক ঝাঁঝালো কবিতা, ছড়া, গল্প ও উপন্যাস। তরুণ কবিদের মধ্যে দেখা গেছে রূপকল্প নির্মাণে, প্রতীক ব্যবহারে, ভাষাভঙ্গিকে অভিনব করে তুলবার প্রবণতা। কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রেও নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন তরুণ লেখকেরা। জাদুবাস্তবতা তাদের অনেকটাই আচ্ছন্ন করে রেখেছে। গত দুই দশকে নগরজীবন ও গ্রামকে কেন্দ্র করে কখনো আত্মজৈবনিক, কখনো যাদুবাস্তবতা, কখনো নিরীক্ষাধর্মী গদ্যে তারা গল্প-উপন্যাস লিখেছেন। নাটকেও পাওয়া যাবে নানা বৈচিত্র্যের সন্ধান।

সবমিলিয়ে বলা যায়, এই সময়ের সাহিত্য সরাসরি বক্তব্য প্রকাশের স্তর থেকে সরে এসে হয়ে উঠছে অস্তিত্ব-নিরস্তিত্বের ব্যক্তিক গাথা। লেখকেরা প্রথাগত ভাষা ও ভঙ্গিতে সরাসরি ঘটনার বর্ণনায় আর আগের মতো আগ্রহী নন, তারা ব্যক্তিঅস্তিত্বের গভীরে কিংবা অন্তর্লোকে নিমজ্জিত হয়ে উপলব্ধি করতে চান তার যাপনের প্রকৃত স্বরূপ। বাংলাদেশের সাহিত্য এভাবেই হয়ে উঠেছে মানবীয় অন্তর্লোকের উদ্ভাষণ, মনোবাস্তবতার যাপিত দলিল। সহজ ছন্দোবদ্ধ কবিতার দিকে যেন আবার ফিরছেন কবিরা। কেউ কেউ একে হাল আমলের ফ্যাশনদুরস্ত শব্দ উত্তর-আধুনিক বলে চিহ্নিত করতে চাইছেন। কিন্তু উত্তর-আধুনিকতার স্বরূপ যে কী তা এখনো সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি, হবেও না হয়তো। কারণ, উত্তর-আধুনিকতা নিজেই নির্দিষ্ট কোনো ছকে নিজেকে আটকে রাখতে চায় না, সেটাই তার বৈশিষ্ট্য। তাহলে কিভাবে ব্যাখ্যা করব একে? আসলে সাহিত্যকে বোধহয় এখন আর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে নয়, উপলব্ধি করে জারিত করার সময় এসে গেছে। নির্দিষ্ট দেশকালের মধ্যে তার শিকড় চাড়িয়ে দিয়েও যে বাংলাদেশের সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যের প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠেছে, বুঝে নিতে হবে সেটাই। তবে মতাদর্শিকভাবে বিভ্রান্তি তৈরি করে যারা জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে ইতিহাস ও ঐতিহ্যচ্যুত করে ভুল পথে চালিত করতে চেয়েছিল, তাদের সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। ফলে, সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশের অধিকাংশ লেখক সর্বমানবিক অসাম্প্রদায়িক প্রেক্ষাপটেই তাদের সাহিত্য রচনা করছেন। সবধরনের বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হয়ে গণতান্ত্রিক, উদারনৈতিক, ধর্মনিরপেক্ষ, আধুনিক রাষ্ট্রের স্বপ্নের কথাই কবি, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও লেখকেরা বলে চলেছেন।

ঢাকা, ২৪ মার্চ ২০২০

অসুস্থ ‘তিলোত্তমা’র কাছে কী সেবা চান আপনি!



প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত, প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম

ছবি: সংগৃহীত, প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম

  • Font increase
  • Font Decrease

জুলাই ১৩, ২০২৪ সালের ভোর পাঁচটায় শুরু হয়েছিল এক তুমুল বৃষ্টি। রাজধানী ঢাকার বেশিরভাগ মানুষ তখনও গভীর ঘুমে।

এ সময়টা ঘোর বর্ষাকাল। সে কারণে ভারী বৃষ্টিপাত হতেই পারে। তাই, অ্যালার্ম শুনেও আরেকটু ঘুমিয়ে নিই বলে যারা কিছুটা দেরিতে উঠে অফিসে যাবেন বলে আটটার দিকে পথে নেমেছেন, তাদের চক্ষু সেদিন চড়কগাছ‍!

সকাল ৯টা পর্যন্ত বৃষ্টি থামেনি। একটানা চার ঘণ্টার মুষলধারার পতনে ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার ২৬ থেকে ৩০টি বড় রাস্তা একসঙ্গে ডুবে গেছে।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, এই ‘ডোবা’ সেই ডোবা নয়! রাস্তায় ১-২ ঘণ্টা জ্যামে দাঁড়িয়ে থাকার পর অনেক গাড়ির ইঞ্জিনে পানি ঢুকে পড়ায় অচল হয়ে যানজট অসহনীয় করে তুলেছিল সেদিন। সংবাদে টেলিভিশনের ভিডিওচিত্র দেখেও তাই-ই মনে হচ্ছিল।

সে এক অতি ভয়ঙ্কর অবস্থা সারাদিন জুড়ে। যেখানে চোখ যায়, সেখানেই মনে হয়, প্লাবন বয়ে যাচ্ছে। নটরডেম কলেজের পাশের রাস্তায় পার্কিং করা কারের শুধু ছাদটা দেখা যাচ্ছে। মালিক গাড়িতে উঠতে গিয়ে হতবাক হয়ে পড়েছেন।

নিউমার্কেটের প্রধান গলিতে বুকসমান পানি। দোকানকার মালিকেরা যারা বাসা থেকে ডুবন্ত নিউমার্কেটের ছবি দেখে দৌড়ে এস মাল সরানোর চেষ্টা করেছিলেন, তারা অনেকে এসে দেখেন দোকানের তালা ঘোলা-ময়লা পানিতে ডুবে অচেনা হয়ে গেছে। মালপত্র ভিজে গছে। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যে পর্যন্ত সেই মালামাল সরাতে পারেননি।

কোথায় নেবেন! বেরুনোর সব রাস্তায় থৈ থৈ পানি! ভ্যান, যানবাহন কিছুই ঢোকানো যাবে না! এখানে জলের যানবাহন নেই। কলের গাড়ি জমানো বৃষ্টির বুকসমান জলে চলার পথ খুঁজে পায়নি কোথাও।

গ্রীন রোডে অনেকগুলো প্রাইভেট হাসপাতাল। সেখানে আগত রোগীদের অবস্থা খুবই করুণভাবে চিত্রিত হয়ে সংবাদে ঠাঁই নিয়েছে সেদিন। ডুবন্ত রিকশাভ্যানে নারী রোগীকে শুইয়ে নিয়ে ঠেলে চলছেন রোগীর আত্মীয়-স্বজনেরা। পাশের ভবনের কৌতূহলী মানুষ শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে ‘আহারে’ বলে অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। ভাগ্যিস! শুক্রবার হওয়ায় সেদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা ছিল না।

এদিন পথে যারই নেমেছেন, তারাই দুর্ভোগে পড়ে গিয়েছেন। বাইকারদের অনেকের ইঞ্জিনে পানি ঢুকে স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেছে। পেটের ধান্ধায় যারা ব্যাটারিরিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন, তাদের বাহন অচল হয়ে যাওয়ায় সেগুলো ঠেলে অন্যখানে সরিয়ে নেওয়ার কোনো উপায় ছিল না।

চিৎকার করে কেউ কেউ বলছিলেন- ‘আমাদের ট্যাক্স, ভ্যাট আদায়ের সময় যারা নিয়ম দেখায়, যারা জরিমানা আদায় করে তারা এখন ঘরে বসে টিভিতে আমাদের কষ্ট দেখে তামাশা করছে! এই তিলোত্তমা নগরে নাগরিক সুবিধা কি সামান্য বৃষ্টির পানিতে ডুবে থাকবে’!

কথা হলো- এই ‘তিলোত্তমা’ কী দেবে তোমায় আমায়! তার কি-বা দেবার আছে! রাজধানী ঢাকাকে বিশেষণ দিয়ে রূপসীর টোলপড়া গালের তিলের সঙ্গে তুলনা করা হয়। এর সৌন্দর্যের মোহে কবি-সাহিত্যকরা কত শত ছড়া-কবিতা লিখেন দিনরাত।

কর্তৃপক্ষ প্রতিবছর কত মূল্যবান প্রসাধনী কিনে সাজানোর চেষ্টা করেন এর দেহকে। এর একই অঙ্গে উত্তর-দক্ষিণে কত বাহারি আলো শোভা পায়‍ কিন্তু দিনশেষে এত মেকাপ ‘রিমুভ’ করে ঘুমুতে যাওয়া উপায় নেই তার। এজন্য সে নিজেই নিজের সহ্যগুণ হারিয়ে ‘ভালনেরাবল’ বা ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। কিন্তু সেদিকে কারো কোনো নজর নেই।

তবুও প্রতিদিন নতুন নতুন ফেসপাউডার, কাজল, ভারী ভারী গহনা পরানো হচ্ছে। তিলোত্তমার বুক চিরে এত ভারী গহনা পরানোর ফলে এর বুক দুরু দুরু করছে। কানের গহনা কখন কান ছিঁড়ে পড়বে, তার নিরাপত্তা নেই। এর প্রাকৃতিক পঞ্চন্দ্রিয় এখন বন্ধ হয়ে গেছে! এসব কথা আক্ষেপ করে বলছিলন এক প্রবীণ ঢাকাবাসী। তাঁর কাছে ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার প্রাকৃতিক পঞ্চন্দ্রিয় বন্ধ হওয়ার কথা হঠাৎ আঁতকে উঠে জিজ্ঞাসা করলাম- সেটা কেমন!

মানুষের প্রাকৃতিক পঞ্চন্দ্রিয় বন্ধ হয়ে গেলে যদি দ্রুত চিকিৎসা করানো না যায়, তাহলে তার মৃত্যু অনিবার্য! তবে ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার পঞ্চন্দ্রিয় বন্ধ হলো কীভাবে! তিনি জানালেন, ধরুন, এর বাতাসের মান বছরের ১০ মাসই অস্বাস্থ্যকর থাকে। পথে হাঁটতে গেলে নাক, চোখ দিয়ে গরম পানি ঝরে। এখন বর্ষাকাল তাই বায়ুতে একটা স্বস্তি। এর মুখ খোলা। কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, যা দিয়ে প্রতিদিন নতুন নতুন মানুষ, ছাত্র, বেকার, ভাসমান মানুষ ঢুকছে। কেউ একবার ঢুকলে আর বের হতে চায় না।

তবে ভয়ঙ্কর বিষয় হলো- এর নিচের ইন্দ্রিয় দুটো বর্ষাকালে হঠাৎ করে অকেজো হয়ে পড়ে। যেমন- ধরুন, ভূগর্ভস্থ সুয়্যারেজ লাইন ও নর্দমাগুলোর কথা। এই দুটি ‘তিলোত্তমা’র অতি গুরুত্বপূর্ণ ইন্দ্রিয়। জুলাই ১৩, ২০২৪ তারিখ চার ঘণ্টার বৃষ্টির পানি যদি বাধাহীনভাবে সব নর্দমা দিয়ে বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়তো, তাহলে কি এই ভয়ঙ্কর জলজট হতো!

কিন্তু ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার অতি গুরুত্বপূর্ণ ইন্দ্রিয় সদৃশ নর্দমাগুলোর মুখ বন্ধ হয়ে পড়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান এর নর্দমাগুলোর ভেতরে পাইপ বসিয়ে এর স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে। ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার উন্নয়ন কাজে এত বেশি প্রতিষ্ঠান জড়িত, তা গুনে শেষ করা যাবে না। তাদের মধ্যে কাজের সমন্বয় নেই। কে কখন কাটলো, কে ঢেকে রাখলো, আর কে নর্দমাগুলোর ভেতরে পাইপ বসিয়ে পানি প্রবাহ বন্ধ করে দিলো, তা ঠিকমতো হিসাব রাখার মতো সময় সুযোগ নেই কর্পোরেশনগুলোর।

সুতরাং একটু বৃষ্টি হলেই প্লাষ্টিক, মাটি, কাপড়ের টুকরো, কিচেন গার্বেজ ইত্যাদি দিয়ে এর নিচের ইন্দ্রিয় বা ময়লা নিষ্কাশনের নর্দমা বর্ষাকালে হঠাৎ করে অকেজো হয়ে পড়ে; যার নেতিবাচক প্রভাব এসে পড়ে রাজপথে, অলিতে-গলিতে, বাড়িতে, মার্কেটে। নগরের সব জায়গার সব কার্যক্রম হঠাৎ থৈ থৈ পানিতে সয়লাব হয়ে যায়।

এজন্য কর্পোরেশনগুলোর সার্বক্ষণিক ওয়াচটিম ও মটিভেশন কর্মসূচি থাকা দরকার। একেকটি সার্বক্ষণিক ওয়াচটিমের এক-দুইজন সদস্য একেকটি এলাকার ১০টি করে নর্দমার প্রবাহ পরিষ্কার আছে কিনা তা নজরদারিতে রাখলে এই জলাবদ্ধতা সহজেই নিরাময় করা যাবে!

জাপানের ট্রাফিক যেমন অফিসে বসেই রাস্তার চলন্ত গাড়ি ওয়াচ করে মাসিক বেতন বিলের সঙ্গে জরিমানার বিল কেটে ধরিয়ে দেয় তদ্রুপ আমাদের সিটি কর্পোরেশনের নর্দমা ওয়াচ টিমের দৈনন্দিন কার্যকলাপ সিসি ক্যামেরা ও ড্রোন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ করে জরিমানার বিধান করা যেতে পারে।

‘তিলোত্তমা’ ঢাকার নির্মাণ কাজ সারাবছর জুড়ে চলে। কখনো শেষ হয় না। নির্মাতারা রাস্তার পার্শ্বে বিভিন্ন নির্মাণ সামগ্রী, নুড়িপাথর বর্জ্য ফেলে স্তূপ করে রাখে। একটু বৃষ্টি হলে সেগুলো গড়িয়ে কাছাকাছির ড্রেন বন্ধ করে দেয়। বিভিন্ন পার্ক, পথঘাটের খোলা রেস্টুরেন্টে হরদম পলিথিন প্যাকেটে খাদ্যসামগ্রী বিক্রি হয়। ফুটপাতের দোকান, দর্জিপাড়া ইত্যাদি থেকে প্লাষ্টিক ব্যাগ ও বেশি শক্ত বর্জ্য নর্দমার মধ্যে ফেলা হয়ে থাকে। ওয়াচটিমের মাধ্যমে সেগুলো নিয়মিত সরিয়ে ড্রেনের ময়লা পানির গতিপ্রবাহ দেখে প্রতিদিন রিপোর্ট নেওয়ার নিয়ম থাকা উচিত।
হয়ত অনেক নিয়ম-কানুন হাতে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ‘তিলোত্তমা’র রাস্তায় যেখানে-সেখানে কাগজ, পলিথিন, ইটের টুকরা, আবর্জনার ছড়াছড়ি দেখে এসব কাজের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তাইতো মনে হয়, মাত্র একবেলা বৃষ্টির পানিতে কেন এই বন্যা! গেল অর্থবছরে ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে সাতশ পঞ্চাশ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে বলে একটি জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম হয়েছে। তবু কেন নগর জুড়ে ভয়াবহ জলাব্ধতার দুর্ভোগ কিছুদিন পর পর ঘাড়ে চাপে! এর দায়ভার কার!

‘তিলোত্তমা’ ঢাকা যানজট, জলজট ইত্যাদিতে নিজেই পঙ্গু হয়ে অসাড় হয়ে পড়েছে। বুয়েটের আবাসিকের মতো জায়গায় নগর পরিকল্পনাবিদদের কোয়ার্টারের নিচতলাবাসী এবার জলজটকে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। তারা কেউ কেউ পাম্প দিয়ে ঘরের পানি সেচে বাইরে ফেলার চেষ্টা করেছেন। কেউ সারারাত ঘুমাতে পারেননি। তাদের জন্যও উন্নত নাগরিক সেবা সে রাতে শূন্যের কোটায় নেমে গিয়েছিল।

‘তিলোত্তমা’ ঢাকায় প্রায় প্রতিবছর এই জায়গায় বার বার কাটাছেঁড়া করায় অতি উন্নয়নের ভারে সে ন্যুজ্ব হয়ে পড়েছে। যেমনটি ঘটেছিল পপ তারকা মাইকেল জ্যাকসনের বেলায়। তাঁর দেহের বিভিন্ন অঙ্গে এত বেশি প্লাস্টিক সার্জারি করা হয়েছিল যে, তিনি একসময় চরম হতাশ হয়ে ওষুধ গ্রহণ ছেড়ে দিয়ে একা একা বাঁচার জন্য নিঃসঙ্গ থাকতে চেয়েছেন। তবুও শেষ রক্ষা হয়নি তার। এখন থেকে আমাদের ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার অঙ্গে আর কাটাছেঁড়া না করাটাই উত্তম।

অসুস্থ ‘তিলোত্তমা’র ওপর একসঙ্গে অনেক ব্যাধি ভর করেছে। এ অবস্থায় তার কাছে আর কী নতুন সেবা চাওয়ার আছে আমাদের! তাই, ‘তিলোত্তমা’র ওপর আর শল্য চিকিৎসা না চাপিয়ে উল্লিখিত টোটকা দাওয়াই দিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর আছে বলে মনে হয় না!

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন। E-mail: [email protected]

;

সাহিত্য পত্রিকা 'কথার কাগজ'র আত্মপ্রকাশ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সাহিত্য পত্রিকা 'কথার কাগজ'র আত্মপ্রকাশ

ছবি: সাহিত্য পত্রিকা 'কথার কাগজ'র আত্মপ্রকাশ

  • Font increase
  • Font Decrease

শ্রাবণ সংখ্যা আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে শিল্প ও সাহিত্যের ছোট পত্রিকা 'কথার কাগজ'-এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলো।

শুক্রবার (১২ জুলাই) বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মিলনায়তনে 'কথার কাগজ' শ্রাবণ সংখ্যার মোড়ক উন্মোচন করা হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক শাহানারা স্বপ্না, কথাসাহিত্যিক ফরিদুল ইসলাম নির্ঝর, স্টুডেন্ট ওয়েজ প্রকাশনীর প্রকাশক মাশফিক তন্ময়, কথার কাগজের প্রধান সম্পাদক কেতন শেখ, নির্বাহী সম্পাদক অয়ন আব্দুল্লাহ প্রমুখ। পত্রিকাটির বার্ষিক শ্রাবণ, কার্তিক ও ফাল্গুন তিনটি সংখ্যায় প্রকাশ হবে।

মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে কথার কাগজের প্রধান সম্পাদক কেতন শেখ বলেন, 'করোনাকালীন ২০২০ সালে কথার কাগজের জন্ম। সে সময় কয়েকজন প্রবাসী আর দেশি লেখক অনলাইনে ব্লগের মাধ্যমে কথার কাগজের লেখালেখি শুরু করি। তরুণ সাহি- ত্যিকদের সঙ্গে প্রবীণ সাহিত্যিকদের লেখালেখির একটি প্ল্যাটফর্ম হয়ে দাঁড়ায় কথার কাগজ।

প্রকাশক মাশফিক তন্ময় বলেন, 'এক সময় সাহিত্য আন্দোলনের প্রধান বাহন ছিল ছোট পত্রিকা বা লিটলম্যাগ। কিন্তু নানা সংকটে লিটলম্যাগের কলেবর ছোট হয়ে গেছে। প্রকাশকরা অনেকেই অর্থসংকটে তাদের প্রকাশনা বন্ধ করে দিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে অনলাইনের এই যুগে ছাপা কাগজে কথার কাগজের যাত্রা তরুণ লেখকদের অনুপ্রেরণা জোগাবে।'

শাহানারা স্বপ্না বলেন, 'আশা করি, পত্রিকাটি অনেক দূর এগিয়ে যাবে। শ্রাবণ সংখ্যার প্রথম দর্শনে মনে হচ্ছে এটি পাঠকদের সাহিত্যের খোরাক জোগাবে।'

ফরিদুল ইসলাম নির্ঝর বলেন, 'মানুষের ভাষার প্রতি টান থাকলে দেশ ও দেশের বাইরে থেকে কাজ করা যায়, এর উদাহরণ কথার কাগজ। সম্পাদকম- গুলীর তিনজনই দেশের বাইরে থেকে এর যাত্রা শুরু করেন। আজকে দেশে এসেই তারা পত্রিকাটির ছাপা সংস্করণের মোড়ক উন্মোচন করলেন।'

সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান বলেন, 'আমাদের তরুণরা বিদেশ চলে যাচ্ছে, আর ফিরছে না। তবে কথার কাগজের সঙ্গে জড়িতরা বিদেশ থেকে সাহিত্য আর দেশের টানে ফিরে এসেছেন। অনলাইনের যুগে যখন অনেক পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, এ অবস্থায় তারা কথার কাগজের প্রিন্ট ভার্সন নিয়ে এসেছেন। এটি অনেক ভালো লাগার।' নতুন পত্রিকাটি টিকিয়ে রাখতে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

;

লেখক শেখ হাসিনা কোটিপতি হওয়ার পথে!



আবদুল হামিদ মাহবুব
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখালেখির হাত খুব ভালো। তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী হননি তখনই তার একাধিক বই প্রকাশ হয়েছে। সম্ভবত তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই ‘ওরা টোকাই কেন’। ঢাকার আগামী প্রকাশনী থেকে বইখানা বের হয়েছিল। ওই প্রকাশনী থেকে আমারও দু’খানা ছড়ার বই প্রকাশ হয়। ১৯৯১ সালে আমার ‘ডিমের ভিতর হাতি’ যখন প্রকাশ হচ্ছিলো তখন আগামী প্রকাশনীর কর্ণধার ওসমান গনি ভাই শেখ হাসিনার ‘ওরা টোকাই কেন’ এককপি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন।

বইখানা প্রথম না দ্বিতীয় সংস্করণের ছিলো সেটা মনে নেই। ওই বই কয়েকটি নিবন্ধের সংকলন। অধিকাংশ নিবন্ধেই শেখ হাসিনা তাঁর ভিতরের যন্ত্রণার কথা লিখেছিলেন। লিখেছিলেন দেশ ও রাজনীতি নিয়ে তাঁর পরিকল্পনার কিছু কিছু ইঙ্গিত। পড়েছিলাম তো অনেক আগে। তারপরও লেখাগুলোর অনেক বিষয় মনে রয়ে গেছে। প্রতিটি নিবন্ধ পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। আমার পারিবারিক ছোট লাইব্রেরিতে বইখানা গোছিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু আজ যখন ওই বই খোঁজতে লাগলাম, পেলাম না। অনুমান হচ্ছে আমার বইচোর কোন বন্ধু হয়তো এই বইখানা মেরে দিয়েছেন। অথবা বন্যা অতঙ্কে কয়েকেবার বাসার বইগুলো টানাটানি করার কারণে কোথাও হয়ত খুইয়ে ফেলেছি। তবে আমার ধারণা এই বইয়ের ক্ষেত্রে প্রথমটি ঘটেছে।

প্রধানমন্ত্রীর অনেক বইয়ের মতো ‘ওরা টোকাই কেন’ নিশ্চয়ই বহুল প্রচারিত হয়েছিল, বেরিয়েছিল অনেক অনেক সংস্করণ। আর বই সমূহের রয়্যারিটিও তিনি হাজার হাজার টাকা পেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এমন প্রাপ্তি ঘটে থাকলে, আমি একজন লেখক হিসাবে অবশ্যই পুলকিত হই। আমি দেখেছি সেই ১৯৯১ সালের পর থেকে আগামী প্রকাশনীর প্রকাশনা ব্যবসারও অনেক উন্নতি হয়েছে। ব্যবসার উন্নতি ঘটার অর্থ প্রকাশকের উন্নতি ঘটা। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি আগামী প্রকাশনীর কর্ণধার ওসমান গনি ভাইয়ের আর্থিক অবস্থা অনেক অনেক ভালো হয়েছে।

পূর্বে দেখতাম একুশের বইমেলায় আগামী প্রকাশনী ছোট্ট স্টল নিত। এখন প্যাভিলিয়ন নেয়। লাখ লাখ টাকা খরচ করে প্যাভিলিয়নের অঙ্গসজ্জা করা হয়। নিশ্চয় বইয়ের ব্যবসা ভালো হয়। সেকারণেই বইমেলার প্যাভিলিয়ন তৈরিতে বিনিয়োগও বেশি করেন। প্রতিবছরই আগামী প্রকাশনীর কোন না কোন বই কেনার জন্য পাঠকের লাইন পড়ে। পাঠক যখন যে কোন লেখকের বই কেনে, সেটা দেখে আমি একজন লেখক হিসাবে আনন্দিত হই। বইয়ের ব্যবসার উন্নতি হোক। প্রকাশকরা ভালো লাভ করুন, আমি মনে প্রাণে সেটা চাই।

অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, প্রকাশকের লাভ হলে আমার মতো মফস্বলের লেখকরা কি লাভমান হই? অবশ্যই যৌক্তিক প্রশ্ন। এর জবাব খুব সংক্ষিপ্ত। প্রকাশকরা যখন বই প্রকাশ করে লাভের মুখ দেখবেন, তখন তারা নতুন নতুন বই প্রকাশে আগ্রহী হবেন। নতুবা আমাদের মতো লেখকদের প্রকাশককে উল্টো টাকা দিয়ে বই প্রকাশ করিয়ে নিতে হবে। এবং আমরা অনেকেই সেটা করছিও।

অনেকে আবার এও বলেন ডিজিটালের এই যুগে এখন আর কেউ বই কিনে পড়ে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে টুকটাক পড়েই তাদের পড়া শেষ করেন। সেই কারণে লেখকরা গাঁটের টাকা খরচ করে বই প্রকাশ করলেও সেগুলো বিক্রি হয় না। আমি এই অপবাদটা মানতে নারাজ। কারণ আমি দেখেছি কেবল ফেব্রুয়ারি মাসেই বইমেলা চলাকালে শত শত কোটি টাকার বই বিক্রি হয়। আর যারা পড়ুয়া, তারা সারা বছরই খোঁজে খোঁজে রকমারি, প্রথমা, আগামী, শ্রাবণ, ইউপিএলসহ বিভিন্ন আনলাইন বই বিক্রয় প্রতিষ্ঠান থেকে বই আনান।

আমি মফস্বলের একটি শহরে থাকি। আমাদেরে শহরে বইয়ের দোকান আছে অনেক। সেগুলোতে স্কুল কলেজের পাঠ্য ও গাইড বই ছাড়া অন্য বই খুব কমই দেখা যায়। সৃজনশীল বলুন আর মননশীল বলুন, সেইরকম বইয়ের দোকান খুব একটা নাই। আমাদের শহরে প্রকাশনা ব্যবসার সাথে ‘কোরাস’ নামে একটি দোকান চালান বই পাগল এক যুবক মুজাহিদ আহমদ। তাঁর কোরাসেই আমাদের মত পাঠকের উপযোগী কিছু কিছু বই আসে। কিন্তু সবসময় কোরাসও আমাদের মতো পাঠকদের চাহিদার যোগান দিতে পারে না। তারপরও মন্দের ভালো হিসাবে দোকানটি টিকে আছে, টিকে থাক্।

আমাকে প্রায়ই অর্ডার করে ‘রকমারি’ থেকে বই আনাতে হয়। আমার আনানো বই ছাড়িয়ে আনার জন্য আমি নিজে প্রায়ই কুরিয়ার অফিসে যাই। আমি যেদিনই কুরিয়ার অফিসে গিয়েছি, দেখেছি কেবল আমার বই নয়, আমার মতো আরও অন্তত বিশ থেকে পঁচিশ জনের বইয়ের প্যাকেট এসেছে। কুরিয়ার অফিসের লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জেনেছি, প্রতিদিনই এভাবে কিছু না কিছু বই নানাজনের নামে আসে। আর আমার নিজের চোখে দেখাটাকেওতো বিশ্বাস করতে হবে। মানুষ যদি বই নাই পড়বে তবে কেনো রকমারি কিংবা অনলাইনের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে এতো এতো বইয়ের প্যাকেট আসবে? আমি বলবো বইয়ের পাঠক মোটেই কমেনি বরংচ বেড়েছে।

শুরু করেছিলাম আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বইয়ের প্রসঙ্গ দিয়ে। বই প্রসঙ্গেই বলতে গিয়ে অন্য প্রসঙ্গও এসে গেল। আমাদের শহরের সেই যে ‘কোরাসে’র কথা বলেছি; ক’দিন আগে এক দুপুরবেলা কোরাসে গিয়ে বই দেখছি। এসময় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুইজন প্রধান শিক্ষক কোরাসে এসে ঢুকলেন। তাদের দু’জনের হাতেই বেশ বড় সাইজের চারখানা করে বই। ওই দুই প্রধান শিক্ষক আমার পূর্ব পরিচিত। তাদের হাতে বই দেখে আমি উৎফুল্ল হলাম। কি বই? কোথা থেকে আনলেন? এমন প্রশ্ন করে বইগুলো দেখতে চাইলাম। দু’জনই ক্ষোভ প্রকাশ করে আমার সামনে টেবিলের উপর ধাম্ ধাম্ করে বইগুলো রাখলেন। একজন বললেন, ‘‘আমাদের বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের পড়ার জন্য এই বইগুলো নগদ চব্বিশ’ টাকা দিয়ে কিনে এনেছি। বলুন ছাত্ররা এই বই পড়তে পারবে? তারা কি কিছু বুঝবে?’’ অন্য প্রধান শিক্ষকের চেহারায় তখনও বিরক্তি রয়ে গেছে। তিনি বললেন, ‘বইগুলো দেখুন, আপনি লেখক মানুষ, আপনিও কিছু বলুন।’

আমি তাদের আনা বইয়ের দিকে মনোযোগ দিলাম। দেখি চার চার আটখানা বই, দুটি বিষয় নিয়ে করা হয়েছে। প্রচ্ছদে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ছবি। বইগুলোর লেখক আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একটি বইয়ের নাম ‘সকলের তরে সকলে আমরা’। এই বইয়ে প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ ও ২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত যে ভাষণগুলো দিয়েছেন সেগুলোর বাংলা ও ইংরেজি সংকলন। অপর বইয়ের নাম ‘আহ্বান’। এই বই করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী ২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত জাতির উদ্দেশে যেসব ভাষণ দিয়েছেন সেগুলো সংকলিত করে।

দু’খানা বইয়ের-ই কাগজ, ছাপা, বাঁধাই খুবই উন্নত মানের। প্রতি কপি বইয়ের মূল্য ছয়শত টাকা। প্রত্যেকটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লাইব্রেরির জন্য প্রতিটি বইয়ের দুই কপি করে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস বিক্রি করেছে। প্রধান শিক্ষকরা এই বইগুলো কিনে নিতে বাধ্য। চারখানা বইয়ের জন্য প্রধান শিক্ষকদের দুই হাজার চারশত টাকা করে অফিসের সংশ্লিষ্ট ক্লার্কের কাছে পরিশোধ করতে হয়েছে। বুঝতে পারি টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে বলেই এই দুই প্রধান শিক্ষক ক্ষুব্ধ। আমি শিক্ষকদের অনুমতি নিয়েই একটি বিদ্যালয়ের জন্য আনা চারখানা বইয়ের ছবি উঠিয়ে নিলাম। এই সময় কোরাসের কর্ণধার মুজাহিদ আহমদ বললো, ‘ভাই, আমি এমন একখান বই প্রকাশের অনুমতি পেলে কোটিপতি হয়ে যেতাম।’

আমি ওই দুই প্রধান শিক্ষককে উদ্দেশ্য করে বললাম; ‘প্রধানমন্ত্রীর বই প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাচ্ছে, এটাতো আনন্দের বিষয়। কিন্তু আমারও প্রশ্ন হচ্ছে বইগুলো কি প্রাথমিকের ছাত্রছাত্রীদের জন্য উপযোগি? আর প্রধানমন্ত্রীর রাষ্ট্রিয় এইসব ভাষণ বই আকারে করাটা তো সরকারি খরচেই হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, উচ্চ বিদ্যালয় ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লাইব্রেরিগুলোতে দিতে হলে বিনামূল্যে দেওয়ার কথা। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ সংকলন টাকার বিনিময়ে কিনতে হবে কেনো?’

তখন একজন বললেন; ‘ভাই, এই বই রাষ্ট্রিয় ভাবে হয়নি। ব্যবসার জন্য প্রধানমন্ত্রীর আশপাশের এক দু’জন প্রকাশনীর মাধ্যমে প্রকাশ করে আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে তারা কোটি কোটি টাকা কামাই করে নিচ্ছেন।’ উনার কথায় আমি বইয়ের প্রথম দিকের পাতা উল্টালাম। ঠিকইতো প্রকাশক ‘জিনিয়াস পাবলিকেশন্স’-এর মো. হাবিবুর রহমান। দু’খানা বইয়েরই গ্রন্থনা ও সম্পাদনা মো. নজরুল ইসলাম, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার (সচিব)। খেয়াল করে দেখলাম বই দু’খানার কপিরাইট শেখ হাসিনা। বুঝতে পারি যে এই বইগুলোর যে রয়্যালিটি আসবে সেটা আমাদের প্রধানমন্ত্রীই পাবেন।

এখন একটা হিসাব করে দেখি। বাংলাদেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৬শ ২০টি। এই বই যখন প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে বাধ্যতামূলক কিনতেই হবে, তা হলে ৪ কপি করে বই বিক্রি হবে উল্লেখিত বিদ্যালয়গুলোতে ২ লাখ ৬২ হাজার ৪শ ৮০ কপি। এই বইয়ের মূল্য থেকে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের হাতে টাকা আসবে ১৫ কোটি ৭৪ লাখ ৮৮হাজার। বইয়ের কপিরাইট অনুযায়ী শতকরা ১৫ ভাগ রয়্যালিটি নিলেও আমাদের প্রধানমন্ত্রী পাবেন ২ কোটি ৩৬ লাখ ২৩ হাজার ২শ টাকা। হিসাবে কিন্তু আমার মাথা ঘুরে গেছে। বই থেকে এমন অঙ্কের রয়্যারিটি এদেশে আগে কেউ পেয়েছেন কি না আমি জানি না।

আর এটাতো আমি কেবল প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বিক্রির হিসাব দিলাম। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লাইব্রেরির জন্য যখন বাধ্যতামুলক করা হয়েছে, তবে তো উচ্চ বিদ্যালয়, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়েও এই বইগুলো এভাবেই বিক্রি হবে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যুক্ত করলে আরো কতো কতো হাজার বেড়ে যাবে। আমি হিসাব বাড়ালে অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারি।

আমার ঘরেও একজন প্রধান শিক্ষক আছেন। লেখাটার পূর্ণতার জন্য তার কাছে কিছু তথ্য জানতে চেয়েছিলাম। তিনি খ্যাক্ করে উঠে বললেন, ‘স্কুল আমি চালাই। আমার স্কুলের জন্য কখন কি ভাবে কি কিনবো না কিনবো সেটা তোমাকে বলবো কেনো?’ দেখলাম ঘাটাতে গেলে আবার কি থেকে কি হয়ে যায়। তাই কথা না বাড়িয়ে লেখা শেষ করার দিকেই মনোযোগ রাখলাম।

আমরা যারা লেখক আমাদের মধ্যে একটা কথা প্রচলিত আছে যে, প্রকাশকরা লেখকদের ঠকান। তারা ঠিক মতো লেখকের পাওনা রয়্যালিটি পরিশোধ করেন না। তাই বলে কি প্রধানমন্ত্রীকে ‘জিনিয়াস পাবলিকেশন্স’-এর মো. হাবিবুর রহমান ঠকানোর সাহস করবেন? নিশ্চয় না। এই ভরসাতেই বলতেই পারি বই বিক্রির অর্থে আমাদের লেখক শেখ হাসিনা কোটিপতি হবার পথে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, ছড়াকার

ইমেইল: [email protected]

;

দশ টাকার শোক



মনি হায়দার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

প্রায় পনেরো মিনিট ধরে মানিব্যাগটা উল্টেপাল্টে দ্যাখে রজব আলী।

মানিব্যাগটা খুব পছন্দ হয়েছে তার। বিশেষ করে মানিব্যাগটার বাদামি রংটা। ব্যাগটা চামড়ার তৈরি। রজব আলী নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শোকে। বোঝা যায় না কোন্ পশুর চামড়ায় মানিব্যাগটা তৈরি হয়েছে। মানিব্যাগটার ভেতরে অনেকগুলো ছোট ছোট কুঠরি। রজব আলী কল্পনায় দেখতে পায়- মানিব্যাগটার ভিতরে রাখা টাকায় ভেতরের কুঠুরিগুলো ভরে উঠেছে।

ব্যাগটা প্যান্টের পকেটে নিয়ে যখন হাঁটবে পিছটা ফুলে যাবে, মুহূর্তেই শরীরের কোষে কোষে একটা অন্যরকম অহমিকা অনুভব করে সে।

ভাই, মানিব্যাগটার দাম কতো ? রজব আলী মানিব্যাগঅলাকে জিজ্ঞেস করে।

ব্যাগঅলা রজব আলীর উপর মনে মনে চটে উঠেছে। সেই কতোক্ষণ থেকে ব্যাগটা উল্পেপাল্টে দেখছে। কেনার কথা বলছে না। অথচ রজব আলীর দেখার মধ্যে দুটো ব্যাগ সে বিক্রি করেছে। ফুটপাতের জিনিস এতক্ষণ নাড়াচাড়া কেউ করে না। ব্যাগঅলা রাগ করে কিছু বলতেও পারে না। যদি কেনে ?

আপনি নেবেন ? রজব আলীর দাম জিজ্ঞাসায় ব্যাগঅলা পাল্ট প্রশ্ন ছোড়ে। কারণ রজব আলীকে দেখে তার মনে হয় না এই লোক মানিব্যাগ কিনবে।

রজব আলী একটি বহুজাতিক কোম্পানির অফিসের পিওন। পরনের পোশাকে ঐ বহুজাতিক কোম্পানির পরিচয় আছে। ব্যাগঅলার ধারণা এইসব লোকজন সাধারণত মানিব্যাগ-ট্যাগ কেনে না। তাদের সামান্য টাকা আয়, কোনোভাবে সেই পয়সায় মানিব্যাগ কেনার মানসিকতা বা প্রয়োজনীয়তাও থাকে না।
নেবো।

ইতোমধ্যে ব্যাগঅলার সামনে দামি প্যান্টশার্ট পরা একজন ভদ্রলোক এসেছে। সঙ্গে তন্বী তরুণী। তাদের আসায় চারপাশের আবহাওয়ায় বিদেশী সেন্টের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। ভদ্রলোকের কাছে রজব আলী অযাচিতভাবে হেরে যায়। বাস্তবতার কারণে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়াতে হয় তাকে।

তন্বী তরুণী ও ভদ্রলোক মিলে কয়েকটা মানিব্যাগ দেখে। বাছাই করে। অবশেষে তন্বীয় কথানুযায়ী ভদ্রলোক তিনশো পঁচিশ টাকায় একটা মানিব্যাগ নিয়ে চলে গেলো। মাত্র তিন-চার মিনিটের মধ্যে তারা মানিব্যাগ দেখলো, দাম করলো, কিনলো এবং চলেও গেলো। অথচ রজব আলী বিশ-পঁচিশ মিনিচের মধ্যে মধ্যে দামটাও জানতে পারলো না ! তারা চলে যাওয়ার পর রজব আলী ব্যাগঅলার কাছে যায়।

বললেন না কতো দাম ?

রজব আলীর দিকে আড়চোখে তাকায়, মানিব্যাগ আপনার পছন্দ হয়েছে?

পছন্দ না হলে দাম জিজ্ঞেস করবো কেনো ?

একশো আশি টাকা।

একশো আশি টাকা। রজব আলী মুখ থেকে বিপন্ন শব্দগুলো বের হয়।

বিরক্তি প্রকাশ করে ব্যাগঅলা, অবাক হওয়ার কি আছে? আপনার সামনেই তো দেখলেন তিনশো পঁচিশ টাকায় একটা মানিব্যাগ বিক্রি করেছি। ঠিক আছে আপনি ঐ সোয়াশ টাকাই দেন।
সোয়াশ টাকা একটা মানিব্যাগের দাম ! রজব আলীর বিস্ময় কোনো বাঁধা মানে না।

ব্যাগঅলা বুঝতে পারে রজব আলী এতো টাকায় ব্যাগ কিনবে না। সবাইতো ঐ টাকাঅলা ভদ্রলোক নয়, বেশি দাম-দর না করেই তাদের হাকানো দামেই কিনবে। রজব আলীরা তো মানিব্যাগই কেনে না। সেখানে রজব আলী যে কিনতে এসেছে সেটাই অনেক। ব্যাগঅলা মানিব্যাগ বিক্রি করলেও তার পকেটে মানিব্যাগ থাকে না। নিজের সঙ্গে রজব আলীর সাদৃশ্য দেখতে পায় ব্যাগঅলা। একই কাতারের ঠেলা-গুতা খাওয়া মানুষ তারা। লোকটাকে ঠকিয়ে লাভ নেই। হয়তো অনেক আশা করে সারা জীবনে একবার একটা মানিব্যাগ কিনতে এসেছে।

আপনি সত্যিই কি মানিব্যাগটা কিনবেন ? নরম কণ্ঠে ব্যাগঅলা জানতে চায়।

কিনবো বলেই তো পছন্দ করেছি। দাম জানতে চাইছি।

তাহলে শোনেন ভাই, অনেক্ষণ ধরে আপনি মানিব্যাগটা দেখছেন, ফাইনাল কথা বলে দিচ্ছি, মানিব্যাগটা আপনি আশি টাকায় নিতে পারবেন। আশি টাকার এক টাকা কমেও বিক্রি করবো না।
রজব আলীর এই মুহূর্তে ব্যাগঅলাকে খুব কাছের মানুষ মনে হয়। কোথায় একশো আশি টাকা, সেখান থেকে একশত পঁচিশ এবং সবশেষে পুরো শতকই নেই; কেবল আশি টাকা। সে পকেট থেকে টাকা বের করে দিয়ে মানিব্যাগটা পকেটে রাখে। মানিব্যাগটা পকেটে রাখার সঙ্গে সঙ্গে রজব আলী নিজেকে একজন দামি মানুষ ভাবে। তার পকেটেও অনেকের মতো মানিব্যাগ আছে।

দীর্ঘদিনের একটা আকাক্ষা, একটা স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলো রজব আলীর। মানিব্যাগ কেনার একটা সিগারেট কেনে। সাধারণত সে সিগারেট টানে না। কিন্তু এই মুহূর্তে একটা সিগারেট টানার ইচ্ছে হলো তার। না, কেবল সিগারেটই নয়, একটা ঝাল দেওয়া পানও কিনলো এবং মুখে দিয়ে পরম আয়াসে চিবুতে লাগলো। সিগারেটটা ধরিয়ে পান চিবুতে চিবুতে রজব আলী একটা রিকশায় উঠলো। পর পর তিনটি কাজ সে করলো-যা সে খুবই কম করে। সিগারেট টানা, পান খাওয়া এবং রিকশায় করে বাসায় ফেরা। তার জীবনেএকটুকুই শ্রেষ্ঠ বিলাসিতা। রিকশা ছুটে চলেছে।

রজব আলীর মাথার কোষে, যেখানে স্বপ্ন বিলাসী বা ইচ্ছের রক্তকণিকা থাকে- সেখানে মানিব্যাগ কেনার শখ জাগলো প্রায় মাস তিনেক আগে। সে, অফিসের বড় সাহেবের ব্যক্তিগত পিওন। চা, চিনি, সিগারেট থেকে শুরু করে যা কিছু দরকার সবই আনে রজব আলী। দীর্ঘদিনের চাকরির কারণে সে বড় সাহেবের খুব বিশ্বস্ত ও অনুরাগী। অফিসে প্রতিদিন অনেক মেহমান আসে।

নানান কিসিমের মানুষের আনাগোনা বড় সাহেবের কাছে। এইসব মেহমান আসলেই বড় সাহেব বেল টিপে রুমের বাইরে হাতলবিহীন চেয়ারে অপেক্ষায় থাকা রজব আলীকে ডাকেন। রজব আলী ত্রস্ত খরগোশের মতো ভেতরে ঢোকে। কিন্তু ঢুকেই খরগোশের মতো মাথা উঁচু রাখতে পারে না। কোথাকার কোন এক অদৃশ্য অপরিমেয় শক্তি এসে তার মাথাটাকে নিচু করে দেয়।

তার দাঁড়ানো পর বড় সাহেব বড় অবহেলায়, নিপুণ নৈপুণ্যে, গাম্ভীর্যের কৌশলী পারম্পর্যে অবলীলায় প্যান্টের ডান দিক থেকে মোগল সম্রাটদের ক্ষমতায় মানিব্যাগটা বের করে টেবিলে রাখেন। মেহমানবৃন্দ গভীর অভিনিবেশে বড় সাহেবের কর্মকান্ড দেখতে থাকেন। মানিব্যাগটা টেবিলে রেখেই বড় সাহেব টেবিলের অন্যপ্রান্তে রাখা দামি সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে পরম আদরে রাখেন এবং তৎক্ষণাৎ লাইটার জ্বালিয়ে সিগারেট টানেন আয়েসের সঙ্গে।

সিগারেটে দু’-দিনটি টান দিয়ে দুই ঠোঁটের মাঝখানে আটকে রেখে মানিব্যাগটা তোলেন ডান হাতে। মানিব্যাগটা টাকার কারণে সবসময় পোয়াতি নারীর মতো ফুলে থাকে। বড় সাহেবের মানিব্যাগে টাকাগুলো অধস্তন, পরাধীনভাবে নিবিড় শুয়ে থাকতে পছন্দ করে। একহাজার, পাঁচশ, একশ, পঞ্চাশ টাকার অসংখ্য নোট সাজানো পাশাপাশি। দেখতে কতো ভালো লাগে ! রজব আলী দেখে। দেখেই তার আনন্দ।

বাম হাতে মানিব্যাগটা ধরে ডান হাতের দুই আঙ্গুলে বড় সাহেব বেশ কয়েকটা নোট বের করেন। একটা নোট রজব আলীর দিকে বাড়িয়ে দেন, শীগগির নাস্তা নিয়ে আয়।

রজব আলী বিনয়ের সঙ্গে টাকাটা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। এবং নাস্তার আয়োজনে নিদারুণভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এইভাবেই রুটিন চলছিলো। হঠাৎ মাস তিনেক আগে রজব আলীর মাথায় এই প্রশ্নটা উঁকি দেয়- বড় সাহেবের গাড়ি বাড়ি টাকা মান-সম্মান ক্ষমতা আছে। রজব আলীর কিছুই নেই। কিন্তু একটা মানিব্যাগতো থাকতে পারে। আর যাই হোক বড় সাহেবের মতো মানিব্যাগ থেকে সেও টাকা বের করে বাস কন্ডাকটর, চালের দোকানদার, মাছঅলা, ডালঅলাদের দিতে পারবে।

এই ভাবনা, স্বপ্ন এবং কল্পনার পথ ধরে কয়েকমাস যাবৎ রজব আলী চেষ্টা করে আসছে একটা মানিব্যাগ কেনার। নানা কারণে হয়ে ওঠেনি। বৌয়ের শরীর খারাপ- ডাক্তারের টাকা দেওয়া, ছেলেমেয়েদের স্কুলের বেতন, বই খাতা কেনা- যাবতীয় সাংসারিক কাজের চাপে মানিব্যাগ কেনা সম্ভব হয়নি। আজকে সে বেতন পেয়েছে। এবং সমস্ত চাপ উপেক্ষা করে রজব আলী মানিব্যাগটা কিনেই ফেললো। আসলে কখনো কখনো একটু-আধটু রিস্ক নিতেই হয়। নইলে ছোটখাট স্বাদ-আহ্লাদ পূরণ হবার নয়।

রিকশায় বসেই সে জামার বুক পকেট থেকে বেতনের বাকি টাকাগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে মানিব্যাগে। মানিব্যাগটার পেট ফুলে যায়। হাতে নিয়ে তার দারুণ ভালো লাগে। কিছুক্ষণ হাতে রাখার পর রজব আলী মানিব্যাগটাকে পিছনে প্যান্টের পকেটে রাখে। ঘাড় ঘুরিয়ে সে প্যান্টের পিছন দিকটা ফিরে ফিরে দ্যাখে- কতোটা ফুলে উঠলো ? তেমন না। যেভাবে বড় সাহেবের পিছন দিকটা ফুলে থাকে, সে রকম নয়। রজব আলীর মনটা খারাপ হয়ে গেলো।

রিকশা বাসার কাছে আসলে সে ভাড়া মিটিয়ে নেমে যায়। তার মনের মধ্যে ছোট সুখের একটা ছোট পাখি ডানা মেলেছে। গানের সুর ভাজতে ভাজতে রজব আলী দেড় কামরার স্যাঁতস্যাঁতে বাসায় ঢোকে। সে ঢুকলো সংসারে, তাতে সংসারের কিছু যায় আসে না। সংসারটা তার কাছে সীমাহীন অন্ধগলির মোড়। যেখানে অভাব দারিদ্র ক্ষুধার চাহিদা কুমিরের হা মেলে থাকে, সেখানে তার মতো একজন রজব আলীর আসা না আসায় কিছুই যায় আসে না। রজব আলী স্ত্রী মকবুলা বেগম চতুর্থ সন্তান, যার বয়স মাত্র তিনমাস তাকে মাই খাওয়াচ্ছে।

অন্যান্যরা মেঝেতে জটলা পাকাচ্ছে একটা পুরোনো ক্যারামের গুটি নিয়ে। মকুবলা বেগম ঘাড় ফিরিয়ে রজব আলীকে একবার দেখে আবার মাই দিতে থাকে। রজব আলী কি করবে ভেবে পায় না। সাধারণত বেতন নিয়ে বাসায় ফিরলে তরিতরকারি, চাল, ডাল, লবণ, তেল, সাবান, দুই এক প্যাকেট সস্তা বিস্কুট সঙ্গে নিয়ে আসে রজব আলী। আজকে একবারে অন্যরকম একটা জিনিস এসেছে- যার প্রতি তার নিজের মমতা অনেক। সংসারে অন্যদের প্রতিক্রিয়া কি হবে বুঝতে পারছে না।

শুনছো ? রজব আলী স্ত্রীকে ডাকছে।

কনিষ্ঠতম সন্তানের মুখ থেকে মাই সরাতে সরাতে সাড়া দেয় মকবুলা বেগম, কি ?

একটা জিনিস এনেছি।

মকবুলা বেগম সরাসরি তাকায় রজব আলীর দিকে, কি এনেছো ?

অদ্ভুত একটা হাসি রজব আলীল ঠোঁটে, একটা মানিব্যাগ।

দ্রুত ব্যাগটা বের করে মকবুলা বেগমের হাতে দেয় রজব আলী। ব্যাগটা হাতে নিয়ে কয়েক মুহূর্ত স্থানুর মতো বসে থাকে মকবুলা বেগম। একবার কোটরের চোখ দিয়ে তাকায় রজব আলীর দিকে। দৃষ্টি ফিরিয়েই ব্যাগটা অবহেলায় রেখে দেয় সে, মানিব্যাগ ফুটাতে কে বলেছে তোমাকে! বেতন পেয়েছো আজ না ?

বেতন পেলে আর মাথা ঠিক থাকে না। মকবুলা বেগমের লং প্লে রেকর্ড বাজা আরম্ভ হলো, বাসায় কিছু নাই। অফিসে যাবার সময় বললাম, ফিরে আসার সময় ছোট বাচ্চাটার জন্য এক কৌটা দুধ এনো। বড় ছেলেটার খাতা পেন্সিল নেই- নিয়ে এসো। তার কোনো খবর নেই। উনি নিয়ে এলেন মানিব্যাগ। ছেলেমেয়ে বৌয়ের মুখে তিন বেলা ভাত জোটাতে পারে না, উনি মানিব্যাগ কিনে ভদ্দরলোক হয়েছেন! কানার আবার স্বপ্ন দেখার শখ!

রজব আলীর মন শরীর স্বপ্ন আকাক্ষাগুলো শাঁখের করাতে কাটছে এখন। হায়, সংসারের জন্য ব্যক্তিগত দুই-একটা স্বপ্নও কি পূরণ করা যাবে না ! সকাল থেকে রাত পর্যন্ততো সংসারের সুখের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। সামান্য একটা মানিব্যাগের জন্য স্ত্রী এমনভাবে শ্লেষের কথা বলে-একেক সময় মনে হয় রজব আলী আত্মহত্যা করে। পারে না।

স্ত্রীর শান দেওয়া কথার বান থেকে আপাতত রক্ষা পাবার জন্য না খেয়ে বাইরে চলে আসে রজব আলী। এভাবেই সে অক্ষমতার জ্বালা, বেদনা ও ক্ষরণকে তাড়িয়ে থাকার চেষ্টা করে। রাস্তায় দোকানে এখানে সেখানে ঘন্টাখানেক ঘোরাঘুরি করে আবার মকবুলা বেগমের সংসারেই ফিরে আসে। পরের দিন রজব আলী যথারীতি অফিসে।

অফিসের লোকজনের কাছে মানিব্যাগটা দেখায়। কেউ দেখে, কেউ আগ্রহবোধ করে না।

বল তো বারেক, অফিসের আরেকজন পিওনকে ডেকে জিজ্ঞেস করে রজব আলী- মানিব্যাগটা কেমন হয়েছে ?

বারেক মানিব্যাগটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে- ভালো। খুব ভালো হয়েছে। কতো টাকায় কিনেছো ?
প্রচ্ছন্ন গর্ব রজব আলীর, তুই বল।

আমি কেমনে বলবো ?
অনুমানে।
বারেক কয়েক মুহূর্ত ভেবে বলে, ত্রিশ-চল্লিশ টাকা।

তোর বাপের মাথা! ধমকে ওঠে রজব আলী। এ রকম একটা মানিব্যাগ জীবনে চোখে দেখেছিস ? কেমন রং এটার ! ভেতরে কতোগুলো ঘর আছে জানিস ! একহাজার, পাঁচশ, একশো, পঞ্চাশ টাকার নোট রাখার আলাদা আলাদা জায়গা আছে। তাছাড়া এই ব্যাগটা বিদেশী। দেশী না।

তোমার মানিব্যাগের যতো দামই থাক, তুমি বাপ তুলে কথা বলবে ? বারেকের আত্মসম্মানে সামান্য ঘা লাগে।

বলবো না, হাজার বার বলবো। এতো শখ করে একশ টাকা দিয়ে একটা মানিব্যাগ কিনলাম। আর তুই কিনা বলিস মাত্র ত্রিশ-চল্লিশ টাকায় কিনেছি ! জানিস, এই রকম মানিব্যাগ আছে আমাদের বড় সাহেবের।

হতেই পারে। আমার তো মানিব্যাগ নেই। কখনো ছিলোও না। তাই দাম জানি না। কিন্ত তুমি একটা একশো টাকা মানিব্যাগে জন্য বাবা তুলে কথা বলতে পারো না-

বারেক যখন মানিব্যাগ সংক্রান্ত তর্কে হেরে যাচ্ছিলো, তখনই বড় সাহেব অফিসে ঢোকেন সঙ্গে কয়েকজন বন্ধু মেহমান নিয়ে। বারেক চট্ করে সরে যায়। রজব আলী দ্রুত দরজা খুলে দাঁড়ায়। বড় সাহেব সঙ্গীদের নিয়ে রুমে ঢোকেন। রজব আলীকে চা আনতে বলেন বড় সাহেব। শুরু হয় রজব আলীর দৌড়।

কয়েকদিন পর বড় সাহেব অফিসে কয়েকজন ক্লায়েন্টের সামনে বসে রজব আলীকে ডাকেন, রজব আলী?

জ্বী স্যার ?
তোমার হয়েছে কি ?

রজব আলী ভেবে পায় না তার কোথায় কখন কি হয়েছে ? ডানে বামে উপরে নিচে তাকায় সে, কই স্যার-কিছু হয় নাইতো।
তোমার হাতে মানিব্যাগ কেনো ?

এই কথার কি জবাব দেবে রজব আলী? হঠাৎ মগজের কোষ কোনো কাজ করে না। সে বুঝে উঠতে পারে না- তার হাতে মানিব্যাগ থাকলে বড় সাহেবের অসুবিধা কি ? কক্ষের সবাই রজব আলীর দিকে চেয়ে আছে। এক অনিশ্চয়তার মুখোমুখি। হঠাৎ রজব আলী উপলব্ধি করতে পারে- মানিব্যাগটা থাকার কথা প্যান্টের পকেটে। হাতে নয়। এবং তার আরো মনে পড়লো মানিব্যাগটা কেনার পর থেকে, বিশেষ করে অফিস করার সময় মানিব্যাগটা কারণে-অকারণে তার হাতেই থাকে। কেন থাকে ?

সে কি সবাইকে তার সদ্য কেনা মানিব্যাগটি দেখিয়ে তৃপ্তি পেতে চায় ? যা প্রকারান্তরে অক্ষম অথর্ব মানুষের করুণ মনোবিকৃতি ? নিশ্চয়ই তার অবস্থা দেখে বড় সাহেব, তার পরিষদবর্গ, অফিসের লোকজন হাসছে। রজব আলী নিমিষে নিজেকে বায়ুশূন্য ফাটা একটা পরিত্যাক্ত বেলুন হিসাবে নিজেকে আবিষ্কার করে। লজ্জায় বালুর সঙ্গে সে মিশে যেতে চাইছে। কিন্তু মানুষের পক্ষে মুশকিল হচ্ছে- সে ইচ্ছে করলেই বালু বা বায়ুর সঙ্গে মিশে যেতে পারে না। মানুষ হিসাবে তাকে অনড় ও অবিচল থাকতে হয়।

বড় সাহেবের মুখে অদ্ভুত হাসি- রজব ?

জ্বী স্যার ?
মানিব্যাগটা কবে কিনেছো ?

রজব আলী জবাব দেয় না। দিতে পারে না। ভেতরের কে একজন যেন রজব আলীকে থামিয়ে দিয়েছে। যে রজব আলীর ওষ্ঠ জিহ্বা কণ্ঠ ভেতরের ক্ষুধিত শক্তিকে পাথর বানিয়ে জমাট করে রেখেছে। প্রাণপণে চেষ্টা করছে কথা বলতে। পারছে না। সে মাথাটা নিচু করে দাঁড়িয়ে। কথা বলছো না কেন ? বড় সাহেবের কণ্ঠে এখন কর্তৃত্ব ও অপমানের সুর।

ঢোক গিলে জবাব দেয় রজব আলী- কয়েক দিন আগে।

কতো টাকায় ?

একশ টাকা।

তাই নাকি ! দেখি, বড় সাহেব হাত বাড়ান।

রজব আলী সারা জীবনের সমস্ত অভিশাপ নিজের মাথায় ঢালে-কেন সে মানিব্যাগ কিনতে গেলো ? কিনলোই যদি তাহলে পকেটে না রেখে হাতে রাখার প্রয়োজন হলো কেন ? দেখাতে চেয়েছিলো বড় সাহেবকে ? বড় সাহেবের মানিব্যাগ থাকলে পারলে তার থাকবে না কেন ? প্রতিযোগিতা ? কি অসম প্রতিযোগিতা ? কি ভয়ংকর গ্লানিকর পরাজয় !

কই দাও, বড় সাহেবের হাতটা তখনো বাড়ানো। নিন।

রজব আলী ব্যাগটা দিয়ে বেরিয়ে যেতে চায়।

কোথায় যাও? তোমার মানিব্যাগ নিয়ে যাও-

আর যেতে পারে না সে কক্ষের বাইরে। কক্ষের ভিতরে রজব আলীর শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। বড় সাহেব মানিব্যাগটাকে উল্টেপাল্টে দেখেন। কক্ষের অন্যান্য সবাই বড় সাহেবের হাতের ব্যাগটাকে তীর্যক চোখে দেখছে। কেউ কেউ হাসছে। সে হাসির ভেতরে লুকিয়ে আছে তীক্ষ্ন কাঁটা। কাঁটায় বিষ। যা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পান করছে রজব আলী। এছাড়া তার উপায়ও নেই।

রজব আলী !

বড় সাহেবের ডাকে চোখ তুলে তাকায় সে, স্যার!

নাও তোমার মানিব্যাগ। ব্যাগটা ভালোই কিনেছো।

হাত বাড়িয়ে ব্যাগটি নিয়ে রজব আলী দরজা খুলে নিমিষে বাইরে চলে আসে। দরজা দ্বিতীয়বার বন্ধ করতে পারে না, তার আগেই বড় সাহেব এবং অন্যান্যদের হাসির ছুরি তীব্র অপমানে রজব আলীর কান এবং মর্মের মূলে আঘাত হানে। মনে হচ্ছে তাদের হাসির হলকা তাকে শান দেয়া ছুরির মতো কাটছে। আর রজব আলী নিজের রক্তে ভেসে যাচ্ছে।

রজব আলী মানিব্যাগ আর হাতে রাখে না। প্যান্টের পকেটেই রাখে। মাস শেষে মানিব্যাগের ছোট্ট খোপে খুচরো কয়েকটা মাত্র টাকা দেখতে পায় রজব আলী। মানিব্যাগে টাকা নেই, একটা পরিত্যাক্ত রুমালের মতো মনে হয় মানিব্যাগটাকে। এবং রজব আলী বুঝতে পারে- বড় সাহেবের মতো মানুষদের সঙ্গে রজব আলীরা কোনদিন, কোনোকালে পাল্লা দিয়ে টিকতে পারবে না।

মাস শেষ, রজব আলীর মানিব্যাগের টাকাও শেষ। অথচ বড় সাহেবের মানিব্যাগে মাসের প্রথম দিকে যতো টাকা ছিলো বা থাকে, এখনো সে রকমই আছে। কমে না। বরং বাড়ে। তাহাদের টাকা বাড়তেই থাকে। বাড়বে আমৃতকাল।

দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ে রজব আলী।

দীর্ঘনিঃশ্বাস এবং পুঞ্জিভূত ক্ষোভ নিয়ে নিত্যদিনের স্বাভাবিক জীবনযাপন চালিয়ে যাচ্ছে রজব আলী। প্রতিদিনের জীবনাচারের সঙ্গে রজব আলী বেশ মানিয়ে নিয়েছে। মানিব্যাগটা তার সঙ্গে থাকছে প্রতিদিনকার মতো- যেমন তার পকেটে থাকছে একটি রুমাল, একটি চিরুনি।

মাসের প্রথম দিকে মানিব্যাগটা ভরা থাকে, মাঝখানের দিকে কমতে কমতে টাকা অর্ধেকেরও কমে এসে পৌঁছে এবং এই কমার গতিটা বলবৎ থাকে গাণিতিক হারে।

মাসের শেষের দিকে রজব আলী মানিব্যাগ বহন করার আর কোন যুক্তি খুঁজে পায় না। কারণ ব্যাগের তলায় পাঁচ-দশটা টাকা পড়ে থাকে বড় অযত্নে, বড় অবহেলায়। কখনো কখনো রজব আলীর মনে হয়- মানিব্যাগটা বোধহয় তাকেই উপহাস করছে। মাস খানেক পরে একদিন।

রজব আলী অফিস থেকে ফিরছে। মাস শেষের দিকে। বাসে প্রচুর ভিড়। বাসে ওঠা মানে জন্তুর খাঁচায় ওঠা। জীবন যে কতো অবাঞ্ছিত, বাসে উঠেই সেটা বুঝতে পারে রজব আলী।

বাস থেকে নেমেই হাত দেয় প্যান্টের পকেটে। পকেটটা খালি, বুকটা ধড়াস ধড়াস করে, মানিব্যাগটা নেই ! এতো সাবধানে থাকার পরও মানিব্যাগটা নিয়ে গেলো?

রজব আলী কয়েক মুহূর্ত স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। মানিব্যাগটা পকেটমার নিয়ে গ্যাছে। রজব আলী মানিব্যাগটার জন্য ভাবছে না। ভাবছে মানিব্যাগের সর্বশেষ পুরোনো ময়লা দশটি টাকা...। ওই দশ টাকা থাকলে আরো দুই দিন বাস ভাড়া দিয়ে অফিসে আসা-যাওয়া করতে পারতাম।

;